ক্যানভাস
সঞ্জয় বসু, ১৯৯০ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
,,,,,,,,,(পর্ব-১)*
প্রত্যেকের জীবনের প্রথম শিক্ষা লাভ হয় যেখানে, সেই স্কুলের প্রতি একটা স্বতস্ফূর্ত ভালোবাসা ছাড়াও আরো অনেক কিছু অজান্তেই আমাদের রক্তে যে কখন কিভাবে ঢুকে পড়ে তা আমরা নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারি না। তাইতো একটা নিঃস্বার্থ ভালবাসা জুড়ে থাকে আমাদের সকলেরই এই স্কুলের সাথে, স্কুল জীবনের নানা ঘটনার সাথে।
আমি এখনো যখন আমার স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলি, তখন স্কুল জীবনের কোনো না কোনো ঘটনা আমার স্মৃতি পটে আজও ফুটে ওঠে। এইতো কালকেই যখন আমার স্কুলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, স্কুলের দিকে তাকাতেই একটা ঘরের দিকে চোখ পড়ল। আমার মনে পড়ে গেল, এটা সেই মানিক’দার ঘর। যে ঘরের মধ্যে টিফিন তৈরী করতো আমাদের সকলের মানিকদা। মানিকদা সকলেরই দাদা। বর্তমান ছাত্র থেকে প্রাক্তন ছাত্র, সকলেরই মানিকদা। টিফিন বলতে, একদিন লুচি আলুর দম তো অন্যদিন বালুসাই, বা দুটো করে নারকোলের নাড়ু, আবার কোনো দিন হয়তো ক্রীম বিস্কুট। আমাদের মফস্বলের এই স্কুলের তখন নাম ছিল বারাসাত রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়। পরবর্তীতে আমাদের এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষকের স্মৃতিতে স্কুলের নাম হয় বারাসাত পারীচরণ সরকার রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়।
যাইহোক ফিরে আসি স্মৃতির পাতায়। কি যেন বলছিলাম, ও টিফিন নিয়ে। ঐ যে ঘরটার কথা বলছিলাম, ওটাতে টিফিন তৈরী করতো মানিকদা নামের একজন ভদ্রলোক। মানিকদার সম্পর্কে অনেক ঘটনা আছে। সেই সময়ে মানিকদার একটা মোপেড গাড়ি ছিল। যেটার আওয়াজ এত জোরে হতো যে মানিকদা দু’মাইল দূরে থাকলেও সেই মোপেডের আওয়াজ আমরা দূর থেকেই শুনতে পেতাম। যারজন্য মানিকদা স্কুলে ঢুকলেই কাউকে আর বলতে হতো না কে ঢুকছে। আরও একটা বৈশিষ্ট্য ছিল মানিকদা র, যেটা হলো শীতকালে মানিকদার কালো রঙের লং কোর্ট পরে স্কুলে আসা। ঐ লম্বা কোর্টটা একজন টেনে ধরে আড়াল করতো, আর অন্য একজন টিফিনের ডেকচি থেকে টিফিন চুরি করতো। কি সরল সাধারণ আনন্দ উপভোগ করতাম। মোট কথা মানিকদা আমাদের ছাত্রদের একটা চর্চার বিষয় ছিল। আর সেই জন্যই আমরা সবাই ঐ ঘরটাকে মনে রেখে নাম দিয়েছিলাম মানিকদার ঘর। কতো টিফিন চুরির স্বাক্ষী এই সেই ঘর।
আজ মানিক দা আর বেঁচে নেই। কিন্তু সেই ঘরটা আজও মানিকদার স্মৃতিকে বহন করে চলেছে। আজ মানিক দা বেঁচে থাকলে হয়তো জোর করে কিছু খাওয়াতে নিয়ে গিয়ে সেই দিনের টিফিন চুরির পাপ কিছুটা কমাবার চেষ্টা করতাম। এই কথা ভাবতে ভাবতে একটু এগোতেই চলে এলাম একটা মাঠের কাছে। মানিকদার ঘরের বাম দিকের সামনেই মাঠটা, সেখানে রোজ ক্লাস শুরুর আগে আমরা প্রতিদিন প্রেয়ার করতাম। সব ছাত্ররা মিলে “হও ধর মেতে বীর ” বা “ধনধান্য পুষ্প ভরা”, এক একদিন এক একটা গান গাইতাম। প্রথম দিকে গান মুখস্থ না থাকলেও শুধু ঠোঁট নাড়িয়েই কোরাসে সঙ্গ দিতাম। কোরাসের এটাই সুবিধা, আর আমাদের সেই পারদর্শীতায় আমরা কোনো দিন ধরা পড়িনি।
