সাহিত্যিকা

প্যান্ডেলের ঠাকমা

প্যান্ডেলের ঠাকমা
রমা জোয়ারদার, ১৯৬৭ (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) প্রবীর জোয়ারদারের স্ত্রী

ষাটোর্ধ্ব প্রবীনদের আবাসনের পুজো। প্রায় সকলেই সকলকে চেনে। লাঠি ঠুকঠুক করে ধীরে ধীরে হেঁটে সুপ্রীতি পুজো প্যান্ডেলে ঢুকে সে সোজা চলে গেলো একেবারে সামনে, পুজোর জায়গায়। ওখানে অল্প ক’টা চেয়ার রাখা আছে – সবই ভর্তি! একদিকে ঢাকী তার ঢাক সামনে নিয়ে একটা চেয়ারে বসে আছে। আর তার পাশের চেয়ারেই একটা বাচ্চা ছেলে বসে আছে। হাতে কাঁসর ঘন্টা। একজন ভলান্টিয়ার এসে বাচ্চা টাকে উঠিয়ে দিয়ে সুপ্রীতির দিকে চেয়ার ঠেলে দিয়ে বললো – ‘বসুন! আপনি এখানে বসুন।’ বাচ্চাটা আহত, অভিমানী দৃষ্টিতে সুপ্রীতির দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিয়ে তারপরই ঢাকীর চেয়ারের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ছেলেটিকে এভাবে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বসতে সুপ্রীতির ভালো লাগলো না। কিন্তু বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার শারীরিক ক্ষমতা যে তার নেই। তাই একটু কিন্তু কিন্তু করেও সে চেয়ারটায় বসেই পড়ল। বাচ্চা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একবার স্নেহের হাসি হাসল। কিন্তু বাচ্চাটা চোখ নামিয়ে নিল।

প্রতিমার সামনে বসে পুরুতঠাকুর পুজো করছিলেন। ধূপ আর ধুনুচির ধোঁয়ায় পুজোর জায়গাটা ভরে গেছে। একটানা সঙ্গীতময় সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ, দুর্গা ঠাকুরের অদ্ভুত সুন্দর দুটি চোখের দৃষ্টি আর মুখের হাসি – সব মিলে যেন এক সম্মোহনী পরিবেশ! সবাই চুপচাপ বসে ছিল। মন্ত্রোচ্চারণ থামতেই সুপ্রীতির আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। এদিকে ওদিকে তাকাতেই তার নজরে পড়ল – বাচ্চা ছেলেটা ঢাকীর চেয়ারের পিছনে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে!

এমন সময় আরতি শুরু হতে ঢাকী উঠে দাঁড়িয়ে ঢাক বাজাতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারের পিছনে ঘুমন্ত ছেলেটা তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ে সেও পূর্ণোদ্যমে কাঁসর বাজাতে আরম্ভ করল। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে এমন একটা চমক আর মজা ছিল যে শুধু সুপ্রীতি নয়, ওখানে বসে থাকা আরো অনেকে হেসে উঠল। বাচ্চাটা নির্বিকার! কিছু বুঝল বলে মনে হল না।

পর দিন অষ্টমী! সন্ধিপুজোর পাট মিটতে বিকেল হয়ে গেল, আর খানিক বাদেই প্যান্ডেলও অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেল। ঢাকী এক কোনে বিশ্রাম নিচ্ছে। পুজোর পর সুপ্রীতি আর রুমা প্যান্ডেলে বসে গল্প করছিল। দুর্গাপুজো উপলক্ষে একজন চাওয়ালা বসানো হয়েছে। তার কাছে সবসময় চা পাওয়া তৈরি। তখন দুই বন্ধুর হাতে কাগজের গেলাসে গরম চা। গেলাসগুলো একেবারে মাথা পর্যন্ত ভর্তি বলে দুজনেই রুমাল জড়িয়ে ধরে আছে!

