সাহিত্যিকা

গ্রামীণ দুর্গা দর্শনে তিন তরুণ বিক্কলেজিয়ান

গ্রামীণ দুর্গা দর্শনে তিন তরুণ বিক্কলেজিয়ান
দীপ্ত প্রতিম মল্লিক, ১৯৮০, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

ভূমিকা
অনেকবছর আগে বি ই কলেজে পড়ার সময়, মনে পড়ে সেই সময়ে, মানে ১৯৭৫ সালে, আমাদের সহপাঠী মুজিব একদিন ১৩ নম্বর হোস্টেলের খাপওলা থালায় হাফডিমের ঝোলের অবশিষ্টাংশটুকু চুমুক দিয়ে খেতে খেতে বলেছিল – এখানে বাটি দেয় না বলে ঝোল খেতে বড়ো অসুবিধা, আমাদের গ্রামে তো বাসন চাইলেই পাওয়া যায়। আর সে যে সে বাসন নয়, ইয়া মোটা মোটা কাঁসার বাসন, এক একটা ভারী কি!
“সেটা কিরকম?” সুধীর ফ্যান মেশানো ডাল এক হাতা প্লেটে ঢেলে বলল, “ব্যাপারটা কি রকম? বাসন চাইলেই পাওয়া যায়, কে দেয়? কোন পার্টি? সিপিএম না কংগ্রেস?”
মুজীব ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে গ্লাসটা ঠকাস করে টেবিলে নামিয়ে বলল, কে আবার? বদ্যিমাতা।
– সে আবার কে?

আমরা তখন গল্পের গন্ধ পেয়েছি।
– বদ্যিমাতা কে ও কেন? বাসন চাইলেই যতো খুশি পাওয়া যায় তো যত খুশি আনলেই হয়, কাঁসার বাসন বলছিস যখন নিয়ে আয় না দু চারটে। হোস্টেলে তো বাটির অভাব।
সুধীর এখন সিরিয়াস।
মুজীব আর কথা না বাড়িয়ে হাত জোড় করে কাকে যেন একটা প্রণাম ঠুকে উঠে গেল – মনে হয় প্রণামটা বদ্যিমাতাকেই।

এর পর বহু বছর কেটে গেছে, সেই মুজীব আর আমাদের মধ্যে নেই- পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না থাকার দেশে চলে গিয়েছে। আর আমরাও সেই বদ্যিমাতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।

*******

পুরনো একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেলো।

দেখতে দেখতে সেবারের দুর্গাপূজা এসে গেল। দুর্গাপূজা এলেই মন কেমন যে আনচান করে, হৃদয়েও যেন কাশফুলের দোলা লাগে। কিরকম দোলা বোঝানো যাবে না, তবে দোলা যে লাগে বুঝতে পারি। আর প্রবাসে থাকি বলে কিনা জনি না, মা দুর্গা আমায় যখন যেমন টানেন, তাই চলে আসতে চেষ্টা করি কলকাতায়। আসতে আরো ইচ্ছা লাগে ম্যাডামের ট্রিপে অন্তত একটা দিন যাওয়ার জন্য। আমার ম্যাডাম মানে মধুছন্দা- গ্লোবট্রটারস নামক দেশবিদেশ ঘোরার এক প্রতিষ্ঠানের প্রধান সারথী, মালকিন ও অক্সিজেন।

যখনের ইতিহাস লিখছি, তখন আমি ষাটোর্ধ, এবং সঙ্গী আরও দু’জন ষাটোর্ধ, মানে তিন তরুণ বিক্কলেজিয়ান অন্যবারের মতো এবারেও ঠিক করেছিলাম যে গ্লোবট্রটারস এর গ্রামীন দুর্গা ট্রিপে যাবো। সেবারের ট্যুর ছিল জনাই ও গড়ালগাছাতে। তিনজন একসাথে যাওয়ার মজাই আলাদা। আরামদায়ক কোচ, সাথে আরো জনা পঞ্চাশেক লোক, মজাই মজা!

