সাহিত্যিকা

বর্ষাস্মৃতি

বর্ষাস্মৃতি
@তাপস সামন্ত ১৯৯১ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

বর্ষাস্মৃতি ১
বর্ষা বললেই, এ কারাগার ছেড়ে মন সোজ্জা রূপনারায়ণ বরাবর লাগায় এক ছুট। একফালি সবুজ ঘেরা গ্রাম। পুবের মাঠ ছনছনে সবুজ। এলোমেলো ঘন সবুজ দূর্বা ঘাসে ঢাকা। মাঝে মাঝে ধানের চারাতলা। রোয়ার অপেক্ষায়। তারই অনতিদূরে খেলার অস্থায়ী মাঠ। প্রথম ঢালা বৃষ্টির আগে বেশিরভাগ ভাগটাই ফুটিফাটা। বড়জোর কালবৈশাখীর সঙ্গী দু এক পশলা বৃষ্টি হয়তো তার রুক্ষতাকে ঢেকে একটু কোমলতার প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে মাত্র। দূর থেকে অন্তরের রুক্ষতাটুকু আর বোঝার উপায় নাই এতটাই প্রাণবন্ত সবুজ।

কালবৈশাখী চলে গেছে। রয়ে গেছে তার সঙ্গী ঘন বাদল মেঘ আকাশের এক কোণে। সূর্যের প্রকোপে বিদ্ধস্ত। সহযোগীদের অপেক্ষায় যেন কোনরকমে লড়াই টিকিয়ে রাখা সৈনিকের মতো। সময়ের সাথে সাথে সহযোগী সব উড়ে আসে দক্ষিণ পশ্চিম কোন ঘেঁসে। ঘন বাদল মেঘ শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে আকারে বপুতে। বেড়ে ওঠে আকাশের গায়- এক সময় পুরো আকাশ ছেয়ে ফেলে। সুর্য্যের তাপ অসহনীয় হয়ে ওঠে। তবুও হার মানে না বাদল মেঘের দল। আকাশ কালো করে ছুটে আসে। মাঠে ঘাটে হুটোপুটি লেগে যায়। বড়দের যত পার্থিব চাওয়া পাওয়ার মাঝেই ঘুরপাক খেতে থাকে ছোটদের ছোট্ট ছোট্ট ইচ্ছেরা। তারপর যখন মেঘেরা জয়ী হয়, তার নিকষ কালো জটা বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা টপ টপ করে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে এসে পড়ে শুষ্ক মাটির বুকে, সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। গাছে গাছে পাতায় পাতায় জীবনের উন্মাদনা। প্রথম বৃষ্টির সাথে ছেলে ছোকরার দলও দৌড়ে পাল্লা দেয়। শেষ রক্ষা হয় না। সুতীক্ষ্ণ শলাকার মতো আদুল শরীরে এসে বেঁধে। তারপর ঝমঝমিয়ে শুরু হয় বৃষ্টি ঝরা। কখনো পুকুর জলে মাথা ডুবিয়ে, কখনো জামগাছের মগডালে বসে ছেলে ছোকরার দল সেই বৃষ্টির দুর্বোধ্য ভাষা বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যায়। গন্ধরাজ, কামিনী, হাসনুহানা, রজনীগন্ধা সব একজোট হয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানায় সেই বৃষ্টি কে। সুগন্ধি ফুলের ডালি মেলে বরণ করে নেয়। যেসব কোমল পেলব রঙিন পাতারা প্রচণ্ড গরমেও শুকিয়ে যায় নি তারা যৌবনমদমত্ত হয়ে ঘন সবুজ রঙ ধরতে ছোটে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। নহবৎ বেজে ওঠে পুকুরে, নালায়, দহে, পরিত্যক্ত জলাভূমিতে। বর্ষার প্রথম জলের স্বাদ তাদের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে তোলে। মকমকির দল আসর বসায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের; কোন সুদূরে লুকিয়ে থাকা সঙ্গিনীকে সুরপাশে আবদ্ধ করে টেনে আনার তীব্র আকাঙ্খায়।

