সংক্ষেপে সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪)
সংকলক: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১ ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
মুজতবা আলীর রচনার ভূমিকা বা সমালোচনা লেখার ক্ষমতা বা শাস্ত্রাধিকার আমার নেই। তবে তাঁর একজন গুণমুগ্ধ পাঠক হিসাবে কিছু লিখতে ইচ্ছে হল। তাই এই নিবেদন।
সিরিয়াস কথা হেসে হেসে এবং রসিকতার মোড়কে বলার যে অসম্ভব ক্ষমতা তাঁর ছিল সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি নিজেই বলেছেন ‘মৃত্যু’5 লেখাটিতে : “বিশ্বসংসার না জানুক, আমার যে ক’টি পাঠক-পাঠিকা আছেন তাঁরা জানেন আমি হাসাতে ভালোবাসি।“ তাঁর রসিকতাবোধ ছিল অতি উচ্চমানের। জীবনের নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর লেখা। বেশির ভাগ লেখাই তাঁর পান্ডিত্যপূর্ণ। কিন্তু কোথাও মনে হয়নি যে তিনি তাঁর পান্ডিত্য দেখানোর চেষ্টা করছেন, বরং মনে হয়েছে যেন তিনি আমাদের সঙ্গে পাড়ার রকে বসে, আড্ডা দিতে দিতে, সাবলীল এক মজাদার ভাষায় তাঁর জীবনের গল্প শোনাচ্ছেন।
এই হাসানো মানে কিন্তু ভাঁড়ামো নয়। মজলিশী ঢঙে অনেক সিরিয়াস আলোচনা তিনি করেছেন। তাঁর হাসির মোড়কে অনেক কান্না, হাহাকার ও ক্ষোভের কথাও লুকিয়ে আছে। তাঁর লেখনী বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেছে, তাকে মজলিশী বা বৈঠকি ধারা বলতে পারেন। আদতে তিনি একজন মাস্টারমশাই যিনি আমাদের মতো মূর্খদের গল্পচ্ছলে কিছু শেখাতে চেয়েছেন। অসামান্য পান্ডিত্য। সারাজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা দিয়ে বানানো তাঁর লেখা রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনী ও উপন্যাস আমাদের আজও অবাক করে। বার বার পড়তে মন চায়।
উদাহরণ হিসাবে নেওয়া যাক সাড়ে তিন পাতার ছোট্ট তাঁর একটি রম্য রচনা ‘সুখী হবার পন্থা’2। তাঁর ভাষাতেই বলি “…. আমাদের শাস্ত্রেও আছে, ‘ভারাদ্যপগমে সুখীসংবৃতোऽহমিতিবৎ, দুঃখাভাবনে সুখিত্বপ্রত্যয়াৎ।’ বাঙলা কথায়, আমার ঘাড়ে বোঝা ছিল, সেটা নেবে যেতেই বললুম, আহা কি আরাম, এসো ক্ষুদিরাম : আহা কী সুখ, ঘুচে গেছে দুখ। ….” এই হল সুখের সংজ্ঞা। এরপর তিনি সুখী হবার পন্থা সম্বন্ধে পরদুঃখকাতর ফরাসী গুণী ভলতের লেখা এক অন্ধ মহিলাকে সান্ত্বনা দিয়ে লেখা চিঠির উল্লেখ করেছেন : “Nous avons un grand sujet à traiter : il s’agit de bonheur on du moins d’être le moins malheureux qu’on peut dans ce monde.” [অর্থাৎ] “আমাদের আলোচনার বস্তু বিপুলাকার এবং মহত্ত্বপূর্ণ: প্রশ্ন এই, ‘সুখী হওয়া যায় কিসে, কিংবা অন্ততপক্ষে এ সংসারে অল্পতর দুঃখী হওয়া যায় কি প্রকারে?”
