দুটি ছোট গল্প
সুদীপ রায়, ১৯৭০ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
শবনম
(এই গল্পটি বছর কুড়ি পঁচিশ আগের লেখা। তখন না ছিল ইনটারনেটের এমন সুবিধে, না ছিল হাতে হাতে মোবাইল ফোন। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে গল্পটি পড়ার অনুরোধ রইল।)
লাঞ্চের পরে অফিসের বাইরে এসে সুজয় সবে একটা সিগারেট ধরিয়ে পানের দোকানের ট্রানজিস্টরে কমেন্ট্রি শুনছিল … সৌরভ নব্বইতে দুর্দান্ত ফর্মে ব্যাট করছে , আর ঠিক তখনই অর্ণব এসে ভুরু নাচিয়ে বলল ‘গুরু, প্রমোশন পাচ্ছিস, অথচ এতবড় খবরটা বেমালুম চেপে রেখে দিলি? আজ বিকেলেই অফিসের পরে বীয়ার খাওয়াতে হবে। মাইরি।‘
সুজয় একটু চমকালেও সামলে নিল, বলল ‘কি উল্টোপাল্টা বলছিস ? কিসের প্রমোশন?’
অর্ণব সুজয়ের গালে হাল্কা টোকা মেরে বলল ‘ঢপ মেরনা গুরু। এই শর্মার কাছে সব খবর চলে আসে।‘ সুজয় অবাক, ‘আমি কিন্তু সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিনা। কি শুনেছিস বলতো?’
অর্ণব হাসল, বলল ‘কনফার্মড নিউজ আছে আমার কাহে … সুজয় বোস এন্ড অজিত দত্ত, বোথ বিইং এলিভেটেড টু ‘প্রোজেক্ট ম্যানেজার; র্যাঙ্ক উইথ এফেক্ট ফ্রম অগাস্ট, এবার বলো বাবা, কবে ট্রিট পাচ্ছি?
‘আশ্চর্য, আমি কিছুই শুনিনি। খবরটা যদি সত্যিই হয় তাহলে সন্ধ্যেবেলায় পার্ক হোটেলে শুধু বীয়ার নয়, ফুল ডিনার।‘
লাঞ্চের পরেই সুজয়ের ডাক পড়লো জি এমের কেবিনে। সেন সাহেব সুজয়ের কাজকর্মের খোঁজখবর নিয়ে সুজয়ের হাতে প্রমোশনের চিঠিটা দিয়ে বললেন ‘সো ফার সো গুড সুজয়। নাউ ইট ইজ হাই টাইম ইউ টেক আপ হায়ার রেসপন্সিবিলিটি। রূপসাগড়ে আমরা ছোট একটা দেড়’শ মিটার স্প্যানের ব্রীজের কন্সট্ট্রাকশনের কাজের কন্ট্রাক্ট নিয়েছি। গো দেয়ার এন্ড হ্যান্ডল দ্য প্রোজেক্ট এলোন। ইট উইল গিভ ইউ আ গুড ওভারঅল এক্সপোজার। মীট তপন ফর ডিটেলস।‘
তপন অর্থাৎ তপন বসু সুজয়ের ইমিডিয়েট বস। সেনসাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে সুজয় তপনদা’র কাছে গেলো।
তপনদা বললেন ‘কংগ্রাচুলেশন্স। আয়, বোস, তোকে তোর নতুন প্রোজেক্টটার একটা আঊটলাইন দিচ্ছি। কাজটা আমরা গতকালই পেয়েছি। রূপসাগড় এম পি, মহারষ্ট্রের বরডারে ছোট্ট শহর। শহর না বলে একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম বলাই বোধ হয় ঠিক হবে। গতমাসে আমি একবার জায়গাটা দেখে এসেছি। ওখনে রূপসা নদীর ওপরে ব্রীজটা তৈরি হবে। দেড়শ মিটার স্প্যান হলেও কনট্যুর বেশ ঝামেলার। সুতরাং কাজটা চ্যালেঞ্জিং। তোকে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করতে হবে। পারবি তো সামলাতে?