প্রেম জেগে ওঠে মাছেদের বুকেও। সঙ্গী বা সঙ্গিনীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ে সন্ধ্যার শীতল গাঢ় অন্ধকারে। মাঝেমধ্যেই বিদ্যুতের ঝলকানি আর তার সুতীব্র চিৎকারে অন্ধকার চিরে একবারে ফালাফালা হতে থাকে।

বাইরের ঝমঝমে বৃষ্টি তখন কমে ঝিরঝিরে হয়ে এসেছে। ঘরে ঘরে কিশোর কিশোরীরা কেরোসিনের আলোয় বই খুলে বসে। মন তখনো বাইরের ডাক উপেক্ষা করে মনোনিবেশ করে উঠতে পারেনি। মৃদু গুঞ্জনে কেবল পড়ার অভিনয় চলতে থাকে বড়দের বকুনির ভয়ে। সেই ফাঁকে কখনো সখনো বৃষ্টিভেজা ডানা ভারি হয়ে পাপিয়া, হলুদকুঁড়ি, টিয়া, ফিঙে বা বাতাসিদের নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে টেনে একেবারে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসে। তারা অন্ধকার থেকে হঠাৎ আলোয় এসে দৃষ্টি হারিয়ে ঝটপট করে এদিক ওদিক ডানা ঝাপটে বেড়ায়। শেষ রক্ষা হয় না। কৈশোরের পটুতা আর চপলতার কাছে হার মেনে ধরা দেয়। তারপর তাদের স্থান হয় বেতের ঝুড়ি বা আলমারির তাকে। ভীত সন্ত্রস্ত্র আর অসমর্থ ভেজাডানা পাখিগুলোর হৃদস্পন্দন কৈশোর হৃদয়েও কাঁপুনি তোলে। কোন এক ফাঁকে বড়দের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে আড়ালে বেরিয়ে যায় কৈশোর টর্চ, ঝুড়ি আর কাটারি হাতে। বাইরে তখন ঘুটঘুট্টে অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি। রাস্তাঘাট পিছল। আওয়াজ বলতে ব্যাঙ, ঝিঁঝি আর পুকুরে জল নামার একটানা শব্দ।

সেই অন্ধকার সরিয়ে কৈশোর হাতে ধরা টর্চের আলো খুঁজে বেড়ায় মাছেদের। দেখামাত্র মেরে ফেলার হুকুম জারি হয়েছে আজ। অল্প ছিপছিপে শীতল জলে মাছেরা তখন খলবলিয়ে চরে বেড়াচ্ছে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর খোঁজে; প্রেমোন্মাদ, ঢলঢলে যৌবনভার নিয়ে। জোরালো টর্চের আলো তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। থমকে পড়ে তারা। তখনি নেমে আসে কালান্তক শমন কাটারি বা ছোরার বেশে। sযৌবন পেরিয়ে প্রৌড়ত্বের শেষ প্রান্তে এসে সেই কিশোরের উপলব্ধি আক্ষেপ করে সেদিনের নিষ্ঠুরতাকে নিয়ে। আজকেও সব কৈশোর তবুও সেই একই পথে পা বাড়ায় জীবনের নিয়ম মেনে।

