সাহিত্যিকা

একটি কবিতার পঞ্চাশ বছর

একটি কবিতার পঞ্চাশ বছর
@(স্বর্গত)অরুণ কুমার চক্রবর্তী, ১৯৭০ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

সম্প্রতি গত ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ আমাদের দীর্ঘ ৬০ বছরের বন্ধু ও কবি অরুণ চক্রবর্তী আমাদের সকলকে ছেড়ে “লাল পাহারির দেশে” চলে গেলো। হঠাৎ এই খবর পেয়ে আমরা শোকাহত। গতকাল রাত্রেও জঙ্গল পাহাড়ের অনুষ্ঠানে আমাদের আরেক বন্ধু, বালুর সাথে (সেও আর এক কবি) নেচে নেচে অনেক গান বাজনা করেছিল। অরুণ যেখানেই থাকুক শান্তিতে থাকুক – এই প্রার্থণা করি।
ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি
– প্রবীর কুমার সেনগুপ্ত, ১৯৬৯ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

সংযোজনে অসীম দেব, ১৯৭২ ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
এক বছর আগে, ১৯ শে অক্টোবর, ২০২২ অরুন’দা আমাকে নিজের কিছু কথা লিখেছিলেন, সেটি সকলের সাথে ভাগ করে নিলাম।

ভাই অসীম, যে কবিতাটি নিয়ে সারা পৃথিবীর বাঙালির আদরের অন্ত নেই, তিনটি প্রজন্ম নাচ্ছে, গাইছে, অন্য ভাষায় অনুবাদও হয়েছে, সেই কবিতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলো, নানা জায়গায় পালন হয়েছে ও হচ্ছে, তারই ওপর লেখাটি পাঠালাম, পড়ে দেখো কেমন লাগে।

আমি, ১৯৬৮ তে পাশআউট হওয়ার কথা, ১৯৬৩ তে কলেজে ভর্তি, কিন্তু পাসআউট ১৯৭০, পাহাড়, হিমালয়ে ট্রেকিং, বাউল সাধনা, অবদুতের কাছে তন্ত্রতালিম, বাংলার মেলায় মেলায় ঘোরা, বাংলায় অকারণ বিপ্লব, খুন, অযাচিত রক্তপাত, শহীদযাপনের অবমাননা, আসল শহীদ দেখতে আন্দামান চলে যাওয়া, আর কবিতার ঘোলাটে চর্চা, ষাট দশকে কবিদের দাদাগিরি, ১৯৫৮ সালের বিই কলেজের প্রাক্তনী কবি বিনয় মজুমদার, সিনিয়র কবি ও কলেজতুতো দাদার অপমান, জঙ্গলমহল জীবন, আদিবাসী সঙ্গ, ওদের প্রকৃতি চেতনা, সংস্কৃতি গান, একতাবোধ, ওদের নিপীড়ন, অবহেলার ইতিহাস,……সব মিলিয়ে দুটো বছর পেছিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু যা পেলাম তা আমার জীবনে পরম পাওয়া…….
একটা আবেগ করে যায় ভেতরে ভেতরে, হয়তো সেই জন্যেই সব কিছু গুছিয়ে কিছু করা হয়ে উঠলো না। একটি এলোমেলো, বহেমিয়ান জীবন যাপন করলাম,

ভাই, কি হলো জানিনা, তবে গানটি, আরও আছে, থেকে যাবে। কবিতা, ১৯৭২ সালে লেখা, ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত মুখে মুখে আবৃত্তির মাধ্যমে সারা বাংলায় ছড়িয়ে যায়, ১৯৭৯ সালে পুজোর গান হিসেবে, প্রকাশ পায়, মানবেন্দ্র, হেমন্ত, দ্বিজেন, আরতি, সন্ধ্যা, আরও অনেকের পাশে নতুন গান, নতুন মুখ, একটা চ্যালেঞ্জ ছিলই।

