একটি নিছক চুরির গল্প
সুদীপ সেনগুপ্ত, ১৯৮০ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
“আচ্ছা, জীন্সের যে ব্যাগটা করে অভিযুক্ত জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়েছিলো, তার স্ট্র্যাপটা কত লম্বা ছিলো ?”
বাচ্চামত ডিফেন্স ল-ইয়ার মেয়েটি বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে প্রশ্ন করলো।
আমি হতবাক। এক চুরির মামলার সাথে ব্যাগের স্ট্র্যাপের দৈর্ঘ্যের কী সম্পর্ক!
যদিও আমি অভিযোগকারী নই, তবুও যেহেতু আমার ফ্ল্যাটেই চৌর্যবৃত্তিটা ঘটেছিল, আর আমিই মালিক ঐ ব্যাগের, যা বেশির ভাগ সময় আমার অর্ধাঙ্গিনী ব্যবহার করতেন, আমি উত্তর দিতে বাধ্য।
এখন কথা হচ্ছে, আপনারা কেউ কি যে সব বস্তু নিয়মিত ব্যবহার করেন, তার মাপজোক করে রাখেন নিয়ম করে ? কিন্তু আমাকে তো উত্তর দিতেই হবে।
আমি দাঁড়িয়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায়। জীবনে ঐ একবারই কোনও কাঠগড়ায় দাঁড়ানো, অবশ্যই সংসারেরটিকে বাদ দিয়ে।
সুতরাং, একমাত্র পথ – আমাকে অভিনয় করে দেখাতে হবে। দ্রুত আমার ডান হাত চলে গেলো ডান কাঁধের কাছে। বললাম, “ধর্মাবতার, যখন না কি আমি ব্যাগটি কাঁধে ঝোলাই, তখন সেটি এই বগলের কাছেও থাকে না …” বলেই হাতটি সটান নামিয়ে নিই ডান হাঁটুর কাছে, বলি – “এখানেও ঝোলে না।”
বিচারক মশাই মাননীয় নোরান্হা লাগালেন এক ধমক ঐ বাচ্চা মেয়েটিকে – “কি সব অবান্তর প্রশ্ন করছেন, কেস সম্বন্ধে যা জানতে চান তাই জিজ্ঞেস করুন। শুধু শুধু আদালতের সময় নষ্ট করছেন কেন ?” ডিফেন্স কাউন্সেল একটু থতমত খেয়ে চুপ করে গেলো।
ঘটনাটা তাহলে গোড়া থেকেই বলি।
আজ থেকে বছর কুড়ি আগের কথা। কর্মোপলক্ষ্যে তখন গোয়া রাজ্যের অধিবাসী। শিশু কন্যাকে নিয়ে আমরা থাকি মারগাঁও-এ, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ্ ইণ্ডিয়া হাউজিং সোসাইটির এক ফ্ল্যাটে। শান্ত পরিবেশ, প্রচুর নির্মল হাওয়া, আর পরিবেশ দূষণের কোনও চিহ্ন নেই দূর দূর পর্যন্ত। দিনমানে কাজের অলস ব্যস্ততা থাকলেও সন্ধ্যার পরেই নিঝুম নিস্তব্ধ চারিদিক। শুধু কখনও কখনও সোসাইটির পাশের পাড়া থেকে ভেসে আসে গোয়ান গানের রেশ। অধিকাংশ পরিবারই তখন উপভোগ করছে আরামদায়ক সন্ধ্যা, সুরা আর সঙ্গীত সহযোগে। আমাদেরও নৈমিত্তিক দিনান্ত কাটতো টিভি দেখে, গান শুনে আর