আবাসনের গেটের বাইরে একটা আইসক্রিমওয়ালাকে ঘিরে কয়েকটি ছোট ছেলেমেয়ে আইসক্রিম কিনছে। কথা বলতে বলতেই সুপ্রীতির নজরে পড়ল ওদের থেকে একটু তফাতেই সেই কাঁসর বাজানো বাচ্চা ছেলেটাও আইসক্রিমওয়ালার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে ডেকে সে জিজ্ঞাসা করল – ‘কিরে, আইসক্রিম খাবি?’
ছেলেটা মাথা নেড়ে ‘না’ বলল! সুপ্রীতি আর রুমা দুজনেই একটু অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করতে সে বলল – ‘টাকা নেই!’
– ‘আমি টাকা দিচ্ছি। তুই যা, গিয়ে আইসক্রিম কিনে আন!’
কথা বলতে বলতেই সুপ্রীতি তার হাতের পার্স খুলল। কিন্তু ছেলেটি কোনো রকম উৎসাহই দেখালো না। হাত গুটিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল!
– ‘কি রে? কি হল তোর?’ এবার রুমা প্রশ্ন করল।
একই ভাবে দাঁড়িয়ে ছেলেটা উত্তর দিল – ‘’আমি ভিক্ষা নেবো না!’
চমকে উঠল দুই বন্ধু। একটু যেন থতমত খেয়ে গেল। সামলে নিয়ে সুপ্রীতিই আবার বলল – ‘এমা! ভিক্ষা কেন হবে? তুই আমাদের জন্য একটা কাজ করে দিবি, আর তার বদলে আমরা তোকে আইসক্রিম খাওয়াবো।’
ছেলেটা একটু সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে বলল – ‘কি কাজ?’
– ‘দ্যাখ, আমাদেরও খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কে এনে দেবে, বল?’
– ‘আর দেখতেই তো পাচ্ছিস, আমাদের পায়ে কত ব্যাথা। হাঁটতে খুব কষ্ট!’ রুমা কথাটা বলে করুণ চোখে তাকিয়ে রইল।
– ‘তাই তাইতো বলছি, তুই আমাদের জন্য আইসক্রিম নিয়ে আয়, আর তোর নিজের জন্যেও পছন্দমতো আইসক্রিম নিবি! তার পর আমরা তিনজন একসাথে মজা করে আইসক্রিম খাবো!’
ছেলেটা এবার রাজী হয়ে গেল। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল – ‘দাও, টাকাটা দাও। তোমরা কি নেবে, বল।’

এবার প্যান্ডেলে তিনটে চেয়ারে বসে আইসক্রিম খেতে খেতে ওরা তিনজন গল্প শুরু করলো। সুপ্রীতি আর রুমার হাতে ভ্যানিলা কাপ, আর বাচ্চাটার দুহাতে দুটো কাঠি আইসক্রিম। একবার এহাতেরটা চুষছে, একবার ওহাতেরটা চাটছে। দারুন খুশি সে! দিব্যি ভাব হয়ে গেছে তিনজনের। বাচ্চাটার নাম বিদুর।
– ‘বিদুর! এ নামটা তো বড় একটা শুনিনা! কে রেখেছিল?’ রুমা প্রশ্ন করাতে ছেলেটা উত্তর দিল – ‘আমাদের গ্রামের মাস্টার দাদু!’
– ‘তোদের গ্রামের নাম কি?’
– ‘ন’পাড়া!’
– ‘সেটা কোথায়?’
– ‘অনেক দূর। হুই ব্যারাকপুর লাইনে – টেরেনে করে যেতে হয়!’
– ‘আচ্ছা, তোর নাম তো বিদুর! তুই বিদুরের গল্প জানিস?’ সুপ্রীতি জিজ্ঞেস করল।
– ‘বিদুরের গল্প আছে বুঝি?’ ছেলেটার চোখে মুখে একরাশ কৌতুহল।
– ‘আছে বৈ কি, অনেক আছে!’
– কিন্তু, আমাকে তো কেউ বলেনি। ঠাকমা আমাকে শুধু ভুত, পেত্নী আর শিব-দুগ্গার গল্প বলত!’
– ‘বাড়িতে তোর ঠাকুমা আছে?’
– ‘এখন আর নেই। বুড়ো হয়ে গেছিল তো, আর বছরে মরে গেছে!’
বিদুরের মাথায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করে সুপ্রীতি বলল – ‘ঠিক আছে, আমাকে তুই ঠাকুমা বলিস, কেমন!’
বিদুর রুমার দিকে তাকিয়ে বলল – ‘আর তোমাকে? তোমাকে কি বলব?’
– ‘আমাকে তুই দিদিমা বলিস।’ ওরা তিনজনেই হেসে উঠলো। এরপর সুপ্রীতি বিদুরকে পাশে ডেকে নিয়ে একটা গল্প বলতে শুরু করল! ছেলেটা ওর মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে মন দিয়ে গল্প শুনছিল !
পাশ দিয়ে যেতে যেতে পুজোর সেক্রেটারী অনিল মিত্র বলল – ‘বাহ্, ঢাকীর ছেলেটার সাথে আপনারা দেখছি দিব্যি ভাব জমিয়ে নিয়েছেন!’

