সাহিত্যিকা

জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ

জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ
সংকলক: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে বহু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। জীবনে বহু শোক-তাপও পেয়েছেন, কিন্তু কখনই আশাহত হন নি।। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর সাহিত্যে, তাঁর চিঠিপত্রে এবং তাঁর বিশাল কর্মকান্ডে। তাঁর জীবনের কয়েকটি ঘটনার কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরার ইচ্ছে আছে।

********

লেখকের আবেদন
রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ, আমেরিকার ও এশিয়ার অনেক প্রাচ্যবিদ্ পন্ডিতবর্গকে অতিথি-অধ্যাপক হিসাবে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের সেই বিদেশী অতিথি-অধ্যাপকদের সামান্য কিছু পরিচয় এখানে দেওয়া হল। অনেকেই হয়তো বাদ পড়েছেন। পাঠক তোমার কাছে যদি আরও কোনও পন্ডিতবর্গের (বিদেশী অতিথি-অধ্যাপক) খবর থাকে তো আমায় জানিও।

********

রবীন্দ্রসূত্রে শান্তিনিকেতনের বিদেশী অতিথি-অধ্যাপক
রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পর পরিচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, আর প্রয়োগের অন্যতম আদর্শ ক্ষেত্র হল বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: “বিশ্ববিদ্যলয়ে আমরা সকলে একত্রিত হয়ে সর্বসম্মত সত্যকে আবিষ্কারের কাজে লাগাতে পারি, সবাই মিলে আমাদের সাধারণ ঐতিহ্যকে পরস্পর বুঝতে পারি এবং উপলব্ধি করতে পারি এই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীরা যে রূপসৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন, বিজ্ঞানীরা ব্রম্ভান্ডের যে রহস্য আবিষ্কার করেছেন, দার্শনিকরা আমাদের অস্তিত্বের যে সমস্যার সমাধান করেছেন, সাধুসন্তরা তাঁদের জীবনের উপলব্ধ যে আধ্যাত্ত্বিক সত্য উদ্ভাবন করেছেন সেগুলি কোন [বিশেষ] জাতির জন্য নয়, সমগ্র মানৰ জাতির জন্য।…” আসলে এটি রবীন্দ্রনাথের লিখিত একটি ইংরেজি পুস্তিকার (An Appeal For An International University) বাংলা অনুবাদের অংশ। অনুবাদক হলেন অধ্যাপক অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়। এই পুস্তিকাটির Aims and Objects: ‘The university of Santiniketan tries to realise its harmony with the history and spirit of India itself, gathering together the different cultures of Asia, and along with it to accept the best culture that the West has produced in science, literature, philosophy and the arts.’

রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের মানুষ C. F. Andrews (১৮৭১-১৯৪০), কৃষিবিদ্ Leonard Knight Elmhirst (১৮৯৩-১৯৭৪), William. W. Pearson (১৮৮১-১৯২৩), Patrick Geddes [প্যাট্রিক গেডিস (১৮৫৪-১৯৩২)], Dr. Stanley Jones (১৮৮৪-১৯৭৩), A. Bakhman, Alain Daniélou [আলাঁ দানিয়েলু (১৯০৭-১৯৯৮)], সমাজ-সেবিকা Gretchen Green (? – ১৯৭১) অথবা কৃষিগবেষক Dr Bernard Bay – এঁদেরকে এই তালিকা থেকে বাদ রাখছি কারণ এঁরা সেই অর্থে ঠিক শান্তিনিকেতনের অতিথি অধ্যাপক নন। এঁরা রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন সফল করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক একজন দরদী কর্মী হিসাবে। একই কারণে আরও অনেক বিদেশী কর্মী আছেন যাঁদের এখানে রাখা গেল না।

ফের্না বেনোয়া [Fernand Benoit (১৮৯২-১৯৬৯)]
সুইস-ফরাসি অধ্যাপক বেনোয়া ১৯২১ সালের মে মাসে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে তাঁর ভারত ও ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে আগ্রহের কথা জানান। রবীন্দ্রনাথ তখন ইউরোপে। বেনোয়া জানান যে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য ও দর্শন পড়েছেন এবং তিনি সুইৎজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, রুমানিয়া ও তুরস্কে শিক্ষকতাও করেছেন। তখন তাঁর বয়স ৩৫ বছর। তাঁর ইচ্ছা যে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেকে যুক্ত করবেন। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে বেনোয়াকে জ্যুরিখে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন এবং দেখা হলে তিনি বেনোয়াকে শান্তিনিকেতনে আসার আমন্ত্রণ জানান। ১৯২২-এর জুলাই মাস থেকে বেনোয়া শান্তিনিকেতনের স্থায়ী অধ্যাপক পদে যোগ দিয়ে ফরাসি ভাষা শিক্ষার কাজ নেন। বেনোয়া ১৯২৭-এ শান্তিনিকেতন ছেড়ে যান। সাময়িকভাবে হলেও শান্তিনিকেতনে ফরাসি ভাষাচর্চা তখন বন্ধ হওয়ার মুখে পড়েছিল।

