আমাদের মাষ্টারমশাইরা – অন্য ভূমিকায়
স্নেহাশিস ঘোষ, ১৯৭৪ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
“মাষ্টারমশাই” মানেই কিন্তু সব সময় শুধু বই-খাতা, কাগজ-কলম আর পড়াশোনা নয়। তাঁদের পথনির্দেশনার পরিধি তারও অনেক বাইরে বিস্তীর্ণ। মনেপড়ে আমাদের মাষ্টারমশাইদের সাথে স্কুলের পুরনো দিনের কিছু ছোট ছোট ঘটনা। খুবই সাধারণ আর খুবই সাদামাটা সেই সব ঘটনা, কিন্তু সেগুলো এখনও আমাদের মনের মধ্যে থেকে গেছে।
আজকের শিক্ষক দিবসে তাঁদের সকলকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে আমার তিনজন মাষ্টারমশাইদের সাথে সেই সময়ের তিনটি ছোট্ট ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম।
ঘটনা-এক।
হাইস্কুলে আমার প্রথম দিন, প্রথম ক্লাস, প্রথম মাষ্টারমশাই!
এই সেদিনের কথা। আমার বাড়ি ‘কান্দি’ মফস্বলের (মুর্শিদাবাদের) মহকুমা শহর। প্রথমে পড়েছি প্রাইমারী স্কুলে, আমরা যাকে বলতাম পাঠশালা, নাম ‘বিমল চন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়’। সেটা শেষ করে আমি হাইস্কুলে ভর্তি হলাম, অর্থাৎ ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস ফাইভে উঠলাম। স্কুলের নাম ‘কান্দি রাজ হাই স্কুল’। নতুন স্কুল, নতুন ক্লাসরুম, নতুন বই, নতুন মাষ্টারমশাই আর বেশকিছু নতুন বন্ধুবান্ধব। প্রাইমারী স্কুলের ছোট বাড়ি থেকে হাই স্কুলের পুরোনো বাড়ির বড় উঁচু দেওয়াল দেওয়া ঠান্ডা ঘরে শুরু হয়েছিল ফাইভের ক্লাস। তখন মনে ঠিক যতটা আনন্দ ছিল, ঠিক ততটাই ছিল একটা অজানা অনুভূতির শঙ্কা। সময় তখন সকালের দশটা সবে পেরিয়েছে। একটু আগেই দিনের প্রথম ক্লাসের ঘন্টা বেজে গেছে। হাইস্কুলের ক্লাস ফাইভের সেকশন-বি, আমাদের প্রথম ক্লাস, বাংলার। একটা অজানা উত্তেজনায় আমরা সবাই অপেক্ষা করছি।
খানিক পরেই ক্লাসে প্রবেশ করলেন একজন মাষ্টারমশাই। আমাদের কলরব থামলো, আর সবাই উঠে দাঁড়ালাম। ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিহিত একজন ছোটখাটো মহাশয়। নাকের উপরে রাখা চশমা’টার ফ্রেমের উপর দিয়ে তীর্যক চাহনিতে একবার দেখে নিয়ে আমাদের বসতে বলার ইঙ্গিত দিলেন। উনার বগলে চেপে রাখা রেজিস্ট্রার’টি টেবিলের উপরে রেখে বললেন, “সবাই চুপ করে বোসো। আমি এখন এক এক করে তোমাদের নাম ধরে ডাকবো, তোমরা উঠে দাঁড়িয়ে সাড়া দেবে”। এ ব্যপারে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে পাঠশালা থেকেই, তাই বুঝতে সময় লাগলো না, এখন আমাদের ‘রোল-কল’ হবে। মনে পড়ছে না, ক্লাসে আমরা ৪০-৫০, ঠিক কত জন ছিলাম। মিনিট পাঁচেক ধরে “প্রেজেন্ট”, “উপস্থিত”, এর পালা চললো।
