প্রণমি চরণে তোমার
চন্দন গুহ, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর
গুরু রেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।
হাজার হাজার বছর ধরে ভারতে শ্রাবণ মাসে পূর্ণিমার দিন, গুরু পূর্ণিমা উপলক্ষে গুরুকে প্রণাম করার রীতি চালু ছিল। তখন গুরুগৃহে থেকেই বিদ্যা অর্জনের প্রথা ছিল, এই মন্ত্র উচ্চারণ করে শিষ্য বা ছাত্ররা গুরুদেবকে শ্রদ্ধা জানাতেন।
উপরের বৈদিক মন্ত্রের অর্থ হলো:
গুরুকে সর্বশক্তিমান ত্রিদেব, ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশের সাথে তুলনা করা হয়েছে। গুরুর কাছে শিক্ষা ব্রহ্মার মত সৃজনশীল হবে, বিষ্ণুর মত রক্ষক হবে আর মহাদেবের মত দুষ্টের বিনাশকারী হবে। এমন গুরুকে আমি প্রণাম করি।
শিক্ষাগ্রহণকারীর গুরুর প্রতি এমন পূর্ণ সমর্পণ আর কোথাও দেখা যায় না। তবে কেনোপনিষদের শান্তি পাঠ পর্বে দেখা যায় যে শুধু শিষ্য নয়, গুরুও কামনা করেন যেন উভয়েই সমান ভাবে শিক্ষা লাভ করে উপকৃত হন।
ওঁ সহ নাববতু, সহ নৌ ভুনক্তু, সহ বীর্যং করবাবহৈ,
তেজস্বি নাবধীতমস্ত, মা বিদ্বিষাবহৈ ।
ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ
এই মন্ত্রের মূল অর্থ ব্রহ্ম আমাদের উভয়কে সমান ভাবে রক্ষা করুন ও তুল্যভাবে বিদ্যাফল দান করুন; আমরা যেন সমান ভাবে বিদ্যালাভের সামর্থ অর্জন করতে পারি; আমাদের উভয়েরই বিদ্যা সফল হোক, আমরা যেন পরস্পরের বিদ্বেষ না করি।
ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।
শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরু শিষ্যর এমন সাযুজ্য পূর্ণ সমর্পণ অভাবনীয়। এইরূপ মনোভাব নিয়েই গুরু-শিষ্য যুগ যুগ ধরে ভারতে শিক্ষার আদান প্রদান করে সমাজের অশেষ উপকার করে গেছেন।
আধুনিক কালে শিক্ষার প্রচার, প্রসার, আর পদ্ধতির পরিবর্তনের ফলে গুরু-শিষ্যর সম্পর্কের অনেক রকমফের দেখা যায়। গুরুর ঘরে আর কোন শিষ্য বিদ্যা অর্জন করতে যায় না। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সবাই বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বা অধ্যাপকের কাছে শিক্ষালাভ করেন। গুরু এখন শিক্ষক, শিষ্য এখন ছাত্র, সম্পর্ক এখন ছাত্র শিক্ষকের।
বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষকের অবদান যে অপরিসীম তা সবাই স্বীকার করেন। পরিবারের পর বিদ্যালয়ে শিক্ষক বা অধ্যাপকের সাথেই ছাত্ররা সবথেকে বেশি সময় ব্যয় করে। স্বাভাবিক ভাবেই বলা যায়, ছাত্র বা তরুন মনের বিকাশের একটা বিরাট অংশ শিক্ষকরাই তৈরী করেন। সমাজের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা মহৎ কাজ শিক্ষকরা করেন বলেই আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দিনকে নিজেদের মতো শিক্ষক দিবস পালন করেন। ভারতে শিক্ষক দিবস পালন হয় ৫ই সেপ্টেম্বর, পৃথিবীর অন্য বহু দেশ পালন করে ১০ই অক্টোবর, ইউনাইটেড নেশন এর প্রথা মেনে।
