সাহিত্যিকা

সানতানার কড়চা

সানতানার কড়চা
@শান্তনু দে, ১৯৮৯ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

এক – ল্যাদ
কলেজে গিয়ে বেশ অনেক নতুন প্রতিশব্দ/বাগধারা শিখেছিলাম। তার মধ্যে একটা হলো ল্যাদ, মানে আলসেমি … খুব সম্ভবতঃ lethargy থেকে উৎপন্ন। lethargy থেকে তো লেথ হওয়া উচিত, তাহলে ল্যাদ কেন! কারণ বোধ হয় লেথখোরকে লাথখোর শোনাতে পারে, তাই লেথ হয়েছে ল্যাদ।

আমরা কলেজে টু ডাইমেনশনাল মাছের টুকরো, জামদানি শাড়ির মতো পাতলা ফিনফিনে ডাল যেমন খেতাম, তেমনি সস্তা সিগারেটও খুব খেতাম। আর রাতের শেষ সিগারেটটা বিছানায় হেলান দিয়ে খেতে খেতে ঘুমচোখে, মাঝে মাঝে হাত থেকে খসে মেঝেতে পড়ে যেত। ওটা আর তুলতাম না। এটা এক ধরনের সঞ্চয়ও ছিল। সিগারেট দুর্ভিক্ষের সময় খাটের তলা খুঁজলে বিস্তর আধ-ফোঁকা সিগারেট পাওয়া যেত। আরেকটি স্মৃতি। আমি ফোর্থ ইয়ারে রিচার্ডসন হলে থাকতাম। একবার ঘরের বাল্ব কেটে যাওয়ায় প্রায় তিন মাস লাগাই নি। টেবিল লাম্প দিয়েই ম্যানেজ করতাম। তারপর সেটাও কেটে গেলে বাধ্য হয়েই দুটো বাল্ব কিনতে হয়েছিল।

এখনো ল্যাদ খেতে খুব ইচ্ছে করে, বিশেষত সপ্তাহান্তে, সারা সপ্তাহ দৌড়ঝাঁপ করে শরীর আর দেয় না। ইচ্ছে করে চুপচাপ সোফায় তাকিয়া -টাকিয়া সহযোগে বসে থাকি। তবে ভুক্তভোগী মানেই জানেন রবিবার কাজ কিছু কম থাকে না। বাজার করো রে, ফ্যান-এ সি পরিষ্কার করো রে, হ্যান করো, ত্যান করো। তা এতসব কাজ করার জন্য একটা ম্যান ফ্রাইডে পেয়েছি। পাওয়াটাও বেশ কাকতলীয়। আমাদের একটা উঁচু কাঠের টুল ছিল। বাল্ব চেঞ্জ করতে, ফ্যান পরিষ্কার করতে কাজে লাগতো। একবার ওটা ভেঙ্গে গেলে ,দু তিনমাস সারানোর কোনো উদ্যোগই নিই নি। যদি এইভাবেই আরও কিছুদিন ল্যাদ খাওয়া যায়।

এই সময়ে এলো মোহাম্মদ আলী, ইলেকট্রিশিয়ান কোনো একটা অন্য কাজে। যে হেতু এর উচ্চতা বেশ বেশী, প্রায় সাড়ে ছ ফুট… একে দিয়েই বাল্ব চেঞ্জ আর ফ্যান পরিষ্কার করিয়ে নেওয়া হলো, কোনোরকম টুল ছাড়াই। সে তেলুগু ছেলে তবে হিন্দিও ভালো বোঝে। হাতের কাজও বেশ পরিষ্কার।তা গত রবিবার কী একটা কাজে ফোন করেছিলাম… ওর মেয়ে ফোন তুলে বললো, “বাবা ব্যস্ত আছে… রেকর্ডিং করছে।” শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বৌ’কে বলতেই, শুনলাম আমার নাকি কানটাও গেছে। কী শুনতে কী শুনেছি।

