সাহিত্যিকা

বি ই কলেজের পিকনিক ২০২৪ (আটলান্টা থেকে সরাসরি)

বি ই কলেজের পিকনিক ২০২৪ (আটলান্টা থেকে সরাসরি)
মানস দে, ১৯৯৫ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে শুদ্দুকে ফায়ার করা হয়েছে। এতদিন আমাদের CCO ( চিফ কিউলিনারি অফিসার) এর দায়িত্ব দায়িত্ব সহকারে পালন করার পর, বেচারার চাকরি গেল স্রেফ কর্তব্যে গাফিলতির জন্যে। মাংস চাপিয়ে হটাৎ মাঝপথে শুদ্দু হাওয়া। সেই পদের জোর দাবিদার এখন শঙ্করদা, সৌগত বা সঞ্জয়দা। এপ্রন পরে সৌগতের এপ্রোচ ছিল অনেক প্রফেশনাল। জীবনে প্রথমবার ফিশ ফ্রাই ভাজলেও হাবভাবে মনে হবে জাত হালুইকার। সঞ্জয়দাকে বেশ ভার্সাটাইল লাগল। বেগুনি হোক বা মাংসে। শঙ্করদাকে দেখে একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে যাচ্ছিল – “ওরা কাজ করে দেশে দেশান্তরে”..দেশ অনেক দিনে আগে ছাড়লেও ফিশ ফ্রাই শঙ্করদাকে ছাড়েনি। আটলান্টা এসেও ভেজে চলেছে। বছর চার পাঁচেক আগেও আমরা যখন ফিশ ফ্রাই করেছিলাম মেহনতী মানুষ শঙ্করদার মুষ্টিবদ্ধ হাতে হাতুড়ি না থাকলেও ছিল হাতা। সেই হাতা দিয়েই লালে লাল করে দিচ্ছিল প্রতিটা ফিশ ফ্রাইয়ের বাইরের আবরণ। এসেছিল বিপ্লব। ফিশ ফ্রাইয়ের বিপ্লব।

এই সব হাই প্রোফাইল মেনুর পাশে তরুণদা (১৯৬৭ সিভিল) একা কুম্ভের মতো বেগুনি ভাজছিলেন। গাঢ় বাদামি রঙের আবরণে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কালো জিরের নিখুঁত উপস্থিতি, কামড়ালেই উপর নিচের আবরণের মাঝে রেশমের মতো ফিনফিনে বেগুন বেয়ে গরম বাষ্প, আহঃ। মুচমুচে, মুখে দিলেই যেন মাখনের মতো মিলিয়ে যাচ্ছিল। সাধারণ জিনিস যখন অসাধারণের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা শিল্প হয়ে ওঠে। যেমন করে মোহনবাগান সাহেবদের হারিয়ে প্রথম IFA শিল্ড জিতেছিল ঠিক তেমনি নামগোত্রহীন বেগুনি তার নিজের ক্ষমতায় মাংস ও ফিশ ফ্রাইকে দাঁড় করিয়ে গোল দিয়ে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। কি ভাবছেন? সঙ্গে যদি একটু মুড়ি থাকত? তাহলে শুনুন শুধু মুড়ি নয় ছিল চানাচুর, ছিল আমতেল, ছিল কাঁচালঙ্কা ও পেঁয়াজ। আরো যেটা ছিল সেটা না চাইতেই – ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর ঠান্ডা হাওয়া। মনে হয় আবহাওয়ার দেবতাও বি ই কলেজ থেকে পাস এমন একটা পরিবেশ উপহার দেবার জন্যে। ভাবুন শেষ কবে বর্ষার দিনে মুড়ি বেগুনি খেয়েছেন? আর তার সঙ্গে গাঢ় বাদামি রঙের ইয়া বড়ো বড়ো জিলিপি। সঙ্গে দেদার আড্ডা। পিকনিকের স্পিরিট তখন একদম পিকে। মনে হচ্ছিল অডি হাঁকিয়ে আটলান্টায় পিকনিক নয় পায়ে হেঁটে পাজামা আর ফতুয়া পরে ছাতা নিয়ে নাগেরবাজারে দুলারের দোকানে এসেছি। আবেগ। বিশুদ্ধ আবেগ। আবেগটাই শেষ কথা। নিজের কলেজ তো নিজের শিকড়। সেই শিকড়ের আবেগেই তো একজোট হওয়া।