সুজয় বলল ‘তোমার কী মনে হয় তপনদা ?’
তপন বাসু হাসল, বলল ‘ছোট জায়গা। লিমিটেড ইনফ্রাস্ট্রাকচার, সুতরাং অসুবিধে এটা, ওটা আসতেই পারে। বাট আই হ্যাভ ফুল কনফিডেন্স অন ইউ। সুজয় … টেক আপ দ্য চ্যালেঞ্জ। দিস মাইট বী দ্য টারনিং পয়েন্ট অফ ইওর ক্যারিয়ার। এরকম গডফোরসেকেন জায়গায় প্রোজেক্ট সাইটে এর আগেও তো কাজ করেছিস। সো দ্যাটস নট দ্য পয়েন্ট। ডিফারেন্স ইজ এবারে তুই সাইট ম্যানেজার। আননোন টেরিটরি, বাট উই ফেল্ট ইউ আর দ্য রাইট চয়েস।‘
পরদিনই সুজয় প্রোজেক্টের ডিজাইন আর কন্ট্রাক্ট কাগজপত্রগুলো ভালোভাবে দেখে নিল। একেবারে পাণ্ডববর্জিত জায়গা। রাজনন্দনগাঁও জংশন স্টেশনে নেমে ছোট লাইনের গাড়িতে আড়াই ঘন্টার রাস্তা। ছোট্ট শহর হাজার তিরিশ লোকের বাস। ক্লাস টেন পর্যন্ত স্কুলের ব্যবস্থা আছে। কলেজ বলি বা ভালো ডাক্তার, তিনঘন্টা বাস বা জীপ ঠেঙ্গিয়ে রাজনন্দনগাঁও আসতে হয়। মন্দের ভালো যে ফোনে যোগাযোগের জন্য এস টি ডি সুবিধা আছে। সুজয়ের মন উড়ু উড়ু হয়ে গেল। অফিস থেকে সাইটের কাছেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে অফিস কাম গেস্ট হাউস মতন রাখবে। কলকাতা থেকে কুক নিয়ে যাওয়া হবে। সুজয় ছাড়া এখন আরো দুজন যাচ্ছে, একজন জুনিয়র ইঞ্জিনীয়র আর একজন একাউন্টস কাম স্টোরস ক্লার্ক। বাকি লোক রূপসাগড় থেকেই সুজয় জোগাড় করে নেবে। হাতে সাতদিন মাত্র সময়।
পার্ক হোটেলের বারে বসে বীয়ারের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে অর্ণব বলল, ‘যাঃ বাবা, এটা তো শালা তোর পানিশমেন্ট পোস্টিং এর মত হল। কোথায় কলকাতার পার্ক স্ট্রীটের পশ অফিস, আর কোথায় ধাপধাড়া রূপসাগড় না কী একটা জায়গা। গুরু তুই আর শুধরালি না। ‘না’ বলে দিলেই পারতিস। ওদিকে দ্যাখ অজিতদা ঠিক ম্যানেজ করে হেড অফিসে থেকে গেল। তুই যখন সন্ধ্যেবেলা রূপসাগড়ে মশা তাড়াবি, অজিতদা তখন এখানে রেস্ট্যুরেন্টে বীয়ার প্যাঁদাবে।‘
‘আমার কিন্তু মন্দ লাগছে না। রূপসাগড় নামটা বেশ রোমান্টিক। তপনদা বলছিল পাহাড়, নদী, জঙ্গল নিয়ে সুন্দর জায়গা। দেড়টা বছর তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আমার কিন্তু বেশ এক্সাইটেড লাগছে। খাপছাড়া সাইটে এর আগেও থেকেছি। চলেই যাই, কি বলিস ?’
