সাহিত্যিকা

বিক্কলেজ, আরকিকেচ্ছা, আর এক বিশেষ স্মৃতি

বিক্কলেজ, আরকিকেচ্ছা, আর এক বিশেষ স্মৃতি
সুদীপ্ত চক্রবর্তী (’৮২ বান্ডিলের)
** আগের একটি অনুরূপ লেখা থেকে সংক্ষেপিত

বিক্কলেজ এমন এক জায়গা যেখানে যুগান্তরের সাক্ষী প্রাচীন সব ইমারতেরা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকেন যেন আপাতগম্ভীর অন্তরে স্নেহশীল অভিভাবকের মতন, যেখানকার ঝুপসি গাছেরা দেখেছে কতো-না সময়বদল, তাদের পাতার আবেগী ঝিরঝিরিতে ঝরে সেই সব দিনের পরণকথা, যেখানে অনেক মানুষ যারা নিজেরাই ইতিহাস। উপরি আছে চিরবহমানা গঙ্গা আর চিরসবুজ বটস, এরাও যেন অঙ্গাঙ্গী হয়ে মিশে আছে বিক্কলেজের সত্তায়। “বিক্কলেজ” – এই শব্দটি এমন এক চাবি যা খুলে দ্যায় কতোকাল ধরে কতো-না দরাজ দরোজা দেশ কালের দেয়াল পেরিয়ে বয়েসের বাধা ভেঙ্গে শ্রেণীবিন্যাস চূর্ণ ক’রে।

বিক্কলেজ কাহিনী বর্ণন মহাভারতের আকার নিতে পারে, সে কথকতা এই পরিসরে সাধ্য নয়। এখানে শুধু ছুঁয়ে যাওয়া তার অন্যতম, বিশিষ্ট ও বিখ্যাত এক বিভাগকে – স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগ। অর্থাৎ আর্কিটেকচার ওরফে “আর কী কেচ্ছা’ র ডিপার্টমেন্ট অর্থাৎ “ডিপো”।

সেই কোন সুদূর ঊনিশশো ঊনপঞ্চাশ সালে স্থাপত্য আর নগর-পরিকল্পনা দুই আলাদা বিভাগ হিসেবে শুরু হয়ে, ঊনিশশো বাহান্নতে মিলে গিয়ে, আড়ে-বহরে কাজে কম্মে আর সুখ্যাতিতে বেড়ে বেড়ে আজ এ দেশের এক নামকরা অগ্রণী শিক্ষাসত্র আর এর সফল প্রাক্তনীরা আলো করে আছে দুনিয়ার নানা কোণা।

আর্কিটেকচার যে ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের অঙ্গীভূত সঙ্গী হলেও কোথাও একটু আলাদাও, সেটা সদাসর্বদা মনে রাখতে হত আমাদের সময়ে, প্রধানতঃ তিনটি কারণে- প্রথমত, ওই পাঁচ বছর পড়তে হয় বলে। আমরা ভাবতে চাইতাম আমাদের বিষয়টি বিশাল এবং মহত্তর বলে পাঁচবছর লাগে, আর বাকি কলেজদুনিয়া বোধহয় ভাবত আমরা নিকৃষ্ট নিরেস নিরেট মগজের বলে ওই সহজপাঠ টুকুও গেলাতে শিক্ষকদের লেগে যায় পাঁচ-পাঁচটি বচ্ছর !

প্রথমত ওই যে পাঁচ বছরের পড়া অথচ বিষয়টা নাকি সহজ, ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত অত জটিল কঠিন নয়, এটাই একটা রহস্য, আবার ভদ্রতাবশত বাইরে সামনে মুখে না বললেও ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্ররা বিশেষ করে খানদানি যেমন মেকানিক্যাল ইলেকট্রিক্যাল সিভিল ইলেকট্রনিক্স এর ছাত্ররা আর্কিটেকচার এবং শুধু আর্কিটেকচার কেন মাইনিং এর মত এমনকি মেটালার্জির মত বিষয়গুলিকেও একটুখানি, এই ইট্টুসখানি, নিচুনজরে দেখতো এটা সত্যি।

দ্বিতীয়তঃ আর্কিটেকচার এর পড়াশুনোর কায়দা কানুন রঙ-ঢঙ সবই একটু আলাদা। এরা ছবি টবি প্রচুর আঁকে, নানা রকম নকশা করে, আর ওদের পড়াশোনার ব্যাপারটা যে টেকনিক্যাল ও রিয়ালিস্টিক নয় বরঞ্চ আর্টিস্টিক ও ফিলসফিকাল, এই মূলে-ভুল ধারণাটা সুদীর্ঘকাল ধরে নিজেরাও বিশ্বাস করেছে অন্যরাও এরকমটাই ভেবে এসেছে।