বর্ষাস্মৃতি ২
বর্ষণমুখর রাতে মাঠময় ইতস্তত দাপিয়ে বেড়ায় কৈশোর। জোনাকির আলোর মত। মাঠ জুড়ে নেচে বেড়ায়। দূরের টর্চের আলো আর কাছের জোনাকি মিলে মিশে একাকার। হাতের টর্চের আলো জলে প্রতিফলিত হয়ে উর্ধগামী হয়। আর সেই প্রতিফলিত আলোয় জলজ গাছগাছালির প্রলম্বিত ছায়া পড়ে এদিক ওদিক। অন্ধকার রাতে গুঁড়ি গুঁড়ি একটানা বৃষ্টির শব্দ, ব্যাঙেদের ডাকাডাকি, চাপাস্বরে ভেসে আসা দুরের কথোপকথন আর ঘন গাঢ় অন্ধকার যত অসম্ভব কল্পনার উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করে। সেই কল্পনার আঙ্গিকে সব ছায়াই কখন কায়া হয়ে নড়ে চড়ে বেড়ায়। যে সব কাহিনীর আবহে ঠাম্মার কোল ঘেঁষে শৈশব শিহরিত হয় তারাই সব যেন একে একে মূর্ত হয়ে ওঠে কৈশোরের অবচেতনে। আবছা আলোছায়ায় সেই সব কাল্পনিক ছায়ামুর্তির সাথে ছায়াযুদ্ধ চালায় দুঃসাহসী কৈশোর। সাহস যখন বিদ্রোহ করে বসে কৈশোর কন্ঠ চিৎকার করে ওঠে “ওখানে কে রে?”। যথাযথ প্রত্যুত্তর ভেসে এলে অভিযান চলতেই থাকে যতক্ষণ না হাঁক পড়ে বাড়ি অন্য সদস্যদের থেকে। নতুবা পিছন না ফিরে পিছন পানে পিছিয়ে চলার পালা। ছড়ানো ছিটানো আলোর বিন্দুগুলো সব ধীরে ধীরে জোটবদ্ধ হয়। একে একে ফিরে আসে ভিটের পাশে। অভিজ্ঞতার ঝুলিও পরিপূর্ণ হয়ে যায় বিভিন্ন কাটা মাছে ভর্তি ঝুলির সাথে। তারপর ঘাটে হাত পা ধুয়ে বাবা কিংবা মার বকুনি হজম করে বাড়ি ঢুকে পড়া টুক করে। কিছু পরে পিটপিট বৃষ্টি মাথায় করে এ বাড়ি খিঁচুড়ি খেয়ে ও বাড়ি তে শুতে যাওয়া। তালপাতার পেখোয়া সারাক্ষণ সঙ্গী হয়েই থাকত তবে। তারপর ভাই বোনেরা মিলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে যত আজগুবি গল্পের আসর। বাইরে বৃষ্টির দমক বাড়ে কমে। চড়বড়িয়ে টিনের চালে দাপিয়ে বেড়ায়। যেন দুরের কোন ঘোড়সওয়ারের কাছে আসে আবার দুরে চলে যায়। এই যাওয়া আসার মাঝে গল্পের আসর জমে ওঠে। তারপর এক সময় বড়দের হুকুম আসে গল্পের আসর বন্ধ করে ঘুমের দেশে যাবার। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চোখে ঘুম নেমে আসে শেষে।

প্রতিদিনের মতো একই নিয়মে সকাল হয়। কোন দিন বৃষ্টিভেজা ঝকঝকে সকাল। তো কোন দিন আকাশের মুখ বেশ ভার, সুর্যের মুখ ঢেকে বসে আছে। চারিদিকে নরম মাটির বাস ছড়িয়ে আছে। কোন দিন আবার ঝিরঝিরে একটানা বৃষ্টি মাতাল হাওয়ার দমকে দমকে ভেতরে ঢুকে আসতে চায়। কোন কোন দিন রাতের বৃষ্টি নেশার ঘোরে তখনও ঝমঝমিয়ে ঝরে চলেছে দামাল হাওয়ার সাথে।