যাই হোক ঘন্টা খানেক পরে আলী-সাহেব সশরীরে হাজির। জানা গেল, আমাদের মোহাম্মদ আলী নাকি একজন গায়ক। স্টার মেকার না কী একটা বস্তু আছে, সেখানেই গানের রেকর্ডিং করছিল। ইউ টিউবে ও আর ওর ভাই-এর প্রায় ছ হাজার ভিডিও আছে। সোফায় ঠ্যাং-এর উপর ঠ্যাং তুলে বসে চা -জল খাবার খেতে খেতে ওর নজর পড়লো আমার সদ্য কেনা ব্লু টুথ স্পিকারের দিকে। নিজেরই গান ভালো করে প্রায় ঘন্টাখানেক সেটায় শুনে আলী সাহেব সার্টিফিকেট দিলেন যে জিনিসটা খাসা। তারপর যা হলো তার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। বললো, “স্যার, এটা আমায় দিয়ে দিন। আপনি তো শুধু শোনেন, গাইতে তো পারেন না। বুঝতেই পারছেন আপনার থেকে আমার দরকার অনেক বেশী। আর আপনার বিস্তর সিডি আছে ,ভালো সিডি প্লেয়ার আছে…আপনার মতো সমঝদারের এই ব্লু টুথ স্পিকার মানায় না।”

কী করে বোঝাই ,সিডির দাম বিস্তর বেড়ে গেছে ,পাওয়াও যায় না। সি ডি কিনতে গেলে অনাহারে না হলেও অর্ধাহারে থাকতে হতে পারে। তারপরও অনেক লজিক টজিক দিলো। কিন্তু আমি একদম ঠিক করে রেখেছিলাম, মনটাকে নরম হতে দেব না… রাহুল দ্রাবিড়ের মতো একদম দেওয়াল হয়ে থাকবো। পরের সপ্তাহে পেরেছি।
আজ আবার রবিবার…খুব টেনশনে আছি। কী হয় ,কী হয়।

******

দুই – দুর্গাপূজার রচনা
ছোটবেলায় পুজোর ছুটির পরে স্কুল খুললে বন্ধুদের মধ্যে কয়েকদিন জোর আলোচনা হতো ,পুজোর ছুটিতে কে কি করলাম তাই নিয়ে। কোন কোন বছর বাংলা স্যার তো রচনাও লিখিয়েছেন “পুজোর ছুটিতে আমি কী করিলাম” এই শিরোনাম দিয়ে। বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা আর রচনার মধ্যে প্রভেদ থাকতো কারন অনেক আলোচনাই রচনায় এলে টিসি খাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। একদম বালক বয়সে ক্যাপ বন্দুক নিয়ে আলোচনা হতো, পুজোর ঠাকুর দেখা, কার কটা জামা প্যান্ট হলো, কার প্রথম ফুল প্যান্ট হলো ইত্যাদি। ক্লাস সেভেনে উঠতে প্রাকৃতিক কারনেই আলোচনা অতোটা নির্দোষ থাকতো না।

পুজো শেষ, তাই ভাবলাম রচনাটা লিখেই ফেলি।
এবার পুজোয় উত্তরাখন্ড যাওয়ার প্ল্যান ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে পারি নি। ব্যক্তিগত কারনে সেই প্ল্যান ক্যানসেল করে গিয়ে পৌঁছলাম ব্যাঙ্গালোরে, ছেলের কাছে। দিন দুয়েক পরে প্রবলেম কিছুটা কন্ট্রোলের মধ্যে এলে এবারের পুজোটা খারাপ কাটলো না। যে পুজোটা দেখলাম সেটা হচ্ছে এইচ এস আর লে আউট-এ বর্ষা বা (ভরসা?)। পুজোর নাম কেন বর্ষা হবে তা নিয়ে আধ ঘন্টা ভেবেও কুল কিনারা বের করতে পারি নি।

ব্যাঙ্গালোরে শুনেছি অনেক বড় বড় পুজো হয়। তা এই পুজোয় (আমার কোনো ধারণাই নেই এটা বড় না ছোট পুজো), সপ্তমীর সন্ধ্যেবেলা দেখলাম দেদার ভিড়। এখানেই যদি এই হয় তো কলকাতায় কী হচ্ছে ভাবতেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। পাশেই একটা বিশাল মঞ্চ তাতে এক ভদ্রলোক গান গাইছেন… উনি নাইনটি’জ স্পেশালিস্ট মনে হয়… চিরদিনই তুমি যে আমার, তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণ যাত্রা, ইয়ে কালে কালে ইত্যাদি শুনে বেশ খিদেই পেয়ে গেল। বাঙালি রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার আমার প্রস্তাব আস্থা ভোটে খারিজ হয়ে গেল। গেলাম এক বিখ্যাত ইতালিয়ান রেস্তোরাঁয়। আমি ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলাম, (বাংলাতেই করলাম কারন ছেলেটিকে দেখেই বুঝলাম বাঙালি) তোমাদের এখানে সিগনেচার ডিশ কোনটা ? এখানে বলে রাখি আজকাল বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ কর্মচারী দেখি হয় বাঙালি নয় তো উত্তর-পূর্ববাসী। আমার স্ত্রী চেনাশোনা কিছু খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আমি ব্যক্তি-স্বাধীনতা নিয়ে তিন মিনিট ভাষণ দিয়ে, সেই সিগনেচার ডিশ আমার জন্য অর্ডার করলাম.. বলাই বাহুল্য আমার স্ত্রী বা ছেলে অচেনা পিচে ব্যাটিং করতে রাজি নয়। তাই শুধু আমার জন্য এলো সেই সিগনেচার ডিশ। সেই এক ধরনের পাস্তা পাওয়া যায়, ফিতের মতো …Fettuccine না কি একটা বলে সেটাই পালং শাক বাটা দিয়ে সেদ্ধ করে গুচ্ছ চিজ, বেকন আর চিংড়ি দিয়ে রান্না করেছে। বউ আর ছেলের মিটিমিটি বা কখনো উচ্চকিত হাসির মধ্যে সেই পাস্তা-পালং পেটস্থ করলাম।