মনে মনে সে দিনের প্রেয়ার লাইনের গানের দু কলি গাইতে গাইতে একটু এগোতেই চোখে পড়ল সেই কবেকার পুরোনো বড় অর্জুন গাছটাকে, আর তার পাশেই আজও দাঁড়িয়ে আছে ঝাউগাছের সারি। এই সেই ঝাউগাছ তলা, এখানেই, ঠিক এখানেই কতোবার আমাদের লম্বা লাইন করে দাঁড়াতে হয়েছে, দেরি করে স্কুলে এসেছি বলে। এই লাইনটাকে বলা হতো লেট লাইন। লেট হওয়ার সঠিক কারণ না বলতে পারার জন্য অনেকবার বেতের ঘা খেয়ে যখন ক্লাস রুমে ঢুকতাম, তখন প্রথম ক্লাস শুরু হয়ে যেতো। আর আমাদের অবস্থা হতো ইংরেজ আমলের ভারতবর্ষের নাগরিকের মতো। কিভাবে যে সেইসময় আমাদের বন্ধুরা আমাদের দিকে তাকাতো, তাতে মনে হতো আমরা যেন বৃটিশ অপরাধী।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছি। ডানদিকে আর একটা মাঠ। এই মাঠে পি.টি ক্লাসে কতো খেলেছি। মনে পড়ে গেল কোন একদিনের কথা। মনে হয় তখন একাদশে আছি। ফুটবল খেলা চলছে। হাতে বল লাগতে, আমাদেরই এক বন্ধু রেফারি পেনাল্টি দিয়েছে। আমাদের তখন দুদিকে ইঁট দিয়ে গোল পোস্ট করা হতো। পেনাল্টি শট আটকানো চাই। জিততেই হবে। আমাদের যা গোলকিপার তা তে গোল অনিবার্য। কি করা যায়। মাথায় বদ বুদ্ধি খাটালাম। পেনাল্টি শট নেওয়ার আগে চুপি চুপি গোল পোস্টের ইঁট সরিয়ে গোল পোস্ট ছোট করে দিলাম, আর আমাদের গোলকিপারকে বললাম এখন গোলপোস্ট ছোট করে দিয়েছি, তোকে গোল বাঁচাতেই হবে।জানিনা সেদিন আমার মন্তর গুণে না আন্দাজে আমাদের বন্ধু কিন্তু সেদিন ঐ গোলটা বাঁচিয়েছিল। আজ সেই বন্ধু ডাক্তার হয়েছে। জানিনা সে আর কোনোদিন আর কোনো ফুটবলের গোল বাঁচিয়েছে কিনা, তবে সে পরবর্তীকালে নাম করা ডাক্তার হয়ে অনেকের জীবনের গোল বাঁচিয়েছে।
সেই বন্ধুর কথা ভাবতে ভাবতে মাঠটার উল্টোদিকে তাকাতেই সামনে ঐ যে একটু দূরে যে একতলা কোয়ার্টারটা দেখতে পাচ্ছি, আজ যেটা প্রায় ভগ্ন হয়ে পড়ে আছে, সেটা ছিল আমাদের হেডমাস্টারের কোয়ার্টার। মনে পড়ে গেল শিক্ষক পরেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা। আমরা ভাগ্যবান যে, আমরা পেয়েছিলাম মহান শিক্ষক পরেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে আমাদেরে হেড মাস্টার হিসেবে। ওনার মতো আদর্শ শিক্ষক খুবই কম দেখা যায়। যদিও ঐ সময় ওনাকে আমরা মনে রেখেছিলাম ওনার আদর্শগত গুণাবলীর জন্য নয়, মনে রাখতাম ওনার পুত্র ও কন্যা’র সংখ্যার কারণে। ওনার ছিল ১০টি মাত্র মেয়ে আর ১টি মাত্র ছেলে। কত কথাই না হতো তাঁর ঐ ১১জন ছেলেমেয়ে আর ওনাকে নিয়ে। বড় হয়ে অবশ্য কেবল তাঁর আদর্শগত গুণাবলীর কথাই সবাই কে বলেছি। ছেলে মেয়ে বা অন্য কিছু আর বলতে পারিনি।
আমাদের স্কুলের পরিসরটা ছিল অনেক বড়। পাঁচিলঘেরা স্কুলের ভিতরে ছিল তিন তিনটে মাঠ। একটা বড় পুকুর। ঐ যে সামনের পাঁচিলের পাশেই যে বড় মাঠটা, যাকে বারাসাতের সবাই গভর্নমেন্ট স্কুলের মাঠ বলে জানে, ঐ মাঠের পাশেই ছিল বারাসাত সরকারি মহাবিদ্যালয়। সেই সময়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঐ পাশের কলেজে প্রায়শই ঘুরতে যেতাম। কারণটা কিছুই না। কলেজ মানে কো- এড, একসাথে ছেলে মেয়েদের ভিড়। সেই ভিড়ে গা মেলানো, কিছু পাওয়ার আশায়। তবে সেই সময়ে আমার প্রাপ্তি না ঘটলেও, পরবর্তীতে ঐ কলেজ থেকেই আমার পরম প্রাপ্তি ঘটে। আমার কমলিকা ঐ কলেজ থেকেই প্রস্ফুটিত হয়েছে।