সপ্তাহান্তে সমুদ্র সৈকতগুলো পরিভ্রমণ করে। তখনও পর্যন্ত সরকারীভাবে উনত্রিশটি সী-বীচ, যদিও গোনার বাইরে ছিলো বেশ কিছু কুমারী সৈকত। গোয়ান পরিবারগুলির সদস্যদের ছিলো আপাত সমস্যাহীন সহজ সরল জীবন আর জীবনের প্রতি এক ঢিলেঢালা দৃষ্টিভঙ্গি। অনেক পরিবারের সাথেই গভীর অন্তরঙ্গতা হয়েছিলো দীর্ঘদিন থাকার সূত্রে।
আমরা থাকতাম দোতলায়। সামনেই রাস্তা। আর তারপরেই এক কোঙ্কণী পরিবারের বাগানবাড়ি। ওরা শুরু করেছিলো প্রাচীন বাড়িটির সংস্কার কাজ। বাঁশের ভারা লাগিয়ে প্রচুর রাজমিস্ত্রির দল কাজে লেগেছিলো। ওখান থেকে আমাদের ফ্ল্যাটগুলো ছিলো দৃষ্টির সহজ পথে।
সেই সময় অডিও/ভিডিও সি.ডি.’র রমরমা বাজার। সোনির তিন সি.ডি. চেঞ্জারের একটা অডিও সিস্টেম কিনেছিলাম, সাথে ২০০০ ওয়াটের স্টিরিও স্পীকার। সন্ধ্যার পরে এবং সপ্তাহান্তে বেশ জানান দিয়েই বাজতো সেটা। এর কিছুদিন পরে দিল্লিতে কয়েকদিনের জন্য একাই যেতে হলো একটা কাজে। স্ত্রী-কন্যা অবকাশে রইলো দামনে, বন্ধুর বাড়িতে।
দিল্লির দ্বিতীয় দিনে মারগাঁও থেকে এক সহকর্মীর হঠাৎ ফোন, “আপনার ফ্ল্যাটে কাল রাতে কোলাপসিবল গেট এবং দরজার লক ভেঙে চুরি বা ডাকাতি হয়ে গেছে।”
আমি তখন এক মীটিংএর মাঝপথে। বললাম, “আপনি পুরো খবর নিয়ে নিন, পুলিশ কেস হলে দেখে নেবেন।”
রাতে জানালেন তার বিস্তৃত বিবরণী। সকালে অফিসের গাড়ি পিক করতে এসেছিলো, জানতো না আমি আউট অফ স্টেশন। আমি না আসাতে ওপরে গিয়ে দেখে ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা। প্রতিবেশীদের ডাকাডাকি করলে তারাই পুলিশ স্টেশনে খবর দেন। পুলিশ এসে সব চেক করে ফ্ল্যাট সীল করে দিয়ে গেছে। আর এফ.আই.আর. লজ করেছেন আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোক। বললাম, “ঠিক আছে। আমি দু’দিন পরে ফিরে এসে থানায় গিয়ে কথা বলবো।”
দিল্লি থেকে এসে সোজা দামনে। ওদের জানাই নি কিছু। শুধু বললাম, “আজ গিয়ে হয়তো হোটেলে থাকতে হবে।”
“সে কী, কেন?”
“চলোই না, গিয়েই সব জানতে পারবে।”
ভোরবেলা মারগাঁও স্টেশনে সহকর্মী ছিলেন রিসিভ করার জন্য। কাছে এসে বললেন,
“জানেন, আপনাদের ফ্ল্যাটে কাল আবার চুরি হয়ে গেছে।”
আমরা আকাশ থেকে পড়লাম।
“এই যে বলেছিলেন, পুলিশ এসে ফ্ল্যাট সীল করে দিয়ে গেছে !”
“দিয়েছিলো তো, কাল রাতে আবার সীল ভেঙে চোর ভেতরে ঢুকেছিলো।”
“তারপর ?”