সিলভ্যাঁ লেভি [Sylvain Levi (১৮৬৩-১৯৩৫)]
শান্তিনিকেতনে আসেন ১০ নভেম্বর ১৯২১-এ এবং শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেন পরের বছর ১০ আগস্ট। প্রথম বিদেশি অতিথি অধ্যাপক হিসাবে সস্ত্রীক আসেন অধ্যাপক সিলভ্যাঁ লেভি। অধ্যাপক লেভি এখানে তিব্বতি ও চিনা ভাষা শেখাতে শুরু করেন এবং মাদাম লেভি প্রথম থেকেই রোজ ফরাসি ভাষার সর্বোচ্চ শ্রেণিতে ক্লাস নিতে থাকেন। মুজতবা আলী বলেছেন: “ভারতীয় সংস্কৃতির সর্ববিষয়ে লেভির অসাধারণ পান্ডিত্য ছিল তো বটেই; তদুপরি বৌদ্ধধর্মে বোধহয় তখনকার দিনে [১৯২১] পশ্চিমে এমন কেউ ছিলেন না যিনি তাঁর সামনে সাহস করে দাঁড়াতে পারতেন।

মোরিৎস ভিন্টারনিৎস [Moritz Winternitz (১৮৬৩-১৯৩৭)]
প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব মোরিৎস ভিন্টারনিৎস-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয় ১৯২১ সালে প্রাগ শহরে। সেখানেই কবি তাঁকে বিশ্বভারতীর অতিথি অধ্যাপক হিসাবে আমন্ত্রণ জানান। ১৯২২-২৩-এ নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীতে তিনি প্রায় এক বছর পড়ান। ভিন্টারনিৎস শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯২২-এর ডিসেম্বর মাসে। শান্তিনিকেতনে এসে তিনি ছাত্রদের সামনে হাতে লেখা পুঁথি নিয়ে সংস্কৃত গদ্যাংশ খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়াতেন, ব্যাকরণ থেকে আরম্ভ করে অলংকারের কঠিন কঠিন বিষয়ও তারই সঙ্গে পড়ানো হত। আর আশ্রমের সকলের সামনে বক্তৃতা দিতেন ভারতীয় সাহিত্য ও মহাভারতের উপর। পুণা থেকে তখন তাঁর জার্মান ভাষায় লেখা ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস (Geschichte der Indischen Literatur) -এর ইংরেজি অনুবাদ শান্তিনিকেতনে কিস্তিতে কিস্তিতে আসছিল। তিনি সেগুলি থেকেও শ্রেণীকক্ষে পাঠ করতেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের সূত্র ধরে তাঁর জগৎ ও মনন সম্পর্কে অবহিত হয়ে ভিন্টারনিৎস তাঁর সম্পর্কে অনেকগুলি রচনা প্রাগ-এর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখেন। জার্মান ভাষায় তাঁর লেখা রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ও জীবনবীক্ষা (জার্মান নাম Rabindranath Tagore : Religion und Weltanschauung des Dichters) একটি পৃথিবী বিখ্যাত বই। মুজতবা আলী এই বইটির প্রভূত প্রশংসা করে বলেন :”আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শ, তাঁর ধর্ম, তাঁর সাধনা সম্বন্ধে আমি যে-সব পুস্তক পড়েছি তার মধ্যে আমি পন্ডিত, সাধক, দ্রষ্টা অধ্যাপক মরিৎস উইন্টারনিৎসের এই অতি ক্ষুদ্র পুস্তকখানিকে নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চ আসন দিই।” বইটির বাংলা অনুবাদ করেন দেবব্রত চক্রবর্তী (‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : কবির ধর্ম ও বিশ্ববীক্ষা’, পৃ-৮৮, বিশ্বহৃদয় পারাবারে – মোরিৎস ভিন্টারনিৎস, প্রকাশক – সিগনেট প্রেস, কলকাতা) ইংরেজি অনুবাদ Rabindranath Tagore : The Poet’s Religion and World Vision, প্রকাশক : Winternitz Society for Literature and Culture, Kolkata)|