জার্মান কবি হাইনে, ইরানী কবি ওমর খৈয়াম (সঙ্গে মূল ফার্সী এবং কান্তি ঘোষ, সত্যেন দত্ত আর ফিট্জিরাল্ডের অনুবাদ), চীনা সাহিত্যিক লিং য়ুটাঙ (Lin Yutang), রবীন্দ্রনাথ, চন্ডীদাস, লালন ফকীর, গৌতম বুদ্ধ এবং মহাকবি গ্যোটের বক্তব্য শুনিয়েছেন। সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন দু একটা চুটকি গল্পও। কিন্তু লেখাটা পড়ে কখনোই মনে হয় না তিনি তাঁর পান্ডিত্য দেখাচ্ছেন। মনে হয় যেন একটা মজার গল্প শুনছি। এখানেই তিনি অসাধারণ রম্যরচনা তথা প্রবন্ধ-লেখক। শুধু হাসি, কান্না, রসিকতা নিয়ে তিনি যে কত লিখেছেন তার হিসেব জানি না। তাঁর লেখা ‘হাসির অ-আ, ক-খ’2, ‘হাসি-কান্না’2, ‘রসিকতা’2 ইত্যাদিও উল্লেখযোগ্য।
আড্ডাপ্রিয় মুজতবা আলী
বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে আড্ডা দিতে তিনি বড় ভালোবাসতেন। সে কাইরোর কাফে, ইংরেজের ক্লাব, জার্মানির পাব, কাবুলির চা খানা, ফরাসীর বিস্ৎরো হোক বা হেদোর মোড়ে বসন্ত কেবিনই হোক। এই আড্ডার গল্প তিনি বহুবার করেছেন: ছড়িয়ে আছে তাঁর বহু লেখায়।
তাঁর একটি লেখা ‘আড্ডা’1থেকে কয়েকটা লাইন তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলুম না: “কি বললেন স্যার? বাড়ি বিক্রি করতে এসেছেন? আমি কিনবো? আমি? বাড়ি নিয়ে করবোটা কি আমি? জন্ম নিলুম হাসপাতালে, পড়াশুনো করলুম হোস্টেলে, প্রেম করেছি ট্যাক্সিতে, বিয়ে হল রেজিস্টারের আপিসে। খাই ক্যানটিনে – কিংবা যারে কয় ‘ভোজনং যত্রতত্র’ – , সকালটা কাটে কর্তাদের তেলাতে, তেনাদের তরে বাজার করে দিতে। … হাটে-রেশনে, দুপুরটা অফিসে, মাঝে মিশেলে সিনেমা হলে – সন্ধ্যেটা। পটল তুললে শুইয়ে দেবে নিমতলায়। বাড়ি নিয়ে কি আমি গুলে খাবো? তার চেয়ে বলি, আসলে আমার দরকার একটি আড্ডার। …. তার খবর দিতে পারেন? তবে বুঝবো, আপনি একটি তালেবর ব্যক্তি। ….. আড্ডা প্রতিষ্ঠানটি হালফিল পুরোহাতা ব্লাউজের মত ডাইয়িং ইনডাসটারি – মৃতপ্রায়।“
আড্ডা নিয়ে তাঁর মোক্ষম রচনাটি আপনি পাবেন ‘কাইরো’3 লেখাটিতে। তিনি আল-আজাহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়শোনা করতে কাইরোতে এক বছরের অধিক ছিলেন। তাঁর কথাতেই বলি ” … আমি ভালোবাসি হেদো, হাতিবাগান, শ্যামবাজার। ও-সব জায়গায় তাজমহল নেই, পিরামিড নেই। তাতে আমার বিন্দুমাত্র খেদও নেই। আমি ভালোবাসি আমার পাড়ার চায়ের দোকানটি। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা হাজিরা দিই, পাড়ার পটলা, হাবুল আসে, সবাই মিলে বিড়ি ফুঁকে গুষ্ঠিসুখ অনুভব করি আর উজির-নাজির মারি। আমার যা কিছু জ্ঞান-গম্মি তা ঐ আড্ডারই ঝড়তি-পড়তি মাল কুড়িয়ে নিয়ে। তাই যখন কপালের গর্দিশে কাইরোতে বাসা বাঁধতে হল, তখন আড্ডাভাবে তিনদিনেই আমার নাভিশ্বাস উপস্থিত হল। ছন্নের মত শহরময় ঘুরে বেড়াই আর পটলা-হাবলুর বসন্ত রেস্টুরেন্টের জন্য সাহারার উষ্ণ নিশ্বাসের সঙ্গে আপন দীর্ঘ নিশ্বাস মেশাই। …” আড্ডা নিয়ে তাঁর আর একটি লেখা আপনি পাবেন ‘আড্ডা’3 নামের একটি রম্যরচনা পঞ্চতন্ত্র ১ম পর্বে। এছাড়া বহু লেখার ভিতর এই আড্ডা নিয়ে অনেক মজাদার কথা তিনি আমাদের বলেছেন।