যাক কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম। আসলে এই হচ্ছে নস্টালজিক মন। এখন এখানে তো পরক্ষণেই কোথায় হারিয়ে যায়, গন্ডীর বাইরে। কি যেন একটা ভাবতে ভাবতে একটু অন্য মনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাত্ মনে পড়ে গেল স্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কথা। এই মাঠেই হতো বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার হিট লিস্টে আমার নাম উঠলেও, চূড়ান্ত পর্বে চূড়ান্ত ব্যর্থতা নিয়েই আমি বরাবর ফিরেছি। তাতে আমার দুঃখ নেই। বিরতির সময় একটা কমলালেবুর জন্য কতো বড় লাইনে দাঁড়িয়েছি। অনেক সময় সেই লাইন টপকে কয়েকজনের আগে চলে এসেছি, একটা কমলালেবুর জন্য। ওহ! কি আনন্দ! একটা কমলালেবুর মধ্যে লুকিয়ে থাকতো কতো বড় পাওনা। আজ ঘরের ডাইনিং টেবিলে সেই কমলালেবুর ঝুড়ি থেকে কি অনায়াসে আমি সেই লেবু পেয়ে যাই। কিন্তু সেদিনের সেই লাইনে দাঁড়িয়ে পাওয়া লেবুটাতে কি যেন একটা ছিল, যেটা আমি পুরো বাজারের কমলালেবু আনলেও আজ খুঁজে পাইনা। অন্য আর একটা চাপা আনন্দ হতো এই দিনটাতে। স্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পরের দিন থাকতো ছুটি। কিন্তু এই ছুটিটা আমরা জানতে পারতাম ঐ বাৎসরিক প্রতিযোগিতার একদম শেষ লগ্নে, যখন আমাদের প্রধান শিক্ষক এই ছুটিটা ঘোষণা করতেন। প্রতিবছরই ছুটি পেয়েছি, কিন্তু ছুটি পাওয়র আনন্দটা উপভোগ করতাম ঐ বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার একদম শেষ প্রহরে। ঘোষণার সময়।
আমাদের স্কুলের মেন গেট দিয়ে সোজা ঢুকে যে বড় ঘরটা দেখা যাচ্ছে, ওটাকে সবাই আমরা হলঘর বলতাম, কারণ ঐ ঘরটা ছিল বিশাল আকারের আর এখানেই হতো আমাদের ক্লাস ইলেভেন আর টুয়েলভের কমন সাবজেক্ট বাঙলা আর ইংরেজির ক্লাস। এই দিন গুলোতে আর্টস, কমার্স, সায়েন্সের সব ছেলেরা একসাথে মিলে আমরা ক্লাস করতাম। এই ক্লাসেই হলফ করে বলতে পারি সবচেয়ে বেশি প্রক্সি দিয়েছি আমরা। অত ছাত্রের মধ্যে সামনে থেকে পেছন পযন্ত দেখা শিক্ষকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর তাই পিছনে বসে বুক ক্রীকেট বা কাটাকুটির মতো খেলা অনায়াসে চালাত পারতাম।
এই হল ঘরেই প্রতি বছর হতো সরস্বতী পূজো। মনে পড়ে গেল সরস্বতী পুজোর আগের দিনের সেই রাত জাগার কথা। রাত জেগে শরীরের যত্ন নিতে আমরা কতো ডাব চুরি করে খেয়েছিলাম। তখন ছিল শরীরে আমাদের আঠারোর তেজ, ফলে কোনো কাজকেই না বলতে পারতাম না। রাতজাগার পর বাড়ি ফিরে স্নান করে, বাড়ির সরস্বতী পুজো সেরে আবার ফিরে আসতাম আমাদের এই স্কুলে।…..আজ যে সরস্বতী পুজো। সেজে গুজে মাঞ্জা দিয়ে আমরা সেদিন আসতাম স্কুলে। আমাদের এলাকার সমস্ত স্কুলের ছেলে মেয়েদের অবাধ প্রবেশ ছিল এই দিনটাতে। কতো মেয়েদের নজরে পড়ার চেষ্টার জন্য কতো কিছুই না করতাম। যাক সেই সমস্ত ঘটনা পরে একদিন শোনাবো। কিন্তু সেই সময়ে সরস্বতীরা ছিল আমাদের অধরাই। পরে অবশ্য চেষ্টার সুফল পেয়েছিলাম ।
