আমাদের ইংরেজি শিক্ষা
@হিমাংশু নাথ, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আমাদেরই এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, একটি ছেলে পাড়ার দুর্গাপূজার স্যুভেনিরে জন মিল্টনের এক কবিতা নিজের নামে ছাপিয়ে দিয়েছিল। তখন সে বাংলা মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস নাইনে পড়ে। সেই পাড়ায় ছিলেন একজন নামী লোক, ষাটের দশকে মাল্টিন্যাশনালে চাকরি করতেন, কলকাতার এন্টালি অঞ্চলে বড় বাড়িতে থাকেন, গাড়ি ছাড়া চলেন না, এবং দুর্গাপূজায় মোটা অঙ্কের চাঁদা দেন, উনি না চাইলেও প্রতি বছর পূজার লিফলেটে ওনার নাম থাকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক, পাড়ার ছেলেরাই নাম ছাপিয়ে দেয়।
স্যুভেনির হাতে পেয়ে উনি ছেলেটিকে বাড়িতে ডাকলেন, খুব প্রশংশা করলেন যে বাংলা মিডিয়াম স্কুলের ছাত্ররাও এত ভালো ইংরেজি কবিতা লিখতে পারে। আর নিজের মেয়ের সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিলেন। আর এখানেই সমস্যার শুরু। মেয়েটি দশটা কথার মধ্যে আট’টা ইংরেজি বলে, মাত্র দু’টি বাংলায়। আর ছেলেটি দশে দশ। বলা ভালো, ছেলেটি একশ’তে একশ’টাই বাংলা বলে। ছেলেটি বাইরে এসে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যে স্পোকেন ইংলিশ শিখতেই হবে।
আমাদেরও সেই অবস্থা।
যেমন, প্রফেসর অমিতাভ মুস্তাফি ইংরেজি ছাড়া অন্য কোন ভাষা ব্যাবহারই করেন না। ক্লাসে, বা ল্যাবে, এমনকি পরীক্ষার হলেও ইংরেজিতেই বকাঝকা করেন।
কলেজের ফোর্থ ইয়ারে উঠে আমাদের হস্টেলের সব জনতার মাথায় তখন একটা বড় চিন্তা। এর এক বছর পরেই, মানে ফিফথ ইয়ার শেষ হলেই পাশ, এবং চাকরির জন্য ইন্টারভিউ। পড়াশুনোর সাবজেক্ট এর চিন্তা যার যার তার তার, কিন্তু সবারই কমন চিন্তা যে ইন্টারভিউ ফেস করা মানে ইংরেজিতে কথা বলা। কে যেনো প্রস্তাব দিলো, প্রতিদিন সন্ধ্যায়, রাতের খাওয়ার আগে ৮ থেকে ৯-টা, এই ১ ঘন্টা নিজেদের মধ্যে শুধু ইংরেজিতেই কথা হবে।
আমাদের সবারই বাংলা মিডিয়াম – পরিপূর্ণ কমিউনিজম, একেবারেই সাম্যবাদ! আমাদের মধ্যে একমাত্র জয় ইংরেজি (Calcutta Boys) মিডিয়াম আর দেবু ছোটোবেলা ইংরেজি মিডিয়ামে কিছুদিন পড়েছিলো।
আগে সারাদিন সারা সন্ধ্যায় হাউ মাউ হোতো, যেদিন থেকে ফরমান জারি হোলো pin drop silence. আড্ডা বন্ধ হয়ে বই খোলা হোতো আর ছোটো খাটো সংক্ষিপ্ত ইংরেজি কথাবার্তা।
তখন আমরা বেশ তাস খেলতাম। auction bridge. শিক্ষাগুরু কালি, আমরা ছাত্র। কালি-জয়, আমি-উদো পার্টনার। 7.55 তে যে স্টাইলে কথা হতো 8.05 আলাদা। ৮ টার আগে প্রতি deal এর আগে তীব্র সমালোচনা, হেব্বি ক্যালির গপ্পো। ৮ টার পর সেটাই খুব সফিসটিকেট মন্তব্য “bad play”!!
