‘ক্যাম্পাস ক্যালিডোস্কোপ’ মূল উপন্যাসের নির্বাচিত অংশবিশেষ
পৃষতী রায়চৌধুরী, ১৯৯৯ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
দেড়শো বছরের জীবনপ্রবাহ থেকে তুলে নেওয়া হল এক আঁজলা জল। শতসহস্র মুখের মিছিল থেকে বেছে নেওয়া হল গুটিকয়কে। বিশ শতক আর একুশ শতকের সন্ধিক্ষণে এখানে জীবনের কয়েকটি বছর কাটানো সেদিনের তরুণ-তরুণীরা আজ মধ্যবয়সে পৌঁছে জীবনের এক আকস্মিক বাঁকে দাঁড়িয়ে আচমকা ঘুরে তাকায় সেই ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে। তাদের সম্মিলিত স্মৃতিচারণে জেগে ওঠে অতীত। ধূসর বিস্মৃতির পর্দা সরিয়ে সামনে আসে ভুলে যাওয়া দিনযাপন।..
প্রথম বর্ষ
পলাশ
আগষ্ট মাসের এক সকাল। পঁচিশ বছর আগের সেই ভেজা ভেজা সকালটা পলাশের মনের ক্যালেন্ডারে এত পোক্ত ভাবে, এত স্থায়ী ভাবে গাঁথা আছে যে এতগুলো বছরের, এত শত মাইলের দূরত্বও তাকে বিন্দুমাত্র ঝাপসা করতে পারেনি। স্মৃতির পর্দায় সামান্য টোকা দিতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই দিনটা। ক্যাম্পাসের গেটে বাসটা যখন তাদের নামিয়ে দিলো, তখন সকালের নরম রোদ্দুর চারদিকে। ঘড়িতে সময় বলছে সকাল পৌনে সাতটা। গেট দিয়ে ঢুকে চওড়া রাস্তা। দুদিকে গাছের সারি। বোধহয় আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। গাছপালা সব সবুজ, সতেজ, সদ্যস্নাত। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ জলবিন্দু ঝরে পড়ছিল তার মাথায়। যেন শিরে বর্ষিত বসুধারা।
সে শিবপুর বি ই কলেজে প্রবেশ করছিল। প্রবেশ তো নয়, মহাপ্রবেশ। সে প্রবেশ করছিল ক্যাম্পাসে, আর ক্যাম্পাসও এক মোহময় সত্ত্বা হয়ে প্রবিষ্ট হচ্ছিল তার চেতনায়, তার অস্তিত্বে। তার অনাগত ভবিষ্যতের অসংখ্য কার্যকারণের অংশীদারীর দাবি নিয়ে। এ যেন পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করে নেওয়া। প্রথম দেখাতেই আবিষ্ট করে ফেলা একে অপরকে। মোহাচ্ছন্নের মত এগিয়ে চলছিল পলাশ। মাথার ওপর বৃক্ষশাখার সবুজ চাঁদোয়া, সকালের সূর্যকিরণের লুকোচুরি তার ফাঁক দিয়ে। একটু এগিয়ে একটা চৌমাথা পড়ল। এবার কোনদিকে যাবে ঠিক বুঝতে পারছিল না তারা। অ্যাডমিশন লেটারে লেখা আছে তার ঠিকানা হবে হোস্টেল নম্বর ষোলো। কিন্তু সেটা কোনদিকে? উল্টো দিক থেকে দুটো ছেলে আসছিল। তাদের পরনে ঢোলা বারমুডা আর টিশার্ট। চুল উস্কো-খুস্কো, এলোমেলো। চোখে ঘুমের রেশ। তাদের দুলকি চালে হাঁটার ভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে শরীর থেকে ঘুম এখনো পুরোপুরি ছাড়েনি। হোস্টেল ষোলো কোনদিকে জিজ্ঞাসা করাতে তারা দেখিয়ে দিল – চৌমাথা থেকে বাঁদিকের রাস্তাটা ধরে হেঁটে গিয়ে চারটে হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে একদম শেষেরটা ষোলো। চলে যাওয়ার সময় ছেলেগুলো বারবার ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল তাদের দিকে, আর নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলি করছিল।…
বাঁশরী
চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল বাঁশরীর। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফেলতে লাগল সে নীরবে। কুণাল বলতে থাকল আগের কথার রেশ ধরে। “কোনোদিন পারবেও না তুমি। কারণ দু’নৌকোয় পা দিয়ে চলতে গেলে এমনই হয়। তোমাকে তো আমি অনেকদিন বলেছি, বেছে নাও। তুমি আমাকে চাও নাকি নিজের কেরিয়ার। তুমি তো সম্পর্কটাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে নিজের কেরিয়ার নিয়ে মশগুল হয়ে রইলে।“
– পা দিয়ে মাড়িয়ে? এমন কথা বলতে পারলে তুমি?
