সাহিত্যিকা

স্বর্গত অরুণ কুমার চক্রবর্তী স্মরণে

স্বর্গত অরুণ কুমার চক্রবর্তী স্মরণে
সুদীপ রায়, ১৯৭০, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
অজয় দেবনাথ, ১৯৭০ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

অরুণ কুমার চক্রবর্তীর একটি কবিতা
*|| রবিঠাকুর, পেন্নাম হই ||*

অ রবি ঠাকুর হে
তুকে ই বোশেখে গেরামে লিয়ে যাব।
শহর তুকে লাচায় কোঁদায়
বিরিজ বানিয়ে শোয়া করায়
রাস্তা বানিয়ে রোদে পুড়ায়
সি যাতনা আর না সহিব।
তুকে ই বোশেখে গেরামে লিয়ে যাব।

গেরাম তুমার লাইগবেক ভাল-অ
মানুষ মুরা কাল-অ কাল-অ
মাটির উঠান ঘরকে চল-অ
শহর পানে আর যেইতে না দিব
অ কবি ঠাকুর হে
তুকে ই বোশেখে গেরামে লিয়ে যাব।

তুকে সাহস দিব, পিরিত দিব
কাঁঠালপিঁড়ি পেইতে দিব
ঘিজিঙঘিনা মাদল দিব
করম ফুলের মালা দিব,
ঠাকুর, পেন্নাম হই,
কুনো কথা আর না শুইনব-অ
অ কবিঠাকুর হে
তুকে ই বোশেখে ঘরকে লিয়ে যাব।

স্কেচ – অজয় দেবনাথ, ১৯৭০ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

‘হিতাক তারে মানাইতনা রে’
সুদীপ রায়

কখন তিনি কোথায় থাকেন,
কখন লেখেন কখন আঁকেন,
কাউকে অরুণ জানাইতনারে।
অরুণকে এই শহরজীবন,
এমন জীবন, এমন ত্বরণ,
ইক্কেবারে মানাইতনারে।
এখন যখন নেই সে অরুণ
এই জগতের বাসে,
তখন আমার মনের ভিতর
একটি কথাই আসে।
পাগলা অরুণ যা রে যা,
লালপাহাড়ির দেশে যা,
রাঙামাটীর দেশে যা,
শাল মহুয়ার দেশে যা,
বাউলা অরুণ যা রে যা,
মাদল বাঁশির দেশে যা,
অরুণ পাখি যা উড়ে যা,
যা উড়ে যা, যা উড়ে যা রে।
হিতাক তোকে মানাইতনা রে।
ইক্কেবারে মানাইতনা রে।

স্বপ্ন ছিল দিলবাহার,
রাঙামাটি, লালপাহাড়,
কবি অরুণ সেই দেশে,
পৌঁছে গেলেন সবশেষে।
সেথায় উনি মানিয়ে গেছেন অক্লেশে।
জোছনা, আকাশ, মেঘ, বাদল,
হাড়িয়া ভাঁড়, বোল মাদল,
অরুণ কবি গাইছে সেথায় উল্লাসে।

********

এর পরের অংশটুকু সংগৃহীত

প্রয়াত কবি ও গীতিকার অরুন কুমার চক্রবর্তী। বয়স হয়েছিলো ৭৮ বছর। ৫০ বছর ধরে আজও বাংলা-বাঙালির হৃদয়জুড়ে অরুণ চক্রবর্তীর ‘লাল পাহাড়ির দেশে’। একটা লোকগান (Folk Song) সমান জনপ্রিয় হয়ে ৫০ বছর পথ হেঁটে এল, এটা খুব সহজ কথা নয়। আমাদের জীবন আমাদের অস্তিত্ব প্রতি মুহূর্তে হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে বেমানান হয়ে পড়ে, আমরা যে যার আপাত স্বস্থানে যেমন অত্যন্ত বেমানান। সেসব বিভ্রান্তির মুহূর্তগুলোয় জীবন যেন প্রশ্ন করে বসে, ‘তুই ইখানে কেনে, হেথাক তুকে মানাইছে নাই গো, ইক্কেবারেই…’।