ষষ্টির দিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, সাথে আমার দাদা, মানে বিই কলেজ ১৯৭৪ ব্যাচের দীপ্তসুন্দরদা- আর আমারই সহপাঠী সুজিত। সুজিত রাসবেহারী থেকে কোচে উঠেছে। আমি আর দাদা পি টি এস এর স্টপ থেকে উঠবো। বাস আসার কথা সকাল সাড়ে আটটা, মধুছন্দা মেসেজ দিয়েছে বাস এক্সাইডের মোড়ে এসে গেছে, আর কয়েক মিনিটের অপেক্ষা মাত্র, কিন্তু অনেকক্ষণ পরেও কয়েক মিনিট মানে কত বুঝতে পারছি না। এমন সময় সুজিতের মেসেজ এল- আধঘন্টা টয়লেট ব্রেক চলছে রে- বাস নটায় আসবে তোদের ওখানে। শুরুতেই টয়লেট ব্রেক – ভারী আশ্চর্য তো! কিন্তু দাদা বলল, আশ্চর্যর কিছু নেই, অনেক বয়স্ক লোক আছেন বাসে, অনেকেই প্রেশারের ওষুধ খান তাই আর চাপ নিতে পারেন না। মনে পড়ল, বহু বছর আগে দেখা নাটক মারীচ সংবাদের কথা- যেখানে চাপের গুনকীর্তন নিয়ে একটা লম্বা সিন ছিল, অতএব ধৈর্য ধরো বৎস- নিজেকে বললাম।

পিটিএস এর গেটে দাঁড়িয়ে আছি, অনেক সুন্দরী পুলিসকেও দেখা গেল। একটি মেয়ে নিজের ছবি তোলাচ্ছিল বরকে দিয়ে- ছবির কোয়ালিটি দেখে মেয়েটি ক্ষুব্ধ, বলল, তোকে বিয়ে করে যে কি ঝকমারি করেছি মাইরি, আমার ছবি না তুলে কার ছবি তুলেছিস দ্যাখ – আড় চোখে দেখলাম ছেলেটির ঐ ছবির ফ্রেমে মুখ্য স্থান নিয়েছে ঐ সুন্দরী পুলিসটি।

নটার একটু আগেই হৈ হৈ করে বাস চলে এল। আর বাসে উঠতেই মধুছন্দা ও তাঁর মেয়ের সাদর আপ্যায়ন। আমরা তিনজন পাশাপাশি বসলাম প্রথম সীটে। হঠাত পিছন থেকে কে যেন বলল, আরে তিন বিক্কলেজিয়ান পাশাপাশি, বাস চলবে তো? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আমাদের ব্যাচের দেবাশিষ, ও অবশ্য যাদবপুরের। একসাথে আমরা দশ বছর চাকরি করেছি ডিসিপিএলে, এককালে কত বেড়িয়েছি ওর সাথে। সেই দেবা’কে আজ ত্রিশ বছর পর পেলাম – ভাবা যায় না। দেবা একা না, ওর সাথে আছে ওর বন্ধু অর্ণব।

আমরা বাসে প্রায় জনা পঞ্চাশেক আর মধুছন্দার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের তিনটে ছেলে। যাচ্ছি সলপ – মাকড়দা – ডোমজুর – মুন্সীরহাট হয়ে জনাই। আধঘন্টায় বাস কোনা এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে সলপে চলে এসেছে। এখানে বাস দাঁড়ালো – জলখাবারের বিরতি। লুচি, ছোলার ডাল আর মিষ্টি। লুচিগুলো তখনও গরম আর ছোলার ডালের জবাব নেই, সুজিত দেখলাম গুনগুন করে গান ধরেছে “মনে হয় স্বর্গে আছি…” চলছে আমাদের টুকটাক গল্প। বাসে এয়ার কন্ডিশনার পূর্ণ দমে চলছে, ফলে গরম মালুমই হচ্ছে না। এরপর পেরিয়ে যাচ্ছি বিভিন্ন গ্রাম। একটা জিনিষ চোখে পড়ল- এখন সাইকেল প্রায় দেখতেই পাচ্ছি না, মোপেড বা মোটরবাইকেরই আধিক্য বেশি। লোকে বাজার ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাইকে। বুঝলাম দেশ এগিয়ে চলেছে।