অভিমানে বাঁশরীর গলা বুজে এল। চোখ জলে ভরে এল আবার। “জীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি তোমাকে।“
– তোমার আচরণে তো তা প্রকাশ পায় নি।
কুণাল আজ নির্দয়। তার সমস্ত ব্যর্থতার প্রতিশোধ যেন বাঁশরীর ওপরেই নেবে আজ সে। বাঁশরী চুপ করে রইল। চোখের জল গাল বেয়ে গড়াল আবার টপটপ। ভিজিয়ে দিতে লাগল তার দোপাট্টা। সে মোছার চেষ্টাও করল না। সেদিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে কুণাল বলে চলল, “তোমাদের এই ক্যাম্পাসে কেন আসতে ইচ্ছে করে না জানো? এখানে সবার কেমন একটা সুখী, তৃপ্ত মুখ, যেন জীবনে সব পেয়ে গেছে। আই হেট দ্যাট।“
“তাতে আমার কি দোষ?” বাঁশরী কান্নাভেজা গলায় বলল।
– ইউ আর আ পার্ট অফ দ্যাট। তুমিও তো এই মোহ ছাড়তে পারলে না। নিশ্চিত কেরিয়ার ছেড়ে আমার হাত ধরে অনিশ্চিতে ভেসে যেতে পারলে কি? যা দুজনেই পাইনি, তা তুমি না নিলেই পারতে। পারতে না কি?
চুপ করে থাকে বাঁশরী। হাতের তেলো দিয়ে মুছে নেয় চোখের জল। কুণাল আজ আঘাত করবে বলেই এসেছে।..
ঈশান
বাক্সের ওপর রাখা নোটস গুলো উল্টে পাল্টে দেখল ঈশান। শুধু কিছু পুরনো ক্লাস নোট। কিন্তু সীতা যে বলল, সলভড পেপার দিয়েছে কিছু। গাঁতু কি লুকোচ্ছে কিছু? মাথাটা গরম হচ্ছে।
“দিবি কি না বল?” বেশ জোরে চেঁচিয়ে উঠল ঈশান।
-গাঁক গাঁক করে চেঁচাচ্ছিস কেন? বললাম তো আর কিছু দেয় নি। গাঁইয়া ভূত কোথাকার।
চেয়ার থেকে উঠে পড়ে স্লিপারটা গলিয়ে রুম থেকে বেরতে গেল মৈনাক। মুহুর্তের মধ্যে কি যে একটা হয়ে গেল ঈশানের মধ্যে! ঝট করে উঠে এসে ওর হাতটা চেপে ধরল, তারপর এক ধাক্কায় তাকে শুইয়ে দিল বিছানায়। নিমেষের মধ্যে হাঁটু দিয়ে ওর পা দুটো চেপে ধরে কাঁধে চাপ দিল, “একটা কথা বললেই গলা টিপে দেব, কেউ আসার আগেই শেষ হয়ে যাবি শালা। তাড়াতাড়ি বল কোথায় রেখেছিস কোয়েশ্চন পেপার গুলো?”
অর্তকিত আক্রমণের জন্য বোধহয় একেবারেই প্রস্তুত ছিল না মৈনাক। তাছাড়া চেহারা নাদুস-নুদুস হলে কি হয়, গায়ে একেবারেই জোর নেই পিসটার। খেলাধূলোর ত্রিসীমানায় যায়নি কখনো। ছোট থেকে বাবা-মার আদর-যত্নে পুতুপুতু করে মানুষ হয়েছে। মাদুলি-তাবিজে মোড়া এই পিসটার এইটাই জীবনের প্রথম পরীক্ষা যেখানে ওর মা কিংবা বাবা ডাবের জল নিয়ে অপেক্ষা করবে না। এই কথা কাঁদুনি গেয়ে গত ক’দিনে অন্তত বার পাঁচেক বলেছে সে নিজেই। ঈশানের হাঁটুর নিচে হাঁসফাঁস করতে করছে মৈনাক। মুখটা ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য। চোখদুটো বিস্ফারিত।
“মেরে ফেলবি নাকি?” ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল মৈনাক।
ভীতুটার অবস্থা দেখে রাগ ছাপিয়ে এবার হাসি পেয়ে গেল ঈশানের। হাতে কন্ট্রোল রেখে একটু চাপ বাড়িয়ে বলল, “পাঁচ গোণার মধ্যে সত্যি না বললে সেটাই করবো। আমাকে চিনিস না তুই। এক, দুই, তিন-।“
– ট্রাঙ্কের মধ্যে। ওই ট্রাঙ্কে. জামাকাপড়ের তলায়।
– সত্যি?
