ডাউন মেমোরি লেন – আমার শিক্ষকেরা ও আমি
(দুটি ভিন্ন লেখা – আমার শিক্ষকেরা ও আমি, এবং জীবনের রঙ একত্রে সংকলিত)
ময়ূখ দত্ত, ১৯৯০ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
পুথিগত বিদ্যার বাইরে গিয়ে শিক্ষা কথাটার প্রকৃত অর্থ আমাদের বুঝতে সম্ভবত সারা জীবন কেটে যায় এবং সেই অর্থে আমাদের চারপাশের সবাই আমাদের শিক্ষক। তা সে বাড়ির কাজের লোকই হোক যে কিনা একটা কানের দুল খাটের পাশে খুঁজে পেলে সততার প্রতীক হয়ে ফেরত দেয় বা শাড়ির দোকানের সেলসম্যানই হোক যিনি শাড়ির বান্ডিল থেকে একশোটা শাড়ি পেড়ে খুলে দেখানোর পরেও কাস্টমার একটাও না কিনে চলে যাওয়ার হতাশায় নিজেকে গুটিয়ে না রেখে আবার নতুন উদ্যমে কাজে লাগেন। প্রকৃতিও কত কিছু শেখায় আমাদের। তবে এসবের মধ্যে, স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা অনঃস্বীকার্য ভাবে আলাদা স্থান নিয়ে থাকেন তাদের বিভিন্ন ক্যারিশমা নিয়ে… আজ এরকম কিছু শিক্ষ্যকের স্মৃতিচারন করতে চাই….
(১)
ঝাড়গ্রামের কুমুদ কুমারী ইন্সটিটিউশান স্কুলে জীবনবিজ্ঞান এক্কেবারেই ভাল লাগত না, ওই সব মাইটোকন্ড্রিয়া, সাইটোপ্লাজম, বিদঘুটে নাম কিছুতেই মনে রাখতে পারতাম না। নাইন থেকে টেনে ওঠার সময়ে চল্লিশ বা পঞ্চাশের ঘরে আমার নম্বর দেখে বাবার অভিজ্ঞতায় নিশ্চিত ভাবে মনে হয়েছিল “রিস্ক ম্যানেজমেন্ট” এর দরকার আছে, তাই আপনার কাছে পাঠিয়েছিল পড়তে…আপনি তো আবার প্রাইভেট টিউশান করেন না, অনেক অনুরোধে সপ্তাহে একদিন পড়াতে রাজী হলেন। সাথে বিদ্যুৎ আর আপনার নিজের ছেলে, আমাদের ক্লাসমেট প্রদীপ। একমাস পরে বাবা টিউশান বাবদ টাকার কথা বলতে গেলে চোখ বড় বড় করে বললেন ” তাহলে তো প্রদীপের থেকেও আমাকে টাকা নিতে হবে!!” আপনার খুব সহজ সরল কিন্তু কঠিন ব্যাক্তিত্বর সামনে বাবা আর কিছু বলতে পারে নি, শ্রদ্ধায় মাথা নীচু করে ফিরে এসেছিলেন, মনে আছে।
আপনি ধুতি পরে খালি গায়ে পৈতেতে হাত বোলাতে বোলাতে কঠিন কঠিন সব টার্মগুলো কি অনায়াসেই মাথার মধ্যে গেথে দিতেন। মাঝে নিজেও জলখাবার খেতেন, আমাদের জন্য ও প্লেট আসত বাড়ির ভেতর থেকে!! সে এক দারুন অভিজ্ঞতা… কিছুটা হলেও মান রেখেছিলাম আপনার, মাধ্যমিকে লেটার নম্বর পেয়ে… বাবার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট সফল হওয়ার পরে বাবা-মায়ের সাথে এক বাক্স মিস্টি আর একটা কাশ্মিরী শাল এককণা গুরুদক্ষ্যিনা হিসেবে আপনার হাতে তুলে দেওয়ার পরে আপনার মুখে যে হাসি টা দেখেছিলাম, সেটা আজ ও আমার স্মৃতিতে অটুট…সরল খুশীতে উদ্বেল হয়ে বলেছিলেন ” শীতকালে কোনো বিয়েবাড়িতে গেলে এটা খুব কাজে লাগবে…”
শিক্ষা যে বিক্রি করা যায় না, শুধু দান করা যেতে পারে, এরকম প্রাগৈতিহাসিক তত্বের ও যে কিছু ফলোয়ার এই যুগে থাকতে পারে, সেটা গোলোকবাবু, আপনাকে দেখে মনে হয়েছিল – শ্রী গোলোক বিহারী মিশ্র!!!! আপনাকে সাষ্টাঙ্গ প্রনাম।