অরুণ চক্রবর্তী। আপনভোলা। স্বভাব বাউল ছিলেন। বরাবরই স্কুলে প্রথম। পেশায় উঁচু পদমর্যাদার ইঞ্জিয়ার ছিলেন। তাঁর বন্ধুরা ফুলওয়ালা, ফলওয়ালা, টিটি, কুলি, পুলিশ অফিসার, জি আর পি, মাস্টারমশাই, মদওয়ালা, আশ্রমিক, বাউল, চাষি, কবি, মাছওয়ালা, সন্ন্যাসী, মাতাল, চোর, আপাত পাগলের দল। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে বেড়িয়ে পড়তেন এদিক-ওদিক। বিভিন্ন বাউলের আখড়ায়, লাল মাটির দেশে অথবা অজানা কোনও স্টেশনে। ১৯৭২ সালে শিবপুর বি.ই. কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে অরুণবাবু তখন চাকরীপ্রার্থী। ট্রেকিংও চলছে পাহাড়ে, সমুদ্র সৈকতে আর জঙ্গলে। সেবছরই এপ্রিলের শেষাশেষি নাগাদ একদিন ভরদুপুরে নেমে পড়েছিলেন শ্রীরামপুর স্টেশনে (Serampore Station)। স্টেশন চত্বরে একটি গাছ দেখে থমকে গেলেন। গাছটির নাম মহুয়া। ইংরেজিতে Madhuka Latifolia—যা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা বা মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে পর্যাপ্ত দেখা যায়। এই গাছের সঙ্গে বনবাসী মানুষদের কোথায় যেন একটা আন্তরিক যোগাযোগ আছে। এর পাতার আগুনে ওরা শীত আড়াল করে। ফুলের গন্ধে ভেঙে পড়ে সাগরের ঢেউ, গানে গানে কল্লোলিত হয় অরণ্যনির্জন। এ গাছ ওদের বড়ো আদরের। ওর ফলও ওরা খায়। এই মহুয়া গাছই অরুণবাবুর মননে জন্ম দেয় একটি মাটির কবিতা, পরবর্তীতে যা ৫০ বছর ধরে লোকগান হিসেবে থেকে গেছে বাংলা-বাঙালির হৃদয়জুড়ে।

“এই রকম একটি গাছ শ্রীরামপুর স্টেশনে ঠায় দাঁড়িয়ে দেখেছি। যেখানে শব্দের অসহ্য দামামা। লক্ষ লক্ষ মানুষের তাৎক্ষণিক দাপট নিয়ত। ট্রেনের হাঁসফাঁস। হকারের দাপাদাপি, দূষিত ধুলোর থাবা। অসহ্য দুপুর। টোপা টোপা মহুয়া ফুলের ভারে অলংকৃত দেখে মুহূর্তের মধ্যে আমার অরণ্যের কথা মনে হল। অরণ্যবাসীদের কথা মনে পড়ে গেল।” বলেন অরুণবাবু। শ্রীরামপুর স্টেশনে মহুয়া গাছটি দেখে তাঁর মনে হয়েছিল গাছটি এখানে ‘মিসফিট’। মনে হয়েছিল ইঁট, কাঠ, পাথরের এ শহরে লাল মাটির গাছ বড়োই বেমানান। সেই ভাবনাই যে একদিন আপামার বাঙালির মন ‘লাল পাহাড়ির দেশে’ টেনে নিয়ে যাবে এমনকি লোকসংগীত ঘরানার চিরকালীন উদাহরণ হিসেবে থেকে যাবে, তা তিনি টের পাননি। মাথায় লাল ফেট্টি, পকেটে লজেন্স আর মুখে ‘জয় গুরু’। এটাই কবি অরুণ চক্রবর্তী। তিনি মানুষের জন্য কবিতা লেখেন। মনে করেন, কবিতার মধ্যে এমন একটা শক্তি আর সততা আছে যা পৃথিবীর মঙ্গল করে।