– সত্যি।
– ওঠ তাহলে, দে তুই বার করে।
আস্তে আস্তে গলাটা ছেড়ে দিল ঈশান। মৈনাক এক লাফে উঠে ট্রাঙ্ক খুলে জামাকাপড়ের বান্ডিল সরিয়ে বার করে ঈশানের দিকে ছুঁড়ে দিল এক তাড়া সলভড কোয়েশ্চন পেপার।..
দ্বিতীয় বর্ষ
বাঁশরী
জনস্রোতে ভাসতে ভাসতে সে চেঁচাতে লাগল তার বন্ধুদের নাম ধরে – লিচ্ছবি-ই-ই..। প্রজ্ঞা-আ-আ..। শিল্পা.. পলাশ… ঈশান….। কোথায় তোরা? কোথায়..? কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না সে। ধাক্কা এড়াতে একটা স্টলে ঢুকে পড়ল সে। স্টলের মালিক আর একজন কর্মচারী মিলে দ্রুত হাতে বইপত্র গোটাতে ব্যস্ত। ক্ষুধার্ত আগুন ছুটে আসছে দ্রুত গতিতে। শ্বাসরোধকারী গরম বাতাস পাক খাচ্ছে চারদিকে। দমবন্ধ হয়ে আসছে বাঁশরীর। আবার কি সে হারিয়ে গেল? আবার? আবার? পাগলা ঘন্টির মত দমকলের ঘন্টি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আকাশে-বাতাসে। কোথাও দেখা যাচ্ছে না তার বন্ধুদের। হঠাৎ তার কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ। কে যেন অনেক দূর থেকে তার নাম ধরে ডাকল। চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল বাঁশরী। অচেনা জনস্রোতের মাঝখান থেকে উঠে এসেছে তার চির চেনা প্রিয় মানুষটি। কেমন একটা ঘোর লাগছে তার। সত্যি দেখছে সে? এতদিনে তাহলে ফিরে এল সে? শেষ অব্দি এল তার কাছে ফিরে? এমন এক দুর্যোগের দিনে? সে এগিয়ে এসে আঁকড়ে ধরল কুণালকে। জড়িয়ে ধরল প্রাণপণ। কখনও, কোনোদিনও আর ছাড়বে না ওকে। এক মুহুর্তের জন্যেও না। সারা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাক, আগুনে পুড়ে যাক, ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাক, বন্যায় ডুবে যাক, তার কিছু যায় আসে না। তার প্রিয় মানুষটি হারিয়ে গেছিল, সে আবার খুঁজে পেয়েছে- আর কিছুতেই ছাড়বে না তাকে।
– বাঁশরী, বাঁশরী, এই বাঁশরী – কি হয়েছে তোর? এই বাঁশরী… চোখ খোল.. ভয় পাস না..।
অনেক দূর থেকে কে যেন মৃদুস্বরে কথা বলছে। আস্তে আস্তে চোখ খুলল বাঁশরী। আর চোখ খুলেই বাস্তবটা দেখতে পেল। কতক্ষণ যে সে তথাগতকে জাপটে ধরেছিল সে নিজেও জানে না। ছি, ছি, কি ভাবল ছেলেটা। তথাগতর শার্টের খানিকটা অংশ ভিজে গেছে ওর চোখের জলে। অপ্রস্তুত হয়ে ওকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল বাঁশরী।..
ঈশান
রবিবারের এক অলস মাঝ-সকাল। বেলা এগারোটা সাড়ে এগারোটা হবে। ঈশান তখনো বিছানায় গড়াচ্ছিল। পলাশও ঘুমাচ্ছে নিজের খাটে। উৎস বাড়ি গেছে। হঠাৎ দরজায় নক। ঘুমচোখে একবার তাকাল ঈশান। তারপর আবার চোখ বুজে পাশ ফিরে শুলো। যে হবে হোক গে। সে এখন আরেকটু ঘুমোবে, কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই এখন তার। কাল দুপুর থেকেই সে একটা ঘোরে আছে। গতকাল হোলি ছিল। সকাল থেকেই রং মেখে হুল্লোড় করার পর দুপুরে সুতনু আর রুদ্র এক গামলা সিদ্ধি বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। সবাই গ্লাসে ঢেলে খাচ্ছিল। ঈশান এক গ্লাস খেয়ে বলল, আরে এ তো দারুণ খেতে, কিন্তু এ খেয়ে তো আমার কোনো এফেক্টই হল না। দে আরেকটু খাই। রুদ্র বলল, “বেশি খাস না, এর এফেক্ট হতে কিন্তু সময় লাগে। একটু ওয়েট কর।