আমাদের মধ্যে পট্টা বেশ কিছু ইংরেজি জানতো। প্রেসিডেন্সি থেকে ও BSc করে এসেছিলো। ফ্লো বিশেষ ভালো ছিলো না, কিন্তু ভুল ইংরেজি বলতো না। আর কিছুটা জানতো ঁদুলাল। ওরও মোটামুটি পট্টার মতোই। দুলাল ও কিছুটা BSc পড়েছিলো। ব্যাস্….বাকি সব এক লেভেলে। সবাই ঘরে বই খুলে ঘড়ি দেখতাম কখন ৯ টা বাজবে। জয়-দেবু ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে ইংরেজিতে কথা বলতো। আমরাও সেরকম ইংরেজিতে উত্তর দিতাম। কেউই কারোর কথায় হাঁসতাম না, কারন আগেই বলেছি লেভেল সব সমান।
এর মধ্যে দু একজনের কথা একটু বলতেই হবে। একজন পঙ্কা (পঙ্কজ প্রধান)। সবথেকে সাহসী…বেপরোয়া, অকুতোভয়। ওর এক জাহাজী দাদা ছিলো। তার থেকে পঙ্কা শিখেছিলো ইংরেজি বলার সময় গ্রামার-টামার নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না, যা মনে আসবে “ফ্লুয়েন্টলি” বলে যেতে হবে – সেটাই আসল। যুক্তি ছিল, সব জার্মান, ফ্রেঞ্চ, জাপানীরা কি সঠিক ইংরেজি বলে? আমরা জানলাম যে আমেরিকানরাও ব্যাকরণকে অত গুরুত্ব দেয় না। পঙ্কার জাহাজী দাদার ইংরেজিতে জাহাজের ডিরেকশন চেঞ্জ হতো কিনা জানা নেই। দাদার থেকে পঙ্কা একটা মোক্ষম বিদ্যা শিখেছিলো। ইংরেজি শব্দ জানা না থাকলে বাংলা শব্দের পিছনে একটা ing যোগ করলে সাহেবরা মোটামুটি বুঝে যাবে। অনেকটাই শোলের ধর্মেন্দ্রর মউসিকে “চাক্কি পিষিং, চাক্কি পিষিং” ফর্মাটে। পট্টা তাঁর রুমমেট পঙ্কাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো ও ভাবে বললে সাহেবরাও বুঝবে না, বাঙ্গালিরাও বুঝবে না …. ফল হয় নি।
আর একজন ছিলো ঁপার্থ। পার্থ কথার মাঝে এক আধটা শব্দ একদম ব্রিটিশ একসেন্টে বলেই আবার মুল সুরে গান। মানে ভবতারিনী বুনিয়াদী বিদ্যালয় থেকে একলাফে Doon school and back to ভবতারিনী। একথালা পান্তাভাতে একচামচ আফগানি বিরিয়ানি! তার সঙ্গে ম্যাচিং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। অনেকটাই “নমক হালালে” অমিতাভের ইংরেজি ইন্টারভিউ এর পরে কনফিডেন্স লেভেল।
ঁ পালতের বলার প্রচন্ড ইচ্ছে ও প্রচেষ্টা …কিন্তু যতটা চোখ সকেট থেকে বেরিয়ে আসতো, ততটা শব্দগুলো খুঁজে পেতো না।
এরকম আরো আছে। উদো ওর ইংরেজিতে আবার বরানগর-সিঁথির ফ্লেভার আনতো স্ স্ s s করে । হয়তো নার্ভাস হয়ে বা ভাবতো সাহেবরা হয়তো এটা পছন্দ করতে পারে।
আমার নিজের framing of sentence এবং vocabulary অতি সীমিত ও ত্রুটিপূর্ণ ছিলো বলে জয় প্রায়ই বক্তব্য সম্পুর্ন করতে সাহায্য করতো। জয় বা দেবু এইজন্য কোনোদিন কাউকেই বিন্দুমাত্র শ্লেষ বা ব্যাঙ্গ করে নি আমাদের খামতির জন্য। নিজেদের লজ্জা ছিলো না, সবারই একই অবস্থা ছিলো বলে।
তখন আমাদের ইয়ারের মেসো, মামু, আর অসীম প্রচুর ইংরেজি গান শোনে। সেই কলেজের সময়েই আমরা ওঁদের ইংরেজি গানের উপর ফান্ডা দেখে মুগ্ধ। (তবে ওঁদের ছিল শুধুই গানের ডিকশনারি, এদেরকে কোনদিন ইংরেজিতে কথা বলতে শুনিনি)। দেবু সেইসময় স্টিরিও কিনেছে, অসীমকে গিয়ে ধরলো যে একটা হেব্বি ঝিংছ্যাক ইংরেজি ডিস্ক কিনতে হবে। শনিবার বাড়ি যাওয়ার পথে ধর্মতলা থেক গ্র্যান্ড ফাংক গ্রুপের একটা রক মিউজিকের এলবাম নিয়ে বাড়ি ঢুকলো। পরদিন হস্টেলে এসে জানালো যে, বাবা প্রথম দু তিনটে গান শুনে আর বাজাতে দেন নি। উনি বলেছেন যে, গায়ক কি বলছে, মানে গানের লিরিক্স, সেগুলো আগে বলো। তারপর গান শোনা। আবার, আমার শোনা কথা যে অসীম আর সুকান্ত একবার রবীন্দ্রনাথের গানগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছিল, যেমন চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে the moon’s smile broke the barrage, বা তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই Whatever you say brothers, I want golden deer, অথবা জাগরণে যায় বিভাবরী, Bivabori is going in sleep, এইরকম। তবে উপযুক্ত বোদ্ধার অভাবে এনারা মনে হয় খুব বেশিদিন এই কাজ করে যেতে পারেন নি।
প্রত্যেকের কথা লিখতে গেলে লম্বা হতেই থাকবে। কিন্তু একজনের কথা না লিখলে এই কাহিনী সম্পুর্ন হবে না।
অনুপ (রাহা) পৌনে আটটা বাজলেই উসখুস করতো। ওর নাকি সেসানাল জমা দিতেই হবে। ৭.৫৫ পরে কিছুতেই আটকানো যেতো না। ঘরে গিয়ে খাটে বসে চারিদিকে কতগুলো বই সাজিয়ে বসে যেতো। অস্বাভাবিক মনোযোগ …. কোনোদিকে নজর নেই।
সেই সময় জয়-দেবু গুটিগুটি ওর দরজা খুলে ঢুকতো। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচন্ড জোরে তিনটে আলাদা শব্দ – bloody! bastard !! get out!!
