সাহিত্যিকা

ছাত্র ও শিক্ষক — সেকালে ও একালে

ছাত্র ও শিক্ষক — সেকালে ও একালে
তথাগত রায়, ১৯৬৬ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

আমাকে এই বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে, কিন্তু এতে আমার কতটা অধিকার আছে আমি ঠিক জানি না। তার কারণ, আমি শিক্ষকতা করেছি মাত্র কুড়ি বছর, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১০, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং নামে নতুন একটি বিভাগ এই সময় প্রতিষ্ঠা হয়, যাদবপুরের সল্ট লেক ক্যাম্পাসে, এবং আমি এখানে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে নিযুক্ত হই ও কাজ শুরু করি। তার আগে আমি কখনো শিক্ষকতা করি নি। ভারতীয় রেলে কাজ করেছি, প্রধানত কলকাতার মেট্রো নির্মাণে, যদিও আই.আই.টি. খড়্গপুর ও শিবপুর বেসু-তে (বর্তমানে আই.আই.ই.এস.টি.) টুকটাক লেকচার দিয়েছি। যাদবপুরেও আমি যে সব ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছি তারা সকলেই জয়েন্ট পরীক্ষায় উচ্চস্থান অধিকার করে এখানে এসে ভর্তি হয়েছে, সুতরাং সকলেই রীতিমতো ভালো ছাত্রছাত্রী। অতএব সাধারণ কলেজে বিশাল সংখ্যক ছাত্রদের পড়ালে যে সর্বাঙ্গীন অভিজ্ঞতা হয় তা আমার অনেকটা না হলেও সামান্য কিছুটা হয়েছে। তবে একটা বিষয়ে আমি বিশেষত্ব দাবী করতে পারি। যেহেতু এই কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগটি আমার তত্ত্বাবধানেই সৃষ্টি, তাই পাঠক্রম তৈরির কাজটা আমাকেই করতে হয়েছিলো, একেবারেই গোড়া থেকে।

তাই নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি। এখন আমার বয়স হল প্রায় আটাত্তর, অভিজ্ঞতা তো কম হল না! তবে এই অভিজ্ঞতার একাংশ বর্ণনার উদ্দেশ্য এই নয় যে অযাচিত জ্ঞানদান। বস্তুত এটি বৃদ্ধদের একটি দুর্বলতা, এবং আমরা যুবক বয়সে এই নিয়ে অনেক হাসাহাসিও করেছি। এখন সেই হাসাহাসির পাত্র হতে আমার বিলক্ষণ আপত্তি আছে। তবে কেউ করলে করবে।

আমরা যখন বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলাম, আজ থেকে ষাট বছর আগে, তখন কলেজ পুরোপুরি আবাসিক ছিল, অধ্যাপকরাও প্রায় সবাই ক্যাম্পাসের ভিতরেই থাকতেন। অধ্যাপক আর ছাত্রদের ক্লাসের বাইরে মুখ-দেখাদেখিই প্রায় ছিল না। অধ্যাপকদের সব বিচিত্র বিচিত্র নামও দেওয়া হয়েছিল, যেমন ‘ঘোড়া’, ‘দান্তে’, ‘লেগু’, ‘অপেরা’, ‘বস্তা’, ‘ডিংডং’, ইত্যাদি। কিছু অধ্যাপক ছিলেন যাঁরা ছাত্রদের ভালোবাসতেন, ছাত্ররাও তাঁদের ভালোবাসত, তাঁদের আবার অনেকেরই কোনো বিচিত্র নাম ছিলো না। এঁদের মধ্যে বিশেষ করে মনে পড়ছে শ্রদ্ধেয় প্রফেসর শঙ্কর সেন, শঙ্কর সেবক বড়াল, বিমল সেন, চিরঞ্জীব সরকার, এঁনাদের কথা। এঁরা কেউই আর এখন এই পৃথিবীতে নেই। তাঁদের মধ্যে ডঃ শঙ্কর সেন নব্বই পার করে কয়েকমাস আগে চলে গেলেন, আমি শেষ শ্রদ্ধা জানাবার সুযোগটুকু পেয়েছিলাম। কামদাবাবুও একশো পার করে কিছুদিন আগে চলে গেছেন। আমাদেরও যাবার সময় হয়ে এসেছে, এই করোনার বাজারে টুপটাপ আমাদের সমকালীন অনেকেই ঝরে যাচ্ছেন।