বহুভাষাবিদ্ মুজতবা আলী
আপনার যদি বিভিন্ন ভাষা চর্চার (ইংরাজি বাদে, কারণ উনি ইংরেজদের ওপর হাড়ে চটা ছিলেন) উৎসাহ থাকে মানে ফরাসী, জার্মান, সংস্কৃত, আরবী, ফার্সী ইত্যাদি ভাষা নিয়ে, তবে মুজতবা আলীর লেখায় আপনি অনেক মণি মুক্তো খুঁজে পাবেন। তবে হ্যাঁ, লেখাগুলোর পাদটীকা পড়তে ভুলবেন না যেন। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক তাঁর লেখা ‘অল্পে তুষ্ট’1 থেকে : “… ইংরেজী সাহিত্য যে ফরাসী সাহিত্যের কাছে কতখানি ঋণী তার জরিপ করা আমার কর্ম নয়। শব্দবিদ না হয়েও বেপরোয়া আন্দাজে বলি, ইংরিজীর শতকরা নব্বইটি চিন্ময় শব্দ (অ্যাবস্ট্রাক্ট ভকাবুলারি) হয় ফরাসী নয় ওরই মারফৎ লাতিন গ্রীক থেকে নেওয়া।
আরো কত শত বাবদে আজো ইংরিজী ভাষা, সাহিত্য, রান্নাবান্না (মেনুটা এখনো ৮০% ফরাসিস; বীফ, মাটন্, পরক্, ভীল, ভেনজেন্ = গরু, ছাগল, শূয়োর, বাছুর, হরিণের মাংস-সব কটা শব্দ ফরাসী থেকে এসেছে), আদব-কায়দা (R.S.V.P থেকে P.P.C). মদ্যাদি (কন্যাক্ থেকে শ্যামপেন) ফরাসীর কাছে ঋণী – বস্তুত বিলেতে, আজো সভ্যতা ভদ্রতার কোন্ না বস্তু ফরাসীর প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল বা আছে?”
শুধু ব্যাকরণ বা ভকাবুলারি নয়, বিদেশী ভাষার বহু মজাদার গল্প, কবিতা আর অনুবাদও তিনি আমাদের শুনিয়েছেন। তার লেখার শুরুতে প্রায়ই আপনি পেয়ে যাবেন কোন একটা মজাদার গল্প। যেমন ধরুন ‘শের্শে লা ফাম্’4 (Cherchez la femme – মেয়েটিকে খোঁজো) গল্পটি বড়োই উমদা এবং সর্বোপরি ওনার বক্তব্যটা বোঝাতে শুরুর এই গল্পটা খুব কাজে দিয়েছে।
বিশ্ব সাহিত্যের পরিচয়
মুজতবা আলী তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে বহু বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন : যেমন চেখফ, তলস্তয়, মপাসাঁ, লেসকফ, দস্তেয়ফ্স্কি, ফ্ল্যোবের, তুর্গেনেফ, আঁদ্রে জিদ, এমিল জোলা, আলফঁস দোদে, অস্কার ওয়াইল্ড ইত্যাদি। অল্প পরিসরে, তাঁদের লেখার চুলচেরা বিচারও করছেন। শুনিয়েছেন বাংলা অনুবাদ : যেমন চেখফের ছোট গল্প ‘দুশেচকা’ বা The Darling এর বাংলা অনুবাদ ‘দুলালী’ (অনুবাদটি করেন তাঁর অনুরোধে তাঁর সখা মৌলানা খাফী খান)। এখানেই শেষ নয়। ‘দুশেচকা’-র ওপর তলস্তয় যে অপূর্ব এক টিকা বা সমালোচনা লিখেছিলেন তারও বাংলা অনুবাদটি (খাফী খানের অনুবাদ) আমাদের তিনি শুনিয়েছেন। চেখফকে জানতে বা তাঁর লেখার ধরণ জানতে ‘কবিরাজ চেখফ’2 পড়ুন। ছোট গল্পের তিন সম্রাট ‘মোপাসাঁ-চেখফ-রবীন্দ্রনাথ’3 রচনাটি অনবদ্য। তিনজনের রচনা শৈলী নিয়ে একটি মনোজ্ঞ আলোচনা আছে। সঙ্গে আপনি ইস্কিলাস-শেলী- স্পিটলার’3 নিয়ে রম্য রচনাটি পড়ে ফেলুন – তিন পাতার লেখা। তাঁর লেখা ‘পরিচিতি’5 আর ‘মপাসাঁ’6 লেখা দুটি পড়তে ভুলবেন না। মপাসাঁ নিয়ে কিছু অজানা তথ্য পেয়ে যেতে পারেন। ইভান সের্গেভিচ তুর্গেনেফ9 নিয়েও তিনি লিখেছেন। মাঝে মাঝে আফ্সোস হয় যে তিনি এঁদের নিয়ে আরো বেশি লিখলেন না কেন।
ভাষা বাবদ তিনি আমাদের যে কত তথ্য দিয়েছেন তা দেখে আজও অবাক হই। ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ-এর ইংরাজী অনুবাদক হিসাবে শুধু ফিটসজেরাল্ডের নাম জানতুম। কিন্তু ফরাসী বা জার্মান অনুবাদ নিয়ে কোন ধারণাই ছিল না। ‘খৈয়ামের নবীন ইরানী সংস্করণ’2 থেকে জানতে পারলুম চার ভাষার (ইংরাজী, জার্মান, ফরাসী, আরবী) অনুবাদ এবং খৈয়ামের মূল ফার্সী রুবাইয়াৎ নিয়ে (মোট পাঁচটি ভাষায়) খৈয়ামের নবীন ইরানী সংস্করণের কথা। ইন্টারনেট ঘেঁটে পেয়েও গেলাম এই সংস্করণটি। সত্যেন দত্ত বা কান্তি ঘোষের বাংলা অনুবাদ তো আমাদের আছেই।
মুজতবা আলী ও অনুবাদ সাহিত্য
মুজতবা আলীর অনুশোচনা ছিল যে বাংলায় সেভাবে অনুবাদ সাহিত্যের প্রকাশ ঘটে নি। তাঁর লেখা ‘অনুবাদ সাহিত্য’3 নামের একটি প্রবন্ধে তিনি তার একটা কারণ হিসাবে বলেছেন “… কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সৃষ্টিকার। তাঁর পক্ষে অন্য লেখকের রচনা অনুবাদ করবার কোন প্রয়োজন ছিল না।….. অনুবাদ-চর্চা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বেশী সময় নষ্ট করেন নি বলেই বোধ করি বাঙলা সাহিত্যে অনুবাদের দিক দিয়ে এত হীন।” মুজতবা আলীর আক্ষেপটা অন্য জায়গায়। তিনি বলেছেন “ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ফরাসী সাহিত্যের উত্তম উত্তম রস-সৃষ্টি বাঙলায় অনুবাদ করতে আরম্ভ করেন। বিংশ শতকেও তিনি এই কর্মে লিপ্ত এবং মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত তিনি একাজে ক্ষান্ত দেন নি। ঠিক স্মরণ নেই, তবে খুব সম্ভব লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলকের বিরাট মারাঠি গীতার অনুবাদই তাঁর শেষ দান।“
মুজতবা আলী অনেককে অনুরোধ করেও যখন দেখলেন মূল ভাষা থেকে অনুবাদ করার লোকের অভাব তখন নিজে কিছু অনুবাদ কর্মে হাত দিলেন। তিনি নিকোলাস লেসকফ রচিত একটি অনবদ্য রুশ গল্পের অনুবাদ করেন ‘প্রেম’7 নাম দিয়ে (আসল নাম ম্ৎসেনস্ক জেলার ‘লেডি ম্যাকবেৎ’)। এছাড়া তিনি ফরাসী সাহিত্যিক আলফঁস দোদের একটি ছোট গল্পের (লে ভিউ – Les Vieux) অনুবাদ করেন ‘বুড়ো-বুড়ী’8 নাম দিয়ে। দোদের ফরাসী ছোট গল্পের সংকলন ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। উৎসাহী পাঠক মূল ফরাসী গল্পের সঙ্গে মুজতবা আলীর অনুবাদটি মিলিয়ে