আর একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল সেই গাঢ় খয়েরি রঙের টিনের লম্বা শেড।এই যে হলঘর দিয়ে সোজা যে করিডোর আজও শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেটার তলায় কতদিন বাদুড়ের মতো ঝুলতে ঝুলতে মনোহর আইচকে কতোবার অনুসরণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাঞ্চনের মতো চেহারাকে কি আর মনোহর আইচ করা অতো সোজা। এই নিয়ে আরো একটা ঘটনা মনের স্মৃতিপটে ভেসে এলো। একদিন আমি অন্যান্য দিনের মতোই ঐ করিডোরের রড ধরে ঝুলছিলাম,আর পেছন থেকে আমারই এক বন্ধু এসে সোজা আমার দুটো পা টেনে ধরলো, আমি কিছু না বুঝেই সোজা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়লাম ,যার ফল স্বরূপ আমার নাক ফেটে রক্তপাত। আমি তখন মনে হয় তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। আমার সেদিনের নাকের যন্ত্রণার চেয়েও বেশি ভয় হয়েছিল বাড়িতে গিয়ে কি বলবো। যাইহোক সেদিন বাড়িতে গিয়ে মিথ্যা কথা বলে কোনো রকমে রেহাই পেলেও, ভেবেছিলাম হয়তো সেদিন আর পড়তে হবে না, কিন্তু রেহাই ছিল না সেদিনও। আদর, বকুনি এবং পড়া সবটাই ছিল সেদিনে।
আমাদের সময়ে আমরা রোজ স্কুল যেতাম, বিকেলে মাঠে যেতাম খেলতে। সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে ফিরে পড়ি বা না পড়ি বই নিয়ে বসতেই হতো। আজ যখন দেখি আমাদের ছেলে মেয়েরা চেয়ার টেবিলে বসে, খোলা ল্যাপটপের সামনে, তখন ভাবি আমাদের সময়ের সেই মাঠ….সেই বিকেলের আড্ডা …..পড়তে যাইনি বলে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে নোট জোগাড় করা … এইসব কি এদের জীবনে আজ অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেল? না কি আমরাই পিছিয়ে ছিলাম আমাদের সেই সময়ে?
বিকেলে খেলার মাঠে বন্ধুর সাথে মারপিট করাটা ছিল জলভাতের মতো। আবার, একদিন কোনো বন্ধুকে মাঠে দেখতে না পেলে ছুটে যেতাম তারই বাড়িতে, তার খবর নিতে। কি একটা অদৃশ্য টান কাজ করতো আমাদের সম্পর্কের মধ্যে। আজ সেই সম্পর্কের টান সব ক্ষেত্রেই কি রকম যেন উধাও হয়ে গেছে। আজ আর কাউকেই দেখি না বিকেলের খেলার মাঠে। কাউকে দেখি না চায়ের দোকানের টেবিলে বসতে। কেউ আসেনা বন্ধুর বাড়িতে। তার বদলে আজ দেখি বন্ধুরা মিলে কোনো মলের ফুড কোর্টে গিয়ে জড়ো হচ্ছে অথবা নেটফিলিক্স চালিয়ে বাড়িতে বসে ইংরেজি মুভি দেখছে বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে চাট করে চলেছে। আমাদের সময়ের মাঠে বসে বা ঠেকে বসে আড্ডা মারাটা অনেক বেশি সরল সোজা সাপটা হলেও ,আমরা কিন্তু অনেক বেশি অক্সিজেন পেতাম ঐ মাঠ বা ঠেক থেকে। আমার আজও মনে আছে আমি যেদিন বন্ধুদের সাথে রকে বসে আড্ডা মেরেছি, তার পরের দিন পরীক্ষা ভালো দিয়েছি। ঠেকে না গেলে পরীক্ষা ভালো হতো না। জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষার আগের দিনও আমি সেটা বজায় রেখে ছিলাম।
