সাহিত্যিকা

আমার রুমমেটরা

আমার রুমমেটরা
@(স্বর্গত) সর্বানিদাস রায়, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৯৬৪-৭০

ভূমিকা: আমার দাদা (স্বর্গত) সর্বানিদাস রায় কিছু লেখালেখি করতেন। তাঁরই পুরনো একটা লেখা এখানে শেয়ার করলাম।
– বিজিত কুমার রায়, ১৯৮৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

১৯৬৪ সালে বিই কলেজে ভর্তি হয়ে স্থান পাই ৭ নম্বর হোস্টেলের চারতলায়। প্রথম দিনে রুমমেট পেলাম সুদিন রায় ও নীহারকান্তি রায়কে। সুদিন ভবানীপুরের রামরিক ইন্স্টিটিউশন থেকে পাশ করেছে। খুব গোছানো স্বভাব। টাইফয়েডের জন্য হায়ার সেকেন্ডারিতে আশানুরূপ ফল হয় নি, এবার কলেজে তা মেক আপ করতে বদ্ধপরিকর! পড়াশোনার পোকা! আর নীহার চন্দননগর কানাইলাল বিদ্যামন্দির থেকে এসেছে, পড়াশোনায় ভালো, আদর্শবাদী, কিছুটা গ্রাম্যতা আছে।

সুদিন বিই কলেজ থেকে ভালো রেজাল্ট করে GRE দিয়ে আমেরিকায় মাস্টার্স করতে যায়, তারপরে আর কারো সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ রাখে নি! আর নীহার ’৬৯ এ বিই গ্র্যাজুয়েশন করে, তারপর ৭১ সালে বিই কলেজেই মাস্টার্স করে দুর্গাপুরে বেশ কিছুদিন চাকরি করে বিয়ে করে বউ নিয়ে আমেরিকা চলে যায়, প্রথমে নানারকম stray jobs করে। তারপর ১৯৮৬ সালে আমেরিকায় পিটসবার্গ ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করে, তখন সে Westinghouse এ ফুলটাইম চাকরিও করে। তারপরেও সবশেষে U.S. Nuclear Regulatory Commission এ কাজ করেছে। স্বাস্থ্যের কারণে একটু বেশি বয়সেই দূরপাল্লার দৌড় অভ্যাস করে এবং ম্যারাথন রানার হয়ে যায়। ৭ টি মহাদেশে ফুল ম্যারাথন দৌড়েছে। ১৯৯৯ সালে ৫০+ বছর বয়সে প্রথম ফুল ম্যারাথন, আর ২০০৫ সালে নিজের ৪০-তম ফুল ম্যারাথন। এখন চাকরি করেও ম্যারাথন দৌড়াচ্ছে! কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনেছে, বছরে একবার আসে। আমার ও অন্য অনেক বন্ধুর সাথেও যোগাযোগ রেখেছে।

আমাদের ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুদিন পরে আরেকজন ছেলেকে আমাদের ঘরে জায়গা দেওয়া হয়, তার নাম সুবীর দাস, মাইনিং এর ছাত্র, হাওড়ায় বাড়ি ; খুব হুল্লোড়বাজ চালু ছেলে! সুবীর প্রথম বছর ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে নি ; পরের বছরে অন্য হোস্টেলে গিয়ে বন্ধুদের বই ইত্যাদি চুরি করতে গিয়ে ধরা পরে ও বেদম মার খায়! সেবছরও ফেল করায় CNR হয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।

১৯৬৫ সালে অর্থাৎ আমাদের সেকেন্ড ইয়ারে আমার স্থান হলো ১০ নম্বর হোস্টেলে, দোতলায়। সুদিন রায় ও নীহারকান্তি রায় এবারও রুমমেট। ওদের আলাদা সেকশন; দুজনেই মেকানিক্যাল আর আমি ইলেকট্রিক্যাল। চতুর্থ রুমমেট ছিল ঢাকুরিয়ার ছেলে অমিত রায়চৌধুরী, যতদূর মনে পরে সিভিলের। অমিত ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের পাশের ঘরে থাকত, তাই ভালো চেনাশোনা ছিল। যদিও রুমমেট, দুর্ভাগ্যক্রমে অমিতের কলেজ-পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না।