বেলা সাড়ে এগারোটায় জনাই পৌঁছে গেলাম, আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল। বাস থেকে নামতেই দুই যুবকের আপ্যায়ন, বলল- ওপরে চলে যান- চা আর জনাই এর বোঁদে খেয়ে একটু জিরিয়ে নিন। সিঁড়ির মুখে দেখলাম মোটর বাইক নিয়ে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে – নাম ধরা যাক অনিন্দ্য, মানে মধুছন্দার পরিচিত। এখানে অনিন্দ্যর বাবার মামার বাড়ি, এ ছাড়াও ওর এক লতার পাতার জড়ানো আত্মীয় থাকেন। সব মিলিয়ে অনিন্দ্য এক হাসিখুশি মানুষ যে স্থানীয় ইতিহাস সম্বদ্ধে ওয়াকিবহাল আর জ্ঞানও অনেক। মধুছন্দা ওকে ডেকেছে আমাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য যাতে প্রতিটি জায়গার ইতিহাস আমরা জানতে পারি। অনিন্দ্য বলল, ওপরে উঠে যান, ওখানে একটু বসে তারপর আমরা যাব। ওপরে উঠলাম- সারি সারি চেয়ার পেতে বসার জায়গা। আছে খান কয়েক বসার ঘর, টয়লেট, আর একটা বড়ো হলঘর। শুনলাম এই বাড়িটা জমিদার কালীবাবুর বাড়ি। এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয়।

জনাই এর বোঁদে একটু লম্বাটে টাইপ, বোঁদে শুকনো করে লম্বা করলে যেমন লাগে সেরকম লম্বা, তবে স্বাদে খানিক আলাদা। ওখানেই চা খেতে খেতে পাঁচজন মিলে চলল এক জমাটি আড্ডা। আড্ডা যখন তুঙ্গে, বাদ সাধল মধুছন্দা, বলল, নীচে টোটো অপেক্ষা করছে আপনাদের এই অঞ্চলের সব বনেদী পুজোগুলোতে নিয়ে যাবে বলে। রাস্তা সরু তাই এই ব্যাবস্থা।

নিচে নেমে দেখি খান দশেক টোটো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। এক একটা টোটোতে পাঁচজন। তা আমরা তো পাঁচজন হয়েই আছি – বসে পড়লাম সামনের টোটোটায়। দেবা ড্রাইভারকে বলল, চলুন ভাই। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার নেতৃস্থানীয়, বলল, সব টোটো রেডী হলে একসাথে যাব। কিন্তু অন্য টোটোগুলো আর ছাড়ে না। সবাই চায় নিজের নিজের গ্রুপের সাথে থাকতে, ফলে কোনো টোটোতে ছ’জন তো কোনোটায় তিনজন। মধুছন্দা গিয়ে কি সব ম্যাজিক ট্যাজিক করে সবাইকে খুশি করল, যাত্রা শুরু।

সরু রাস্তা- কখনও বা পাশে পুকুর, কেউ স্নান করছে, কেউ বাসন মাজছে। কোথাও বা রাস্তায় গরু দাঁড়িয়ে জাবর কাটছে, কোথাও বা দু’পাশে জঙ্গল, কোথাও বা বাচ্চা ছেলেদের হুটোপাটি – মনে পড়ে যাচ্ছিল শরৎচন্দ্র’র গল্পে গ্রামের বিবরণের কথা।

মিনিট দশ পরে এসে গেলাম এক মন্দির চত্তরে, লেখা বদ্যিমাতার মন্দির। ভিতরে গিয়ে দেখি সুন্দর পরিচ্ছন্ন জায়গা, মন্দিরের ভিতরে বদ্যিমাতার মূর্তি, উল্টোদিকে এক বিরাট দীঘি। মন্দির দেখে এসে দীঘির সামনে বসলাম। মোটরবাইক নিয়ে অনিন্দ্য এসে দাঁড়াল, বলল, কেমন দেখছেন? দীঘিটা?
– বেশ দারুণ দীঘি, দেখে একটা ভক্তিভাব আসছে, দেবা বলল।
– এই দীঘিটা কিন্তু বদ্যিমাতার সাথে জড়িয়ে- অনিন্দ্য বলল।
– কিরকম শুনি?
“তবে শুনুন”, অনিন্দ্য শুরু করল, “এই বদ্যিমাতার মন্দির যে বহু পুরানো সে নিশ্চয়ই জানেন। কম করেও দুশো বছর তো হবেই। দেবীর এখানে দক্ষিণাকালীর রূপ। শোনা যায় এখানে মাঝরাতে মাঝে মাঝেই দীঘির জলে আলোড়ন ওঠে- লোকের বিশ্বাস যে দেবী সেদিন এখানে স্নান করেন।“
– কেউ দেবীকে দেখেছেন? অর্ণব জিজ্ঞাসা করল।
– দেবীকে দেখা যায় না, শুধু জলে একটা তোলপাড় হয়। শুনেছি আগে গরীব লোকেদের কাজের বাড়ি বা যজ্ঞিবাড়ি হলে দেবীকে মিনতি জানালে পরের দিন পুকুর ধারে বাসন পড়ে থাকত আর সে যে সে বাসন নয়, ভারী ভারী পিতল কাঁসার বাসন। আর কাজ হয়ে গেলে পুকুর ধারে রেখে দিতে হতো, পরের দিন আর সে বাসন থাকত না। কি জানি কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী এই কান্ড ঘটাতেন কিনা কিন্তু এখানে সবাই এটা দেবীর দয়া বলেই মানে।
মনে পড়ল মুজীবের কথা। মুজীব তার মানে এই গ্রামের ছেলে- আমি আর সুজিত মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম আর মুজীবের কথা ভেবে মনটা দুখি হয়ে গেল। অর্ণব বলল, ছাড়ো তো, ওসব গল্প কথা, এত সুন্দর দীঘি, এর রূপটাই কি কম!

