আয়ুত্থায়া ব্যাংকক
@রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার, ১৯৭২ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আয়ুত্থায়া — অয়োধ্যা – অয্যোধ্যা
পূর্বকথন
অগস্ট (২০১৯) মাসেই যাওয়া ঠিক হল। সিঙ্গাপুর যেতেই হবে। থাকতে হবে ভাইএর বাড়িতে। ওরাও ব্যাংকক যাবে।
‘বৌদি, তোমরাও তখন এসো’।
এতদিন?
ব্যাংকক গেলে সবাই যায় পাটায়া, নয় কারবি, নয় ফুকেত। গিন্নি আমার ব্যাংকক ধরেই বসে আছেন। যেখানে সবাই যায়, সব সমুদ্রের ধারে। বোটিং, বেদিং, পান ভোজন এইসব নিয়েই একটা প্যাকেজ। কিন্তু এর কোনটাতেই ওনার টান নেই। সবাই মিলে বেড়াবো, শপিং কেনাকাটা করব, সেটাই আনন্দের। ব্যাংককে আমরা ছয় জনের দল হব, সেটাই ওনার উত্তেজনার রসদ। আমাকেই ঠিক করতে হল। ঠিক হল সিঙ্গাপুর- ব্যাংকক- পাটায়া- ব্যাংকক- ব্যাক ট্যু কলকাতা।
আয়ুত্থায়া দিয়ে শুরু। ওটা আমার টান। দলের সবাই চাইছে খাওয়া আর কেনাকাটা। বললাম দেখো, ভালো লাগবে।
আয়ুত্থায়া। ব্যাংকক বিমান বন্দর থেকে ঘণ্টা খানেক গাড়িতে।
ভাবাই যায় না যে শহরটি একসময় ছিল বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্রভুমি, তা এখন একটা মরা শহর। লোকে, মানে টুরিস্টরা, দেখতে আসে ধ্বংসাবশেষ। বর্মীরা বার বার আক্রমন করেও এই ব্যস্ত বাণিজ্য কেন্দ্রটিকে কব্জা করতে পারছিল না।
চিন, ক্যাম্বডিয়া, ভিয়েতনাম, বর্মা এইসব দেশের মাঝে অফুরান জলপথ ঘেরা আয়ুত্থায়া তখন সে অঞ্চলের মক্ষীরানি। বহু পুরনো সিয়ামিজ রাজত্ব। প্রায় চার’শ বছরের ইতিহাস। তার ইতিহাস না জেনে যদি যাই, একদম মজা পাবে না বুঝলে।
তখন ব্যবসা বাণিজ্য হত জলপথে। আয়ুত্থায়ার রমরমাও তাই। কাম্বোডিয়ায় তখন ক্ষমের সাম্রাজ্যর আধিপত্য। ওনারা নাম দিলেন অয়োধ্যা। তখন কাম্বোডিয়ায় ভারতীয়, হিন্দুত্ব, রামায়ণের খুবই প্রভাব। তাই অয়োধ্যা নামটা আশ্চর্য নয়। তখন সেখানে কে নেই? ভারত, চিন জাপান, পারসিয়ান, ইয়ুরোপিয়ান সব ব্যবসাদার। আগে ব্যবসার পথ ছিল জলপথ। এখানে অভাব নেই। শাও ফ্রায়া, শাখা নদি, খাল। একটু এগোলেই সমুদ্র। ব্যবসা ছিল খাদ্য সামগ্রী আর অল্প কিছু বিলাস ব্যাসনের টুকিটাকি নিয়ে। কে কতটা ভাগ পাবে তাই নিয়েই ছিল ক্ষমতার লড়াই। এখনও তাই। একই রকম আছে মানুষ আর মানুষের লিপ্সা। তবে এখন লড়াই হয় তেলের জন্য। তবে তেলের লড়াই বোধকরি শেষ হয়ে এলো। এবার জলের লড়াই হবে।
তবে পয়সা যেখানে, গোলমাল সেখানে থাকবেই। তাই ছিলো। একটা চোরা দলাদলি ঝগড়ার আবহ লেগেই থাকত। সামনে না থেকেও কলকাঠি নাড়ত চিন।