ভিনসেন্স লেসনি [Dr. Vincenc Lesney (১৮৮২-১৯৫৩)]
ইনি ছিলেন বিখ্যাত ভারতত্ববিদ্। লেসনি ছিলেন চেক বিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক। চেক ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথকে নতুন রাষ্ট্র চেকোশ্লোভাকিয়াতে (এই রাষ্ট্রের জন্ম ১৯১৮) আসার আমন্ত্রণ জানান। রবীন্দ্রনাথ তা গ্রহণ করেছিনেল। রবীন্দ্রনাথ চেক বিশ্ববিদ্যালয়ে “The Message of the Forest” প্রবন্ধটি পাঠ করেন (১৮ই জুন, ১৯২২, সকাল এগারোটায়)। রবীন্দ্রনাথ তখন ভিনসেন্স লেসনিকে বিশ্বভারতীর অতিথি অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিতে আহ্বান করেন। তিনি শান্তিনিকেতনর আশ্রমে এক বছর ছিলেন (১৯২২ – ২৩) এবং ছাত্রদের গ্রিক ভাষা ও শব্দতত্ত্ব সম্বন্ধে শিক্ষাদান করেন। তাঁর অমায়িক চরিত্রে, নিষ্ঠায় এবং পান্ডিত্যে আশ্রমবাসী সকলেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি যতদিন শান্তিনিকেতনে ছিলেন একটু একটু করে বাংলা ভাষাও শিখে নেন। লেসনি গুরুদেবের ‘লিপিকা’ থেকে ‘তোতাকাহিনী’ চেক ভাষায় অনুবাদ করেন। নন্দলাল বসু লেসনি সম্বন্ধে বলেছেন: “ইনি এলেন প্রাগ থেকে। লম্বা চওড়া চেহারা, মাথায় প্রকান্ড একটি টাক। ইনিও বাংলা শিখে নিলেন অল্পদিনে।শিখে নিয়ে গুরুদেবের কবিতা, নাটক অনুবাদ করতে লাগলেন। অনুবাদ করলেন চেক ভাষায়।“

বিশ্বভারতীর একটি বিশেষ অধিবেশনে (এপ্রিল ১৯২৩) লেসনি ‘Sanskrit and Slavonic Languages’ বিষয়ে বক্তৃতা দেন। প্রথমে তিনি চেক ও অন্যান্য শ্লাভীয় ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার সম্বন্ধ উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি চেকোশ্লোভাকিয়ায় সংস্কৃত ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের চর্চা কিভাবে আরম্ভ হয় তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন। অবশেষে তিনি চেকোশ্লোভাকিয়া রাজ্য ও তার শাসনপ্রণালী সম্বন্ধে কিছু বলে তাঁর ভাষণ সমাপ্ত করলেন।

কার্লো ফর্মিকি [Carlo Formichi (১৮৭১-১৯৪৩)]
১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথের নিমন্ত্রণে ফর্মিকি শান্তিনিকেতনে আসেন। মুজতবা আলী বলেছেন : “অধ্যাপক ফর্মিকির নাম এদেশে সুপরিচিত নয়, কিন্তু ইতালির পন্ডিত মাত্রই জানেন, সে দেশে সংস্কৃত-চর্চার পত্তন ও প্রসারের জন্য তাঁর কত অবদান। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি তাঁর ছিল অবিচল অনুরাগ এবং গভীর নিষ্ঠা। অধ্যাপক তুচ্চি তাঁর অন্যতম সার্থক শিষ্য। অধ্যাপক ফর্মিকি শান্তিনিকেতনে সংস্কৃত পড়াবার সুযোগ পেয়ে বড় আনন্দিত হয়েছিলেন। একদিন তিনি আমাকে বলেন’ ‘জানো’, সমস্ত জীবনটা কাটল ছাত্রদের সংস্কৃত ধাতুরূপ আর শব্দরূপ শিখিয়ে। রসিয়ে রসিয়ে কাব্যনাট্য পড়ানো আরম্ভ করার পূর্বেই তাদের কোর্স শেষ হয়ে যায়-তারা তখন স্বাধীনভাবে সংস্কৃত-চর্চা আরম্ভ করে দেয়। জীবনে এই প্রথম শান্তিনিকেতনে সুযোগ পেলুম পরিণত-জ্ঞান ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাব্যনাট্য পড়ার। ব্যাকরণ পড়াতে হচ্ছে না, এটা কি কম আরামের কথা।” অধ্যাপক ফর্মিকি ১৯২৬-এ ইতালি ফিরে যান।

জিয়োসেপ্পে তুচ্চি [Giuseppe Tucci (১৮৯৫-১৯৮৪)]
ভারত-তিব্বত-চীনের ইতিহাস এবং বিশেষ করে বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি, বিকাশ এবং দেশদেশান্তরে তার প্রসার সম্বন্ধে ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান। মুজতবা আলী বলেছেন:”বিশেষ করে মহাযান বৌদ্ধধর্মের যে সব শাস্ত্র সংস্কৃতে লোপ পেয়ে গিয়েছে কিন্তু তিব্বতী এবং চীনা অনুবাদে পাওয়া যায়, সেগুলো থেকে তিনি নানাপ্রকার তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ করে বৌদ্ধধর্মের যে ইতিহাস নির্মাণ করেছেন, সে ইতিহাস ভারতের গৌরব বর্ধন করেছে”। রবীন্দ্রনাথ নিমন্ত্রণ করে ইতালি থেকে অধ্যাপক ফর্মিকি ও তুচ্চিকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। ১৯২৫ সালে এঁরা দুজনই ভারতবর্ষে আসেন। আচার্য তুচ্চি পড়াতেন ইতালিয়ান সাহিত্য।

