সাহিত্যিকা

আমার প্রিয় স্যারদের কিছু কথা

আমার প্রিয় স্যারদের কিছু কথা
দীপ্ত প্রতিম মল্লিক, ১৯৮০, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
(আমার লেখা বি ই কলেজে পাঁচ বছর বই থেকে কয়েকটি পাতা- স্যারেদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য)

১৯৭৫ সালে বি ই কলেজে ঢুকলাম। দিনকয়েক র‌্যাগিং এর পর সিনিয়াররা বন্ধু ও দাদার মতো হয়ে গেলো, ফলে ভীতিটাও ধীরে ধীরে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়ে গেলো। তখন বর্ষার শেষ। শরৎের নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘ আর গঙ্গার বুক থেকে উড়ে আসা বিশুদ্ধ হাওয়া। মন যেন আপনিই ভালো হয়ে যায়।

কলেজের ক্লাসগুলি মন দিয়ে করার চেষ্টা করলাম। অংক জিনিষটা সত্যিই ভালো লাগতো। বিশেষ করে জনা দশেক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যে GST (General Student Tutorial) ক্লাসগুলো হতো তা ছিলো অসাধারণ। ডঃ বৈদ্যনাথ পাত্র আমাদের ম্যাথস পড়াতেন। অসম্ভব ভালো বোঝাতে পারতেন আর প্রতিটি ছাত্রর ওপর ছিলো তীক্ষ্ণ নজর যাতে সবাই বুঝতে পারে। আমরা প্রথম দিকে কতোভাবে ওনাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করেছি কিন্তু উনি কোনোদিনও মুহুর্তের জন্যও রাগ করেন নি- হাসিমুখে সব মেনে নিয়েছেন। উনি দুলে দুলে পড়াতেন আর ভেক্টর এ্যালজেব্রা পড়াতেন। একদিন ক্লাসে এসে দেখেন বোর্ডে বড়ো বড়ো করে লেখা “Welcome Dancing Vector”. উনি একগাল হেসে ডাস্টার দিয়ে লেখাটা মুছতে মুছতে বললেন “বা, বেশ ভালো নাম দিয়েছো তো তোমরা- ঠিক আছে এবার শুরু করা যাক।”

বৈদ্যনাথ পাত্র স্যার সেই দিনগুলিতে লিমিট, ক্যালকুলাস, ভেক্টর এ্যালজ্যাবরা, কমপ্লেক্স নাম্বার সবকিছু এমন প্রাঞ্জল করে বুঝিয়েছিলেন যা ভবিষ্যৎ জীবনে আমাদের পড়ানোয় বা জীবনের কর্মক্ষেত্রে প্রচুর কাজে লেগেছে। আমাদের ক্লাসে একজন ছিলো শান্তনু, যে তার “কেলো” নিকনেমেই পরিচিত ছিলো। কেলোর একটা দোষ ছিলো যে কোনো কিছু বুঝতে না পারলে হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ লাল করে প্রশ্ন করতো, “স্যার, এটা কি করে হলো?” অনেক জ্ঞানী গুণী স্যারও আচমকা “এটা কি করে হলো?” শুনে ঘাবড়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু ডঃ পাত্রই বোধহয় একগাল হেসে পুরো জিনিষটা আর একবার বোঝাতেন এবং কেলোকে জিজ্ঞাসা করতেন “কি, এবার বুঝতে পারলে তো?”

******

ফার্স্ট ইয়ারের অন্যান্য স্যারদের কথাও খুব মনে পড়ে। থিয়োরী বলতে ম্যাথস ছাড়া ছিলো ফিজিক্স আর কেমেস্ট্রি। আর ছিলো হিউম্যানিটিজ, যার কথা পরে বলছি। ফিজিক্স যে স্যার পড়াতেন, অসাধারণ দখল ছিলো তাঁর। যদি বলি প্রফেসর প্রবোধ চট্টোপাধ্যায়, এই নামে কেউ চিনবে না। এর কারণ ’৬০ এর দশক থেকেই তিনি বিখ্যাত ছিলেন ঘোড়া নামে। কাহিনী প্রচলিত আছে যে অনেক দিন আগে ফিজিক্স ল্যাবে একটি রেজিস্টট্যান্স বাক্স (resistance box) কিছুতেই খুলছিলো না। তখন ছাত্ররা স্যারকে বলে যে এটা খুলছে না- পালটে দিন। স্যারও অনেক চেষ্টা করে যখন বলছেন যে, “It needs at least a horse power to open”, এবং তখনই কপাল মন্দ যে বাক্সের ঢাকাটা খুলে গেলো। আর কালক্ষয় না করে উপস্থিত ছেলেরা এই সিদ্ধান্তে এলো যেহেতু ১ হর্স পাওয়ার খুলতে লাগে এবং স্যার খুলেছেন অর্থাৎ উনি ঘোড়া। সেই যে নাম চালু হলো – দশকের পর দশক ধরে ঐ একই নাম চলেছে, এবং এখনও।

