বাজলো ছুটির ঘন্টা
হিমাংশু পাল, ১৯৯০ কম্পিউটার সায়েন্স
ঢং-ঢং-ঢং-ঢং-ঢং-ঢং-ঢং-ঢং…ঢং ঢং ঢং !
একনাগাড়ে মধুর ঘন্টাধ্বনি জানান দেয় স্কুলের ছুটি হয়েছে। কোনও ক্লাসে ছয় পিরিয়ডের পর, আর একটু উঁচু ক্লাসে সাত পিরিয়ডের পর। টিফিন পিরিয়ডে ছোটাছুটি, খেলাধুলা ও বন্ধুদের সঙ্গে হই-হুল্লোড়, গল্প-গুজবের পর আরো দু-তিনটে ক্লাস, কার আর ভালো লাগে? তাই শেষ পিরিয়ডের ঘন্টার জন্য সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে, কেউ কেউ ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই বইপত্র গুছিয়ে, ব্যাগ রেডি করে বসে থাকে। একটা যেন প্রতিযোগীতা, ঘন্টা শুনলে কে কত আগে স্কুলের গেট পার হবে? জিতলে প্রাইজ নেই, কিন্তু জেতার আনন্দটাই আমাদের পুরস্কার।
সকাল সাড়ে দশটার সময় স্কুলে পৌঁছে যেতাম, তখনও গেট খুলতো না। উপস্থিত ছাত্রদের সঙ্গে একপ্রস্থ খেলতে খেলতেই স্কুলের গেট খুলে যেত। হুড়ো-হুড়ি লেগে যেত কে আগে ক্লাসে ঢুকবে, কে আগে নিজেদের পছন্দের সিটে বসতে পারবে, পছন্দের বন্ধুবান্ধবীদের সাথে একসঙ্গে। সকাল দশটা পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশে স্কুলের গেটে তালা খোলার আগে ঘন্টা বাজিয়ে স্কুলের ভিতরে আসার সতর্কতা জানানো হতো। স্কুল কম্পাউন্ডে এসে তারপর নিয়মিত প্রার্থনা। আর ঠিক এগারোটা থেকে ক্লাস শুরু। প্রত্যেক পিরিয়ডের শেষে আবার ঘন্টা, এক পিরিয়ডের পর একবার, দু-পিরিয়ডের পর দুবার, এইভাবে তিন, চার পিরিয়ডের পর শোনা যেত টিফিন পিরিয়ডের মধুর ঘন্টাধ্বনি।
ঢং-ঢং-ঢং-ঢং-ঢং-ঢং-ঢং-ঢং…ঢং ঢং ঢং !
শুধুমাত্র ঘন্টা বাজিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা দিতেন যে অশিক্ষক স্কুল কর্মীটি, তিনি নিজে না যেন কত নিয়মানুবর্তিতার অভ্যাস করতেন — প্রত্যেক ঘন্টায়, প্রত্যেক মিনিটে, প্রত্যেক মুহূর্তে। তারই মধ্যে সময়ে অসময়ে কত শিক্ষকেরই কত ফাই-ফরমাশ খাটতে হয়েছে তাঁকে। কোনো শিক্ষকের নস্যির ডিবে খালি, সঙ্গে সঙ্গে ছুটতেন নদীর পারে হালদারদের দোকানে। আবার খেয়াল করে এক প্যাকেট ভার্জিনিয়া বা চারমিনার প্যাকেট নিয়ে আসতে কখনো ভুল হতো না। কোন শিক্ষকের নিত্য প্রয়োজন, দিনে একটা বা দুটো সুখ টানের। নেশার জিনিস – শিক্ষক অশিক্ষক কাউকে ছাড়ে না। নিদেন পক্ষে একটা জর্দা দেওয়া বা শুধু চুন সুপারির পান। সুতরাং স্কুলের চৌকিদারী করাই তাঁর একমাত্র কাজ নয়, কত শত লিখিত অলিখিত দায়িত্ব পালন করে গেছেন দিনের পর দিন সেই কর্মীটি। স্কুল চলাকালীন কেউ অসুস্থ হলে, ডাক্তার বসন্তবাবুর কাছে যাওয়া ও ওষুধ নিয়ে তরি ঘড়ি করে নিয়েও আসতেন তিনি। অথচ ঘন্টা বাজাতে কখনো একমিনিট এধার ওধার হতো না। তিনি কি কোনদিন টাইম মানাজেমেন্টের প্রশিক্ষণ নিয়ে ছিলেন ?
সরস্বতী পূজা, স্পোর্টস কম্পিটিশন ও স্কুলের বাষিক অনুষ্ঠানের মতো ছোট বড় সব অনুষ্ঠানেই পর্দার আড়ালে থেকে নীরবে কত ছোট বড় দায়িত্ব পালন করেছেন। পুরস্কার তো দূর অস্ত, পান থেকে চুন খসলেই রক্ষা নেই। একেবারে নিরক্ষর না হলেও অশিক্ষক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীর সামাজিক মর্যাদা কতটা ছিল জানি না। তবে আমরা ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে “দাদা” বলেই সম্মান দিতাম। ছুটির নোটিশ হাতে নিয়ে যখন দরজায় দাঁড়িয়ে শিক্ষকের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতেন তখন তাঁকে মা সরস্বতীর প্রেরিত এঞ্জেল মনে হতো।
এইভাবেই দিনের পর দিন ছুটির ঘন্টার সাথে সাথে আমরা সবাই একদিন স্কুলের পাঠ শেষ করে দেশে প্রবাসে বিভিন্ন প্রান্তে চলে গেলাম। কালের নিয়মে আমাদের অতি কাছের, অতি পরিচিত মানুষ “জহর’দা”ও কর্ম জীবনের শেষ ঘন্টা বাজিয়ে স্কুল জীবন থেকে অবসর নিলেন। দিন কাল অতিবাহিত করতে থাকেন, জীবন থেকে ছুটি নেওয়ার অন্তিম ধ্বনি শোনার অপেক্ষায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটির গল্পের নায়ক ফটিক চক্রবর্তীর মতো একদিন নিঃশব্দে বলেন, “মা, এখন আমার ছুটি মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”
আমাদের সকলকেই সেই কালের ঘন্টাধনি শুনে একদিন না একদিন জহর-দার মতো মহাকালে বিলীন হতে হবে। সেটাই শাশ্বত নিয়ম, এক সেকেন্ডেরও এদিক ওদিক হয় না কে যেন চিরন্তন বাজিয়ে চলেছে মহাজাগতিক বন্ধন থেকে ছুটির সেই অমোঘ ঘন্টাধ্বনি।
রামনগর অবিনাশ উচ্চ বিদ্যালয় – আমাদের গ্রামের স্কুল। এখানেই আমি পঞ্চম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি।
Khub valo laglo .jhar phuk o korto.as a kobiraj janto