“চোর ধরা পড়েছে।”
“খুলে বলুন।”
জানা গেলো, দু’দিন আগে প্রথম যখন এই ঘটনা ঘটেছিলো, তার পর থেকে রাতে পুলিশ প্যাট্রলিং চলছে রাতে প্রতি ঘন্টায়। আর পাড়ার লোকজনও মোটামুটি আধা ঘুম আধা জাগরণে রাত কাটাচ্ছিলেন।
আমাদের উলটো দিকের ফ্ল্যাটের পরিবারটি মাঝে মাঝেই দরজার লুকিং গ্লাস দিয়ে আমাদের দরজার দিকে নজর রাখছিলো। রাত তিনটে নাগাদ ভদ্রমহিলা দেখেন যে আমাদের ফ্ল্যাটের কোলাপসিবল গেট আধা খোলা, কাঠের দরজার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা পুলিশ প্যাট্রলকে ফোন করে দেন। পুলিশ টীম এসে পৌঁছয় আর সাথে আসে পুরো পাড়ার কর্তা-গিন্নী-ছেলে-মেয়েরা। সেই রাতে আমাদের বাড়িতে লোক, শুধু আমরাই উপস্থিত ছিলাম না।
এর পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। সবাই মিলে চোর খুঁজতে ব্যস্ত। একটাই তো দরজা ঢুকবার আর বেরোনোর। কোথাও চোরকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। ধীরে ধীরে সবাই চলে যেতে লাগলো। পুলিশও দরজায় তালা লাগানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্ত প্রতিবেশী মহিলা শেষ না দেখে কিছুতেই ছাড়বেন না। বারবার বলে যাচ্ছেন,
“আরে, আমরা কেউ তো চোরকে বেরিয়ে যেতে দেখি নি।”
“হ্যাঁ, কিন্ত সবাই মিলে তো খুঁজলাম।”
“তা হোক, আবার চলুন দেখি।”
“ঠিক আছে, চলুন। মনে তো হয় না, কাউকে পাওয়া যাবে বলে।”
আবার খোঁজ, খোঁজ আর খোঁজ। এবার সবাই মিলে বাথরুম, ব্যাল্কনি ঘুরে ঘুরে রান্নাঘরে। একবার তো খোঁজা হয়েই গেছে। হঠাৎ একজন বললেন, “আরে ওটা কালো মতো কি, সিঙ্কের পাশে।” দেখা গেলো, হ্যাঙ্গিং ইউটেনসিল স্ট্যান্ড আর সিঙ্কের মাঝে একফালি জায়গায় সরু মতো একটা লোক, কুচকুচে কালো, দেওয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে। তখন ভোর সাড়ে চারটা। পুলিশ চোরকে নিয়ে চলে গেলো বাড়ি লক করে, সাথে নিয়ে গেলো চোর যে সমস্ত জিনিস নানা ব্যাগের মধ্যে পুরেছিলো নিয়ে যাবে বলে, আর বলে গেলো গৃহস্বামীকে থানায় দেখা করতে।
ইতিমধ্যে লোকাল নিউজপেপারে বেরিয়ে গিয়েছে, “পশ্চিমবঙ্গের ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে দুঃসাহসিক ডাকাতি”।
এর পরের দৃশ্য অন্য রকম। আমরা হোটেলে ফ্রেশ হয়ে দুপুরবেলা চললাম পুলিশ স্টেশন। ইনচার্জ জানালেন, “আপনারা বাড়ি যান, চাবি দিয়ে দিচ্ছি। খুব ভালো করে সব জায়গা ভালোভাবে চেক করে একটা মিসিং আইটেম লিস্ট করুন। আমরাও একটা সীজার লিস্ট বানিয়েছি। আর হ্যাঁ, যিনি এফ.আই.আর. লজ করেছেন, তাকেই প্রাথমিকভাবে আদালতে উপস্থিত হতে হবে।”
দরজা খুলে দেখি, সব ছত্রাখান। বুকটা ছাঁত করে উঠলো। চুরি হয়ে যাওয়ার জন্য নয়, খালি মনে হতে লাগলো, কেউ আমাদের প্রাইভেসি ব্রীচ করেছে, অনধিকার প্রবেশ করেছে আমাদের একান্ত নিজস্বতার গণ্ডী ভেদ করে। কত অসহায় লাগছিলো সেই সময়।
