সাহিত্যিকা

লস কাবোস, মেক্সিকো ভ্রমণ

লস কাবোস, মেক্সিকো ভ্রমণ
@কল্যাণ দাশগুপ্ত, ১৯৭২ ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

গত ১১ই নভেম্বর কল্যাণ দাশগুপ্ত আমাদের সকলকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন। যাওয়ার আগে এই লেখাটি আমাদের সাহিত্যিকা পত্রিকার জন্য দিয়ে গেছেন। সম্ভবত এটিই উনার কলমের শেষ লেখা। আমরা উনার আত্মার শান্তি কামনা করি।

আমার ছেলে আর বৌমা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল যে উত্তর আমেরিকার সর্বশেষ স্বাধীন দেশ মেক্সিকোর লস কাবোস-এ (Los Cabos), (Los Cabos, Spanish pronunciation [los ˈkaβos]) আমাদেরকে নিয়ে যাবে।

কাবো সান লুকাস (Cabo San Lucas), বা সহজভাবে Cabo হলো মেক্সিকান রাজ্যের বাহা ক্যালিফোর্নিয়া (Baja California Sur) উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি রিসর্ট শহর। আর সান হোসে দেল কাবো (San Jose del Cabo) হলো উপদ্বীপের পূর্বে কর্টেজ উপসাগরের তীরে অন্য একটি শান্ত ছোট শহর। Cabo San Lucas আর San Jose del Cabo এই দুই শহর মিলিয়ে নাম Los Cabos, যার পশ্চিমে সদা ব্যস্ত কাবো সান লুকাস এবং পূর্বে শান্ত সান জোসে দেল কাবো, মাঝখানে ২০ মাইল সমুদ্রের ধার দিয়ে পর্যটন করিডোর, সম্মিলিতভাবে লস কাবোস নামে পরিচিত। দুই শহর মিলিয়ে জনসংখ্যা খুবই কম, ২০২০ গণনা অনুযায়ী ৩,৫০,০০০।

Pablo L. Martinez র লেখা Guia Familiar de Baja California, 1700–1900 বই থেকে পাওয়া যায় যে Cabo San Lucas এর স্থাপক হিসেবে Cipriano Ceseña র নাম করা হয়, যিনি ১৭৮৮ সালে মেক্সিকোর উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল Hermosillo, Sonora থেকে এখানে এসেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই লস কাবোস অঞ্চলে বসতি স্থাপনের জন্য স্পেন তাঁদের মিশনারিদের পাঠিয়েছিল। আনুমানিক তার আগে এই অঞ্চলে আগে কোন লোক বসতি ছিল না। পুরনো ইতিহাস সূত্রে পাওয়া যায় যে, Hatsutaro নামের একজন জাপানী, দেশ থেকে বিতারিত, ১৮৪২ সালের মে মাসে Cabo San Lucas এসে পৌঁছান। Hatsutaro-র কথিত বর্ননা নিয়ে Maekawa, Junzo, ও Bunzo Sakai এই ক’জন Kaigai Ibun নামের বইটি লেখেন। বর্ননা অনুযায়ী তখন এখানে মাত্র দুটি ঘর এবং জনা ২০ অধিবাসী। অন্যদিকে দুই আমেরিকান লেখক Henry Edwards ও John Ross Browne দাবী করেন যে Thomas “Old Tom” Ritchie নামের এক ইংরেজ ১৮২৮ সালে এখানে এসেছিলেন।

১৮৪০ এর দশকে মেক্সিকান আমেরিকান যুদ্ধের পরে আমেরিকা শেষ পর্যন্ত বাহা ক্যালিফোর্নিয়াকে মেক্সিকোর অন্তর্গত বলে স্বীকার করে নেয়। যাতায়াতের অসুবিধার জন্য এই অঞ্চলের উন্নয়ন খুব ধীরে ধীরে হয়েছিল। ৭০ বছর আগে, লস কাবোসে ছিল একটি মাত্র টুনা ক্যানারি (টুনা মাছকে টিনজাত করার কারখানা)। ক্রমে কাবো সান লুকাস মাছ ধরার জন্য (sport fishing) একটি বিস্ময়কর জায়গা হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৯৬০ এর সময়ে সি-প্লেনে করে অনেকে এখানে মাছ ধরতে আসতেন। আবার অনেক আমেরিকান সেলিব্রিটিরা কাবোতে ছুটি কাটাতে আসতে শুরু করেছিলেন কারণ তখন এটি ছিল জনপদের বাইরে একটি নির্জন গন্তব্যস্থল। চার্লি চ্যাপলিন, জন ওয়েন এনারা প্রায়ই কাবো’তে আসতেন।