প্রিন্সিপাল ছিলেন প্রফেসর অতুলচন্দ্র রায়, দেখতে কুচকুচে কালো, আমরা বলতাম ব্ল্যাক জুয়েল। ভয়ঙ্কর ব্যক্তিত্ব, আমরা প্রচন্ড ভয় পেতাম। প্রক্টর ছিলেন প্রথমে এ. ডব্লিউ. মামুদ, খুব সেজেগুজে থাকতেন, বর্ণময় ব্যক্তিত্ব; তারপর এলেন প্রফেসর চক্রবর্তী, যাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের গলার বোতাম লাগানো আছে কি না সেটা দেখা, আর তারা সিগারেট খায় কি না। প্রায় নিরানব্বই শতাংশ ছেলে সিগারেট খেত, বেশিরভাগই চারমিনার, তখন ষাটের দশকে দশ পয়সা করে প্যাকেট ছিল। আমাকে একজন সিনিয়র কলেজ থেকে পাশ করে যাবার পর বলেছিলেন, আমাদের সকালের প্রাতরাশ খুব মারাত্মক ছিল, খেয়ে খেয়ে আমার পেটটা গেছে। কি খেতেন? জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন “বোঁদে, ঝুরিভাজা, চা আর চারমিনার”।

ছাত্রীর সংখ্যা ছিল সব ইয়ার মিলিয়ে মোটে বারো-তেরজন। ছাত্র দু’হাজার, অতএব প্রতিযোগিতা যে কি মারাত্মক ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কয়েকজন ললনামোহন ছাত্র ছিল, তারা ছাত্রীদের সঙ্গে খুব মিশত। আর অন্যরা তাঁদের নিয়ে দিবাস্বপ্ন বা নিশাস্বপ্ন দেখত। আসলে তখন একই ক্লাসের ছাত্র আর ছাত্রীদের মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান ছিল তাকে অতিক্রম করে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার দুঃসাহস ও মানসিকতা বেশিরভাগ ছাত্রেরই ছিল না। মেয়েরা তখন সবাই শাড়ি পরত। তবে ওয়ার্কশপে শাড়ি পড়া বারণ ছিল, সেখানে সেই আমলেও ছাত্রীরা প্যান্ট পরে যেত।

১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার সাধারণ নির্বাচনের পরিবর্তনে যুক্তফ্রন্ট সরকারে জিতল। তার কিছু পরেই এলো নকশালবাড়ির ঘটনা, এবং একেবারে নতুন একটা যুগের সূচনা হল। তখন আমরা কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে গেছি। কিন্তু বয়সে তরুণ। সে-যুগ আমাদের কলেজের পক্ষে এবং পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে এক সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। এটা একান্তই আমার ব্যাক্তিগত মত, অন্যরা আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন। কিন্তু এটা আশা করি সবাই স্বীকার করবেন যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, এমনকি ছাত্র-ছাত্র সম্পর্কও অসম্ভব ঘা খায় ছাত্র-যুব মহলে দলীয় রাজনীতির অনুপ্রবেশে ও নকশাল আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। সাধারণ মানুষের মনে এক ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়। নকশাল আমলের আগে দু’দল ছাত্রের মধ্যে বচসা বা গন্ডগোল হলে সেটা বেশিদূর গড়াত না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তর্কাতর্কি বা গালাগালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, এবং অনেক সময়েই বাকি ছাত্ররা উদ্যোগী হয়ে সেই গন্ডগোল মিটিয়ে দিত। কিন্তু নকশাল আন্দোলনের পরে নিজেদের মধ্যেই দূরত্ব তৈরি হয়ে যায় এবং একই ক্লাসের ছাত্ররা বাল্যবন্ধুকে বা পরস্পরকে খুন পর্যন্ত করতে ইতস্তত করে নি।