অর্ণব সিগারেট ধরিয়ে বলল ‘তুই যখন ঠিক করেই ফেলেছিস যাবি, তখন উইশ ইউ অল সাকসেস। কিন্তু চিন্তার ব্যাপার হল, তোর এবসেন্সে শালা অজিতদা না তোকে ফিউচারে ল্যাং মারে। যা খচরা লোক মাইরি।‘
তপনদার কাছে শুনে সুজয় মনে মনে জায়গাটা সম্বন্ধে একটা ছবি এঁকে নিয়েছে। মহাকাল পাহাড়ের আবছা কুয়াশার মধ্যে থেকে রূপসা নদী বেরিয়ে এসে হঠাৎই বাঁক নিয়েছে রূপসাগড়ে। বছরের বেশির ভাগ সময়েই চড়া, যেন পাথরের টুকরোর বিছানা পাতা সারাটা নদী জুড়ে। হেঁটে নদী এপার ওপার করা যায়। বর্ষায় সেই নদীই ফুলে ফেঁপে ভয়ঙ্করী। পূরো শহরটাই সবুজ ঘাসের গালচেতে ঢাকা, সকালের সোনালী রোদে চকচক করে। শহরের মাঝখানে মহাকালদেবীর মন্দির। মন্দিরের সামনে চবুতরাতে সন্ধ্যে হতেই গ্রামের মাতব্বররা এসে মজলিশ আর মৌতাত বসায়।
রূপসাগড়ে যাওয়ার আগের দিন অফিসে লাঞ্চের পরেই সুজয় ফ্রী হয়ে গেল। তপনদার সঙ্গে একবার দেখা করে বাড়ি ফিরে যাবে। টুকিটাকি কিছু কেনারও আছে। তপনদার অফিসে গিয়ে শুনল তপনদা অফিসের বাইরে কোথাও মিটিং এ গেছে। ফিরতে একঘন্টা। এখন কী করবে সুজয়? হঠাৎই সুজয়ের মাথায় এই অদ্ভুত ছেলেমানুষী খেয়ালটা এল। টেলিফোন গাইড থেকে রূপসাগড়ের এস টী ডী কোড দেখে আনতাউড়ি র্যানডম নম্বরে ডায়াল করতে শুরু করল। এমনিই, মজা দেখতে। রূপসাগড় ছোট জায়গা, সুতরাং সিক্স ডিজিট নম্বরের যে কম্বিনেশন মনে এল তাতেই চেষ্টা করতে লাগল। বার দশেক ডায়াল করার পরেও একটা নম্বরও লাগল না – হয় এনগেজড নয় ‘দিস নাম্বার ডাজ নট এক্সিস্ট’। হাল ছেড়ে দেবার আগে শেষবারের মত একবার একটা নম্বর লাগাল সুজয়। আর কী আশ্চর্য সুজয় শুনতে পেল অন্যপ্রান্তে রিং হচ্ছে। প্রথমটায় সুজয় ভাবল ডিসকানেক্ট করে দেবে, কিন্তু কিছু ভেবে ওঠার আগেই কেউ ওদিকে টেলিফোন তুলল। ‘হ্যালো’ নয় ওপাশ থেকে মাঝবয়েসী কোনো ভদ্রলোকের গলা শোনা গেল ‘হাঁ জী কহিয়ে। ম্যাঁয় আব্দুল বোল রহা হুঁ।‘
এখন লাইন কেটে দিতে সুজয়ের বাঁধল। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে সুজয় বলল ‘আসসলাকুম আলম, ভাইসাহাব ম্যাঁয় কলকাত্তা সে বোল রহা হুঁ।‘
‘আলেক্কুম আসসলাম জনাব, আপ কিসসে বাত করনা চাহতে হ্যাঁয়?’ কোলকাতা থেকে ফোন এসেছে শুনেই হয়তো আব্দুলের প্রশ্নে বিস্ময়ের ছাপ।
কি বলবে এখন সুজয় ?
