সাহিত্যিকা

যোগসাধনা এবং অষ্টাঙ্গযোগ

যোগসাধনা এবং অষ্টাঙ্গযোগ
@বিজিত কুমার রায়, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
যোগের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনার প্রক্রিয়াকে যোগসাধনা বলে।
ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন ‘যোগ’ শব্দের অর্থ সংযোগ। জীবাত্মা পরমাত্মার সাথে যুক্ত হয়ে যখন সমদর্শন লাভ করে, তখনই সত্যিকারের যোগ হয়।
মহাগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদগীতাতেও প্রায় অনুরূপ অর্থে ‘যোগ’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ২৯ নং শ্লোকে আমরা পাই
সর্ব্বভূতস্থমানং সর্ব্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্ব্বত্র সমদর্শন।।
অর্থাৎ যোগীগণ নিজেকে সর্বজীবে সমদর্শী হয়ে আত্মাকে সর্বভূতস্থিত দেখেন, আর সর্বভূতকে আত্মাতে দর্শন করেন।
মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন, যোগের দ্বারা চিত্ত বৃত্তি নিরুদ্ধকরন বোঝায়। অর্থাৎ মনের বৃত্তিগুলিকে একান্তভাবে নিরুদ্ধ করাই যোগ। ধর্মসাধনার ক্ষেত্রে যোগের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সনাতন ধর্মশাস্ত্রে যোগের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
যোগ দুই ভাগে বিভক্ত, যথা:
১. হঠযোগ
২. রাজযোগ
হঠযোগের উদ্দেশ্য শরীরকে সুস্থ, সবল ও দীর্ঘায়ু করা। কোনরূপ শক্তিকে আয়ত্ত করতে হলেই শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করা প্রয়োজন। সাধারন লোকে যোগ বলতে হঠযোগের ব্যায়াম ও আসনগুলিকে বুঝিয়ে থাকে। বিশেষ করে ইংরেজি উচ্চারণ মেনে আজকাল সাধারণ লোক হোন বা উচ্চ শিক্ষিত, অনেকেই সাধারণ ভাবে ”যোগ” কে “যোগা” বলে থাকেন, এটিও সর্বৈব ভুল। তাছাড়া এই ব্যায়ামগুলিকেই যোগ বলে মেনে থাকেন যদিও এটি যোগ সূত্রের একটি অংশ মাত্র যার সূচনা বলা হয় মুনি ঋষিদের শারীরিক ভাবে সচল রাখার জন্য।
অন্যদিকে রাজযোগের উদ্দেশ্য জীবাত্মাকে পরমাত্মার সাথে যুক্ত করা। আর এই পরমাত্মার সাথে যুক্ত হওয়াই হচ্ছে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ।
তবে হঠযোগের সাথে রাজযোগের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধও রয়েছে। সাধনার পূর্ব শর্ত হচ্ছে শরীরকে সুস্থ রাখা। ‘শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম’ অর্থাৎ শরীর ও মন সুস্থ না থাকলে জাগতিক বা পারমার্থিক কোন কর্মই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায় না।
রাজযোগের আটটি অঙ্গ, সেগুলিকে ‘অষ্টাঙ্গ’ বলে। এগুলি যথাক্রমে যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারনা, ধ্যান ও সমাধি। এই আটটি প্রক্রিয়া ক্রমে ক্রমে অভ্যাস করতে হয়। এগুলির একটি আয়ত্ত হলে তবেই পরবর্তী সোপানে আরোহন করা যেতে পারে। এখন আলোচনা করব কোন পর্যায় বলতে কি বোঝায়। চলুন দেখা যাক:

