সাহিত্যিকা

সুমনের দিবাস্বপ্ন অথবা দিব্যজ্ঞান

সুমনের দিবাস্বপ্ন অথবা দিব্যজ্ঞান
@প্রণব কুমার মজুমদার, ১৯৭১ সিভিল ইঞ্জনিয়ারিং

বারাসাত রেলস্টেশনের বেঞ্চে বসে ছিল সুমন। পথে ঘুগনী-রুটি খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি করে বাড়ি ফিরতি ট্রেনের প্রতীক্ষায় বসে বসে অনেক কিছুই ভাবছিলো। ভাবছিলো মাস্টারি করার চাকরিতে দিনের উপস্থিতির হাজিরা দিয়ে এলো শুধুমাত্র একটা সাদা কাগজে হস্তাক্ষর করে। নিজেদের অর্থনৈতিক দাবি আদায়ে তার কলেজের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হতে ঐদিন থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা বন্ধ রেখে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের ঘোষণা করে। সুমন ভাবছিলো শিক্ষাকে অবরোধ করে শিক্ষা বিস্তারের এমন কৃতিত্ব তত্ত্বের, না প্রয়োগের, নাকি উভয়েরই।

আবার ভাবলো ধুত্তোর! চুলোয় যাক এসব রসকষহীন গুরুগম্ভীর ভাবনা। পুরষ্কারের ঘোষণা থাকলে না হয় ভাবা যেতো। তার থেকে বরং ঐ ছাগলটার ভুট্টার খোসা চিবোনো দেখা যাক। আহা ছাগলটার কি পরিতৃপ্তি এমন বিনি পয়সার ভোজ খাওয়ায়! সুমন বেঞ্চের পাশে ভুট্টার পসরা সাজিয়ে বসে থাকা ভুট্টাওয়ালীর ছাড়ানো খোসার সদ্ব্যবহার করতে থাকা ছাগলটাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে ওর খাওয়াটা নিজেই যেন অনুভব করতে লাগলো। ঠোঁটদুটো ফাঁক করে এগিয়ে দিয়ে আবার বন্ধ করে চেপে ধরছে খোসাটাকে আর ঠোঁটের খোলা-বন্ধর অন্তর্বর্তী সময়ে বোধহয় দাঁত দিয়ে চেপে রাখছে খোসাটাকে। তারপর নিচের চোয়ালটা বাঁদিক থেকে ডানদিকে সরে যাচ্ছে। ঠোঁট বন্ধ অবস্থায় বোধহয় দাঁতের পাটি আলগা হচ্ছে আর জিভ দিয়ে টেনে নিচ্ছে চর্বিত ভুট্টার খোসা। সেইসঙ্গে বন্ধ ঠোঁটদুটো একটু ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে দাঁতের পাটির মাঝে পরবর্তী খোসার অংশকে চর্বিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে। আহা, খাদ্য গলাধঃকরণের কি সুশৃঙ্খল পদ্ধতি! ঠোঁটের বাইরের খোসার অংশ ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসছে।

এবার মুখের সামনে মেঝের ওপর আর এক গুচ্ছ খোসা এসে পড়লো। পাশে বসা ভুট্টাওয়ালী ছুঁড়লো গোছাটা আর নুন-লেবু মাখানো বাদামী-লাল করে পোড়ানো ভুট্টাটা তুলে দিলো সামনে দাঁড়ানো খদ্দেরের হাতে। মুখ দিয়ে কামড় বসানোর আগেই সেই খদ্দেরের চোখে-মুখে কেমন এক পেলব তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়লো। এদিকে ছাগলটার চোখদুটোও যেন বুঁজে এলো – না ঘুমে নয়, আবেশে আর বোধহয় সঞ্চিত খাদ্যের ভাণ্ডার চোখের সামনে দেখে। আহা, এ হেন দৃশ্যের সঙ্গে কিঞ্চিৎ আবহসঙ্গীত হলে জমতো ভালো। আরে হ্যাঁ, আছেও তো – মুখ দিয়ে চিবোনোর একটা পচর পচর শব্দ। দর্শনেন অর্ধভোজনং – তাই সুমনও প্রায় অপলক নেত্রে দেখতে লাগলো এমন মাধুর্যমণ্ডিত দৃশ্য।