দলীয় রাজনীতির অনুপ্রবেশে এই ছাত্র-ছাত্র ও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যখন খুনের জায়গায় পৌঁছয় তখন আমি ছাত্র ও শিক্ষার জগৎ থেকে বহু দূরে। কিন্তু খবর ভেসে ভেসে কানে আসত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অজাতশত্রু মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক গোপাল সেনের নৃশংস হত্যায় যে কি দুঃখ পেয়েছিলাম তা বলার নয়। ভদ্রলোককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম, এবং ওরকম একটা মানুষকে যে ছাত্ররা ঠান্ডা মাথায় খুন করতে পারে তার পিছনে কি পরিমাণ কুশিক্ষা কাজ করেছে তা ভেবে রাতে ঘুম আসত না।

কিন্তু সব ধর্মেই একটা কথা আছে। বাইবেলে আছে (আমি খ্রিষ্টান পাদ্রীদের স্কুলে পড়েছি, তাই একটু একটু জানি) “For they sow the wind and shall reap the whirlwind”, “হাওয়া পুঁতলে সেটা ঘূর্ণিবাত্যা হয়ে দেখা দেয়”। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে একেই কর্মফল বলা হয়, যা এখন ইংরেজি ভাষায় ‘karma’ হয়ে ঢুকে গেছে। এর প্রকাশ আমরা দেখেছিলাম বরানগরের নারকীয় হত্যাকাণ্ডে, যে একটি রাতেই আনুমানিক শতাধিক ছাত্র যুবককে খুন করা হয়। ধীরে ধীরে এই খুনের সর্বনাশা ও বন্ধ্যা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়, এবং বহু নেতা ও কর্মীরা ঘরছাড়া হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যান। আর যে সব উনিশ কুড়ি বছরের ছাত্রযুবরা নেতাদের আহবানে রক্তাক্ত বিপ্লবের, সমাজব্যবস্থা বদলের স্বপ্ন দেখেছিল, যাদের অনেকের মধ্যেই অসাধারণ মেধা ছিল, তারা অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে, অনেকেই পুলিশের মার খেয়ে বিকলাঙ্গ হয়েছে, বা বনবাদাড়ে ঘুরে দুরারোগ্য রোগের শিকার হয়ে এখন বাকি জীবনটা কাটাচ্ছে।

অনেকটাই এই সর্বনাশা আন্দোলনের প্রভাবে আমাদের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, যা ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয় ছিল, এবং আই আই টি-র সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে যার নাম করা হত, সেটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেলো, এবং আজও সেই অবস্থা থেকে আমরা উত্তরণ করতে পারিনি। আমরা এই প্রতিষ্ঠানটিকে অসম্ভব ভালোবাসতাম, এবং এখনো বাসি, তাই এটা আমাদের কাছে একটা অত্যন্ত বেদনার বিষয়। এই প্রাঙ্গনেই আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো পাঁচটা বছর কেটেছে, এখন থেকেই আমার বন্ধুদের উদ্ভব, যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আজও অটুট আছে। আমাদের চেয়ে পুরোনো একটিই কলেজ ছিল, রুড়কীর থমসন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, যা আজ পুরোদস্তুর আই আই টি-তে পরিণত, কিন্তু আমরা মাঝপথে এসে পথ হারিয়ে আটকে গেছি।

পাঁচ বছর (বর্তমানে চার) একই ক্যাম্পাসে চব্বিশ ঘন্টা থাকার ফলে যে কি ধরণের আত্মীয়তা তৈরী হয় তা শুধু যারা থেকেছে তারাই জানে। আমি একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। কয়েকবছর আগে একবার রি-ইউনিয়নে গিয়ে আমি বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলাম যে ১৯৭৫ সালে আমি রোটারি ইন্টারন্যাশনাল থেকে একটা সুযোগ পেয়েছিলাম আমেরিকায় মিসৌরিতে গিয়ে সেখানকার মানুষের সঙ্গে সময় কাটাতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমি ছুটি পাই নি, ফলে আমার যাওয়াও হয় নি, সে দুঃখ এখনো মনে আছে। হঠাৎ একটা একদম বাচ্চা ছেলে, বয়স সম্ভবত কুড়ির ঘরে, কোনোদিন চিনতাম না, আমার কাছে এসে বলল, দাদা, আমার নাম শান্তনীল ঘোষ, আমি মিসৌরিতে থাকি, সেন্ট লুইসের কাছে, আপনি আমার কাছে আসবেন? আমার চেয়ে চৌত্রিশ বছরের জুনিয়ার একটি ছেলে আমাকে এরকম অযাচিতভাবে আমন্ত্রণ করছে, আমি একেবারে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম, পরে তার আমন্ত্রণ রক্ষাও করেছিলাম। কিন্তু মাঝখানে এক অধ্যক্ষ এসে এই আশ্রমিক প্রতিষ্ঠানকে সকাল-বিকেলের কলেজ করে দেন। ফলস্বরূপ আমাদের বর্তমান আই.আই.ই.এস.টি’র ছাত্র শিক্ষক বা ছাত্র-ছাত্র সম্পর্ক আজ এককথায় সম্পর্কহীন।