সেই সময়েও ক্ষমতার লড়াই থেকেই ধ্বংস হয়ে গেল আয়ুত্থায়া। রাজা একজন ছিলেন। তাঁর শাসনকালে ধর্ম, সংস্কৃতি, স্বাচ্ছন্দ্য সবই ছিল। না হলে কি অমন বিশাল বিশাল সব মন্দির স্তুপ হয়? নৃত্য, গীত, সাহিত্য সবদিকেই সুনাম হয় এই শহরের। কিন্তু রাজা সামলাতে পারছিলেন না সেই ক্ষমভেলোভী বৌদ্ধ ভিক্ষু আর অর্থলোভী বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলিকে। এখনেই ছিল দুর্বলতার বীজ। শত্রু যখন ঘিরে ধরেছে, তখন একজোটে তার মোকাবিলা না করে যে যার আখের গোছাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। বর্মীরা শুরু করল লুঠতরাজ, আগুন লাগানো। শহরটায় ছিল মস্ত মস্ত কাঠের ইমারত, পোড়ামাটি আর ইটের মন্দির। প্রচুর বুদ্ধদেবের মূর্তি, প্রতিকৃতি, পুঁথি, ধর্মগ্রন্থ। আর অনেক অনেক সোনা ছিল মন্দিরে মন্দিরে। জ্বলতে লাগলো ঘর বাড়ি, মন্দির। পালাতে লাগলো মানুষজন। বর্মীরা সোনা গলিয়ে নিয়ে চলল বর্মায়। পুঁথি পত্র আর কাঠের সব ইমারত জ্বলে গেল। ধ্বংসপুরীতে শুধু দাঁড়িয়ে রইল পোড়া মাটির সব মন্দির।
সব চেয়ে বেশী মারদাঙ্গা হয়েছে বর্মার সাথে। সবচেয়ে উল্লেখ্য চতুর্থ বারের যুদ্ধ। তখন রাজা পাল্টেছে, নাম আয়ুত্থায়া হয়েছে। হাতির লড়াই হয়েছিল। শ্যামদেশের রাজা সম্মুখসমরে বর্মার হবু রাজাকে হত্যা করার পর যুদ্ধ থামে। হয়ত সে কারণেই থাইলান্ডের প্রিয় জন্তু হাতি। জাতীয় পশু।
মনে মনে অনেক রাগ পুষে বর্মিরা ফেরত যায়। এবার সিয়ামিজরা বর্মা আক্রমণ করে, দখল করে অনেকটা। সিয়ামিজরা মরল নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে। বর্মা আবার আক্রমণ করল, আবার ফিরে গেল। এবার শক্তি সঞ্চয় করে ফিরল। আক্রমণ করল উত্তর পশ্চিম ঘিরে। আগের যুদ্ধে যেমন হত। জল খাবার বন্ধ করে প্রতিপক্ষকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। এর আগেও এই রকম ঘেরাও হয়েছে। সে ঘের থেকে বেরিয়ে এসেছে তাক্সিনদের রাজধানী।
এবার ১৪ মাস অবরোধের পর হার মানল আয়ুত্থায়া। ভেঙ্গে পড়ল সব। সব দলপতিরা নিজের নিজের আখের গুছিয়ে নিয়ে পালাল। এতদিন যাদের কোলে বসিয়ে লালন করেছে আয়ুত্থায়া, তারাই শত্রুর হাতে ছেড়ে গেল তাঁকে। বর্মিরা নামলো ধ্বংসলীলায়। সব জ্বালিয়ে দিল নির্বিচারে। দলিল, দস্তাবেজ, পুঁথি, মন্দির, মূর্তি সব সব সব। এত দিনের রাগ! প্রতিশোধ।
তাক্সিন পালাচ্ছেন। সঙ্গে এমেরাল্ড বুদ্ধ মূর্তি। আর বিশ্বাস উনি ফিরবেন আয়ুত্থায়া উদ্ধার করতে। উনি ফিরে এসে বর্মিদের তাড়িয়েছিলেন। চিন তখন রেঙ্গুন দখল করতে চলেছে।
তারপরেও বাকি ছিল। বিদেশীদের মার সামলে শহরটা যখন আবার গুছিয়ে নেবার পথে, এল নিজের লোকের লুঠতরাজ।
ওরা তখন নিজেদের বলত “তাই”। হয়ত সেই থেকেই থাইল্যান্ড।