বর্ষাস্মৃতি ৩
সকাল সে যেমন ই হোক- মেঘে ঢাকা, বৃষ্টি মাখা, বা রোদ ঝলমলে, কৈশোরের কাছে সে স্বাধীনতার প্রতিমুর্তি। বাইরের জগৎ যখন অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে রাতের চৌহদ্দির দেওয়ালগুলো ভেঙ্গে, তখন কৈশোর বুক ভেসে যায় মুক্তির আনন্দে। চার দেওয়ালের বাইরে বেরোনোর ছাড়পত্র। বাইরে বেরোলে গুরুজনদের বকুনি নেই, অন্ধকারে অহেতুক ভয় বা আশঙ্কার কারন নেই এমন কি ঘরে ফেরার তাড়াও নেই। এমনই উন্মুক্ত মন নিয়ে কৈশোরের দল বেরিয়ে পড়ে মাঠে মাঠে। আলতাপাটি ডোবা জলে মাঠ তখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনোন্মুখ। কোথাও বা এখনও ডাঙা জেগে। বর্ষার নতুন জলাভূমি। কাছে পিঠের পুকুরে তখনও হয়তো জল নেমেই চলেছে। কাঁকড়ারা এদিক ওদিক নতুন বাসা বানিয়েছে। সদ্যতোলা কাঁকড়ামাটি গর্তের আশেপাশে জড়ো করা। কোথাও আবার গর্তের মুখ নিচু রয়ে গেছে। তাই দিয়ে বৃষ্টির জল ঢুকেই চলেছে ঢক ঢক করে। পুকুরে জল নামার শব্দ বেশ একটা নৈসর্গিক আবহসঙ্গীত রচনা করছে। সবাই মিলে পাল্লা দিয়ে চলে জল ছেটানো। কে কদ্দূর ছিটোতে পারে। তারই মাঝে হঠাৎ পা পিছলে ডিগবাজি। সব কিছু ভিজে জবজবে। হঠাৎ সবারই হুঁস ফেরে অকারনে।