তারপর সেই রাতে আমার অবস্থা হলো এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মতো… ক্রিজে (টয়েলেটে) যাচ্ছি আর আসছি। কিন্তু আমি এই সব অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকি। টপ করে norflox tz খেয়ে অবস্থা সামাল দিলাম। পরের দিন সন্ধ্যেবেলা আবার সেই বর্ষা (বা ভরসা) পুজোয়। আজ আসছেন অঞ্জন দত্ত সঙ্গে গিটারে অমিত দত্ত। যারা আমার সমসাময়িক তারা হয়তো শিবা নামের রক ব্যান্ডের নামের সাথে পরিচিত। উনি সেই ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট ছিলেন। অমিতবাবু নাম লেখেন (Amyt)…কিন্তু এই বয়সেও বাজান অনবদ্য। অঞ্জনবাবু খুব বিনয়ের সাথে বললেন যে ওঁর সৌভাগ্য যে অমিত দত্তের সাথে গাইতে পারছেন। খুব একটা ভুল বলেন নি কিন্তু এই বিনয় আর পুরনো নস্টালজিয়ায় ওঁর গানও আমার বেশ লাগলো।

পরের দিন টার্গেট ইন্দিরা নগরের বিখ্যাত পুজো। কিন্তু রাস্তায় এত জ্যাম যে পৌঁছতেই পারলাম না। চলে গেলাম চার্চ স্ট্রিট। সন্ধ্যাবেলায় চার্চ স্ট্রিটের পরিবেশ বেশ মায়াবী। ব্লসমস এর পাশের কফি শপে বসে কফি খেয়ে ব্লসমস এ ঢুঁ মারলাম। পেয়ে গেলাম রিডার্স ডাইজেস্ট পাব্লিকেশনের হার্ড কাভার এডিসনের শার্লক হোমস এর তিনটে বই… পুরনো কিন্তু একদম নতুনের মতো .. দেখে বোঝার উপায়ই নেই যে পুরনো… যেমন পেপার কোয়ালিটি সে রকম ছাপা। এবারের পুজোয় এটাই আমার কেনাকাটা। আমার ছেলে কিনলো নিটজের একটা ফিলসফির বই। (ওর বাড়িতে এরকম কিছু বই আর মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস পাওয়া যায় …ফিলোসফি, anthropology বা প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাস, গিটার, ইলেকট্রিক গিটার, বিশাল বড় একটা কি বোর্ড। পড়ে না, বাজায়ও না। হয় তো ভবিষ্যতে কোনদিন গার্ল ফ্রেন্ডকে ইম্প্রেস করার জন্য কাজে লাগতে পারে বলে কিনে রাখে।)…

এবারে খাওয়া পার্সি রেস্তোরাঁয়। নাম সোডাবটলওপেনারওয়ালা…অপূর্ব ইনটিরিয়র, একটা না চলা jukebox অবধি আছে। খেলাম ছেলের সাজেশন অনুযায়ী ধানসাক (কনফার্ম করে নিয়েছিলাম পালং শাক ইত্যাদির ব্যাপার নেই) ও ক্যারামেল পুডিং। খাবার বেশ ভালো।