এরপর ১৯৭৩ সালে টিজুয়ানার ইউএসএ/মেক্সিকো বর্ডার থেকে কাবো সান লুকাসের বাজার পর্যন্ত হাজার মাইল দীর্ঘ ট্রান্সপেনিনসুলার হাইওয়ে-১ সম্পূর্ণ হয়েছিল। পর্যটন করিডোর, এটি উপকূলরেখার পাশ দিয়ে যায়, আসলে একটি হাইওয়ে যা কাবো সান লুকাস এবং সান জোসে দেল কাবোকে সংযুক্ত করে। এই হাইওয়ের দুপাশে অনেক রিসর্ট, কনডো এবং একটি গল্ফ কোর্স আছে। এই সড়ক হওয়ার পরেই কাবোর আধুনিকীকরণের ও অর্থনৈতিক উন্নতি শুরু হয়। আজ দূর দূরান্তরের মানুষদের জন্য এটি এক জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য হয়ে উঠেছে। শুধুই বিলাসবহুল হোটেল, রিসর্ট, বা বিশ্বমানের মেরিনা নয়, বিশ্বের জনপ্রিয় ও বৃহত্তম মাছ ধরার টুর্নামেন্ট এখন এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। তাই এটি শুধুমাত্রই সেলিব্রেটিদের কাছেই জনপ্রিয় নয় বরং সারা বিশ্বের হাজার হাজার লোকের কাছেও আকর্ষনীয় যারা রাতের জীবন, বিশ্বের সেরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা এবং তার সৈকত, জল-ভিত্তিক ক্রিয়াকলাপ উপভোগ করতে পারে। প্লেয়া এল মেডানো হলো কাবোর প্রধান সৈকত, যেখানে অনেক আউটডোর রেস্তোরাঁ এবং অসংখ্য বার রয়েছে। বিশ্বের সর্বাধিক অর্থমূল্যের মাছ ধরার মার্লিন টুর্নামেন্ট কাবো এখন সান লুকাসে অনুষ্ঠিত হয়, প্রতি বছর অক্টোবর মাসে। শীতকালে, এই এলাকায় তিমির ঝাঁক লক্ষ্য করা যায়। আলাস্কা এবং সাইবেরিয়া থেকে দশ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত ভ্রমণ করার পর কর্টেজ উপসাগরের উষ্ণ জলে স্ত্রী তিমি মাছেরা এখানে তাদের সন্তান প্রসব করে। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অনেক তিমি মাছের এখানে দেখা যায়।

লস কাবোসে আছে দুটি বিমানবন্দর: কাবো সান লুকাস বিমানবন্দর এবং লস কাবোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কাবো সান লুকাস বিমানবন্দর একটি ছোট বিমানঘাঁটি যেখানে প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত জেট এবং শাটল উঠানামা করতে পারে এবং কাবো সান লুকাসের কাছে অবস্থিত। আর লস কাবোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মেক্সিকোর ষষ্ঠ-ব্যস্ততম বিমানবন্দর এবং ল্যাটিন আমেরিকার শীর্ষ ৩০-এর মধ্যে একটি, এটি সান হোসে দেল কাবোতে অবস্থিত।

