সাহিত্যিকা

অকালবোধন ও মূর্তিতত্ত্ব

অকালবোধন ও মূর্তিতত্ত্ব
দেবপ্রসাদ দে, ১৯৭৭ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

বাল্মীকির রামায়ণে রামের দুর্গাপূজার কোনো বিবরণ নেই। কিন্তু রামায়ণের পদ্যানুবাদ করার সময় কৃত্তিবাস ওঝা কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এর কাহিনি কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে সংযোজিত করেছেন। কৃত্তিবাসি রামায়ণ অনুসারে, রাবণ ছিলেন শিবভক্ত। মা পার্বতী তাকে রক্ষা করতেন। তাই ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দেন, শিবের স্ত্রী পার্বতীকে পূজা করে তাকে তুষ্ট করতে। তাতে রাবণ বধ রামের পক্ষে সহজসাধ্য হবে। ব্রহ্মার পরামর্শে রাম শরৎকালে পার্বতীর দুর্গতিনাশিনী রূপের বোধন, চণ্ডীপাঠ ও মহাপূজার আয়োজন করেন। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন রাম কল্পারম্ভ করেন। তারপর সন্ধ্যায় বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস করেন। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও সন্ধিপূজার পরেও দুর্গার আবির্ভাব না ঘটায়, রাম ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে মহানবমী পূজার পরিকল্পনা করেন। হনুমান তাকে ১০৮টি পদ্ম জোগাড় করে দেন। মহামায়া রামকে পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখেন। একটি পদ্ম না পেয়ে রাম পদ্মের বদলে নিজের একটি চোখ উপড়ে দুর্গাকে নিবেদন করতে গেলে, দেবী পার্বতী আবির্ভূত হয়ে রামকে কাঙ্ক্ষিত বর দেন। তবে সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে যে কৃত্তিবাস ওঝা যে কাহিনী সংকলন করেছেন, তা রামচন্দ্রের প্রকৃত জীবনী বাল্মিকী রামায়ণে বা রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদসমূহ যেমন, তুলসীদসের হিন্দি রামচরিতমানস, তামিলভাষায় কাম্ব রামায়ণ, কন্নড় ভাষায় কুমুদেন্দু রামায়ণ, অসমিয়া ভাষায় কথা রামায়ণ, ওড়িয়া ভাষায় জগমোহন রামায়ণ, মারাঠী ভাবার্থ রামারণ, উর্দু ভাষায় জগমোহন রামায়ণ, মারাঠি ভাষায় ভাবার্থ রামায়ণ, উর্দু ভাষায় পুথি রামায়ণ প্রভৃতিতে উল্লেখিত হয়নি। এছাড়াও যোগবাশিষ্ট রামায়ণে উক্ত হয়নি।

সনাতম ধর্মের যেকোনো পূজার ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংস্কৃত মন্ত্রগুলি। দুর্গা পূজার মন্ত্র গুলি সাধারণত শ্রী শ্রী চণ্ডি থেকে পাঠ করা হয়। ঢাক-ঢোল, খোল করতাল, সুগন্ধী আগর বাতি তার সাথে এই সংস্কৃত মন্ত্রগুলি এক পবিত্র পরিবেশের জন্ম দেয়। দুর্গা পুষ্পাঞ্জলি দেয়ার মন্ত্র:
ঔঁ জয়ন্তি (দেবী পার্বতীর তৃতীয় নয়ন থেকে সৃষ্টি যার) মঙ্গলা (যেই রূপে দেবী পার্বতী মঙ্গল দাত্রী) কালী (যেই রূপে দেবী পার্বতী কাল চালনা করেন), ভদ্র কালী (যেই রূপে দেবী পার্বতী সুখ দেন), দুর্গা (যেই রূপে দেবী পার্বতী দুর্গম নাশিনী) শিবা (যেই রূপে দেবী পার্বতী শিব দর্শনা) ক্ষমা (যেই রূপে দেবী পার্বতী ব্রহ্মা কে দয়া করেন) ধাত্রী (যেই রূপে দেবী পার্বতী জগৎ চলনা করেন), স্বাহা (নিজের কেশ সতী অগ্নিতে আহুতি) স্বধা (যেই রূপে দেবী পার্বতী মুক্তি দেন) নমস্তুতে। এস স্ব চন্দন পুষ্প বিল্ব পত্রাঞ্জলী নম ভগবতী দুর্গা দেবী নমহ্। ”

দুর্গা প্রণাম মন্ত্র:
সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে
শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে
অর্থ: হে দেবী সর্বমঙ্গলা, শিবা (শিবের স্ত্রী), সকল কার্য সাধিকা, শরণযোগ্য, গৌরি (পার্বতী গৌর বর্ণা) ত্রিনয়ণী, নারায়নী (পার্বতী বিষ্ণুর বোন) তোমাকে নমস্কার।

মূর্তিতত্ত্ব

বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী; তার মুকুটের উপরে শিবের ছোট মুখ ,দেবীর ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিকেয়। কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার ১৬১০ সালে এই সপরিবার দুর্গার প্রচলন করেন। তাঁরা কার্তিকেয়র রূপ দেন জমিদারপুত্রের, যা তৎপূর্ব ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আদলে যুদ্ধের দেবতা রূপে। এছাড়াও বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গা এক বিশেষ মূর্তি দেখা যায়। সেখানে দেবীর ডানপাশে উপরে গণেশ ও নিচে লক্ষ্মী, বামে উপরে কার্তিকেয় ও নিচে সরস্বতী এবং কাঠামোর উপরে নন্দী-ভৃঙ্গীসহ বৃষভবাহন শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া অবস্থান করেন। কলকাতার কোনও কোনও বাড়িতে দুর্গোৎসবে লক্ষ্মী ও গণেশকে সরস্বতী ও কার্তিকেয়ের সঙ্গে স্থান বিনিময় করতে দেখা যায়। আবার কোথাও কোথায় দুর্গাকে শিবের কোলে বসে থাকতেও দেখা যায়। এগুলি ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তিও চোখে পড়ে। তবে দুর্গার রূপকল্পনা বা কাঠামোবিন্যাসে যতই বৈচিত্র থাকুক, বাংলায় দুর্গোৎসবে প্রায় সর্বত্রই দেবী দুর্গা সপরিবারে পূজিতা হন।