আমার বাড়ির একটু দূরে ছিল এক চায়ের দোকান। রোজ আজকাল পত্রিকা পড়া আর আড্ডা মারাটা ছিল আমার দৈনন্দিন জীবনেরই একটা অঙ্গ। আমরা আমাদের ভালো খারাপের অনেক কিছুই শিখতে পেরেছিলাম ঐ চায়ের দোকানের বা ঠেকের আড্ডা থেকে। আজ আমি উপলব্ধি করেছি …..আজ আমি বলতে দ্বিধা করিনা যে, প্রতিটা মানুষের উচিত চায়ের দোকানে আড্ডা মারা,,,,, প্রকৃত শিক্ষার উন্মেষ ঘটে এই চায়ের দোকানের আড্ডা থেকেই। আজ হয়তো গুগুল ঘেঁটে নিমেষেই সবকিছু পাওয়া যায়, কিন্তু গুগুল কি পারবে সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে? পারবে কি বন্ধুত্বের সঠিক মানদণ্ড ঠিক করতে? পারবে না। কারণ বন্ধুত্ব গুগুলের নির্দিষ্ট সমীকরণ মানে না, সেটা যে অন্তহীন, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সমীকরণ।
********
ক্যানভাস,,,,,,,,,(পর্ব -২)
স্কুলে যেদিন থেকে হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট পরা শুরু করলাম, সেইদিন থেকেই নিজেকে কি রকম যেন একটা কেউকেটা……মানে নিজেকে অনেক বড় বড় ভাবতে শুরু করলাম। বড় বলতে অন্য কিছু না, নিজেকে সাবালক, নিজেকে স্বাধীন ভাবতে শুরু করা। যদিও তখন আমার হাতে থাকতো না একটাও ফুটো কড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় কোনোদিন যদি বাবার কৃপাধন্যে ৫০ পয়সা পেতাম, তো সেইদিন নিজের মনে মনে কতো যে কল্পনার ছবি আঁকতাম, তা বলে বোঝানো যাবে না। কিভাবে ঐ ৫০পয়সাটা খরচ করবো, সারাদিন সেই নিয়েই ভেবে যেতাম। কি মজাটাই না হবে আজ স্কুলে গিয়ে। গণেশদার থেকে ৫ পয়সা দিয়ে হজমি কিনবো। সন্তোষ দার আইসক্রিম কতো দিন খাইনি। টুনুদার গরম ঘুগনি। হাতে আওয়াজ করা সেই খটি গরমওয়ালাকে এই কদিন ধরে আবার আসতে দেখছি। একটু খটি গরম ও খাবো।আরো কতো কিছুই না ভাবতাম ঐ নয়া আধুলির গরমে। আমি হলফ করে বলতে পারি এখনকার পিত্জা বা স্যান্ডউইচের চেয়ে অনেক অনেক বেশি আনন্দ করে খেতাম সেই ৫ পয়সার হজমি, সেঁকুল, আইসক্রিম বা খটি গরম।
স্কুল জীবনের একটা ঘটনা এই প্রসঙ্গে খুব মনে পড়ে গেল। আমি তখন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। আমাদের সাথে নভোনীল নামে এক বন্ধু পড়তো। নভোনীলের কাছে রোজই বেশ অনেক পয়সা থাকতে দেখতাম। ওর বাবা বোধহয় বড় ব্যবসা করতো। ফলে পয়সার কোনো অভাব ছিল না। আমার বাবা কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। মাসের খরচ একটা নির্দিষ্ট বাঁধা ছকের মধ্যেই করতে হতো। স্কুল জীবনে বাবা আমাদের হাতে খুব কম দিনই পয়সা দিতেন। প্রতি মাসের শেষে আমার প্রাইভেট টিউটরের মাইনেটাও পর্যন্ত বাবা নিজের হাতে করে স্যারের বাড়িতে দিয়ে আসতেন। কোনোদিন বাবার শরীর খারাপ হলে একটা সাদা মুখবন্ধ খাম, আমার হাতে দিয়ে স্যারকে দিয়ে দিতে বলতেন। সেই সময় পয়সা পেতাম না বলে বাবার ওপর রাগ হলেও পরে বড়ো হয়ে বুঝেছিলাম কেন বাবারা ছোট বেলায় ছেলে মেয়েদের হাতে পয়সা দিত না।
ছোটবেলার যে বন্ধুটার কথা বলছিলাম, সেই নভোনীলের বেশভূষা, চালচলনে ছিল পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলেদের মতো একটা অহংকারী ছাপ। দু দিন অন্তর অন্তর স্কুল ব্যাগ থেকে শুরু করে জামা ,জুতো সবই পাল্টাতে দেখতাম ওকে। সবকিছুই ছিল ঝাঁ চকচকে নতুন। টিফিনের সময় ওকে কতো কিছুই না খেতে দেখতাম। গণেশ’দার থেকে হজমি, সেঁকুল, সন্তোষ’দার থেকে কাগজের খাপ থেকে বের করা সবুজ রঙের,চ্যাপটা কাঠি লাগানো ম্যাংগো আইসক্রিম। ঘুগনি। আরো