রাজযোগের আটটি অঙ্গ, সেগুলিকে ‘অষ্টাঙ্গ’ বলে। এগুলি যথাক্রমে যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারনা, ধ্যান ও সমাধি। এই আটটি প্রক্রিয়া ক্রমে ক্রমে অভ্যাস করতে হয়। এগুলির একটি আয়ত্ত হলে তবেই পরবর্তী সোপানে আরোহন করা যেতে পারে। এখন আলোচনা করব কোন পর্যায় বলতে কি বোঝায়। চলুন দেখা যাক:
যম – অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ এই পাঁচটিকে যম বলা হয়।
নিয়ম – শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায়, এবং ঈশ্বর উপাসনা এই পাঁচটি নিয়মের অন্তর্ভুক্ত। ‘যম’ ও ‘নিয়ম’ এই দুটিরই উদ্দেশ্য ইন্দ্রিয় ও চিত্তবৃত্তিগুলিকে দমন করা এবং অন্তর্মুখী করে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করা।
আসন – যোগ অভ্যাস করার জন্য যেভাবে শরীরকে রাখলে শরীর স্থির থাকে অথচ কোন কষ্টের কারন ঘটে না তাকে আসন বলে। স্থির ও সুখজনকভাবে অবস্থান করার নামই আসন।
প্রাণায়াম – প্রাণায়ামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ প্রাণবায়ুর নিরোধ। ‘প্রাণ + আয়াম = প্রাণায়াম। প্রাণ অর্থ শ্বাসরূপে গৃহীত বায়ু আর আয়াম অর্থ বিস্তার। অর্থাৎ স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে গতিরোধ করাকেই প্রাণায়াম বলে। প্রাণায়ামে শ্বাস-প্রশ্বাস বিস্তারিত ও দীর্ঘতর করা হয়। এইরকম ছন্দোবদ্ধভাবে শ্বাস গ্রহন করায় শ্বসনতন্ত্র বলিষ্ঠ হয়, স্নায়ুতন্ত্র শান্ত থাকে এবং পার্থিব আকাঙ্খা হ্রাস পায়। সাধারনত তিনটি প্রকৃয়ার মাধ্যমে প্রাণায়াম সম্পন্য হয়। এগুলি হলো রেচক, পূরক ও কুম্ভক। শ্বাসগ্রহনকে বলে পূরক, ত্যাগকে বলে রেচক এবং শ্বাস ধারনকে বলে কুম্ভক।
প্রত্যাহার – আসন ও প্রাণায়ামের দ্বারা শরীরকে নিশ্চল করলেও মনের চঞ্চলতা সম্পূর্ণ দূর নাও হতে পারে। এরূপ অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলিকে বাহ্যবিষয় থেকে প্রতিনিবৃত্ত করে চিত্তের অনুগত করাই হলো প্রত্যাহার।
ধারনা – কোন বিশেষ বস্তু বা আধারে চিত্তকে নিবিষ্ট বা আবদ্ধ রাখাকে ধারনা বলে। অর্থাৎ ‘ধারনা’ শব্দের অর্থ দ্বারালো একাগ্রতা। জগতে একাগ্রতা ছাড়া কিছুই লাভ করা যায় না। ঈশ্বরকে লাভ করতে গেলেও চিত্তকে একাগ্র করতে হয়।
ধ্যান – যে বিষয়ে চিত্ত নিবিষ্ট হয়, সেই বিষয়ে যদি একতানতা জন্মায় তাহলে তাকে ধ্যান বলে। অর্থাৎ ধ্যান শব্দের প্রকৃত অর্থ নিরবচ্ছিন্ন গভীর চিন্তা।
সমাধি – ধ্যান যখন গাঢ় হয় তখন ধ্যানের বিষয়ে চিত্ত এমনভাবে নিবিষ্ট হয় যে, চিত্ত ধ্যানের বিষয়ে লীন হয়ে যায়। এ অবস্থায় ধ্যানরূপ প্রকৃয়া এবং ধ্যানের বিষয় উভয়ের প্রভেদ লুপ্ত হয়। চিত্তের এই প্রকার অবস্থার নামই সমাধি। এই সমাধি দুইরকম – সবিকল্প ও নির্বিকল্প।