“ কিন্তু শুনল না ঈশান। পর পর আরো দু-গ্লাস খেয়ে নিল। তাতেও তেমন কিছু হয়নি। দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তারপর বিকেলে বাথরুমে গিয়ে মনে হলো হঠাৎই সবকিছু দুলতে শুরু করেছে। ভূমিকম্প? তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেরতে যাবে, দরজাটা আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না সে। কোথায় গেল দরজাটা? একটু আগেই তো সে ওই দরজাটা দিয়েই ঢুকল। কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল দরজাটা? এ কি সেই আলিবাবার গল্পের মত চিচিং ফাঁক কেস? এখান থেকে বেরনোর একমাত্র পথ কি তবে দেওয়ালের ওই ঘুলঘুলিটা? ওই ঘুলঘুলি দিয়েই কি বেরতে হবে তাকে? হঠাৎ মনে হল সে টিকটিকির মত দেওয়াল বেয়ে ওপরে উঠছে। ছাদটা নিচে চলে এসেছে আর মেঝেটা ওপরে। সে প্রাণপণে দেওয়াল চেপে ধরে আছে। একটু এদিক-ওদিক হলেই সে নিচে পড়ে যাবে। চেঁচিয়ে বন্ধুদের ডাকার চেষ্টা করল সে, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরচ্ছে না। চারতলা থেকে পড়লে সে বাঁচবে কি করে? ইস্, এভাবে বেঘোরে মারা পড়বে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে? শেষে কাঁদতে লাগল সে। সারা জীবনের যত কান্না সব যেন বেরিয়ে আসতে লাগল। কিসের দুঃখ তার, কেন যে কাঁদছে জানে না সে। শুধু মনে হল অনন্তকাল কেঁদে যেতে পারলে তবেই সে শান্তি পাবে।..
লিচ্ছবি
বক্সিং রিং এর সীমানায় একটা চৌকো মত উঁচু বাঁধানো চাতাল। কোনো এক সুদূর অতীতে এখানে হয়ত বক্সিং হত, কিন্তু সে যে কবে, কোন কালে, তা কেউ জানে না। গার্লস হোস্টেলের ঠিক সামনে এর অবস্থান বলে এর দুদিকের সিঁড়িতে বসেই সন্ধ্যেবেলা দাদা-দিদিরা বসে প্রেম করে। সুমনা’দি সেদিন বলছিল, “বুঝলি না, এটা ভবিষ্যতের প্রস্তুতি। বাকি জীবনটা তো বক্সিং করেই কাটবে।“ আগে এই বক্সিং রিঙে বসে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকাদের দেখে দারুণ রোম্যান্টিক একটা ব্যাপার বলে মনে হত লিচ্ছবির। আর আজ এখন সে নিজেই বক্সিং রিং-এর সিঁড়িতে বসে আছে। সাত্যকিদা পাশে বসে কিছু একটা বলছিল, তার কানে তেমন ঢুকছিল না। সে তাকিয়ে দেখছিল সামনের গ্রেভ-ইয়ার্ডের পাঁচিলে বসে ফোর্থ ইয়ারের ফর্সা দিদি-কালো দাদা, থার্ড ইয়ার ইলেকট্রিকালের শিউলিদি আর মাইনিং-এর ঋজুদা – কী এনগ্রসড হয়ে আছে নিজেদের নিয়ে! কী এই রসায়ন? সে কেন এর সন্ধান পায় না? তার মনটা কেন যে পড়ে থাকে গল্পের বইয়ে, তাসের আসরে? শুধু দুজনের কুহু-কূজনের থেকে কেন তাকে বেশি টানে বন্ধুদের দলবদ্ধ হৈ চৈ আড্ডা? সে এখন বক্সিং রিঙে বসে ভাবছিল, প্রেম একটা ভীষণ ওভার-রেটেড বিষয়। গল্প, উপন্যাস, সিনেমায় প্রেমকে যত গ্লোরিফাই করে দেখানো হয়েছে যুগে যুগে, ততটা মোটেও ডিজার্ভ করে না ব্যাপারটা। তেমন কিছু আহামরি ইন্টারেস্টিং নয়। এর চেয়ে ঢের বেশি ইন্টারেস্টিং হলো গল্পের বই পড়া, সিনেমা দেখা, বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা মারা, তাস খেলা, বেড়ানো, ট্রেকিং, ব্যাডমিন্টন।
সাত্যকিদা হঠাৎই উঠে পড়ল। বলল, – চলো একটু হাঁটি। লিচ্ছবি আপত্তি করল না। বাইরেটা আজ সত্যি খুব সুন্দর। বিরাট চাঁদ উঠেছে আকাশে। পূর্ণিমার আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। মৃদু হাওয়া দিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে লাভার্স্ লেন বা এল-স্কোয়ার ছাড়িয়ে গিয়ে ফাঁকা স্টেডিয়ামের একটা ধাপে বসল দুজনে। নির্জন স্টেডিয়াম। ঠান্ডা হাওয়া, ঝিরঝিরি দুলতে থাকা গাছের পাতা, থালার মত চাঁদ টাওয়ার ক্লকের উপর দিয়ে, জোছনায় ভেসে যাচ্ছে ওভাল মাঠ – এত আয়োজন সব বুঝি বৃথা যায়। সাত্যকিদার আকুল চেয়ে থাকে তার দিকে। সে চোখ নামিয়ে নেয়। সাত্যকিদা হাত ধরতে চায়- সে হাত গুটিয়ে নেয়। নেই, নেই, সেই অনুরণন নেই। একজনের আকুলতা, আবেগ, ট্রান্সফার হচ্ছে না অন্যজনের মধ্যে। এমন মায়াবী সন্ধ্যায় যদি সেই ম্যাজিক, সেই স্পার্ক তৈরি না হয়, তবে আর কবে হবে?..