তখন আমাদের ডেস্কটপ কম্পিউটার, তার সমস্ত অ্যাক্সেসরিস নিয়ে। দেখলাম, স্বস্থানেই আছে। টিভি টিভির জায়গাতেই। এরপর যার খোঁজ, সেই নতুন-কেনা সি.ডি. চেঞ্জারের আর দেখা নেই। শূন্য স্ট্যান্ড পড়ে আছে। আর আছে একদিকে যত্ন করে রাখা সমস্ত বাংলা সি.ডি.গুলো, ইংরেজি আর হিন্দিগুলো উধাও। সব স্যুটকেস হাট করে খোলা পরিধেয় পোশাক লন্ডভন্ড করে, আলমারিতে প্রহারের চিহ্ন। পরখ করে দেখা গেলো, আলমারির দরজার ওপরের দিক আর নীচের দিক দিয়ে অনেক চেষ্টা হয়েছে ভাঙার, কিন্ত এক বিখ্যাত কোম্পানির মজবুত স্টীল আলমারি তাদের সে সুযোগ দেয় নি। আর ছড়িয়ে আছে সব ঘর জুড়ে পোড়া খবরের কাগজের স্তূপ। আর এমার্জেন্সি ল্যাম্পটা ডিসচার্জড হয়ে পড়ে আছে। বোঝা গেলো, লাইট জ্বালতে চায়নি চোরের দল। উধাও হয়ে গেছে ঠাকুরের সিংহাসনে যত ধাতব মূর্তি ছিলো, এছাড়া আরও অনেক কিছু। কিন্তু এত কি ঠাহর করা যায়, রোজকার জীবনে কোথায় কি ছিলো আর কি নেই এখন।
পেলাম না একটা সোনালী রঙের ‘লাফিং বুদ্ধা’র স্ট্যাচু।
যাই হোক, একখানা লিস্ট বানিয়ে পুলিশের কাছে জমা দেওয়া হলো। ওরা জানালো, কেস ফাইল করছে। যথাসময়ে আদালতের ডাক পাওয়া যাবে। আর যাকে অ্যারেস্ট করেছে তার ইন্টারোগেশন চালু থাকবে।
এরপর জীবন চলতে থাকলো তার নিজের গতিতে। আমরাও ধীরে ধীরে শোক ভুলতে লাগলাম। এমন সময় একদিন প্রতিবেশী ভদ্রলোক বাড়িতে এলেন।
“আর বলবেন না, তিনদিন অফিস থেকে ছুটি নিতে হলো।”
“কি ব্যাপার? মানে আমাকে বলছেন …”
“কাকে আর বলবো … আপনার ফ্ল্যাটের চুরির কেস !”
“সে কি !”
“আপনি তো ছিলেন না, কমপ্লেন তো আমাকেই লজ করতে হয়েছিলো।”
“সে তো জানিই। কিন্ত ঘটনা তো আমার ঘরেই ঘটেছিলো !”
“আপনাকেও ডাকবে, তবে হয়তো সাক্ষী হিসেবে।”
“কিছু জানা গেলো, দু’দিন কি ভাবে চুরি হলো, পুলিশ সীল করার পরেও ?”
“সে এক লম্বা কাহিনী। প্রথম দিন যে গ্যাংটা এসেছিলো, তারা ছিলো কর্ণাটকের। ঐ যে রাজমিস্ত্রিরা কাজ করছিলো সামনের বাগানবাড়িতে, তারা আমাদের হাউজিংকে নজরে রাখতো, কে কখন আসে, কে কখন বাড়ি ফাঁকা রেখে যায়। তারাই সুযোগ বুঝে তালা ভেঙে ঢুকেছিলো, আলমারিটাকে কবজা করার চেষ্টাতেই রাত ভোর হয়ে যায়। যা জিনিস জড়ো করেছিলো, তাই নিয়ে চম্পট দেয়।
দ্বিতীয় দিনের নায়ক একটি কেরালাইট যুবক। পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দি অনুযায়ী সে নাকি ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য উপরে এসে খালি ফ্ল্যাট দেখে তালা ভেঙে ঢুকে পড়ে!!! যাই হোক, তার কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত স্বীকারোক্তি নিতে পেরেছে পুলিশ। অনেক জিনিস উদ্ধার করলেও আপনার সাউন্ড সিস্টেম খুঁজে পাওয়া যায় নি।
এবার বোধহয় আপনাকে ডাকবে ভেরিফিকেশনের জন্য।”
কয়েকদিন পর বাৎসরিক শীতের মেলা বসে গেলো মারগাঁওএ। স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছি, হঠাৎ দেখি সেই ভদ্রলোক যার কাছ থেকে আমরা লাফিং বুদ্ধা নিয়েছিলাম।
“কেমন আছেন? বছরে এই একবারই এক্সিবিশন স্টলে আপনাদের সাথে দেখা হয়।” “আমাদের শপ তো কারওয়ারে। গোকর্ণ বা মুর্ডেশ্বরে ঘুরতে এলে পথের মাঝে আমাদের ওখানে একবার পায়ের ধূলো দেবেন।”
“সে তো নিশ্চয়ই। আপনার মনে আছে, এই মেলাতেই আপনার কাছ থেকে লাফিং বুদ্ধা নিয়েছিলাম।”
“হ্যাঁ, অনেকগুলো দেখে সেরাটাই নিয়েছিলেন।”
“আপনি বলেছিলেন ঐ স্ট্যাচু চিরকাল আমাদের কাছে থেকে যাবে।”
“বলেছিলাম তো।”
