এমপেক স্যার
রঞ্জন চক্রবর্তী, ১৯৮০ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
হঠাৎ করেই বহুদিন পর প্রামাণিক স্যারের খোঁজ পেয়ে গেলাম। ফেসবুকে এদিক ওদিক চোখ দিতে দিতে দেখি আমাদের স্কুলের একটি ওয়েব পেজ। তাতে যোগাযোগ করার জন্য মন থেকে হারিয়ে যাওয়া বহু শিক্ষকদের কারো ফোন নম্বর, কারো বাড়ির ঠিকানা দেয়া। মুহূর্তে মনটা ফিরে গেল কয়েক দশক আগের সেই স্কুল জীবনে।
আজ শনিবার ছুটির দিন। দেরী না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে স্ত্রী করবীকে বললাম “আমি একটু বেরোচ্ছি। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যেতে পারে।” কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আমার ছোট মেয়ে তিতাস জিজ্ঞেস করল
— বাবা, কোথায় যাচ্ছ? আজ আমাদের ডিনারে নিয়ে যাবার কথা আছে। মনে নেই?
— আছে রে। ডিনারের সময়ের আগেই ফিরে আসব। যাচ্ছি এমপেক স্যারের বাড়ি।
— বাবা, কথাটা এমপেক নয়, এমপেগ – গ। পুরো কথাটা মোশান পিক্চার এক্সপার্টস গ্রুপ, বুঝেছ?
— তুই চুপ কর। এ আমাদের এমপেক স্যার। মানে পুরো কথাটা “মারব পিঠে এক কিল”। ক্লাসে অঙ্ক না পারলেই কথায় কথায় আমাদের বলতেন তাই আমরা সবাই আড়ালে ওনাকে ঐ নামে ডাকতাম।
তিতাস ভুল বুঝতে পেরে জিভ কেটে বলল
— ও হো। সরি। তা কে এই এমপেক স্যার?
— আরে উনি ছিলেন এক অদ্ভূত মানুষ। অঙ্কে, যাকে বলে তুখোড় ছিলেন আর পড়াতেনও দুর্দান্ত। আমার, আর শুধু আমার কেন, ক্লাসের প্রায় সব ছাত্রদের অঙ্ক করার নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন ওনার পড়ানোর গুণে। কিন্তু পড়ানোর থেকেও ভালো লাগত ওনার কথা। কত রকমের গল্প বলতেন এক এক দিন ক্লাসে। একদিন বললেন “বুঝলি, তোরা এত ভালো শিখে নিচ্ছিস যে সময়ের দু মাস আগেই আমার সিলেবাস শেষ হয়ে যাবে। তাই এবারে মাঝে মাঝে গল্প বলব। তোরা রাজি তো?” গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে। তাই আমরা এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। সবথেকে যেটা ভালো লাগত, আর এখন ভাবায় সেটা হল গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে সবার বাড়ির খবর রাখতেন। ওনার একটা স্টাইল ছিল। ক্লাস শেষ করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে পেছন ফিরে কাউকে না কাউকে লক্ষ্য করে একটা ভাঙ্গা চক-এর টুকরো ছুঁড়ে দিতেন আর জিজ্ঞেস করতেন নানান সংসারের কথা। কাউকে বলতেন “কিরে যতীন, তোর দিদির জ্বর সেরেছে”? অথবা কোন দিন “অ্যাই পলাশ, তোর ভাইটা হাঁটতে শিখেছে?”
— ভারি মজার মানুষ তো! কি করে এত খবর রাখতেন?