মধুছন্দা দেখি জোর কদমে এগিয়ে আসছে, বলল, উঠুন, উঠুন – দেখে আসুন চৌধুরিবাড়ির পুজো। পাশ দিয়ে অনিন্দ্য যাচ্ছিল, বলল, মান্না দের সেই কালজয়ী গান, “শুনেছি চৌধুরি বাড়িতে নাকি বসেছে আসর” – তা এটাই সেই চৌধুরিবাড়ি যাকে নিয়ে গানটা লেখা।

ধীর পায়ে এলাম চৌধুরিবাড়ি। এই জায়গার নাম বাকসা। এককালের নামকরা গঞ্জ ও বন্দর। তখন এখানে সরস্বতী নদী প্রবল ভাবে বহমান ছিল আর সেই কারনেই পর্তুগিজরা ব্যাবসার সুবিধার জন্য এখানে এক বন্দর স্থাপন করে। তাই সেকালে বাকসা ছিল এক খানদানি জমাটি জায়গা।

বাকসা চৌধুরিবাড়ি

বারো ভুঁইয়ার সাথে মোগলদের বিরোধ যখন তুঙ্গে, তখন সেকালের নামকরা লোক জটাধারী বিষ্ণু বিরক্ত হয়ে হুগলির শিয়াখালায় বসবাস করতে শুরু করেন। ওনারই বংশধর বর্ধমানের দেওয়ান রূপনারায়ণ চৌধুরি ১৬ বিঘা নিষ্কর জমি পেয়ে এখানেই নিজের জমিদারির পত্তন করেন। রূপনারায়ণ ছিলেন মহারাজ নন্দকুমারের বন্ধু। আর তাই বন্ধুর অন্তিম পরিণতি উনি মেনে নিতে পারেন নি। যাই হোক, ২৫০ বছর আগে উনি একধারে দুর্গাপূজা ও অন্যধারে রাধাগোবিন্দর মন্দির চালু করেন। আজও দুটোই চলছে। বাকসার সেই স্বর্ণযুগের দিন আর নেই কিন্তু দেবীর আরাধনা আজও অম্লান। এখানে কিন্তু দেবী দশভূজা নন, চারটি হাত, দেখলাম ডাকের সাজের স্নিগ্ধ প্রতিমা।