সেই জ্বলে যাওয়া আয়ুত্থায়া এখন world heritage site
******
আমরা রাজার বোট হাউস নিয়ে কথা বলছি। সেখানেও কড়াকড়ি। জলের ওপর নৌকো। নৌকোর ওপর ঘরবাড়ি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন এদিকে কেউ আসেনি। অথচ সান্ত্রী মোতায়েন। গেট দিয়ে ঢুকে বাড়িটা এক চক্কর মেরে আসতে পারো। আমি যাই নি। রাগ করে ছবিও তুললাম না। বেড়াতে এসে কেউ যখন নিয়ম দেখায় এটা কোর না, ওটা কোর না, ভারি রাগ হয় আমার। আরো রাগ হয় যেখানে বেড়া দেওয়া, তার জাল বা ঐ রকম কিছু, যা কিনা সহজ মেলামেশা, যাতায়াতে বাধা। মনে আছে কন্যাকুমারিতে যখন বলল ধুতি পড়তে হবে, বলে দিলাম ‘কন্যাকুমারী, এ জন্মে তোমার আমায় দেখা হল না’। যাক গে, সে কথা। ওরা আমায় বলছিল কটা ঘর, বারান্দা, রান্না ঘর ইত্যাদি। শুনে মনে হল হানিমুন কাপল হলে বেশ ভালো ব্যবস্থা।
এ কি, এ কি? গাড়ি যে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমাদের হাত দেখিয়ে বলে দিল সামনে বিখ্যাত মঠ। দেখে এস। খেয়ে নিতেও পারো। আমরা বিরক্ত। আমাদের বেড ব্রেকফাস্ট। আমরা এমন খেয়েছি…। এখন খাওয়ার কথাই ওঠে না। আমাকেই প্রশ্ন করছে টিম “কোথায় তোমার আয়ুত্থায়া “?
বেশী গাড়ি নেই? মাথার ওপর ঠা ঠা রোদ্দুর। একটা বেশ ছড়ানো চালা বাঁধা। ছড়ানো ছেটানো বসার জায়গা আছে। লোকজন কম। খাবারের দোকানের কমতি নেই। একটা গাড়ি না চলা রাস্তা পেরিয়ে আমরা মন্দির চত্বরে এলাম। একদম কালিঘাটের মত ব্যাপার স্যাপার। পূজোর ডালি বিক্রি হচ্ছে। ফুল কম, ধুপ, ফল, জুসের ক্যান আর টিপের যেমন পাতা হয়, তেমন পাতা কাগজ বড়, ছো্ট মাঝারি। কলা গাছও দেখলাম। আমরা এগিয়ে চলেছি টানে। দুপাশে সার সার দোকান, যেমন থাকে ধর্মস্থানে। অনেক কিছু মিছু বিক্রি আছে।
দোকান সরে গেছে। মাঝ বরাবর সোনার বুদ্ধ। সোনার শ্রমণ বা…। জানি না। দুপাশে যাতায়াতের পথ। দেখলাম পুজো হচ্ছে। এখানে পুজোর দরকারি অঙ্গ হল ঐ টিপের কাগজ থেকে খুব যত্ন করে সোনার ফিনফিনে পাত বার করে মূর্তির গায়ে লেপে দেওয়া। একবার ভাবলাম মেয়েটিকে এগিয়ে জিজ্ঞেস করি যে, সোনা? নাকি সোনালি ফয়েল? সে ভারি ভক্তি ভরে অখণ্ড মনোযোগে কথা বলছে তার আরাধ্য বুদ্ধদেবের সাথে। ওর সঙ্গের বাচ্চাটি অবাক আমায় দেখছে। থাক, আমার প্রশ্ন আমার কাছেই থাক। ফুলের ব্যবহার কম। নকল মালার সাজও দেখলাম। আর দেখলাম কলাগাছ। কর্তা গিন্নি মানত করছেন সেও দেখলাম। পুরুতের উৎপাত নেই। বাইরে খাবারের দোকানি একটু দীঘার মত ডাকাডাকি করেছিল। তাও খুব নরম করে। অসভ্যতা নেই। আর নেই নোংরা। সামনে এগোতে হবে। সবাই ওদিকে যাচ্ছে, ওদিক থেকেই ফিরছে। কি আছে?