পরের দিন ছেলের অফিস তাই একাই চলে গেলাম আই এস এল এর ম্যাচ দেখতে। খুব সুন্দর আরেনজমেন্ট কিন্তু মাঠে মাত্র সাত হাজার লোক। গোয়া বনাম বেঙ্গালুরু এফ সি। খেলা বেশ ভালো হলো কিন্তু গোল হলো না। সুনীল ছেত্রীকে সেই প্রথমবার মাঠে দেখলাম।

দশমীর দিন একটি বাংলা সিনেমা দেখা উচিত মনে হলো, দেখলাম দশম অবতার… এটা বাইশে শ্রাবণের প্রিকোয়েল। যদি অন স্ক্রিন অনবরত খিস্তি শুনতে প্রবলেম না থাকে, আর প্লটে সহস্র ফুটো আপনাকে বদার না করে তাহলে দেখতে পারেন… অনির্বান, প্রসেনজিত, জয়া হাসান এর অভিনয়ের জন্য আর রিলকের লেখা একটা কবিতার অনুবাদের জন্য।ওভার অল আমার রেটিং ৮/১০ ।

যাই হোক আমার চা জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল,এবার নিজেই এক কাপ করে নি।

******

তিন – নামের মাহাত্ম্য
ঠাকুর্দা, আমার নাম রেখেছিলেন জ্ঞানদারঞ্জন। মা, কাকীমা এদের সে নাম পছন্দ ছিল না, নাকি বড্ড সেকেলে। তা ছাড়া ভয়ও ছিল যে এই জ্ঞানদা নাম নিয়ে মাধ্যমিকে দু বার গাড্ডা খেলে বা সামান্য ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস না করতে পারলে, ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ এফেক্ট আসতে পারে। তাদের আশঙ্কা পুরো অমূলক না হলেও খুব একটা ভুল ছিল না। কিন্তু তার পরিবর্তে যেটা নাম রাখলেন সেটা এতই ছোট, যে শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। এমনিতেই সিঙ্গল সিলেবল পদবী নিয়ে দুঃখের শেষ নেই। ছোটবেলায় বাবাকে সাজেশন দিয়েছিলাম, ‘দে’ পদবী কিছু বাড়ানো যায় কি না…দে রায় বা দে সরকার বা দেহাতি। সুবিধে হয় নি।

এই না হওয়া নাম, মানে জ্ঞানদারঞ্জন নিয়ে মনে আছে আমার মনে বেশ দুঃখ ছিল। ছোটবেলা থেকেই বড় নাম নিয়ে আমার ফ্যাসিনেশন… পেলের আসল নাম ছিল এডসন আরান্তেস দি নাসিমেন্টো। কী মিষ্টিই না লাগতো নামটা… আহা কবিতার লাইন যেন একটা। কর্মজীবন কাটছে এমন জায়গায় সেখানে নাম শুরু হলে আর শেষ হয় না। আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নাম, পামুলাপার্থী ভেঙ্কটা নরসিমহা রাও এখানকার হিসেবে বেশ ছোট। তেলুগুদের এত বড় বড় নাম হয় যে সংক্ষেপে A to Z বলে ডাকার চল আছে।

আমার ফোনে A to Z Murthy, A to Z Srinivas এই সব নাম সেভ করা আছে। সব থেকে হাইট হলো, এখানকার একটা স্টেশন আছে,তার নাম ভেঙ্কটানরসিমহারাজুভারিপেটা। যাই হোক আমাদের বংশে এক নতুন অতিথির আগমন হয়েছে। ফ্যামিলি হো আ গ্রূপে (যেখানে সবাই সকালে গুড মর্নিং আর রাতে গুড নাইট সম্বলিত বাণী দেয়) নাম রাখা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বাবা, মা দুজনেরই নাম ‘র’ দিয়ে শুরু, তাদের ইচ্ছে বাচ্চার নামও তাই হোক। আমি কতগুলো নাম সাজেস্ট করলাম… রামকানাই (ঠিক আছে এটা না হয় বাদ দিলাম, স্বয়ং রবি ঠাকুর নামটাকে একটু কালিমালিপ্ত করে গেছেন), রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, রমণীমোহন (ছোকরা বেশ হ্যান্ডসাম হয়েছে), রামকৃষ্ণ, রবাহূত (এটার মানে খুব একটা সুবিধের নয়, কিন্তু এদের জেনারেশনে কেই বা এই সব শব্দের মানে জানবে?), রাসপুটিন (পুটিনের থেকে খারাপ নয় মোটেও) থেকে শুরু করে রবিন উইলিয়ামস, রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, রেইন এন্ড মার্টিন। কিন্তু এদের এসব নাম পছন্দ হলো না।
যাক হে যাক, যা ইচ্ছে নাম রাখুক,আমার কী।