আমার BIO – DATA
অরুণ কুমার চক্রবর্তী, ছদ্মনাম: মুসাফির বাউল,
জন্ম: কলকাতা, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬
শিক্ষা: স্কুল, চন্দননগর কানাইলাল বিদ্যামন্দির, হুগলী,
কলেজ: বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) শিবপুর, প্রথম শ্রেণীর মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতক,
১৯৬১ সাল থেকে লেখালেখি, স্কুল ম্যাগাজিনে। প্রেরণা দিয়েছেন, বাবা, মাস্টার মশাই নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়, রমানাথ চট্টোপাধ্যায়,
আকর্ষণ: প্রকৃতির টানে বনে জঙ্গলে হিমালয়ে, হাই অলটিচুড, সান্দাকফু, মিলাম গ্লাসিয়ার, পিণ্ডারী গ্লাসিয়ার প্লেন ল্যান্ড ট্রেকিং, সুবর্ণরেখা নদীর উৎস থেকে মোহনা, Youth Association of India, Hooghly District branch, Chandannagar এর উদ্যোগে ৫০০ কিলোমিটার যাওয়া। আদিবাসী ভাই বোনদের টানে জঙ্গলমহলএ ট্রেকিং, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বিহার, ঝাড়খন্ড, গুমো, বীরভূম, ওদের জীবনযাত্রা গান, সাংস্কৃতিক আচারণ, প্রাকৃতিক বিদ্যা, জঙ্গল চেতনা, সুদীর্ঘ কালের লড়াই, আর টিকে থাকার রহস্য ইত্যাদি…

হুগলি জেলার শ্রীরামপুর ইস্টিসনে মহুয়া গাছ দেখে একটি কবিতার জন্ম, পরে গান, বাউল, ইন্টারন্যাশনাল, ন্যাশনাল গায়ক গায়িকার কন্ঠে সারা পৃথিবীতে প্রচারিত, কবিতা ও সুর, অরুণ…, কবিতার গান নিয়ে সিনেমা, you dont belong, ডিরেক্টর স্পন্দন ব্যানার্জি, দিল্লি, প্রিমিয়াম New York, আর নিউ দিল্লি, জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তি, সারা ভারত ইন্টার ইউনিভার্সিটি folk fest এ বিশ্বভারতীর ছেলেমেয়েদের gold medal প্রাপ্তি…..
কবিতার বই বারোটি, ধুলো খাই যদি প্রেম পাই, জলছুরি কাটছে পাথর, অরণ্য হত্যার শব্দে, এসো কবতায় কথা বলি ইত্যাদি, বাংলার
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কবিদের নামে পুরস্কার, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, চারণ কবি বৈদ্যনাথ, ভারত চন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রূপসী বাংলা, লালন কবি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ইন্দো-বাংলাদেশ সাহিত্য পুরস্কার, বঙ্গরত্ন পুরস্কার, লালনকবি শিরোমনি, সাহাজিয়া ফাউন্ডেশন পুরস্কার, National Award, Care for Environment Contest, Ministry Of Environment and Forest, Govt. Of India, New Delhi.
Attended গাছ বাঁচাও আন্দোলন, CHIPCO movement, inspired by Sundarlal Bahuguna, of Garwal Himalayas
Poetic honour from almost all districts of WB, Assam, Orissa, Jharkhand, and Karnatak.

*******

সাহিত্যিকা পত্রিকায় অরুণ কুমার চক্রবর্তীর একটি পুর্ব প্রকাশিত লেখা এই সংখ্যায় পুনর্মুদ্রণ করা হলো

*******

একটি কবিতার পঞ্চাশ বছর

১৯৭২ সালের এক আবেগময় মুহুর্তে একটি কবিতা লিখেছিলাম ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’। আজ ২০২২ সালে এই কবিতাটি গান ও কবিতার রূপে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছে। পিছুপানে তাকিয়ে এর ইতিহাস নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে হলো।