সাধকের যখন ধ্যানের বস্তু ও নিজের মধ্যে পার্থক্যের অনুভূতি থাকে তখন সে অবস্থাকে বলা হয় সবিকল্প সমাধি। আবার সাধক যখন ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান সে অবস্থাকে বলা হয় নির্বিকল্প সমাধি। তখন সাধকের মনে চিন্তার কোন লেশমাত্র থাকে না। এই সমাধি লাভ যোগসাধনার সর্বোচ্চ স্তর এবং যোগীর পরম প্রাপ্তি।

সাধকের যখন ধ্যানের বস্তু ও নিজের মধ্যে পার্থক্যের অনুভূতি থাকে তখন সে অবস্থাকে বলা হয় সবিকল্প সমাধি। আবার সাধক যখন ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান সে অবস্থাকে বলা হয় নির্বিকল্প সমাধি। তখন সাধকের মনে চিন্তার কোন লেশমাত্র থাকে না। এই সমাধি লাভ যোগসাধনার সর্বোচ্চ স্তর এবং যোগীর পরম প্রাপ্তি।
আজকাল পৃথিবীময় যোগের প্রচুর চল হয়েছে যার সাথে প্রকৃত যোগের কোনও সম্পর্ক নেই। উপরন্তু আমাদের প্রশাসনিক সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তি এই পদ্ধতিটিকে বিশ্বপ্রসিদ্ধ করার চেষ্টায় আছেন। যদিও এতে খারাপ কিছু নেই কিন্তু এই যোগ কিন্তু কোনো হুজুগের ব্যাপার নয়। এই সুপ্রাচীন পদ্ধতিটি সম্পর্কে অনেক ভুল ধারনা দীর্ঘদিন ধরে সত্যের বেশে প্রচারিত হচ্ছে।

প্রচলিত ধারণা # ১: যোগের উৎপত্তি হিন্দুধর্ম থেকে
যোগ ততটাই হিন্দুধর্মের যতটা মাধ্যাকর্ষণ খ্রীস্ট ধর্মের। আইজ্যাক নিউটন খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বী ছিলেন আর মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্বটি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বলেই কি মাধ্যাকর্ষণ খ্রীস্ট ধর্মের হয়ে যায়? যোগ একটি প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি যিনি চাইবেন, তিনিই কাজে লাগাতে পারেন।

যোগ বিজ্ঞান যে হিন্দুত্বের তকমা পেয়েছে তার কারণ, এই বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিটির জন্ম এবং প্রসার এই সংস্কৃতিতে আর স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনে এটি হিন্দু জীবনশৈলীর অঙ্গ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। “হিন্দু” শব্দটি এসেছে মূল শব্দ “সিন্ধু” থেকে, যা একটি নদীর নাম। যেহেতু এই সভ্যতা সিন্ধু তথা ইন্ডাস নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল, তাই এই সভ্যতার নাম হয় হিন্দু। এই হিন্দু কোনও ধর্মমত নয় – এটি একটি ভৌগলিক তথা সাংস্কৃতিক পরিচয়।

প্রচলিত ধারণা # ২: যোগ মানে, জিলিপির মতো, অসম্ভব কিছু অঙ্গভঙ্গি
আমরা যখন ‘যোগ’ শব্দটি বলি, পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই যোগাসনের কথা ভাবেন। জীবনের প্রায় সব দিকগুলিতেই যোগ বিজ্ঞান অবদান রেখেছে, কিন্তু তার মধ্যে শারীরিক ভঙ্গীকেই মানুষ আজ যোগকে উপস্থাপন করার জন্য বেছে নিয়েছে। অথচ যোগশাস্ত্রে আসনগুলিকেই সব থেকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রায় দুশোর কিছু বেশি যোগসূত্রের মধ্যে শুধুমাত্র একটি সূত্রই উৎসর্গ করা হয়েছে যোগাসনের জন্য। কিন্তু আধুনিক যুগে এই একটি সূত্র বাকি সূত্রগুলির থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়ে বসেছে।

পৃথিবী আজ কোন দিকে চলেছে তা নানাভাবে স্পষ্ট। আধুনিক পৃথিবীর যাত্রা একটি দিকেই – গভীরতর অন্তর্জগত থেকে শরীরের দিকে। ঠিক এই ব্যপারটির পরিবর্তন আবশ্যক। আকাঙ্ক্ষিত যে মানুষ তার শরীর থেকে শুরু করে অন্তর প্রকৃতির দিকে যাক।