প্রত্যেকদিন তিনটে শব্দ!
তবে এর একটা সমাপ্তিও আছে। রাত ঠিক ৯ বেজে ১৫ সেকেন্ডে অনুপ ঘর থেকে বেরোতো…. দৃপ্ত পদক্ষেপ …. সবার ঘরে গিয়ে ঘোষনা …Time is up…..Time is up……
কি নিশ্চিন্ত ….
পাশাপাশি আমরা অনেকেই ইংরেজি সিনেমা দেখতে শুরু করলাম। তবে দেখা গেলো যে ডায়লগের সিনেমা থেকে একশনের সিনেমাই অধিক জনপ্রিয়, যেমন ব্রুস লী, বা ক্লিন্ট ইস্টউড। ডায়লগ কম, ঝারপিট বেশি।
যাই হোক, ইংরেজি বলা কতদূর হয়েছিল জানিনা, তবে প্রাথমিক জড়তা নিশ্চয়ই কিছু কমেছিলো। জয়-দেবু কে ধন্যবাদ ….
সোনার দিনগুলি…
এবারে শেষ করছি,
আমরা পাস করে বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক পরেই কলকাতার টেলিরামা কোম্পানি ইলেকট্রনিকস ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্টের জন্য এলো। শুরু হলো গ্রুপ ডিসকাশন দিয়ে, বিষয় electronics in our daily life. একসাথে পুরো ডিপার্ট্মেন্ট গ্রুপ ডিসকাশনে বসে গেছে। দেখা গেলো আধ ঘন্টার সেই আলোচনায় সেরা ছাত্ররা কেউ মুখই খুললো না। আর জনেন্দ্র আচার্য সারা আধ ঘণ্টায় একটিই মাত্র কথা বলেছিল, electronics is making people lazy.
আমাদের ছাত্রজীবনের সময়ে জনেন্দ্রর সেই একটি মাত্র লাইনের ছোট্ট একটি ঐতিহাসিক উক্তি আজও জনগন মনে রেখেছে।
আমি শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী,
হস্টেল জীবনে আমরাও একবার ভেবেছিলাম যে ইংরেজিতে কথাবার্তা চালু হোক। মাত্র সপ্তাহ খানেক চালু রাখতে পেরেছিলাম,
পুরনো হস্টেল দিনের কথা মনে পড়ে গেল।
Just nostalgic.
Those were the good old immatured days. So much of fun.
অপূর্ব।
এই প্রসঙ্গে বলি আমাদের 12 নম্বরের এই রকমের ইংরেজীতে কথা বলার ভূত চাপেনি। এখানে গ্রেট পড়ুয়া যেমন ছিল, তেমনই ছিল বিখ্যাত ফুটবল প্লেয়ার, চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু আর প্রেমের দেবতা কিউপিড, (আর আমাদের মাঝে নেই)।বাকি সবাই মুনি ঋষিদের মতো গঙ্গার ধারে ধ্যান করতেন।
তবে পাশ করার পর আমি নিজে বহুদিন ইংরেজীতে কথা বলার অভ্যাস ঝালিয়ে নিতাম আমাদের মেসের মেম্বারদের সাথে।সেই ইংরেজী একসেন্ট প্রায় খাঁটি ইউরোপিয়ান মতো হত, নিন্দুকেরা বলতো কিছুই নাকি বোধগম্য হতো না।আমি এই প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলাম এক বছর ধরে। তারপর একবার বেনারস ঘুরতে গিয়েছিলাম এক দলের সাথে সঙ্গে আমাদের জুনিয়র এক ছাত্র ছিল। আমরা রাস্তার ঘুরছি, নিজেদের মধ্যেই বাংলায় কথা বলছিলাম, হঠাৎই এক সাদা চামড়ার পাবলিক এসে American accent এ জানতে চাইলেন -you man, how to go to *sarnat* ? আমি ইতস্তত করতে করতে কেবল -i i করতে করতে বলতে চাইছিলাম যে আমি জানি না। ততক্ষণে সাহেব অন্য দিকে চলে গেল। সেটাই ছিল আমার বৃটিশ accent এ কথা বলার শেষ চেষ্টা।
সত্যিই লেখাটা খুব ভাল হয়েছে। হিমুর অরিজিনাল লেখা যে বা যারা পরিবর্ধন করেছে, তাকে বা তাদের বাহবা দিতেই হয়।💐🌹