******

চার – দাঁত
অতীনবাবু সত্তরে পড়েছেন। দক্ষিণ কলকাতার কোন এক আবাসনে দু কামরার ফ্ল্যাটে থাকেন। অবসর গ্রহণের পরেও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে কচুরি আর জিলিপি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে রসগোল্লা সন্দেশ আর মিষ্টি দই কিনে নিয়ে আসেন আর সারা দিন একটু একটু করে খান। না ওঁর ডায়াবেটিস নেই। সারা দিন ফেসবুকে গল্প লেখেন। কল্পনাপ্রবণ মানুষ। কথিত আছে ওঁনার গল্পে গরু শুধু গাছেই ওঠে না, সেই গরু নারকেল গাছে চড়ে ডাব পেড়ে কেটে স্ট্র দিয়ে খায় বা সাঁতরে সাত সমুদ্দুর পার হয়ে ইংল্যান্ডে প্রিমিয়ার লিগে দেখতে যায়।

এরকমই এক দিন, অতীনবাবু রসগোল্লা খেতে খেতে গল্প লিখছেন, গল্পে গরু সবে “দু হাতে দুই পিস্তল নিয়ে, অন্য হাতে টর্চ নিয়ে এক টানেলের মধ্যে এক সিরিয়াল কিলারকে ধাওয়া করেছে। ঘড়িতে তখন ঢং ঢং করে রাত একটা বাজলো। ইত্যাদি।

“রসগোল্লা খেতে খেতে মুখে শক্ত কী একটা পড়লো। বের করে দেখলেন একটা দাঁত …মানুষেরই দাঁত। অন্য মানুষ হলে ভয় ঘেন্না ইত্যাদি ইমোশনের জোয়ার বয়ে যেত…কিন্তু অতীনবাবু অন্য ধাঁচে গড়া। ভাবতে বসলেন এই দাঁত নিশ্চয়ই রসগোল্লা কারিগরের, বুড়ো মানুষ হয় তো, বানানোর সময় টুক করে খুলে পড়েছে টেরই পায় নি। মোবাইলে ফোন নম্বর দেখে দোকানের মালিককে ধরে প্রথমেই চেঁচামেচি না করে, শান্ত স্বরে রসগোল্লা শিল্পীর বয়েস জানতে চাইলেন। জানা গেল শিল্পী পল্টুর বয়েস মাত্র তিরিশ। কল্পনাপ্রবণ অতীনবাবু মানসচক্ষে দেখতে পেলেন, পল্টু মারামারি করে দাঁত ল্যুজ করে ফেলেছে, তারপর সেই দাঁত রসগোল্লা বানানোর সময় কোনো ভাবে খুলে পড়ে গিয়ে ,ছানার সাথে মিশে গেছে।

জানা গেল ,পল্টু জাত শিল্পী মানুষ… অবসর সময়ে ছবি এঁকে ফেসবুকে পোস্ট করা ছাড়া অন্য কোন হবিই নেই,মারামারি করার হবি তো নেইই। অতীনবাবু আবার কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিলেন… এবার অবশ্য হেল্প পেলেন কয়েকদিন আগে দেখা লাইফ অফ পাই সিনেমা থেকে। ভাবলেন সিনেমায় যেমন আপেলের মধ্যে দাঁত পেয়ে পাই বুঝতে পারে গাছটা কার্নিভোরাস …সেরকমই হয়তো গরু যে ঘাস খেয়েছে বা গাছের পাতা খেয়েছে সেই গাছ কার্নিভোরাস।

এইরকমই সাত পাঁচ ভাবছেন…তখনই বেল বাজলো আবাসনের ইস্ত্রিওয়ালা রামসদয় এসেছে। রামসদয় ঘরে ঢুকে সোফায় গ্যাট হয়ে বসে অন্য দিনের মতোই গল্পগাছা করতে থাকে। আজ জিজ্ঞেস করলো ,”ভোম্বলদা আজ চুপচাপ কেন? গল্প আসছে না?”
অতীনবাবু ওরফে ভোম্বল ,সমস্যার কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই রামসদয় চেঁচিয়ে ওঠে, “ভোম্বলদা তোমার দাঁত!”