রোল কল শেষ করে মাষ্টারমশাই আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমাদের ক্লাসের একজনকে মনিটর হতে হবে। তার কাজ হবে প্রত্যেক ক্লাশ শুরু হওয়ার আগে ডাস্টার দিয়ে এই ব্ল্যাক বোর্ড মুছে পরিষ্কার করে রাখা, মাষ্টারমশাই এর টেবিল ও চেয়ার ঠিক জায়গায় রাখা, মাষ্টারমশাই যখন চাইবেন, সকলের কাছ থেকে হোম-টাস্কের খাতাগুলো সংগ্রহ করে টেবিলে রাখা আর মাষ্টারমশাইয়ের খাতা দেখা শেষ হলে সেই খাতা আবার সকলকে ফিরিয়ে দেওয়া। স্কুলের প্রার্থনা শেষ হলে, মাঠ থেকে মনিটর তার ক্লাসের সব ছাত্রদের লাইন করে ক্লাসে নিয়ে আসবে আর প্রতিদিন দেখবে মাষ্টারমশাই আসা অবধি ক্লাসে যেন কেউ চিৎকার চেঁচামেচি না করে”।
“এবার বলো, কে মনিটর হতে চাও, হাত তোলো”।
নতুন মাষ্টারমশাইয়ের হঠাৎ এইরকম একটা প্রস্তাবে, তাও আবার হাইস্কুলের প্রথম ক্লাসে, আমরা কেউই তাতে সায় দিতে পারলাম না, একটা সঙ্কোচ বোধ নিয়ে সবাই শুধু এর ওর মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু আমাদের কারও হাত উপরে উঠলো না।
“কি হলো, কেউ মনিটর হতে চাও না?” মাষ্টারমশাই তাঁর চেয়ার ছেড়ে দুই ধারের বেঞ্চি ও টেবিলের মাঝের ফাঁকা জায়গায় এসে এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “তা’হলে সবাই শান্ত-শিষ্ট হয়ে বসো, কেউ কথা বলবে না। আমি নিজেই তোমাদের মধ্যে থেকে একজনকে ঠিক করে দিচ্ছি, সেই মনিটর হবে”।
এবার তিনি তাঁর চশমার উপর দিয়ে সব ছাত্রদের দিকে নজর রাখতে রাখতে ক্লাসের মধ্যে চারিদিকে পায়চারী করতে লাগলেন। সে এক মজার ব্যাপার। এইভাবে মিনিট দুয়েক ধরে চললো তাঁর অনুসন্ধান।
“কি নাম?” আমার একদম পাশ থেকেই এই প্রশ্ন’টা এলো, মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম আমিই তাঁর নিশানা। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের নাম’টা বললাম। উনি আমাকে ডেকে আমার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেলেন তাঁর টেবিলের পাশে আর ক্লাসের সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “এর নাম স্নেহাশীষ ঘোষ, আজ থেকে সারা বছরের জন্যে এই ক্লাসের মনিটর থাকবে। কি কি কাজ করবে সেটা তো আগেই বলেছি। তোমরা সবাই এর সাথে সহযোগিতা করবে”।
হঠাৎ কি যে ঘটে গেলো, সেটা বোঝার আগেই মাষ্টারমশাই আমাকে নিজের জায়গায় বসতে বললেন। বসে পরলাম। আমিই কি তা’হলে তাঁর দৃষ্টিতে সব থেকে শান্ত ছেলে? ঠিক বুঝলাম না। নজরে পড়লো, উনি রেজিস্টার’টা খুলে কিছু একটা লিখে রাখলেন।