বৃষ্টির জন্যে একদিকে ত্রিপল দিয়ে ঘেরা হয়েছিল। একদিকে তরুণদা বসে বেগুনি, আরেকদিকে শঙ্করদা ও সৌগত ঝুঁকে ফিশ ফ্রাই আর অন্যদিকে শুদ্দু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাংসের জন্যে পেঁয়াজ ভাজছে। এরই মাঝে সঞ্জীব খুব ব্যস্ত হয়ে ফিশ ফ্রাই টেস্ট করে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে আর তারপাশে নচিদা বাইরে বৃষ্টির জন্যে মাছ ধরতে যেতে না পেরে সঞ্জীবের বক্তৃতা শোনার ভান করছে আর মাঝে মাঝে খ্যাচা খ্যাচ ফটো তুলছে।

খাওয়াটাই শেষ কথা নয় পিকনিকে। কলেজের ছেলেমেয়েরা ছাড়াও তাদের পরিবারও থাকে আমন্ত্রিত হয়ে। যেমন সঞ্জীবের বৌ শ্রীরূপা, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির। ওরাও ওদের পিকনিকে আমাদের খুব যত্ন করে খাওয়ায়। মানে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। তাই আমাদের গেস্টদের কথা ভেবে মেনু ঠিক করা। নচিদার নিজের হাতে করা সেই আয়োজনের তালিকা নিচে দিলাম –
ব্রেকফাস্টে – ফুলকো মুড়ির সঙ্গে চনমনে চানাচুর আর বেগুনের পাশবালিশ, গরম জিলিপির মারপ্যাঁচ, ভাঁড়ে চা ভবানী।

মেন খাবার – সাদা মেঘের ভাত, স্যালাডের সমারোহ, শালিমারি ডাল, তিলাপিয়া রায়বাহাদুরি ফ্রাই, আলু পোস্তর মিলমিশ, পটল চেরা পোস্ত, মোচার মূর্ছনা, ধোঁকা কি ধড়কান, নবাবী এঁচোড়, ডিমের দমাদম, কচি পাঁঠার কারসাজি, আমসত্ত্ব খেজুরের লুকোচুরি, ধরি কি ধরি না পাঁপড়, রসে বশে গুড়ের গোল্লা, আর সবশেষে মন আনচান পান। খাওয়ার পর শ্রীরূপা বললো যাদবপুরের পিকনিকে নাকি একটা খাবারের ট্রেতে দুটো করে হাতা থাকে। আর আমাদের নাকি একটা হাতা দুটো ট্রে সামলাচ্ছিল। বললো খাবারের থালা যদি মুম্বাইয়ের রিয়েল এস্টেট হয়ে যায় তাহলে খুব প্রবলেম। ঐজন্যে ওদের পিকনিকে ওরা নাকি খেয়াল রাখে কলকাতা ময়দানের মতো রাখতে – নো এনক্রোচমেন্ট। হ্যাঁ, আমাদের কিছু অসুবিধা ছিল, সেটা জানি। ওদের পিকনিকে এক জায়গায় দাঁড়িয়েই মোটামুটি সব খাবার নেওয়া যায়, বেশি কষ্ট করতে হয়না। আমাদের পিকনিকে খাবার নেবার জন্যে একটু একটু হাঁটতে হয়।