আমরা যা অনুশীলনে দেখি, অর্থাৎ এর পদ্ধতিটি, সেটি নিতান্তই শারীরিক। আপনাকে শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে এর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। তা না হলে এটা জীবন্ত হয়ে উঠবে না। এই কারণেই সনাতন প্রথায়, গুরুর উপস্থিতির উপর এত বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল- একে জীবন্ত করার জন্য। যোগপ্রক্রিয়া আমাদের দেহতন্ত্রটিকে অত্যন্ত নিপুনভাবে পরিচালনা করে তাকে আরও উন্নত মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার এক সূক্ষ্ম কৌশল। যোগ মানে হল, যা উন্নততর প্রকৃতির উন্মেষ ঘটায়। প্রত্যেকটি আসন, প্রত্যেকটি মূদ্রা, প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসের নিয়ম – সব কিছু ওই দিকেই কেন্দ্রীভূত।

প্রচলিত ধারণা # ৩: সিক্স প্যাক অ্যাব চাই? যোগ অসাধারণ ব্যায়াম অনুশাসন
যদি শুধু একটি সুঠাম শরীর আমার কাম্য হয়, যদি আমি ‘সিক্স-প্যাক-অ্যাবস্‌’ (six-pack abs) বা এক কথায় পেশীবহুল শরীর চাই, তাহলে আমি টেনিস খেলবো, পাহাড়ে চড়ুবো। কারণ, যোগ কোনও শরীরচর্চা নয়, এর সঙ্গে ভিন্নতর মাত্রা সংযুক্ত আছে। এটি এক অন্য মাত্রার সুস্থতা – অবশ্যই এর থেকে সুস্বাস্থ্য পাওয়া যায়, কিন্তু সিক্স-প্যাক-অ্যাবস্‌ নয়। যদি আপনি ক্যালরি খরচ করার জন্য বা পেশী শক্তি বাড়ানোর জন্য যোগ করেন তাহলে এটা পরিস্কার যে আপনি ভুল পদ্ধতিতে যোগ করছেন, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। পেশী তৈরীর জন্য আপনি জিমে যেতে পারেন। যোগাভ্যাস খুব সূক্ষ্ম এবং প্রশান্ত ভাবে করা প্রয়োজন, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে নয়, কারণ যোগ কোনও শরীর চর্চা নয়।

এই ভৌত শরীরে স্মৃতির একটা গোটা কাঠামো আছে। যদি এই শরীরটাকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করার সদিচ্ছা থাকে, তাহলে বুঝতে পারি যে, সব কিছু – কীভাবে শূন্য থেকে সৃষ্ট হয়ে ব্রহ্মান্ড আজকের এই রূপ ধারণ করলো, আর এই শরীরের মধ্যেই সেই রহস্য নিহীত আছে। আপনি যখন আসন করেন তখন সেই স্মৃতিগুলিকে উন্মুক্ত করেন এবং এই জীবনের পুনর্গঠন করে এক অপার সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যান। যদি হঠযোগ সঠিক পরিবেশে শেখানো যায়, তাহলে এটি আপনার শরীরকে দেবত্বের অমৃত গ্রহণের উপযুক্ত করে তোলার জন্য একটি দারুণ প্রক্রিয়া।