বিস্ময়!!
বিশাল সোনার বুদ্ধ। বিশাল মানে বিশাল। চল্লিশ ফুট হবে। সামনে পেছনে পাশে এতো কম জায়গা, আন্দাজ করা কঠিন। একদম অভিভূত হয়ে দেখছি। ছবিতো অনেক তোলা হল, সেই বিপুলতা, সেই অবাক হাওয়া ধরা পড়ল কি? না।
ফেরার সময় বার বার মুখ ফিরিয়ে দেখছিলাম। একদম আড়ম্বরহীন সেই বিশালতা। না এলে ঠিক হত না।
ড্রাইভারের দেখা নেই। ও পুজো দিতে গেছিল। যা বোঝা গেল, এখানে এলে কেউ পুজো না দিয়ে যায় না। ভাসা, ভাসা। ওকে বলতে চাইলেও বোঝাতে পারলাম না, জানলে ওর সাথে যেতাম। অতৃপ্তি। শুধু মন্দিরের নাম জানলাম ওয়ট ফানান ছএং।
******
গাড়ি চলতে শুরু করেছে আবার। আমরা কিন্তু তখনও ঐ বিশাল বুদ্ধ মূর্তি নিয়েই কথা বলছি। আলোচনা চলছে। মনে পড়ছে আমাদের ছোটবেলার বারোভাই এর বারো হাত কালি প্রতিমার কথা। বা সাম্প্রতিক হাজার হাতের দুর্গা প্রতিমার কথা। গুজরাটের বিশাল মূর্তির লজ্জা। সঙ্গের সিঙ্গাপুরের লোকেদের বললাম সে গল্প। তার মাঝে খোঁজ চলছে এই বিশাল বুদ্ধ মূর্তি নিয়ে।
থাইলান্ডে বিশাল, সুবিশাল মূর্তি অনেক আছে। প্রথমটি ওয়ট মুয়াং এ। সেটি আমরা এখানে যেমন দেখলাম ‘ভুমস্পর্শ’ মুদ্রায় ডান হাতে মাটি ছুঁয়ে বসা। ঠিক এখানে যেমনটি। ২৮৫ ফুট উঁচু। আর আমরা যেটা দেখে এলাম এখন সেটি মাত্র ৬২ ফুট। ওয়ট ফানান ছএং এর এই মূর্তি বহু পুরনো। কোন নথি নেই। যা জানা যায় এই মূর্তি ছিল মুক্ত আকাশের নীচে। পরে ওরা্বিহান সেখানে ছাউনি গড়েন। যথেষ্ট জায়গা সত্যি-ই ছিল না। আরও কাহিনি আছে। ১৭৬৭ তে যখন আয়ুত্থায়া জ্বলছে তখন এই মূর্তির চোখ দিয়ে জল পড়ছিল।
সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন এল বিশ্বের সব চেয়ে বড় বুদ্ধ মূর্তি কোথায় আছে? খোঁজ করে জানা গেল মায়ান্মার। তারপরেই ভুটান। থাইল্যান্ড সেখানে কল্কে পায় না। সেই যে আফগানিস্থানের পাহাড়ে কোঁদা বুদ্ধ মূর্তি কামান দেগে ভেঙ্গে দেওয়া হল তার কথাও এল। বামিয়ান বুদ্ধ। দুটি মূর্তি ছিল। দুটি ই ভাঙ্গা হয়। তবে মজা হল সেই জায়গাতেইএখন সেই বুদ্ধদেবকেই দেখা যায় ৩ডি আলোর খেলায়।
সামনে একটু ঝুঁকে পড়তেই বুঝলাম গাড়ি থামল। বিরক্ত হয়ে দেখলাম দু’পাশ। একপাশে ব্যস্ত রাস্তা। অন্য পাশে পার্ক করা গাড়ি, দুয়েকটা ছোটখাটো টুরিস্ট বাস। ভাঙ্গাচোরা পাঁচিল, অযত্নের গাছ। আবার আমাদের অন্য কোন জায়গায় ছেড়ে দিল নাকি! এর পর তো বেলা পড়ে যাবে।