কত কি। কোনোটা ভালো লাগলে একই জিনিস দুবারও ওকে কিনে খেতে দেখেছি। একটা শেষ হলেই সোজা চলে যেতো স্কুলের গেটের কাছে। আবার কিছু একটা কিনে খেতে খেতে চলে আসতো আমাদের ক্লাস রুমে। কতো পয়সাই না খরচ করতো ঐ আধ ঘণ্টার টিফিন পিরিয়ডে। আমার ঐ সময়ের আধুলিটার দাম ওর কাছে আজকের আধুলির মতো ছিল। আমার কাছে খুব কম দিনই পয়সা থাকতো। আর থাকলেও ওর মতো অতো নয়। ফলে আমি প্রায়দিনই হাঘরের মতো তাকিয়ে থাকতাম ওর দিকে। মাঝে মাঝে লোভ সামলাতে না পেরে ওকে বলেও বসতাম খাওয়াতে। ভাবতাম বন্ধুর কাছে খেতে চাইলে কোনো অসম্মান হয় না। আমার কথা রাখতে হয়তো ও কোনো কোনোদিন খাওয়াতে রাজি হতো। আবার কোনোদিন নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখানও করে দিতো। তবে বেশিরভাগ দিনই নিরাশায় ভূগতাম। মনে আছে নভোনীল একদিন আমাকে একটা এক টাকার নোট দিয়ে সন্তোষদার কাছ থেকে দুটো আইসক্রিম কিনে আনতে বলেছিল। একটা ওর আর একটা আমার জন্য। আমাদের ঐ সময়ে এক টাকার গরম ছিল অনেক। সেইদিন আইসক্রিম খাওয়ানোর জন্য ওকে কতবার যে কুর্নিশ করেছিলাম সেটা বলার নয়।
আমাদের স্কুলের টিফিন টাইমে ফুচকা নিয়ে কাউকে কোনোদিনও বসতে দেখিনি। আদি অনন্ত কাল ধরে মেয়েরা এটা বেশি ভালোবাসে বলেই হয়তো, মেয়েদের স্কুলের সামনে ওদের বসতে দেখা যেতো। আমাদের স্কুলের অবস্থানটা ছিল দু দুটো মেয়েদের স্কুলের পাশে। অর্থাত বুকে পিঠে মেয়েদের স্কুল নিয়ে, আমাদের স্কুল স্বমহিমায় আজও বিরাজমান। পাশেই মেয়েদের যে স্কুলটা, তার নাম বারাসাত গার্লস হাই স্কুল। স্কুলটা যে জায়গায় , সেই জায়গাটার নাম শেঠপুকুর হওয়াতে এই স্কুলটা শেঠপুকুর গার্লস স্কুল বলেই বেশি পরিচিত।
অন্য আর একটা মেয়েদের যে স্কুল,তার নাম বারাসাত কালীকৃষ্ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। আমাদের স্কুলের চির প্রতিদ্বন্দ্বী। স্কুল দুটোর মধ্যে চিরকালীন রেষারেষি থাকলেও, ঐ স্কুলের মেয়েরা বরাবরই আমাদের স্কুলের ছেলেদেরই একটু বেশী পছন্দ করতো। আর আমরা ছেলেরা সেই সময়ে ওদের সামনে অস্বীকার করলেও আজ বলতে বাঁধা নেই যে আমাদের মনের বেশীর ভাগটাই জুড়ে থাকতো ঐ কালীকৃষ্ণ স্কুলের মেয়েরাই। আজও সেই ট্রাডিশন সমানে বয়ে নিয়ে চলছে এই দুই স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা।
প্রসঙ্গত বলি, এই বঙ্গের প্রথম নারী শিক্ষা মন্দির এই বারাসাত কালীকৃষ্ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। ১৮৪৭ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় ও কালীকৃষ্ণ মিত্র মহাশয়ের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। যে কাঁঠালি চাঁপা গাছের নীচে বসে বিদ্যাসাগর ও কালীকৃষ্ণ মিত্র মহাশয়েরা এই বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য মিটিং করেছিলেন, সেই গাছটি আজও স্বমহিমায় বিরাজমান। মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে, সেই কাঁঠালি চাঁপা গাছ– ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে।