“আদিবাসী আঞ্চলিক মানুষের মুখ মনে করে, তাদের গান, নাচ, পায়ে পায়ে ভেঙে যাওয়া হাজার ঢেউ, তাদের সহজিয়া জীবন যাপন…সব মিলিয়ে একটা উচ্চারণ ‘হাই দ্যাখো গো…তুই এখানে কেনে, লাল পাহাড়ির দ্যেশে যা, রাঙা মাটির দ্যেশে যা’।” বলেন লালপাহাড়ি গানের গীতিকার-কবি।

অরুণবাবুর কথায় “মানুষের জন্য লিখি। মানুষ ভালোবেসেছে ৫০ বছর ধরে। আরও বাসবে কারণ এর মধ্যে একটা কথা লুকিয়ে আছে—হেথাক তোকে মানাইছে নাই রে। যেখানে তোমার জায়গা নেই, সেই জায়গাটা তোমার জন্য নয়। সারা পৃথিবী জুড়ে এত অশান্তি, আতঙ্কবাদ, মারামারি, খুনোখুনি, অহংকার। যদি সত্যি সত্যিই মানবিকতার অধিকারি হতো মানুষ, সব মানুষের ভিতর যদি মানবিকতা প্রতিষ্ঠিত হতো তাহলে এসবের কোনও জায়গাই থাকতো না। তাই ঠিক জায়গায় ঠিক মানুষের থাকাটা প্রয়োজন। মহাশ্বেতা দেবী কবিতা পড়তেন না কিন্তু আমার লাল পাহাড়ির দ্যেশে যা খুব পছন্দ করতেন। গুনগুন করে গাইতেনও।”
ভি বালসারার হাত ধরে গান হয়েছিল কবি অরুণ চক্রবর্তীর লালপাহাড়ি কবিতা। সুর করেছিলেন সুভাষ চক্রবর্তী। ১৯৭৩-৭৪ সালেই সুরারোপণের কাজ হয়ে যায়। তা মঞ্চে মঞ্চে গেয়ে বেড়ান সুভাষবাবু। খনি অঞ্চলে, সাঁওতাল পাড়ায়। ভি বালসারাজি তখন ইনরেকো (কলকাতার অক্রুর দত্ত লেন) কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। সুভাষবাবুর মুখে গান শুনে বেশ চমকে গিয়েছিলেন। নতুনত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন। ফোকগানের একটা বাজার আছে, মানুষ শুনতে চায় তার উপর কোম্পানির খুব একটা ক্ষতি হবে না মনে করে তিনি রাজি হয়ে যান। Extended Play (E.P), 45 r.m.p সারা বাংলা, আসাম, ত্রিপুরায় হইচই পড়ে যায়। হু হু করে বিক্রি হতে থাকে রেকর্ড। দেশ-এ, আনন্দবাজারে, অমৃত পত্রিকায়, যুগান্তরে ভূয়সী প্রশংসা ছাপা হয়। আখড়ায়, সভায়, সমিতিতে, মাউন্টেনিয়ারিং ক্যাম্পে ক্যাম্পে, কবিতার আড্ডায় শোনা যেত এই গান।

লোকাল ট্রেন থেকে বাংলা ব্যান্ড এখনও এই সুরে মাতোয়ারা। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুদিত হতে চলেছে লালপাহাড়ি কবিতা। অনেক সময় দেখা যায় কোনও লোকগান তুমুল জনপ্রিয় কিন্তু তার গীতিকারের নাম আমরা জানি না। লাল পাহাড়ি গানের সঙ্গেও এরকমটা ঘটেছিল। আমরা জানি বাংলা ব্যান্ড ‘ভূমি’ এই গানটি রেকর্ড করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। গীতিকারের নাম উল্লেখ না করায় শুরু হয়েছিল বিতর্ক।

লোকাল ট্রেন থেকে বাংলা ব্যান্ড এখনও এই সুরে মাতোয়ারা। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হতে চলেছে লালপাহাড়ি কবিতা। ‘সহজিয়া ফাউন্ডেশন’ গত ৮ জুলাই রবীন্দ্র সদনে সম্মান জানায় ‘লালপাহাড়ি’র স্রষ্টাকে।

 

Sahityika Admin

Add comment