ভুমিকায় বলি, পৃথিবীর সংস্কৃতির প্রাঙ্গণে সংগীত শ্রেষ্ঠ শিল্প, তারপরেই কবিতার স্থান, কবিতাকে আমরা বলি সূক্ষ্ম চেতনা শিল্প, আর কবিতায় সুরারোপণ হলেই সংগীত, প্রায় সাড়ে আটশো বছর আগে কবি জয়দেবের সময় থেকে গীতিকবিতার পর্ব শুরু হয়েছে। কবি কবিতা লিখতেন আর রাজা লক্ষণ সেনের রাজসভার অন্যতম কবি জয়দেব, কবিতায় সুর স্থাপন করে গাইতেন, এমনটিই ছিল তখনকার বিনোদন ব্যবস্থার রূপ। কবিতার উৎসমুখ (nucleation) ছিল রাধাকৃষ্ণের অপূর্ব লীলার অনুরাগ, বীতরাগ, অভিমান, দেহবল্লরীর নিবিড়তা, কামবিলাসের অপূর্ব মগ্ন অনুভব, লীলার গভীর ঘনত্ব, দেহ থেকে দেহাতীত অবস্থানে উত্তীর্ন হওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি শেষে মানসিক রমণের আয়োজন। নানান রাজকার্যে নিমগ্ন ক্লান্তি অবসাদ থেকে রাজা মুক্ত হয়ে আবার নব উদ্যোমে রাজকার্যে নিযুক্ত হতেন। সেই থেকে গীতিকবিতার ধারা আজও বয়ে চলেছে আমাদের সমগ্র বাংলা সাহিত্যে। এ এক অপূর্ব পরম্পরা, রবিঠাকুরের গীতাঞ্জলি সেই প্রবহমান ধারার অনবদ্য শ্রেষ্ঠ উপহার, আমার মনে হয়েছে যে কোনো সৃষ্টির মূলে একটি উৎসমুখ থাকা খুবই জরুরি। সেই উৎসমুখটিকে বলতে একটি nucleation site, যেখান থেকে চিন্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়, তরপর বর্ধন বা বেড়ে ওঠা (growth), এরপর রূপান্তরিত হওয়া (transmigration) যে কোনো গঠনে, কবিতায়, গানে, ভাস্কর্যে, নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে, ছবিতে (painting) বা রম্যারচনায়। এভাবেই একটি বিজ্ঞান সব সৃষ্টির অন্তরালে কাজ করে চলেছে তিনটি phase বা অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে, 1. Nucleation,
2. Growth,
3.Transmigration
এটিই অপূর্ব বিজ্ঞান মেনে বা না -মেনে, জেনে বা না-জেনে সৃষ্টিকররা নিজ নিজ কাজটুকু করে চলেছেন,….

আমাদের শরতকালে নীল আকাশ আছে, তাতে শাদা মেঘেরা ভেসে বেড়ায়, এ এক শরতকালের চিরকালীন চিত্রপট। আমরা দেখেছি, আমাদের আগেও মানুষজনেরা দেখেছে, কিন্তু রবিঠাকুর এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে কবিতা লিখলেন ….. নীল আকাশে কে ভাসালে শাদা মেঘের ভেলা রে ভাই শাদা মেঘের ভেলা…… এই লেখায় সুরারোপণ করে গান হলো, আমাদের ছেলেমেয়েরা একশো কুড়ি বছর ধরে নেচে চলেছে,….

ঠিক এভাবেই, সেটা ছিলো ১৯৭২ সাল, আমাদের হুগলী জেলার শ্রীরামপুর স্টেশনে একটি মহুয়া গাছকে দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, এ গাছটি এখানে কেন? বুঝতে পারলাম একটি nucleation site তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এই মহুয়া গাছ আমার খুবই প্রিয়। বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, রাঁচি, হাজারীবাগ, মধ্যপ্রদেশ, সিংরোলি, বিহার, ঝাড়খন্ড,…. আরও অনেক জায়গায় পর্যাপ্ত দেখেছি। সারা জঙ্গলমহল জুড়েই এদের অবস্থান, আর এদের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে আদিবাসী সমাজ, ওদের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, বিনোদনের ঘন উপাদান, অপূর্ব বন্ধনক্রিয়া।

আমি নিজের মনেই প্রশ্ন প্রশ্নে জর্জরিত….. লালমাটির গাছ এখানে কেন? আমাদের এই হুগলি জেলায়, এই জেলা তো ধানের দেশ, আলুর দেশ, আমের দেশ।