প্রতিমা দেখে বাইরে এলাম। মধুছন্দার উদ্যোগে খান কয়েক গ্রুপ ছবি তোলা হল। ওখানেও এক বিরাট দীঘি। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি, অনিন্দ্য পাশে দাঁড়াল- বলল, “এখানেও একটা কাহিনী আছে, শুনবেন নাকি?”
নিশ্চয়ই – আমরা তো এক পায়ে খাড়া।
অনিন্দ্য শুরু করল, “এক সময় চৌধুরিবাড়ি সংস্কারের জন্য প্রচুর মিস্ত্রি ডাকা হয়। তাঁদের থাকার জায়গা মিললেও বাথরুম ছিল না। তাই মিস্ত্রিরা দীঘির দু ধারের জঙ্গল ব্যাবহার করতো প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য। কদিন পর মিস্ত্রিরা চলেছে ভোরবেলা কাজ সারতে, এমন সময় দীঘির ধারে একটা বেলগাছ ছিল, তার থেকে নামলেন রক্তবর্ণ কাপড় জড়ানো এক সাধু, তারপর ঐ মিস্ত্রিদের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে বাড়ির দালানে মিলিয়ে গেলেন। মিস্ত্রিরা তো ভয়ে কাঠ। পরের দিনও এক কান্ড। তখন মিস্ত্রিরা ভয় পেয়ে কাজ ছেড়ে পালায়। বেশ বোঝা যাচ্ছিল ওই জায়গা অপবিত্র করা ওনাদের পছন্দ নয়।“
অনিন্দ্যর কথা শেষ হতে না হতে আবার মধুছন্দা- বলল, “ছবি তোলা হলে আসুন, কালীপ্রসন্ন সিংহর বাড়ির পুজোটা দেখে আসি- পাশেই আছে।“
কালীপ্রসন্ন সিংহ- সকলের অতি পরিচিত এক নাম। স্কুলে বাংলা সাহিত্যর ইতিহাসে এনার কথা অনেক পড়েছি, আমারও এক প্রিয় চরিত্র। শুনেছি উনি ব্রাহ্মনদের টিকি কেটে কিনে নিতেন ও কত মূল্যে কিনলেন সেই লেখা সহ দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখতেন। দুর্জয় সাহস- প্রচলিত ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। মাত্র ২৯ বছর বয়েসে (১৮৪১-১৮৭০) উনি মারা যান বটে কিন্তু ওনার লেখা হুতোম প্যাঁচার নকশা বা মহাভারত অনুবাদ সব কালজয়ী লেখা।

কালিপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন জনাই এর সিংহ বাড়ির সন্তান। বাকসার বাড়িতে ওনার পূর্বপুরুষ মহেন্দ্রনাথ সিংহ প্রথম দুর্গাপূজা চালু করেন, এবং আজও তা চলে আসছে। বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখলাম অধিকাংশই পোড়োবাড়ির রূপ নিয়েছে। একটি অংশ সংস্কার করে পুজা হচ্ছে – সেখানে শোলার কাজে মোড়া নয়নাভিরাম প্রতিমা।

এখানের প্রতিমা দেখে আবার উঠলাম টোটোয়। খানিকটা পথ গিয়ে এলাম আর এক বনেদী বাড়ি- মিত্র বাড়ি। প্রায় সাড়ে চারশো বছর পার হয়েছে এই পুজোর। প্রথম দিকে হোগলা পাতার ছাউনি করে পুজো হতো, পরে পাকা ঠাকুরদালান হয়। এই পুজো শুরু হয় ভ্রুকুটিরাম মিত্রর হাত ধরে। এখানে মায়ের পরণে থাকে নতুন বেনারসী। এ ছাড়া আছে কুলদেবতার মন্দির।

এখানে মিত্র বাড়ির ১২ টা পাকা শিব মন্দিরও আছে, যার পাশে এককালে ছিল স্রোতস্বিনী সরস্বতী নদী। তখন এটি গঙ্গার প্রধান শাখা হওয়াতে ভালো স্রোতও ছিল আর ডাকাতির ভয়ে অনেকেই এই জমাটি লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে সরস্বতী নদী ধরে নৌকা নিয়ে যেতেন। শোনা যায়, রাণী রাসমনি যখন এই নদীপথ ধরে বেনারস যান, তখন এই বারো মন্দির আর কুলদেবতার মন্দির দেখে ওনার এতো পছন্দ হয় যে, উনি জামাই মথুরবাবুকে বলেন স্কেচ করে নিতে। এর আদলেই নাকি পরে গড়ে ওঠে দক্ষিণেশ্বর মন্দির।

আমাদের কপাল ভালো- মিত্র বাড়ির একজনকে পেয়ে গেলাম, যিনি এই পুজো নিয়ে অনেক গল্প শোনালেন। প্রতিমার কাঠামো মাত্র দুটো বাঁশের ওপর তৈরি। এখানে প্রতিবার দুর্গাকে নতুন বেনারসী পরানো হয়। প্রতিমার চারপাশে আছে অজস্র পোড়া মাটির টিয়া পাখি – এটা এখানের পুরানো প্রথা। বিজয়া দশমীতে ঐ কাঠামো নিয়ে আগে শুধু বাড়ির ছেলেরাই প্রতিমা বাইরে বের করেন- তারপরই অন্যরা হাত দিতে পারবে। বিসর্জন হয় ওনাদেরই বারো মন্দির সংলগ্ন বিরাট পুকুরে। তার আগে বেনারসি খুলে ঘরোয়া শাড়ি পরানো হয় দেবীকে। বিসর্জনের পর ঐ বাঁশের কাঠামো আবার ঘরে আনা হয় আর তার ওপর গড়ে ওঠে পরের বছরের প্রতিমা। অষ্টমীতে ছাগ বলি হয় এখানে। একটি ছাগলের মাথা রাখা হয় দেবীর বেদির পিছনে ও একত্রে বিসর্জন হয়।