ঝাড়গ্রাম বা পুরুলিয়ার মত মফঃস্বল শহরে সাত ও আটের দশকে পাতি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াশুনা করে মানুষ হাওয়ার ফলে ইংরেজী টা বরাবরের মত SWAT analysis quardrant এর Weak zone এ চলে গেছে। পরবর্তী কালে চাকুরী সুত্রে বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে কাজ করতে গিয়ে যখন দেখেছি যে আমাদের অবস্থা অতটা খারাপ নয়… বরং অনেক দেশের নাগরিকদের থেকেই অনেক ভাল (বিশেষত চীনা / কোরীয়ান / ইটালিয়ান দের তুলনায়), তখন মনে বল পেয়েছি, তাও স্বস্তি পাই না কখনোই!!! শবর সিরিজের সিনেমাতে শবরের assistant এর বাজে ইংরেজী ধরিয়ে দিলেই উনি বলে থাকেন – “কি করব স্যার, জগবন্ধু ইন্সটিটিউটের ছাত্র তো!!” এক্কেবারে আমার মনের কথা…
ক্লাশ টেন বা ইলেভেন এ পড়ার সময়, হঠাত কি করে যেন স্কুলের “ভাল” ছেলেদের মধ্যে একটা রব উঠেছিল যে আই আই টি জন্য তৈরী হওয়া দরকার। পুরুলিয়া জিলা স্কুলের স্যার কে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – ” স্যার কি করে আই আই টি র জন্য তৈরী হব?”
সেই জামানায়, পুরুলিয়ার মত শহরে, যেখানে দিনের কাগজ আমরা পেতাম সন্ধ্যেবেলা (কলকাতা থেকে একটাই ট্রেন এসে পৌছালে) স্যারেরাও যে খুব আপ টু ডেট থাকতে পারতেন, তা মনে হয় না….. তবে স্যার আমাদের উপদেশ দিয়েছিলেন যে আই আই টি তে চান্স পেতে গেলে রেজনিক হ্যালিডে র বই পড়তে হবে… । যেন গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছি, এই ভান নিয়ে আমরা কয়েকজন খুব উৎসাহ নিয়ে শহরের বই এর দোকানগুলোয় দৌড়ালাম বই টার খোজ নিতে…. সেখানে গিয়ে শুনলাম যে বই টা কলকাতা থেকে আনানো যেতে পারে, কিন্তু বই টি নাকি ইংরেজী তে লেখা। এদিকে আমরা অনেকে জানতামই না যে চিত্তরঞ্জন দাসগুপ্ত র বাইরে যে এরকম একটা ইংরেজিতে লেখা বই এর জগত আছে,… এক নিমেষেই আই আই টি র স্বপ্নবেলুন চুপসে গেল… আজ ও বুঝতে পারি নি যে স্যার সত্যি সত্যি ঐ কথা টা সাজেশান হিসেবে বলেছিলেন নাকি আমাদের ক্ষ্যমতা যাচাই করার পরে আমাদের অনুৎসাহিত না করে একটা অজুহাত খাড়া করেছিলেন…যাতে আমরা বেকার সময় নষ্ট না করি…যাই হোক, ইংরেজীতে লেখা ফিজিক্স বই পড়ার চাপ নেওয়া যাবে না বুঝে আই আই টি চলে গেল স্বপ্নের বাইরে…
(২)
বিই কলেজের কলেজের প্রথম দিন, হসপিটালের সামনে সম্ভবত কোনো ফর্ম ফিল আপ করার লাইনে…সবাই র্যাগিং এর ভয়ে কাঁপছি, শিবপুরের সেই বিখ্যাত /কুখ্যাত ‘র্যাগিং’ কি জিনিষ তার ট্রেলার চালু হয়ে গেছে। আপনি এলেন সীনে। চারদিকে সন্ত্রস্ত ফিসফিসানী শুনলাম ‘টম’ এসেছে…চারদিকে শুধু ‘টম…টম.’.. শুধু একটা গলার আওয়াজ, আর সব সিনিয়র দাদা/দিদিরা এক নিমেষে ফাঁকা। সেদিনই কেমন যেন বুঝে গেলাম যে শিবপুরের ডন কে?