রাতের বেলা সুপ্রীতি যখন প্যান্ডেলে ঢুকল, ততক্ষণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ওকে দেখে বিদুর দৌড়ে এসে বলল – ‘ঠাকমা, তোমার জন্য চেয়ার রেখে দিয়েছি, বোসো এখানে। দিদিমা তো কখন এসে গেছে! সামনে বসেছে।’
হাসিমুখে সুপ্রীতি বলল – ‘ঠিক আছে। আমি এখানেই বসি।’
একটা চেয়ার নিয়ে এসে বিদুর একটু তফাত রেখে সুপ্রীতির পাশেই বসল। অনুষ্ঠানে তার বিশেষ মন নেই। মাঝে মাঝেই সে সুপ্রীতির দিকে তাকাচ্ছে। একটু পরে বলল – ‘ঠাকমা, কাল আর একটা গল্প বলবে তো?’
– ‘আচ্ছা, কাল ভোগ নিবেদনের পর আসিস। কাল তোকে বিদুরের গল্প বলব। তোর গল্প শুনতে ভালো লেগেছে?’
– ‘খুব ভালো লেগেছে!’ ঘাড় কাত করে বিদুর বলল। ‘তুমি খুব ভালো গল্প বলতে পার।’
বিদুরের কথায় সুপ্রীতি হাসল। হাসিটা একটু ম্লান। ওর শরীরটা ঠিক ভালো লাগছিল না। অনুষ্ঠান শেষ হবার আগেই সে উঠে ঘরে চলে গেল!

পরদিন রুমা আর ইন্দিরার সাথে পুজো প্যান্ডেলে ঢুকে সুপ্রীতি দেখে ভোগের আরতি শুরু হয়ে গেছে! বিদুর তখন ঢাকের তালে কাঁসর বাজাচ্ছিল। কিন্তু তার মধ্যেও সে রুমা আর সুপ্রীতিকে দেখতে পেয়ে এক গাল হাসল। আরতি শেষ হতে বিদুর কাঁসর রেখে দৌড়ে ওদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল – ‘আইসক্রিম এনে দেবো?’
মাথা নেড়ে সুপ্রীতি বলল – ‘না,আজ আর আইসক্রিম নয়! আমাদের তিনজনের জন্য চা আনতে হবে। কিন্তু তুই নিজের জন্য আইসক্রিম নিবি!’
সঙ্গে সঙ্গে বিদুর ছোটাছুটি করে চা, আইসক্রিম সব নিয়ে এল। তিন বন্ধু চা খেতে খেতে গল্প করল, আর বিদুর ওদের পাশে দাঁড়িয়েই আইসক্রিমটা শেষ করল। তারপর একটু উশখুশ করে সুপ্রীতির শাড়ির একটা কোনায় টান দিয়ে বলল – ‘বিদুরের গল্পটা বলবে না?’
এরপর সুপ্রীতির পাশের চেয়ারে বসে মন দিয়ে মহাভারতের বিদুরের গল্প শুনছিল একালের ছোট্ট বিদুর!