যাইহোক তৃতীয়ত, আর্কিটেকচারের পড়াশুনো ইঞ্জিনিয়ারিং এর থেকে নিরেস হোক বা না হোক বিপুল সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করতেন এবং আজও করেন আর্কিটেকচার নাকি মেয়েদের জন্য ভালো সাবজেক্ট। তার ফল হলো এই, যে আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টটি প্রায় ঊষা কাল থেকেই সদাই সুন্দরীদের ফুল্ল কুসুমিত আড়ৎ হয়ে দাঁড়ালো, আর নারীবিবর্জিত সেই মধ্যযুগীয় বিক্কলেজে সকল সন্তপ্ত সন্তানদের লোলুপ দৃষ্টি ও সঘন দীর্ঘশ্বাস-এর কারণ।

পড়াশোনার বিষয়ে বলতে গেলে বলা যায়, আর্কিটেকচার এর মত জটিল কঠিন সংবেদনশীল বিষয় পড়ানোর জন্য যে সুদীর্ঘ পাঁচটি বছর এর প্রয়োজন হয় তার সদুপযোগ করার জন্য শিক্ষক ও ছাত্র উভয় দিক থেকেই আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের দিক থেকে চেষ্টার কোনোই ত্রুটি কোনোদিন দেখা যায়নি। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শেষ প্রতিনিধি শিব মুখার্জী স্যারকে আমরা পেয়েছিলাম ; প্রবাদপ্রতিম আরো সব শিক্ষকদের মধ্যে আরো এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব অবনী দে স্যার যিনি সেই শুরুর দিন থেকেই বিভাগাধ্যক্ষ ছিলেন, তাঁকেও পেয়েছি।

জোসেফ এ্যালেন স্টেইন সায়েব, সাক্রেস্তি সায়েব তথা পাকনিকার, কীর্তিকার স্যারদের নাম শুনেছি ছবি দেখেছি, কীর্তিকার সায়েবকে দেখেওছি মনে হচ্ছে, শ্যাম বেনেগাল মহাশয়ের দাদা নিজগুণে গুণী শিল্পী সুদর্শন সুদর্শন বেনেগাল সায়েবের কাছে অঙ্কন শিখেছি, আর আমাদের সময়কার সব শিক্ষকদের কাছেই বিষয়গত শিক্ষণের সাথে সাথে স্নেহ ভালবাসা প্রশ্রয় প্রভূত পেয়েছি।

আমাদের বিশিষ্ট বিভাগে বিখ্যাত স্থপতিরা আসতেন সারা পৃথিবী থেকে। আর্কিটেকচার বিভাগের অতীত ও বর্তমানের সমস্ত দেখা না-দেখা শিক্ষকদের আন্তরিক অশেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে তারপর জানাই, শিক্ষক হিসেবে যে মানুষটি আমার মনে, এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস আরও অনেক অনেকেরি মনে, গভীর ছাপ রেখে আছেন, তিনি কিন্তু সেই অর্থে শিক্ষকই নন।

গোবিন্দ বাবুর কথা বলছি।
ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বিশুদ্ধ স্নেহরসে টইটম্বুর, ধনাত্মক চিন্তাধারায় প্লুত, অসূয়াশূন্য, ক্ষোভশুন্য উষ্ণ উজ্জ্বল হৃদয়ের, বহু গুণে গুণী ঐতিহাসিক এই মানুষটি যেন যুগান্তর ব্যেপে দাঁড়িয়ে ছিলেন এই সুপ্রাচীন সংস্থানের আরেকটি অজরামর ইমারতেরই মতন।

স্থাপত্যবিদ্যার বিশ্বাবিদ্যালয়ের কোন বড় তকমা তাঁর ছিল না, মনেহয় স্থাপত্যবিদ্যার দূর আত্মীয় একটা সংশ্লিষ্ট গোছের ডিপ্লোমা কিছু ছিল, তিনি ছিলেন “ডেমনস্ট্রেটর” পদে। কিন্তু কীসের গুণে যে তিনি বিগত আগত বর্তমান সকল ছাত্র ছাত্রীর এমন প্রিয়-শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠেছিলেন, তা নিয়ে ভাবলে মানুষে মানুষে সম্পর্ক তথা এই পৃথিবীতে ভালো ভাবে বাঁচার পন্থা বেশ পরিষ্কার ভাবে বোঝা যেতে পারে। একটু চেষ্টা করা যাক।