এরপরই আমার মগজে কবিতার জন্ম। আমি অনেক আগেই লিখেছিলাম, কইতে কহ যে, কবির জরায়ু থাকে কবির মগজে, কে বোঝে সহজে, কবির জরায়ু থাকে কবির মগজে…..
তারপর আমার এই কবিতার জন্ম, গাছটা বেমানান, এই স্টেশনে গাছটিকে এক্কেবারেই মানাচ্ছে না। যেমন আমি, ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম, হয়ে গেলাম ইঞ্জিনিয়ার। ঘন্টা হলো, একটি অসফল কারিগর, কিন্ত মগজজাত একটি সন্তান প্রসব হলো। সে এক চূড়ান্ত যন্ত্রনা, nucleation পর্যায় থেকে growth পর্যায়ে শেষ। একটি সৎ ফসলের জন্ম ঘটাতে অন্তর্লিন শক্তির বিক্রিয়া তখন কোষে কোষে ঘটাচ্ছে বিপর্য্যয়, আলোড়ন, ভ্রুণ থেকে শিশুর অবয়ব ঘটে গেছে মগজের গর্ভাধারে। সে যে আলো চায়, পৃথিবীতে আসতে চায়, গর্ভফুলের কোরকের অন্ধকার আর তাঁর ভালো লাগছে না। সে আসবেই, প্রকৃতির অনিবার্য নিয়মে সে প্রকাশিত হবেই আপন মাধুর্যে। পাথরে পাথরে বপন করে যাচ্ছে তৃষ্ণা, চাই চাই, তৃষ্ণা যে মেটানো চাই। অরণ্য ভর করেছে, বনবাসীদের নিটোল কালো মুখগুলি আমার চারপাশে, কী চায়? পাতায় পাতায় বেজে উঠছে আদিম মাদল, গান। নৃত্যমুখর পায়ে পায়ে যাচ্ছে সাতসাগরের ঢেউ। কতগুলো স্নায়ু ছিঁড়লো, আর কতো বাকী?? কষ্ট যে আর সহ্য হয় না, বড্ডো কষ্ট হে, বড্ডো কষ্ট। শব্দ চাই, শব্দের রঙ চাই, শাদা ক্যানভাস কই? হে অরণ্য, শব্দ দাও, মাদল, সুর দাও, লেখার তুলি দাও, কবিতা এবার জন্ম নাও,। কবি প্রস্তুত, হে পাঠক, তুমি?? হে প্রবহমানতা, তোমার শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের ছিঁটেফোঁটা আমাকে অর্পণ করো, শব্দের ছবিতে ওকে লালন করবো,… আমাকে মুক্তি দাও,….

কে বসালো এই গাছ? এপ্রিল মাস, স্টেশনের ব্যস্ততা, একটু আগে বিরাট একটা ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিন কাটোয়া লোকাল টেনে নিয়ে গেছে। একটা অপূর্ব অতি চেনা গন্ধ আমাকে সচেতন করে তুললো। আনমনে খুঁজতে খুঁজতে দেখি যে আপ স্টেশনের শেষপ্রান্তে একটি পাতাহীন গাছে অজস্র ঝুমকো ঝুমকো মহুয়া ফুলের গুচ্ছ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। গাছের গোড়ায় মহুয়া ফুল ছাড়িয়ে রয়েছে, অনাবিল আনন্দে, যেমন জঙ্গলমহলে করে থাকি। স্টেশনের সেই নোংরা মাটি থেকে মহুয়া ফুল কুড়িয়ে খেতে লাগলাম। আহা, কী আনন্দ সেই ফুলের রসে রসে। হটাৎ খেয়াল হলো আমাকে ঘিরে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন দাঁড়িয়ে পড়েছে। অবাক হয়ে দেখছে, কী সব বলাবলি করছে। হটাৎ সম্বিত ফিরতেই, সুরিন্দর চাওয়ালা, আমাকে আগে থেকেই চিনতো, বললে, সাব, ঠিক হ্যায় তো? আমি আর ফুল কুড়িয়ে না খেয়ে, পকেট থেকে রুমাল বের করে তাতে রাখতে লাগলাম। একটু লজ্জা আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল। তখন কী আর করতে পারতাম? সুরিন্দরের কাছ থেকে চা নিয়ে খেতে লাগলাম।