*******

পাঁচ – রামের সাথে আলাপ
বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা।
বৃষ্টিস্নাত দিন। সকাল থেকে অঝোরে ঝরে, তখন ‘টিপটিপ বরসা পানি’।
সল্টলেক পিএনবির মোড় থেকে বই-এর স্টল দেশ আর পূজা-বার্ষিকী আনন্দমেলা কিনে বি-এ/বি-বি র মাঝখানের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটছি। ইচ্ছে… যতটা পারি হেঁটে তারপর একটা রিকশা নিয়ে সিটি সেন্টার। তারপর দু’নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে এক মাসীর অস্থায়ী খাবারের স্টল। কাঠের বেঞ্চে বসে একটা লাল চা আর কিং সাইজের অর্ডার দিয়ে, দেখি পাশেই একটি ছেলে বসে গোগ্রাসে ঘুগনি-মুড়ি খাচ্ছে, রাস্তার উপরে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে… খাওয়া প্রায় শেষ। খাওয়ার ধরন দেখেই বুঝলাম, পেট সেরকম ভরে নি।
বললাম, ‘মাসী, এই ভাইকে একটা ডবল ডিমের মামলেট দেবেন।’
ছেলেটা চমকে উঠে,-‘তুই কে বা#,আমার জন্যে খাবার অর্ডার করছিস?’
আমি একটু আমতা আমতা করে, ‘ইয়ে মানে, এখন আমি আপনার কেউ নই ঠিকই, কিন্তু আপনার খাওয়া শেষ হলে আমি আপনার রিকশায় চাপবো। আপনার খাওয়া দেখে ভাবলাম যে খুব খিদে পেয়েছে তাই … তা ছাড়া অনেকটা রাস্তা যেতে হবে তো।’
আপনি সম্বোধনেই হোক বা অন্য কোন কারণেই দেখলাম ছেলেটা বেশ নরম হয়ে গেল… হেসে বললো, ‘আমারটা ই-রিকশা, চালাতে পরিশ্রম খুব একটা নেই।’

ভাল করে দেখি, সত্যিই কী সব মোটর -ফোটর লাগানো। যাই হোক ছেলেটার সাথে আলাপ জমে উঠলো। নাম বললো, রাম মন্ডল। মিনিট পনেরোয় যা জানা গেল তা এরকম, ওর ভাষ্যেই বলি…
“স্যার, আমি রাম মন্ডল। রিকশা চালাই। পাশেই দত্তাবাদের বস্তিতে থাকি। আমার ভাই, লক্ষণ মন্ডল। যাদবপুরে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ে, ফাইনাল ইয়ার। ষোল বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ায়, তখন থেকেই আমি রিকশা চালাই। বাবা আমার মা’কে খুব ক্যালাতো, তাই মা আমার খুব ছোটবেলায় পালিয়ে গেছে। যাই হোক আমার পড়াশোনা আর হয় নি। কিন্তু রিকশা চালিয়েই ভাইকে পড়াশোনা শিখিয়েছি। খুব ভাল পড়াশোনায়। এখন আর আমার উপর চাপ নেই। ওর খরচ ওই চালিয়ে নেয়।”
শুনে আমার খুব ভালো লাগলো, ‘বাহ, বেশ তা ই-রিকশা কিনলেন কী ভাবে। শুনেছি অনেক দাম।’
– কোম্পানির মাল হলে প্রায় এক লক্ষ টাকা। কিন্তু এটা লোকাল-মেড, পঞ্চাশ হাজারেই পেয়ে গেছি। আমার ভাই এই গরমকালে ব্যাঙ্গালোরে ট্রেইনিং করতে গেছিল, দু’মাসের জন্য বড় সাহেবী কোম্পানিতে … তাঁরা অনেক টাকা দিয়েছে স্যার, ট্রেইনিং পিরিয়ডেই। চাকরীও দিয়ে দিয়েছে … এই তো আসছে জুনেই জয়েন করবে। ওই টাকা দিয়েই সে কিনে দিল।’
-‘এই ই-রিকশা চালিয়ে কত হয় মাসে?’
-‘প্রায় পনের ষোল হাজার টাকা হয়ে যায় মাসে দাদা। মোটরে চলে তো, অনেক ট্রিপ মারা যায়।’
-‘পুরো টাকাটাই খরচ হয়ে যায়?’
-‘না স্যার। মাসে হাজার টাকা একটা রেকারিং খুলেছি ব্যাংকে। ওটা রিকশার মেইন্টেননেসের জন্য। আর দু হাজার টাকা দুটো সিপ-এ লাগিয়েছি।’
-‘বাহ, খুব ভাল। কিন্তু দু হাজার টাকা সিপ-এ কেন? বিয়ের জন্য? গার্ল ফ্রেন্ড আছে ?”
ঈষৎ লজ্জা পেয়ে, ‘আছে স্যার.. অপর্ণা। ও একটা আয়া সেন্টারে কাজ করে। আমরা দুজনেই পয়সা জমাচ্ছি। ও ফেলুদার খুব ভক্ত। তাই বিয়ের পর, ফেলুদা যেখানে যেখানে গেছিল, সেখানে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান আছে… বেনারস, জয়সলমির, মুম্বাই, গ্যাংটক, দার্জিলিং।’