মিত্র বাড়ি

আজ ষষ্টি, ফলে দেবী এখনও নিজের জায়গায় বসেন নি, তবে দেখলাম লাল বেনারসী পরানো হয়ে গেছে। বেশ কিছু ছবি তুলে বাইরে এলাম, দেখি অনিন্দ্য। বললাম, কি কোথায় গিয়েছিলে, দেখতে পাইনি?
– মিত্র বাড়ির একজনের থেকে ইতিহাসটা পেয়ে গিয়েছেন তো? অনিন্দ্য বলল।
– হ্যাঁ, তা মোটামুটি পেয়েছি- দাদা বলল।

বাইরে মিত্রবাড়ির রাধাকৃষ্ণর মন্দিরটি দেখলাম- অতীব সুন্দর- নতুন রঙ হয়েছে- দেখে মনে হলো ছোট আকারে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরটিই দেখছি। বারোটি মন্দির, যেগুলি সরকারের ঐতিহাসিক মনুমেন্টের তকমা পেয়েছে।

ভালো করে দেখে দেখে ছবি তুলছি। মধুছন্দাকে দেখি সবাইকে ডেকে ডেকে টোটোতে তুলছে পরবর্তী বনেদী বাড়ি যাওয়ার জন্য, যার পোষাকি নাম কর্তাবাড়ি। মিনিট দশেক টোটো ভ্রমণের পর এলাম কর্তাবাড়ি। একে রাজবাড়িও বলা হয়। তখন বাজে দুপুর দুটো। ক্ষিদেয় পেটে টান পরেছে কিন্তু কর্তাবাড়ির আকর্ষণ আরো বেশী। অনিন্দ্য বাইক নিয়ে হাজির। ঢোকার মুখে বলল, এই যে কর্তাবাড়ি দেখছেন এটা ১৭৭৬ থেকে আছে, মানে বহু পুরানো। আসলে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধর পর অত্যাচারিত জমিদার ভবানী মুখোপাধ্যায় পাকাপাকিভাবে বসবাসের জন্য এই জনাইতে চলে আসেন। উনিই প্রথম ছোট করে দুর্গা পুজা চালু করেন। এর পর ওনার দুই ছেলে আত্মারাম ও হৃদয়রাম যথেষ্ট নাম করেন ও পুজোকে আরো বড়ো করেন।

ভিতরে ঢুকলাম। স্নিগ্ধ প্রতিমা, মাথায় অপূর্ব কারুকার্য মন্ডিত মুকুট।
বেশীক্ষণ সময় পাওয়া গেল না কারণ সবারই পেটে টান পড়েছে। মধুছন্দা বলল, আর খান তিনেক বাড়ি আছে এখানে, সেগুলো দেখেই আমরা টোটো নিয়ে ফিরে যাব সকালে যেখানে ছিলাম, সেই বাড়িতে। ওখানেই লাঞ্চ।

লাঞ্চের নামে উৎসাহ বেড়ে গেলো, এবারে এলাম গাঙ্গুলিবাড়ি। অনিন্দ্য জানাল এটা ৩৭০ বছরের পুরানো বাড়ি। আর এই পুজো ৩২০ বছরের পুরানো। এই বংশের পূর্বপুরুষ সুধীন্দ্র কুমার গাঙ্গুলি ছিলেন বিখ্যাত ডাক্তার আর উনি এই পুজো চালু করেন। প্রতিমা দেখে বেরিয়ে আর একটু এগিয়ে এলাম আর এক ঐতিহাসিক বাড়িতে যার নাম বাজারবাড়ি।