এবার নিজের ভ্রমণে ফিরে আসি।
ভোরের আলো ঠিক মত ফোটার আগেই পৌঁছে গেলাম সি-ট্যাগ এয়ারপোর্টে। সিয়াটেল থেকে লস কাবোস ৪ ঘন্টার উড়ান। প্রথম দুই ঘণ্টা জমির উপর দিয়ে উড়ে তারপর সমুদ্রের উপর দিয়ে লস কাবোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। ছোট এয়ারপোর্ট, এর একদিকে রুক্ষ পাহাড়। মেক্সিকোর ভূমি স্পর্শ করে এগিয়ে গেলাম ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে। আমেরিকার ভিসা থাকলে ভারতীয়দের মেক্সিকোর জন্য ভিসা লাগেনা। ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস হয়ে তারপর ডলার ভাঙ্গিয়ে মেক্সিকান পেশো কিনে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি বেশ গরম, আর গাছপালা নেই বললেই চলে। অল্প কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেই হোটেল এর গাড়ি আমাদেরকে নিয়ে চললো হোটেলের পথে। চওড়া মসৃণ রাস্তা কিন্তু বড়ো রুক্ষ মরুভূমির মতো কাঁটাগাছের ঝোপঝাড় এবং বড়, মাঝারি সাগুয়ারো (Saguaro) গাছ (দক্ষিণ-পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মরুভূমি অঞ্চলে দেখা যায়, বড় ফণীমনসার মতো একটি পুরু স্তম্ভাকার ক্যকটাস প্রজাতির গাছ)। শহরে ঢুকে অবশ্য বেশ কিছু বড় বড় গাছ দেখলাম, তার মধ্যে কাঠালিচাঁপা, কৃষ্ণচুঁড়া এবং খেজুর গাছই বেশি।

যদিও ভোরে সিয়াটেল থেকে রওয়ানা দিয়ে মাত্র ৪ ঘন্টার পথ এসেছি, কিন্তু এখানের কাজকর্ম এতই শিথিল যে ইমিগ্রেশন, ডলার ভাঙ্গানো, ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা, আর হোটেল চেক ইন করতে করতে প্রায় বিকেল হয়ে গেলো। আমাদের হোটেলটি ছিল সান হোসে ডেল কাবো শহরের সমুদ্রের ধারে। চেক-ইন করে সমুদ্রমুখী তিন তলার হোটেলের ঘরে ঢুকে মালপত্র গুছিয়ে রেখে স্নান করে কিছক্ষন বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম ডিনারের জন্য। বলে রাখি, এখানে বিকেলের আলো থাকতেই ডিনার টাইম শুরু হয়ে যায়। রেস্টুরেন্টটি শহরের পুরোনো অঞ্চলে, হোটেল থেকে আন্দাজ ৭ কিলোমিটার দূরে। এই পুরোনো শহরের রাস্তাঘাট বেশ সরু, আর দুধারের বসতবাড়ি পুরোনো ছোট একতলা অথবা দোতলা, সামনের দিকে কোন ফাঁকা জমি নেই। বোগেনভেলিয়া, পেঁপে আর জবাফুল গাছ ছাড়া আর কোন বড় গাছ চোখে পড়লো না। রেস্তোরাঁটা খুব বড় না, কিন্ত ভীড় ছিল। ঢুকেই দেখলাম একজন চেয়ারে বসে গীটার বাজিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করে অতিথিদের আনন্দ প্রদান করে চলেছেন।

পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরোতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। হোটেলের কার রেন্টাল থেকে তিন দিনের জন্য একটা গাড়ি নেওয়া হলো। আমরা চললাম কাবো সান লুকাসের পথে, নয়নাভিরাম দ্যা করিডোর দিয়ে। দেখলাম কাবো সান লুকাস অত্যন্ত জনবহুল,আর গাড়ি পার্কিং এক বড় সমস্যা। আমরা একটি মলের পার্কিং লটে গাড়ি রেখে বেরিয়ে পরলাম মেরিনার দিকে যেখানে নানান আকৃতির বোটের সমাহার। আমাদের দেখে অনেকেই এগিয়ে এলেন তাঁদের বোটের টিকিটের জন্য। স্যুভেনির বিক্রেতা এবং হোটেলের দালালরাও ছেঁকে ধরেছিলো, তবে একবার না বলে দিলে ওঁরা আর কোনরকম পিড়াপিড়ি করেননি। আমরা আগে থেকেই ঠিক করে এসেছিলাম যে একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির গ্লাস বোটেই যাব। ঐ কোম্পানির অফিসে গিয়ে বেলা তিনটের বোটে সিট রিজার্ভ করেছিলাম। কাছাকাছি একটি রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করে আমরা বোট কোম্পানির অফিসে কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর ওনাদের গাইড এসে আমাদেরকে নিয়ে খালি পায়ে একটি স্বচ্ছ কাঁচের বোটে উঠতে বললেন। দু’ধারের লম্বা সিটে বসে লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম। আরও ছয়জন পর্যটক একই বোটে উঠার পর বোট চলতে শুরু করলো। গাইড এক এক করে সৈকতগুলি এবং সমুদ্রের মধ্যে প্রাকৃতিক শিলাগুলির বৈশিষ্ট্য এবং নাম বলে দিচ্ছিলেন। ল্যান্ডস এন্ডের দিকে যাওয়ার পথে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম এম্পাকাডোরা সৈকত। এই সৈকতে আসতে হলে ওয়াটার ট্যাক্সিই একমাত্র বাহন। তারপর দেখলাম পেলিকান রক, এটি সমুদ্রের মধ্যে একটি শিলা। সেখানে প্রায় ৬ মিটার উচ্চতার কয়েকটি পেলিকান আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। সামান্য এগিয়ে বিদেশী গ্রীষ্মমন্ডলীয় রঙ্গিন মাছের কয়েকটি ঝাঁক বোটের নীচে দেখতে পেয়েছিলাম। গাইড কয়েক টুকরো টরটিলা জলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে মাছগুলো এসে যায়।