মিস স্টেলা ক্রামরিশ [Dr. Miss Stella Kramrish (১৮৯৫-১৯৯৩)]
বিশিষ্ট অস্ট্রিয়ান শিল্পবিশেষজ্ঞার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় হয় [১৯২০] অক্সফোর্ডে। স্টেলা এসেছিলেন অক্সফোর্ডে ভারতীয় শিল্পের উপরে বক্তৃতা দিতে। বক্তৃতার শেষে রবীন্দ্রনাথ স্টেলার সাথে আলাপ করেন এবং তাঁকে কলাভবনে যোগ দিতে আহ্বান করেন। সেই সময়ে ইংল্যান্ডের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক থাকার ফলে অস্ট্রিয়ান স্টেলা ক্রামরিশ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুপারিশে ভারতে আসার অনুমতি পেয়েছিলেন। তিনি আশ্রমে আর্ট-সমালোচক রূপে যোগ দেন। বিশ্বভারতীতে তিনি জার্মান ভাষাও শিক্ষা দিয়েছেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমের ছোট ছোট বালিকাদের মিউজিক্যাল ড্রিলও তিনি শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া স্টেলা ক্রামরিশ শিল্পকলা সম্বন্ধে ধারাবাহিক বক্তৃতা দিয়েছেন। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আরম্ভ মিশর, এসেরিয়া, গ্রিস ও ইতালির শিল্পকলার বিষয়ে পর্য্যন্ত বক্তৃতা দেন। ক্রমে তিনি মধ্যে এশিয়া, চীন, জাপান ও ভারতবর্ষের শিল্পকলা সম্বন্ধেও বলেন।

মিস শ্লোমিথ ফ্লাউম – Miss Schlomith Flaum (১৮৯৩-১৯৬৩)
ইনি একজন শিক্ষিকা যিনি প্যালেস্টাইন থেকে আসেন(১৯২৩ সালে)| ইনি ইউরোপের প্রায় সব ভাষা ভালরূপে জানতেন এবং Hebrew ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বহুদিন চর্চা করেছেন। ইনি রোমে গিয়ে আধুনিক Montessori method শিক্ষা করে সেখানকার ডিগ্রী পান এবং পরে আমেরিকার কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে General pedagogies – সাধারণ শিক্ষাপ্রণালী বিষয়ে কিছুকাল অধ্যয়ন করেন। আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের সাথে এনার সাক্ষাৎ হয় এবং তখনই শান্তিনিকেতনের আদর্শে তিনি আকৃষ্ট হন। গুরুদেবের অনুরোধে তিনি শান্তিনিকেতনে আসেন এবং দু’বছর থেকে আধুনিক কিন্ডারগার্টেন প্রণালীতে ছোট ছেলেমেয়েদের শেখাবার ভার নেন এবং বিশ্বভারতীর ছাত্রদের জার্মান ভাষা শিক্ষায় সহায়তা করেন। ইনি বাংলা শিখে গুরুদেবের কিছু কিছু বই হিব্রুতে অনুবাদ করেন। তিনি প্যালেস্টাইনে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার আদর্শে ছোটদের জন্য একটি স্কুল খোলেন।

আঁদ্রে কাৰ্পেলে [Andrée Karpélès (১৮৮৫-১৯৫৬)]
আঁদ্রে কাৰ্পেলে ছিলেন একজন ফরাসি চিত্রশিল্পী। আঁদ্রে খুব বেশিদিন শান্তিনিকেতনে ছিলেন না। ১৯২২-এর ডিসেম্বরে তিনি আসেন, আর ফ্রান্সে ফিরে যান পরের বছর এপ্রিল মাসে। তিনি শান্তিনিকেতনে আসার আগেই শান্তিনিকেতন পত্রিকায় লেখা হয় : “প্যারী সহর হইতে Melle Andrée Karpélès নামে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পূজার ছুটির পরে এখানে আসিয়া বিশ্বভারতীর কলাবিভাগের কার্যে যোগদান করিবেন। ইনি পূর্বে আরো কয়েকবার ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন। ইনি কলাভবনে স্বহস্তে অঙ্কিত গুরুদেবের একটি তৈলচিত্র উপহার দিয়েছেন।” (শান্তিনিকেতন, ভাদ্র-আশ্বিন সংখ্যা, ১৩২৯)।
পাঁচ মাসও তিনি শান্তিনিকেতনে থাকার সুযোগ পাননি। কিন্তু এই স্বল্পবাসে শান্তিনিকেতনের জীবনে একটা ছাপ রেখে যেতে পেরেছিলেন। কলাভবনের ‘বিচিত্রা’ কারুসংঘ প্রতিমা দেবী ও তাঁর উদ্যোগেই স্থাপিত হয়েছিল। আঁদ্রের কাছে ছাত্রছাত্রীদের পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে অয়েল পেন্টিং শেখার সুযোগ ঘটে। আঁদ্রে ছিলেন কাঠখোদাই, এনগ্রেভিং-এর কাজে দক্ষ। ‘বিচিত্রা’-র ছাত্রছাত্রীদের তিনি উডকাট ও অয়েল পেন্টিং শেখাতেন।
যদিও আঁদ্রের ইচ্ছে ছিল দ্বিতীয়বার শান্তিনিকেতনে ফিরে আসার কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা সম্ভব হয় নি। তাঁর বিদায় অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে “ভরা থাক্‌ স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।“ গানটি গাওয়া হয়েছিল। গানটি কবিগুরু আঁদ্রের বিদায় অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন।