এর দুদিন পরে ম্যাথমেটিক্সের প্রথম ক্লাসে আপনি এসে আমাদের সাথে কোনো কথা না বলে, কোনো কাগজ না দেখে বোর্ডে লিখতে আরম্ভ করলেন। আপনার লেখা শেষ হয়ে দেখলাম আপনি লিখেছেন pi = 3.1415926535897932384626433832795028841971….আজও জানি না আপনি কি করে ওই ডিজিট গুলো মনে রাখতেন!! তবে এটুকু বলতে পারি, আপনার উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল…আমরা সবাই খুব ইম্প্রেসড হয়ে গিয়েছিলাম!!
অনেক বাঁদরামো করেছি আমরা। ক্যাম্পাসের সেকেন্ড গেট দিয়ে আসাযাওয়ার রাস্তায় হোস্টেলের পাশেই ছিল আপনার কোয়ার্টার। কলেজ ছুটি পড়ার দিনে, আমরা যারা হাওড়া/শিয়ালদার কাঞ্চনজঙ্ঘা বা পুরুলিয়া এক্সপ্রেস ট্রেন ধরতাম, সেই খুব ভোরে আমাদের কয়েকজন সেকেন্ড গেট দিয়ে বেরনোর ঠিক আগে আপনার ব্যালকনিতে টাইমার ফিট করা চকোলেট বোম (ধুপকাঠি লাগানো) লাগিয়ে পালাতাম …ভোরবেলায় ওই ভাবে আপনাকে বিরক্ত করে আমরা তখন আনন্দ পেলেও আজ বুঝি, ওটা আমাদের উচিত ছিল না….প্রফেসর টিএম (বা টম, প্রফেসর তপেন্দ্র নাথ মৌলিক), আমাদের আজ ক্ষমা করে দেবেন।
(৩)
অনেক যুগ ধরে চলে আসা ছাত্রদের দেওয়া আপনার ডাকনামটা শুধু আপনার মেয়ে (আমাদের ক্লশমেট) বৈশাখীই নয়, আপনি ও মেনে নিয়েছিলেন, হয়ত নিজের অজান্তেই, খুব sportingly. বাড়ী তে একটা রাশভারী ব্যাক্তিত্ব নিয়ে থাকতে ভালবাসতেন…অবশ্য আমরা যে কজন আপনার বাড়ীটাকে রীতিমত আড্ডাখানা বানিয়ে ফেলেছিলাম (অবশ্যই মাসীমার স্নেহমিশ্রীত আশকারায়), তারা কোনোদিনই খুব একটা পাত্তা দিতাম না ওই সব রাশভারী কথায়। খুব অল্পদিনেই বুঝে গিয়েছিলাম যে ওই রাশভারী ব্যাক্তিত্বের পেছনে একটা খুব সহজ সরল মানুষ লুকিয়ে আছে, যিনি সারাক্ষন কথা বলতে ভালোবাসেন… অন্যরা কিছুক্ষন কথা বলার পরেই আমরা দেখতাম আমাকে সামনে রেখে কিছু না কিছু বাহানা খুঁজে নিয়ে চলে গেছেন সামনে থেকে। মেকানিকাল এর ছাত্র না হলেও আপনার থেকে মেকানিক্যালের ছেলেদের কত কীর্তিকলাপ শুনতাম.. অনেক জ্বালিয়েছি আপনাকে, মাসীমা কে…cold drinks বাড়ীতে ছিল না বলে জোর করে মাসীমা র থেকে টাকা নিয়ে সেকেন্ড গেটের বাইরে থেকে cold drink কিনে এনে তবে শান্তি দিয়েছিলাম!!! পাশের ঘরে এইসব চীৎকার, চ্যাচামিচি হচ্ছে, সবই শুনতে পেতেন, বুঝতেন, মেয়ের বন্ধুবান্ধব বলে হয়ত প্রশ্রয়ে সহ্যও করে নিতেন, নিজের মনে হাসতেনও হয়ত। এই সব প্রশ্রয়ের প্রতিদান বলে কিছু হয় না… শেষ আপনার সাথে দেখা সল্ট লেকের বাড়ীতে বেশ কয়েক বছর আগে…non-stop গল্প করার অভ্যেস টা তখনো বিদ্যমান…তারপরে একদিন বৈশাখীর থেকেই জানলাম আপনি অন্য জগতে পাড়ি দিয়েছেন।