এরপর লাভার্স বিচ, তারপাশেই ডিভোর্স বিচ এবং নেপচুনস্ ফিঙ্গার। নেপচুনের আঙুলের নামটি একটি বৃহৎ আঙুলের আকৃতির চূড়া থেকে এসেছে যার উচ্চতা প্রায় 8 মিটার। জলের তলায় বিভিন্ন ধরণের প্রবালসহ কয়েকটি সুন্দর অগভীর চূড়া দেখতে পাওয়া যায়, সেই জন্য সকালবেলায় অনেকেই এখানে স্মরকেলিং করেন। তবে লাভার্স বিচ, আর পাশাপাশি ডিভোর্স বিচ নাম কেন হয়েছে তার কোন যুক্তি নেই, লোকমুখে ছড়ানো নাম। বিচের গঠনেও কোন ফারাক নেই।

এরপর আমরা বিখ্যাত আর্চের দিকে যাত্রা করলাম। এখানে বলা হয় desert meets the sea (ল্যান্ডস এন্ড)। কাবো সান লুকাস-এ দেখার প্রধান আকর্ষণগুলির মধ্যে একটি হলো ল্যান্ডস এন্ডের আর্চ স্থানীয় স্প্যানিশ ভাষায় El Arco, একটি প্রাকৃতিক শিলাগঠন (granitic rock) যা সামুদ্রিক ঢেউ এর আঘাতজনিত ক্ষয় দ্বারা তৈরি হয়েছিল। এখানেই প্রশান্ত মহাসাগর কর্টেজ উপসাগরের সাথে মিলিত হয় (ক্যালিফোর্নিয়া উপসাগর, স্প্যানিশ: Golfo de California, বা কোর্টের সাগর (Mar de Cortes)। আজ এটি ক্যাবোসের প্রতীক। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ এই আর্চের উপর আছড়ে পড়ে সাদা ফেনার চাদরে যেন পাহাড়টিকে ঢেকে ফেলেছে। এরও যে এক অপরুপ সৌন্দর্য আছে সেটা না দেখলে জানতেই পারতাম না। ছোট বোটগুলি কর্টেজ উপসাগরের মধ্যেই তাদের যাত্রা সীমিত রাখেন কারণ প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল ঢেউ এবং গভীরতা ছোটো বোটগুলির পক্ষে বিপজ্জনক।

এবার প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যকে প্রাণভরে উপভোগ করে একই পথে প্রত্যাবর্তন। পরের দিনও আমরা সানসেট ক্রুজে গিয়েছিলাম। বিকেল ছটার সময় আমাদের ক্যাটামেরান রওনা হয়েছিল আগের দিনের মতো। একই রুটে ল্যান্ডস এন্ডের আর্চ পর্যন্ত গিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে কিছুটা চলে গিয়ে ফেরত এসেছিলাম। প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে পাহাড়ের গায়ে কিছু শীল মাছের দেখা পেয়েছিলাম। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় সূর্যাস্ত আমরা দেখতে পাইনি তবে আমরা অনেক স্টিংরে মাছ দেখতে পেয়েছিলাম জলের উপর ২/৩ ফুট মতন লাফিয়ে উঠতে। গাইড বলেছিলেন যে মেটিং সিজনে পুরুষ মাছ এইরকমই লাফিয়ে স্ত্রী-মাছদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে।