পলাশ
ফার্স্ট গেটের বাসস্ট্যান্ডের সামনের দোকানে এক কাপ করে চা খেয়ে তিনজনে একসঙ্গে হেঁটে ক্যাম্পাসে ফিরল। পান্ডিয়া হলের সামনে এসে তথা হঠাৎ বলল, “পলাশ, তুই এগো, আমি বাঁশরীকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসছি।“
পলাশ অবাক। সামনেই পান্ডিয়ার গেট- এখান থেকে আবার কাউকে এগিয়ে দেওয়ার কি আছে? সে বাঁশরীর দিকে তাকাল। বাঁশরী হ্যাঁ, না কিছুই বলছে না, হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। অগত্যা একাই হোস্টেলের পথ ধরল পলাশ। উল্ফেনডেন হলের পাশ দিয়ে হোস্টেল সেভেনের দিকে রওয়ানা হয়ে পিছন ফিরল হঠাৎ। পান্ডিয়ার গেটের সামনে তথা আর বাঁশরী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছে। খুবই সাধারণ দৃশ্য, সে নিজেও কতবার এখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা মেরেছে লিচ্ছবি, বাঁশরী, শিল্পাদের সঙ্গে, কিন্তু আজ তথার এই হঠাৎ আলাদা হয়ে চলে যাওয়াটা কেমন যেন চোখে লাগল। একটা কোকিল পাগলের মত ডাকছে উল্ফের পাশের নিম গাছটার উপর বসে। হু হু একটা মনখারাপ আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরছে পলাশকে। কোথায় কি যেন একটা শূন্য হয়ে গেল। এই শূন্যতা কোনোদিন আর ভরবার নয়।
হোস্টেলে ফিরে পলাশ দেখল তার রুমে নিত্যকার তাসের আসর বসেছে। ঈশান, উৎস, ভূতো আর জিয়া। পলাশ নিজের গীটারটা টেনে নিয়ে টুংটাং করতে লাগল। কিছুতেই আজ মন লাগছে না তার। থেকে থেকেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে সে। অস্থির লাগছে। ঘড়ির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে বারবার। কান খাড়া। করিডরে কারো পায়ের শব্দ হল কি? তথা এখনও ফিরল না তো? কোথায় আছে ও? কি করছে? তথা কখন কি কোথায় যায় তার হিসেব ও আগে কখনো রাখেনি। কিন্তু আজ যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
– টু ডায়মন্ড।
– থ্রি ক্লাব্স।
– থ্রি স্পেড।
– থ্রি নো-ট্রাম্প।
– ডবল।
– রি-ডবল।
মেঝেতে বসে থাকা জনতা নিলাম ডেকে চলেছে অনমনীয়ভাবে। যেন যুদ্ধ লেগেছে। কেউ কাউকে জমি ছাড়বে না। ওদের কথাবার্তা, কল ডাকা, গেম করা, সব অর্থহীণ বকবক মনে হচ্ছে পলাশের। ইচ্ছে করছে এক দাবড়ানি দিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে দেয়। বন্ধ করে দেয় এই বিরক্তিকর খেলা। তথা কেন এখনো আসছে না, কি কথা ও এতক্ষণ বলছে বাঁশরীর সঙ্গে, কেন ও একা এতক্ষণ বাঁশরীর সঙ্গে কথা বলবে- এই কৈফিয়ৎ চাইতে ইচ্ছে করছে জনে জনে সবাইকে ধরে। সবাই যেন এক ষড়যন্ত্রে সামিল।..