স্টেন কোনো [Sten Konow (১৮৬৭-১৯৪৮)]
স্টেন কোনো ছিলেন একজন বিখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ ভারতবিদ্। নরওয়ের অসলো শহরের ক্রিস্টিয়ানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভারতীয় দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন (১৯১০)। পরবর্তীকালে (১৯১৪) হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি পড়াতেন। নরওয়ের এই সুইডিশ ভারতবিদকে রবীন্দ্রনাথ অল্পই চিনতেন। রবীন্দ্রনাথের আবেদনে স্টেন কোনো শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন (১৯২৪-২৫)। তিনি হলেন শান্তিনিকেতনের তৃতীয় বিদেশী অতিথি অধ্যাপক। এর আগে সিলভ্যাঁ লেভি ও মোরিৎস ভিন্টারনিৎস শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। অনেক আগে (১৯২১-২২) রবীন্দ্রনাথকে তাঁর দেশে নিয়ে যাওয়ার খুবই ইচ্ছে ছিল স্টেন কোনোর। রবীন্দ্রনাথও নরওয়ের সাহিত্য চর্চায় বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। স্টেন কোনোর আহ্বানের প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লেখেন : “Nothing could be given me keener pleasure than to be able to visit Norway and come in touch with your people, who have deeply attracted me with their great literature.”
স্টেন কোনোর পান্ডিত্যের কথা রবীন্দ্রনাথের অজ্ঞাত ছিল না। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নরওয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং সেই প্রতিশ্রুতি ১৯২৬-র ইউরোপ সফরে তিনি রক্ষা করেন।

মার্ক কলিন্স [Dr. Mark Collins (১৮৬৬-১৯৩?)]
ভারতবিদ্ মার্ক কলিন্স ছিলেন ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের সংস্কৃত ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক (১৯০৮-১৯১৪). পরবর্তীকালে তিনি ভারতে এসে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন এবং ১৯১৯ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে তিনি শান্তিনিকেতনে এসে যোগদেন ১৯২২ সালে। শান্তিনিকেতনে তিনি ভাষাতত্ত্বের অতিথি অধ্যাপক হিসাবে ছিলেন ১৯৩১ পর্যন্ত। প্রায় চল্লিশটি ভাষায় তিনি অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। শান্তিনিকেতনের টাটা ভবনের ধুলো, মাকড়সার জাল, ও ইঁদুর ভর্তি দু’কামরার ছোট নিবাসে দিনরাত অধ্যয়ন রত থাকতেন। খুব কম লোকের সঙ্গে মেলামেশা ও কথাবার্তা ছিল তাঁর। পরবর্তীকালে জানা যায় এই আবরণের পিছনে একটি দুঃখজনক ঘটনা ছিল। নিজের উচ্ছূঙ্খল পত্নীর থেকে অব্যহতি পাওয়ার জন্য শান্তিনিকেতনে লুকিয়ে ছিলেন। একদিন হটাৎ তাঁর পত্নী শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হলে সবকিছু পরিত্যাগ করে চুপচাপ তিনি একলা কোথাও চলে যান।

বগদানফ্ [L. Bogdanov]
১৯২৩-এ বিশ্বভারতীতে যোগ দিলেন রুশীয় অধ্যাপক বগদানফ্। তিনি সেন্ট পিটাসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষা দিতেন। এই দুটি ভাষা আয়ত্ত করার জন্য তিনি বহুকাল তুরস্ক ও পারস্য দেশে ছিলেন। রাশিয়ায় সোভিয়েত শাসন প্রবর্তিত হওয়ায় জারতন্ত্রী যে-সব রুশীয় পন্ডিতকে দেশত্যাগ করতে হয় তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এর ফলে বহুদিন তাঁকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর দুঃখের কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিশ্বভারতীতে নিয়োগ করেন। তাঁর আগমনে এখানে ফারসি ভাষা চর্চার সূত্রপাত হয়। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলি, মৌলানা জিয়াউদ্দিন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পার্সিয়ান কাব্য ও সুফীবাদ নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। ১৯৩০-তে তাঁকে বিদায় দেওয়া হলে তিনি কাবুলে চলে যান।