অনেককেই দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ক্লাসের বেশীর ভাগ ছাত্রই অন্যান্য প্রাইমারী স্কুল থেকে এসেছে। সবাই আমাকে চেনে না। নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা মনে হচ্ছিল। সেই শুরু, পরের বছর দুই-তিন আমি ক্লাসের মনিটর ছিলাম। হয়তো ক্লাশ ফাইভের সুবাদেই সেটা চলে আসছিল। যাইহোক, হাইস্কুলের প্রথম দিনে, প্রথম ক্লাসের এই ঘটনা’টা এখনও মনে আছে। তবে এটা ঠিক মনে নেই যে সেই ক্লাসে বাংলার কোন বই’টা দিয়ে উনি আমাদেরকে পড়াতে শুরু করেছিলেন অথবা আদপেই সেদিন তিনি আমাদের কিছু পড়িয়ে ছিলেন কিনা। কিন্তু এটুকু ঠিক মনে আছে, প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসের মাঝখানে ক্লাসের বড়সড় উঁচু দরজা দিয়ে ছোটখাটো, শীর্ণ, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত ধোপদুরস্ত, বয়স্ক একজন ব্যক্তি ক্লাসের মধ্যে এসে প্রথমে মাষ্টারমশাই এর সঙ্গে কিছু কথা বললেন। বুঝলাম, উনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রী তারাপদ বড়াল। তারপরে উনি আমাদের ক্লাসের ছেলেদেরকে উদ্দেশ্য করে দু-চারজন’কে দু-চার’টে কথা জিজ্ঞেস করলেন, যেমন, কোন্ প্রাইমারি স্কুল থেকে এসেছে, কোথায় বাড়ি, সেই স্কুলের হেড মাষ্টারমশাই এর কি নাম, এই রকম আর কি। পরে বললেন, তোমরা জানো তো ইনি দীনেশ বাবু, এই স্কুলের অনেক পুরোনো মাষ্টারমশাই, তোমাদের বাংলার ক্লাস নেবেন। কেউ ওঁকে বিরক্ত করবে না, ভালো করে মন দিয়ে সবাই পড়াশোনা করবে”। এই বলে উনি করিডোরের ওপাশের ক্লাস ফাইভের এ-সেকশনে চলে গেলেন। বুঝলাম এই দুই ক্লাসে তাঁর এই অকস্মাৎ পরিদর্শনের উদ্দেশ্য ছিল, শুধু এই নতুন ছাত্রদের সাথে পরিচিত হওয়া।
সেদিন আরও কিছু ক্লাস করেছিলাম, কিন্তু এই প্রথম ক্লাসের কথাই শুধু মনে আছে।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, তখন দিনের শেষে আমাদের এই হাইস্কুলে ছুটির ঘন্টা বাজতো না। তার পরিবর্তে হেডমাস্টারমশাই নিজে এসে প্রতি ক্লাশের শিক্ষকদের ছুটির নির্দেশ দিয়ে যেতেন। শেষ ক্লাসের শেষ ক্ষনে, তাই আমাদের সে এক প্রলম্বিত অপেক্ষা থাকতো, কখন উনি আসবেন আর কখন আমরা ছুটি পাবো।
কেন জানিনা এখন আমার মনে হচ্ছে, হেডমাস্টারমশাই সেই প্রথম দিনে আমাদের ক্লাস ফাইভের নতুন ছাত্রদের বেলা একটায় টিফিনের সময় হাফ-ছুটি করে দিয়েছিলেন। আমরা সবাই খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছিলাম।
হাইস্কুলের প্রথম দিনে মাষ্টারমশাইরা, আমাদের পড়াশোনা কি করিয়েছিলেন মনে পড়ছে না, তবে ক্লাসের অনুশাসন বজায় রাখতে সেদিন এইভাবে বই-খাতার বাইরে বেরিয়ে এসে, ক্লাসের একজন মনিটর নির্বাচন করেছিলেন, সেটা মনে আছে।
(কলকাতা। ২৬.০৬.২০২৪)
********
ঘটনা – দুই।
বেঞ্চিতে দাঁড়িয়ে আমি, ক্লাসের মনিটর! সৌজন্যে মাষ্টারমশাই!