নিজ কাজটুকু তিনি অত্যন্ত ভালো ভাবে জানতেন, যা শেখাতেন পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে শেখাতেন।তাঁর অনুচ্চকিত অথচ দীপ্তিমান পরিব্যাপ্ত শর্তহীন স্নেহ আর তার সংযমী অথচ সাবলীল প্রকাশ – সবাই অনায়াসে বুঝতে পারত। আর শিক্ষকসুলভ যথাযথ দূরত্ব ও সংযম রেখেও সহজ সুন্দর ভাবে ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে মিশে রঙ্গরসিকতা করার দুর্লভ কলাটি তাঁর আয়ত্ব ছিল।আর ছিল এক দুর্মর প্রসন্নতা; কখনো আঘাতে অপমানে কষ্টে সমস্যায় নিজের গরিমাটি হারাতেন না। অতি সহজ হয়েও তিনি কিন্তু জীবনরসিক ছিলেন ভালই, মানসচোখে ছিল এক রসদৃষ্টির পরকলা, তাই দিয়ে দেখতেন জগতসংসারটাকে।ক্ষোভ ছিল অল্প, ক্ষমা ছিল বেশী; দুঃখ ছিল যথেষ্ট, জারি রাখতেন হাসি।

আর তাঁর গুণের কথা তো গুণে শেষ করা যায় না, সব আমরা জানতামও না শুরুতে, পরে জেনেছি উনি চমৎকার নকশাকরা উলের পোশাক বোনা, মাছ ধরা, আলপনা দেয়া ইত্যাদি কর্মে যেমন দক্ষ ছিলেন, কামারের কুমোরের কাজও জানতেন, ষাট বছর বয়েসে লর্ডসের কাদা মাঠে বুট পরে পুরো সময় বল খেলতেও দেখেছি, আবার তাস দাবার আসরে বিলিয়ার্ডের টেবিলেও দেখেছি। শৌখিনতা দিব্যি ছিল, দেশের বাড়িতে একখানা গোদা রকমের গাড়ি কিনে চালাতেনও জানি। আমাদের সঙ্গে শিক্ষাভ্রমণে গেলে দেখতাম উনি লখনউতে চুড়িদার কুর্তা বাঁকা টুপি আর ম্যাড্রাসে গেলে “মুন্ডু” বা “নেরিয়াথি” বা “ভেষ্ঠি” পরবেনই। আর তাঁর সাথে থাকতেন অসাধারন অতুলনীয়া আমাদের সবার “মাসীমা”। সেই সব উপাদেয় ভ্রমণে অসংখ্য অবিশ্বাস্য আনন্দের মজাময় হাসির পুর-দেয়া সত্যি ঘটনার নায়ক নায়িকা ওই দুই জন। আমরা সেই সব কাহিনী কালানুক্রমে দলানুক্রমে বহন করে এসেছি, জানিনা সে সব আজ লুপ্ত কিনা।

তাঁর ছেলে জাহাজে ভাল কাজ করতেন সেই সময়, গোবিন্দবাবু জাহাজকে বলতেন “জাহাদ”, সেটা আমরা লক্ষ্য করতাম। তা সেই ছেলের সুবাদে গোবিন্দবাবু অনেক নতুন নতুন জিনিস যেমন ট্রানজিস্টার রেডিও, বিদেশি ক্যামেরা, এমনকি এক আজব জিনিস মুভি ক্যামেরাও আমদানি করেছিলেন। সম্ভবত ওঁর আনবার আগে-পরে বিভাগেও ওই জিনিসগুলি এসেছিল।তাছাড়া বিভাগে ছিল চলচ্চিত্র প্রক্ষেপক যন্ত্র, স্থিরচিত্র পরিস্ফুটন সংক্রান্ত সরঞ্জাম ইত্যাদি। সেগুলির যত্ন বা ছোটোখাটো সারাই ইত্যাদি উনিই করতেন যতোদূর মনে পড়ে। অর্থাৎ গোবিন্দবাবুর মধ্যে সারল্য, সংযম, বুনিয়াদী ভাবের সঙ্গে অদ্ভুত মিশেল ছিল শৌখিনতার, আধুনিকতার,যান্ত্রিকতার,শিল্পীসত্তার।