বলল এটাই সেই। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তেমন করে গেট বলে কিছু নেই। ঢুকে পড়লাম। হ্যাঁ, এটাই। বাঁ হাতে পুরো কমপ্লেক্সের একটা মডেল কাচের বাক্সে। আশেপাশে কেউ নেই। আমার একটা গাইড নেবার ইচ্ছে।
মডেল দেখে একটু ঘিঞ্জি মনে হল। মনে হল কোন একটা প্ল্যান মেনে কাজ হয় নি। পরে পরে যোগ করতে করতে এই চেহারাটা এসেছে। নাম জানা গেল ওয়ট মহাথাট। মাঝে পুজাস্থল, চারপাশে গম্বুজ চারটে। পূব দিক ভালো, সূর্য ওঠার দিক, মঙ্গলময়। পশ্চিম ভালো নয়, অশুভ। উত্তর শুভ, দক্ষিনের নাকি মন্দ ভালো কোন গুনই নেই।
আমার তর সইছে না। ঢুকে পড়লাম। ঢুকে পড়লাম মানে কি— ছোট একটা সিকিউরিটি পোস্ট। তার সামনেই খোলা প্রান্তর পোড়া ভাঙ্গা সব স্তুপ, বাড়ি গম্বুজ নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। যা দেখে এলাম, ছোট বড় মিলিয়ে গোটা পঁচিশ গম্বুজ বা প্যাগোডা। গুটি ছয়েক বাড়ি। সামঞ্জস্য নেই।
যাত্রা হল শুরু। এক ফ্রেমে ছটি গম্বুজ। তারপরই ছোট ছোট ভিত নিয়ে একটি চত্বর। বোঝা গেল যে পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপর পেলাম মডেলের একদম সামনে বাঁ হাতের প্যাগোডা। এটা দেখে চেনা যায়। এক জায়গায় খোলা পেলাম এদের রিপেয়ার করার নক্সা। ইট সিমেন্টের কাজ। তবে তাতে একটা নক্সা পেলাম। কিসের?
গম্বুজ বা প্যাগোডা যাই দেখছি চারতলা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে। অথচ মডেলে সাত তলা বা তার বেশি দেখাচ্ছে। আচ্ছা কত লোক মারা গেছিল? তার হিসেব আছে কি?
এরপর হৃদয়বিদারক দৃশ্য। মূর্তি আছে মাথা নেই। এক জায়গায় দেখা গেল একটি আস্ত মূর্তি আছে। তাকে অঙ্গবস্ত্র দিয়ে পুজো করা হয়েছে। এর পর ছোট বড় ভাঙ্গা মূর্তি দেখতে দেখতে পৌঁছলাম সেই জায়গায় যার ছবি সবচেয়ে বেশি বার তোলা হয়েছে। ধ্বংসের পর ওখানে একটি মূর্তি ছিল। এবার গাছ তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মুখটুকু শুধু দেখা যায়।
আমাদের ফেরার পথে সার সার ধড় মুণ্ড তালগোল পাকানো মূর্তির সারি। ভারি মন নিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম। কেউ একজন, যে জানে এখন আমাকে যদি দুশ আড়াইশ বছর পেছনে নিয়ে যেতে পারত!