‘আব্দুল মিয়াঁ, আমি কোলকাতা থেকে সুজয় বসু বলছি। আপনি কী আমাকে একটু মদত করতে পারবেন? আসলে আমি রূপসাগড়ের কোনো একজনের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম। ঘটনাচক্রে আপানার সঙ্গে কানেকশন হয়ে গেছে।‘ সুজয় অনেক ভেবে আস্তে আস্তে কথাগুলো বলল।
‘ম্যাঁয় সমঝা নহিঁ, আপ হ্যাঁয় কৌন অওর আপ জাননা ক্যায়া চাহতে হ্যাঁয়?’ আব্দুলের কণ্ঠে দ্ব্বিধা।
‘এয়সা হ্যায় আব্দুল ভাই, শায়দ আপকো পতা হোগা আপকে ওহাঁ এক নয়া ব্রীজ বন রহা হ্যায়। আমাদের কোম্পানী ওই ব্রীজ বানানোর কন্ট্রাক্ট পায়া হ্যায়। হাম ওখানের ইঞ্জিনিয়ারিং কাজটা দেখেগা। হামারা নাম সুজয় বাসু। এই ব্যাপারে থোড়া কথা বলার ইচ্ছা হ্যায়।‘
কথাটা বলে সুজয়ের নিজেরই কেমন যেন বোকা বোকা লাগল। আব্দুল এ ব্যাপারে হয়তো আদার ব্যাপারী। কিন্তু এখন কিছু করার নেই। এরকম উল্টোপাল্টা ফোন করা একেবারেই উচিত হয় নি। কেন যে এমন উদ্ভট খেয়াল মাথায় চেপেছিল। এখন যাহোক কিছু একটা বলে ম্যানেজ করতে হবে।
ওদিক থেকে জবাব এল ‘জনাব, ম্যাঁয় ইহাঁ কী পঞ্চায়েত কে চেয়ারম্যান হুঁ। মুঝে ব্রীজ কে বারে মালুম হ্যায়। আপলোগ কব কাম চালু করনা চাহতে হ্যাঁয়? ক্যায়া জানকারি চাহিয়ে?’
এবারে সুজয় চমকাল। এখন কী বলবে সুজয় ? কী জানতে চাইবে ?
‘আপকে ওহাঁ ইনটারনেট কানেকশন হ্যায়?’ সুজয় বোকার মত ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল। যেন ব্রীজ বানাতে ওটাই সবচেয়ে জরুরি। বলার মত কিছু না থাকলে যা হয় আর কী !
‘ক্যায়া? ইন্টটারনেট? ও ক্যায়া চিজ হ্যায় জনাব?’
‘কম্প্যুটার জানেন তো? ই মেল … ঠীক হ্যায়। কোই বাত নহিঁ। ম্যায় ইতোয়ার কো আ রহা হুঁ। আপসে জরুর মিলুঙ্গা। শুকরিয়া ভাইসাব।‘ সুজয় মওকা পেয়ে এবারে এই অহেতুক কথোপকথন শেষ করতে চাইছে।
‘এক মিনিট, ভাইসাব। আপনে কম্প্যুটার বোলা? মেরে ঘরমে কম্প্যুটার হ্যায়। শায়দ মেরী বেটি আপকি মদদ কর সকতী, শবনম বেটি একবার ইধর আ জা’। আব্দুল মেয়েকে ডাকল।
দুমিনিটের নিরবতা, এবারে ওপাশে সুরেলা কণ্ঠে কেউ বলল ‘জী, বোলিয়ে।‘
অদ্ভুত সুন্দর সুরেলা গলা। সুজয়ের সমস্ত শরীর যেন চনমন করে উঠল।
‘হাম কোলকাতা থেকে সুজয় বাসু বোল রাহা হ্যায়। রূপসাগড়ে ক্যেয়াইন্টারনেট কানেকশন হ্যায়?‘
‘জী নহিঁ। ইয়ে ছোটিসী জগাহ হ্যায়। হ্যাঁ, রাজনন্দনগাঁওমে আপকো ভিএসএনএল নেট কানেকশন মিল জায়েগা।‘
কথাতো নয়, সুজয়ের মনে হল স্বরে যেন মূক্তো ঝরে পড়ছে। সুজয় একটু চুপ করে থেকে রেশটা টেনে রাখতে চাইছিল। এত সুন্দরও কারো গলার আওয়াজ হতে পারে? ভাগ্যিস আব্দুল মেয়েকে ডেকেছিল।
