সুনীল মাস্টার
অনিরুদ্ধ রায়, ১৯৮৩ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আমাদের স্কুলের বাংলার মাষ্টার, সুনীলবাবু ছিলেন ভয়ানক বদরাগী আর মারকুটে। আমাদের সময় শিক্ষকরা ছাত্রদের মারধোর করত, আমরাও সহ্য করে নিতাম, কিন্তু সুনীলবাবুর মারধোর ছিল মাত্রাতিরিক্ত।
একদিন ক্লাসে এসে ভাবসম্প্রসারণ করতে দিয়ে চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন, পিছনের বেঞ্চ থেকে কৃষ্ণ বেড়ালের ডাক দিল, অথচ সুনীলবাবুর ঝিমুনি কাটল না। এবার বিভিন্ন বেঞ্চ থেকে বেড়াল ডাক শুরু হলো। একসময় সমবেত বেড়াল ডাক এমন পর্যায় উন্নিত হলো যে সুনীল বাবু তড়াক করে উঠে সামনের বেঞ্চের দুতিনজনকে যাকেই হাতের কাছে পেলেন বেধরক চড়, থাপ্পড়, কিল ঘুষি মেরেও ক্ষ্যান্ত হলেন না, এলোপাতাড়ি আরো কয়েকবার হাত চালিয়ে, তারপর ডাস্টারটা সজোরে ছুড়ে মারলেন। সেটা সপাটে গিয়ে লাস্ট বেঞ্চের কল্লোলের মাথায় গিয়ে আঘাত করলো। কল্লোলের মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগলো। স্যার এবার ভয়ে ক্ষ্যান্ত দিয়ে নিজেই কল্লোলকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে মাথায় ছটা স্টিচ করিয়ে ফিরলেন।
পরের দিন সারা স্কুলময় পোস্টার পড়ে গেল, “সুনীল বাবুর মুন্ডু চাই – মাও সে তুং”। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যেতে, হেড স্যার সুনীলবাবুকে ডেকে বললেন আপনি নিজেকে সংশোধন করুন, মাও সে তুং অবধি আপনার খবর চলে গেছে, আপনাকে তো বাঁচানোই মুস্কিল হয়ে গেলো মশাই! সুনীলবাবুও ভয় পেয়ে গেলেন, সত্যিই তো তিনি মাও সে তুং এর টার্গেট হয়ে গেলেন? পোস্টার লেখাও দিন দিন বাড়তে লাগলো, আর মাও সে তুং প্রত্যেক দিন সুনীলবাবুর কাছে জবাবদিহি চাইতে শুরু করলেন। সুনীলবাবু কিছুদিন গুম মেরে থেকে অবশেষে প্রানের ভয়ে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পালিয়ে গেলেন। ওনার খবর এরপর আর কেউ রাখলো না। সুনীলবাবুর শেখানো কোনো কথাই আর ছাত্রদের মনে থাকলো না, তবে সুনীলবাবু একবার ক্লাসে বিবাহের মানে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন- বি পূর্বক বহ ধাতুর ঘঙ্, বিয়ের আসল ব্যাপারটা যে ঘঙ্ সেটা কিন্তু ছেলেদের মাথায় ঢুকে গেছিল।
আমাদের মাস্টার খ্যঁদানো, মার্কামারা ব্যাচে চার পাঁচজন ছাড়া কেউ ভালো রেজাল্ট করলো না। ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র বিধুশেখরই বাংলা নিয়ে পড়লো, তারপর বোড়ালের এক স্কুলে মাস্টারের চাকরি পেয়ে বর্তে গিয়ে বেশ সুখেই জীবন কাটাতে লাগলো। যে সব ছেলেরা ভালো চাকরি বাকরি করে বা ডাক্তার, উকিল হয়ে জীবন শুরু করলো তারা সবাই কিছুদিন বাদেই কেমন ঝিমিয়ে পড়ল, বিধু কিন্তু সবসময় তরতাজা। সিরাজের বাড়িতে মাঝে মধ্যে ছুটির আড্ডা হয়, বিধু ওখানে রেগুলার যায় আর সবার সাথে আন্তরিক ভাবে গল্প করে। একদিন প্রমোদ ওকে জিজ্ঞেস করলো – অ্যাই বিধু, তুই বাংলা পড়িয়ে সত্যি আনন্দ পাস? আমি ইন্সুরেন্সের এজেন্ট হয়ে বুঝেছি যে সব থেকে খারাপ প্রফেশনে ঢুকেছি। চেষ্টা করলে তো তোর মতো বাংলায় এম এ হতে পারতাম?