স্যার খুবই ভালো পড়াতেন। আর বেশ জোর দিয়ে দিয়ে উচ্চারণ করতেন। উনি আমাদের degrees of freedom পড়াবার সময় এমনভাবে degreeeeeeeeeeeeees of freeeeeeeeeedom বলতন যে আমরা হেসে ফেলতাম। স্যার বলতেন হেসো না, পরীক্ষায় এলে হাসি বেরিয়ে যাবে। স্যার আবার মাঝে মাঝে ক্লাস টেস্ট নিতেন। ওনার পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতি ছিলো আলাদা। যার যা রোল নাম্বার তাকে তিন দিয়ে ভাগ করে অবশেষ (remainder) যদি শুন্য হয়, তাহলে কোশ্চেন সেট ওয়ান, এক হলে কোশ্চেন সেট টু, আর দুই হলে আর একটি কোশ্চেন সেট। তখন জেরক্স ছিলো না, সাইক্লোস্টাইল বলে এক ধরনের ফুটো ফুটো কাগজে টাইপ বা হাতে লিখতে হতো তারপর সেটা একটা মেশিনে, অনেকটা ছাপাখানার মতো চালাতে হতো। সাইক্লোস্টাইল কাগজে লিখলে ছোট ছোট ফুটো হতো ও তার মধ্য দিয়ে কালি ঢুকে অনেকটা ছাপানোর মতো হতো। সত্তর দশকের শেষ দিকে জেরক্স আসতে সাইক্লো সত্তর বিদায় নেয়। এ যেন এক নতুন যুগের সূচনা।

ঘোড়া স্যার প্রথম ক্লাস টেস্ট নেবেন। ছাত্রদের পরীক্ষার পদ্ধতি প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। উনি বললেন, “divide your roll no by three”, এমন সময় রঙ্গন ঢুকলো। রঙ্গনের রোল নাম্বার ওয়ান। ও ক্লাসে আসতে দেরী করেছে, ব্যাপারটা জানে না। ভাবছে স্যার ওকেই প্রশ্নটা করেছেন। সে তড়িঘড়ি জবাব দিলো, “পয়েণ্ট থ্রি থ্রি স্যার”। স্যার প্রথমটা বুঝতে পারেন নি। অন্যদিকে সবাই সমস্বরে হেসে উঠতে স্যারের মুখেও যেন অল্প হাসির আভাস দেখা গেলো।

ঘোড়া স্যারের কথা যখন এলো তখন স্যারের দু একটা গল্প না বললে ওনার কথা অসম্পুর্ণ থেকে যাবে। মনে পড়ে স্যারের প্রথম দিনটির কথা। আমরা সবাই বসে আছি ক্লাস রুমে। বিরাট ঘর, গ্যালারীর মতো থাকে থাকে বেঞ্চ। প্রায় আশি জন স্টুডেন্ট আমাদের মেক্যানিকালের। সবাই প্রচন্ড চুপচাপ, কেননা শুনেছি স্যার প্রচন্ড কড়া। সিঁড়িতে আওয়াজ শোনা গেলো- খটাখট, খটাখট- স্যার আসছেন।

একমুখ হাসি নিয়ে দন্ত বিকশিত করে স্যার এলেন। ফাইল আর অজস্র কাগজ এক হাতে আর এক হাতে চাবীর গুচ্ছ। খটাং করে চাবীর গোছাটা ডেস্কের ওপর ফেলে ঝটাস করে একশো আশি ডিগ্রী ঘুরে বললেন- brow….. ni……..an………. motionnnnnnnnnnnnnnnn” বলে আবার হাসি যেন দেখা গেলো স্যারের মুখে। আমরা স্বস্তি পেলাম। বুঝলাম, স্যার ব্রাউনিয়ান মোশোনে নির্দয় হলেও আমাদের প্রতি নয়। স্যারের পড়ানো এতো প্রাঞ্জল ছিলো যে বহু শক্ত শক্ত জিনিসও জলবৎ তরলং হয়ে যেতো। ক্লাসে কোনোরকম কথাবার্তা সহ্য করতে পারতেন না।