‘ক্যায়া হুয়া, আপকো মেরী বাত সুনাই দে রহা হ্যায় ন? ম্যায় শবনম বোল রহী হুঁ।‘
সুজয় উত্তর দিতে যাবে, ঠিক সেই সময়েই অফিসে লোড শেডিং হয়ে গেল।
সুজয় ইনটারকমের এক্সটেনসন লাইন থেকে কথা বলছিল। লোড শেডিং হতেই লাইনটা কেটে গেল। এখন ডাইরেক্ট লাইন থেকে আবার নতুন করে অবশ্য কথা বলা যেতে পারে, কিন্তু কোন নম্বরটা ডায়াল করে আব্দুলের লাইন পেয়েছিল, এখন আর কিছুতেই মনে করতে পারল না। হান্টিং লাইন, তাই রীডায়ালের প্রশ্নই ওঠে না। সুজয়ের নিজের উপরেই ভয়ানক রাগ হল। লোড শেডিং হওয়ার আর সময় পেল না? আশ্চর্য সুন্দর গলা কিন্তু মেয়েটির। আরো কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলে ভালো লাগত।
পাওয়ার ফিরে আসতেই অর্ণব এসে সুজয়কে বলল ‘তপনদা আজ আর অফিসে ফিরছে না তোকে একবার সন্ধ্যে সাতটার সময়ে তপনদার বাড়িতে যেতে বলেছে আধঘন্টার জন্য … কিছু ইন্সট্রাকশন দেবেন। ……… কী ব্যাপার অমন মুখ ব্যাজার করে বসে আছিস কেন ?’
সুজয় অর্ণবকে রূপসাগড়ে ফোনের আর শবনমের ব্যাপারটা বলল।
সব শুনে অর্ণব বলল ‘এ তো মেঘ না চাইতেই জল। গিয়ে লেগে পড় গুরু। ভালো সময় কাটবে।‘
সুজয় হেসে বলল ‘যাঃ কী যে বলিস … তুই আর তিলকে তাল করিস না। মেয়টার গলার আওয়াজটা অসাধারণ লেগেছিল। তাই তোকে বললাম।‘
রাতে শুয়ে ঠিকমত ঘুম এল না সুজয়ের। একটা হালকা অস্বস্তি। আচ্ছা যে মেয়ের এত সুন্দর গলা, সে মেয়ে দেখতেও নিশ্চয়ই ফাটাফাটি সুন্দরী হবে। শবনম নামটাও কী সুন্দর। আচ্ছা শবনম নামটার অর্থ কী? কত বয়েস হতে পারে শবনমের? কম্প্যুটার জানে, সুতরাং কলেজে পড়ে ধরে নেওয়া যেতে পারে। আর বাবা মা’র সঙ্গে যখন থাকে সুতরাং অবিবাহিত নিশ্চয়ই। অতএব বয়েস আঠারোর মত হবে বোধ হয়। খুব বেশি হলে উনিশ। না না উনিশের বেশি কিছুতেই নয়। সুজয়ের দৃঢ় বিশ্বাস হল শবনম হল আঠারো উনিশ বছর বয়েসের রীতিমত সুন্দরী এক টীন এজার। এতক্ষণে সুজয়ের অস্বস্তি একটু কমল। মনে মনে শবনমের একটা চেহারা এঁকে ফেলল। পাঁচ দুইয়ের দোহারা গড়ন। গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য। কল্পনার পাখা উড়িয়ে সুজয় দেখল পূর্ণযৌবনা শবনম তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, স্তনভারে ঈষৎ আনতা, নিতম্বিনী, ঠিক যেন কোনারকের ভাস্কর্য।
‘সুজয়, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ সুজয় … ম্যাঁয় শবনম বোল রহী হুঁ।‘
আবার সেই মধুবর্ষণ। সুজয়ের সারা শরীর আবার রিনরিন করে উঠল। ঝনন ঝনন বাজে … সুরবাহারে রসশৃঙ্গারে।
‘শবনম আমি জানতাম তুমি আসবে … কেমন আছ তুমি শবনম?’