সিটি সেন্টারে পৌঁছে ,ছেলেটার হাতে পাঁচশ টাকা দিয়ে বললাম , ভাই বেনারসে গিয়ে তোরা আমার কথা ভেবে ভরপেট রাবড়ি খেয়ে নিস।’

******

ছয় – সিনেমা তৈরির হাঁড়ির খবর
সারা ভারত ঘুরে বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে কলকাতায় পৌঁছলেন। পয়সা কড়ির খুব টানাটানি। থাকতেন গড়িয়াহাটের দিকে এক কামরার এক ফ্ল্যাটে। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সবই উল্টো দিকের মাসির দোকানে।

আমাদের শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তখন আনন্দবাজারে সবে চাকরি পেয়েছেন। নাইট শিফ্ট করে ফেরার সময়ে ওই একই মাসির দোকানে বাপুজি কেক বা ঘুগনি মুড়ি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করতেন। তখনই বিদ্যাধর আর শ্যামলের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব মতো গড়ে উঠলো। তখন গড়িয়াহাট এখনকার মতো জমজমাট নয়। চারদিকে নতুন নতুন বাড়ি হচ্ছে। ঘুগনি মুড়ি খেতে খেতে বিদ্যাধর আর শ্যামল দেখতেন কাছেই একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ির তদারকি করছেন। আর মাঝেমাঝেই পরম মমতায় বাড়ির দেওয়ালে হাত বুলোচ্ছেন। বিদ্যাধর বললেন, “বুঝলে শ্যামল, ভদ্রলোককে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ছে। উনিও খুব কষ্ট করে আমাদের ত্রিনিদাদের বাড়িটা বানিয়েছেন। ভাবছি এই নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবো।” এই শুনে শ্যামল তো অবাক। কুবেরের বিষয় আশয়ের প্লট তো তখন ওঁর মাথায় ঘুরছে। তো ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ যিনি, পরবর্তী কালে ভি এস নায়পল নামে খ্যাতি পাবেন, আর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সেই উপন্যাসের প্লট, স্টাইল এই সব নিয়ে আলোচনা করতেন।

ভি এস ত্রিনিদাদে ফিরে গিয়ে লিখলেন “এ হাউজ ফর মিস্টার বিসওয়াস।” এদিকে শ্যামল লিখতে শুরু করলেন কুবেরের বিষয় আশয়। শোনা যায় ওই মাসির দোকানে আমাদের জর্জ বিশ্বাসও নাকি চা খেতে আসতেন। লেবু চা আর চার্মিনার খেতে খেতে গুনগুন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। গান শুনে ভি এস হয়ে গেলেন ওঁর বিশাল ফ্যান। একদিন মানিকদার বাড়িতে দেবব্রত ওঁকে নিয়ে যান। স্ত্রী বিজয়া নায়পলকে লুচি ও মোহনভোগ খেতে দেন। মোহনভোগ খেয়ে তো বিদ্যাধর যাকে বলে একদম আপ্লুত। তাই উপন্যাসের নায়কের নাম দেন, মোহন বিশ্বাস, আমাদের জর্জ’দা আর মোহনভোগ, দুজনেরই উদ্দেশ্যে ট্রিবিউট।

এরপর কয়েকবছর কেটে গেছে … এ হাউজ ফর মিস্টার বিশ্বাস বাজারে একদম হইচই ফেলে দিয়েছে। অন্যদিকে দেশ পত্রিকায় কুবেরের বিষয় আশয় ধারাবাহিক বেরোচ্ছে… কিন্তু এত ভালো উপন্যাস পাবলিক ততটা খাচ্ছেই না। তা সেই হাউজ ফর মিস্টার বিশ্বাস গিয়ে পড়লো লন্ডনের উঠতি মিউজিক কম্পোজার মন্টি নরম্যানের কাছে। এতো ভালো লাগলো বইটা যে ওই প্লট নিয়ে একটা মিউজিক্যাল কম্পোজিশন লিখে ফেললেন। তা সেই মিউজিক্যাল নোটস যখন দেখলেন আলবার্ট ব্রকোলি তখন জেমস বন্ডের বইগুলো নিয়ে সিনেমা বানাবেন ভাবছেন। ব্রকোলি মন্টি নরম্যানকে ডক্টর নো সিনেমার মিউজিক কম্পোজ করতে বললেন।