অনিন্দ্য এখানেও হাজির। জানলো, এই পুজো ২৮০ বছরের। উমাকান্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন তখনকার এক নামকরা পুরুষ। উনি ছিলেন ইংরাজদের ঘনিষ্ট আর লর্ড ব্লেন্টিকের খাস সহকারী। এখন যেখানে বর্তমান বাড়ি উমাভিলা – সেখান থেকে ৯৯ বিঘা জমি, তৎকালীন বাজার পর্যন্ত কিনে ওনার জমিদারির পত্তন করেন।

উমাভিলা

রংচঙে গেট দিয়ে ঢুকলাম। জনাইতে যতগুলো বনেদী বাড়ি দেখলাম, তার মধ্যে এটার অবস্থা সব চেয়ে ভালো। পূজা মণ্ডপে অজস্র লণ্ঠন ঝাড়পোঁছ চলছে। খবর নিয়ে জানা গেল এখানে সেই প্রাচীন কাল থেকে লণ্ঠনের আলোয় পুজো হয়ে আসছে, তাই ইলেকট্রিক আসার পরেও সেই প্রথা অক্ষুণ্ণ।

এরপর চললাম জনাইতে আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল কালীবাবুর বাড়ি, তখন প্রায় বেলা আড়াইটে। ক্ষিদের চোটে আর পারা যাচ্ছে না, ধীর পায়ে এগুচ্ছি, অনিন্দ্য দাঁড়িয়ে। দাদা বলল, কি কিছু বলো!
– নিশ্চয়ই দাদা, শুনুন, এই বাড়ির পত্তন হয়েছিল কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। কালিবাবু ছিলেন তদানীন্তন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনীর দেওয়ান। উনিই এই পুজো প্রথম চালু করেন। নিজে ছিলেন বৈষ্ণব মতে বিশ্বাসী, তাই পুজার সব ভোজ নিরামিষ। প্রথম জীবনে উনি ছিলেন ভাগলপুরের দেওয়ান, পরে জনাইতে চলে আসেন।

আমরা ঢুকলাম, দেখি বিরাট বাড়ি, দু পাশে সাদা পিলার দেওয়া গাড়িবারান্দা আর ঘর। সোজা ঠাকুর দালান ও ওপরে ঘর, মাঝে খোলা চত্তর। এখানেও ডাকের সাজের সুসজ্জিত প্রতিমা। অতি মনোরম মা’র রুপ।

কালিবাবুর বাড়ি দেখে আবার চাপলাম টোটোতে। পৌনে তিনটে নাগাদ এলাম সকালে যে বাড়িতে উঠেছিলাম সেইখানেই। দেখি একটি হলে সারি সারি টেবিল চেয়ারে পাত পাতা হচ্ছে। আর আমাদের রোখে কে! আমরা তিন বিক্কলেজিয়ান আর সাথে দেবা আর অর্ণব এই পাঁচজনে একটা টেবিল দখল করে বসে পড়লাম। খাবার পরিবেশন করলেন মধুছন্দার নিয়োজিত এখানকার লোকাল ক্যাটারার। খাবার সাধারণ, কিন্তু তার মান তুলনাবিহীন। ভাত, ফুলকপির তরকারি, আলুভাজা, ছানার কালিয়া, চাটনি, পাঁপড়, রসগোল্লা। ছানা মনে হয় কম পড়েছিল, তাই তাতে পনীর মেশানো হয়েছে, তা হোক, তা সত্ত্বেও স্বাদ অতুলনীয়।

খাওয়ার পর চেয়ারে বসে গুলতানি মারছি হঠাৎ মধুছন্দা রব তুলল, “ওঠো, সবাই বাসে ওঠ, আমাদের এবার গড়ালগাছা যেতে হবে।“ গড়ালগাছা জনাই থেকে সাত কিলোমিটার রাস্তা, ভেবেছিলাম মিনিট পনেরোতে পৌছে যাব, কিন্তু ড্রাইভার কোনো এক টারনিং মিস করে বেশ খানিক যাওয়ার পর সেই ভুল ধরা পড়ল। ফলে অতো বড় বাস ঘোরাতেই বেশ খানিক সময় চলে গেল। এবার আর ভুল না- দাদা গুগল ম্যাপ দেখে বলে বলে যেতে লাগল আর অবশেষে আমরা গড়ালগাছা পৌছালাম। একটা মোড়ের মাথায় ভালো পারকিং এর জায়গা দেখে ড্রাইভার ওখানেই বাস দাঁড় করিয়ে দিলো, বলল বাস আর যাবে না, ঘোরাতে পারব না। যদিও পরে দেখেছিলাম বাস ঢোকার মতো প্রশস্ত রাস্তা ও ঘোরানোর ও ভালো জায়গা ছিল। তো তখন তো জানা নেই, একবার বাস ঘোরানোর অসুবিধা সবাই দেখেছি, কাজেই আমরাও মেনে নিলাম। মধুছন্দা বলল, এখান থেকে খুব জোর মিনিট দশের রাস্তা- বাবুদের বাড়ি বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। যদি হেঁটে না যেতে চাও, তাহলে অপেক্ষা করতে হবে। আমরা দেখলাম কখন টোটো পাই জানা নেই, তার চেয়ে হেঁটে মেরে দি।