‘আমি যে শবনম সুজয়। শবনম নামের অর্থ জান তো? ফুলের গন্ধে মাতাল ভোরের শিশির … যাকে চোখে দেখা যায় না … অনুভব করা যায় … আমার রূপ, রঙ কয়েক মুহূর্তের জন্য। ম্যাঁয় পল দো পল কে শায়র হুঁ।‘
‘পৃথিবীতে সবকিছুই তো ক্ষণিকের শবনম। এই যে আমি তোমার রূপ, রঙ, রস, বর্ণ, গন্ধে বিভোর মাতোয়ারা … এও হয়তো সময়ের মাপকাঠিতে নিতান্তই তুচ্ছ।‘
‘তুমি খুব সুন্দর কথা বল সুজয়। তুমি কি কবিতা লেখ?’
‘তেমন করে কখনো লিখি নি, আজ লিখব।‘
খিল খিল করে হেসে উঠল শবনম। ‘ঠিকই শুনেছিলাম … বাঙালি ছেলেরা বড় প্রেমিক স্বভাবের হয়।‘
‘তোমার চোখ দুটো ভারি সুন্দর শবনম্। কী গভীর … কী প্রশান্ত।‘
‘ওকথা বোলো না সুজয়। বললাম না আমি শবনম, ক্ষণযৌবনা।‘ শবনমের কথায় কোথায় যেন বিষণ্ণতার ছোঁয়া।
‘কেন শবনম, আমি কি এতই অপাংক্তেয়?
‘তা নয় সুজয়, পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু গভীর থাকে যা ভীষণ নিজস্ব, ভীষণ প্রিয়, ভীষণ ভাবে একান্ত। তাকে দূরে দূরে রাখাই ভালো। নিজের নিয়মেই তাকে কাছে আসতে দিতে হয় সুজয়। সময়ের আগে কাছে এলে তার রহস্যে ঘেরা আকর্ষণটা আর থাকে না। তখনই আসে হতাশা। আর আমি তো এই মুহূর্তে শুধুই তোমার কল্পনা। আমাকে কল্পনার মধ্যেই থাকতে দাও না কেন? বাদ মে দেখা জায়েগা … কাল ক্যায়া হোগা কিস নে আজ জানা ?”
সুজয়ের ঘুম ভাঙল এলারম ক্লকের কর্কশ আওয়াজে। সকাল ন’টা পনেরোর ট্রেন ধরতে হবে।
হাওড়া স্টেশনে অর্ণব এসেছিল সুজয়কে সী অফ করতে। ট্রেন ছাড়তেই বল ‘গুরু তোর আর শবনমের মধ্যে কেসটা কতদূর গড়াল আমায় টাইম টু টাইম জানাস। এসব ব্যাপারে আমি অথরিটি। কখন কী করতে হবে আমি ডিটেলে বলে দেব।‘
সুজয় অর্ণবের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল ‘কে শবনম ? ও নামের কাউকে তো আমি চিনি না !’