দেখতে পারেন । অসাধারণ অনুবাদ। চেখফের একটি একাঙ্ক নাটক (A Marriage Proposal) তিনি ’বিয়ের প্রস্তাব’2 নামে অনুবাদ করেন। আমেরিকান সাহিত্যিক রিচার্ড কর্নেলের “The Most Dangerous Game”-এর অনুবাদ তিনি করেছিলেন ‘সর্বাপেক্ষা সঙ্কটময় শিকার’5 নাম দিয়ে। ‘কত না অশ্রুজল’ সঙ্কলনগ্রন্থের* চিঠিগুলো তিনি অনুবাদ করেছেন অত্যন্ত সংবেদনশীলতার মাধ্যমে। ‘অনুবাদ সাহিত্য’10 নিয়ে মুজতবা আলীর লেখা আর একটি প্রবন্ধ পাবেন পঞ্চতন্ত্র দ্বিতীয় পর্বে।
ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস, বড়গল্প ও প্রবন্ধসংগ্রহ
মুজতবা আলী দেশে বিদেশে বহু জায়গায় ঘুরেছেন এবং থেকেছেনও বেশ কিছুকাল করে। সামান্য কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বলা যায় – ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতন যাত্রা এবং বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে অধ্যয়ন (১৯২১-১৯২৬)। কাবুলে অধ্যাপনা (১৯২৭-১৯২৯), কাইরোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন (১৯৩৪-৩৫), জার্মানি ভ্রমণ (বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালযে অধ্যয়ন (১৯২৯-১৯৩২), পরবর্তীকালে আরও দুবার জার্মানি ভ্রমণ (১৯৬২ ও ১৯৭০)। মাঝখানে ১৯৩০ এ প্যারিস ও লন্ডনে অধ্যয়ন। বিভিন্ন সময়ে ইউরোপের নানা জায়গায় তিনি ভ্রমণ করেছেন : যেমন অস্ট্রিয়া, ভেনিস, লজান, মন্ত্রো, লুৎসেন, ইন্টার লেকেন, জুরিখ, মিলান, জেনেভা, লেজা, কলোন, ডুসেলডর্ফ ইত্যাদি।
চাকরিসূত্রে ও অন্যান্য কারণে থেকেছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায় – বরোদা, কটক, পাটনা, দিল্লি, আলীগড়, কলকাতা ও বেঙ্গালুরু। বহু ভাষাবিদ, মিশুকে এই মানুষটি মিশেছেন বিভিন্ন ভাষাভাষী সাধারণ লোকের সঙ্গে। বিশাল তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি। সেই অভিজ্ঞতা আর তাঁর ভাষার কারিকুরি দিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু ভ্রমণকাহিনী। ‘দেশে বিদেশে’ (কাবুল ভ্রমণ ও তাঁর বসবাসের অভিজ্ঞতা) , ‘ভবঘুরে’ (বন শহর থেকে হাইকিঙে বেরিয়ে জার্মান গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণ) জলে ডাঙায় (ছোটদের জন্য লেখা), ‘মুসাফির’, ‘বিদেশে’ ইত্যাদি ভ্রমণ কাহিনী তিনি লিখেছেন। তবে সব ভ্রমণকাহিনীর সেরা হল ‘দেশে বিদেশে’। আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় কাবুল যাত্রা ও কাবুলের সাধারণ মানুষের জীবনধারার যে চিত্রায়ণ তিনি করেছেন তার কোন তুলনা আমার জানা নেই। মুজতবা আলীর যদি শুধু একটা রচনা পড়বেন বলে ঠিক করেন, তবে আপনি অবশ্যই ‘দেশে বিদেশে’ পড়বেন বলে আমার বিশ্বাস। ‘দেশে বিদেশে’ শেষ করেই আপনি ‘পঞ্চতন্ত্র’ প্রবন্ধ সংগ্রহ পড়বেন বলেও আমার বিশ্বাস এবং শেষে সমগ্র মুজতবা আলী রচনাবলী।