যখন পড়াতেন যেন হৃদয় দিয়ে পড়াতেন। স্যার আজ নেই, ওনাকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করি আরো একবার।

কলেজের বহু ছেলে- হাজারের ওপর। মুচিপাড়ায় সিনিয়ার দাদাদের হোস্টেল ছিলো ৭,৮, ৯, ১০, ১১, ১২ আর সাহেবপাড়ায় ১৪, ১৫, ১৬ (সিঙ্গল সীটেড হোস্টেলগুলি বাদ দিলে)। কেন মুচিপাড়া আর কেন সাহেবপাড়া নাম আজও জানি না। সম্ভবত বো্ধহয় ব্রিটিশ আমলে সাহেবরা যেদিকে থাকতো, সেটা সাহেব পাড়া? জানিনা, সেই কোনকাল থেকে এই নাম চলে আসছে। আজও সেই নাম অব্যহত। কলেজকে সামনে রেখে সেন্টার ধরলে পূর্ব দিক হলো সাহেবপাড়া আর পশ্চিমে মুচিপাড়া। তো এই মুচিপাড়ার ৭,৮, ৯, ১০, ১১ এই সব হোস্টলগুলোয় ঢোকার আগে কলেজের মেন রোডের ওপর দুটো কালভার্ট ছিলো। ওখানে সিনিয়ারদের, মানে সেকেন্ড, থার্ড আর ফোর্থ ইয়ারের ছেলেদের জোরদার আড্ডা চলতো। একদিন ঘোড়া স্যার প্রচন্ড গতিতে সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন, হয়তো কোনো এমারজেনসি হবে। কিছু ছেলে, যারা কালভার্টে বসে আড্ডা মারছিলো, বললো, “স্যার, দৌড়ে কোথায় যাচ্ছেন? কোনো বিপদ হয়েছে?” স্যার প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে জবাব দিলেন “হাসপাতাল”, এই বলে চলে গেলেন।
কিছু বদ ছেলে বললো “শুনলি?”
“হাঁ, শুনলাম- হাসপাতাল।”
“তাই? আমার যেন মনে হলো “স্টেবল” শুনলাম।”
আমাদের তখন আর কিছুই বলার নেই।

******

ফার্ষ্ট আর সেকেন্ড ইয়ারে একটা সাবজেক্ট ছিলো তার নাম “হিউম্যানিটিস”। ইঞ্জিনীয়ারীং এর ছাত্র, কাজেই সর্বদা একটা যেন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যতা দেখানোর সুযোগ পেলে কেউ আর আমরা ছাড়তাম না। জীবনে কোনোদিন হিউম্যানিটিস – যাকে আমরা অবজ্ঞা করে ‘হাম’ বলতাম, পড়তাম না। এমন কি পরীক্ষা দিতে গেছি কোনোদিন বই এর পাতা না উলটে। ক্লাস শুরুর আগে আমাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেতো- কারা দরজার সামনের বেঞ্চগুলোয় বসবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে পারসেন্টেজ দিয়ে পালাবে। ক্লাস শুরু হতো আশিজন নিয়ে- রোলকল হয়ে যাওয়ার পর স্যার যেই পিছন ফিরে বোর্ডে কিছু লিখতে যাবেন- দরজার সামনের একদল ছেলে পালাতো। তখন পরবর্তী দল আস্তে আস্তে সরে গিয়ে দরজার সামনের সীটে বসতো। ক্লাস যখন শেষ হতো- তখন মাত্র খান কুড়ি ছেলে ক্লাসে থাকতো। স্যার অসহায়। অনেক রকম অনুরোধ করতেন না পালাতে, আমরা যৌবনের প্রাবল্যে তা গ্রাহ্য করতাম না। অথচ কি করতাম পালিয়ে? ক্যান্টিনে বসে “হরেনদা দুটো চা আর একটা সিদ্ধার্থ (মানে খালি কাপ- তখন সিদ্ধার্থ রায় কে আমরা ব্ল্যাঙ্ক বা খালি এই চোখে দেখতাম) মানে সোজা কথায় চা আর সিগারেট ধ্বংস করা ছাড়া কিছুই করতাম না।