যাক ইতিহাস ঘেঁটে নিজের ভাবনাকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে লাভ নেই। চলে আসি সেই স্মৃতির ফুচকার কথায়। এই কালীকৃষ্ণ স্কুলের সামনেই দুজন ফুচকাওয়ালাকে টিফিনের সময় রোজ দেখতাম ফুচকা নিয়ে বসতে। ঠেলাগাড়ির ওপর বসানো কাঁচের বাক্সে তখন ফুচকা আসতো না। ফুচকাওয়ালারা তখন লম্বা বেতের মোড়ার মতো দেখতে পায়ার ওপর লাল শালুতে মোড়া ফুচকা ভর্তি চুবড়িটা বসাতো। এখনকার মতো প্লাস্টিকের বাটিতে তেঁতুল জল দিতো না। ফুচকাওয়ালাকে ঘিরে গোল বেষ্টনীর প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিত শালপাতার পাত্র। আর এই শালপাতাতেই দিত মাটির হাঁড়ির তেঁতুল জলে চোবানো ফুচকা। পাশ থেকে প্রায়শই শোনা যেত একটু নুন কম দাও বা ঝালটা একটু বেশী দিও। আর সবার শেষে সবার মুখে একটা ফাউ ফুচকা চাওয়ার ব্যাকুল আর্তি। যে আর্ত চিৎকার আজও বাঙালি ভোলেনি। আজও বাঙালি ফাউ পেতে ব্যগ্র সর্বক্ষেত্রে। ঝুড়িতে ভর্তি ফুচকা চোখের নিমেষে কেমন যেন শেষ হয়ে যেত ওদের ছুটির সময়। এ যেন এক প্রতিযোগিতা।
এই মেয়েদের স্কুলটার প্রতি একটা বয়সকালের আকর্ষণ আমাদের ছেলেদের মধ্যে বরাবরই ছিল। আজও আছে। কতো দূর দূরান্ত থেকে ছেলেরা আজও এসে দাঁড়িয়ে থাকে এই স্কুলের সামনে রোদ, জল, ঝড়কে উপেক্ষা করে…….. তাদের প্রিয়ার একটু অমোঘ দর্শন লাভের আশায়। ফলত স্কুল টাইমে রাস্তায় সাইকেল রিকশার ভিড় হওয়াটা একটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। যদিও এই ভিড়ের জন্য মেয়েদের স্কুলের সামনে দিয়ে বাধ্য হয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যাওয়াটা বেশ উপভোগ্যই ছিল। কতো শত সাদা সবুজ বসনের নতুন নতুন মুখ মনের জায়গা খুঁজে পেতো সেই সময়। কেউ জিততো,আবার কেউ না পাওয়ার ব্যাথায় হারিয়ে ফেলতো নিজেকে। কতো কি যে ঘটে এই জীবনের রঙ্গ মঞ্চে তার হিসেব কে রেখেছে।
সেই সময়কার রোমিও’র দল ছুটির সময় তাদের প্রিয়ার পাশ দিয়ে যেতে যেতে গুজে দিত সুগন্ধি মাখানো চিঠি। তাতে থাকতো অনেক রাত জেগে তৈরী করা ভালোবাসার স্পর্শ। কেউ যদি দেখে ফেলে এই ভয় সবসময় ফুটে উঠতো তাদের চোখে মুখে। ফলে মন দেওয়া নেওয়ার সব ভাষা লিপিবদ্ধ থাকতো ঐ এক টুকরো সুগন্ধি মাখানো কাগজের প্রতিটা ছত্রে ছত্রে। আজ ভালোবাসার সেই পরশ গেছে উবে। ভালোবাসার জায়গা আজ দখল করেছে ভালোলাগায়, এ যেন এক পণ্য।
হঠাৎই আমার জানা একজন ছেলের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ছেলেটির নাম রতন। বয়স অষ্টাদশ। শীর্ণকায় গড়ণ। প্রতিদিন ঐ স্কুলের সামনে দিয়ে দিনে অন্তত দশ থেকে পনেরো বার সাইকেল চালাতো রতন। কোনো জিনিস কেনার প্রয়োজন হলে, সেই জিনিস অন্য কোথাও পাওয়া গেলেও, রতন যেতো সেখানেই যেখানে যেতে হলে ঐ স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। রতনের সমস্ত গন্তব্য স্থানের রুট ছিল ঐ স্কুলের সামনের রাস্তার ওপর দিয়ে। কাজ থাকুক বা না থাকুক, সাইকেলে স্কুলের সামনে ঘুরতেই হবে। রতন যখন সাইকেল চালিয়ে ঐ স্কুলের সামনে দিয়ে যেতো, তখন মনে হতো, ও যেন কোনো সাইকেল রেসের প্রতিযোগী। সাইকেলের গতি থাকতো বেপরোয়া, আর সঙ্গে ছিল বিভিন্ন ভঙ্গিমার ভাঁজ। রতনের সাইকেলের চাকার চলার পথের দাগ প্লট করলে সেটা আমাদের কাশ্মীর উপত্যকার মানচিত্রের মতোই দেখতে লাগবে। সার্কাসের আচ্ছা আচ্ছা জিমন্যাস্টিকসের ছেলেমেয়েরাও বোধহয় তাদের শরীরকে এতো ভাঁজ দিয়ে বাঁকাতে শেখেনি। তার ওপর রতনের গতির সংগে থাকতো সাইকেলের কর্কশ ক্রীং, ক্রীং বেলের আওয়াজ। নিজেকে সে রোমিও ভাবলেও, মেয়েরা তাকে মজা কোরে ক্রীং, ক্রীং বলেই ডাকতো।