তৃতীয় বর্ষ
থার্ড ইয়ার, ভাইজ্যাগ ট্রিপ
পলাশ
আরো কয়েকটা টান দেওয়ার পর মাথাটা এবার বেশ হালকা লাগছে। সব কিছু সে এবার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কি তার করণীয়? রেজারটা তুলে নিল সে। ঝট করে খুলে ফেলল নতুন লাগানো ব্লেডটা। দেখল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। কতটুকু লাগবে? অনেক কি? সবার মুখোমুখি হওয়া, আবার সেই থান-ইঁট সমান বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকা, সবাই ফোর্থ ইয়ারে উঠে যাবে, আর সে থার্ড ইয়ারেই থেকে যাবে বছরের পর বছর – না না অসম্ভব। তার চেয়ে এই ভালো। বেশি লাগবে না। কয়েক মুহুর্ত মাত্র। তারপরেই শেষ হয়ে যাবে সব কিছু। মুক্তি। ছুটি। চিরকালের মত। শেষ টান দিয়ে নিল সে তার হাতের সিগারেটে। স্নায়ু এখন একেবারে শিথিল। এবার ব্লেডটা ডান হাতে নিয়ে দ্রুত চালিয়ে দিল বাঁ হাতের শিরায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল। বাঁ হাতখানা তার খাটের ধারে ঝুলে রয়েছে। কব্জি থেকে বেরনো রক্তের স্রোত মেঝে দিয়ে গড়িয়ে যেতে লাগল। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। তার মধ্যেও ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলে গেল তার। ল্যামিনার ফ্লো, টারবুলেন্ট ফ্লো। কব্জি থেকে বেরনোর সময় ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে – টারবুলেন্ট ফ্লো। আবার সেই রক্তের স্রোতই দেখো মেঝেতে গড়াচ্ছে যখন – একমুখী, ধীরগতি। ল্যামিনার ফ্লো। কি দারুণ উদাহারণ। কে যেন ঘুম পাড়ানি সুরে বলে যাচ্ছে.. জলে ফাঁড়া আছে.. জলে ফাঁড়া আছে..। ঘুম পাচ্ছে পলাশের। শীতও করছে খুব। লেপটা পায়ের কাছে গোটানো আছে। হাত বাড়িয়ে ওটা টেনে নিয়ে মুড়ি দিয়ে শুলে আরাম হত একটু। কেউ কি নেই যে লেপটা একটু বিছিয়ে দেবে তার শরীরে..? সে যে উঠতে পারছে না.. তার বড্ড ঘুম পাচ্ছে.. চোখ জুড়ে আসছে..। ঘুম.. ঘুম.. অনেকদিন ভালো করে ঘুমোয়নি সে।
ঈশান
ঈশানের চোখ জ্বালা করছে। নিজেকে আর সামলাতে পারছে না। দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল সে। পিঠটা কাঁপতে লাগল। কান্নার দমকে। – আমার তখন ওকে একা ছেড়ে দেওয়াটা উচিৎ হয়নি রে ভূতো। কি করে যে এমন বোকামো করলাম আমি.. আমিই দায়ী রে.. আমারই দোষে…।
– চুপ কর ঈশান। শান্ত হ’। তোর কি দোষ? সব ঠিক হয়ে যাবে দেখ। ভূতো পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে আছে শক্ত করে।
– তুই জানিস না….। আমি ওকে.. ওকে খুব তোড় করেছিলাম রে তখন। একে তো ও ডিপ্রেস্ড ছিল.. তার ওপরে আমি..।
কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে ঈশান। ও বাঁচবে তো রে, ভূতো? এমন ভাবে সে ভূতোর মুখের দিকে তাকাল যেন ভূতোর কথার উপরেই নির্ভর করছে পলাশের বাঁচা-মরা।
– বাঁচবে, বাঁচবে, নিশ্চয় বাঁচবে। আই বিলিভ ইট ডিপ ইন মাই হার্ট। বেশি দেরি তো করিনি আমরা। হয়ত একটু রক্ত লাগবে, অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গেছে তো। সে যত রক্ত লাগে আমরা জোগাড় করে দেব। পুরো বি ই কলেজ লাইন দিয়ে দেবে রক্ত দিতে। ওকে আমরা বাঁচাবই।..