আমি তখন ক্লাস সেভেনে। আমাদের স্কুলের বেলতলার পুরোনো একতলা বিল্ডিং এ তখন সিক্স ও সেভেন এর ক্লাস হতো, হয়তো এইটেরও।
সেই সময়ের কথা। স্কুলের প্রথম ঘন্টা বেজে গেছে, প্রথম ক্লাস, অঙ্কের। আমরা যদুপতি বাবু মাষ্টারমশাইয়ের আসার অপেক্ষা করছি। খুবই রাগী আর কড়া ধাতের মানুষ ছিলেন। ওনার চোখই কথা বলতো। তাঁর বড় বড় চোখ দুটো ছিল যেন ইঁটের ভাঁটা, মনে হতো আগুন জ্বলছে, ভয়ে ওনার দিকে সোজাসুজি তাকানো যেত না। ক্লাসের মধ্যেও কোলাহল নয়, ছিল একটা গুঞ্জন মাত্র, এই বোধহয় উনি এসে পরলেন। একটু পরে উনি এসেও গেলেন। আমাদের দিকে একটা নজর দিয়ে রোল কল করলেন। শেষ হলে আমাকে বললেন হোমটাস্কের খাতাগুলো কালেক্ট করে ওনার টেবিলে রাখতে। আমাকে বলার কারণ, আমি তখন ক্লাসের মনিটর।
আমি একে একে সকলের খাতা কালেক্ট করলাম, স্বাভাবিক ভাবেই দু-চার জনের ছিল না। সব শেষে ব্যাগ থেকে আমার নিজের খাতা’টা নিতে গিয়ে দেখি সেটা ব্যাগে নেই। আমার মাথায় হাত। আমি তো হোমটাস্ক করেছিলাম। বুঝলাম ব্যাগে নিতে ভুলে গেছি। এরকম তো আমার সচরাচর হয় না। কি হবে এখন? মুখ শুকিয়ে গেলো, তার সঙ্গে গলাটাও। কালেক্ট করা আমার হাতের নোটবুক গুলো কোনো রকমে মাষ্টারমশাই এর টেবিলে রাখলাম। উনি তখন আজকের আলোচ্য বিষয়ের কিছু অংশ ব্ল্যাক বোর্ডে লিখছিলেন। সেটা শেষ করে নিজের চেয়ারে বসলেন। সামনে রাখা হোমটাস্কের নোটবুক গুলো দেখে বললেন, “সবাই খাতা জমা দিয়েছে? যারা দেয়নি তারা বেঞ্চির উপরে দাঁড়িয়ে পড়ো”। দেখলাম পিছনের দিকের বেঞ্চিতে তিনজন দাঁড়িয়ে পড়লো। আমি কি করি বুঝতেই পারছিলাম না। বেঞ্চিতে দাঁড়াতে হবে ভেবেই মাথা কাজ করছিল না। খাতাগুলো টেবিলে জমা করে ওখানেই দাঁড়িয়ে আছি, নিজের সীটে গিয়ে বসতেও পারছি না। মনে একটু সাহস জুগিয়ে মাষ্টারমশাই কে আস্তে করে বলেই ফেললাম, “আমি হোম টাস্ক করেছি কিন্তু খাতাটা আনতে আজ ভুলে গেছি”। উনি অবিশ্বাসের চোখে আমার মুখের দিকে দু সেকেন্ড দেখে একটু নরম গলায় বললেন, “তা’হলে আর কি, বেঞ্চিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরো”। আমাদের বাড়ি স্কুলের কাছেই, জোরে হাঁটলে তিন মিনিটের দূরত্বে। সাহস করে বলেই ফেললাম, “বাড়িতে আছে, চট্ করে নিয়ে আসবো”?