যাই হোক, বেশ কিছুদিন এভাবে হাম ক্লাস চলার পর একদিন স্যার গেলেন রেগে। বললেন, নেক্সট উইক ক্লাস টেস্ট। এবার থেকে মাসে একটা করে ক্লাসটেস্ট নেবো-দেখি কে পালায়।

কিন্তু আমরা হচ্ছি হবু ইঞ্জিনিয়ার। আমরা কি ক্লাস টেস্টের ভয়ে পড়বো? তাও কিনা হাম? সবাই বললাম নেভার। আমরা বুদ্ধি করে করলাম কি যে কটা চ্যাপ্টার পড়ানো হয়েছে- প্রত্যেকটার যা যা প্রশ্ন হতে পারে, সেগুলো সাদা কাগজে সুন্দর করে লিখে নিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য যেটা পরীক্ষায় পড়বে, সেটাই জমা দেবো। আমাদের মধ্যে অলিখিত চুক্তি হলো যে আধ ঘন্টা ভান করবো যেন বিরাট কিছু লিখছি যাতে স্যার বুঝতে না পারেন যে আমরা হোস্টেল থেকে লিখে এনেছি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য। যে দিন পরীক্ষা পড়লো তখন ভারত ইংল্যান্ড টেষ্ট সিরিজের পঞ্চম দিন। ভারত জিততে চলেছে। উত্তেজনাময় পরিস্থিতি। আমাদের দিব্যেন্দু ছিলো একবারে ক্রিকেট পাগল। কানে পকেট ট্রানজিসটার লাগিয়ে ক্লাস পর্যন্ত গেলো। রেডিও বন্ধ করে পরীক্ষা দিতে বসলো।

যা ভাবা গিয়েছিলো- আমরা এমন এক কোশ্চেন পেলাম, যার উত্তর আমরা লিখে এনেছি। আমরা কোশ্চেন পেয়ে খুব ভান করছি যেন বিরাট কিছু লিখছি। যে করে হোক আধ ঘন্টা কাটাতে হবে হঠাৎ দেখি দিব্যেন্দু উঠে দাঁড়ালো- হাতে উত্তরপত্র, যেটা হোস্টেল থেকে লিখে এনেছে। ক্রিকেটের উত্তেজনায় ও আর থাকতে পারেনি। তখন পাঁচ মিনিটও হয় নি। স্যার ওর উত্তরপত্রটা খুব যত্ন করে দেখে বললেন- “very fast, তুমি দু পাতা পাঁচ মিনিটে লিখে ফেললে -brilliant boy”। এই বলে স্যার মুখ তুলে দেখেন ক্লাসের সব ছেলে উঠে পড়েছে আর প্রত্যেকের হাতেই উত্তরপত্র পরিপাটি করে লেখা। ব্যাস- পরীক্ষা ক্যান্সেল। তখন নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি। সবাই দোষ দিচ্ছে দিব্যেন্দুকে। বলছে ও কেন পাঁচ মিনিটে জমা দিতে গেলো? এর ফলে যেটা হলো স্যার আর কখনো পরীক্ষা নেননি। পরীক্ষায় নাম্বারও খারাপ দেন নি।