৫ই সেপ্টেম্বর আমাদের দেশে শিক্ষক দিবস হিসেবে উদযাপন করার একটি কারন আছে। ১৯৬২ সালে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহন করেন। ধর্ম ও দর্শন শাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ডঃ রাধাকৃষ্ণন প্রথম জীবনে মাদ্রাজ, মহীশূর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বছর অধ্যাপনা করেন। রাষ্ট্রপতি হবার পর তাঁর গুণমুগ্ধ ছাত্ররা ৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সালে তার জন্মদিন পালন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যে ব্যক্তি এক সাধারণ অধ্যাপক হিসেবে জীবিকা শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি পদে উন্নত হয়েছিলেন, তাঁর জন্মদিন পালন করার দাবী খুবই যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু,অমায়িক ডঃ রাধাকৃষ্ণন ৫ই সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন পালন না করে, ঐ দিন শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করতে বলেন, যাতে সমগ্র শিক্ষক, অধ্যাপক সকলেই সম্মানিত বোধ করেন। তাই ৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬২ সাল থেকে আজও ভারতে শিক্ষক দিবস পালন হয়।
আমার শিক্ষক, প্রাথমিক স্কুলে
গত শতকের ছ’য়ের দশকের কথা, মানে ছটি দশক অতিক্রান্ত। সেই দিনে স্কুলের বাস ছিল না, ইউনিফর্ম ছিল না, না দরকার ছিল টিফিন নিয়ে যাবার। পড়ার এত প্রতিযোগিতাও ছিল না। স্কুলের পড়া ও শিক্ষকের বেতের উপর গার্জিয়ানের এমন অগাধ ভরসা ছিল যে ছাত্র পাস করবেই। বেলঘরিয়ার উদয়পুর আদর্শ বিদ্যালয়ে (২ নম্বর শাখা) আমার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল। পাশেই ছিল ১নম্বর শাখা। একদম পাশাপাশি কেন দু’খানা স্কুল, কেউ জানে না! স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন অনিলা দত্ত। লম্বা, একটু ভারী চেহারার, কিন্তু খুব দ্রুত চলাফেরা করতেন। গম্ভীর মেজাজের ছিলেন বলে ওনার ক্লাসে বিশেষ গোলমাল হতো না। একবার গল্পের ছলে দার্জিলিং নিয়ে অনেক কিছু বলার পর গোটা চারেক শব্দের বানান লিখতে বলেন যার মধ্যে দার্জিলিং শব্দও ছিল। কেউ একজন দার্জল লিখেছিল বলে খুব বকাবকি করেছিলেন, পরে বেশ মজাও করা হয়েছিল।
অনিলা দি পরে শুনেছিলাম কাছের অন্য সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াতে চলে যান।
অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন জীতেন রায়। লম্বা, মিশকালো গায়ের রং, প্যান্ট শার্ট পড়তেন। তাঁর ক্লাস বেশ ভয়ের ছিল। চক ডাস্টারের সাথে একটা বেত নিয়ে ক্লাসে আসতেন। কেউ অঙ্ক না পারলেই বেত চলতো। হাতের তালু, পিঠে কত যে বেতের ঘা পড়েছে তার হিসেবই নেই। সব চাইতে বেশি বেত খেতো ওনার নিজেরই ভাই বিধান। বিধান বলতো,”আর বলিস না, দাদা বাড়িতেও বেত মেরে, জুলফি টেনে প্রাণ বের করে দিচ্ছে”। বেচারা বিধান অঙ্কে বেশ অপটু ছিল।