কিন্তু হাঁটছি তো হাঁটছিই – দশ মিনিট হাঁটার পর লোককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেলো আরো দশ মিনিট। তবে এবার কিন্তু আরো দশমিনিট পর বাবুদের বাড়ি সত্যিই এল। এখান আর অনিন্দ্য নেই, কে জানাবে ইতিহাস? মধুছন্দা তাই পরিবারের একজনকে ধরল এই পুজোর ব্যাপারে কিছু বলার জন্য।

ভদ্রলোক শুরু করলেন, আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি- তিনশো বছর আগে তৈরি এই জমিদার বাড়ি। মানে আজ থেকে নয় জেনারেশন আগে। ৩০০ বছর আগে সন্তোষ মোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন মহা পন্ডিত। যে কোনো তর্কসভায় উনি থাকতেন প্রধান বক্তা আর ওনাকে বিতর্কে কেউ হারাতে পারতো না। ওনার জ্ঞান ছিল এমনই গভীর। নদীয়াতে এক তর্ক সভায় উনি জয়ী হতে তৎকালীন বর্ধমানের মহারাজ ওনাকে বিদ্যাবাগীশ উপাধি দেন আর পুরষ্কার হিসাবে সাতখানা গ্রাম দান করেন যার মধ্যে গড়ালগাছা ছিল একটি। ১৭৬৭ সালে উনি প্রথম দুর্গাপূজা চালু করেন। ওনার দুই পুত্র গোকুলচন্দ্র ও রাধানাথ। রাধানাথ ছিলেন মুর্শিদাবাদের দেওয়ান ও নবাবের খুব প্রিয়। স্বাভাবিকভাবেই পলাশী যুদ্ধে রাধানাথ নবাবের দলে যোগ দেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ যুদ্ধে নবাবের পতন হয় আর রাধানাথ যেহেতু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন তাই উনি চলে আসেন গড়ালগাছাতে। আসলে যাঁরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, তাঁদের অনেককেই গ্রামে পালাতে হয়েছিল। রাধানাথও ছিলেন সেই দলে।

এই বাড়িটাও একই ধাঁচের। দু দিকে গাড়ি বারান্দা, পিলার ও ঘর আর সোজা ঠাকুর দালান। ইউ শেপের দুতলা বাড়ি আজও অম্লান। দেবীর এখানেও ডাকের সাজ।

আমাদের বেড়ানো শেষ। পাঁচটা দশে আমরা বাবুদের বাড়িকে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠলাম। খানিকটা এগুতেই প্রবল জ্যাম। বাস এক পা এক পা করে এগিয়ে যখন কালিপুর মোড় এল, দেখি ডানকুনির রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম থাকলেও বেনারস রোড খালি। ব্যাস- আমাদের আর পায় কে! বেনারস রোড কোনা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে সাড়ে আটটায় চলে এলাম পিটিএস। নামার আগে মধুছন্দা একটি করে মোমেন্টো দিলো সবাইকে। বাস শুদ্ধু সব্বাইকে বিদায় জানিয়ে বিষণ্ণ মুখে দুজনে নামলাম। বিদায় মধুছন্দা, বিদায় সুজিত, দেবা, অর্ণব আর বাকি সবাই।
আবার অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা পরের বছরের।

দীপ্ত প্রতিম মল্লিক
(তথ্য – কিছুটা শোনা, কিছুটা বইপত্র আর কিছুটা ইন্টারনেট, অজ্ঞানতাবশতঃ তথ্যর কিছু ভুল ভ্রান্তি থাকলে মার্জনা প্রার্থনীয়)

Sahityika Admin

Add comment