প্রফেসর নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী (এন আর চক্রবর্তী) বাবা-মা আত্মীয়স্বজন ছেড়ে হোস্টেল লাইফে বাড়ির ছোয়া কিছুটা হলেও পেতাম আপনাদের কোয়ার্টারে গেলে… আপনার ও মাসীমার স্নেহ আর প্রশ্রয় কে অনেক অনেক প্রনাম…
(৪)
ঝাড়্গ্রাম/পুরুলিয়াতে ছোটবেলা থেকেই বড় হতে হতে অবশেষে আধামানুষ হয়ে বি ই কলেজের মতো একটা বিরাট কলেজে ভরতি হবার পরে অবাক হয়ে ক্লাস করতাম আর সব বিখ্যাত বিদগ্ধ পন্ডিত প্রফেসরদের লেকচার অবাক হয়ে শুনতাম। কিরকম একটা ভয় মিশ্রীত শ্রদ্ধার সাথে…একে তো ইংরেজীতে লেকচার, যার নোট নিতে নিতেই স্যারেরা পরের টপিকে চলে যেতেন …পাতি বাংলা মিডিয়ামে পড়াশুনা করা একটা মফঃস্বলের ছেলের কাছে এটা একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল…
এইভাবেই একবছর কেটে যাবার পরে আপনি যখন সার্ভে ক্লাস নিতে এলেন, মনে হলো এই তো, এতোদিনে একজন স্যার কে পেয়েছি যিনি আমাদের ভাষায় কথা বলেন বা আমাদের কথা বোঝেন…বা ভাবেন, চিন্তা করেন আমাদের মত করে…প্রথম ক্লাসেই ভালোবেসে ফেললাম আপনাকে। একজন ছাত্রদরদী শিক্ষকের প্রকৃত মানে শিখলাম স্যার, আপনাকে দেখে…কত গল্প, কত মিথ আপনাকে জড়িয়ে।
যতদূর মনে পড়ে, আমাদের সার্ভে বই এর লেখক ছিলেন Kanitkar. প্রায় ৬০০-৮০০ পৃষ্ঠার বই…তার মধ্যে Geodesic Survey” বলে একটা চ্যাপ্টার ছিলো। বেশ বিদঘুটে ব্যাপার, গ্রহতারা দের মাঝে সার্ভে করা (মানে থ্রি ডি স্পেসে)। কেন পড়তে হত এখনো যে খুব একটা বুঝেছি এরকম নয়… বেশীর ভাগটাই মাথার ওপর চলে যেত…Kanitkar এর বই তে প্রায় ১৫৬ পেজ ছিল এই চ্যাপ্টার টার…স্যার এলেন ক্লাস নিতে, ৪৫ মিনিট বোঝালেন চ্যাপ্টার টা, তারপরে একটা 5 page note distribute করলেন…পরের দিন এসে নতুন চ্যাপ্টার শুরু করে দিলেন…হঠাত আমাদের এক গাঁট পড়ুয়া বন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে একটু যেন হতাশ হয়েই প্রশ্ন করে বসলঃ “স্যার, আপনি পরের চ্যাপ্টার শুরু করে দিলেন? Geodesic Survey Chapter টা শেষ?”
– হ্যাঁ, কেন?
– কিন্তু স্যার, Kanitkar এর বইতে ত এটা ১৫৬ পেজের!!!