বিধু শান্ত স্বরে বললো – আমি তো আর খালি বাংলা পড়াই না, ইতিহাস, ভূগোলও পড়াই। ছাত্র পড়ানোর একটা আলাদা চার্ম আছে। যার সয় সেই রয়। আমাদের স্কুলের ফিজিক্সের মাস্টার ব্রজেনবাবু তো চাকরি ছেড়ে এখন তোর মতোই ইন্সুরেন্সের দালালি করছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম – টেনশন হীন এত সুখের চাকরি ছাড়লো কেন?
– ঐ টেনশনের চোটেই ছাড়লো, এমনিতেই ছাত্রদের সবাইকে খুব তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো, সবাইকে ব্যাঙ্গ করে বলতো মুদির দোকান, পানের দোকানে গিয়ে বসতে। মন দিয়ে পড়াতো না অথচ কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতো। পরীক্ষার হলে গার্ড দিচ্ছিল, একজন ছাত্র আর একজনের দেখে টুকছিলো, ও দুজনকেই বেধরক পিটিয়ে খাতা কেড়ে নিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বার করে দিল। এবার সব ছাত্ররা ওর পেছনে লেগে গেল, গার্জেন কমিটি থেকে ওর নামে কমপ্লেন হলো, ও সেইসব ঝামেলা সামলে আর চাকরিতে টিকে থাকতে পারলোনা। আমরা যেমন সুনীলবাবুকে তাড়িয়েছিলাম, এরও ঐ একই অবস্থা হলো। আসলে কী জানিস, ছাত্ররা কেউ খারাপ হয় না, মাস্টাররাই ভালোবেসে পড়ায় না, ছাত্রদের প্রতি কোনো দরদ নেই। ভালো ছেলে তৈরি হবে কী করে? আমাদের স্কুলে কতো মেধাবী ছাত্র পড়তে আসে জানিস? একবার ক্লাস ফাইভের পরীক্ষায় আমি ইতিহাসের প্রশ্নে দিয়েছিলাম – বাবরের বাবার নাম কী? একটা ছেলে লিখেছিলো – বাচ্চু মিঞা (ডাকনাম)। কী আসাধারণ বুদ্ধি ভাব তো! বাবরের বাবার ডাকনাম কী ছিলো কোন ঐতিহাসিক জানে? আমি শূন্যও কুর্নিশ করে দিয়েছিলাম, কিন্তু সেই ছেলে ক্লাস সেভেনের পর স্কুল ছেড়ে দিলো। এরকমই হয়, সবথেকে ভালো ছেলে গুলোই হারিয়ে যায়।
সুদীপ নরেন্দ্রপুরে ফ্ল্যাট কিনে থাকতে লাগলো, ও খোঁজ পেল যে ওদেরই পাড়ার এক লাইব্রেরিতে সুনীলবাবু বসেন আর খুব কম টাকায় উৎসাহী ছাত্র- ছাত্রীদের বাংলা শেখান। বিধু কোনো কাজে একদিন নরেন্দ্রপুরে সুনীলবাবুর সাথে দেখা করে এল, উনি বিধুকে একদিন বাড়িতেও আসতে বললেন। আমরা যারাই শুনলাম বিধুর ওপর ক্ষেপে গেলাম, ঐ সব বাজে মাস্টারের সাথে দেখা করার কী দরকার?
বিধু বললো – দেখ, এখন আমি নিজে মাস্টার তো তাই মনে হয় আমরা অযথাই ওনাকে তাড়িয়েছিলাম, উনি তো কল্লোলকে নিজেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন!