এখন খারাপ লাগে স্যার আমাদের যতো যত্ন নিতেন, আমরা তার বিনিময়ে কেন কিছুই দিই নি।

******

মনে পরে আর এক শিক্ষক মণিদার কথা। উনি হিউম্যানিটিস পড়াতেন। তাই আমরা ওনাকে কোনো গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু স্যারের নিরলস চেষ্টার কথা ভাবলে এখন খারাপ লাগে। কি আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিলো ওনার, যাতে আমরা কিছু শিখি। উনি আমাদের হিস্ট্রি পড়াতেন। সদ্য সদ্য কলেজে জয়েন করেছেন। ওনার প্রথম ক্লাস পড়লো ইলেকট্রিক্যালে। উনি ঢুকতেই সবাই চেঁচিয়ে উঠলো “ছেড়ে দিন স্যার”। কিন্তু স্যার পূর্ব অভিজ্ঞতায় তাকে কোনো গুরুত্ব দিলেন না। সব কিছু অবজ্ঞা করে উনি ওনার প্রথম লেকচারটা শুরু করেছেন, অমনি একটি লম্বা সুদর্শন ছেলে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলো। স্যার বললেন, ‘কি হয়েছে, কাঁদছো কেন?’
“আপনার পড়ানোর স্টাইলটা এতো ভালো, আমার কান্না পাচ্ছে স্যার”।
মণিস্যার অত্যন্ত ক্রূদ্ধ হয়ে বললেন “বাঁদরামি হচ্ছে! কান্না পাচ্ছে? তোমাকে এবার সত্যিকারের কান্না পাওয়াবো, নাম কি?”
“মনিলাল স্যার”, ছেলেটি অকপটে স্যারের নামটি বললো। কান্না কিন্তু থামে না। বার বার ফোঁস ফোঁস করে কেঁদে যাচ্ছে আর বলছে, “এতো ভালো পড়ানোর স্টাইল আপনার, আমি আর পারছি না। মনিস্যার একটা কাগজে ওর নাম (মানে স্যারের নিজের নাম) টুকে বললেন, “রোল কতো?”
ছাত্রটী অবলীলায় বললো “মাইনীং ৬৬ স্যার।”
তখন মাইনীং তে ১০ জনের বেশী হতো না, স্যার সেটা জানতেন। প্রথম দিন এ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারও ছিলো না। কিছু করতে না পেরে রেগে গিয়ে বললেন “ভেবেছ কি? মনিলাল এতো শস্তা? আমি তোমাদের কোনো ক্লাস নেবো না, বেরিয়ে যাও”।
ছাত্রটি বেরিয়ে গেলো স্মার্টলি। ও আসলে থার্ড ইয়ারের সুরজিৎদা। মজা করতে এসেছিলো।
পরের দিন আবার স্যার যখন ক্লাস নিতে এলেন, দেখেন বোর্ডে বড়ো বড়ো করে লেখা, “মনিলাল is not so cheap. His price is 50 paisa- very costly.”
স্যার আস্তে আস্তে লেখাটা মুছে দিলেন। সব কিছু ভুলে আবার ইতিহাসে নজর দিলেন।

******

ইঞ্জিনীয়ারীং এর ছাত্র হিসাবে আমরা ম্যাথস সাবজেক্ট টা খুব যত্ন নিয়ে দেখতাম। পারত পক্ষে ম্যাথস ক্লাস কেউ মিস করতে চাইতাম না। ডঃ পাত্রর কথা তো আগেই লিখেছি- এ ছাড়া আরো অনেক ভালো ভালো প্রফেসার ছিলেন। তপেনদা, ডঃ বেরা এরা তো ছিলেনই, তখন ম্যাথসের হেড ছিলেন ডঃ দাসগুপ্ত। ম্যাথসে প্রভূত জ্ঞান, সব কিছুর মধ্যেই উনি ম্যাথস দেখতেন। সিনিয়াররা বলতো উনি আকাশের তারাকেও জিরো মনে করে অঙ্ক করতেন। এরকম পন্ডিত লোকেদের সমাবেশ তখন আমাদের কলেজেই ছিলো।এখনো আমরা গর্ব বোধ করি আমাদের ম্যাথস ডিপারটমেন্টের কথা ভেবে। যেভাবে আমরা লিমিট, ডিফারেন্সিয়াল ক্যাল্কুলাস শিখেছি- সেই একদম বেসিক থেকে শেখা – আমাদের দেশে যা বিরল। সেদিন যা শিখেছি আজও যেন তা মনে গেঁথে আছে।

ফার্স্ট ইয়ারে একটি চ্যাপটার ছিলো ডিরেকশনাল ডেরিভেটিভ। জিনিষটা কি ছিলো ঠিক মনে নেই- ভেক্টর এ্যালজেবরার একটি কঠিন সংস্করণ তার সাথে থ্রি ডায়মেন্সন জিওমেট্রির মিক্সচার। সেটা ছিলো হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা। তখনকার দিনে পরীক্ষার পর খাতা দেখানোর রেওয়াজ ছিলো। স্যার প্রতেকের পেপার চেক করার পর পরেই একদিন ক্লাসে সবাইকে ডেকে খাতা দিতেন। ছাত্ররা দেখতে পারতো কে কি ভুল বা ঠিক করেছে। আর কেন নাম্বার কাটা গিয়েছে।