কিন্তু, ও কি! ছোট হয়ে আসা ভুট্টার খোসাটা একটু যেন বড় হয়ে উঠলো। আরে, এ কি ব্যাপার! সেই সঙ্গে একটু যেন মোটাও হয়ে উঠলো। পলকহীন চোখের ক্লান্তি এড়াতে পাতা জোড়া একটু ফেলতে যাচ্ছিল সুমন, কিন্তু তারা ঐ পড়ন্ত অবস্থাতেই থেকে গেলো। ভুট্টার ছোট্ট খোসাটা দেখা গেলো দিব্যি একটা বইয়ের চেহারা নিলো, সে নিজে যে বিষয়ের মাষ্টার সেই পাঠ্য বইএর অর্ধেকটা বোধহয় ছাগলটার জিভের টানে তার মুখের মধ্যে চলে গেছে। ঐ তো, ছাগলটার গলার নলিটা নড়ছে – গলার দিক থেকে পেটের দিকে একটা ফোলা ভাব অগ্রসর হচ্ছে। সেই সঙ্গে সুমনের মনের মধ্যেও একটা বিস্ময় যেন ধীরে ধীরে একটা আশ্বস্ততায় রূপান্তরিত হতে থাকলো। শিক্ষা বিস্তারের খাতিরে কত শত বই জন্মগ্রহণ করেছিলো। তারপরে তারা তাদের উদ্ভিন্ন যৌবন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে উন্মুক্ত করবার জন্যে আকুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকতো। যাক, তাদের মধ্যে অন্ততঃ একটা বইও যে ঐ ছাগলটার উদরে প্রবিষ্ট হচ্ছে এটাও যথেষ্ট আনন্দের। আরও আনন্দ ছাগলটা সুমনের পড়ানোর বই মনের সুখে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। বই ছাপানোর কালির অজৈব রং যদি ছাগলটা কোনও প্রকারে ত্যাগ করতে পারে তাহলে বইয়ের কাগজের জৈব পদার্থ অবশ্যই তার প্রাণ ধারণে কৃতকার্য হবে। যে উদ্দেশ্যেই বইটার জন্ম হয়ে থাকুক, অপরের জীবন রক্ষার্থে এই যে তার জীবন দান এ ও তো এক মহৎ কার্য। বাহ্, খাসা ব্যবস্থা – শুধু সাদা কাগজে সই করা চাকরির হাজিরা হিসাবে গণ্য হবে কিনা এই দুশ্চিন্তার অন্ততঃ অবসান ঘটলো। আশা করা যেতে পারে ছাগলটা ‘ব্যা’ ডাক ছাড়াও দু-চার পিস ‘শিক্ষা’ শোনাতে পারবে।

আ ম’লো যা! জেগে আমি এসব কি চিন্তা করছি – সুমনের মাথায় এই ভাবনাটা খেলে গেলো। তার চেয়ে ট্রেন আসার আগে যেটুকু সময় পাওয়া যায় তাতে একটু ঝিমিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু নাহ্, ঠিক নিশ্চিন্ত মনে ঝিমোতে পারছিলো না সুমন। ছাগলটার চিবোনোর ঐ পচর-পচর আওয়াজটা কানে বাজতে থাকলো। আর ঐ চিবোনোর দৃশ্যটাও বন্ধ চোখের সামনেই দিব্যি ফুটে উঠছে। তবে হ্যাঁ – ছাগলটা ভুট্টার খোসাই চিবোচ্ছে। নাকি সেই বইটাই। কিন্তু ও কি হচ্ছে? ছাগলটার শিং দুটো কেমন যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে! তাই তো! আরে ছোট হতে হতে একেবারে যে মিলিয়ে গেলো। ঐ যাঃ, কান দুটোও যে ক্রমশঃ ছোট হয়ে যাচ্ছে! এ কি সর্বনেশে কাণ্ড রে বাবা? সুমন বন্ধ চোখ দুটো আরও চেপে বন্ধ করলো। ফলে ঘটলো ঠিক উল্টোটা। দৃশ্যটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আরে, এবার যে ছাগলটার মিহি দাঁড়িগুলো আরও বড় আর ঘন হয়ে উঠছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ – নাকটাও যেন ঠোঁট ছেড়ে একটু ঠেলে উঠলো। তাজ্জব ব্যাপার, নাকের তলায় আবার দিব্যি পুরুষ্ট এক জোড়া গোঁফও ঝুলে পড়লো। সুমন ঠাহর করতে পারলো – আরে, এ মুখ তো আমার চেনা, নিত্যি দেখা – আয়নাতে। হ্যাঁ, এ তো সুমনের নিজেরই মুখ। চোখ বুজে সুমন দিব্যি ভুট্টার খোসা চিবোচ্ছে। বাহবা, এ যে ভারি মজার কাণ্ড। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে খাওয়াটা বেশ রসিয়েই হচ্ছে।