– ও!! তাই নাকি? তা হবে হয়ত… একটা কাজ করো…ওই ১৫৬ পাতা একটা জেমস ক্লিপ দিয়ে আটকে রেখে দিও…হস্টেলে তাস খেলে রাতে যখন চোখ থেকে ঘুম চলে যাবে, তখন মাঝরাতে ছাদে উঠে গালাগালি র প্রতিযোগিতা না করে, জেমস ক্লিপ টা খুলে ওই চ্যাপ্টার টা পড়তে বসে যেও, ৫ মিনিটের মধ্যে ঘুম পেয়ে যাবে…আর exam এর জন্য চিন্তা করার কিছু নেই, আমার ওই ৫ পেজের নোটই যথেষ্ট।
আমাদের সেই পড়ুয়া বন্ধুটির মুখটা ছিলো দেখার মত…
ফটোতে আমি ডানদিকে পিছনের সারিতে, খানিক হীরো হওয়ার চেষ্টায়। আমার ঠিক সামনেই দুই বেণী দুলিয়ে (বা ঝুলিয়ে) বৈশাখী, আর আমার পাশে ফাইল হাতে কৌশিক (কচি)
মেকানিক্যাল এর প্রফেসর এন আর চক্রবর্তীর মেয়ে বৈশাখী ছিল আমাদের ক্লাসে। সহকর্মী প্রফেসরের মেয়ে, একই ক্যাম্পাসে থাকে সেই সুবাদে স্যার ওকে চিনতেন অনেকদিন থেকেই। কদিন বৈশাখী ক্লাশে আসে নি, স্যার রোল কল করছেন- রোল নাম্বার ১২??
– ইয়েস স্যার…
– রোল নাম্বার ১৩??
– (কোনো একজন ছেলে) ইয়েস স্যার…
মাথা রেজিস্টার থেকে না উঠিয়ে) স্যার বললেন, “বাবা রা, প্রক্সি দেওয়া খুব ভাল, এতে friendship সুদৃড় হয়, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি “equality in gender”…atleast কোনো মেয়ের প্রক্সিটা আরেকজন মেয়ে কেই দিতে দিও। সবাই কে চান্স দেওয়া উচিত, তাই না??”
কোনো এক ব্যাচের গ্র্যান্ড ভাইভা হবে, দুজন ছাত্র তৈরী নয় ভাইভার জন্য, আপনার কাছে গিয়ে ভাইভাটা পেছোনোর অনুরোধ করল। আপনি বললেন, ” কি? আজ শরীর ভাল নয়? ঠিক আছে, কাল এসো এসে ভাইভা দিয়ে যেও”
– স্যার, কালকের মধ্যে কি করে তৈরী হব? সাতদিন অন্তত সময় দিন!!
– সাত দিন? আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমরাও তৈরী হয়ে নাও, আমিও এই ফাঁকে ভালো হয়ে তৈরী হয়ে নেবো!
এটা শোনার পরে ছাত্রেরা নাকি পরের দিনই এসে ভাইভা দিয়ে গিয়েছিল!!
এরকম কত শত গল্প যে আপনাকে নিয়ে আছে কে জানে… আপনি যেখানে গেছেন, সেখানে নিশ্চই এখন চারদিকে শুধু হাসির ফোয়ারা, বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, আর এখানে আমরা সবসময় গর্ব করে বলে বেড়াই, যে “আমরা প্রফেসর পি কে রায়কে (প্রদীপ কুমার রায়) দেখেছি, উনার ক্লাশ করেছি”….
File photo of Prof. PK Roy, Survey Camp 1981-82
Prof Saibal Ghosh, we affectionately used to call Saibal-da
শিবপুরে কলেজে ভর্তি হয়ে দেখি সব ক্লাসই ইংরেজিতে। প্রথম দিকে নোট নিতে সে কি ঝামেলা!! এক লাইন নোট নিচ্ছি তো দেখি স্যার তিন লাইন এগিয়ে গেছন। কি লিখব বুঝে পাই না… তার মধ্যে কিছু কিছু স্যার আবার আরো শক্ত ইংরেজী তে কথা বলতেন ক্লাসে। প্রফেসর ব্রম্ম আমাদের Soil Mechanics বা Foundation Engineering এর ক্লাস নিতে এসে কিসব সাইন ফি, কস জি এইসব বলতে আরম্ভ করলেন। কিছুই বুঝছি না, তো নোট নেব কি? তারপরে যখন বোর্ড দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম উনি কি লিখছেন, তখন বুঝলাম যে উনি ফাই কে ফি বলছেন আর জাই কে জি বলছেন। পাশ থেকে মুশকো বিজ্ঞের মতন করে মতামত দিলো “আসলে উনি অনেকদিন আমেরিকাতে ছিলেন তো..” আমি শুধু এটাই বুঝলাম না যে তাতে আমাদের কি দোষ? আমরা তো আর আমেরিকায় নেই, শুধু একটা চাকরি চাই দুবছর পরে…, তাহলে আমাদের ওপর এই অত্যাচার কেন?
