এলোমেলো বেড়ানো: ধারাবাহিক অষ্টম পর্ব
©অমিতাভ রায়, ১৯৭৯ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আগের পর্ব পড়তে হলে, লিংক
Mitaoli Chausath Yogini Temple
মিটাওলি
একশো বছরেরও আগে ১৯২১-এর ১২ ফেব্রুয়ারি গ্রেট ব্রিটেনের ডিউক অফ্ কনট ভারতের বর্তমান সংসদ ভবনের শিলান্যাস করেছিলেন। তখন অবিশ্যি নাম ছিল কাউন্সিল হাউস্। পরিকল্পনা আগেই হয়েছিল। ১৯১১-য় কলকাতা থেকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তের সময়ই ঠিক হয়ে যায় যে, অচিরেই দিল্লিতে গড়ে তোলা হবে এক নতুন শহর। সেই উদ্দেশ্যে ১৯১২-র ফেব্রুয়ারিতে গঠিত হল তিন সদস্যের টাউন প্ল্যানিং কমিটি। লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান জর্জ সুইন্টন, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার জন আলেকজান্ডার ব্রডি এবং স্থপতি এডউইন ল্যান্ডসির লুটিয়েন্স হলেন টাউন প্ল্যানিং কমিটির সদস্য। ১৯১২-র ২৮ মার্চ তিনজনকে নিয়ে তখনকার বোম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে জাহাজ রওনা দিল।
ভারতে আসার আগে রাজা পঞ্চম জর্জ কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি এবং রানি যে জায়গায় নতুন শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে এসেছেন সেখানেই শহর গড়তে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ‘রিজ্’ বা জঙ্গলে ঘেরা উঁচুনিচু পাথুরে এলাকা পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।
জর্জ সুইন্টন এর আগেও ভারতে এসেছেন। বাকি দুজনের ভারত সম্পর্কে তখন কোনও ধারণাই নেই। এপ্রিলের তীব্র গরমে দিল্লিতে পদার্পণ করার পর তাঁদের প্রাথমিক কাজ হল নতুন শহরের জায়গা নির্বাচন। সে কি চাট্টিখানি কথা! তবুও তাঁরা হাল ছাড়েননি। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুখেচোখে জল দিয়ে কোনওরকমে এক কাপ চা শেষ করেই শুরু হয়ে যেত তাঁদের দৈনন্দিন কর্মসূচি।
শাহ্জাহানাবাদ বাদ দিয়ে পুরো এলাকাটাই এবড়োখেবড়ো পাথুরে মাটির উপর বেড়ে ওঠা গাছপালার জঙ্গল। সেই জঙ্গলাকীর্ণ ভূমিতে আবার নানারকম জন্তুজানোয়ারের সমাবেশ। কাজেই, কখনও মোটর গাড়ি কখনও আবার হাতির পিঠে চড়ে চলতে থাকে স্থান সমীক্ষা। রবিরশ্মির তীব্রতা অসহনীয় হয়ে ওঠার আগেই এখনকার জনপথ-এ অবস্থিত ইম্পিরিয়াল হোটেলে প্রত্যাবর্তন। এটাই সে যুগের দিল্লির সেরা হোটেল। রাজা-আমলারা দিল্লি এলে এখানেই থাকতেন। যে কারণে আজও ইম্পিরিয়াল হোটেলের একটি কফি শপের নাম ‘১৯১১’।
ব্রিটিশ আমলে দিল্লির ইম্পিরিয়াল হোটেল
রাজা-রানি যেখানে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গেছেন প্রথমেই সেই করোনেশন পার্ক এলাকা বাতিল করা হল। এখনকার আউটার রিং রোড ধরে রোহিনী বা সোনিপতের দিকে গেলে তিমারপুর আর জাহাঙ্গীরপুরীর মাঝামাঝি রাস্তার বাঁ পাশে একটা নীচু জমির উপর সেই ১৯১১-য় রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি জাঁকজমক করে স্থাপন করেছিলেন নতুন শহরের ভিত্তিপ্রস্তর। জায়গাটাকে ব্যবহার-উপযোগী করে তুলতে প্রচুর খরচ। তার উপরে যমুনা নদীর কাছাকাছি এর অবস্থান। যমুনার চরিত্র বোঝা মোটেও সহজ কাজ নয়। নদীর উজানে ভারী বর্ষণ হলে শাহ্জাহানাবাদের উত্তরের দুই পাড় জলে ডুবে যায়। যমুনার পূর্ব পাড়ের জমিও একই কারণে খারিজ করতে হল।
