সাহিত্যিকা

বাংলার অপরূপ শোলা শিল্প

বাংলার অপরূপ শোলা শিল্প
@বিজিত কুমার রায়, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

আসুন আমরা এক সম্পূর্ণ রূপে বাঙালি হস্তশিল্প নিয়ে চর্চা করি যা আমাদের সাজ সজ্জা আর বিশেষ করে প্রতিমার সাজ কে এক অনন্য রূপ দিয়েছে ।
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, শোলার সাজ যেটি ডাকের সাজ নামেও অতি পরিচিত ।

বাংলার ঐতিহ্যবাহী শোলা শিল্প
শোলা শিল্প (ইংরাজিতে PITH) বাংলার এক অতি প্রাচীন হস্তশিল্প। এই শিল্পের কদর বিশেষত করে বাড়ে দুর্গোৎসবের সময়। এই সময় শোলার কাজের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয় কারণ থিম পুজোর যতই ভিড় হোক, মা দুর্গার ডাকের সাজের সাবেক রূপের চাহিদা আজও একইরকম। শোলার সাজ ছাড়া জগজ্জননী মায়ের সনাতনী রূপ যেন ঠিক পূর্ণতা পায় না। শুধু এই বঙ্গ নয় স্থান-কালের সীমা পেরিয়ে শোলার সূক্ষ্ম কাজ আজ মুগ্ধ করে চলেছে গোটা বিশ্বকে। কথিত আছে, মায়ের শোলার সাজ কৃষ্ণনগর থেকে পোস্ট অফিসের পার্সেলে আনা হত। ইতিহাস বলে, পূজা উপলক্ষে জার্মানি থেকে সর্বপ্রথম ডাকের মাধ্যমে শোলার কাজটি সরবরাহ করা হয়। সেই থেকে ডাক মারফত আনা হত বলে এর নামই হয়ে যায় ডাকের সাজ।

শোলা শিল্প বাংলার অত্যন্ত গর্বের, অতি-প্রাচীন এক হস্তশিল্প, যা শুধু অর্থনৈতিক জীবন নয়, একসময় বাংলার অন্যান্য সমাজ-সংস্কৃতির গভীরেও ছড়িয়ে গিয়েছিল এর প্রভাব। অলঙ্করণ থেকে প্যাকেজিং, শোলার নানা বৈচিত্রপূর্ণ ব্যবহারের দিকটি এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃতি অর্জন করে নিয়েছে। অলঙ্করণ সামগ্রীর ক্ষেত্রে, বাংলার শোলা শিল্পীদের দক্ষতা এখন কিংবদন্তির পর্যায়ে। একসময় শোলা শিল্পের দারুণ রমরমা ছিল উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। তবে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তামিলনাড়ু, পুদুচেরি, ওড়িশা, অসম ও বর্তমান বাংলাদেশের কিছু অংশেও অবশ্য শোলা শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। কিন্তু ঠিক কত পুরনো এ-শিল্প, ইতিহাস থেকে সে-বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায় না।

শোলার ভেতরের অংশটি হয় দুধ-সাদা। হাতির দাঁতের থেকে তৈরি সূক্ষ্ম শিল্পকর্মের মতো নানা রকমের সূক্ষ্ম ও শৌখিন জিনিস তৈরি করা সম্ভব হয় শোলা থেকে। শোলার উপর চমৎকার ফুটে ওঠে ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য। তাই একে অনেক সময় ‘হারবাল আইভরি’ বা ভেষজ হস্তিদন্তও বলা হয়ে থাকে। অনেকটা স্পঞ্জের মতো এই শোলাকে, ‘ইন্ডিয়ান কর্ক’ও বলা হয়। একসময় হাতির দাঁত নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরে, মুর্শিদাবাদের দক্ষ শিল্পীরা নাকি হাতির দাঁতের বদলে শোলার কাজ শুরু করেন।