— কি জানি। আসলে অঙ্ক’র খাতা দেখার সময়েই সামান্য সামান্য কথার মধ্যে দিয়েই টেনে বের করে আনতেন পরিবারের সব কথা। কিন্তু কখনো বুঝতেই দিতেন না সেটা। আমরা বলতাম “উনি নিশ্চয়ই হাত গুনতে জানেন অথবা ওনার দৈব শক্তি আছে”। এখন আসি রে। ওনার সঙ্গে দেখা হলে ফিরে এসে বলব সব কথা। জানিনা দেখা হবে কিনা। তবু খোঁজ যখন পেলাম, যাই একবার। মনটা ভীষন টানছে রে।
— হ্যাঁ যাও। ফিরে এলে আরো শুনব তোমার ইন্টারেস্টিং স্যারের কথা। মা—, বাবা বেরোচ্ছে।
ঠিকানা খুঁজে নিয়ে স্যারের বাড়িটা বের করলাম। দরজায় বেল বাজাতেই এক মহিলা দরজা খুলে দিলেন।
— আপনাকে তো চিনলাম না
— আমি পরিতোষ। প্রামাণিক স্যার আছেন?
— আপনি কি ডাক্তার বাসু?
— না তো। আমার নাম পরিতোষ চট্টোপাধ্যায়
— ও, বাবা কারুর সঙ্গে দেখা করেন না। মানে দেখা করার অবস্থাতে নেই। ডাক্তার বাসুর আসার কথা তাই জিজ্ঞেস করলাম
— আপনি কি ওনার মেয়ে?
— না, উনি আমার শ্বশুরমশাই
— ও
ইতিমধ্যে ভেতরের ঘর থেকে স্যারের গলার আওয়াজ পেলাম। মনে হল চিৎকার করে বলছেন “কে? খোকা এলি?”
চমকে উঠলাম সেই কথা শুনে। উনি যে আমার ডাকনামটা জানতেন সেটা আমিই জানতামনা বা বুঝিনি কোনদিন! সম্বিৎ ফিরে পেলাম ওনার পুত্রবধুর কথায়। বললেন
— নিন, একবার যখন শুরু করেছেন তখন আর কোন কথা শুনবেন না। আপনাকে না দেখে ছাড়বেনও না। সমানে জেদ করবেন। ভেতরে আসুন।
ভেতরে গিয়ে দেখলাম সেই সপ্রতিভ মানুষটা আর নেই যেন। কিছুটা বয়সের ভারে কিছুটা হয়ত কোন রোগে ভুগে শরীরটা ভেঙ্গেই গেছে বলা যায়। একটা সাদা হাতা গোটানো জামা আর সাদা ধুতিকে লুঙ্গির মত করে পরে বসে ছিলেন।
কাছে গিয়ে প্রণাম করে বললাম,
— স্যার, চিনতে পেরেছেন আমাকে? আমি পরিতোষ।
— ও খোকা, এলি তাহলে শেষে?
আবেগে চুরমার হয়ে আমি বললাম “স্যার, আপনি আমার ডাকনাম জানতেন যে আর সেটা এতদিন পরেও মনে রেখেছেন ভাবা যায় না”।
এই কটা কথা বলার পর দেখলাম ওনার পুত্রবধু আমাকে ইশারায় ডাকছেন। কাছে যেতে ছলছলে চোখে বললেন,
— আমার স্বামীর ডাকনাম খোকা ছিল। উনি এক মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন প্রায় বছর খানেক হল। তারপর বাবার শরীর ও মন একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। কাউকে চিনতে পারেন না। থেকে থেকেই কাউকে দেখতে পেলে বা গলা শুনলে “খোকা খোকা” বলে ডাকেন।
এরপর আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়াইনি সেখানে। কেন জানিনা থাকতে পারছিলাম না। সেই মহিলাকে ছোট কথায় “আমি খুবই দুঃখিত” বলে এক ছুটে প্রায় পালিয়ে এলাম। ভেবেছিলাম ওনাকে এবার বলব “জানেন স্যার, আমরা আপনাকে এমপেক নাম দিয়েছিলাম। আপনি হয়ত জানেন না। সেই পুরোন দিনের মত একবার বলুন তো- মারব পিঠে এক কিল”।
মনে মনে ভাবলাম আপনি সে কথাটা বলতেনই শুধু, মারেন নি কোনদিন। কিন্তু আজ পিঠে একটা ব্যথা অনুভব করলাম যেন।
Add comment