ডঃ পাত্র জানুয়ারী মাসে একদিন ক্লাসে এলেন একগুচ্ছ খাতা নিয়ে। ম্যাথস সেকেন্ড পেপার। স্যার রোলকলের সময় এক এক করে সবাইকে খাতা দিলেন। বাদ গেলো শুধুমাত্র রোল নাম্বার ৭১- আশীষ সান্যাল। ঝকঝকে চেহারার আশীষ দুঃখ দুঃখ মুখ করে বললো “স্যার, আমার খাতা?”
“কে আশীষ? হাঁ, তোমার খাতা ভাই আমি ডঃ দাসগুপ্তর কাছে দিয়েছি।”
“কেন স্যার, আমি কি অপরাধ করেছি?” আশীষ তো অবাক।
“আরে তুমি দেখছি ডিরেকশনাল ডেরিভেটিভের অংক ইন্ট্রিগাল ক্যালকুলাস দিয়ে সলভ করেছো। আমি না তোমার স্টেপগুলো ঠিক বুঝতে পারি নি ভাই, তাই ডঃ দাসগুপ্তর কাছে পাঠিয়েছি, উনি যদি বুঝতে পারেন।”
আশীষ তো হতবাক, বললাম, “আশীষ, কি করেছিস?”
আশীষ বললো “আমিও ঠিক জানি না। অংকটা আসলে যে ডিরেকশনাল ডেরিভেটিভের বুঝতে পারি নি। আমি ভেবেছিলাম ক্যালকুলাসের অংক। তাই ভেবে আমি করেছি। আর পেন্ডুর সাথে এ্যানসার চেক করেছি। তখন কি আর জানি এটা ক্যালকুলাসের অংকই নয়?”
পেন্ডু মানে আমাদের অপুর্ব শীল, আশীষের পরেই ওর রোল নাম্বার। বেচারী আশীষ আর কি করে? পরে শুনেছিলাম ডঃ দাসগুপ্ত ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন – “দেখো, আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না, তুমি যদি বুঝিয়ে দাও, তোমায় ফুল মার্কস দেবো।”
আশীষ সবিনয়ে বলেছিলো “ছেড়ে দিন স্যার, নাম্বার লাগবে না। কিভাবে করেছি জানিনা তাই এবারে ছেড়ে দিন।”

*****

ফার্ষ্ট ইয়ারের যে সব সাবজেক্টগুলো ছিলো তার মধ্যে সবচেয়ে নতুন ধরনের সাবজেক্ট ছিলো ইঞ্জিনীয়ারিং ড্রইং। ড্রইং তখন করতে হতো ড্রইং বোর্ডে আর পারপেন্ডিকুলার লাইন টানার জন্য ছিলো টি। কাঠের তৈরী ড্রইং বোর্ড- যার সাইজ ছিলো ৮০ সেন্টিমিটার বাই ৫০ সেন্টিমিটার আর ‘টি’ র দৈর্ঘ্য ৮০ সেমি। আমাদের ডান হাতে আর বগলে বোর্ড আর বাঁ হাতে টি নিয়ে যখন ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে যেতাম তখন নিজেকে বিরাট বড়ো এক কেউকাটা বলেই মনে হতো। ইঞ্জিনীয়ারিং এর ছাত্র। তার যেন সবচেয়ে বড়ো পাসপোর্ট ছিলো ঐ যন্ত্র দুটি। এগুলি বগলদাবা করে যখন যেতাম, চেষ্টা করতাম গঙ্গার ধারের বি ই কলেজ মডেল স্কুলের পাশের রাস্তা দিয়ে যেতে, যাতে সেই স্কুলের মেয়েরা ইম্প্রেসড হয়। অতো ভারী বোর্ড, কলেজে তালা চাবী দেওয়ারও ব্যাবস্থা ছিলো, কিন্তু প্রায় পুরো ফার্স্ট ইয়ার আমরা ওই ভারী বোর্ড বয়ে বেরিয়েছি। কিন্তু দুঃখের কথা, একটাও মেয়ে বন্ধু জোগাড় করতে পারি নি। নিদেনপক্ষে কেউ ইম্প্রেসডও হয়নি। অযথা বোঝা বয়েছি।