কলেজ থেকে পাশ করার চব্বিশ বছর পরে আবার অধ্যাপনার জগতে ফিরে এলাম, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, সল্ট লেক ক্যাম্পাসে, একেবারে নতুন কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হয়ে। তখন আমরা শুধু দুজন শিক্ষক, আমার সঙ্গে ছিলেন আমাদের কলেজেরই ১৯৮৩ সালের গ্রাজুয়েট শুভজিৎ সরস্বতী। প্রথম প্রথম খুব সাবধানে পা ফেলেছিলাম, কারণ জানতাম সময়ের নিয়মে শিক্ষাজগতের আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে, ব্যাপারটা আগে বোঝা দরকার। আংশিক সময়ের অধ্যাপক নিয়োগ করলাম, কিছু বাইরে থেকে, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগ থেকে। ল্যাবগুলো খাড়া করলাম। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ শঙ্কর সেন, তার পরে এলেন ডঃ প্রতীপ মুখার্জি, সিভিলের বিভাগীয় প্রধান ডঃ পীযূষ সোম। এঁনারা সবাই আমার পূর্বপরিচিত, প্রথম দুজন তো কলেজে আমার শিক্ষক ছিলেন, যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। বছর দু-তিনের মধ্যেই ব্যাপারটায় বেশ সড়গড় হয়ে গেলাম, তারপর আর অসুবিধে হয় নি।

এর মধ্যে আনন্দের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম যে শিক্ষাজগতে সেরকম মৌলিক পরিবর্তন কিছু হয় নি, অন্তত প্রযুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে তো হয় ই নি। ছাত্রীর সংখ্যা বেশ বেড়ে গেছে, এটা অবশ্যই একটা ভালো পরিবর্তন। ছাত্রছাত্রীরা সেইরকমই মেধাবী আছে, শিক্ষকেরা ভুল পড়ালে ধরে ফেলে। আমি কখনো দু-একটা ভুল করলে ভুল স্বীকার করতে পিছপা হই নি, সেইজন্য আমার তেমন অসুবিধেও হয় নি।

এই প্রসঙ্গে আমার ছাত্রজীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। একজন অধ্যাপক বই থেকে অঙ্ক টুকে এনে বোর্ডে লিখে দিতেন। একবার একটা অঙ্কের উত্তর বেরুলো কিউবিক ফিটে, অধ্যাপক সেটাকে 7.48 দিয়ে গুণ করে (বইতে যা লেখা আছে) গ্যালনে উত্তর লিখে দিলেন। ক্লাসের একজন ছাত্র প্রশ্ন করলো, স্যার, 7.48 কেন, এক কিউবিক ফুটে তো 6.24 গ্যালন হয়! বাস্, স্যার আর উত্তর দিতে পারেন না! এদিকে ছেলেরা খুক খুক করে হাসছে! স্যার বলতে পারতেন, যে পরেরদিন জেনে বলবেন। কিন্তু সেটা বলায় তিনি অভ্যাস্ত ছিলেন না, তাই হাসির পাত্র হলেন। আসলে আমরা তখন ইম্পিরিয়াল গ্যালনেই অভ্যস্ত ছিলাম, যার 6.24 গ্যালনে এক কিউবিক ফুট হয়। কিন্তু বইটা মার্কিন বই, তাই তারা ইউ এস গ্যালন ব্যবহার করেছিল, যাতে 7.48 গ্যালনে এক কিউবিক ফুট। আর আমাদের অধ্যাপক বই থেকে অঙ্ক টুকছেন। তাই ক্লাসে পড়াতে গিয়ে এই পরিণতি। তবে সুখের বিষয়, এসব গোলমেলে ইউনিট এখন উঠে গেছে।