যে কোনও জায়গায় তো আর নতুন শহর স্থাপন করা যায় না। জল সরবরাহ, নিকাশি ব্যবস্থা, রেল ও সড়ক পরিবহণ ইত্যাদি বিষয়ে নজর না রাখলেই নয়। তা-ও তো তখন বিমানের যুগ শুরু হয়নি।
শেষ পর্যন্ত কয়েক মাস বাদে সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত হল মালচা-র রিজ্-এর পূর্ব দিকের ঢালে গড়ে উঠবে ভারতবর্ষের নতুন রাজধানী। রাইসিনা হিলসের উপর উঁচু জমিতে নির্মিত হবে ভাইসরয় হাউস অর্থাৎ এখনকার রাষ্ট্রপতি ভবন। ইতিমধ্যে লুটিয়েন্সের পরামর্শে ভারতের নতুন রাজধানী নির্মাণের প্রকল্পে যোগ দিলেন প্রখ্যাত স্থপতি হারবার্ট বেকার। তিনি তখন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় ইউনিয়ন বিল্ডিংস্ নির্মাণের কাজে ব্যস্ত। সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী দক্ষিণ আফ্রিকার কাজ অসমাপ্ত রেখেই ভারতে এলেন লুটিয়েন্সের বন্ধু হারবার্ট বেকার। হারবার্ট বেকারকে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে খুশি হলেন লুটিয়েন্স।
কর্মজীবনের সূচনাপর্বে তাঁরা একই সংস্থায় কাজ করতেন। তারপর লুটিয়েন্স ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বসতবাড়ি, বাংলো, গির্জা ইত্যাদি নির্মাণের কাজে জড়িয়ে পড়েন। আর বেকার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ উপনিবেশে গড়ে তুলতে শুরু করেন সরকারি ভবন, প্রাসাদ ইত্যাদি। সবমিলিয়ে বেকারের অভিজ্ঞতা ছিল অনেক বিস্তৃত। তবুও সরকারের আনুকূল্যে এবং টাউন প্ল্যানিং কমিটির সদস্য হিসেবে ভারতের নতুন রাজধানী গড়ে তোলার সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব পেলেন লুটিয়েন্স।
রাজা পঞ্চম জর্জ
টাউন প্ল্যানিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়া হল। গভর্নমেন্ট হাউস (পরে ভাইসরয় হাউস হয়ে এখনকার রাষ্ট্রপতি ভবন), ওয়ার মেমোরিয়াল আর্চ (ইন্ডিয়া গেট) এবং পাবলিক রেকর্ডস অফিসের (এখনকার ন্যাশনাল আর্কাইভস ভবন) নকশা প্রণয়ন এবং রূপায়ণের দায়িত্ব নিলেন লুটিয়েন্স। আর বেকার পেলেন সেক্রেটারিয়েট (এখনকার নর্থ ও সাউথ ব্লক) এবং কাউন্সিল হাউসের (বর্তমান সংসদ ভবন) নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণের কাজ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজের সুবাদে হারবার্ট বেকারের দৃষ্টিভঙ্গি উদার এবং সুদূরপ্রসারী হওয়ায় ভারতীয় স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি আগ্রহী। বিভিন্ন দেশিয় রাজাদের প্রাসাদ দেখে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে রাইসিনা হিলসের ঢালের উপর নর্থ ও সাউথ ব্লক নির্মাণের পরিকল্পনা করলেন। ভারতীয় স্থাপত্যশৈলী বজায় রেখে নকশা প্রণয়ন করা হল। লুটিয়েন্স প্রথমে সেই নকশা পছন্দ না করলেও বেকারের যুক্তি মেনে নেন। কাউন্সিল হাউস বা এখনকার সংসদ ভবনের নকশা প্রণয়নের সময় মুশকিল হল। লুটিয়েন্সের প্রস্তাব অনুযায়ী ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুকরণে ভারতীয় সংসদ ভবনের নকশা ছকতে বেকার রাজি নন। তিনি ভারতের প্রচলিত স্থাপত্যশৈলী অনুসারে নকশা প্রণয়ন করতে আগ্রহী। অনেক দৌড়ঝাঁপ করে হারবার্ট বেকার খুঁজে পেলেন তাঁর মনের মতো নকশার ভাবনা। কোথায়?