রাতের খাবারের জন্য সান হোসে ডেল কাবোর পুরনো শহরের মেক্সিকান রেস্তোরাঁগুলিই আমাদের খুব পছন্দের ছিল। পুরনো শহরটির কেন্দ্রস্থলটি খুব ঐতিহ্যবাহী, এখানে একটি সুন্দর পুরানো গির্জা আছে যার ঠিক সামনে একটি ৪০০*২৫০ মিটারের বাধানো স্কোয়ারে একটি সাদা গেজেবো (Gazebo) (কনসার্টের জন্য একটি মঞ্চ) এবং স্কোয়ারের চারিপাশে বসবার জন্যও কয়েকটি সুন্দর বেঞ্চ আছে। ১৭৩০ সালে এই গির্জাটি স্পেনীয় ধর্মজাজকেরা তৈরি করেছিলেন, প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন Nicolás Tamaral যিনি ১৭৩৪ সালের পেরিক্যু বিদ্রোহের (Pericú Revolt) সময় নিহত হন, এবং বিদ্রোহীরা মিশনটির ধংস করে। ১৭৩৫-৩৬ সালে এটিকে আবার পুননির্মান করা হয়। এরপর গির্জাটি বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রথমে এটি ছিল কাঠের তৈরি, একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এটি সম্পূর্ণ ভাবে ভষ্মীভূত হয়ে যায়। ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চার্চটি তার বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়েছিল, কিন্তু একটি হারিকেনের ঝড়ে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর ২০ শতকের শুরুতে পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছিল। এটি লস কাবোসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভগুলির মধ্যে একটি, একটি সক্রিয় গির্জা, আর সাপ্তাহিক এবং ছুটির পরিষেবাগুলিতে অংশ নেওয়ার জন্য এই অঞ্চলের সেরা জায়গা।

Estero de las Palmas de San José del Cabo Mission

এই স্কোয়ারটি ঘিরে অনেক রকম দোকান আছে, স্থানীয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, গয়নার দোকান, ধর্মীয় সামগ্রীর দোকান, স্যুভেনির দোকান, রেস্তোরাঁ, বেকারি এবং জামাকাপড়ের দোকান, ইত্যাদি। বৃহস্পতিবার অনেক রাত পর্যন্ত এই দোকানগুলো খোলা থাকে। পুরো শহর যেন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাবেলায় এই জায়গায় চলে আসে, অনেকটা আমাদের মেলার মতো। এখানে অনেক ভালো ভালো অথেনটিক মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট আর বার আছে। বেশিরভাগ মেক্সিকান মেনুর সাথে আগেই পরিচয় ছিল যেমন টাকো, সালসা, নাচোস, ক্যাসাডিলা ইত্যাদি তবে মেক্সিকোতে বসে চিলেস এন নাগোডা, বুরিটোস, আগুয়াচিলে (Aguachile) এবং বিভিন্ন রকমের মার্গারিটা খাওয়ার মজাটাই আলাদা। বৃহস্পতিবার ছাড়া অন্যান্য দিনে এখানে এত ভীড় হয় না এবং স্টলগুলোও থাকনা। প্রসঙ্গত বলি, এখানে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ।

এখানে আরও একটি বেড়ানোর জায়গা palacio municipal, আমরা যাকে বলি শহরের টাউন হল। ১৯২৭ সালে মেক্সিকো ঘরানায় তৈরি এই স্থাপত্যের আহামরি কিছু নিদর্শন নেই, কিন্তু স্থানীয় লোকেদের কাছে এর এক ঐতিহাসিক ও আবেগ নিশ্চয়ই আছে।

