সাহিত্যিকা

আমাদের পুনর্মিলন (১৯৬৪-২০২৪)

আমাদের পুনর্মিলন (১৯৬৪-২০২৪)
গ্রন্থনায় প্রবীর কুমার সেনগুপ্ত, ১৯৬৯ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

গত ২৭ শে অক্টোবর ২০২৪, রবিবার, আমরা কলেজ ক্যাম্পাসে আমাদের বন্ধুত্বের হীরক জয়ন্তী (১৯৬৪ – ২০২৪) উৎসব পালন করলাম।

১৯৬৪ সালের ২ রা আগস্ট আমরা এক এক করে কলেজের হোস্টেলে এসে হাজির হয়েছিলাম। মনে হয় যেন গত কাল বা পরশুর কথা। আজও আমাদের বেশ মনে আছে নিজেদের মধ্যে আলাপ পরিচয় আর সামান্য র‍্যাগিং এর পরে দাদাদের সাথে আলাপ। আমরা প্রায় ৪৫০ ছাত্রছাত্রীরা পশ্চিমবঙ্গের আর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছি। নেপাল, কাশ্মীর থেকে আসা বন্ধুরাও ছিল। এক এক জনের পারিবারিক সংস্কৃতি, ধর্ম আর আর্থিক ক্ষমতার বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আমরা সকলে মিলে মিশে একই পরিবারের সদস্য হয়ে গেলাম। তারপর পাঁচ পাঁচটি বছর কী ভাবে যে কেটে গেলো – সে সব লিখতে গেলে হয়তো আরও একটা মহাভারত সৃষ্টি হয়ে যাবে। তাই সেই চেষ্টা আর করছি না।

রবি ঠাকুরের গান “পুরানো সেই দিনের কথা …..” আমাদের সকলেরই খুব প্রিয়। ঐ গানের শেষ দুটি লাইন আমাদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
“হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায়,
আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয়”।
এই দুটি লাইনের ঠিক মাঝখানে আমাদের সকলেরই চল্লিশ পঞ্চাশটি বছর লুকিয়ে রয়েছে।

কলেজ থেকে পাশ করে বের হওয়ার পর কাজের সন্ধানে আমরা দেশের বা পৃথিবীর নানা প্রান্তে কে যে কোথায় ছড়িয়ে পড়লাম তার হিসেব করা মুশকিল। তখন এত হোয়াটসএপ, ইমেইল, মোবাইল ফোন ছিল না। স্বাভাবিক নিয়মেই বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ অনেক কমে গেল। আমরা কে যে কোথায় হারিয়ে গেলাম সে খবরই রইলো না। আমাদের অনেকেই আজ পৃথিবীর সকল মায়া ছেড়ে পরপারে চলে গেছে। তারপর যারা আছি, আমরা নিজেদের কাজের থেকে অবসরের পর “আবার দেখা যদি হল সখা ….” আমরা আবার একটা ফ্যামিলির মতো হয়ে গেলাম।

এর মধ্যে ১৯৯০ সালে আমাদের BEC-1969 Group একটা Registered Association হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মাঝে মধ্যেই আমরা প্রায়ই নানা রকম ছোট বড় Get Together বা দু-চার দিনের জন্য কাছাকাছি বা দূরে কোথাও বেরিয়ে আসি।

সেই দিনের অনুষ্ঠানে আমাদের গান, আবৃত্তি আর স্বরচিত কবিতা পাঠ ছাড়াও একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল গ্রুপ ডিসকাশন। মোট চারটে গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। তিনটে গ্রুপ ছিল বন্ধুদের নিয়ে আর একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছিল বন্ধু-পত্নীদের নিয়ে, অর্থাৎ আমাদের গৃহিণীদের নিয়ে। আমরা ছেলেরা বেশির ভাগই কলেজ জীবন আর হোস্টেল জীবনের খাট্টামিঠা গল্পেই মত্ত ছিলাম। ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের ডাউনিং হস্টেলে যখন রাত্রে ভাতের বদলে রুটি দেওয়া শুরু হয় সেই সময় হঠাৎ এক রাত্রে ডিনার স্ট্রাইক শুরু হয় আর খুব হৈচৈ হয়। সবাই একসাথে “আমাদের দাবী মানতে হবে – ভাত চাই, ভাত চাই” বলে আওয়াজ তুললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই হোস্টেলের সুপার কামদা-বাবু আসতেই সবাই হুড়মুড় করে দৌড়ে যে যেখানে পারে বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরেছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে কয়েকজনের জুতো খুলবারও সময় হয়নি। লেপের তলা থেকে বের হওয়া জুতো পরা পা দেখে কামোদা-বাবু সবাইকে শুনিয়ে বললেন – “বাঃ। এখনকার সাহেব ইঞ্জিনিয়াররা জুতো পরেই ঘুমায় দেখছি। কাল আবার সকালে ক্লাস করতে যেতে হবে”। এই বলে উনি হাসতে হাসতে চলে গেলেন। আর আমরাও সবাই সুড়সুড় করে ডাইনিং রুমে গিয়ে টেবিলে বসে পরলাম।