তখনকার সেন্ট্রাল প্রভিন্স অথবা এখনকার মধ্যপ্রদেশে তো তখন রাজরাজড়ার ছড়াছড়ি। রাজপ্রাসাদেরও অভাব নেই। রয়েছে অসংখ্য মন্দির। স্থাপত্যশৈলীর কত না বিন্যাস! পথ পরিক্রমায় নেমে হারবার্ট বেকার পৌঁছে গেলেন গোয়ালিয়র। সিন্ধিয়াদের জয়বিলাস রাজপ্রাসাদ দেখে তো তিনি অভিভূত। এখানেই পেলেন চৌষট্ট যোগিনীর মন্দিরের খবর। শহর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে চম্বল উপত্যকার মোরেনা জেলার মিটাওলি গ্রামের এক টিলার উপর অবস্থিত ‘চৌষট্ট যোগিনীর মন্দির’। এ এক অনবদ্য স্থাপত্য। মন্দির চত্ত্বর পুরো গোলাকার। একটাই প্রবেশ পথ। সেই দরজা দিয়েই বেরিয়ে আসতে হয়। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে অলিন্দ ধরে বামপন্থা অবলম্বন করে চক্রাকারে পদচারণা শুরু করলে আবার সদর দরজায় ফিরে আসতেই হবে। দক্ষিণাবর্ত বেছে নিলেও একই পরিস্থিতি। মন্দির চত্ত্বরের ব্যাসার্ধ ৫৭ মিটার। কাজেই অঙ্কের নিয়মে অলিন্দের দৈর্ঘ্য ৩৫৮ মিটার। বৃত্তাকার প্রাঙ্গণের পরিধি ধরে গড়ে তোলা ঢালাও বারান্দায় একের পর এক সাজানো রয়েছে চৌষট্টিটি ছোটো ছোটো কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে রয়েছে এক একটি পাথরের মূর্তি। মূর্তিগুলির ভগ্নদশা দেখে এখন বোঝা যায় না যে, এগুলো আদতে কার মূর্তি। তবে লোকে বলে যে, এগুলি যোগিনী মূর্তি। পাথরের তৈরি স্তম্ভ ধরে রেখেছে কক্ষ এবং অলিন্দের ছাদ। অলিন্দের অন্য পাশে রয়েছে মন্দিরের চবুতরা। আর বৃত্তাকার প্রাঙ্গণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি স্বতন্ত্র বৃত্তাকার ছোটো মন্দির। পাথরের প্রাঙ্গণ পায়ে পায়ে হেঁটে বৃত্তের কেন্দ্রের বৃত্তাকার মন্দিরে পৌঁছে গেলেই বোঝা যায় যে, এটি আসলে শিবমন্দির। পাথরের শিবলিঙ্গ বিরাজমান, এবং ভগ্নদশা নয়। মন্দিরের দেওয়ালে খচিত ১৩২৩-এর এক শিলালিপি থেকে পাঠোদ্ধার করে পুরাতত্ত্ব বিশারদরা জানিয়েছেন, ১০৫৫ থেকে ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি রাজা দেবপাল এই এলাকার শাসক ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই জ্যোতিষশাস্ত্র এবং গণিতচর্চার জন্য এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। ইতিহাস অথবা পুরাতত্ত্ব যাই বলুক না কেন, এখন কিন্তু মন্দিরটি ‘সংসদ মন্দির’ নামেই সুপরিচিত। প্রচলিত ধারণা, এই মন্দিরের ছক সামনে রেখেই হারবার্ট বেকার প্রণয়ন করেন তখনকার কাউন্সিল হাউস অর্থাৎ এখনকার ভারতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশা। ওড়িশাতেও একটি ‘চৌষট্ট যোগিনীর মন্দির’ রয়েছে। তবে হারবার্ট বেকার সেখানে গিয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি।
মিটাওলির মন্দিরের ব্যাসার্ধ ৫৭ মিটার আর বর্তমান সংসদ ভবনের ব্যাস ৫৭০ মিটার। অঙ্কের হিসেবেও কোথায় যেন একটা মিল রয়েছে। সংসদ ভবনের একতলায় বৃত্তাকার করিডর। আর দোতলায় ১৪৪টি স্তম্ভ ধরে রেখেছে বৃত্তাকার দালান। শিল্যান্যাসের ছয় বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯২৭-এ বর্তমান সংসদ ভবনের উদ্বোধন হয়। আয়োজিত হয়েছিল লেজিস্লেটিভ অ্যাসেম্বলির অধিবেশন।
তথ্যসূত্র-
Irving: ∗Indian Summer∗: Lutyens Baker & Imperial Delhi (paper): Lutyens, Baker and Imperial Delhi
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, The Wire, Britannica, Parliament of India,
লেখক অমিতাভ রায়
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।
Add comment