লিচ্ছবি
সাড়ে ছ’টার সময় একবার নিচে গিয়ে দেখল লিচ্ছবি, কিন্তু ভূতোর কোনো পাত্তা নেই। মিনিট পনেরো টিভি রুমে কাটিয়ে উপরে উঠে এল সে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পার্থিব’ নিয়ে বসল। এ বছর বইমেলায় কিনেছিল। পরীক্ষা হয়ে গেলে সামার ব্রেকে পড়বে বলে তুলে রেখেছিল। গল্পের বই-এ ডুবে গেছিল, জানলায় হঠাৎ খটাং করে ঢিল পড়ার একটা শব্দ। চমকে উঠল লিচ্ছবি। গা’টা ছমছম করে উঠল তার। বি ই কলেজে ভূত আছে একথা বহুল প্রচলিত, তবে ভূতেদের আস্তানা হিসেবে খ্যাতি লাভ করা জায়গা গুলোর তালিকায় পরিত্যক্ত ডাউনিং হল, স্লেটার হল, নিমঝিলের পাড়ের ঝুপসি গাছগুলো, বিদিশা ঝিল আর গ্রেভ-ইয়ার্ড আছে বলে সে জানতো, পান্ডিয়াতে কোনোদিন ভূতের উপদ্রবের কথা শোনা যায়নি। তাছাড়া ভূতে জানলায় ঢিল ছুঁড়তে যাবে কেন খালি খালি? ভাবতে ভাবতেই আবার একটা ঢিল খটাং করে জানলার গ্রিলে এসে লাগল। এবার জানলার পরদা সরিয়ে লিচ্ছবি দেখল- ভূত নয়, ভূতোর কারসাজি। তার ঘরের ঠিক নিচে রাস্তার ধারে ভূতো দাঁড়িয়ে আছে, আর তৃতীয় ঢিলটা ছোঁড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
– কি ব্যাপার রে? অ্যাই? ঢিল ছুঁড়ছিস কেন? ওপর থেকে চেঁচাল লিচ্ছবি।
– কি করব? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, কাউকে দেখতেও পাচ্ছি না যে ডাকতে পাঠাব। বাধ্য হয়ে-। আয়, নেমে আয়।..
চতুর্থ বর্ষ
ঈশান
হেড তাঁর চিঠিতে স্পষ্ট করে লেখেননি ঈশানের বিরুদ্ধে অভিযোগটা ঠিক কি। ঈশানও ঠিক বুঝতে পারছে না কতটা বলবে। কোনটা বলাই বা যুক্তিযুক্ত। সে বন্ধুর প্রোজেক্ট থেকে হুবহু কপি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে, আর তার প্রোজেক্ট মার্কস পুরোটাই কেটে নিয়েছেন স্যার- নাকি সে বন্ধুকে কপি করতে দিয়েছিল আর ধরা পড়ে দায়টা নিজের ঘাড়ে নিয়েছে বন্ধুকে বাঁচাতে- কোনটা শুনলে বাবা বিশ্বাস করবে? রাগ, দুঃখ এসব একটু কম হবে বাবার? কোনটা বলবে ঠিক করে উঠতে পারে না ঈশান। মাথা নিচু করে সে বসে থাকে চুপচাপ, আর মনে মনে বাছা বাছা গালি দিতে থাকে একেবি’কে। এমন একটা সিচুয়েশনে তাকে ফেলবার জন্য। সব তো মিটে গেছিল রে বাবা। কেন, প্রজেক্টের চল্লিশ নম্বর খেয়েও কি তোর শান্তি হয়নি? আরও কি চাস তুই? রাস্টিকেট? ইয়ার লস? সাসপেনসন ফ্রম ক্লাস? ক্যালেন্ডারে মা-কালীর রক্তমাখা জিভ বার করা মুখটাতে একেবির মুখ দেখছিল ঈশান। হাতে ধরা মুন্ডটা ঈশানের।..
লিচ্ছবি
নিজের হোস্টেলে ফিরে এল লিচ্ছবি। কেন কে জানে মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে। কার ওপর যে রাগ তাও ঠিকমত বুঝে উঠতে পারছে না। অথচ সকাল থেকে কারো সঙ্গেই কোনোরকম ঝগড়া বা মন কষাকষি হয়নি মোটেও। পান্ডিয়ার গেটে ঢুকতে গিয়ে একবার পিছন ফিরে তাকাল সে। ওরা দুজন হেঁটে যাচ্ছে পাশাপাশি। মৌলির হল্দে দোপাট্টা উড়ে এসে ঠেকছে ভূতোর শ্যাওলা-সবুজ টি-শার্টে, কালো প্যান্টে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে ওদের দেখছে লিচ্ছবি। চোখটা জ্বলছে তার। নাঃ, অধিকার বোধটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। ভাল নয় এটা। এত মনখারাপ কেন করবে? অযৌক্তিক ব্যাপার যত সব। মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে থাকে লিচ্ছবি। পারে না। ঘন কুয়াশার মত তাকে জড়িয়ে থাকে এক নাছোড় মনখারাপ। ধীরে ধীরে সন্ধ্যে নামে জানলার বাইরে।
মনখারাপের সেই সন্ধ্যেয় ঘর অন্ধকার করে চুপচাপ বসে ছিল সে। একটু আগেই লবি থেকে দেখে এসেছে সে ভূতোর রুম অন্ধকার। তার মানে বাড়ি চলে গেছে সে। কল্পনায় সে দেখতে পাচ্ছে – হলুদ দোপাট্টা আর শ্যাওলা সবুজ টি-শার্ট পরস্পরকে লেপ্টে বসে আছে। সেকেন্ড হুগলী ব্রিজের ওপর গঙ্গার হু হু হাওয়ায় হলুদ দোপাট্টা থেকে থেকেই ছুঁয়ে যাচ্ছে শ্যাওলা-সবুজ টি-শার্ট পরা ছেলের মুখ। মাথা নিচু করে গুনগুন করে কথা বলছে দুজনে।
সাড়ে সাতটা নাগাদ রুমের দরজায় এসে একজন জানান দিল – অভীকদা ডাকছে নিচে।
ওঃ, বাড়ি যাওয়া হয়নি তাহলে? তাকে পৌঁছেই ফিরে আসা হয়েছে? লঘু পায়ে নিচে মেনে এল সে কয়েক মিনিটের মধ্যেই। তাকে দেখেই ভূতো প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, – কী রে, মন খারাপ?