বাংলার আরও একজন শিক্ষিকা ছিলেন অলকা মিত্র, ইনিও বেশ লম্বা, ফর্সা, লম্বা চুল। তখন আমরা শিশু, সব কিছু না বুঝলেও এই টুকু বুঝতাম কে দেখতে সুন্দর। অলকাদি সুন্দর দেখতে ছিলেন। একবার অলকাদি একজন কে উহ্য শব্দের বানান বলতে বলেন,সে উ জয় য ফলা দিয়ে শুরু করে না পারলে পরের জনকে জিজ্ঞাসা করেন, সেও না পারলে এক এক করে সবাইকে বলতে বলেন,না পারলে বেঞ্চে দাঁড় করালেন। শেষে ফাষ্টগার্ল সুপ্তি রায় সঠিক বানান বললে “উ, উ হ য ফলা”। পরের শব্দটি ছিল কুজ্বটিকা। (এই কুজ্বটিকা বানান করা নিয়ে গল্পও আছে)। এবার সবাই ধরাশায়ী হলে অলকাদি রাগে মুখ লাল করে ক্লাস ছেড়ে চলে যাবার আগে শাসিয়ে গেলেন যে পরের দিন এসে আবার বানান ধরবেন, না পারলে আর রক্ষা নেই। আশ্চর্যজনক ভাবে পরের দিন অলকাদি সব সোজা সোজা বানান ধরেছিলেন, আর আমরাও রক্ষে পেয়েছিলাম।
এক জন শিক্ষক ছিলেন, সবাই বলতো বুড়ো মাষ্টারমশাই, নাম আর মনে নেই। উনি ক্লাসে এলেই কয়েকজন ছাত্রছাত্রী তাঁর চেয়ারের কাছে গিয়ে কেউ হাত টিপে দিতো, কেউ বা আঙ্গুল টেনে দিতো, আর বুড়ো মাষ্টারমশাই আরামে ঘুমিয়ে পড়তেন। পরে অবশ্য তিনি ক্লাস নিতেন। বুড়ো মাস্টারমশাই কী বিষয়ে পড়াতেন আজ আর সঠিক মনে নেই। মনে হয় সাধারণ জ্ঞান বিষয়েই পড়াতেন, কারন একবার প্রশ্ন করেছিলেন যে আম খেয়ে খোসা রাস্তায় ফেলে দিলে কী ক্ষতি হয়, সবাই এক সাথে বলেছিলাম যে লোকে পা হড়কে পড়ে যাবে! মাস্টারমশাই বলেছিলেন, “না, মাছি বসে খাবে, আর রোগ ছড়াবে”।
প্রাথমিক স্কুলে পড়ানোর জটিলতা কম, শিক্ষকদের খুব বেশি মেধার দরকার নেই। দরকার হলো অসীম ধৈর্যের আর শিক্ষার ট্রেনিং। এখানে পড়েই স্কুলের শেষ পরীক্ষায় তৃতীয় হয়ে একটা রহস্য রোমাঞ্চের বই উপহার পেয়েছিলাম যা বহুদিন আমার কাছ ছাড়া হয়নি।
উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক
প্রাথমিক স্কুলের গন্ডি পার হয়ে উচ্চমাধ্যমিকের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলাম। বেলঘরিয়া যতীনদাস বিদ্যামন্দির স্কুল, বাড়ির কাছেই। এখানেও স্কুল বাস, স্কুল ব্যাগ, ইউনিফর্ম, টিফিন, ইত্যাদির হ্যাপা ছিল না। পিপাসা পেলে টিউব ওয়েলের ঠান্ডা জল অঢেল পান করতাম। স্কুলে জীবনের প্রায় শেষে ইউনিফর্ম -সাদা জামা খাঁকী প্যান্ট চালু হয়েছিল। অবশ্য কেউ ফ্যান্সী ড্রেস পরে আগে স্কুলে যেতাম না।
কয়েক জন শিক্ষকের কথা বলি।
রেবতী রঞ্জন চক্রবর্তী-
স্যার ছিলেন বেশ বিচিত্র রকমের। অগোছালো জামা কাপড় পরে আসতেন, তিন চার দিনে দাঁড়ি কাটতেন না। কেমন যেন একটু আনমনা থাকতেন। উনি ক্লাস সিক্স আর সেভেনে বিজ্ঞান পড়াতেন। একদিন ক্লাসে বায়ূমন্ডল পড়াবার সময় বাতাসে যে জলীয় বাষ্প থাকে তা প্রমান করার জন্য কাঁচের গ্লাসে জলের মধ্যে দু’টুকরো বরফ ঢেলে দিলেন। কিছক্ষণ পরে গ্লাসের বাইরে ঠান্ডা জলের বিন্দু জমা হলে বীরদর্পে ঘোষনা করলেন বায়ূমন্ডলের জলীয় বাষ্পই ঠান্ডায় জমে জল হয়েছে।