পল রিশার [Paul Antoine Richard (1874 – 1967)]
শান্তিনিকেতনের শুরুর আমলে ফরাসি ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পান মরিস ভাই। পুরো নাম হিরজিভাই পোস্তোনজি মরিসওয়ালা। কিন্তু যখনই কোনো ফরাসিভাষী মানুষ শান্তিনিকেতনে এসেছেন, তাঁকেই ফরাসি শেখানোর কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে। যেমন ছিলেন পল রিশার। জাপানে পিয়ারসনের সঙ্গে আলাপের সূত্রে কবির সঙ্গে পল রিশারের যোগাযোগ। তাঁর লেখা ‘To the Nations’ গ্রন্থের ভূমিকা পিয়ারসনের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ লিখে দিয়েছিলেন। ফরাসি এই চিন্তাশীল ব্যক্তি ১৯২১-এর জানুয়ারিতে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। তাঁর পত্নী মিরা রিশার (Mirra Alfassa) শ্রীঅরবিন্দের আশ্রম স্থাপনে উদ্যোগী হন ও সেখানেই আজীবন সাধনা করেন।পরে তিনি ‘মাদার’ (The Mother or La Mère) নামে পরিচিত হন। পল রিশার শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন (পাঁচ সপ্তাহ) ফরাসি ভাষার ক্লাস নেন এবং ছাত্ররা খুবই উপকৃত হয়। মরিস ভাই এই সুযোগে তাঁর কাছ থেকে ফরাসি ভাষার কথোপকথনের পাঠ গ্রহণ করেন।
এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে চার্লস এন্ড্রুজের প্রাক্তন ছাত্র নসিরুল্লা ও তাঁর ফরাসি স্ত্রী (নাম ?) আশ্রমে আসেন। নসিরুল্লা উর্দুভাষার পাঠ দিতেন ও তাঁর স্ত্রী পড়াতেন ফরাসি ভাষা। এছাড়া ফরাসি প্রফেসর শ্রীমতি এমি হিস্যাযার (Aimee Hissaire) শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ১৯২৯ সালে। তিনিও বোধহয় শান্তিনিকেতনে ফরাসি ভাষা শিক্ষা দিতেন।

সানো জিন্নোসুকে (Sano Jinnosuke)
১৯০৫ সালে জিজুৎসু শিক্ষা ও জাপানি ভাষা শিক্ষাদানের জন্য তিনি শান্তিনিকেতনে আসেন। এবং ছিলেন তিন বছর। এখানে কিছু পূর্বকথা বলা দরকার। জানুয়ারি, ১৯০২-এ বিখ্যাত জাপানী শিল্পশাস্ত্রী কাউন্ট ওকাকুরা কাকুজো (Okakura Kakuzo (১৮৬২-১৯১৩)] কলকাতায় আসেন স্বামী বিবেকানন্দকে জাপানের একটি ধর্মসভায় নিয়ে যাওয়ার ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়ে। স্বামীজীর জাপান যাওয়া হয়নি এবং সাত মাস পরেই (৪ঠা জুলাই, ১৯০২) তাঁর মৃত্যু হয়। তবে ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় রম্যাঁ রলাঁকে বলেন, “বিবেকানন্দ তাঁকে [ওকাকুরাকে] বলেছিলেন, ‘এখানে আমার সঙ্গে আপনার কিছুই করণীয় নেই। এখানে তো সর্বস্ব ত্যাগ। রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে যান। তিনি এখনো জীবনের মধ্যে আছেন।“
কিন্তু ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের কাছে যতটা গিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের অনেকে তাঁর দিকে এগিয়েছিলেন অনেক বেশি। অবনীন্দ্রনাথ ও গগেন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয়ের পর ওকাকুরা দেশে ফিরে টাইকান য়োকোয়ামা [Taikan Yokoyama (১৮৬৮-১৯৫৮)] ও হিসিদা সুনসো [Hisida Sunso] নামে দু’জন শিল্পীকে জোড়াসাঁকোতে পাঠিয়ে দেন – নব্য বাংলার চিত্রকলায় এই দুই শিল্পীর প্রভাব যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের জন্য তিনি কুসুমতো সান (Kusumoto-san) ও কোনো সান (Kōno-san) নামে দু’জন দারুশিল্পী ও জুজুৎসু শিক্ষার জন্য সানো জিন্নোসুকে পাঠিয়ে দেন।

শিনজো তাকাগাকি – Shinzo Takagaki (1893–1977)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানে জুজুৎসু ও জুডো পদ্ধতির সাহায্যে খালি হাতে লড়াইয়ের প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। অস্ত্র আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ ভারতবাসীর হাতে সামান্য একটি লাঠি রাখাও তখন নিষিদ্ধ ছিল। রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, জুজুৎসু ভারতবাসীর অস্ত্রের অভাব ঘোচাতে পারবে। জাপানে তিনি ব্যবস্থা করে এসেছিলেন, সেই অনুযায়ী জাপানের সুবিখ্যাত জুজুৎসু শিক্ষক তাকাগাকি শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯২৯ সালের নভেম্বর মাসে। ছাত্র ছাত্রীদের জুজুৎসু শেখানোর উদ্দেশ্যে। এঁর জন্য দু’বছর প্রায় চোদ্দ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ – টাকার অঙ্ক থেকে আন্দাজ করা যায় তাঁর উৎসাহের পরিমান। কিন্তু কোনো স্থায়ী কাজ হয় নি। দুর্ভাগ্যের যে তিনি ছাত্রছাত্রীদের জুজুৎসু শিক্ষায় উৎসাহিত করতে পারেননি। এমনকি কলকাতার নিউ এম্পায়ার মঞ্চে জুজুৎসুর প্রদর্শনী করেছিলেন তাকাগাকি ও শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ একটি গান বাঁধলেন: “সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।..”
দু’বছর পরে তাকাগাকি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় জুজুৎসু শিক্ষার পাঠ উঠে যায়। তাকাগাকি এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে জুজুৎসু শিক্ষা দেন।

