রাজযোগের আটটি অঙ্গ, সেগুলিকে ‘অষ্টাঙ্গ’ বলে। এগুলি যথাক্রমে যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারনা, ধ্যান ও সমাধি। এই আটটি প্রক্রিয়া ক্রমে ক্রমে অভ্যাস করতে হয়। এগুলির একটি আয়ত্ত হলে তবেই পরবর্তী সোপানে আরোহন করা যেতে পারে। এখন আলোচনা করব কোন পর্যায় বলতে কি বোঝায়। চলুন দেখা যাক:
যম – অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ এই পাঁচটিকে যম বলা হয়।
নিয়ম – শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায়, এবং ঈশ্বর উপাসনা এই পাঁচটি নিয়মের অন্তর্ভুক্ত। ‘যম’ ও ‘নিয়ম’ এই দুটিরই উদ্দেশ্য ইন্দ্রিয় ও চিত্তবৃত্তিগুলিকে দমন করা এবং অন্তর্মুখী করে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করা।
আসন – যোগ অভ্যাস করার জন্য যেভাবে শরীরকে রাখলে শরীর স্থির থাকে অথচ কোন কষ্টের কারন ঘটে না তাকে আসন বলে। স্থির ও সুখজনকভাবে অবস্থান করার নামই আসন।
প্রাণায়াম – প্রাণায়ামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ প্রাণবায়ুর নিরোধ। ‘প্রাণ + আয়াম = প্রাণায়াম। প্রাণ অর্থ শ্বাসরূপে গৃহীত বায়ু আর আয়াম অর্থ বিস্তার। অর্থাৎ স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে গতিরোধ করাকেই প্রাণায়াম বলে। প্রাণায়ামে শ্বাস-প্রশ্বাস বিস্তারিত ও দীর্ঘতর করা হয়। এইরকম ছন্দোবদ্ধভাবে শ্বাস গ্রহন করায় শ্বসনতন্ত্র বলিষ্ঠ হয়, স্নায়ুতন্ত্র শান্ত থাকে এবং পার্থিব আকাঙ্খা হ্রাস পায়। সাধারনত তিনটি প্রকৃয়ার মাধ্যমে প্রাণায়াম সম্পন্য হয়। এগুলি হলো রেচক, পূরক ও কুম্ভক। শ্বাসগ্রহনকে বলে পূরক, ত্যাগকে বলে রেচক এবং শ্বাস ধারনকে বলে কুম্ভক।
প্রত্যাহার – আসন ও প্রাণায়ামের দ্বারা শরীরকে নিশ্চল করলেও মনের চঞ্চলতা সম্পূর্ণ দূর নাও হতে পারে। এরূপ অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলিকে বাহ্যবিষয় থেকে প্রতিনিবৃত্ত করে চিত্তের অনুগত করাই হলো প্রত্যাহার।
ধারনা – কোন বিশেষ বস্তু বা আধারে চিত্তকে নিবিষ্ট বা আবদ্ধ রাখাকে ধারনা বলে। অর্থাৎ ‘ধারনা’ শব্দের অর্থ দ্বারালো একাগ্রতা। জগতে একাগ্রতা ছাড়া কিছুই লাভ করা যায় না। ঈশ্বরকে লাভ করতে গেলেও চিত্তকে একাগ্র করতে হয়।
ধ্যান – যে বিষয়ে চিত্ত নিবিষ্ট হয়, সেই বিষয়ে যদি একতানতা জন্মায় তাহলে তাকে ধ্যান বলে। অর্থাৎ ধ্যান শব্দের প্রকৃত অর্থ নিরবচ্ছিন্ন গভীর চিন্তা।
সমাধি – ধ্যান যখন গাঢ় হয় তখন ধ্যানের বিষয়ে চিত্ত এমনভাবে নিবিষ্ট হয় যে, চিত্ত ধ্যানের বিষয়ে লীন হয়ে যায়। এ অবস্থায় ধ্যানরূপ প্রকৃয়া এবং ধ্যানের বিষয় উভয়ের প্রভেদ লুপ্ত হয়। চিত্তের এই প্রকার অবস্থার নামই সমাধি। এই সমাধি দুইরকম – সবিকল্প ও নির্বিকল্প।
সাধকের যখন ধ্যানের বস্তু ও নিজের মধ্যে পার্থক্যের অনুভূতি থাকে তখন সে অবস্থাকে বলা হয় সবিকল্প সমাধি। আবার সাধক যখন ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান সে অবস্থাকে বলা হয় নির্বিকল্প সমাধি। তখন সাধকের মনে চিন্তার কোন লেশমাত্র থাকে না। এই সমাধি লাভ যোগসাধনার সর্বোচ্চ স্তর এবং যোগীর পরম প্রাপ্তি।
প্রচলিত ধারণা # ১: যোগের উৎপত্তি হিন্দুধর্ম থেকে
যোগ ততটাই হিন্দুধর্মের যতটা মাধ্যাকর্ষণ খ্রীস্ট ধর্মের। আইজ্যাক নিউটন খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বী ছিলেন আর মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্বটি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বলেই কি মাধ্যাকর্ষণ খ্রীস্ট ধর্মের হয়ে যায়? যোগ একটি প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি যিনি চাইবেন, তিনিই কাজে লাগাতে পারেন।