এ ছাড়াও বায়ূমন্ডলে যে আক্সিজেন থাকে তা যে কোনও বস্তুর জ্বলনে সাহায্য করে সে তথ্য তিনি সুন্দর ভাবে আমাদের দেখিয়েছিলেন। একটা সমতল প্লেটে মোমবাতি জ্বালিয়ে বললেন, “দেখো যতক্ষন এই মোমবাতির প্যারাফিন থাকবে ততক্ষণ এই মোমবাতি অক্সিজেনের সাহায্যে জ্বলতে থাকবে”। এবার একটা কাঁচের বড় গ্লাস উল্টো করে সেই প্লেটের উপর রেখে দিলেন। কিছুক্ষণ পরে মোমবাতির শিখা আস্তে আস্তে নিষ্প্রভ হয়ে নিভে গেল। প্রমান হলো অক্সিজেন না থাকলে কোন পদার্থ জ্বলবে না।
একদিন স্যার ক্লাসে এসে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখলেন,”আমার দাঁতে ব্যাথা, আজ আর পড়াতে পারবো না”। এই লিখে হাতের তর্জনী ঠোঁটে রেখে সবাইকে চুপ করে বসে থাকার ইঙ্গিত করে চেয়ারে বসে রইলেন। সেদিন প্রথম বেঞ্চের ছেলেরা মহা আনন্দে কাটাকুটি খেলতে শুরু করছিল, আর পেছনের বেঞ্চের ছেলেরা কাগজের প্লেন ছোঁড়া শুরু করলে স্যার টেবিলে ডাস্টার ঠুকে সবাইকে শান্ত করেছিলেন। ক্লাস শেষের বেল বাড়লে স্যার চলে গেলেন। সেদিন আমরা বেশ মজা পেয়েছিলাম।
রেবতী স্যারকে আমরা ঠিক বুঝতে পারতাম না।
তারা প্রসন্ন চক্রবর্তী (পন্ডিত মশাই)
চক্রবর্তী স্যার আমাদের সেভেন আর এইটে সংস্কৃত পড়াতেন। ওনার ব্যাবহার খুব সহজ সরল হলেও তার পড়াবার ধরণ কিন্তু বেশ জবরদস্ত ছিল। এক এক করে সব ছাত্রদের আগের দিনের পড়া ধরতেন, না পারলেই কানমলা নয় ঝুলফি ধরে টান দিতেন। কিছুদিনের মধ্যেই সব ছাত্র ওনার এই করপোরাল পানিশমেন্টে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। একবার ক্লাসে পড়া ধরতে ধরতে উনি একেবারে এক কোনায় চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে দূরে এক ছাত্রকে পড়া জিজ্ঞেস করলে সেই ছাত্র খুব মৃদু স্বরে কি বলেছিল সেটা পন্ডিত মশাইয়ের কানে যায় নি। তিনি আর সময় নষ্ট না করে অন্য ছাত্রকে পড়া ধরার আগে বললেন,”তুই আজ ফাঁকে বাঁইচা গেলে রে”(পন্ডিত মশাই বাঙ্গাল ছিলেন)। বলা যেতে পারে সবাইকে পড়া ধরা ওনার একটা প্যাশন ছিল।
পন্ডিত মশাই পরীক্ষার খাতাও দেখতেন খুব দ্রুত। একবার ক্লাস সেভেনে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার দু’দিন পর ফার্স্ট বয় সনৎ বোস কৌতুহল বশে জানতে চেয়েছিল যে স্যার সংস্কৃত পরীক্ষার খাতা দেখেছেন কি না। স্যার বলেছিলেন হ্যাঁ, দেখেছেন। সব চাইতে বেশী কত নম্বর উঠেছে জানতে চাইলে পন্ডিতমশাই বলেন,”নব্বই এর কোঠায়”। সনৎ নিজে ঐ নম্বর পেতে পারে মনে করে জানতে চেয়েছিল কে পেয়েছে? পন্ডিত মশাই আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলেছিলেন,”উ পাইছে”। সে দিনের আনন্দ আজও ভুলি নি। আসলে আমার দিদি তখন সবে বি এ পরীক্ষা দিয়েছিল, আমাকে মুখে মুখে সংস্কৃতের শব্দরুপ, ধাতুরুপ, ব্যাকরণ শিখিয়েছিল যেটা আমার পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেতে সাহায্য করেছিল।আজ বয়েসের ভার ন্যুজ্ব,ভগ্ন স্বাস্থ সেই দিদিকে দেখে কেউ কল্পনা করতে পারবে না যে এই দিদিই একদিন আমার বাড়ির শিক্ষক ছিলেন!