শোলার কাজের উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা প্রাচীন লোকগাথা ও পৌরাণিক উপাখ্যান। কেউ বলেন স্বয়ং দেবাদিদেব শিবের ইচ্ছায়, আবার কেউ বলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় নাকি শোলার কাজ শুরু হয়! ‘আউটলুক ট্রাভেলার’ সূত্রে জানা যায় একটি লোককাহিনির কথা, সেখানে বলা হয়েছে শোলা উদ্ভিদটি নাকি ভগবান শিবের ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। তবে বেহুলা-লখিন্দরের লৌহবাসরের সম্ভাব্য প্রতীক, ‘মনসামেড়’ বা ‘করন্ডি’ (চিত্রিত শোলার এক অপূর্ব নিদর্শন) থেকে অনুমান করা যায় যে অতি প্রাচীন সর্পপুজো বা মনসাপুজোর সঙ্গে শোলা চিত্রণের একটি নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আর ‘লোকায়ত প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান, মন্ত্র-তন্ত্র, পূজা-পার্বণ এবং বিবাহে নিত্যদিনের শিল্পসামগ্রী রূপে শোলাশিল্পের গুরুত্ব সমগ্র মধ্যযুগ জুড়েই ছিল।

এরকম তথ্যই উঠে এসেছে শোলা ও কুসুম শিল্পের উপর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাপত্রে। প্রকৃতপক্ষে, ‘মধ্যযুগে পল্লী শিল্পীদের সৃষ্ট লোকশিল্পেই লোকসমষ্টির প্রয়োজন দূর হত।’ তবে পরবর্তী সময়ে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সময়কালে নাকি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শোলার কাজ। এমনটাই জানা যাচ্ছে কলকাতার জার্মান কনস্যুলেট সূত্রে। প্রসঙ্গত, এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হল, শোলার কাজের মূল শিল্পী বা বাংলার শোলা শিল্পের একরকম ধারক ও বাহক বলে পরিচিত, ‘মালাকার’ সম্প্রদায় নাকি তাদের আদি বাসস্থান, অধুনা উত্তরপ্রদেশের মথুরা থেকে বাংলায় এসেছিল সম্রাট জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে।

যাই হোক, একসময় বাংলার খাল, বিল, পুকুর, ডোবায় আপনা-আপনিই প্রচুর পরিমাণে জন্মাতো শোলা গাছ। বৈজ্ঞানিক নাম ‘এস্কাইনোমিনি অ্যাস্পেরা’। এই শোলাগাছই ছিল শোলা শিল্পের মূল কাঁচামাল। বাংলা ছাড়া শোলাগাছ জন্মাত অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও অসমের জলাভূমি অঞ্চলে। একসময় এইভাবে প্রকৃতিতে সুলভে পাওয়া গেলেও পরবর্তীকালে শোলার চাষ শুরু হয় জলাভূমিতে এবং তা প্রসার লাভ করে বাংলার বেশ কিছু অঞ্চলে।

বাংলার সনাতন শিল্পধারায় শোলার দুটি শিল্পরূপ দেখতে পাওয়া যায়। একটি হল চিত্রিত রূপ এবং অপরটি মণ্ডিত রূপ। শোলার উপর রং খুব ভাল ধরে তাই এর উপর রঙের কাজও হয় চমৎকার। অন্যদিকে, নরম শোলাকে কেটে অসাধারণ সূক্ষ্ম নৈপুণ্যে নানা কারুকার্য্য ফুটিয়ে তোলা হয় ও বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করা হয়। ব্যবহারের দিক থেকেও শোলার কাজ নানা ভাগে বিভক্ত। যেমন চাঁদমালা, শোলার মালা, লক্ষ্মীঝারা, কদমফুল ইত্যাদি দ্রব্যগুলি ধর্মীয় আচারের সঙ্গে যুক্ত। আবার বরের টোপর, কনের সিঁথি মুকুট ইত্যাদি বিয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে বিয়েতে পরম্পরাগতভাবে শোলার টোপরের ব্যবহার ছাড়াও একসময় রণক্ষেত্রেও শোলার টোপরের ব্যবহার বিষয়ে জানা যাচ্ছে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্য থেকে। ‘শোলার টোপর শিরে ঘন সিংহনাদ পুরে বাঁশে বান্দে চামর নিশান…।’