সেপ্টেম্বর ১৪ এর বৃষ্টিভেজা দিনে বুফোর্ড ড্যাম পার্কের প্যাভিলিয়নে তখন থিকথিকে ভিড়। অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে তিন প্রজন্ম ও তাদের পরিবার মিলিয়ে প্রায় আশি জন। তার মধ্যেই কারো কারো অনুপস্থিতি জানান দিচ্ছিল তাদের উপস্থিতি। গত বছর রণেনদাকে (১৯৬৬ মেকানিক্যাল) দেখে কেউ ভাবেনি সেটাই তাঁর সশরীরে শেষ পিকনিক। রণেনদার সেই না থাকাটা প্রবলভাবে ছিল এই পিকনিকে। আমি নিশ্চিত শুভ (১৯৯৬ মেকানিক্যাল) থাকলে সেও আজ আসত। উলফেন্ডেন হলের সামনের ছোট মাঠে ওর সাথে ক্রিকেট খেলেছি কতবার। কখনো ভাবিনি একদিন এদের ছবিতে নিজের নাম লিখতে হবে। ছবিদুটো যখন যথাক্রমে সুমিতাদি ও ঋতুপর্ণার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছিল মনে হচ্ছিল, সময়টা যেন একটু থমকে গিয়ে বলে গেল – নেক্সট মর্নিং ইজ নেভার গ্যারেন্টেড। সময় মাঝে মাঝে থমকে যায় বৈ কি? একটা মেয়ের মৃত্যু যেন বিশ্বের গোটা বাঙালি সমাজের সময়কে থমকে দিয়েছে। মহালয়া প্রায় বাড়ির উঠোনে, পুজো নিয়ে অদ্ভুত এক উদাসীনতায় আচ্ছন্ন যেন সম্পূর্ণ বাঙালি জাতি। সবাই যেন একটা মৃত্যুর বিচার চাইছে। বি ই কলেজ অ্যালুমনি এসোসিয়েশন, আটলান্টার পক্ষ থেকেও প্ল্যাকার্ড নিয়ে আওয়াজ উঠেছে বিচারের।

ঝিরঝিরে বৃষ্টি, মেঘ, দুজনের না ফেরার দেশে চলে যাওয়া, একটা মেয়ের মৃত্যু, মিনিটখানেকের নীরবতা – সব মিলিয়ে একটা বিষাদের আবহাওয়া একসময় আচ্ছন্ন করেছিল পুরো পরিবেশটাকে। সেই আবহাওয়া কিছুটা হলেও কেটেছিল গান, কবিতা ও গল্পে। পিকনিকের এই দিকটার দায়িত্বে ছিল দীপ।

এভাবেই আনন্দে ও বিষাদে শেষ হলো ২০২৪ এর কলেজের পিকনিক। একটা আবেগকে কেন্দ্র করে তিনটে প্রজন্ম তাদের পরিবার নিয়ে একত্রিত হয় প্রতি বছর। নেতৃত্বে রক্তিমদা (১৯৭৫ ইলেক্ট্রনিক্স)ও তপনদা (১৯৭৩ ইলেক্ট্রিক্যাল)। অস্টিন টেক্সাস থেকে গত বছরের মতো আটলান্টায় এসেছিল পার্থদা (১৯৬৩ সিভিল), অগাস্টা থেকে তিন ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে এসেছিল বৈদ্যনাথদা (১৯৬৫ মেকানিক্যাল)। সেই একই আবেগে সুজনদা (১৯৮১ সিভিল) হয়ে যায় জর্জিয়া টেকে পড়তে আসা বি ই কলেজের ছেলেদের লোকাল গার্ডিয়ান। তাদেরকে নিয়ে আসা ও পৌঁছে দেবার মধ্যে যতটা দায়িত্ব ছিল, তার থেকে কোন অংশে কম ছিল না ফেলে আসা কলেজের আবেগ।

এখনো কি বড়ঘড়িটা সকাল আটটায় ভোঁ করে? এখনো কি লেডিজ হোস্টেলের নিচে ছেলেদের প্রপোজ মেয়েরা ফিরিয়ে দেয়? এখনো কি ক্লাস কেটে মিনি বা লঞ্চে উঠে ধর্মতলায় সিনেমা দেখতে যায় ছেলেমেয়েরা? সময়ের স্রোতে অনেক কিছু ভেসে গেলেও কিছু জমে থাকে আমাদের স্মৃতিতে পলির মতো হৃদয়ের অনেক গভীরে। সেই পলির পরিমান যত বেশি হয় তত বেশি হয় আবেগ। সেই আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত উদযাপনে বয়োজোষ্ঠ্যেরা দাদা ও দিদি আর কনিষ্ঠেরা ভাই ও বোন হয়েই থেকে যায় সারাজীবন একটা পরিবারের মতো। হয়তো বা জীবনের ওপারেও। কে জানে…,

Sahityika Admin

Add comment