গাড়ি আমাদের ঘাটে নিয়ে গেল। এখান থেকে লোকে নৌকো চড়েও ফেরে। আমরা গাড়িতেই যাবো। নামার কথাই নেই। আমি একটু অন্যমনস্ক। গাড়ি আবার থেমেছে। সবাই নামছে। এখানে আবার কি? চমক এখানেও। একদম ময়দানে তিনি শুয়ে আছেন। বিশাল। ষাট সত্তর ফুট হবেন। সামনে তারই ছোট প্রতিকৃতি। সেখানেও দেখলাম সোনার ফয়েল লাগানোর রীতি আছে। এখানে বেশ মজার ব্যাপার একটা দেখেছি। বুদ্ধাকে চিপ্স আর কোকের ক্যান দেওয়া হয়। এখানে তিনটি পদ্মফুল আর একটা কাত হয়ে থাকা গেলাস।
আয়ুত্থায়া পর্ব শেষ।
*********
উত্তরকথন
দেখিনি সোনার বুদ্ধ। আয়ুত্থায়া লেখার পর অনেকদিন আমাকে সোনার বুদ্ধ ডেকেছে। ছবি দেখেছি। রেখেছি যত্ন করে। তাও শান্তি নেই মনে। আমাকে আবার বসতেই হল। উনি চান আমি আমার মত করে লিখি। তাই……।
১৩০০ ১৪০০ সালের কথা। তখন কোথায় থাইলান্ড, কোথায় ব্যাংকক। তখন ঐ চত্বরে সুখথাই সাম্রাজ্য। ঐ অঞ্চলে ভারত, বুদ্ধ, সংস্কৃত, পালি এই সবের অনেক প্রভাব। সুখথাই নাম এসেছে সুখ আর উদয় এই দুটি শব্দ থেকে। অনুবাদে কি দাঁড়ায়? সুখের ভোর।
সত্যিই সুখের রাজ্য ছিল। রাজা যদি ভালো হন, শান্তি থাকে, সুখ সমৃদ্ধি এমনি আসে। যাকে আমরা বলি লক্ষ্মী। এখানে গণতন্ত্রের বাস তখন। রাজা প্রজার সম্পর্ক মানে পিতা পুত্রের সম্পর্ক।
এখনকার মত নয়। এখন তো প্রভু – দাসের সম্পর্ক।
সমৃদ্ধ রাজা অনেক সৌধ, মন্দির, মসজিদ বিদ্যালয় বানান। বিদেশীরা বাণিজ্য করতে এলেই শহরে ঢুকে বুঝতে পারেন এটা সমৃদ্ধ রাজ্য। এখানেও ব্যতিক্রম নেই। রাজা তার সংস্কার ধর্ম বিশ্বাস মেনেই রাজকর্ম করেন। এখানে হিন্দুধর্ম মহাযান বৌদ্ধধর্মের মিশেল প্রভাব। রাম আছেন, আছেন বুদ্ধ। সবচেয়ে নজর কাড়া কীর্তি ছিল রাজধানির একবারে মাঝখানে বিশাল এক বুদ্ধ মূর্তি। ফ্রা সুখথাই। পুরোটাই সোনার। সাড়ে পাঁচ টন সোনা দিয়ে তৈরি। তখনকার দিনে এইসব ব্যাপারে ভারত অনেক এগিয়ে। বুদ্ধদেবের আদল বলে দিচ্ছে এ মূর্তি ভারতে তৈরি। ভারতে তৈরি আর সব মূর্তির মতই ডিম্বাকৃতি মুখের গড়ণ। বারো ফুট লম্বা, চওড়ায় নয় ফুট। যেমন অনুপাতে দৃষ্টিনন্দন হয় মূর্তি। শরীর শতকরা আশি ভাগ খাঁটি সোনায় তৈরি। মুখমণ্ডল চুল, চূড়া শতকরা ৯৯ ভাগ নিখাদ সোনা। ভূমিস্পর্শ ভঙ্গিমায় আসীন মূর্তির চুলের সাজ, নিখুত বাঁকের ভ্রুযুগল, লম্বা কানের লতি, গলার তিনটি ভাঁজ, চওড়া কাঁধ, প্রশস্ত বুক বলে দিচ্ছে এ রাজকুমার বুদ্ধ। সেকালে এই মূর্তি সবার চোখ টেনেছে।
এটাও সত্যি রাজা যদি তার উত্তরসূরি না তৈরি করেন, রাজ্য থাকে না। কোন রাজা বিলাস ব্যসনে ডুবে যান, সময় দিতে পারেন না, কারো বা অভাব থাকে সুযোগ্য আধারের। সব রাজা, সাম্রাজ্য সম্রাট কিন্তু ইতিহাসে একই গল্প শোনায়। আর একজন যোগ্যতর কেউ আসেন। যুদ্ধ হয়। মানুষ মরে, রাজাও মরে। নতুন রাজা আসে, নতুন শিক্ষা, নতুন সংস্কৃতি, নতুন জীবনযাত্রা। এখানেও ব্যতিক্রম নেই।