১৯৬৬ সালে থার্ড ইয়ারে আমি ১০ নম্বর হোস্টেলেরই তিনতলায় স্থান পেলাম। এবার নতুন রুমমেট দিল্লীর আদিত্য সরকার, যার সম্বন্ধে বিশদে লিখেছি আলাদা এক পোস্টে, তাই এখানে আর কিছু লিখছি না। সেই আদিত্য ছিল এক বর্ণবহুল চরিত্র! সে বছরে ছিল আদিত্যের গীটার শেখার ব্যর্থ চেষ্টা। দ্বিতীয় রুমমেট কৃষ্ণনগর, বা আরও সঠিকভাবে বললে শক্তিনগরের বিপ্লব সরকার। সুস্বাস্থ্য, সুদর্শন, হাসিখুশি, আড্ডাবাজ পাবলিক। ওর বাবা ছিলেন কংগ্রসের এমএলএ নরেন্দ্রনাথ সরকার, ডাকসাইটে মানুষ! একদিন হোস্টেলে এসেছিলেন, লম্বা-চওড়া চেহারা। জানা গেল যে উনি আমার বাবাকে ভালো চিনতেন, তবে কী সূত্রে সেটা এখন আর মনে নেই। সেই বছরের শেষ দিকেই বিপ্লব আমাদের সহপাঠিনী সুন্দরী ইন্দিরা মিত্রের প্রেমে পরে যায়। শনি-রবিবার দুজনে কলকাতার নানা জায়গায় ঘুরতো। কিছু কিছু প্রেমের গল্প আমরা বিপ্লবের কাছে শুনতে পেতাম। কলেজ পাশ করে অল্প কিছুদিন চাকরী করার পরে ওরা দুজন বিয়ে করে। আমার বন্ধুদের সেই প্রথম বিয়ে! তারপরে ওরা একসঙ্গে ইলেকট্রিক্যাল কন্ট্রোল প্যানেল তৈরির ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসা ক্রমে দাঁড়িয়ে যায়, এখনো চালু আছে। এবং আমাদের মধ্যে যোগাযোগও কিছুটা আছে।
তৃতীয় রুমমেট ছিল নোয়াখালী থেকে আসা সত্যেন সাহা। ওর বাবা নোয়াখালীতে ব্যবসা করতেন। সত্যেন স্কুল পাশ করে কলকাতায় ওর দাদার কাছে মেসবাড়িতে চলে এসে পরীক্ষা দিয়ে আমাদের কলেজে ভর্তি হয়। সত্যেন পড়াশুনায় ছিল খুব ভাল। কলেজ পাশ করে ও ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়ে Indian Power Engineering Services (Central Electricity Authority, CEA) তে যোগ দেয়। বরাবরই দিল্লিতে ছিল। Director হয়েছিল। অনেক পরে অফিসের কাজে পাটনা যাওয়ার সময়ে এক বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় !

১৯৬৭ সালে অর্থাৎ আমাদের ফোর্থ ইয়ারে আমার স্থান হোলো ১৪ নম্বর হোস্টেলে, তিনতলায়। ৪ জনের ঘরে দেওয়া হলো দুজনকে। আমি আর গৌতম রায়। গৌতম আর আমি ফার্স্ট ইয়ার থেকে একই হোস্টেলে এবং সেকেন্ড ইয়ারে একদম পাশের ঘরেই থাকত। তাই ঘনিষ্ঠ পরিচিতিও ছিলো। হিন্দী হাই স্কুলের ছাত্র, ইংরেজিতে তুখোড়! সেইসময়ের দিনে ক্যারাটে জানে, জার্মান ভাষা কলেজেই শিখছে, আর মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ইংরেজি ও স্প্যানিশ গান গায়! আর সেই সময়ে আমি British Council লাইব্রেরি থেকে অনেক ইংরেজি বই এনে পড়তাম (বার্নার্ড শ’র প্রায় সব নাটকই পড়ে ফেলেছিলাম) আর কঠিন শব্দ বা idiom পেলেই ওর শরণাপন্ন হতাম। গৌতমের দিদি সেই সময়ে ছিলেন Indian Foreign Service-এ, Senegal-এ পোস্টেড। ওঁনার অনেক কথা গৌতমের কাছে শুনতাম। কলেজ থেকে পাশ করার কিছুদিন পরে গৌতম আমেরিকায় চলে যায়, ওখানেই থেকে গেছে। আর যোগাযোগ নেই আমার সঙ্গে।

বিভিন্ন হোস্টেলের রুমমেটদের কথা এখানেই শেষ; কারণ এর পরে ম্যাকডোনাল্ড হল (repeating ফোর্থ ইয়ার) ও উলফেন্ডেন হল, ফাইন্যাল ইয়ারে single-seater রুমে একাই থাকি।

তবে এক বন্ধুর কথা আজ লিখতে চাই। তাঁকে ১৯৭০ ব্যাচের পাশ করা প্রায় সবাই চিনত, খুব পপুলার ছিল। নাম তপন সেনগুপ্ত, জামশেদপুরের আদি ছেলে, যদিও তখন থাকতো দক্ষিণ কলকাতায়। আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু (যেমন চন্দ্রপ্রকাশ মুখার্জী, সমর সেন, অমিত সেনগুপ্ত, সায়গল) আমাদের ফাইন্যাল ইয়ারে তপনের ঘরেই পুরো সন্ধ্যা ও ঘুমোবার আগে পর্যন্ত সময়ে আড্ডা মেরে কাটিয়ে দিতাম! তপন ভালো গান গাইত, বহু ব্যাপারে খবরাখবর রাখত, ভালো ক্লাস নোট নিত, ভালো বোঝাতেও পারতো, আর ভীষণ আড্ডা দিতে পারতো! আমাদের কলেজের পরেও বসুশ্রী কফি হাউসে সেই আড্ডা বেশ কিছুদিন চলেছিল, যতদিন না চাকরী পেয়ে তপন গেলো MECON-এ আর চাঁদু গেলো DVC-তে! আমি আর তপন দুজনে ফাইনাল পরীক্ষার পরে রেজাল্ট বেরোবার আগেই একটা ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম Madras IIT-তে Computer Lab-এ। আসল উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল ওদের খরচায় বেড়ানো! আনন্দে মাদ্রাজ শহর ও তিরুপতি ঘুরেছিলাম! ক্যামেরা হাতে নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম বলে, ওরা আমাকে একটু আওয়াজ দিয়েছিল, তবে আসাযাওয়ার পুরো ফার্স্ট ক্লাস ভাড়া দিয়েছিল! ওখানে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে স্টাইপেন্ড ছিল খুবই কম, তাই দুজনের কেউই জয়েন করতে খুব একটা উৎসাহী ছিলাম না। তপনের সংগে পরে আর যোগাযোগ ছিল না। দু -এক বছর আগে ওর মারা যাওয়ার খবর মন খুব খারাপ করে দিয়েছিল !

Sahityika Admin

Add comment