একদিন লন্ডনের এক পাবে ব্রকোলি আর মন্টি বিয়ার খাচ্ছেন, সেই পাবে ঢুকলেন,ভি এস নায়পল। দেখেই চিনতে পেরে মন্টি নরম্যান ওঁকে জড়িয়ে ধরলেন। কথায় কথায় উঠলো জর্জ বিশ্বাসের নাম। শুনে তো ব্রকোলি আর নরম্যান একদম ইম্প্রেসড। ঠিক করলেন ডক্টর নো সিনেমার আন্ডার দ্য ম্যাংগো ট্রি গানটা ওঁকে দিয়েই গাওয়াবেন। পর দিন সকালেই এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ধরে কলকাতায়। জর্জ বিশ্বাসকে অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্তু জর্জ বিশ্বাসের এক কথা- “ইংরিজিতে গাইমু না।” মন্টি ব্রকোলিকে অনেক বোঝালেন জেমস বন্ডের সিনেমায় রবীন্দ্র সংগীত রাখলে কিছু ক্ষতি হবে না বরং একটা নতুন টাইপের কিছু হবে। কিন্তু ব্রকলিসাহেব মানলেন না। শেষে মন্টি হতাশ হয়ে নিজের বউকে দিয়েই গানটা গাওয়ালেন। আর ডাক্তার নো সিনেমার যে থিম মিউজিকটা বানানোর কথা ছিল, সেটা ওই হাউজ ফর মিস্টার বিশ্বাসের একটা গান থেকে টুকে দিলেন।

সবকিছুর পর সে এতোই জঘন্য হলো যে সেটা কারোর কারোর পছন্দই হলো না। জন ব্যারিকে দিয়ে আবার রি-এরেঞ্জ করাতে হলো। গিটার, স্যাক্সোফোন আর আট নটা ব্রাস ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে যেটা এমন সুন্দর আর কালজয়ী ব্যাপার হলো যে ষাট বছর পরে এখনো অপরিবর্তিত আছে।

******

সাত – গর্ব
কয়েক বছর আগের ঘটনা
মানুষের গর্ব বা অহংকার একদমই থাকা উচিত নয়। কিসের গর্ব? অর্থের গর্ব, রূপের গর্ব, শিক্ষার গর্ব, রুচির গর্ব…. আর একটু মাইক্রো লেভেলে নামলে, বাংলা লিখতে বানান ভুল না করার গর্ব, আশি বছর বয়সে মাউন্ট এভারেস্টে চড়ার গর্ব, সত্তর বছর বয়সে ছ পেগ মাল খেয়ে আউট না হওয়ার গর্ব বা নব্বই বছর বয়সে পঞ্চাশটা সিগারেট খাওয়ার গর্ব।

কিন্তু এসব কেন লিখছি?
দু তিনদিন আগেই দিল্লি এয়ারপোর্টে এক বেশ বয়স্ক (আমি বয়স্ক লিখছি, তার মানে বয়সের গাছ পাথর নেই) ভদ্রলোক আমায় বললেন, ভাই আমার এই ব্যাগটা একটু দেখো, আমি একটু স্মোকার্স রুম থেকে আসছি।
প্রায় আধ ঘন্টা পরেও দাদুর দেখা নেই। সিকিউরিটিকে বলবো বলবো ভাবছি, এমন সময় উনি হাজির। এত দেরী হল কেন জিজ্ঞেস করত বললেন ,”অনেকক্ষণ সিগারেট খেতে পারবো না তো তাই এক সাথে পাঁচটা মেরে দিলাম।”
আমি : মিনিট দশেক পরে,একটু ধাতস্থ হয়ে,”স্যার আগের কোন জন্মে কি আপনি, পিরামিডের উপরে যারা পাথর ঠেলে তুলতো,তাদের দলে ছিলেন?”

Sahityika Admin

1 comment

  • সানতানার কড়চা আগেও অনেকবার পড়েছি। লেখকের হিউমার সেন্স অসাধারণ