প্রচলিত ধারণা # ৪: মাত্র গত শতাব্দীতেই যোগ বিশ্বের দরবারে পৌছতে পেরেছে
যদিও যোগ আজ বহু বিচিত্র রূপে এবং বিকৃতভাবে অভ্যাস করা হচ্ছে, তবুও অন্তত ‘যোগ’ শব্দটি সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। এর প্রসার ঘটানোর জন্য কখনও কোনও সংগঠিত প্রতিষ্ঠান ছিল না, তা সত্ত্বেও, এটির অস্তিত্ব অম্লান, এবং তার কারণ, দীর্ঘতম সময় ধরে মানুষের মঙ্গলের জন্য এর থেকে বেশি কার্যকরী আর কিছুই ছিল না।
লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ আজ যোগাভ্যাস করছে, কিন্তু যোগ এল কোথা থেকে? কে সৃষ্টি করল যোগ? সে এক দীর্ঘ কাহিনী। এই সুপ্রাচীন কাহিনী কালের ধূসরতায় হারিয়ে গেছে। যোগের সংস্কৃতিতে শিব ভগবান হিসেবে পরিচিত নন, তিনি পরিচিত আদিযোগী হিসেবে অর্থাৎ প্রথম যোগী – যোগের স্রষ্টা হিসেবে। তিনিই সেই মানুষ যিনি প্রথম এই বীজ বপন করেছিলে মানুষের চেতনায়।
শিব প্রথম প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তার স্ত্রী পার্বতীকে। দ্বিতীয় দফার যোগ শিক্ষা দান করেন তার প্রথম সাতজন শিষ্যকে কেদারনাথের কান্তি সরোবরের তীরে। এখানেই বিশ্বের প্রথম যোগ শিক্ষার কার্যক্রম হয়। বহু বছর পর, যখন যোগ শাস্ত্রের জ্ঞান দান সম্পূর্ণ হয়, তখন উদ্ভব হয় সাতজন পূর্ণরূপে আলোকপ্রাপ্ত সত্ত্বার- সাতজন সুপ্রসিদ্ধ ঋষি যাঁরা সপ্তঋষি নামে পরিচিত এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতে পুজিত ও প্রশংসিত। শিব এই সাতজনের প্রত্যেককে যোগশাস্ত্রের একটি করে দিক প্রদান করেন, আর এই সাতটি দিক যোগের মূল সাতটি ধারা হয়ে যায়। আজও যোগের এই সাতটি পৃথক ধারাকে বজায় রাখা হয়েছে।
সপ্ত ঋষিদের বিশ্বের সাতটি ভিন্ন দিকে পাঠানো হয়েছিল, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যোগের এই সাতটি ধারাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, যার সাহায্যে মানুষ নিজেদের বর্তমান সীমাবদ্ধতা এবং অভ্যাসের দাসত্বের উর্দ্ধে উঠে বিকশিত হতে পারবে। একজন গেলেন মধ্য এশিয়ায়, একজন মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায়, একজন দক্ষিণ আফ্রিকায়, একজন আদিযোগীর সঙ্গেই থেকে গেলেন, একজন হিমালয়ের নিম্ন অঞ্চলে এবং একজন দক্ষিণের ভারতীয় উপমহাদেশে চলে গেলেন। সময় অনেক কিছুই ধ্বংস করেছে, কিন্তু যদি ওই সব অঞ্চলের সংস্কৃতিকে গভীর ভাবে লক্ষ্য করা যায়, তাহলে দেখা যাবে সেখানকার মানুষদের ছোট ছোট লোকাচারের মধ্যে ঋষিদের সেই সংস্কার আজও বেঁচে আছে। হয়তো বিভিন্ন রঙ রূপ ধারণ করেছে, নিজস্ব রঙ হারিয়েছে হাজার রকম ভাবে, কিন্তু এই প্রবণতাগুলো আজও দেখা যায়।
প্রচলিত ধারণা # ৫: সঙ্গীত যোগের সহায়ক