ড্রইং সাবজেক্টটা ছিলো অনেকটা কনসেপ্টের। থ্রি ডায়মেনশন কনসেপ্ট না থাকলে একটু মুশকিল। মনে পড়ে সুজিত মোদকের কথা। সুজিত ড্রইংটা একদমই বুঝতো না। সামনের কেউ ড্রইংটা করছে, সুজিত পিছন থেকে কাঁটা কম্পাস দিয়ে ডায়মেনশনটা শূণ্যে মাপার চেষ্টা করতো- কতো বড়ো হবে লাইনটা। একদিন স্যার ধরলেন, বললেন, “কাঁটা আকাশে ধরে কি করছো?”
“স্যার, ডায়মেনশনটা ধরার চেষ্টা করছি।” সুজিত বললো।
“ডায়মেনশন কি শূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে? যাও নিজের কাজ করো।”

মনে পড়ে ড্রইং পরীক্ষার কথা। খুব শক্ত একটা ফিগার ছিলো যার থেকে প্ল্যান, এলিভেশন আঁকতে হবে। সুজিত কিছুই করতে না পেরে প্ল্যানে একটা ফুটকি আর এলিভেশনে আর একটা ফুটকি বসালো। স্যার ধরলেন, “এটা কি করেছো? এতো বড়ো জিনিষটা প্ল্যানে আর এলিভেশনে শুধু একটা ফুটকি?”
সুজিত বললো- “নীচে কি লিখেছি দেখুন?”
স্যার দেখলেন নীচে লেখা- “viewing from infinity”.
মোদককে অবশ্য স্যার জিরোর বেশি দেন নি। মোদক প্রশ্ন করতে বলেছিলেন, “নাম্বারটা ইনফিনিটি থেকে দিয়েছি, তাই দেখতে পারছো না।”

আমাদের অতো সাধের ড্রইং বোর্ড সেকেন্ড ইয়ারের পর সেই যে তালাচাবী মেরে কলেজে রইলো, আনবো আনবো করে আর আনাই হলো না। আজও সেই বোর্ড হয়তো কলেজে কোনো বেঞ্চের শোভাবর্ধন করছে। জানতে ইচ্ছে করে এখনো কি বোর্ড আছে? না কি কম্পুউটারে ক্যাড তে ড্রইং শেখানো হয়? শ্রীনিবাস স্যার, ডি দাস, এনাদের সেই ডাস্টার দেখিয়ে প্রথম প্ল্যান, এলিভেশন শেখানো- এগুলোর বদলে কম্পুউটার কতোটা উপযোগী?

ফার্ষ্ট ইয়ারের যে সব সাবজেক্টগুলো ছিলো তার মধ্যে অংক, ফিজিক্স, ড্রইং,হাম সবার কথা একটু করে হলেও বলেছি। যে সাবজেক্ট সম্বন্ধে বলা হয় নি এবার সেগুলো এক এক করে বলা যাক। থিয়োরী ও প্রাকটিক্যাল নিয়ে কেমিস্ট্র ছিলো এক অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট। আর কেমিস্ট্রর কথা বললে প্রথমেই মনে পড়ে মেটুদার কথা। স্যারের আসল নাম কি ছিলো মনে নেই। পড়াতেন ভালো কিন্তু ভগবান ওনাকে মেরে দিয়েছিলেন- উনি সিক্স বলতে পারতেন না, বলতেন টিক। সিক্স উচ্চারণ এতো দূরুহ লাগতেো ওনার কাছে- বিশেষ করে দু বার সিক্স এলে। মনে পড়ে প্রতিবার রোলকলের সময় এলে, বিশেষ করে যখন ছয় এর ঘরে রোল নাম্বার, স্যার হিমশিম খেয়ে যেতেন। টিকটি ওয়ান, টিকটি টু, এই করে হোঁচোট খেতে খেতে সিক্সটি সিক্স তে এসে মুখ থুবড়ে পরতেন- টিকটি টিক। তখন বেশ কিছু ছেলে সমস্বরে টিক টিক করে ধুয়ো তুলতো। স্যারের অপরিসীম ধৈয্য- প্রতিদিন রোল কলে ধাক্কা খেলেও উনি হাল ছাড়তেন না।