আরেকজন স্যার ছিলেন, প্রফেসর তলাপাত্র, খুব কঠিন একটা বিষয় পড়াতেন (Fluid Mechanics)। তার ওপরে আবার কেউ ক্লাশে বাংলায় কথা বললে খুব রেগে যেতেন, ভয়ে আমাদের মত “জগবন্ধু স্কুল” মার্কা back benchers রা কোনো প্রশ্নই করতাম না। সত্যি বলতে আমাদের মত সাধারণ মেধার ছেলে-মেয়েরা প্রচুর চেষ্টা করতাম বিষয়টা বুঝতে, কিন্তু ব্যাপার টা অনেকটা ওই “Brief History of Time” বই পড়ার মত ছিলো। প্রথমদিকটা সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করত, তারপরে ১০ মিনিটের মধ্যেই গোটা ব্যাপারটা মাথার বেশ ওপর দিয়ে যেতে শুরু করত!!… স্বভাবতই তখন পেছনের বেঞ্চের ছেলেরা গল্প করত বা book cricket খেলত!!
একটা গল্প শুনেছিলাম আমাদের দু’ব্যাচ আগের এক সিনিয়র এর থেকে। প্রফেসর তলাপাত্র পড়াচ্ছেন, সব মাথার ওপর দিয়ে প্রচন্ড স্পীডে উড়ে যাচ্ছে, কিছুই ঢুকছে না। হঠাৎ স্যার দেখলেন দুজন অভিন্নহৃদয় বন্ধু পেছনে বসে গুজগুজ করছে। স্যার খুব রেগে গিয়ে বললেন
“hey, stand up…”
(ছেলেটি উঠে দাঁড়াল ভয়ে ভয়ে)
“what you were doing?”
মানে স্যার…কিছু না স্যার!!
“speak in english only…”
– (silence)
” speak up, else you will be thrown out of the class!! understand?”
– (enter the dragon দেখে আসা ইংরেজী accent কে নকল করে) স্যার, ইয়াম কুপিং দ্যা পিক্সার…
“what?”
– কুপিং দ্যা পিক্সার স্যার।
সেই প্রথমবার নাকি প্রফেসর তলাপাত্রকে দেখা গিয়েছিল বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায়, কেননা উনি একজন ছেলের ইংরেজি বুঝতে পারছিলেন না। অনেক পরে আরেক ছাত্র স্যারকে বুঝিয়ে বলেছিল যে আসল উত্তর টা ছিল “I am copying the picture sir!!” (what sir had drawn on the blackboard)। এর পরে অনেকে নাকি প্রফেসর তলাপাত্র কে মাঝেমাঝে বাংলায় কথা বলতে শুনেছিল!!
[প্রফেসর ব্রম্ম, প্রফেসর তলাপাত্রঃ স্যার, এই অর্বাচীন কে ক্ষমা করে দেবেন]
[প্রফেসর তলাপাত্র স্যারের সেদিনের সেই ইংরেজি বলা ছাত্রটি আজ এখন সরকারী কর্তাব্যাক্তি, ইংরেজিতে শশী থারুর কে প্রায় ধরে ফেলেছেন]
আপনারা সবাই থাকছেন স্যার!!
ভালো থাকবেন, প্রনাম…
If you have to put someone on a pedestal, put teachers. They are society’s heroes.
– Guy Kawasaki
Better than a thousand days of diligent study is one day with a great teacher.
– Japanese Proverb
খুব ভালো লিখেছিস, আরও লিখতে থাক।