এখানে ছাত্র ও কর্মীদের সঙ্গে রয়েছেন অধ্যাপক শিব মুখার্জি, অধ্যাপক অবনী দে ও গোবিন্দবাবু। ওনার সেরা কাজ ছিল কোটি কোটি কালো কালো বিন্দুর সাহায্যে বা রেখার জালে যেকোনো মানুষ বা দৃশ্যের বিস্ময়কর নিখুঁত ছবি ফুটিয়ে তোলা।সে ছিল স্থাপত্যবিদ্যার অন্তর্গত এক অতীব জরুরি কেরদানি “ডট রেন্ডারিং” বা “হ্যাচ রেন্ডারিং” এর এক চরম পরাকাষ্ঠা। কখনোবা এর সঙ্গে যোগ হোতো সূক্ষ্ম রেখার অতি সরেস খেলাধূলা। সে সব ছবি আজ ইতিহাস, কিন্তু লুপ্ত ইতিহাস নয়, গোবিন্দবাবুর আঁকা মহান স্থপতিদের ছবি আজো আলো করে আছে বিভাগের দেয়ালগুলি। সম্প্রতি শ্রীযুক্ত বিভোর দাস মহাশয় বিক্কলেজের উপর যে উপাদেয় উৎকৃষ্ট পুস্তকখানি উপস্থিত করেছেন, তার মধ্যে স্যারের আঁকা বেশ কিছু ছবি আছে, যদিও মুদ্রণ খুব পরিষ্কার নয়। বিন্দু বসানোয় গোবিন্দবাবুর পাল্লাদার ছিলেন একমাত্র আমাদের ঐতিহাসিক শ্রদ্ধেয় “ফনসেকা দাদা”, কিন্তু তিনি ছাত্রজীবন পার করে বিন্দু বসানোয় ক্ষ্যান্ত দেবার পরেও স্যার কিন্তু আরো বহু যুগ ওই অপূর্ব শিল্প চালিয়ে গেছেন।বছরের পর বছর ছাত্রছাত্রীর দল সেই সব ছবি দেখে অবাক মেনে মাথা ঠেকিয়েছে। ওনার করা ছোট ছোট মাটির মূর্তিও দেখেছি মনেহয়।

এতো সব গুণ ছাড়াও সততা, নিয়মানুবর্তিতা ধরনের চারিত্রবৈশিষ্ট্যগুলি উনি নিঃশব্দে বিনা বিজ্ঞাপনে বহন করতেন। কখনো সরাসরি গুরুগিরি না করা উপদেশ না দেয়া নালিশ না করা নিন্দা না করা অথচ নিজের বক্তব্য টুকু সহজ ভাবে নরম ভাবে খোঁচাহীন ভাবে বলে দেয়া তাঁর স্বভাব ছিল। এইরকম একটি চরিত্র দুর্লভ এবং তাই তিনি ওই বিশাল ঐতিহ্যময় প্রাচীন শিক্ষাসত্রের অগণ্য সুখ্যাত বিখ্যাত মহারথীর মধ্যেও এক ক্ষুদ্র কিন্তু উজ্জ্বল হীরের মতন আলো ছড়াতেন।উনি যেন স্থাপত্য বিভাগের এক সমান্তরাল সহযোগী সংস্থা হয়েই বিরাজ করতেন, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা পেত নির্মল আশ্রয় আর নির্দোষ প্রশ্রয়। শিক্ষকদেরও উনি প্রিয়পাত্র ছিলেন। আবার ১/২ জানাপাড়া লেন (আমরা বলতাম হাফ জানাপাড়া লেন) –এর একান্নবর্তী বিশাল বাড়িতে কর্তা হিসেবে তাঁর সম্মান ও দেখেছি। তাঁর সব গুণগুলি আমরা নিজেদের অজান্তেই নকল করতে চেষ্টা করতাম, নিজেরাও টের পেতাম না সেটা।মূল পুঁজি ছিল ওই ভালবাসা টুকু। সব কিছুর গোড়ায় শেষ কথা ওই ওটিই।

১৯৮৫ সাল নাগাদ এক বিভাগীয় পুনর্মিলনে গোবিন্দবাবুর পুরো নামটি কলেজের খাতায় ছিল গোবিন্দ চন্দ্র রায়, কিন্তু আমাকে উনি একদিন বলেছিলেন যে তাঁর পিতৃদত্ত নাম গোবিন্দসুন্দর। কেন জানিনা এই সঠিকতর নামকরণটি বাজারে বেরয়নি।