অমর ভট্টাচার্য
গাট্টাগোট্টা চেহারার অমরবাবু সবসময় ইস্ত্রী করা সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পড়ে স্কুলে আসতেন। অল্প বয়সে নিশ্চয়ই ব্যায়াম করতেন, না হলে এমন বলশালী চেহারা হয় না। খুব পান খেতেন। মাঝে মাঝে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতেন যেন পানের পিক বা সুপারীর টুকরো ঠোঁটে না লেগে থাকে। আরও একটা মুদ্রা দোষ ছিল, পড়াতে পড়াতে হাতের তালু দিয়ে মুখের সামনে কোন অদৃশ্য ভাসমান ড্রসোফিলা মেলানোস্ট্রিকটাস জাতীয় ক্ষুদ্র পোকা তাড়াতেন মনে হতো। উনি আমাদের খুব ভাল বাংলা পড়াতেন, বেশ অলংকারিক ভাষা ব্যবহার করতেন।আপাত গম্ভীর হলেও বেশ রসিক ছিলেন।
একবার সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ণিমার দিনে পেপারে লিখেছিল যে দুপুর একটা নাগাদ গঙ্গায় বিশ ফুট উঁচু বান আসবে। অনেক ছাত্র প্ল্যান করলো যে চতুর্থ পিরিয়ড বাঙ্ক করে দক্ষিনেশ্বরে বান দেখে এসে টিফিনের পর আবার ক্লাসে ফিরে আসলে স্কুলে বা বাড়িতে জানাজানি হবে না, আর বেত্রাঘাতও এড়ানো যাবে। এখন সেই দিনে দ্বিতীয় পিরিয়ডে ক্লাস ছিল অমর বাবুর। নরমাল এটেন্ডেন্স, নো গোলমাল। চতুর্থ পিরিয়ডে যে স্যারের ক্লাস তিনি কোন কারনে সে দিন উপস্থিত ছিলেন না বলে অমরবাবু এলেন ক্লাস নিতে। এসে অবাক হয়ে দেখলেন ছাত্র সংখ্যা প্রায় আর্ধেক। কারন কি জানতে চাইলেন। সেই যুগে ক্লাসে সাহসী আর সত্যবাদী ছেলের অভাব ছিল না, জানানো হলো যে সবাই বানপ্রস্থে গেছে। অমর বাবু তখনই এটেন্ডেন্স খাতা আনিয়ে রোলকল শুরু করলেন, এবসেন্টদের নামের পাশে লিখলেন,বান। দুঃখের বিষয় সে দিন অত উঁচু বান দক্ষিনেশ্বরে দেখা যায় নি, হুগলি নদীর মোহনায় ডায়ন্ডহারবারে কামান দেগে ঢ়েউএর উচ্চতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অমরবাবুর আরও একটা গুণ ছিল, ভাল গান গাইতেন। স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী ও নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে উনি কিছু ছাত্রদের নিয়ে গানের মহরা দিতেন। আমাদের ব্যাচের দীপেশ রায় ভাল গাইতে পারতো বলে সেও ঐ অনুষ্ঠানে গান গাইতো। অমরবাবুর তালিমে দীপেশ এখনও বিভিন্ন নাট্ট গ্রুপে অভিনয়ের সাথে প্রয়োজনে গানও গায়।
রতন মনি সরকার
রতন স্যার ছিলেন স্লিম চেহারার প্যান্ট শার্ট পরা অল্প বয়স্ক যুবক। আমাদের দাদাদের বয়সী। আমাদের কেমিস্ট্রি পড়াতেন। হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের উঁচু ক্লাসে সাধারণত কেউ পড়া ধরতেন না, রতন স্যারও নয়। সিলেবাস শেষ করার তাড়ায় পড়া ধরে সময় নষ্ট কে করবে? স্কুলে আমাদের রেকমেন্ডেড বই ছিল সমর গুহের কেমিস্ট্রি। আমরা ক্লাসে ঐ বই খুলে বসে থাকতাম। আর যখন রতন স্যার পড়াতেন, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে দাগ দিয়ে রাখতাম। একবার কিছু একটা পড়াতে পড়াতে একটু