“সেটি মাস তিনেক হলো আমাদের বাড়ি থেকে চুরি হয়ে গেছে।”
“সে কি! না, না – ঐ মূর্তি আপনাদের কাছে ফিরে আসবেই। আমি বলছি, মিলিয়ে নেবেন। আর আমাকে জানাবেন তখন।”
“দেখা যাক। আপনার কথায় বিশ্বাস রাখলাম।”
কোর্টের ডাক এলো সপ্তাহখানেকের মধ্যেই। সামনের মঙ্গলবার সকাল এগারোটায় চার নম্বর ঘরে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হতে হবে। সেই আমার প্রথম আদালত দর্শন এবং শেষও। গিয়ে দেখি, প্রচুর লোক বসে আছে। শুনলাম অনেকগুলো শুনানি পর পর আছে। একদম পেছনের বেঞ্চে দেখি লাইন দিয়ে বসে বেশ কিছু লোক রীতিমত খাওয়া-দাওয়া করছে আর হাহা-হিহি করছে। পেয়াদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এরা কারা?” বললো, “এরা রোজই আসে। নানারকম কেস দেখে এবং শোনে সারাদিন, তারপর চলে যায়। হয় কিছু শিখতে আসে, নয়তো টাইম পাস করতে আসে।”
এই সময় এক রাশভারি মহিলা আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করতে লাগলেন। কাছে গেলাম।
“আমি পাবলিক প্রসিকিউটর, পুলিশের হয়ে আমি এই কেসটা দেখছি। আপনি তো উইটনেস।”
“হ্যাঁ, আর চুরিটা আমার বাড়িতেই হয়েছে।”
“আপনার বাড়ি থেকে যা যা উদ্ধার হয়েছে সেগুলো আপনাকে আইডেনটিফাই করতে হবে।”
“আচ্ছা।”
“আপনাকে মনে করে বলতে হবে কি খোয়া গেছে আর তারপর সেটা চেক করতে হবে পুলিশের যে জিনিসগুলো কোর্টে প্রডিউস করবে, তার মধ্যে। চেকিং হয়ে গেলে সব চলে যাবে মারগাঁও পুলিশের মহাফেজখানায় যতদিন না মামলার নিষ্পত্তি হয়।”
“বুঝলাম।”
“আর ঐ যে বাচ্চা মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে কালো গাউন পরে, ও হচ্ছে ডিফেন্স ল-ইয়ার, মানে চোরের উকিল। উল্টো-সিধা প্রশ্ন করতে পারে আপনাকে। এবারে যান। মিস্টার নোরান্হা, মাননীয় জাজ এসে গেছেন।”
সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ালাম। দপ্তরী একটা বাইবেল নিয়ে এসে শপথ পাঠ করিয়ে গেলো।
কি করি, কোথায় থাকি, এই সব আলোচনার পর জাজ মশাই উল্টোদিকের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো কার্তিক ঠাকুরের মত সুন্দর, মিহি গোঁফওয়ালা, ধবধবে ফর্সা একটি তরুণ ছেলেকে দেখিয়ে বললেন, “একে চেনেন ?”
আমি তো অবাক।
“না তো ! কে এ?”
“এই তো আপনার চোর।”
হায় রে, এতদিন চোরের বর্ণনা শুনেছি কুচকুচে কালো, পাতলা মতো কেউ। এ যে একেবারে উলটপুরাণ।
“আমি কি করে চিনবো? আউট অফ স্টেশন ছিলাম আমি। দেখিই নি ওকে।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। ওর নাম জোভি জোস, কেরালার ছেলে। আপনাকে এবার জিনিসপত্রগুলো আইডেনটিফাই করতে হবে।”
একটা বিশাল ট্রান্সপারেন্ট বস্তা হাজির করলো একজন পুলিশের লোক। তাতে ডাঁই করা রয়েছে সব।
“বলুন, বলুন।”
“প্যানাসনিক কর্ডলেস ফোন।”
“আছে।”
“টাইটান রিস্টওয়াচ।”
“আছে।”
“সোনালী গণেশ মূর্তি, রূপালী শিব ঠাকুর।”
ঝাঁপিয়ে পড়লো ডিফেন্স ল-ইয়ার।
“হয় নি, হয় নি। রূপালী গণেশ মূর্তি, সোনালী শিব ঠাকুর। আপনার জিনিস নয় এ সব।”
“আরে, রঙ বলাটা একটু উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে।”
“আপনার জিনিস, অথচ আপনি ঠিক বলতে পারছেন না !”