আষাঢ় শ্রাবণের টানা বর্ষণের পর মেঘমুক্ত আকাশের অবারিত নীলে ঝিলমিল শরতের দিনলিপি। যার সৌরভ ছাড়া অপূর্ণ থাকে শরতের আলপনা আঁকা সে আর কিছুই নয়, শুভ্র শিউলি। শিউলি ছাড়া শরৎ যেমন নিষ্প্রাণ, তেমনি শারদীয় উৎসবও অনেকটাই অসম্পূর্ণ। মিষ্টি শিশিরের পরশ, ঢাকের শব্দ আর ভোরের শিউলি তলা-এসবই একে অন্যের পরিপূরক।

শিউলিই এমন এক ফুল যেটি মাটিতে ঝড়ে পড়লেও পূজোয় দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা যায় এই ঝরা ফুল।

শিউলির আরেক নাম পারিজাত। পৌরাণিক কাহিনীতে বার বার এসেছে শিউলি ফুল বা পারিজাত ফুলের কথা। কৃষ্ণের দুই স্ত্রী-সত্যভামা ও রুক্মিণীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগানও পারিজাতের ঘ্রাণে আমোদিত হোক। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা! কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে চান। তাই লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন। যার ফুল রুক্মিণীর বাগানেও ঝরে পরে সুগন্ধ ছড়ায়। এদিকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্রতো ঘটনাটা জেনে খুব রেগে যান! তিনি বিষ্ণু অবতারের উপর গোপনে ক্রুদ্ধ ছিলেন। এই কারণে তিনি কৃষ্ণকে শাপ দেন কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই কিন্তু ফল কোনদিন আসবে না, তার বীজে কখনও নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না।

শিউলি প্রকৃতিতে শরৎ ঋতুর অনন্য উপহার হয়ে আসে। এদের অন্য নাম শেফালি। পারিজাত নামেও এরা পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Nyctanthes arbor-tristis/ Night-flowering Jasmine (নাইট ফ্লাওয়ার জেসমিন) / Harsingar (হারসিঙ্গার) / কোরাল জেসমিন।

গ্রাম কিংবা শহরের বিভিন্ন পার্ক-উদ্যান এবং বাড়ির আঙিনায় সহজেই এ গাছের দেখা মেলে। দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে পশ্চিমে বাংলাদেশ, ভারত, উত্তরে নেপাল ও পূর্বে পাকিস্তান পর্যন্ত এলাকা জুড়ে শিউলি ফুল দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গ ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের রাষ্ট্রীয় ফুল। সুগন্ধি এই ফুলে রয়েছে পাঁচ থেকে সাতটি সাদা বৃতি ও মাঝে লালচে-কমলা টিউবের মতো বৃন্ত। শরৎ ও হেমন্তকালের শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা শিউলি অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করে। তবে ফুলের আয়ু সীমিত সময়ের। রাতে ফুটে সুগন্ধ ছড়িয়ে সকালেই ঝরে যায়।

শিউলি ফুল শরৎকালের অন্যতম অনুষঙ্গ। শরতের শিশিরভেজা ঘাসে কমলা রঙের নলাকার বোঁটায় সাদা পাপড়ির অজস্র ফুল পড়ে থাকার দৃশ্য লোভনীয়। শিশিরভেজা ঘাসে খালি পায় শিউলি ফুল কুড়ানোর একটা আলাদা সুখ আছে। রাতে ফুটে সকাল না হতেই ঝরে পড়ে বলে এই ফুলকে বলে ‘নাইট জেসমিন’। শিউলি ছাড়াও এর আরো অনেক নাম আছে। যেমন- শিউলি, শেফালি, শেফালিকা (বাংলা), শেওয়ালি (মণিপুরী), পারিজাত (মারাঠি), পারিজাতম (তেলেগু), গঙ্গা শিউলি (উড়িষ্যা), হরসিংগার, রাগাপুষ্পী, মালিকা ইত্যাদি।

প্রাচীনকালে এ ফুলের বোঁটার রঙ পায়েস ও বিভিন্ন মিষ্টান্নে ব্যবহার করা হতো। শিউলি ফুলের মালা খোঁপার সৌন্দর্য বাড়াতেও অনন্য। ফুল চ্যাপ্টা ধরনের। শিউলির পাতা ও বাকল বিভিন্গের মহৌষধ। ঔষধি হিসেবে ব্যবহার হয় শিউলির বীজ, পাতা ও ফুল। এই ফুল বোঁটা শুকিয়ে গুঁড়ো করে পাউডার বানিয়ে হালকা গরম পানিতে মেশালে চমৎকার রঙ হয়।

মহাকবি কালিদাস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং বিভূতিভূষণসহ অনেক কবি-সাহিত্যিক শিউলি ফুল নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ অনেক গান ও কবিতায় শিউলির প্রসঙ্গ এনেছেন নানাভাবে। শিউলির মধ্যে তিনি শরতের অপরূপ সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিলেন।

Sahityika Admin

Add comment