চলতে চলতে, গান শুনতে শুনতে, কাজ করতে করতে যোগ হয় না। যোগাসন অভ্যাস করার সময় আয়না অথবা কোন সঙ্গীত থাকা উচিৎ নয়। হঠযোগে আপনার শরীর, মন, শক্তি এবং অন্তঃকরণ, এই সবকিছুর এক বিশেষ একাত্মতার প্রয়োজন। সৃষ্টির উৎসকে যদি আপনার মধ্যে একাত্ম করতে চান, তাহলে আপনার শরীর, মন, শক্তিকে অবশ্যই পূর্ণরূপে একাগ্র হতে হবে। বিশেষ নিষ্ঠা এবং মনযোগের সাথে এগোতে হবে। সেই কারণেই পথ চলা, বা গান শুনতে শুনতে, কাজ করতে করতে যোগ হয় না। যোগ স্টুডিওগুলির একটি বড় সমস্যা এখানে শিক্ষক আসন করাকালীন কথা বলেন। এটা নিশ্চিত ভাবেই আপনার ক্ষতির কারণ হয়ে যায়।
আসন করার সময় কথা না বলাটা কোনও আদর্শ পদ্ধতি নয়, বরং এটাই নিয়ম। আসনে বসে আপনি কখনই কথা বলতে পারবেন না। আপনি যখন আসন করেন, আপনার শ্বাসপ্রশ্বাস, মনঃসংযোগ, শক্তি প্রভৃতির স্থিতিশীলতা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। কথা বললে, আপনি এই সবকিছু বিনষ্ট করে ফেলবেন।
ভুল পদ্ধতিতে যোগাভ্যাস করে বহু মানুষ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। তার মানে এই নয় যে যোগ বিপজ্জনক। হঠকারিতা সব সময়ই বিপদ ডেকে আনে, নিজেরই ক্ষতি করে। সেই প্রাচীন সময় থেকেই নির্বুদ্ধিতা বিপদ ডেকে এনেছে পৃথিবীতে।
প্রচলিত ধারণা # ৬: যোগের নির্দেশিকা চাই? বই পড়ে যোগ শিখতে পারেন
আজকাল, যে কোনও বই-এর দোকানে গেলে, অনেকগুলি যোগের বই পেয়ে যাবেন। ‘কীভাবে ৭ দিনে যোগ শিখবেন, কিভাবে ২১ দিনে যোগী হতে পারবেন’…বহু মানুষ এই সব যোগের বই থেকে যোগ শিখে নিজেদেরই ক্ষতি করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে এটা খুব সরল মনে হয়, কিন্তু অভ্যাসের সময় এর সূক্ষ্ম দিকগুলো উপলব্ধি হয়। যোগাভ্যাস করতে হয় সঠিক ধারণার মাধ্যমে এবং প্রকৃত শিক্ষকের সহায়তায়। অন্যথায় না জেনে যোগ শিখতে গেলে গভীর বিপদে পড়তে পারেন। বই আপনাকে যোগ শেখার প্রেরণা দিতে পারে, কিন্তু বই কখনই যোগ শেখায় না।
প্রচলিত ধারণা # ৭: যোগ প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যায় অভ্যাস করতে হয়
যোগ সকাল-সন্ধ্যায় অভ্যাস করার জন্য নয়। এটি বিশেষভাবে বাঁচা। নিজেকে যোগ হয়ে উঠতে হয়। যদি সেটা সকাল-বিকেলের যোগ হয়, তবে বাকি সময়টা জটিলতায় জড়িয়ে থাকা – সেটি যোগ নয়, শুধুই যোগের অভ্যাস।
জীবনের এমন কোনও দিক নেই যা যোগ প্রক্রিয়ার বাইরে। যদি আপনার জীবনটাই যোগ হয়ে ওঠে, তাহলে আপনি সব কিছু করতে পারবেন। আপনি যাই করতে চান- সংসার, অফিস, ব্যবসা, কোনও কিছুতেই সমস্যা হবে না, যদি আপনার অস্তিত্বটাই হয়ে ওঠে যোগময়। জীবনের প্রতিটি দিককেই আপনি জড়িয়ে পড়ার ফাঁদ হিসেবে বা মুক্তির উপায় হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন। যদি এটাকে আপনি নিজেকে বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য ব্যাবহার করেন, তাহলে আমরা তাকে বলি কর্ম। আর যদি মুক্তির জন্য একে ব্যবহার করেন, তখন তাকে বলি যোগ।
*******

Sahityika Admin

1 comment

  • আমি বেসিক যোগাভ্যাস করি। এই লেখা আমাকে অনেক সাহায্য করবে।