তান-ইউন-শান [(Tan Yun-Shan (১৮৯৮-১৯৮৩)]
তান-ইউন-শান শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯২৮-এ এবং বিশ্বভারতীর চীনা-সংস্কৃতির (Sinology) অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। মাত্র পাঁচ জন ছাত্র নিয়ে তিনি চীনা ভাষা শিক্ষাদান শুরু করেন। তিনি নিজেও সংস্কৃত শিখতে শুরু করেন। একাধারে শিক্ষক ও ছাত্র। শান্তিনিকেতনের শিক্ষকমন্ডলীর সঙ্গে তাঁর সাংস্কৃতিক আলোচনা ও ভাবের আদান প্রদান প্রায়শই চলতো। তিনি নিজে চীনা সংস্কৃতির একজন বিশিষ্ট পন্ডিত ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই শান্তিনিকেতনে গড়ে ওঠে এশিয়ার প্রাচীনতম চীনা ভবন। তিনি সারা জীবন চীনা-ভারত (Sino-Indian) সংস্কৃতি ও বন্ধুত্বের সুদৃঢ় বন্ধন তৈরী করতে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

জ্যুলা গ্যারমানুশ – Gyula or Julius Germanus (১৮৮৪-১৯৭৯)
প্রাচ্যবিদ, ইসলাম ধর্ম এবং দর্শনের সুবিখ্যাত হাঙ্গেরিয়ান পন্ডিত। জন্ম ও শিক্ষা বুদাপেস্টে। হাঙ্গেরিয়ান ভাষা ছাড়া আরবি, তুর্কি আর উর্দু ভাষায় দক্ষ। বুদাপেস্ট ইউনিভার্সিটিতে তুর্কি ও আরবি ভাষা এবং সাহিত্যের অধ্যাপক। ১৯২৯ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৩২-এর মার্চ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে ইসলাম ধর্ম-দর্শন এবং সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯২৬ সালে তৎকালীন হাঙ্গেরিয়ান পেন ক্লাবের সেক্রেটারি জুলিয়াস গ্যারমানুশ (জ্যুলা) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে এক সাক্ষাৎকার হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন ব্যালাটোন ফুরেদ (ব্যালাটোন লেক)-এর বিশ্ববিখ্যাত হার্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁদের এই ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের সময় রবীন্দ্রনাথ জ্যুলা গ্যারমানুশকে শান্তিনিকেতনে আসার আমন্ত্রণ জানান। জ্যুলা গ্যারমানুশ জীবনের শেষ পর্যায়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

পিয়েত্রো গুয়াডাগনি
ইতালীয় ভাষার প্রফেসর। সুবক্তা, সাহসী ব্যক্তিত্ব। গোঁড়া রাষ্ট্রবাদী এবং মুসোলিনির একনিষ্ঠ সমর্থক, এমনকি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্ক করার সাহস রাখতেন। অধ্যাপক সমাজে জনপ্রিয় ছিলেন। নীতিগত মতভেদের কারণে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যান (১৯২৯)।

রেভারেন্ড লিন্ডসে
শান্তিনিকেতনের ইংরেজির প্রফেসর – গাঁধীবাদী, আমেরিকান মেথডিস্ট চার্চের মিশনারি ছিলেন। ওই সময় (১৯২৯-৩০)। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে থাকতেন। ভারতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং গাঁধীজির সহযোগীও ছিলেন।

আলেক্স আরোনসন – Alex Aronson (১৯১২ — ১৯৯৫)
আলেক্স ছিলেন একজন জার্মান লেখক ও শিক্ষক। হিটলারের ইহুদি-নিধন যজ্ঞ থেকে রক্ষা পেতে তিনি ১৯৩৭ সালে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। বিশ্বভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের তিনি ইংরাজি পড়াতেন। এছাড়া বিশ্বভারতীর বিভিন্ন পত্র পত্রিকা প্রকাশনায় সাহায্য করেছেন। লেখক হিসাবেও তিনি যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর লেখা একটি বই (Rabindranath Through Western Eyes) বেশ বিখ্যাত হয়। বইটি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যর পর প্রকাশিত হয় (১৯৪৩)। ২০০০ সালে বিশ্বভারতীর প্রকাশনায় Dear Mr. Tagore, (95 Letters Written to Rabindranath Tagore from Europe and America)) আলেক্স আরোনসনের অনেক অবদান আছে।