আরো আবিষ্কার করলাম, শিক্ষকদের নামকরণ করার প্রথাটা আদৌ উঠে যায় নি। কিন্তু আমাদের সামনে কখনো বলবে না, ঐটুকু সম্মানটুকু তখনও ছিল। একজন ছাত্র প্রাক্তন হয়ে যাবার পর জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাপু হে, বল তো তোমরা আমার কি নাম দিয়েছিলে? সে কি আর বলে? অনেক চাপাচাপির পর বলল স্যার, আমরা আপনাকে ‘বাবা’ বলতাম, আর সরস্বতী স্যারকে ‘ছেলে’ বলতাম।

যাক, এটা তেমন মারাত্মক কিছু নয়।

একটা জিনিস নিয়ে আমাদের সময়কার ছাত্রদের সমস্যা ছিল, যাদবপুরে এসে দেখলাম সেটা আরো ঘনীভূত হয়েছে, পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। সমস্যাটা আর কিছু নয়, ইংরাজি বলতে না পারা। দু’কারণে সমস্যাটা আরো খারাপ হয়েছে। প্রথম কারণ, আমাদের সময় ছেলেমেয়েরা স্কুলে ইংরেজি পড়ত ঠিকই, মোটামুটি শুদ্ধ ইংরেজি লিখতেও পারত, শুধু অভ্যাসের অভাবে বলতে পারত না। সেটা সামান্য অভ্যাসেই মেধাবী ছেলেমেয়েরা ম্যানেজ করে নিতে পারত। আর আমি যখন পড়াতে এলাম তখন দেখলাম এরা স্কুলে ইংরেজি পরেই নি, যেটা পড়েছে তাকে দুগ্ধপোষ্য ইংরেজিও বলা যায় না। কেন? কারণ উনিশশো-আশীর দশকের গোড়ার দিক থেকে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি পড়ানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যুক্তি হিসাবে বলা হয়েছিল “শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ”। অথচ যাঁরা এই সব নিয়মকানুন করেছিলেন তাঁরা এমন ছিলেন যে নিজেদের ছেলেমেয়েদের মোটা মাইনের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াতেন। তাই আমি ছাত্রদের বলেছিলাম, ইংরেজি না শেখানোর এই নব্য শিক্ষাব্যাবস্থা তোমাদেরকে অথর্ব করে এই পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়েছে, এবার তোমাদের মাকড়সার মতো পা গজাতে হবে, অর্থাৎ নিজের চেষ্টায় ইংরেজি শিখতে হবে। সুখের বিষয়, কথাটা ছেলেমেয়েরা বুঝতে পেরেছিলো।

আমার শিক্ষকজীবনে একেবারে শেষে একটা ঘটনা ঘটেছিল যেটা আমি আমার শেষ দিন পর্যন্ত ভুলব না। যাদবপুর থেকে আমার অবসর নেবার দিন ছিল ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০১০। তার সপ্তাহ দুয়েক আগে ক্লাস নিতে গিয়ে দেখি ক্লাসের দরজা বন্ধ! সাধারণত দরজা খোলাই থাকে, আমি ক্লাসে ঢুকে বন্ধ করি। যাই হোক, আমি কিছু না ভেবে দরজা ঠেলে ক্লাসে ঢুকতেই ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে উঠে গান গাইতে লাগলো, “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ”। দিনটা ছিল আমার ৬৫তম জন্মদিন, ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০১০। তারপর তারা একটা কেক বার করল, কেক কাটা হল। আমি খুব একটা আবেগপ্রবণ মানুষ নই, কিন্তু সেদিন আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল।

আমার জীবনের — শুধু শিক্ষক জীবনের নয়, গোটা জীবনের — অন্যতম পরম প্রাপ্তি ওই গান আর ওই কেকটা, তার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসা।

                                                         The worst sinner has a future, even as the greatest saint has had a past. No one is so good or bad as he imagines
– Dr. Sarvepalli Radhakrishnan

 

Sahityika Admin

3 comments