এইবার এই ভাবনা থেকে শুরু হলো আমার চিন্তনপ্রক্রিয়া। ওদের প্রসন্ন মুখগুলি মনে পড়লো, মনে পড়লো ওদের গান, বাই বাগিয়াম তিনা গ, সুরজমণি রাণী গ, বাই বাগিয়াম তিনা, অপূর্ব পরস্পর কোমরবন্ধনে আবদ্ধ সমবেত নাচ, মাদলি মাদল বাজাইন দাও হে, তুরুতরু তুরুতরু, কইলকাতা থেকেন আইলেন বিদ্যাসাগর গুরু…. পায়ে পায়ে ভেঙে যাচ্ছে হাজার সাগরের ঢেউ, অপূর্ব তালে ছন্দে উদাত্ত মাদলের বোলে নেচে নেচে উঠছে আকাশ বাতাস,
গুবদাগুপুং গুবদাগুপুং গুপুং
গুবদাগুপুং গুবদাগুপুং গুপুং
অপূর্ব মগ্নতায় আচ্ছন্ন তলতলে মুখ, মেয়েদের খোঁপায় ফুল, শালপাতার ঝুলর, গলায় বনফুলের মালা, অপূর্ব নিজস্ব ঢংয়ে আটোসাটো কাপড়ের শারীরিক বিন্যাস, মুখেমুখে লেগে আছে সারল্যের উদ্ভাসি আলো, মনের গভীর অন্তরালে কবিতার জন্মবীজ মগজে অঙ্কুরিত হচ্ছে …

জন্ম নিলো কবিতা…..
হে পাঠক, তোমার অধিকার বুঝে নাও এবার…..

শ্রীরামপুর ইস্টিসনে মহুয়াগাছটা

হাই দ্যাখো গ ‘, তুই ইখানে কেনে,
লাল পাহাড়ির দেশে যা,
রাঙামাটির দেশে যা
হেথাকে তুকে মানাইছে নাই গ’
ইক্কেবারেই মানাইছে নাই
অ – তুই লালপাহাড়ির দেশে যা…
সিখান গেইলে মাদল পাবি
মেইয়া মরদের আদর পাবি
অ-তুই লাল পাহাড়ির দেশে যা লারবি যদি ইক্কাই যেতে
লিস না কেনে তুয়ার সাথে
নইলে অ -তুই মরেই যা
ইক্কেবারেই মরেই যা
হাই দ্যাখো গ’, তুই ইখানে কেনে,
লাল পাহাড়ির দেশে যা
রাঙ্গা মাটির দেশে যা
রাঙ্গামাটির থানে যা……

অনুলেখ :—-
ঐ মহুয়াগাছ আমার মনের মধ্যে যে বিস্ফোরণ ঘটালো, অন্য কবির মধ্যেও ঐ বিস্ফোরণ অন্যভাবে ঘটাতে পারে, এ কথা অনস্বীকার্য। যে কবি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার স্বস্থান থেকে সত্যকার আত্মপ্রকাশ ঘটুক, সৎ রুচিশীল সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্য নিশ্চয় তাই…..

এরপর নানান জায়গায় কবিসম্মেলনে কবিতাটি আবৃত্তি করি। ১৯৭২ সাল, কবিতাটি অনেকেই ধীরে ধীরে গ্রহণ করছে। ষাট দশকে কফি হাউসের সো কল্ড আঁতেলরা কিন্তু নেয় নি। অন্য আঞ্চলিক কবিতাগুলি, লিবে লিবে বাবুগুলা সব লিবে, লিয়ে লিয়ে মজা লুইটবেক, হাই গো জঙ্গলমহল জুড়ে শহর আইছে গো শহর আইছে, আনধার থাইকবেক নাই, কফি হাউস নেয় নি….

এরপর বিখ্যাত সংগীত সুরকার ও কম্পোজার মিস্টার ভি বালসারা মশাইয়ের আনুগত্যে আমার আর আমার অগ্রজ কবি রূপনারায়নপুরের অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের দুটো দুটো করে চারটি কবিতার প্রচলিত সুরে গান গাইলো বেলিয়াতোড়ের সুভাষ চক্রবর্তী। সেই সময়, মানে ১৯৭৯ সালে মান্না দে, শ্যামল মিত্র, তরুণ বন্দোপাধ্যায় , সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাস, নাজিম হিকমত.. কবিতার গান, আধুনিক গান গাইতো। তখন ওকে বাঁকুড়ার ভূমিপুত্র এবং আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণ শুনে ওকে আমার কবিতা দেখাই, এবং ও চারখানা গান তৈরি করে। আমি এরপর ওঁকে বালসারা সাহেবের কাছে নিয়ে যাই। বালসারা সাহেব INRECO কোম্পানি থেকে, তখনকার নিয়ম অনুযায়ী আমার কবিতার গান পুজো সংখ্যার গান হিসেবে প্রকাশিত হয়। বালসারা সাহেব মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টটা দেখতেন। আমি বুঝিয়ে বললাম, যে লোকসংগীতের একটা অন্যরকম চাহিদা থাকেই, অন্তত গ্রামবাংলায়। হলোও তাই। রেকর্ড বের হবার পর ত্রিপুরা, আসাম, গ্রামবাংলায় ঐ গান নিয়ে হই হই পড়ে গেলো। ঐ রেকর্ডে লাল পাহাড়ির দেশে যা, এই নাম দিয়ে লিরিক হিসেবে চিহ্নিত হলো, সংগীত পরিচালনা ও গায়ক সুভাষ,……