লস কাবোসের সর্বাধিক জনপ্রিয় এলাকাগুলিকে তিনটি প্রধান এলাকায় শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে: সান জোসে দেল কাবো, কাবো সান লুকাস এবং দ্য ট্যুরিস্ট করিডোর। অনেকের কাছেই সান হোসে দেল কাবো “পুরানো শহর” নামে পরিচিত, লস কাবোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এখানেই অবস্থিত। এটিই পূর্ব অন্তরীপের প্রবেশদ্বার। ভ্রমণার্থীরা এবং স্থানীয় বাসিন্দারা এই এলাকাটিকে পছন্দ করেন কারণ এটি এলাকাটি তার পুরানো মেক্সিকোর শহরের প্রাচীন আকর্ষণ বজায় রেখেই নতুন শহর গড়েছে, অত্যাধুনিক রিসর্ট এখানে তৈরি হয়েছে এবং গল্ফ, রেস্তোরাঁ, সাঁতারের সৈকত, মেরিনা ইত্যাদিও রয়েছে। তবে প্রাচীন এই শহরাঞ্চলে এখনও পাথরের বাড়িঘর (cobblestone streets – natural building material based on cobble-sized stones used for pavements, roads, streets, buildings), (adobe houses – Spanish pronunciation: [aˈðoβe] – building material made from earth and organic materials. স্প্যানিশ ভাষায় Adobe মানে মাটির ইট) ইত্যাদি দেখা যায়।

লস কাবোসের সর্বাধিক ট্রাফিক এলাকা হলো কাবো সান লুকাস, যেখানে প্রচুর দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, নাইটলাইফ ভেন্যু এবং সৈকত বার তৈরি হয়েছে। রোমাঞ্চপ্রার্থী এবং ভ্রমণার্থীরা কাবো সান লুকাসকে “লস কাবোস এলাকার বিনোদন কেন্দ্র” বলে মনে করেন। প্লেয়া এল মেডানো হলো কাবোর প্রধান সৈকত, এখানে অসংখ্য আউটডোর বার আর রেস্তোরাঁ আছে। মেরিনার পাশ দিয়ে ল্যান্ড’স এন্ড প্রমোনটরি, প্লেয়া ডেল আমোর (লাভারস বিচ) এবং এল আর্কোর সাইট, সামুদ্রিক পাহাড়ের একটি প্রাকৃতিক আর্চওয়ে।

লস কাবোস’কে মেক্সিকোর শীর্ষ পাঁচটি পর্যটন কেন্দ্রর একটি হিসেবে গন্য করা হয়। স্কুবা ডাইভিং, স্মরকেলিং, Balnearios, সমুদ্রের খিলান El Arco de Cabo San Lucas এবং সামুদ্রিক জীবনের জন্য এখন লস কাবোস পরিচিত। এছাড়াও শহরটি ক্রুজ জাহাজের জন্য জনপ্রিয় বন্দর। লস কাবোসের চারপাশের জলে স্ট্রিং রে, হাঙ্গর, মাহি-মাহি (ডোরাডো) এবং স্ট্রাইপড মার্লিন সহ অনেক সামুদ্রিক প্রাণীর আবাসস্থল। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী পর্যটন এখন এই অঞ্চলের প্রধান অর্থনৈতিক বানিজ্য, এবং প্রতি বছর ২০ লাখ পর্যটক এখানে আসেন।

বেড়ানোর আনন্দ যেন খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসে। এবার বাড়ি ফেরার পালা । সকালে ভাড়া গাড়ি ফেরত দিয়ে হোটেলের গাড়ি করে চললাম এয়ারপোর্টে।

অনেক স্মৃতি, ভালোলাগা, ইতিহাস মনের মধ্যে ধারন করে। যা দেখলাম, এই জীবনে কোন দিন ভুলবো না। বিমানের জালনা দিয়ে নীচে তাকিয়ে ছিলাম যতক্ষন দেখতে পাওয়া যায়।

https://photos.app.goo.gl/iBqbJN2iehXx2zee8

Sahityika Admin

2 comments

  • ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার অনেক ভ্রমণ কাহিনী পড়ছি।এই রকম মেক্সিকোর কাহিনী প্রথম পড়লাম। সুন্দর বর্ণনা।

  • এই লেখাটা পড়ার আগ লস কবোস নামই শুনিনি। লেখক বেঁচে থাকলে হয়তো এরকম ভালো লেখা আরও কিছু দিতে পারতেন।