সুখথাই পরাজিত হল আয়ুত্থায়া রাজবংশের কাছে। গর্বের সোনার বুদ্ধ ঠাইনাড়া হলেন। এলেন আয়ুত্থায়ায়। এ মূর্তি বার বার বাসা বদল করেছেন। সুখথাই- আয়ুত্থায়া- থনবুড়ি- ব্যাংকক। তারপর শুরু হল আয়ুত্থায়ার অবনমন। বর্মীরা আক্রমন করল বার বার। বৌদ্ধ মঠে সন্যাসীরা চিন্তায় পড়লেন। কি করে এই মূর্তি বাঁচান হবে লুঠেরাদের হাত থেকে।
মূর্তির প্রথম অধিষ্ঠানের সন তারিখ জানা নেই। কোন সূত্রে কোথাও উল্লেখ নেই। তবে এইবার মূর্তি হারিয়ে গেলেন প্রায় দুশ বছর। ১৭৫৭। বর্মীদের আক্রমনে ধ্বংস হল আয়ুত্থায়া, জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল। ছোট বড় মাঝারি সব সোনার মূর্তি সোনার তাল হয়ে রাওয়ানা হল বার্মার দিকে। পাথর মাটির কিছু মূর্তি পড়ে রইল আয়ুত্থায়ার ধ্বংসস্তুপে।
রাম ১ রাজা হবার পর আদেশ করলেন সব বুদ্ধ মূর্তি আয়ুত্থায়া থেকে বাংককে আনার। চায়না টাউনের কাছে ওয়াট ছটানেরাম প্যাগোডায় এল কাচের পুঁতি দিয়ে সাজান একটি মূর্তি। যখন এই বুদ্ধ মন্দিরের জীর্ণ দশা সে মূর্তি গেল ওয়াট ট্রাইমিতে। সেখানেও একচালার তলায় রইলো মূর্তি আরো কুড়ি বছর। ব্যাংকক এমনিতেই মঠ প্যাগোডায় ভরা। এও তেমনি এক মঠ।
১৯৫৪ সালে সংস্কার শুরু হয়। বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের ২৫০০ বর্ষপূর্তি উৎসবের আয়োজনে। ১৯৫৫ সালে এই মূর্তি সরানোর সময় দড়ি ছিঁড়ে মূর্তি মাটিতে পড়ে। মূর্তির এক কোনে চিড় ধরে, খসে পড়ে পলেস্তারা। দেখা যায় ভেতরে চকচক করছে সোনা!! সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তখন সারা ব্যাংকক জুড়ে একটাই খবর। একটু একটু করে পলেস্তারা খসান হয়। অনুসন্ধান চলতে থাকে। মূর্তিটি কোথা থেকে এলো। আদি ইতিহাস জানা গেল না। তবে এটা নিশ্চিত ১৭৫৭ সালে এ মুর্তি ছিল আয়ুত্থায়াতে। ওপরের পলেস্তারা আর কাচ পুঁতির কাজের জন্য এটা নজর কাড়েনি বর্মীদের। প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলারের মূর্তিটি রক্ষা পায়। তারপর সুখথাই মহারাজের শিলালিপিতে উল্লেখ পাওয়া যায় এক সোনার বুদ্ধের। সেই বুদ্ধ যদি ইনি হন তাহলে মূর্তিটি প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো। অতি যত্নে একটু একটু করে পলেস্তারা ছাড়ানর পর আরো এক চমক ছিল। একটা ছোট বাক্সে একটা চাবি পাওয়া যায়। সে চাবি দিয়ে অত বড় মূর্তিটি ৯টি ভাগে খুলে ফেলা যায়। সেভাবেই সরান হয় মূর্তি।
২০১০ থেকে এই মূর্তি মানানসই মন্দিরে অধিষ্ঠান করছেন ব্যাংককের চোখের মনি হয়ে।
Add comment