– কী আশ্চর্য, আমার কেন মনখারাপ হবে? মনখারাপ তো তোরই হওয়ার কথা।..
পলাশ
গানটা শেষ করতে পারল না পলাশ। থেমে গেল মাঝপথেই। গলা ধরে আসছে। বিদায় হোস্টেল লাইফ। বিদায় কলেজ জীবন। বিদায় ক্যাম্পাস। বর্ষাকালের সদ্যস্নাত ক্যাম্পাস, পরীক্ষার আগের চুপচাপ সিরিয়াস ক্যাম্পাস, বসন্তের পাগল হাওয়ায় ভেসে যাওয়া মন খারাপের ক্যাম্পাস, শীতের মিষ্টি রোদ মেখে রঙবেরঙের মরশুমি ফুলে সেজে থাকা হাসিখুশি ক্যাম্পাস, আগষ্টের শুরুতে একদল নতুন ছেলেমেয়ের আগমনে মুখরিত ক্যাম্পাস, জুনের শেষের ফাঁকা নিস্তব্ধ ক্যাম্পাস, রেবেকার রাতের উৎসব-রঙীন ক্যাম্পাস, সুইসাইড বা অ্যাক্সিডেন্টে কোনো নবীন প্রাণ ঝরে যাওয়ার পর ভয় পেয়ে থমকে যাওয়া থমথমে ক্যাম্পাস। বিদায় তোমাকে।
কিন্তু কেন তার এত মায়া এই ক্যাম্পাসের জন্য? কেন এত পিছুটান? এত মনখারাপ? কি পেয়েছে সে এখান থেকে? ঐ যে ঈশান, তথা, জিয়া, বাঁশরী- ওরা সবাই চাকরি পেয়েছে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে। জীবনের নিশ্চিন্দি পেয়েছে ওরা। তথা, বাঁশরী, উৎস, জিয়া – এরা জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছে এখানে। এদের সবার জীবনের ডালি পূর্ণ করে দিয়েছে এই ক্যাম্পাস। আর অন্যদিকে সে নিজে কি পেয়েছে? তার ঝুলি তো শূণ্য। তাকে রিক্ত হাতে নিষ্ঠুরের মত ফিরিয়ে দিয়েছে এই ক্যাম্পাস। সব দিক থেকে ব্যর্থ সে। জীবন এমনকি একদিন মুখ ফিরিয়েও নিয়েছিল তার দিক থেকে। ঠেলে দিয়েছিল পিচ্ছিল অন্ধকার এক গহ্বরের মধ্যে। তবু কেন টলটলে এক কষ্ট তার বুকের মধ্যে? কেন মনে হয় শ্যামল সুশীতল ছায়া বিছিয়ে পরম মায়ায় তাদের জড়িয়ে আছে এই ক্যাম্পাস? মায়ের আঁচলের মত পরম নির্ভরতার সেই আশ্রয়। বাইরের পৃথিবী যেন নিষ্ঠুরের মত ওৎ পেতে বসে আছে। থাবা চাটছে লোভীর মত। রাত পোহালেই তাদের টেনে-হিঁচড়ে বার করে নিয়ে যাবে এই নিশ্চিন্দির ঘেরাটপ থেকে। বন্ধুবান্ধবের এই পরিচিত সুখী গন্ডী থেকে। শিকারি চিলের মত ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে তাদের প্রত্যেককে। তারপর ছুঁড়ে ফেলবে জীবনের রণাঙ্গণে। নির্দয়, ক্ষমাহীণ, কঠোর সেই রণভূমি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলাদা হয়ে যাবে তারা।..
————–
উপন্যাসটি আমাজন থেকে সংগ্রহ করার লিংক রইল নিচে। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শঙ্খ কর ভৌমিক (ল্যামি), ’৯৭ মাইনিং। প্রকাশক Ukiyoto Publishing। বইটি শিবপুর বি ই কলেজের সর্বকালে সকল প্রাক্তনীর প্রতি উৎসর্গীকৃত।
Add comment