নোরান্হা সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন,
“ডিফেন্স কাউন্সেল, ডোন্ট বি সিনিক।”
এইভাবে চলতে চলতে আমার মনে পড়লো, আরে, আসল জিনিস দুটোই বলা হয় নি।
“সোনি সি.ডি. প্লেয়ার।”
“নেই তো।”
“ওটাই তো আমার সবচেয়ে দরকার ছিলো! একদম নতুন, চালানোও হয় নি বেশি।”
“এগুলো তো দ্বিতীয় দিন চুরির সীজার লিস্ট। ওটা প্রথম দিন চলে গেছে তো, তাই এতে নেই।”
ভীষণ মনমরা হয়ে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘লাফিং বুদ্ধা’র সোনালী মূর্তি ?”
“আছে।”
জাজ বললেন, “আর চেক করার দরকার নেই। যে চারটে ব্যাগ আছে, ও গুলো ওনার কি না ভেরিফাই করিয়ে নাও।”
তাকিয়ে দেখি, আমাদের ব্যাগগুলোই জোভি জোস ব্যবহার করেছে আমাদেরই থেকে চুরি করা মাল নিয়ে পালানোর জন্য।
ঠিক এই মুহূর্তেই সেই বাচ্চা মেয়েটি আবার ঘটনার মধ্যে এলো।
“এই ব্যাগগুলো আপনার ?”
“হ্যাঁ।”
“ঐ নীল জীন্সের ব্যাগটা ?”
“হ্যাঁ তো।”
“বলুন তো, ব্যাগের যে হ্যান্ডেল স্ট্র্যাপ রয়েছে, তার লম্বা কত ?”
এইখানে পাঠক, আপনাকে ফিরে যেতে হবে গল্পের একদম শুরুতে।
সাক্ষ্যপর্ব ওখানেই শেষ। আমাকে বলা হলো রায় বেরিয়ে গেলে পুলিশ স্টেশনে যোগাযোগ করে জিনিসপত্র কালেক্ট করে নিতে।
জেনে আশ্বস্ত হলাম যে ‘লাফিং বুদ্ধা’ আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে।
তবে এখানেই গল্পের শেষ নয়।
দিন যায়। ইতিমধ্যে আমারও গোয়া বাসের দিন শেষ হয়ে আসছিলো। পরের ঠিকানা, দুবাই।
একদিন মারগাঁও থানায় গেলাম। ইনচার্জ বললেন, “আপনি জানেন না? আপনার হিয়ারিংএর পরের দিনই জাজ ট্রান্সফার হয়ে গেলেন অন্য কোর্টে আর পাবলিক প্রসিকিউটর তার কয়েকদিন বাদেই রিটায়ার করলেন। আপনি একবার নতুন পি.পি.র অফিসে দেখা করুন। আপনার মালপত্র এখানেই আছে।”
নতুন পি.পি. একজন জাঁদরেল লোক। নাক কুঁচকালেন।
“কি ব্যাপার?”
“জাস্টিস নোরান্হা-র আদালতে একটা চুরির কেস ছিলো …”
“জাস্টিস! নোরান্হা আবার জাস্টিস হলো কবে, অ্যাঁ?”
“না, মানে জাজ আর কি। এ সব তো জানি না আসলে …”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। জানি কেসটা। চোর তো তিন মাস জেল খেটে ছাড়া পেয়ে গেলো। আবার চুরি করতে বেরিয়ে পড়েছে হয়তো।”
“আমি কি করবো এখন? গোয়া থেকে ট্রান্সফার হয়ে যাবো সামনের মাসে।”
“সপ্তাহ খানেক পর থানার মহাফেজখানা থেকে জিনিসগুলো নিয়ে যাবেন।”
বিশাল বস্তাটা নিয়ে এলাম বাড়িতে। বেশির ভাগ জিনিসই এখন অপ্রয়োজনীয়। মিউজিক সিস্টেমটার জন্য দুর্বলতা ছিলো। থানার এক কনস্টেবল বললো, “দেখুন, কোনও বড়বাবুর বাড়িতে হয়তো শোভা পাচ্ছে।”
তবে ‘লাফিং বুদ্ধা’ ফিরে পেলাম।
গোয়া ছেড়েছি বছর কুড়ি হতে চললো। আজও সে ‘লাফিং বুদ্ধা’ আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই আছে।
Add comment