প্রফেসর সন্তোষ কুমার ভট্টাচার্য, আমার শিক্ষক
প্রণব কুমার মজুমদার, ১৯৭১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
১৯৭১ সালে আমি শিবপুর বি ই কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলাম। ফোর্থ ইয়ারে আমাদের একটা পাঠ্য বিষয় ছিল জিওডেসি, আজ পঞ্চাশ বছর পরে পাঠ্যবিষয়ের স্মৃতিশক্তি অনেকটা কমে এলেও যতদূর মনে পড়ে এ্যষ্ট্রোনমিক্যাল সার্ভে ছিল এই বিষয়ের অন্তর্গত। আকাশের নক্ষত্রদের সাহায্য নিয়ে রাতের বেলায় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের জরিপ করাই ছিল এই বিষয়ের মূল পাঠ্য। কঠিন কঠিন অঙ্ক করতে হতো, সাত ঘরের লগটেবিল লাগতো তার জন্য।
এই বিষয়টা আমাদের পড়িয়েছিলেন প্রফেসর সন্তোষ কুমার ভট্টাচার্য। ছাত্রদের মুখে উনার একটা সাংকেতিক নাম ছিলো, “ভটূ”, কে কবে দিয়েছিল জানি না, সম্ভবত পদবী ভট্টাচার্য থেকে ভটূ হয়েছিল। এবং এই ভটূ নাম আবহকাল থেকেই শুনেছি, আমার দশ পনেরো বছরের সিনিয়র ছেলেমেয়েরা এই নামেই জানে, আমার দশ পনেরো বছরের জুনিয়ররাও। ওনার গ্রাজুয়েশন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোথা থেকে ছিল জানি না, কোনোদিন সে চেষ্টাও করিনি, কিন্তু বি ই কলেজে পাঁচ বছরের পড়াকালীন যত শিক্ষককে পেয়েছিলাম তার মধ্যে ওনাকেই আমার হিসাবে এক নম্বর স্থানে রেখেছিলাম।
বিষয়বস্তুর দিক থেকে ঐ জিওডেসির চাইতে অনেক কঠিন বিষয় যেমন ছিল, তুলনায় সহজ বিষয়ও তেমনি ছিল। কিন্তু কঠিন অথবা সহজ বিষয় বলে ওনার পড়ানোর বিষয়কে আমি বেছে নিচ্ছি না। আবার উচিৎ নয় বলে শিক্ষকদের বিদ্যা বা পাণ্ডিত্য নিয়ে কোনোদিন গবেষণা করিনি, তৎসত্ত্বেও প্রফেসর ভট্টাচার্যকে প্রথম স্থানে রেখেছিলাম ওনার শিক্ষকতার কারণে, কত আন্তরিকতার সাথে উনি আমাদের পড়িয়েছিলেন সেটা মনে রেখে, অন্ততপক্ষে আমার কাছে। একজন ছাত্র একজন শিক্ষকের থেকে যা আশা করে, ওনার মধ্যে আমি সেটাই পেয়েছিলাম – ওনার পড়ানোর এমন কৌশল ছিল যে বিষয়টাকে সহজবোধ্য ভাবে আমি আমার মনের মধ্যে গেঁথে নিতে পারতাম। উনি বোঝানোর জন্য ইংরাজি এবং বাংলা ভাষা মিশিয়ে ব্যবহার করতেন। খুব ধীরে ধীরে উচ্চারণ করতেন। গম্ভীরভাবে পড়ালেও প্রয়োজনে একটু আধটু কৌতুক করতেন, যেমন হামেশাই পড়ানো শুরু করতেন এরকম একটা বাক্য ব্যবহার করে – আজ আমরা একটা ‘কৌশল’ শিখবো। বোর্ডের ওপর এত চমৎকার ছবি আঁকতেন যে বিশ্বব্রম্মাণ্ডের নক্ষত্রদের অবস্থান চোখের সামনে ফুটে উঠতো, আমি যেন মহাকাশে বিচরণ করতাম।
ফোর্থ ইয়ারে মাইথনে আমাদের সার্ভে ক্যাম্পে গিয়ে হাতে কলমে ধৈর্য ধরে সবাইকে থিওডোলাইট দিয়ে তারাদের গতিবিধির পরিমাপ করা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এককথায় বলা যায় ওনার পড়ানো আমার মন ছুঁয়ে যেতো। ঐ বিষয়টার প্রতি আমার একটা আকর্ষণ গড়ে উঠেছিলো। আমার কর্মজীবনে শিক্ষকতা করতে গিয়ে ওনার পড়ানোর আন্তরিকতা এবং ছাত্রদের প্রতি ব্যবহার আমি বরাবর ভীষণভাবে অনুসরণ করে এসেছি, সেটাই আমার ওনার প্রতি সারা জীবনের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। বর্তমানে প্রফেসর সন্তোষ কুমার ভট্টাচার্য মহাশয়ের অবস্থান আমার কিছুই জানা নেই, কিন্তু আশাকরি যেখানেই থাকুন উনি যেন ভালো থাকেন।
আমার অন্তরের শ্রদ্ধা তাঁকে জানাই। আর একটা কথাও বলতে চাই যে একমাত্র প্রফেসর ভট্টাচার্যের নামোল্লেখ করলেও আমি কিন্তু আমার অন্যান্য কোনও শিক্ষককেই কোনও ভাবেই অবজ্ঞা করতে চাইছি না। তাঁদের সকলের প্রতি আমি শিক্ষক দিবসে আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।।
Add comment