সুর্য্য উঠেপড়ে দিগন্তরেখা ছাড়িয়ে। মেঘলা বা বৃষ্টিমাখা সকাল হলে সরাসরি না দেখা গেলেও বোঝা যায় মোটামুটি পরিষ্কার ভাবেই। এরই মাঝে মাঠের ওই ছিপছিপে জলে আটকা পড়ে থাকা কই, মাগুর, শিঙি, ল্যাঠা, শোল ইত্যাদি জিওল মাছের সন্ধান মেলে। খালি হাত, নতুন বর্ষার জলে মাছের পিচ্ছিল শরীর আর যৌবন উন্মত্ত জীবনীশক্তির কাছে কৈশোর বার বার হেরে যায়। জেদ চেপে বসে। অনেক কসরত করে শেষে ধরা দেয়। মাছের পিছু পিছু সবাই গিয়ে পৌঁছায় জলাভূমির ধারে যেখানে মাঠের শীতল জল শব্দ করে জলাভূমি একটানা ভরিয়ে চলে। সেই জলস্রোতের বিপরীতে উপস্থিত সব খাদ্য আর খাদকের দল। নিরীহপ্রাণ পুঁটি, মৌরলার দল উজান খোঁজে ডিম পাড়ার জন্যে। তাই স্রোতে বিপরীতে লাফ মেরে উজান বাইতে চায়। আর জলস্রোতের পাশেই লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকে জলঢোঁড়া, হেলে, জলমেটুলি বা আরও কিছু নির্বিষ সাপ, পাশাপাশি বোড়া, জলবোড়া বা অন্য বিষাক্ত সাপও। মাছেরা লাফালাফি করলে বা উজান বেয়ে জল ছেড়ে উঠলেই খপ করে ধরে ফেলে। সে এক অদ্ভুত শিকার ধরার প্রতিযোগিতা। কৈশোরের উন্মাদনা কোন কিছুই গ্রাহ্য করে না। সেও হাত বাড়িয়ে দেয় সবার আগে মাছটি হস্তগত করার জন্যে। ফলে অনেক সময়ই সাপের রাগ এসে পড়ে হাতের ওপর। মাছের বদলে কামড়ে ধরে হাতের আঙ্গুল। খলখল করে রক্ত ঝরে। আর কাটা অংশে জল লেগে বা বিষক্রিয়ায় জ্বালা করে। অজানা আশঙ্কায় বারবার চেনার চেষ্টা করে সাপটাকে। তারপর বাড়ি ফেরার পালা কিছুটা বিষণ্ণ মনেই। আশঙ্কা কিছুতেই চাপা থাকে না কেউ না কেউ বাবা মা বা বাড়ির কানে তোলে কথাটা। মুহূর্তে হুলুস স্থুলুস পড়ে যায় বাড়িতে। সাপে কামড়ানো আঙ্গুলটা নিয়ে রীতিমতো টানাটানি চলে। কোথাও না কোথাও থেকে চুনহলুদমাখা চলে আসে। প্রলেপ লাগানো হয়। খবর যায় পাড়া গুনিন সুবলবাবু কাছে। সুবলবাবু প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। একমাত্র সন্তান বলে ছোটবেলা থেকেই ভীষণ খাইয়ে লোক। বেঁটেখাটো শক্তপোক্ত চেহারা। সুবলবাবু কে খবর দেওয়া হয়েছে শুনে পরে যা ঘটতে চলেছে সেটা আন্দাজ করা মোটেই দুরূহ ব্যপারে নয়। ভয়ে বিরক্তিতে আর রাগে জ্বলুনি টা শারীরিক থেকে কখন যেন মানসিক হয়ে পড়ে। বাবা মা কে বোঝানোর কোন ত্রুটি রাখে না যে সবই আসলে সুবলবাবুর বুজরুকি। ওভাবে বিষ কিছুতেই নামে না। সবার অযাচিত উপদেশে বাবা মাও দশচক্রে ভগবান ভুত। অগত্যা সুবল বাবু এসেই পড়লেন। সদরে মাদুরপাতা হল। প্রাথমিক খোঁজখবরাদি (যার মধ্য দিয়ে স্রেফ জেনে নেওয়া যে সত্যি কোন বিষধর সাপ কামড়েছে কিনা বা পরিবার ঠিক কতটা উদ্বিগ্ন। নৈবেদ্য সেই মতো সাজানো হবে।) শুরু হয়। এক সময় দেখা যায় ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী কৈশোর একরাশ বিরক্তি নিয়ে মাদুরে বসে। আর সামনে সুবলবাবু মাটিতে বাঁ হাত রেখে উবু হয়ে বসে। তার চারিদিকে গোল হয়ে ঘিরে উৎসুক জনতা। তখন বাইরে রোদ না বৃষ্টি না মেঘলা তাতে কারো কোন কিছু আসে যায় না। কৈশোরের চোখগুলি তখন অদম্য কৌতুহলী- কোন মন্ত্রবলে ওই বাঁ হাত চলতে শুরু করবে তা নিয়ে! কেউ কেউ আবার অবিশ্বাসী হয়ে বিদ্রোহ করে। বড়রা সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যান। হঠাৎই সব কথা থেমে যায়। সুবলবাবু ঝুঁকে পড়ে অত্যন্ত চাপা গলায় বিড়বিড় করে কিছু বলছেন। কিন্তু সেই শুনে তার ভাষা বা অর্থ উদ্ধার খুব দুরূহ ব্যপার। প্রতিবার বলা হলে আস্তে হাতে ফুঁ দেন জোরে নিচু মুখে- কেউটের শ্বাস ছাড়ার মতো “ফুঁউউউউউ” করে আওয়াজ বের হয়। একবার, দুবার। কৈশোর ধৈর্য হারাতে বসে। এই শেষ বার উদ্ধার করতেই হবে শব্দগুলো। সবারই কান খাড়া। ওই নিঃশব্দ আবহে অবশেষে পরিষ্কার হয় শব্দগুলো
“আলবিষ তালবিষ আর শেয়ালবিষ সব
আমার হাতের ‘পরে রাখ এসে শব।
নিয়ে চল এই হাত যতদুর চলে
মা মনসার দৈবকৃপা বলে।
বিষ থাকে তো যা
না থাকে তো না যা।
বিষ থাকে তো যা
না থাকে তো না যা।
বিষ থাকে তো যা
না থাকে তো না যা।
মা মনসার কৃপায়” ফুঁউউউউউউ।
ধীরে ধীরে হাত চলতে শুরু করে। কৈশোর পা বাইতে বাইতে হাঁটুর ওপরে গিয়ে থেমে যায় হাত।