আমার আব্দারের উনি একদম রেগে গেলেন। উঁচু আওয়াজে বললেন, “তোমার বাড়ি তিন পা দূরে, চট্ করে গিয়ে নিয়ে আসবে আর যারা তিন মাইল দূর থেকে স্কুলে আসছে, তারা কি করবে? যাও বেঞ্চিতে গিয়ে দাঁড়াও”। ততক্ষণে আমার কথা বন্ধ হয়ে গেছে, কান গরম আর চোখ দুটো প্রায় ভিজে। লজ্জায় মুখ নীচু করে নিজের জায়গায় গিয়ে আর কোনো বাক্যব্যায় না করে সোজা বেঞ্চির উপরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ক্লাসের মনিটর ফার্স্ট বেঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে হোমটাস্কের খাতা জমা দেয়নি বলে। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিলো। সবার চোখ তখন নিশ্চয়ই আমার দিকে।
স্কুলের জীবনে সেই প্রথম আমার বেঞ্চিতে দাঁড়ানো। ভাবতেই পারছিলাম না।
মাষ্টারমশাই বোর্ডে তাঁর লেখা কয়েকটা অঙ্ক আমাদের করতে বলে হোমটাস্কের খাতা দেখায় ব্যস্ত হয়ে পরলেন। আমিও আমার খাতা কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অঙ্কগুলো সলভ করার চেষ্টা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পরে সব খাতা দেখা শেষ হলে, স্যার ইশারায় আমাকে ডেকে বললেন, “নেমে এসে খাতাগুলো সবাই কে ফেরত দিয়ে দাও”। শাস্তির সময় কম হলেও সেদিন তখন খুশী তো হতে পারিনি। মুখ কাঁচুমাচু করে সবাইকে এক এক করে খাতা তো ফেরত দিলাম, কিন্তু সেই দিনটা যে আমার একদমই ভালো কাটেনি সেটা বলাই বাহুল্য। বেঞ্চিতে দাঁড়িয়ে শাস্তি পাওয়া সেটাই ছিল প্রথম আর সেটাই শেষ।
স্কুলের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে মাষ্টারমশাইদের কখনো বই-খাতার বাইরেও বেরিয়ে আসতে হয় আর ক্লাসের নিয়ম-কানুন বজায় রাখতে কখনও ক্লাসের মনিটরকেও বেঞ্চির উপরে দাঁড়াতে হয়।
(কলকাতা, ২৭.০৬.২০২৪)
********
ঘটনা – তিন।
আমাদের নিরাপত্তার চিন্তায়, মাষ্টারমশাই!
সেই স্কুলেরই কথা, বোধহয় তখন আমি ক্লাস নাইনে। স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে সকলেই যে মাঠে খেলতে যেতাম, তা’ কিন্তু নয়। যে কোনো কারণেই হোক, হয়তো ফুটবলের ব্লাডার ফেটে গেছে, হয়তো ক্রিকেট ব্যাট এর হ্যান্ডেলটাই ভেঙ্গে গেছে, হয়তো ব্যাডমিন্টন রেকেটের স্ট্রীং ছিঁড়ে গেছে। তখন তো আমাদের অভিধানে এসবের অতিরিক্ত (Spare) বলে কিছু থাকতো না। খারাপ হলে খেলা বন্ধ আর সারানো হলে তবে আবার খেলা শুরু। কোনও দিনে এমনও হতো যে, সেদিন মাত্র ২-৩ জন খেলতে এলো, তখন হয়তো মাঠে না গিয়ে বাড়িতেই আমরা একটু ক্যারাম খেলে নিলাম। অগত্যা কিছু না জমলে ছাদে উঠে কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করে নিলাম। সেদিনও এই রকমই কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছিল – ছিল একটা ব্যতিক্রমী বিকেল। তাই অগত্যা ছাদে চলে গেছিলাম আমরা ক’জনে, গল্প করে বিকেল’টা কাটিয়ে দেবো বলে।
সাধারণতঃ ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের নিয়ম ভেঙ্গে আনন্দ উপভোগ করার একটা প্রবণতা থাকে। একটু দুঃসাহস দেখানো যাকে বলে। এটা বোধহয় ছেলেদের একটা জন্মগত চরিত্র। যেমন পাঁচিল টপকানো, গাছে উঠে এক ডাল থেকে অন্য ডালে ঘুরে বেড়ানো, কোনো নির্ণীয়মান বাড়ির ভিতের উপর দিয়ে দৌড়ানো, তৈরী হওয়া বাড়ির দোতলা থেকে নীচে রাখা বালির ঢিবির উপড় ঝাঁপ দেওয়া, দূর থেকে ছুটে এসে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পরে ডুব সাঁতার দেওয়া, এই রকম সব ছোট ছোট দুষ্টুমি আর কি।