যোগ বিজ্ঞান যে হিন্দুত্বের তকমা পেয়েছে তার কারণ, এই বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিটির জন্ম এবং প্রসার এই সংস্কৃতিতে আর স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনে এটি হিন্দু জীবনশৈলীর অঙ্গ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। “হিন্দু” শব্দটি এসেছে মূল শব্দ “সিন্ধু” থেকে, যা একটি নদীর নাম। যেহেতু এই সভ্যতা সিন্ধু তথা ইন্ডাস নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল, তাই এই সভ্যতার নাম হয় হিন্দু। এই হিন্দু কোনও ধর্মমত নয় – এটি একটি ভৌগলিক তথা সাংস্কৃতিক পরিচয়।
প্রচলিত ধারণা # ২: যোগ মানে, জিলিপির মতো, অসম্ভব কিছু অঙ্গভঙ্গি
আমরা যখন ‘যোগ’ শব্দটি বলি, পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই যোগাসনের কথা ভাবেন। জীবনের প্রায় সব দিকগুলিতেই যোগ বিজ্ঞান অবদান রেখেছে, কিন্তু তার মধ্যে শারীরিক ভঙ্গীকেই মানুষ আজ যোগকে উপস্থাপন করার জন্য বেছে নিয়েছে। অথচ যোগশাস্ত্রে আসনগুলিকেই সব থেকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রায় দুশোর কিছু বেশি যোগসূত্রের মধ্যে শুধুমাত্র একটি সূত্রই উৎসর্গ করা হয়েছে যোগাসনের জন্য। কিন্তু আধুনিক যুগে এই একটি সূত্র বাকি সূত্রগুলির থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়ে বসেছে।
পৃথিবী আজ কোন দিকে চলেছে তা নানাভাবে স্পষ্ট। আধুনিক পৃথিবীর যাত্রা একটি দিকেই – গভীরতর অন্তর্জগত থেকে শরীরের দিকে। ঠিক এই ব্যপারটির পরিবর্তন আবশ্যক। আকাঙ্ক্ষিত যে মানুষ তার শরীর থেকে শুরু করে অন্তর প্রকৃতির দিকে যাক।
প্রচলিত ধারণা # ৩: সিক্স প্যাক অ্যাব চাই? যোগ অসাধারণ ব্যায়াম অনুশাসন
যদি শুধু একটি সুঠাম শরীর আমার কাম্য হয়, যদি আমি ‘সিক্স-প্যাক-অ্যাবস্’ (six-pack abs) বা এক কথায় পেশীবহুল শরীর চাই, তাহলে আমি টেনিস খেলবো, পাহাড়ে চড়ুবো। কারণ, যোগ কোনও শরীরচর্চা নয়, এর সঙ্গে ভিন্নতর মাত্রা সংযুক্ত আছে। এটি এক অন্য মাত্রার সুস্থতা – অবশ্যই এর থেকে সুস্বাস্থ্য পাওয়া যায়, কিন্তু সিক্স-প্যাক-অ্যাবস্ নয়। যদি আপনি ক্যালরি খরচ করার জন্য বা পেশী শক্তি বাড়ানোর জন্য যোগ করেন তাহলে এটা পরিস্কার যে আপনি ভুল পদ্ধতিতে যোগ করছেন, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। পেশী তৈরীর জন্য আপনি জিমে যেতে পারেন। যোগাভ্যাস খুব সূক্ষ্ম এবং প্রশান্ত ভাবে করা প্রয়োজন, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে নয়, কারণ যোগ কোনও শরীর চর্চা নয়।
এই ভৌত শরীরে স্মৃতির একটা গোটা কাঠামো আছে। যদি এই শরীরটাকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করার সদিচ্ছা থাকে, তাহলে বুঝতে পারি যে, সব কিছু – কীভাবে শূন্য থেকে সৃষ্ট হয়ে ব্রহ্মান্ড আজকের এই রূপ ধারণ করলো, আর এই শরীরের মধ্যেই সেই রহস্য নিহীত আছে। আপনি যখন আসন করেন তখন সেই স্মৃতিগুলিকে উন্মুক্ত করেন এবং এই জীবনের পুনর্গঠন করে এক অপার সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যান। যদি হঠযোগ সঠিক পরিবেশে শেখানো যায়, তাহলে এটি আপনার শরীরকে দেবত্বের অমৃত গ্রহণের উপযুক্ত করে তোলার জন্য একটি দারুণ প্রক্রিয়া।
আমি বেসিক যোগাভ্যাস করি। এই লেখা আমাকে অনেক সাহায্য করবে।