কলেজে বা হোস্টেলে নানা রকম ঘটনা দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা হল। এর মধ্যে বাতাইতলায় লোকাল ছেলেদের সাথে মারামারি আর তার পরের প্রায় তিন দিনের বেশি অনশন ধর্মঘট যেমন ছিল তেমনই পানাগরের NCC Camp থেকে পালিয়ে আসবার কথা আর তার ফলস্বরুপ সরস্বতী পুজোর মধ্যে Punishment Camp এর গল্পও ছিল।

আর মহিলাদের গ্রুপের আলোচ্য বিষয় ছিল তাদের বিয়ের পর তারা কেমন ভাবে এই BEC 69 গ্রুপের সাথে একাত্ম হয়ে গেলো। সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করলো – এই গ্রুপ ডিস্কাশন মহিলাদের আলোচনাই সবচেয়ে বেশি মনোগ্রাহী হয়েছিল। নানা রকম আলোচনার মধ্যে তারা এটাও বলেছিল যে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে একজন বি ই কলেজের প্রাক্তনীর সাথে যখনই আরোও এক প্রাক্তনীর আলাপ হয় – তারা বয়সের তফাৎ ভুলে গিয়ে খুব সহজেই দাদা ভাইয়ের মত হয়ে যায় আর প্রয়োজনে একে অপরকে নানা রকম সাহায্য করে।

তারপর Alumni Guest House এ লাঞ্চের ব্যবস্থা। দুটো ডাইনিং রুমে কোনরকমে ঠেসাঠেসি করে বসে তিনটে ব্যাচে লাঞ্চ হল। লাঞ্চের পর ছোট ছোট দলে ক্যাম্পাসের চারিদিকে ঘুড়ে বেড়িয়ে সেই ছোট বয়সে ফিরে যাওয়া। সে সব দিনের নানা রকম গল্প স্ত্রীদের সাথে share করা আর নিজেকে হীরো প্রতিপন্ন করা।

সেই দিনের অনুষ্ঠানে প্রত্যেক বন্ধুকে সকলের নাম খোদাই করা হীরক জয়ন্তীর একটি স্মৃতিচিহ্ন (Memento) দেওয়া হয়েছিল। যে সব প্রয়াত বন্ধুর স্ত্রী-রা উপস্থিত ছিল তাদের হাতেও প্রয়াত বন্ধুর স্মরণে তাদের নামে একই রকম এক একটি স্মৃতিচিহ্ন (Memento) তুলে দেওয়া হয়েছিল।

আমাদের এই বন্ধুত্বের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে আমরা একটা ম্যাগাজিন বা স্যুভেনির বের করেছি। আমাদের বন্ধুরা কর্মজীবনের আর পারিবারিক জীবনের নানা রকম অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে share করেছে। এইখানে দেওয়া ওই link এ আমাদের ওই ম্যাগাজিন দেখতে পাওয়া যাবে ।
https://drive.google.com/file/d/1Doe2ZAeM0mUMthnoGFxvKQwhtuBHeIbL/view

অত বড় ম্যাগাজিনের সব গল্প পরবার ধৈর্য সকলের নাও থাকতে পারে, তবে আমি অনুরোধ করবো – একেবারে শেষে আমাদের প্রয়াত বন্ধু চন্দনের স্ত্রী স্বপ্নার “ভুল ঠিকানা” কবিতাটা একবার পড়তে।
আমার বিশ্বাস – ভালো লাগবে।

এরপর প্রায় তিনটের সময় ফার্স্ট লবিতে এসে গ্রুপ ফটো তোলবার সময় আমাদের ছাত্র সময়ের ফটোগ্রাফার D Ratan এর কথা বিশেষ ভাবে মনে পরে যাচ্ছিল। এখন আর সেই কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা ক্যামেরার লেন্স কভার খুলে ‘এক-দুই-তিন’ গুনবার দিন শেষ হয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ, ফটোগ্রাফারের এক সহকারি হাতে একটা হ্যান্ড মাইক নিয়ে আমাদের নানারকম ডিরেক্সন দিয়ে বলছিল – আপনি একটু ডান দিকে সরে যান, আপনি একটু মাথাটা উচু করুন, এইবার একটু হাসি মুখ করুন, ইত্যাদি। গ্রুপ ফটো নিচের Link এ দেখা যাবে।

https://www.facebook.com/photo/?fbid=8578624645548996&set=gm.10162504201941742&idorvanity=55122671741

ফটোগ্রাফির পর আবার ইনস্টিটিউট হলে এসে চা কফি বিস্কুটের পর সবাই মিলে আমাদের প্রিয় – ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গান গেয়ে আমাদের সে দিনের অনুষ্ঠান শেষ করলাম।

 

 

Sahityika Admin

1 comment

  • It is proposed to have names in group photo
    L to R and row wise along with departments
    For benefit of friends residing outside of
    Kolkata