স্মৃতি
অজয়ের ভাগ্য ভালো ছিলো। ভিড় বাসে উঠে পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই বসার জায়গা পেয়ে গেছে। গুছিয়ে বসে পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছে একটু থিতু হতেই মাথার ভেতরে কেমন যেন একটা অস্বস্তি শুরু হল। চোখে হঠাৎ যেন অস্পষ্ট দেখছে, যেন মাথার ভেতরে একটা ঘুণপোকা কুরে কুরে খাচ্ছে।
অজয় চোখ বন্ধ করে দুমিনিট শান্তভাবে বসে রইল। আর ঠিক তারপরেই ব্যাপারটা ঘটল। চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে গেলেও অজয়ের আর কিছুতেই মনে পড়ল না ও কেন বাসে উঠেছে, কি উদ্দ্যেশ্যে, বা কোথায় যাচ্ছে। অজয় শান্তভাবেই চিন্তা করলো, ঘাবড়ালো না। চুপ করে বসে মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু না, অজয়ের হঠাৎই যেন অতীতের সব স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়ে গেছে। এই মুহূর্তে এমন কী ওর বাড়ি কোথায়, কোন স্টপেজ থেকে বাসে উঠল এসবও কিছুই মনে পড়ছে না। আবছা ভাবে মনে পড়ছে বৌ স্মৃতি আজ সকালে কোথাও যেন একটা যাবার কথা বলেছিল, কোনো একটা হাসপাতালে যেখানে চেনা কেউ একজন ভর্তি আছে, কিন্তু এর বেশি কিছুই আর মনে পড়ছে না। বাইরে রাস্তা ঘাট দেখে মনে হচ্ছে বাইপাসের ওপর দিয়ে বাস যাচ্ছে। কিন্তু অজয়ের কোথায় গন্তব্য সেটাই তো বিরাট একটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে অজয়ের কাছে।
অজয় এবার ভারি অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এ আবার কিরকম হল ? এরকম ব্যাপার আগে তো কোনোদিন হয় নি। তবে কারো কারো এরকম হয় বলে আগে শুনেছে। কার এক মেশোমশাই এরকম রাস্তায় বেরিয়ে সবকিছু ভুলে যেতেন। চেনাজানা লোকেরা পরে খুঁজে পেতে ধরে এনে বাড়ি পৌঁছে দিত। অজয় বাসের ভিড়ের মধ্যেই এদিক ওদিক তাকাল। না, ভিড়ের মাঝে চেনা কোনো মুখ নজরে এল না।
অজয়ের হঠাৎই মনে পড়ল এর আগে একদিন পাড়ার মুদী দোকানে গিয়ে লজ্জায় পড়েছিল। মুদীর বিল একশ তেইশ টাকা হিসেব করে কিছুতেই ও দিয়ে উঠতে পারছিল না। প্রথমে একটা একশ টাকার নোট বার করে বাকি তেইশ টাকা খূচরো টাকায় হিসেব করতে গিয়ে বারবার গোলমাল করে ফেলছিল। শেষে বাধ্য হয়ে দোকানের ছেলেটি অজয়ের মানিব্যাগ থেকে তেইশ টাকা গুনে বার করে নিতে অজয় সে যাত্রা পার পেয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার এখন ঘটনাটা মনে পড়লেও দোকানটা কোথায় আর দোকানি ছেলেটির নাম্ অজয়ের এখন আর কিছুতেই মনে পড়ছে না।
এ এক চুড়ান্ত অস্বস্তি। এরকম অসুখের কথা অজয় শুনেছে … কী একটা বিদঘুটে নাম যেন, কিন্তু নামটা কিছুতেই মনে আসছে না। কী সব্বোনাশ অজয়কে আবার সে রোগে ধরল নাকি?