হয়তো সেই সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই আমি দোতলার ছাদের ইঁটের ছোট দেওয়ালের (Parapet) উপরে বসে সেদিন গল্প করছিলাম। নতুন কিছু নয়, আগেও এরকম ভাবে বসে বসে গল্প করেছি, একা বসে গল্পের বইও পড়েছি, কোনো কিছু না ভেবেই, যেন কোনো ব্যাপারই নয়।
কিন্তু সেদিন প্যারাপেটের উপড়ে বসে থাকাকালীন শুনতে পেলাম নীচে দেবাশীষ দেবাশীষ বলে আমার ছোড়দা’র নাম ধরে কেউ একজন ডাকছেন। স্বভাবতই প্যারাপেট থেকে নেমে নীচের দিকে তাকালাম। দেখি আমাদের স্কুলেরই মাস্টারমশাই শৈলেন বাবু। একই পাড়ায় থাকেন। রোজ বিকেলে এই রাস্তা দিয়ে উনি হাঁটতে যান, সেটা জানতাম। ভাবলাম হয়তো কোনো দরকার আছে। আমি জানতাম ছোড়দা বিকেলে এই সময় কোনোদিন বাড়িতে থাকে না। গলা বাড়িয়ে ওঁকে বললাম, “ছোড়দা বাড়িতে নেই, আমি আসছি, স্যার”।
মনে হলো যেন একটু রেগে গেলেন। ভারী শান্ত গলায় বললেন, “আসতে হবে না। যেখানে তুমি বসেছিলে, ওটা কি বসার জায়গা? ওখান থেকে নীচে পড়ে গেলে কি হবে, জানো না? কখনো ওভাবে ওখানে বসবে না, নেমে এসো”। এইটুকু বলেই উনি যেমন যাচ্ছিলেন সেইরকম চলে গেলেন। বুঝলাম তাঁর দরকার’টা সেই সময় আসলে ছোড়দার সঙ্গে নয়, আমার সঙ্গেই ছিল। আমি যাতে সেই অবস্থায় অন্যমনস্ক হয়ে না যাই, সেজন্যে আমার নাম ধরে না ডেকে, তখন যুক্তি সঙ্গত কারণেই ছোড়দার নাম ধরে তিনি ডেকেছিলেন। আমাদের মাস্টারমশাই’দেরও বলিহারী। অন্তর থেকে তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা কি শুধু শুধুই তৈরী হতো?
মাষ্টারমশাইয়ের ওই ক’টা কথা সেদিন আমাকে একদম অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। লজ্জায় মাথা কাটা গেছিলো আমার। সেই দিনটা পর্যন্ত যে সম্ভাবনা নিয়ে কখনো ভাবিনি, এক মুহুর্তে সেটা বুঝে গেছিলাম – নিজের অজান্তে কতটা বোকামি করে ফেলতাম। উনি সেদিন আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে সুষ্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কিনারার সংজ্ঞাটা ঠিক কি। বুঝেছিলাম কিনারা এমনই একটা জায়গা, যেখানে নিজের উপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এরপর থেকে ছাদে গেলে আর যাই করি না কেন, ছাদের প্যারাপেটে উঠে আর কোনোদিনও বসিনি।
একটা অতি সাধারণ ছোট্ট ঘটনা। সেই কবে একদিন হঠাৎ ঘটেছিল। এখনও সেটা ভুলেও ভুলতে পারিনি। এখন কখনো যদি ভাবি, আমি ছাদের প্যারাপেটের উপড়ে বসে আছি, ভাবলেই শিউড়ে উঠি, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
বই-খাতার বাইরে বেরিয়ে এসে কিনারার সম্ভাব্য বিপদের পরিচয়’টা সেদিন করিয়েছিলেন আমাদেরই একজন মাষ্টারমশাই।
(কলকাতা, ২০।০৭।২০২১)
আমি বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাক্তনী, বিই কলেজের নই। কান্দি স্কুলে আমি ছোটবেলায় চার বছর পড়েছি। তখনের কথা কিছুই মনে নেই, শুধু স্কুল বিল্ডিং এর দু তিন জন মাষ্টার মশাই ছাড়া। এই লেখা পড়ে সেই স্কুলের কয়েকটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো।
স্মৃতি সততই সুখের
খুব ভালো লাগলো।