এই ক্রীং, ক্রীং নামের পেছনেও একটা ঘটনা আছে।
ঐ সময় প্যান্টের ঘের বেশি করার একটা কম্পিটিশন এসেছিল। ঘের বেশী করে প্যান্ট বানানোটা ছিল সেই সময়ের ছেলেদের একটা ফাশন স্টেটমেনট। যার প্যান্টের ঘের যত বেশি সে নিজেকে তত রোমিও র কাছাকাছি ভাবতো। এই রতন একদিন তার ৬৫ ঘেরের প্যান্ট পরে সাইকেল চালাতে গিয়ে ঐ স্কুলের মেয়েদের সামনে সাইকেলের চেনে প্যান্ট জড়িয়ে সোজা পড়ে যায় সামনের পৌরসভার ড্রেনে। সারা গায়ে নর্দমার নোংরা মাখা অবস্থায় যখন সে ওপরে ওঠে, তখন লজ্জায় সাইকেল ফেলে কোনোরকমে ওখান থেকে উঠে পালায়। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কেউ বুঝতে পারেনি ছেলেটা কে? কিন্তু, বাড়ি এসে পরিষ্কার হয়ে আবার যখন সে ঐ স্কুলের সামনের ড্রেন থেকে সাইকেলটা আনতে যায়, তখন সবাই রতনকে চিনে ফেলে। আর সেই থেকেই কালীকৃষ্ণর মেয়েরা রতনের নতুন নামকরণ করে ক্রীং, ক্রীং। পরে রতন বেচারার এমন অবস্থা হয়েছিল যে, রতনকে কেউ আর রতন বললে চিনতো না। ক্রীং, ক্রীং বলতে হতো।
আমরা যখন একটু বড় হয়েছি। মানে গোঁফের রেখাটা সবে দেখা দিয়েছে, সেই সময়ে বিকেলে একটা রোজকার আড্ডার চল ছিল। আমরা প্রতিদিন বিকেলে অন্তত ৩০/৩৫ জন বন্ধুরা রাস্তার ধারের পোলে বসে আড্ডার আসর বসাতাম। শুধু মেয়েদের দেখা বা আওয়াজ দেওয়া নয়। অনেক বয়স্কদের পেছনে লেগেও কি যেন একটা আনন্দ উপভোগ করতাম। দোষটা হয়তো আমাদের সেই সময়ের বয়সকালের। মনে আছে একজনকে হাইটেক বলে আওয়াজ দিলেই, সে কি গালিগালাজই না করতো। ঐ গালি শোনাটাতেই ছিল আমাদের আনন্দ। আবার তার যখন কোনো বিপদ বা দরকার হতো আমরাই এগিয়ে যেতাম তার অসুবিধা দূর করতে। এই গালিগালাজ শোনাটা ছিল আমাদের কাছে একটা বিশেষ পাওয়া। একদিন আমাদের ঐ ঠেকের এক বন্ধু একজনকে ল্যাংচা বলে পালিয়ে আসতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। আর যাবে কোথায়? যাকে ক্ষ্যাপানো হতো, সে হাতে নাতে ধরে ফেলে বেদম মার দিলো। আর তার সাথে গালিগালাজ। বেচারা কোনো মতে হাত ছেড়ে পালিয়ে বাঁচে। পরদিন থেকে ঐ বন্ধুটা ল্যাংচাকে আরো বেশী করে ক্ষ্যাপাতো। তবে মাঝে মাঝে ওকে লাংচা খাওয়াতেও দেখেছি।
আর একজন ছিল হাইটেক বুড়ি। মানে হাইটেক বললেই সে ক্ষেপে যেতো। এই হাইটেক বুড়ি যেদিন গাড়ির ধাক্কায় আহত হয়েছিল, আমরাই তাকে পরম যত্নে চিকিৎসা করাই। ঐ হাইটেক বা ল্যাংচাদের সাথে আমাদের কোথাও যেন একটা বন্ধন ছিল। ওদের একদিন না দেখলে আমাদের মনটাও বিষন্নতায় ভরে যেতো।
পাড়ার সেই ল্যাংচা বা হাইটেকরা আজ আর নেই। নতুন প্রজন্ম আর কাউকে ক্ষ্যাপায় না। পাড়ার আড্ডার সেই পোলগুলো আজ বিষন্নতায় আচ্ছন্ন। আজ আর কেউ বসে না তার ওপর। আজকের যৌবনের হাতে সময় কম। তাই শূন্যতার হাহাকার যেন আজ সেই নিঃস্বার্থ আনন্দকে খুঁজে চলেছে।
*সঞ্জয় বসু। ২০.০৭.২০২১*
Add comment