আর একজন কেমিস্ট্রি স্যারের কথা মনে পড়ছে- ডঃ শ্রীমানী। উনি আকাশের দিকে মুখটা তুলে পড়াতেন। আকাশের দিকে মুখ তুলে উদাস ভঙ্গীতে অনেক শক্ত জিনিসও সহজ করে তুলতেন।

মনে পড়ে কেমিস্ট্রর আর এক স্যার বকুদার কথা। বকুদার সব ভালো, দোষ একটাই- কথায় কথায় what is called বলা। একদিন বকুদা মনোযোগ দিয়ে পড়িয়ে চলেছেন। আর চলছে what is called বলা। সময় প্রায় শেষ- এমন সময় হঠাৎ মিতদ্রু চিৎকার করে উঠলো, “সেঞ্চুরী স্যার সেঞ্চুরী”।
“কিসের সেঞ্চুরী?”- বকুদা অবাক।
“স্যার আপনার what is called বলার”- বকুদার আর বাক্যস্ফুর্তি হলো না। চক ডাস্টার তুলে গম্ভীর ভাবে চলে গেলেন।

******

ফার্ষ্ট ইয়ারে আর একটি সাবজেক্ট ছিলো সারভে। সব ডিপার্ট্মেন্টের সব ছেলেমেয়েদেরই এটা করতে হতো। ডাম্পি লেভেল নিয়ে আমরা চলে যেতাম কলেজের সামনের মাঠ লর্ডসতে। আমাদের টীচার ছিলেন শৈবালদা। অন্য প্রফেসরদের আমরা স্যার নামে সম্বোধন করতাম। কিন্তু কেন জানিনা আমাদের ব্যাচের আগে থেকেই অনেকে উনাকে শৈবাল’দা নামেই সম্বোধন করতো। এতই কাছের মানুষ ছিলেন উনি। লেকচার টেকচার দেওয়ার পর শৈবালদা লর্ডসতে সারভে করানো শুরু করতেন। আর আমরা ডাম্পি লেভেল নিয়ে সারভের বদলে নজর করতাম মডেল স্কুলের কোন মেয়েরা যাচ্ছে ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার পালিয়েও যেতো। শৈবালদা আমাদের কি করতে হবে বুঝিয়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালানোর ধূম বেড়ে যেতো। আট জনের গ্রুপ- একদিন তার মধ্যে ছজনই গেলো পালিয়ে। এমন সময় শৈবালদা এসে হাজির। বললেন – এ কি, তোমরা দুজন, বাকীরা গেলো কই? এমন সময় দেখা গেলো বাকী ছজন আইস ক্রীম খেতে খেতে ফার্ষ্টগেট দিয়ে ঢুকছে। শৈবালদা রেগে গিয়ে বললেন, “আমি সব দেখেছি, কে সারভে করেছে আর কে বাইরে আড্ডা মেরে আসছে। পরীক্ষার নাম্বারও সেভাবে দেবো”। ইতিমধ্যে বাকী ছজনও হাজির। শৈবালদা আমাদের ওপর এতো রাগ দেখালেও যখন বাকী ছজন বললো, “স্যার, গরম লাগছিলো বলে একটু আইসক্রীম খেয়ে এলাম”, স্যার গলে জল। শুধু বললেন- বাইরে গেলে একটু বলে যেও। এভাবে হুট হাট চলে যেও না। পরীক্ষায় সবাই ভালো নাম্বার পেয়েছিলাম।

শৈবালদার কথা বারবার মনে পড়ে। মেক্যানিকালের ছাত্র হওয়াতে শৈবালদাকে এক বছরই পেয়েছিলাম, বন্ধুর মতো সবার সাথে মিশতেন। এরকম মাই ডিয়ার স্যার খুবই কম দেখেছি।

পাঁচ বছরে অজস্র স্যারকে কাছে পেয়েছি। সবার কথা লিখতে গেলে একটা আলাদা বই হয়ে যাবেো। একটা মিল ছিলো সবার মধ্যে- সবাই চাইতেন আমরা বড়ো হই, কিছু শিখি । আজ তাই উদাত্ত কণ্ঠে বুক ফুলিয়ে বলি, স্যার, যা শিখিয়েছিলেন, কিচ্ছু ভুলি নি। আর ভুলিনি আপনাদেরও।তাই সবাই কে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

******

The children are now working as if I did not exist.
-Maria Montessori.

Sahityika Admin

Add comment