এরপর চূড়ান্ত জনপ্রিয় গান লাল পাহাড়ি দেশে যা, যখন বাউলদের কানে গেলো, ওরা বেশ মজা পেয়ে গাইতে গাইতে আরও জনপ্রিয় করে তুললো। নিমাই গোসাঁই বাউল গানের পাশাপাশি লাল পাহাড়ি গেয়ে ওর দর এমন বাড়তে লাগলো যে গানটি আসরে দুবার তিনবার গাইতে হলো। শেষে একদিন আমার কাছে এসে বললে, গুরু, (সে আমাকে গুরু মনে করতো), গানটো বড়ো ছোটো হইনছে, উটাকে বড়ো কইরে দ্যান, আমি তখন দুটো স্টানজা বাড়িয়ে সুর দিলাম। সেই গান আজ সারা পৃথিবী সুরে সুরে উড়ে বেড়াচ্ছে, বাউলরা গাইছে, ইন্টারন্যাশনাল আর্টিস্ট থেকে বাচ্চা বাউল গানটি গাইছে,…..

তবে এই গানকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ছাপা কবিতা, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থে অরণ্য হত্যার শব্দে সংকলনে মুদ্রিত, রেকর্ডে আমার নাম মুদ্রিত, তবুও কেউ কেউ বলে যাচ্ছেন যে এটা তাঁদের গান। একটা ভুল আমার দিক থেকে হয়েছে যে, আমি গানটির কোনো কপি রাইট করিনি। আসলে কপি রাইট যে করতে হয় সেটা আমি জানতামই না। মুদ্রিত রেকর্ডে আমার আরও একটি গান, যা হবার তা হবেক গো,… আমার তিনখান কবিতা পাঞ্চ করে ভূমি নামক একটি ব্যান্ড ওদের নিজেদের গান বলে চালিয়ে প্রচুর ব্যবসা করলো। অনুমতি নেয় নি। কোনো সিডি বা ক্যাসেট দেয়নি, গানটির মধ্যে নাগর বলে একটি শব্দ যোগ করে ওদের গান বলে চালিয়ে গেলো। পরে, কবিতাটির চল্লিশ বছর উদযাপন করার সময়, আয়োজক সহাজিয়া ব্যান্ড, রবীন্দ্রসদনে, কলকাতা, সৌমিত্র ব্যান্ডের গায়ক পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দিই। প্রথমদিকে অনেকেই দাবী করেছে যে তাদের গান তাঁদের সুর , কোনো প্রমাণ দেখাতে পারে নি। আর কি করেই বা দেখাবে,……

হটাৎ একদিন দিল্লি থেকে OVER DOZE প্রোডাকশন হাউসের ডিরেক্টর স্পন্দন ব্যানার্জি এলেন। লাল পাহাড়ি গান নিয়ে তিনি ডকুমেন্ট করলেন। অনেক আগে থেকেই অনেকে নানান সুরে গানটি গাওয়ার চেষ্টা করেছিল। পবন দাস দাবী করলো সুরটি নাকি তার, যদিও তার অনেক আগেই প্রচলিত কোম্পানি থেকে সুরে গানটি রেকর্ড হয়ে গেছে। গানটি কোনো এক সিনেমায় নাকি ব্যবহার করেছেন নাম দেয় নি, অনুমতি নেয়নি, লেখক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার পূর্ব পশ্চিম উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন, অনুমতি নেন নি, নামও দেন নি। অন্যদিকে শ্রদ্ধেয় উষা উথুপ, আমাকে কাছে ডেকে অনুমতি নিয়ে গানটি গেয়ে শুনিয়ে টাকা দিয়ে, কিছু উপহার দিয়ে আমাকে সম্মানিত করেছিলেন। দিল্লির ছেলেরা যে ফিল্মটি বানিয়েছিলো, Ytube এ আছে, you don’t belong, নিউ ইয়র্কে প্রিমিয়ার হয়েছে। অন্যান্য বিদেশে, দেশেও হয়েছে। দিল্লিতে হয়েছে, গানটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। কেরল সরকার ফিল্মটিকে পুরাস্কৃত করেছেন। কয়েক বছর আগে সহজমা অর্থ সম্মান দিয়ে সম্মানিত করেছেন,……

এখনও কিছু ছেলেমেয়ে কবিতাটি বলে, কেউ কেউ গান গেয়ে প্রাইজ দেখাতে আসে,…..