অন্যদিকে, ইংরেজ আমল ও তার পরবর্তী সময়কালে, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে শোলার প্যাকেজিং দ্রব্য এবং টুপির উল্লেখ করতেই হবে। এ-ছাড়া, সজ্জাদ্রব্য হিসাবে দেব-দেবীর অলংকার, শোলার মুখোশ, শোলার ফুল, শোলার খেলনা, পুতুল ও উপহার সামগ্রীও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এমনকী, জন্ম ও বিয়ের সময় নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে শোলার ‘শীতল পট’ ব্যবহার (মূলত রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে) এবং মৃত্যু সম্পর্কিত তথা পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপে শোলার ‘ফুলঘর-রথঘর’-এর ব্যবহার একসময় যথেষ্ট প্রচলিত ছিল। আসলে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রায় সমস্ত পর্যায়েই কোনও-না-কোনওভাবে যেন জড়িয়ে ছিল, কোনও-না-কোনও শোলা শিল্পজাত সামগ্রী!

শোলা শিল্পের সেই দিন আর নেই, তবে আজও বাংলায় একরকম বংশ পরম্পরায় বয়ে চলেছে এই অনন্য শিল্প ধারাটি। যত সূক্ষ্ম কাজ, তত সময় সাপেক্ষ। এক একটি গোটা পরিবার নিযুক্ত থাকে শিল্পকর্মে। সবাই যে যার মতো এক একটি অংশের কাজ করে। তবে প্রধান শিল্পীই সবচেয়ে জটিল কাজগুলো করে থাকে। আবার, বয়স্ক শিল্পীদের সাহায্যের সময় তরুণ শিল্পীদেরও একরকম প্রশিক্ষণ হয়ে যায় ঘরে বসেই। খুব সাধারণ যন্ত্রপাতি ও দেশীয় মালমশলা দিয়ে কী অসাধারণ সব মোটিফই (নকশা) না তৈরি হয়! নানা সম্প্রদায় মিলে রাজ্যে প্রায় ৭০০০ মানুষ এখন এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তবে শোলার কাজের যেমন সম্প্রদায়গত বিশেষীকরণ লক্ষ্য করা যায় তেমনি স্থানগত বিশেষীকরণও নজরে পড়ে। যেমন, বাংলার চাঁদমালা, ঝারা (শোলার ঘনকের প্রতিটি কোণ থেকে ঝোলানো একটি করে শোলার তারাফুল অথবা কদমফুল), শোলার মালা, কদমফুল ইত্যাদির বিশেষীকরণ ঘটেছিল হুগলি জেলার সুন্দুরুসে। অন্যদিকে রাসরচনা ও রাসগাছ (শ্রীকৃষ্ণের রাসযাত্রায় ব্যবহৃত শোলাসামগ্রী) তৈরিতে বিখ্যাত ছিল হাওড়ার রামেশ্বরপুর ও হুগলির সুন্দুরুস। আবার ফুলঘর-রথঘর তৈরিতে নামডাক ছিল হাওড়ার ভান্ডেরগাছার। আর হাওড়ার বাণীবনের খ্যাতি ছড়িয়েছিল শোলার মডেল ও বিভিন্ন অলঙ্করণ সামগ্রী তৈরিতে। তবে হাওড়া-হুগলি ছাড়া বাংলার অন্যত্রও শোলা শিল্পকর্মের এরকম বেশ কিছু বিশেষীকরণ নজরে পড়ে। যেমন, কোচবিহারের দিনহাটার বিষহরি পট (মনসাপুজোয় ব্যবহৃত উপকরণ), দার্জিলিং-এর খড়িবাড়ির শীতল পট, নদিয়ার কৃষ্ণনগরের লক্ষ্মী মুখড়া (লক্ষ্মীপূজায় ব্যবহৃত সামগ্রী), মালদার ইংরেজবাজারের মাণ্ডুস (মনসাপুজোয় ব্যবহৃত উপকরণ), বর্ধমানের বনকাপাসি ও বীরভূমের কীর্ণাহারের দেব-দেবীর অলংকার, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশপুর ও পুকুরিয়ার শোলার ফুল ইত্যাদি।