‘টিকেট’
এই মরেছে … বাসের কন্ডাক্টর এসে অজয়ের পাশের ভদ্রলোকের কাছে টিকেট চাইল। এবারে নিশ্চয়ই অজয়ের কাছে টিকেটের পয়সা চাইবে। অজয় তখন কোথায় যাবে বলে বলবে? এ মুহূর্তে অজয়ের কোনো গন্তব্যস্থানের নামই মনে পড়ছে না। কী করে পড়বে, বাসের রূটটাই যে অজয় জানে না।
‘সায়েন্স সিটি একটা’ পাশের ভদ্রলোক বললেন।
হঠাৎ অজয়ের মনে পড়ল সায়েন্স সিটির কাছাকাছি প্রলয় মানে অজয়ের বড় শালা থাকে না? কিন্তু সঠিক কোথায়, মানে কোন পাড়ায় থাকে, কোন বাস স্টপ এসব মনে পড়ছে না। কোনো একটা আবাসনে থাকে এটুকু মনে পড়ছে, কিন্তু আবাসনের নাম মনে নেই … ভোঁ ভাঁ। যাক অজয়ও না হয় সায়েন্স সিটিরই একটা টিকেট কেটে নেবে। ওখানে নেবে না হয় একবার আবাসনগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখবে যদি প্রলয়দের আবাসনটা চিনতে পারে।
আশ্চর্যভাবে কন্ডাক্টর কিন্তু অজয়ের কাছে টিকেট কাটতে পয়সা চাইল না। পেছনের রো তে চলে গেল। এরকম ভুল হল কী করে হল কে জানে! যাক গে, মন্দের ভালো কিছুটা সময় পাওয়া গেল। যদি কিছু মনে পড়ে যায় এর মধ্যে। তবে সায়েন্স সিটি এখান থেকে কতদূর সেটাও তো অজয় বুঝতে পারছে না। অজয় আর কিছু ভাবতে পারছে না। কী করে এই সমস্যা থেকে উদ্ধার পাবে সেটাও বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল পকেটে মোবাইল ফোনটা তো আছে। সেখানে স্মৃতির ফোন নম্বর থাকলে স্মৃতিকে ফোন করে এ সমস্যা থেকে হয়তো পরিত্রাণ পেতে পারবে। স্মৃতি কে বলে দিলেই হবে যে ও সায়েন্স সিটি বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে স্মৃতি প্রলয়কে ফোন করে দিলে প্রলয় এসে ওকে এ যাত্রায় রেসক্যু করতে পারবে।
গুড লাক, অজয় ফোনটা বার করে স্মৃতির মোবাইল নম্বরটা পেয়ে গেল। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ হলে যা হয়। মোবাইলে লো ব্যাটারী। একবার রিং হওয়ার পরেই অজয়ের ফোনটা অফ হয়ে গেল। এখন আর কিছু করার নেই। অপেক্ষা করতে হবে কখন পাশের ভদ্রলোক সায়েন্স সিটিতে নামেন। তখন অজয়ও নেমে গিয়ে যাহোক কিছু একটা উপায় করবে।
‘শুনছো, রুবী এসে গেছে, আমাদের এবারে নামতে হবে।’ স্মৃতির গলা শুনে অজয়ের সম্বিত ফিরল। স্মৃতি উঠে দাঁড়িয়ে লেডীজ সীটের দিক থেকে অজয়কে ডাকছে। আরে স্মৃতিও তাহলে অজয়ের সঙ্গে এ বাসেই উঠেছে? কেলেঙ্কারি, অজয় সে কথাও বিলকুল ভুলে গেছে।
‘অজয় উঠে পাশে আসতেই স্মৃতি বলল ‘কোন জগতে থাক? একবার রিং করেই ফোনটা বন্ধ করে দিলে? ভাবলাম তুমি রুবী হসপিটালে নামার জন্য রিমাইন্ডার দিচ্ছ। আমি তোমার টিকেটটা কেটে কন্ডাক্টরকে বলে দিয়েছিলাম। ভিড়ে তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। তুমি আবার টিকিট কেটে বস নি তো ?‘
কী আনন্দ, কী আনন্দ … অজয়ের এবারে সব কথা মনে পড়ে গেল। পেটে ব্যাথা নিয়ে বড় শালা প্রলয় আজ দুপুরে রুবীতে ভর্তি হয়েছে। আর ওরা দুজন প্রলয়কে রুবীতে দেখার জন্য গড়িয়ার বাড়ি থেকে বাসে উঠেছিল।
এখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
প্রলয়ের অসুখের খবরের মধ্যেও অজয়ের মনে প্রশান্তি … এ যেন তার পুনর্জন্ম হলো। ঠিক করল রুবীতে গিয়ে এখনই একজন ভালো নিউরোলজিস্টের সঙ্গে একটা এপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করে নেবে এট দ্য আরলিয়েস্ট কনভেনিয়েন্স।
একটা থরো মেডিক্যাল চেক আপ দরকার।
Add comment