ট্রিকি প্রশ্ন করেছিলেন যার উত্তর আমরা অনেকেই দিতে পারি নি। রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে রতন স্যার বলেছিলেন,”তোদের দ্বারা জীবনে কিছু হবে না, একটা ছেলেও ভাল রেজাল্ট করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সিএ হতে পারবিনা। ঐ স্কুল টিচারই হবি”। রতন স্যারের মনে কি তাহলে কোন ক্ষোভ ছিল যে উনি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে শিক্ষক হয়েছিলেন? স্যারের কথাটা আমাদের আরও বেশি পরিশ্রম করে পড়াশোনা করার উৎসাহ জুগিয়েছিল। আমরা কলেজে পড়ার সময় একদিন খবর পেয়েছিলাম যে রতন স্যার স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জমি জরিপ বিভাগে অফিসার পদে জয়েন করেছেন। রতন স্যার কি শিক্ষকতা ছেড়ে সরকারী অফিসার হয়ে তার পুরানো পেশা সম্পূর্ন ভুলতে পেরেছিলেন? স্যার কিন্তু আমাদের উপকারই করেছিলেন।
দীনেশ মজুমদার
নামটা মনে হলেই একটা ব্যক্তিত্বের কথা মনে হয় যা আমার মনে বহুদিন অম্লান ছিল। গৌর বর্ণ, মাঝারি উচ্চতা, সিল্কের পাঞ্জাবি ও ধুতি পরা দীনেশ স্যার আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। স্যারের অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য উনি স্কুলের কড়িডোরে দাঁড়ালেই সব ছাত্র যে যার ক্লাসে ঢুকে পড়তো! স্কুল চুপ হয়ে যেতো। ওনার নিক নেম হয়ে গিয়েছিল হল্লা গাড়ি! আর তিনি সেটা জানতেনও। স্যার আমাদের ইংরেজী পড়াতেন। ক্লাস ইলেভেনে উনি সেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অফ ভেনিস পড়িয়েছিলেন। সেই নাটকের এক একটি চরিত্র, এন্টোনিও, বেসানিও, পোর্শিয়া, সাইলক, প্রিন্স অফ মরক্কো, সব বেশ সুন্দর করে বর্ননা করেছিলেন। তারপর যখন ক্লাইমেক্স হলো পোর্শিয়া জজ সাহেবের সামনে একফোটা রক্ত না বের করে সাইলককে বললেন যে সে এন্টোনিও শরীর থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নিয়ে দেখাক, তখন আমরা সকলেই চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিলাম। তরুনী, সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী পোর্শিয়া বহুদিন আমাদের বয়সন্ধি কালের হিরোইন ছিলেন।
দীনেশ স্যারের অন্য আরও একটি পরিচয় ছিলো। উনি এক রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু স্কুল পরিচালনায় সেই রাজনীতির কোন প্রভাব কোন দিন পড়তে দেন নি। সে জন্য তাঁকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। দীর্ঘদিন দক্ষ প্রধান শিক্ষক থাকার জন্য তিনি সব দল নির্বিশেষে সবার প্রিয় ছিলেন। রিটায়ার হবার দিন প্রচুর ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকরা এসে ওনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। দীনেশ স্যার হলেন আমার দেখা একজন সেরা প্রধান শিক্ষক।
ব্যানার্জি স্যার