কয়েক মাস আগে শান্তিনিকেতনে একটি দল ওখানে বেড়াতে এসে, আমাকে মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখে, প্রায় তিরিশ জন ঘুরে ঘুরে লাল পাহাড়ি গান গেয়ে নেচে দেখালো। তারপর একজন বয়স্ক মহিলা এগিয়ে খুব খুশি হয়ে বললেন, দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো, দেখলাম, সবাই খুশি। পরে বললেন, আমি দিদিমা, এই আমার মেয়ে, এই আমার নাতনি। তার মানে তিন তিনটি প্রজন্ম গানে গানে মজে আছে। সবাই ভুলভাল গাইছে। যে যেমন খুশি ইম্প্রোভাইস করছে।

অনেকেই জানিয়েছেন ঠিক গানটি চাই, সেটি এখানেই থাক, পাঠক, গায়ক ও আবৃত্তিকাররা খুঁজে নিক। তবে একটা কথা ঠিক, আমি তো ছোটো কবিতা লিখেছিলাম, সেটি গান হয়ে সারা পৃথিবী ছড়িয়ে গেল, বাংলা কবিতার জয় হোক, বাংলা গানের জয় হোক…….

কবিতা : লাল পাহাড়ির দেশে যা
কথা ও সুর অরুণ কুমার চক্রবর্তী

হাই দ্যাখ গো, তুই ইখানে কেনে,
ও তুই লাল পাহাড়ির দেশে যা রাঙামাটির দেশে যা
হেথাকে তুকে মানাইছে নাই রে
ইক্কেবারেই মানাইছে নাই রে
লাল পাহাড়ির দেশে যাবি
হাঁড়িয়া আর মাদল পাবি
মেইয়া মরদের আদর পাবি
হেথাকে তুকে মানাইছে নার রে
ইক্কেবারেই মানাইছে নাই রে
নদীর ধারে শিমুলের গাছ
নানা পাখির বাসা রে
নানা পাখির বাসা
কাল সকালে ফুইটবে ফুল
মনে কতো আশা রে
মনে কতো আশা
সেথাকে যাবি প্রাণ জুড়াবি
মেইয়া মরদের আদর পাবি
হেথাক তুকে মানাইছে নাই রে
ইক্কেবারেই মানাইছে নাই রে
ভাদর-অ আশ্বিন-অ মাসে
ভাদু পূজার ঘটা রে
ভাদু পূজার ঘটা
তু আমায় ভালোবেসে পালিয়ে গেলি
কেমন বাপের বেটা রে
কেমন বাপের বেটা
মরবি তো মরেই যা
ইক্কেবারেই মরেই যা
হেথাক তুকে মানাইছে নাই রে
ইক্কেবারেই মানাইছে নাই রে…


(Photo Credit – Amiya Naskar (EIPC))

 

 

 

Sahityika Admin

3 comments

  • অরুণ চক্রবর্তী তাঁর প্রাপ্য অধিকার ও সম্মান পেলেন না। অন্যদিকে তাঁরই
    কবিতা গান চুরি করে অন্য অনেকেই বাণিজ্য করলো।
    সাহিত্যিকা পত্রিকাকে ধন্যবাদ এনার বিষয়ে সকলকে সচেতন করলেন।

  • প্রদীপ রায়চৌধুরীর সাথে সহমত। অরুণ চক্রবর্তী তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি পেলেন না।

  • একজন কবির কাছে কবিতা সৃষ্টি তো সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার মতই ঘটনা। স্বর্গীয় কবি অরুণ চক্রবর্তী নিজে অরণ্যের ছত্রছায়াতেই থেকেছেন বরাবর। তাঁর বিখ্যাত কবিতার জন্মবৃত্তান্ত এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলির ওঁনার জবানীতেই জানা গেল।