সাহিত্যিকা

বিই কলেজের শিক্ষকদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য

বিই কলেজের শিক্ষকদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য
সুবীর চৌধুরী, ১৯৭১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

সারা বিশ্ব জুড়ে শিক্ষক দিবস ৫ই অক্টোবর পালন করা হলেও ভারতবর্ষে এই দিনটি পালিত হয় সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে। ভারতবর্ষের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি আর দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি তথা প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ডঃ সর্বপল্লি রাধা কৃষ্ণণের জন্মজয়ন্তী ৫ই সেপ্টেম্বর আর সেইদিনই শিক্ষক দিবস পালন করাহয়। এইদিনে আমাদের বিই কলেজের কিছু শিক্ষকদের আমি স্মরণ করে তাঁদের প্রণাম জানাই যারা আমাদের শিক্ষাদান করেছিলেন। হোস্টেলে থেকে পাঁচবছর কলেজে পড়াশোনার সময় নানান বিষয়ে অনেক মাস্টার মশাইরা আমাদের পড়িয়ে ছিলেন আর তাঁরা সকলেই আমাদের নমস্য ব্যাক্তি তবে কয়েকজনের কথা ৫৪-৫৫ বছর পরে আজও মনে আছে।

আমি বিই কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৬৬ সালে আর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বের হলাম ১৯৭১ সালে। কলেজে ফার্স্টইয়ার থেকে ফিফথইয়ার টানা এই পাঁচবছরে অনেক নামকরা ও দিকপাল মাস্টার মশাইদের সান্নিধ্যে এসেছি যারা আমাদের নানান বিষয়ে পড়িয়েছেন আর গড়ে পিঠে ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করেছিলেন। কলেজে ঢুকেই সিনিয়ার দাদাদের কাছে শুনেছিলাম ফার্স্ট ইয়ারে ম্যাথস আর কেমিস্ট্রি ক্লিয়ার করা নাকি খুবই কষ্টকর, সহজে পাশ করা যায় না আর তাই এই দুটো সাবজেক্ট নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলাম। আবার মনেমনে এটাও ভেবেছিলাম অঙ্ক আর ড্রয়িং এই দুটোই তো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভিত। তাই এই দুটো বিষয় পাশ করাও খুবই জরুরী।

প্রথমদিনের ড্রয়িংক্লাসে গিয়ে সান্যালসাহেবকে দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, বেশ মোটাসোটা আর বেঁটেখাটো চেহারার মানুষ ইনি আমাদের ড্রয়িংস্যার। দেখতাম স্যার প্রত্যেক ছাত্রের টেবিলে এসে প্রথমেই ড্রয়িং করার পেন্সিলটা হাতে নিয়ে চেক করতেন পেন্সিলের শিষটা ঠিকমতন কাটা আছে কিনা। আর পছন্দ নাহলে তাঁর ডান হাতের মুঠোয় গোটা পেন্সিলটা ধরে শিষের দিকটা ড্রয়িং সিটের ওপরে আছড়ে ফেলতেন আর বলে দিতেন পরের দিন আবার যদি দেখি পেঞ্চিলের শিষ ঠিক মতো কাটা নেই তাহলে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। শেষমেশ ফার্স্টইয়ারের ড্রয়িং পরীক্ষায় পাশ করেছিলাম। স্যার আজ শিক্ষকদিবসে আপনাকে আমার বিনম্র প্রণাম জানাই ।

থার্ড ইয়ারের ক্লাসে পড়ানো শুরু হোল স্ট্রেনথ অফ মেটিরিয়ালস আর ক্লাস নিতে এলেন প্রফেসর বিমল সেন। প্রথমদিন স্যারকে ক্লাসে দেখেই মনেমনে তাঁকে প্রনাম করেছিলাম কারন বিষয়টা খুব একটা সোজা নয় আবার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট। হাতে সাদাচক নিয়ে ব্লাকবোর্ডে যে ফ্রি হ্যান্ড ডায়াগ্রাম আঁকলেন একদম ছবির মতন আর তার সঙ্গে মুক্তাক্ষরে লেখা ছবির বিবরণ। খুবই কঠিন বিষয় কিন্তু স্যার কি সহজ সরল ভাষায় আমাদের বুঝিয়ে দিতেন। ওনার ক্লাস আমরা পারত পক্ষে মিস করতাম না আর ওনার লেকচার শুনে যতটা পারতাম খাতায় নোট করে নিতাম। এতো ডিটেলে পড়াতেন যে আলাদা করে বই পড়তেই হতো না।

স্যার একদম সঠিক সময়ে ক্লাশ রুমে চলে আসতেন। দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন আর সবসময়ে খুব সুন্দর পোশাক পড়ে ক্লাসে আসতেন। গরমের দিনে বেশিরভাগ সময়ে সাদা হাফশার্ট আর কালো বা ব্রাউন রঙের ট্রাউসার। আর শীতকালে সুট, সঙ্গে মানানসই টাই। স্যারের সেই সৌম্যমূর্তি আর অমায়িক ব্যবহার আজও চোখের সামনে ভাসে। স্যার আপনি কঠিন সাবজেক্ট সহজ করে পড়িয়েছিলেন, আজ শিক্ষক দিবসে আপনাকে আমার অন্তরের প্রণাম জানাই ।

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের হেড আর একজন নমস্য ব্যাক্তি ছিলেন প্রফেসর সন্তোষ কুমার মুখার্জি, দাদারা তাঁর নাম দিয়ে গেছেন লর্ড মুখার্জি। সত্যই তিনি সার্থকনামা। একজন পণ্ডিতব্যাক্তি। যেমন রাশভারী চেহারা তেমনি শরীরের টকটকে রং, চোখে পুরু মোটা ফ্রেমের চশমা। স্যার সবসময়ে খুব সুন্দর পোশাক পড়তেন আর শীতকালে তাঁকে দেখতাম হালকা রঙের স্যুট সঙ্গে ম্যাচ করা টাই পড়তে। স্যার সিভিল ডিপার্টমেন্টের অনেক কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আমাদের কোন ক্লাস নিতেন না, তবে উনি কলেজের পিজি ছাত্রদের নিয়মিত ক্লাস নিতেন। একবারই শুধু আমাদের ক্লাস নিতে এসেছিলেন। সেদিন অন্য এক বিষয়ের ক্লাস ছিল আর সেই স্যার ক্লাসে আসার আগে আমাদের মধ্যে কোন এক ছাত্র আমাদের অজান্তে ব্ল্যাকবোর্ডে সেই স্যারের সম্বন্ধে কিছু কটু কথা লিখেছিল, স্যার ক্লাসে ঢুকে ব্ল্যাক বোর্ডে লেখাটা পড়ে আমাদের কিছু না বলে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যান আর অল্প কিছুক্ষণ পরেই ক্লাসে ঢোকেন লর্ড মুখার্জি। সেদিন স্যারকে আমাদের ক্লাসে ঢুকতে দেখে আমরা সকলেই খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। স্যার সেদিন খুব সুন্দরভাবে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এই কলেজের প্রতিটি শিক্ষক খুবই সম্মানীয় শিক্ষক আর যেকোনো শিক্ষকের অপমান মানে সেটা তাঁর নিজের অপমান। ওই ধরণের ঘটনা ক্লাসে আর যেন কোনদিন না ঘটে। স্যার, আজ শিক্ষক দিবসে আপনাকে আমার প্রণাম জানাই ।

Sahityika Admin

Add comment