যাই হোক, এমন নানা মূল্যবান তথ্য কিন্তু জানা যাচ্ছে অধ্যাপক কুন্দন ঘোষের ‘শোলাপীঠ ক্র্যাফট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল: অ্যান ওভারভিউ’-শীর্ষক গবেষণা পত্রটি থেকে। প্রসঙ্গত, বাংলার বাইরে ওড়িশায় প্রভু জগন্নাথ দেবের সজ্জায়, রথযাত্রার সাজে (বৈতা বন্দনা) ও ওডিসি নৃত্যের মুকুটে, পরম্পরাগতভাবে ঝলমল করে শোলার কাজ। খুব স্বাভাবিক ভাবে বাংলার প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশায় তাই শোলার এই ধরনের কাজেরই বিশেষীকরণ লক্ষ্য করা যায়।

প্রশ্ন জাগে, শোলার এতরকম শিল্পদ্রব্য বিক্রি হয় কোথায়? প্রত্যেক জেলার স্থানীয় বাজার ছাড়াও, বাংলার শোলা শিল্পদ্রব্যের একটি প্রধান বাজার কলকাতা। রাজ্য সরকারি সংস্থা, ‘মঞ্জুষা’ ও ‘বিশ্ববাংলা’র মাধ্যমেও শোলার নানারকম পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা আছে। প্রতি বছর হস্তশিল্প মেলার মাধ্যমেও শোলাশিল্পজাত পণ্যের প্রদর্শন ও বিপণনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শোলার তৈরি বিশেষ ধরনের ‘বেলমালা’র ভালো চাহিদা রয়েছে কেরল এবং তামিলনাড়ুতেও।

একটা সময়, শোলা-চাষি ও শোলা-শিল্পীদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, শোলা-শিল্পীদের মূল কারিগর মালাকার সম্প্রদায়ের শক্তপোক্ত সামাজিক ভিত্তি, হালকা শোলার সহজ পরিবহণযোগ্যতা ইত্যাদি শোলাশিল্পের উন্নতিতে সহায়ক হয়েছিল। সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীত, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ অনেকটা ফিকে হয়ে গেলেও, পরম্পরাগত সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে শোলা-শিল্প অনেকাংশে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও শোলা শিল্প আজও টিকে আছে। আবার, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শোলার কাজের একটা বিশ্ব-বাজারও (গ্লোবাল মার্কেট) তৈরি হয়েছে। এটাও শোলা-শিল্পকে যে কিছুটা অক্সিজেন দিচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী শোলাশিল্পজাত সামগ্রীর যুগোপযোগী বৈচিত্রকরণ সম্ভব না হলে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী শোলাশিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে না পারলে এই গৌরবময় শিল্পের ভবিষ্যৎ যথেষ্ট প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়তে পারে। বিল-ঝিল শুকিয়ে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো শোলা পাওয়া যায় না। অনেক জলাভূমি ভরাটও হয়ে গেছে। একসময় অনেকটা বিনামূল্যেই বিলঝিল থেকে যে শোলা সংগ্রহ করত মালাকাররা, এখন তা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। কাঁচামালের সংকটের কারণে মালাকাররা পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এক সময় বিয়ে, নববর্ষ, পূজা, মেলা ও উৎসব-পার্বণে মালাকাররা তাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করলেও এখন বছরের বেশিরভাগ সময় তাদের কর্মহীন থাকতে হয়।