শ্রীধর্মাধার রাজগুরু মহাস্থবির
রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে সিংহল (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) থেকে শ্রীধর্মাধার রাজগুরু শান্তিনিকেতনে আসেন। তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র ও বৌদ্ধদর্শন শিক্ষাদান ও গবেষণা করেন। বিশ্বভারতীর শুরুর কালে (১৯২০) বিধুশেখর শাস্ত্রী ও শ্রীধর্মাধার রাজগুরু পালি, অ্যান্ড্রুজ ইংরেজি এবং নন্দলাল ও সুরেন্দ্রনাথ কর চিত্রকলা শিক্ষা দেবেন বলে ঠিক হয়। ১৯২০ সালের ২রা মে শ্রীধর্মাধার রাজগুরু হিন্দি ভাষায় বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে একটি বক্তৃতা দেন। তাঁর অধীনে মহাযান বৌদ্ধপূরণের অনুশীলনের মাধ্যমে ভারত-ইতিহাসের একটি অচর্চিত অধ্যায় সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের আহ্বান করেন।

মর্গ্যানস্টিয়ের্নে [Georg Morgenstierne (1892 – 1978)]
মর্গ্যানস্টিয়ের্নের নাম আমরা মুজতবা আলীর লেখাতে (‘রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সহকর্মিদ্বয়’ – বড়বাবু) পাই। ইনি নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের প্রফেসর ছিলেন। তাঁর ভাষা বিষয়ক গবেষণার কাজে তিনি আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান ও ভারতবর্ষে আসেন। ১৯২৩-এ (?) মর্গ্যানস্টিয়ের্নে শান্তিনিকেতন আসেন এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বহু ঘন্টা, বহু দিনব্যাপী ভারতীয় তথা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সন্বন্ধে আলোচনা করেন। তিনিও বোধহয় (?) শান্তিনিকেতনে ভাষাতত্ত্বের ক্লাস নিয়েছেন।

গেরট্রড রুডিগ্যার
এক জার্মান তরুণী, জার্মান বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও পর্বতরোহী। ১৯২৯ সালের গ্রীষ্মে শান্তিনিকেতনে আসেন। তিনি কিছুদিন ছাত্রছাত্রীদের জার্মান ভাষা শিক্ষা দেন। শান্তিনিকেতনের ছাত্রীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। ডাঃ টিম্বার্সের হাসপাতালে (শান্তিনিকেতনে) কাজ করতেন। তাঁর চরিত্র জার্মান অনুশাসন, যুক্তির দৃঢ়তা আর শারীরিক ক্ষমতার প্রতিরূপ ছিল।

মিস ক্রিস্তিন বসনেক
মিস ক্রিস্তিন বসনেক ছিলেন ফরাসি স্কুল শিক্ষিকা। তিনি ১৯৩৫ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্বভারতীর ছাত্রীনিবাস শ্রীভবনে প্রনেত্রী রূপে যোগ দেন। আল্যাঁ দানিয়েলু ও বেনোয়ার সূত্রেই তিনি শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। সেই অর্থে তিনি রবীন্দ্রসূত্রে না হলেও তিনি রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের খুব প্রিয় ছিলেন। তাঁকে প্রায় পাঁচ বছর ফরাসি ক্লাসে শিক্ষিকা হিসেবে পাওয়া যায়। তিনি ১৯৪০-এ বিশ্বভারতী ত্যাগ করেন। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি রবীন্দ্র-রচনা ফরাসিতে অনুবাদের কাজে মন দিয়েছিলেন।

** তথ্য সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১. রবিজীবনী (পঞ্চম – নবম খন্ড) – প্রশান্তকুমার পাল । প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।
২. সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী (প্রথম খন্ড – ময়ূরকন্ঠী (‘আচার্য তুচ্চি’, ‘বিশ্বভারতী’ ইত্যাদি রচনা)) – প্রকাশক: মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স।
৩. রবীন্দ্রনাথ ও ফ্রান্স – সৈয়দ কওসর জামাল। প্রকাশক: আজকাল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
৪. বিশ্বহৃদয় পারাবারে (মোরিৎস ভিন্টারনিৎস ) – দেবব্রত চক্রবর্তী । প্রকাশক: সিগনেট প্রেস।
৫. রবীন্দ্রজীবনকথা – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স।
৬. Rabindranath Tagore – A Biography by Krishna Kripalani, Publishers: UBS Publishers’ Distributers Pvt. Ltd.
৭. অগ্নিযুগে শান্তিনিকেতনে হাঙ্গেরীয় দম্পতির স্মৃতিলিপি – জি রোজা হাইনোসি (বাংলায় অনুবাদ – বিচিত্রা ভট্টাচার্য)
৮. গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ – সমীর সেনগুপ্ত। প্রকাশক : প্যাপিরাস ।
৯. Internet / Wikipedia

** Photo acknowledgement: Rabindranath Tagore and Germany – the Story behind my Research, by Martin Kämpchen, German author, translator and journalist

Sahityika Admin

2 comments

  • এই সাহিত্যিকা পত্রিকায় দেবাশীষবাবুর জানা অজানা ধারাবাহিক পত্রিকাটিকে এক অন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। লেখক যে অনেক পরিশ্রম করে এটির সংকলন করেন বলাই বাহুল্য।
    আমি আরও লেখার জন্য অপেক্ষা করবো।
    ধন্যবাদ

  • খুব ভালো লেখা, অনেক যত্ন ধৈর্য নিয়ে পড়াশোনা করে।
    অনেক কিছুই জন্য গেলো।