গল্প তখন মাঝপথে, ভোগ খাবার ডাক পড়ল! রুমা আর ইন্দিরা বলল – ‘এখন ভোগ খেতে চল সুপ্রীতি। এমনিতেই অনেক বেলা হয়ে গেছে! বাকি গল্পটা তুই সন্ধ্যা বেলায় শুনে নিস, বিদুর!’

দশমীর দিন সকাল থেকেই বিসর্জনের তোড়জোড় চলছে। পুজো, দধিকর্মা, হয়ে গেল। বিদুর ভিতরে ভিতরে বেশ অস্থির হয়ে উঠছিল। ঠাকমা তো এখনও এলো না! কাল রাতেও আসেনি। বিদুর পুরো প্যান্ডেল ঘুরে খুঁজেছে। ঠাকমা, দিদিমা কাউকেই দেখতে পায়নি! ঠাকমা গল্পের শেষটুকু কাল রাতে বলবে বলেছিল। এলোনা কেন, কে জানে? অন্য কোথাও ঠাকুর দেখতে গেছিল বোধহয়! কিন্তু সকালেও তো আসছে না। একটু পরে তো বিদুর ওর বাবার সাথে ন’পাড়ায় চলে যাবে। এখন না এলে ঠাকমার সাথে তো আর দেখাই হবে না!

একবার অনিলবাবুকে দেখতে পেয়ে বিদুর তার কাছে ছুটে গেল – ‘কাকু, কাল যে ঠাকমার পাশে আমি বসেছিলাম , সে আসছে না কেন, জানো? কোথায় আছে সে?
তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিল অনিল! অবাক হয়ে বিদুরের দিকে তাকিয়ে বলল – ‘তোর ঠাকুমাকে আমি চিনব কি করে? ভাল করে খুঁজে দ্যাখ, এখানেই কোথাও আছে!’

আবাসনের নিজের ঘরে সুপ্রীতি তখন জ্বরের ঘোরে অর্ধচেতন অবস্থায়! ঘরের মধ্যে একজন নার্স ছাড়াও আরো জনা তিনেক লোক। তার মধ্যে রুমা একজন। পুজোর দিনে ডাক্তার পাওয়া খুব মুস্কিল। তবু ওরা চেষ্টা করছে,যদি কাউকে পাওয়া যায়!
জ্বরের ঘোরেও লাল লাল চোখ মেলে সুপ্রীতি চারদিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে দুবার বলে উঠল – ‘বাবু! বাবু!’ রুমাকে নার্স জিজ্ঞাসা করলো – ‘বাবু কে? আপনি জানেন?’
– ‘হ্যাঁ, ওনার ছেলে। আমেরিকায় থাকে!’
এমন সময় ঘরে একজনের খবর এলো, ডাক্তার আসছেন। তবে এখনও ঘন্টাখানেক লাগবে এখানে পৌঁছাতে!

বেদি থেকে প্রতিমা নামানো হয়ে গেছে! একটু পরেই বিসর্জনের জন্য ট্রাকে তোলা হবে। ঢাকী ঘুরে ঘুরে ঢাক বাজিয়ে বখশিশ সংগ্রহ করছে। ছেলেকে এদিক ওদিক করতে দেখে ধমক দিল – ‘কী করছিস, বল্ তো? শুধু এদিকে ওদিকে ছটফট করে দৌড়ে বেড়াচ্ছিস? শান্ত হয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাক!’
দূর থেকে ইন্দিরা কে আসতে দেখে বিদুর দৌড়ে গেল। ইন্দিরাকে জিজ্ঞাসা করল – ‘ঠাকমা এলো না?’
ইন্দিরা বিদুরের মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বলল – ‘তোর ঠাকমার খুব জ্বর হয়েছে। উঠতেই পারছে না মোটে!’
বিদুরের মুখ শুকিয়ে গেল। মাথা নীচু করে সেখান থেকে সরে গেল । প্রতিমার সামনে তখন খুব ভীড়! এক কোনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে বিদুর দুর্গা ঠাকুরের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল – ‘আমার প্যান্ডেলের ঠাকমাকে তুমি ভালো করে দিও, ঠাকুর! সামনের বছর এসে যেন আবার ওই ঠাকমাকেই দেখতে পাই!’

Sahityika Admin

Add comment