আমাদের দেশে সাধারণত দুই ধরনের শোলা পাওয়া যায় কাঠ শোলা ও ভাট শোলা। মালাকাররা তাদের শিল্পকর্মের জন্য ভাট শোলা ব্যবহার করে থাকেন। একে মালি শোলাও বলা হয়ে থাকে। এ শোলা বেশ নরম ও ওজনে স্পঞ্জের মতো হালকা। কাণ্ডসর্বস্ব এ গাছের ভেতরটা ধবধবে সাদা। জলাভূমি, বিলঝিল ও হাওর-বাঁওড় থেকেই মালাকাররা শোলা সংগ্রহ করে তা রোদে শুকিয়ে পরে ছুরির মাধ্যমে অপরূপ নকশা ফুটিয়ে তোলেন।

গ্রামের শোলা শিল্পী নিখিল চন্দ্র মালাকার জানান, আমি আমার বাপ-দাদার কাছ থেকে এ কাজ শিখেছি। আগে আমাদের গ্রামে শতাধিক পরিবার এ পেশায় ছিল, এখন আমরা দুই-তিন পরিবার কোনো রকমে টিকে আছি। এই দুই-তিন পরিবার শোলার কাজ করলেও প্রয়োজনীয় শোলা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই অনেক কষ্টে আমাদের সংসার চালাতে হয়। বছরে একবার সোনারগাঁয়ের লোকজ উৎসবে আসি। কিন্তু ক্রেতারা শোলার জিনিসের ন্যায্য দাম দিতে চায় না। সব মিলে এ পেশাটি এখন বিলুপ্তির পথে। এ পেশার সংকটের কারণে আমার ছেলে-মেয়েরা এ পেশায় আসতে আগ্রহী নয়।

একই এলাকার আরেক শোলা শিল্পী নিমাই মালাকার জানালেন, শোলা শিল্পের সবচেয়ে বড় সমস্য পর্যাপ্ত শোলা না পাওয়া। দিন যত যাচ্ছে, শোলা ততই কমে যাচ্ছে। কতদিন এ পেশা ধরে রাখা যাবে তা অনিশ্চিত। শোলার চাষাবাদ করা গেলে এ শিল্পটি একটি সম্ভাবনাময় কারুশিল্প হতে পারে বলে জানান তিনি ।

কারুশিল্পীরা আমাদের সংস্কৃতিতে আত্মার স্পন্দন। তাদের অবশ্যই টিকিয়ে রাখতে হবে। এটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ নিতে হবে। শোলা শিল্পের কাঁচামাল শোলা চাষের ব্যবস্থা করা ও শিল্পীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্পটিকে রক্ষা করা সম্ভব।

বিশেষ করে, শোলার কাজের পরম্পরাগত নান্দনিক সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিবেশমিত্রতার দিকটিও সচেতন জনমানসে আজ আরও বেশি করে প্রচারিত হওয়া প্রয়োজন। সৌভাগ্যের বিষয়, বর্তমানে রাজ্য সরকার সক্রিয়ভাবে শোলা-শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছে নানা প্রকল্পের মাধ্যমে। এ-ছাড়া, কলকাতার জার্মান কনস্যুলেট ও কিছু বেসরকারি সংস্থাও শোলা-শিল্পের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ করছে বিভিন্ন স্তরে। আশা করা যায়, এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে গোটা বাংলাতেই শোলা-শিল্প এক নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করবে। হয়তো আবারও ফিরে আসবে শোলা-শিল্পের সেই সোনালি দিনগুলি। সম্প্রতি ২০২১ সালে, বাংলার দুর্গাপুজো, ইউনেস্কোর বিশেষ স্বীকৃতি লাভের পর বাংলার শোলা-শিল্পের ভবিষ্যৎ যেন আরও উজ্জ্বল হয়েছে। বেশি করে পড়ছে আন্তর্জাতিক প্রচারের আলোও। কারণ, শোলার সাজ ছাড়া জগজ্জননী মায়ের সনাতনী রূপ যেন ঠিক পূর্ণতা পায় না যে ।

 

Sahityika Admin

Add comment