আমার বাবার অনেক বই ছিলো, বাড়ি পাল্টানোর সময় বই গুলোকে আবর্জনা মনে হলো। ছেলেরা কোনোদিন ছুঁয়েও দেখলো না, শুধু পড়ার বই আর মোবাইল ফোন বাদে কোনো কিছুই ওদের কাছে দরকারি ছিল না। বই সব অযত্নে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাই এগুলো আর বহন করে নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমি বিধুকে বলতে, ও বললো নরেন্দ্রপুরের ঐ লাইব্রেরীতে দিয়ে দিলে ওরা খুশি হয়ে নেবে। তাই একদিন গাড়ি করে সব অবাঞ্ছিত বই ওখানে দিতে গেলাম। একজন সুন্দর দেখতে ছেলে বইগুলো নিয়ে যত্ন করে রাখলো। ছোটো লাইব্রেরিটা বেশ গোছানো, অনেক বাংলা,ইংরেজি ক্লাসিক বই আছে। আমি চারদিক দেখে ছেলেটাকে বললাম- “বাঃ বেশ সুন্দর তো তোমাদের পাঠাগার?”
ছেলেটা বললো- স্যারের জন্যই সব হয়েছে।
পাঠাগারের সামনের বারান্দায় মাদুর পেতে দেখি সুনীলবাবু। মুখ সাদা দাড়িতে ছেয়ে গেছে। মহাভারত পাঠ করছেন, আর সামনে বেশ কয়েকজন শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে শুনছে, একজন মহিলাও আছেন। স্যার অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন, শীর্ণকায় মলিন চেহারা, তবে চোখ দুটো উজ্জ্বল। আমার কেমন যেন আমাদের কৃতকার্যের জন্য আজ খারাপই লাগলো, আমিই তো ছিলাম মেইন পোস্টার বয়। মহাভারত পাঠ শেষ হলে আমি ওনাকে প্রনাম করে আমার পরিচয় দিলাম, উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, লাইব্রেরিতে বই দিয়েছি শুনে খুশি হলেন, আমাকে ওর বাড়িতে গিয়ে এক কাপ চা খাওয়ার অনুরোধ করলেন। অনুরোধ ঠেলতে পারলাম না, লাইব্রেরির কাছেই ওনার বাড়ি, ওনার সাথে গেলাম। একটা মিষ্টি মেয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে আমায় প্রনাম করলো। সাদামাটা বেশেও খুব ঝকঝকে চেহারা।
স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন – এটি আমার নাতনি, তিথি।
আমি জানতে চাইলাম, – তুমি কী পড়ো?
সে মিষ্টি হেসে বলল- পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলেছি।
স্যার পাশ থেকে বললেন- ও এবছর আই এ এস ফাইনাল ক্লিয়ার করেছে।
আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে বলে উঠলাম – বাঃ, তোমারও কি দাদুর মতো বাংলা সাবজেক্ট?
– না, সংস্কৃত। তবে, দাদুই অনুপ্রেরণা।
চা খেতে খেতে স্যার বললেন- তোদের মারধোর করে নিজেও খুব কষ্ট পেতাম। আমার ছেলেও আমার এই মারকুটে স্বভাবের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো, আলাদা সংসার পাতে, আমাকে খবরও দেয় নি। তারপর ক্যানসারে ভুগে অল্প বয়সেই মারা গেল, আমি বৌমা আর নাতনিকে বাড়িতে নিয়ে আসি, নিজের সব ভুল শুধরে ওকে মানুষ করি। আজ মেয়েটা সফল হয়ে আমায় তৃপ্ত করেছে, আমার আর নিজেকে অসফল মনে হয় না।
আমি বাড়ি ফেরার সময় বললাম – স্যার, আমরাও ভীষণ ভুল করেছিলাম, পরে বুঝেছি।
স্যার স্মিত হেসে আমার হাতদুটো ধরে বললেন – নারে, তোরাই তো আমার ভুলটা শুধরে দিয়েছিলি। আবার আসিস, বাবা।
আজও আমার কানে বাজে স্যারের সেই ছোট্ট কথাটা “তোরাই তো আমার ভুলটা শুধরে দিয়েছিলি।“
ধন্যবাদ।