মুজতবা আলী রম্যরচনা (প্রবন্ধ বলাই বোধ হয় ঠিক) ছাড়া বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও বড় গল্প লিখেছেন যেমন ‘শবনম’, ‘শহর-ইয়ার’, ‘তুলনাহীনা’, ‘টুনি মেম’, ‘অবিশ্বাস্য’ ইত্যাদি। শবনম পড়লে আজও চোখে জল এসে যায়। কে যেন বলছিলো তিনি আমাদের শুধু হাসাতেই চেয়েছিলেন? তাঁর লেখা ‘কত না অশ্রুজল’ -এর চিঠিগুলো পড়লে কোন পাষন্ডের চোখে জল না এসে থাকতে পারে? মুজতবা আলীর প্রবন্ধ সংকলন নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে, একান্তই যদি না পড়ে থাকেন তবে, শুরুটা করতে পারেন পঞ্চতন্ত্র, চাচা কাহিনী, রাজা উজীর, বড়বাবু দিয়ে।
মুজতবা আলীর রচনায় রবীন্দ্রপ্রভাব
মুজতবা আলীর শতকরা প্রায় আশি শতাংশ রচনায় রবীন্দ্রনাথকে কোন না কোন ভাবে পাওয়া যায়। তাঁর চিন্তার জগতে রবীন্দ্রপ্রভাব অপরিসীম বলে মনে হয়। আলাদা করে শুধু রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখা রচনাগুলো চিহ্নিত করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। তাঁর লেখা যে কোন একটি প্রবন্ধসংগ্রহ বা উপন্যাস নিয়ে পাতা উল্টে যান, আপনি রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ পাবেনই পাবেন। তবু বলি ‘গুরুদেব’6, ‘মৃত্যু’5 (রবীন্দ্রনাথের জীবনে অকালমৃত্যুর মিছিল), ;পঁচিশে বৈশাখ’3, ‘রবি-পুরাণ’9, ‘রবীন্দ্রনাথের আত্মত্যাগ’5, ‘রবীন্দ্র-সঙ্গীত ও ইউরোপীয় সুরধারা’6, ‘রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সহকর্মিদ্বয়’5 – এই রকম অনেক রচনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাঁর লেখায়। মুজতবা আলী বলতেন রবীন্দ্রনাথের সব রচনা যদি কোনদিন মানুষ ভুলে যায় তাহলেও রবীন্দ্রসংগীত চিরদিন বেঁচে থাকবে বাঙ্গালীর অন্তরে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাঁর অসীম অনুরাগ প্রায় তাঁর সব রচনাতেই প্রকাশ পেয়েছে।
সাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্র মহাশয়ের লেখা মুজতবা আলী রচনাবলীর ভূমিকায় পাই “রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অভিভূত করেছেন, প্রভাবিতও করেছেন। তাই তাঁর উপন্যাসের মধ্যে যেটি প্রথম ও বোধকরি সমধিক জনপ্রিয় – সেই ‘শবনম’-এ তাঁর অজ্ঞাতসারেই ‘শেষের কবিতা’-র প্রভাব এসে পড়েছে।”
মুজতবা আলীর রচনার সঠিক মূল্যায়ন
১৯০৪ – ১৪ই সেপ্টেম্বর করিমগঞ্জ শহরে (অধুনা বাংলাদেশে অবস্থিত) মুজতবা আলীর জন্ম। ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতন যাত্রা এবং রবীন্দ্রনাথের ছত্রছায়ায় (১৯২১-১৯২৬) বিশ্বভারতীতে অধ্যয়ন। এরপর থেকেই দেশের ও বিদেশের নানা জায়গায় তিনি হয় অধ্যয়ন বা অধ্যাপনার কাজ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর দাদা সৈয়দ মূর্তাজা আলীর লেখা থেকে পাই যে মুজতবা আলী পনেরটি ভাষা জানতেন। ল্যাটিন, ফরাসী, জার্মান, ইটালিয়ান, রাশিয়ান ইত্যাদি ইউরোপীয় ভাষা ও আরবী, ফার্সী, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত, গুজরাটী, মারাঠী, ইত্যাদি প্রাচ্য ও ভারতীয় ভাষায় তাঁর দখল ছিল। Wilhelm Humboldt নামক প্রতিষ্ঠানটির স্কলারশিপ নিয়ে জার্মানি যান। ১৯৩৬ সালে তাঁর PhD থিসিস – “The Origin of the khojalis and their religious life today” জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়। এরপরও অনেক বার তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেন। দিল্লীর অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকুরী করেন, অল ইন্ডিয়া রেডিও কটক ও পাটনাতে ডিরেক্টর পদেও ছিলেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন B.B.C তে ছিলেন কিছুদিন।
বিচিত্র তাঁর অভিজ্ঞতা, সঙ্গে অগাধ পান্ডিত্য। কিন্তু ভুলেও তিনি তাঁর পান্ডিত্য প্রকাশ করতেন না। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে তিনি যেন অতি বিনয়ী। তিনি যেন কখনোই প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক হওয়ার চেষ্টা করেন নি। আবারও বলছি আদতে তিনি একজন মাস্টারমশাই। সর্বদা আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। আমরাই তাঁর পান্ডিত্যের তল খুঁজে পাই না। তবে তিনি নিজেকে কখনোই পন্ডিত হিসাবে তুলে ধরেন নি। বরঞ্চ রসিকতা করে বলেছেন পন্ড করাই যার কাজ সেই হল পন্ডিত। মনে প্রশ্ন জাগে সত্যিই আমরা বাঙালিরা কি তাঁকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছি? নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি তাঁর সাহিত্য নিয়ে আজকের দিনে আলোচনা করে? আজকের দিনে যারা বিদেশী ভাষা শিক্ষায় উৎসাহী তারা কি মুজতবা আলীর ‘হরিনাথ দে স্মরণে’9 প্রবন্ধটি পড়েছে? আমার জানা নেই।
১৯৭৪ সালে ১১ই ফেব্রুয়ারী তিনি মারা যান ঢাকায় থাকাকালীন। তাঁর স্ত্রী রাবেয়া খাতুন ও দুই ছেলে তাঁর মৃত্যূর সময় উপস্থিত ছিলেন। অসাধারণ সাহিত্যিক মুজতবা আলীকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।
তথ্য সংগ্রহ
মুজতবা আলী রচনাবলী: 1. রাজা উজীর, 2. টুনি মেম, 3. পঞ্চতন্ত্র প্রথম পর্ব, 4. ভবঘুরে ও অনান্য, 5. বড়বাবু 6. ময়ূরকন্ঠী, 7. প্রেম, 8. দুহারা, 9. চতুরঙ্গ 10. পঞ্চতন্ত্র দ্বিতীয় পর্ব
* যে জার্মান বই থেকে অনুবাদ: Die Stimme des Menschen. Briefe und Aufzeichnungen aus der ganzen Welt 1939-1945 Gesammelt und herausgegeben. von Hans. Walter Baenl Piper Verlag, 1961,
A very thoughtful write up on a renowned writer, who had his own style of writing.
Thanks for the writer, and the editors also.