আমরা তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। জুলাই মাস, জোর কদমে ক্লাস চলছিল। আর ক’মাস পরে টেষ্ট পরীক্ষা হয়েই স্কুলের জীবনকে বিদায় দিতে হবে। একদিন প্রধান শিক্ষক রেগুলার অঙ্কের শিক্ষক সুব্রত স্যারের পরিবর্তে অন্য একজনকে পরিচয় করিয়ে বললেন, “ইনি আজ থেকে তোমাদের অঙ্কের ক্লাস নেবেন। সুব্রত স্যার বিটি পড়তে গেছেন। আর ইনি অঙ্কে পি এইচ ডি করা”। আমাদের মুখ থেকে শুধু বিস্ময়কর আওয়াজ হয়েছিল। স্কুলে পি এইচ ডি শিক্ষক! দূর্ভাগ্য বশত স্যারের নাম আজ আর মনে করতে পারছিনা, পদবী খুব সম্ভব ব্যানার্জি ছিল। খুব রোগা,সুরু সরু হাত, অমর স্যারের মত তাগড়া লোকের সাথে করমর্দন করলে মনে হয় ওনার হাত ভেঙ্গে যেতো। দীনেশ স্যার পরিচয় করিয়ে চলে গেলে নতুন স্যার জানতে চাইলেন ঐ দিন অঙ্কের কি ক্লাস ছিল। ট্রিগনোমেট্রিক আইডেনটিটি শুনে কে সি নাগের বই খুলে চ্যাপটারের ১ নম্বর অঙ্ক বোর্ডে সলভ্ করলেন। এই ভাবে প্রায় ত্রিশ মিনিটের ক্লাসে চ্যাপটারের সব অঙ্কই কষে দিলেন। এত দ্রুত অঙ্ক করা আমরা আগে কখনও দেখি নি। কোন অঙ্ক যদি sine formula দিয়ে না হতো,তখন বলতেন cosines formula ব্যবহার করতে। এই রকম দ্রুততার সঙ্গে ক্লাস নিতে নিতে তিন মাসের মধ্যেই আর্ধেক বইয়ের সব অঙ্ক করে দিয়ে বলেছিলেন উনি থাকলে আর দু’মাসে বই শেষ করে দিতেন। স্কুলের শিক্ষকের সব চ্যাপটারের সব অঙ্ক করে দেওয়া ছাত্রদের পক্ষে কতটা ভাল সে তর্কে গেলাম না। আমরা যারা প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়িনি, তাঁদের খুবই উপকার হয়েছিল।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষে একদিন ক্লাসের শেষে একটু আবেগ ভরা স্বরে বললেন,”ডিয়ার বয়েজ, আজ আমার শেষ ক্লাস, আমি রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজে লেকচারার পদে আগামীকাল জয়েন করতে যাব। তোমাদের আগের শিক্ষকও ফিরে এসেছেন, তিনি কাল থেকে আবার ক্লাস
নেবেন। তোমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করি”।
এমন শিক্ষক সব জায়গাতেই সমাদর পাবেন। দুঃখের বিষয়,তিনি এত অল্প দিন আমাদের পড়িয়েছিলেন যে ওনার নাম আর স্মরন করতে পারছি না। উনি ছিলেন আমার প্রিয় শিক্ষকের একজন।
শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের গুণাগুণ বিচার করা আমার ক্ষমতার বাইরে।আজ ছয় দশকের বেশি সময় পার হয়ে গেছে প্রাইমারী ও হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে শিক্ষার। শিক্ষার কিছু যদি গ্রহণ করে থাকি তবে সেটা এই সময়েই হয়েছিল, পরে যা হয়েছিল সেটা দেওয়ালে ফাইনাল লেয়ার সিমেন্ট দিয়ে প্লাস্টার আর চুনকামের মতো। শিক্ষক দিবসে এত শিক্ষক থাকতে এই ক’জন শিক্ষকের কথাই বা কেন মনে পড়লো? এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। তবে ওনাদের আচরণে ছল কপটতা ছিল না, আন্তরিকতা ছিল যথেষ্ট। ওনাদের আর একবার চরণ স্পর্শ করতে পারলে কৃতজ্ঞ বোধ করতাম।
Add comment