ঐভাবে খেতে খেতেই হঠাৎ সুমনের মনে হলো যে মুখের খাদ্য প্রায় নিঃশেষিত। আর কি কিছু জুটবে না? সন্দেহটা দানা বাঁধতেই সুমন চোখ দুটো খুললো, দৃষ্টি পড়লো ছাগল থেকে পরিবর্তিত নিজেরই মুখ থেকে ঝুলে থাকা ভুট্টার খোসার অংশটুকুর ওপর। আরে, কি যেন একটা লেখা আছে তার গায়ে। ঠিক ঠাহর করতে পারলো না, তবু মনে হলো ‘অশিক্ষা’ ধরনের কিছু একটা শব্দ। একটু গবেষণা করে বোঝার উপায় রইলো না, সুশিক্ষিত জিভ ততক্ষণে তাকে মুখের ভেতরে ঠেলে দিয়েছে। এরপর একের পর এক ক্রেতা এসে ভুট্টাওয়ালীর সামনে দাঁড়াচ্ছে। ক্রেতারাই ভুট্টা বাছাই করে খোসা ছাড়িয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে সুমনের মুখের সামনে। আর আগুনে সেঁকা বাদামী-লাল ভুট্টা ভুট্টাওয়ালী তুলে দিচ্ছে ক্রেতার হাতে। সুমনের নজরে পড়লো একগুচ্ছ খোসার গায়ে ‘দুর্নীতি’ শব্দটা লেখা, আর তার দোসর সেঁকা ভুট্টার গায়ে লেখা ‘নৈতিকতা’ শব্দটা। এরকমই পরস্পর বিরোধী কথার ফুলঝুরি যেন ঝরতে শুরু করেছে খোসা আর ভুট্টার গায়ে। সুমন দেখলো যে ভুট্টাওয়ালীর ঝুড়িটা বেশ রংচঙে, চকচকে আর তার গায়ে লেখা আছে – নিজে খান, অপরকেও খাওয়ান। বাহ্! ভুট্টাওয়ালীর ব্যবসায়িক বুদ্ধি তো যথেষ্ট প্রখর।

সুমন লক্ষ্য করলো যে তার দাতার সংখ্যাও ক্রমশঃ বাড়ছে। কি কাণ্ড! অচেনাদের ভিড়ে চেনারাও আছে দেখা যাচ্ছে যে! ঐ তো তাদের কলেজের অমুকবাবু। আরে, পাড়ার তমুকদাদাও আছে তো! দেখো দেখি কাণ্ড! ঐ ফাঁক দিয়ে যে তার আত্মীয়া হেমুকমাসিকেও দেখা যাচ্ছে। এ জনস্রোতের বিরাম নেই নাকি রে বাবা? এত খেলে তো তার শুধু বদহজমই হবে তাই নয়, পরলোক প্রাপ্তির সম্ভাবনাও প্রবল। না, না। ঐ তো আশার আলো উঁকি দিচ্ছে। শেষ আছে, শেষ আছে ভুট্টাওয়ালীর ভুট্টা আর তার সঙ্গে এ মানবসাগরেরও। কিন্তু শেষজনকেও কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। দূর থেকে ঠিক ঠাহর করা না গেলেও তার দাড়ি-গোঁফ কেমন যেন চেনা। হ্যাঁ, ঠিকই তো! এ মুখও তো তার রোজ দেখা – আয়নায়। আরে, এ মুখ তো সুমনের নিজেরই। এমন মজার কাণ্ড তো সুমন এর আগে আর কখনও দেখেনি।

এই রহস্য নিয়ে সুমন একটু গবেষণা করতে যাবে, সেই সময় হঠাৎই বাধা পড়লো। প্ল্যাটফর্মের মাইকে ঘোষণা হলো – ‘শিয়ালদহ যাওয়ার লোকাল ট্রেন হাবরা ছেড়ে আসছে।’
কি বললো? ‘পরলোক যাওয়ার ট্রেন আসছে।’
সুমন ধড়মড় করে উঠে পড়লো তন্দ্রাভাব কাটিয়ে। না, ভয়ের কিছু নেই। সুমন নিজের বাহুমূলে চিমটি কেটে টের পেলো এখনও সে জীবিত আছে এবং দিব্যি বেঞ্চে বসে আছে। আর পাশে ঐ তো একটু আগে ভুট্টার খোসা চিবোতে থাকা ছাগলটাও আছে, তবে সে এখন মুখে কিছু চিবোচ্ছে না। বদলে সুমনই চিবোতে চিবোতে হাঁটা শুরু করলো প্ল্যাটফর্মের উপযুক্ত জায়গায় দাঁড়ানোর অভিপ্রায়ে।
হ্যাঁ, চিবোতে লাগলো ঘুগনী-রুটি খাওয়ার পর মুখশুদ্ধি হিসাবে গালে ফেলা আমলকির টুকরোটা।

Sahityika Admin

1 comment

  • বেশ মজাদার লেখা।
    লেখকের হিউমার সেন্স অসাধারণ