কলেজ শেষে জগতমাঠে চরতে বেরিয়েও স্যার এর সাথে যোগাযোগ ছিলো অটুট। কোলকাতায় এলে একবার কলেজ যেতামই আর কলেজ গেলে স্যার এর বাড়ী অবশ্যই। আমাদের বিয়েতে ওনার দেয়া উপহার ছিল সেই লাখো বিন্দুর সমাহারে আঁকা আমাদের যুগলমূর্তি।অশেষ যত্নে আর পরম স্নেহে রচিত সেই প্রীতিচিহ্ন আজো স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আমাদের ঘরের দেয়ালে বিরাজ করছে। আর আমার ছিল এক বাণী কুড়োনোর খাতা; সেখানে উনি জলরঙ দিয়ে এক অপূর্ব ফুলেভরা মাধবীলতার গুচ্ছ এঁকে দিয়েছিলেন আর লিখেছিলেন কিছু স্বভাবজ অনুচ্চকিত আশীর্বাণী।

যতদূর মনে পড়ে, শেষ দেখা হয়েছিল যখন উনি আমার বাবার পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের দিন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। তখন ওনার বয়েস হয়ত আশী, সঠিক অবশ্য বলতে পারবোনা, তবে একেবারেই সুস্থ সক্ষম সতেজ সটানই দেখেছিলাম মনে পড়ে।

তারপর একদিন খবর পাই, গোবিন্দবাবু আর নেই।
আশ্চর্যের ব্যাপার, বিশেষ মনখারাপ হয়নি। খবরটা স্থির ভাবেই নিতে পেরেছিলাম।
না, পরে বুঝলাম যে আশ্চর্য কিছুই নয়, আসলে উনি আমাদের মধ্যে এমন ভাবে রয়ে গিয়েছেন যে শরীর গেলেও সেই মনব্যাপী অস্তিত্ব আর যাবার নয়। স্মৃতিছাপ এতই তরতাজা এতদিন পরেও, মনে হয় উনি আছেন বেঁচেবর্তে দিব্যি, আর যে কোন দিন সকালে কলেজমাঠে ফুটবল খেলে বাড়ি ফিরে তৈরি হয়ে আবার কলেজে এসে একদম কাঁটায় কাঁটায় সক্কাল আটটায় খালি স্টুডিও থেকে ছাড়বেন তাঁর পরিচিত সেই পেলব আক্ষেপের স্বগতোক্তি –“ সে-ই সকালা সকালা এসে বসে আছি কেউ ত এলে নে ……।“ তখন আমরা জামার বোতাম ওপরনীচে লাগিয়ে হাওয়াই চটি গলিয়ে ঘুমচোখে আধাসেঁকা পাউঁরুটি জাবর কাটতে কাটতে পড়িমরি করে কলেজমুখো ছুটছি।

১৯৮১ সাল নাগাদ সেবানিবৃত্ত হবার সময় আমাদের “স্যাট” পত্রিকায় এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়।
তিনি কোনোদিনও গুরুগিরি না ফলিয়েও মহাগুরু, শাসন কখনো না করেও অভিভাবক, জোর করে কিছু শেখাতে না চেয়েও মহান শিক্ষক। তিনি ছিলেন শুধু এক অতি উৎকৃষ্ট মনোহরণ উদাহরণ। শুধু শুকনো শ্রদ্ধেয় প্রশংসনীয় প্রণম্য ইত্যাদি বিশেষণ ওঁর জন্যে নিখুঁত মনে হয় না, উনি নিজেও ঠিক এইসব হতে চাইতেন না। উনি উপরন্তু একটু চাপা স্নেহ লুকোনো ভালবাসা আর সরস টিপ্পনীর কারবারি ছিলেন; দুঃখ ক্ষোভ নালিশ গুলোকে দূরে সরিয়ে ভালো কাজে ব্যাপৃত থেকে জীবনকে উপভোগ করায় বিশ্বাস করতেন।

ওঁকে নকল করার সাধ্য ছিল না, কিন্তু অবচেতন সে চেষ্টা করেছে। বিক্কলেজের আরকিকেচ্ছার যতেক পড়ুয়া পেয়েছিলো তাঁকে, আর যারা শুনেছে তাঁর কাহিনী, সবার মধ্যেই তিনি বসে আছেন আজো।

I cannot teach anybody anything; I can only make them think.
– Socrates

Sahityika Admin

Add comment