বর্ষাস্মৃতি ৪
কৈশোর বেজায় বেআক্কেলে। সব কিছুই নিজের বোধবুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে চায়। নিজের বিশ্লেষণে যদি সত্যিটা বেরিয়ে না আসে তো কিছুতেই সেটা সত্যি বলে মেনে নিতে চায় না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগে মনে। সেই অনুসন্ধিত্সার সামনে কোন কিছুই সন্দেহের উর্ধ্বে উঠতে পারে না। তাই আজ যখন দেখল ডানহাতের আঙ্গুলে সাপ কামড়ানোয় বাম পায়ের হাঁটু অব্দি বিষ উঠল তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। বলে উঠল “বাবা, সাপটা তো ডান হাতের আঙ্গুলে কামড়েছে। এই দেখো!” বলে আঙ্গুলের ক্ষতটা তুলে ধরল। কালিবাবু তা শুনে গম্ভীর হয়ে বললেন “তাই ভাবছিলাম হাঁটু ছেঁড়ে বার বার হাতটা ওর হাতের ওপর চলে যাচ্ছিল কেন। একটা নতুন গামছা আনুন তো”। শুনে তো আমার রাগ মাথায় উঠে গেল। একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ল। বলি ভেবেছেটা কী? সেই বিরক্তি ওনার সম্মানে গিয়ে আঘাত হানল। এদিকে আমার কথা কেউ শুনলও না। অগত্যা পিঠ পেতে ওই নতুন পাকানো গামছার মার বার চারেক হজম করতেই হল। তার পর “রাতে ঘুমুবে না আর জলভাত খাবে। আর ক্ষতস্থানে চুনের প্রলেপ দেবে”। এই বলে কালিবাবু ১০টাকা দক্ষিণা আর ওই নতুন গামছাখানা নিয়ে চলে গেলেন। আমি পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে মনে মনে ফন্দি আঁটলাম। যে করে হোক ওনার চালাকি বার করতেই হবে। এই ভেবেই মনের আনন্দে সে রাত কাবার হয়ে গেল।

বর্ষার মাঝামাঝি। মাঠ ভর্তি জল থই থই করছে। অথচ ধানের চারা পোঁতার তখনো দেরি। জলজ উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধির অতি উত্তম সময়। শাপলা, শালুক, ঝাঁঝি, শোলা আরও হরেক কিসিমের গাছে ভরে গেছে মাঠ। তখন আমাদেরও ভারি মজার দিন। হাঁটুজলে মাঠময় হুটোপুটি। শালুক ফুল আর ডাঁটা তোলার ধুম। আমাদের কতো কাজ- শালুকের ফল ( ‘ভেঁট’ ) জোগাড় করে তার বীজগুলো ছাই মাখিয়ে রোদে শুকনো করা, শালুক ডাঁটাকে কলমিডাঁটা দিয়ে জুড়ে লম্বা পাইপ বানানো, সেই পাইপ দিয়ে আম বা নিম গাছের মগডালে বসানো বালতি থেকে সাইফোন করে জল নামিয়ে ফোয়ারা বানানো, ফুলসমেত শালুকডাঁটা আলতো করে ভেঙ্গে (যাতে ছালের সাথে লেগে থাকে, ছেড়ে না যায় ) মালা বানিয়ে গলায় পরে ঘুরে বেড়ানো, আরও কত কী। এসবের ফাঁকে মাছ ধরার নানান ফন্দি ফিকির। বন্ধুরা তাদের বাবার কাছে পয়সা পেত জালবোনার সুতোর জন্য। আমার তো সে প্রশ্নই নেই উল্টে জাল বুনি জানলে উত্তমমধ্যম দিয়ে গা গরম করে দেবে। কিন্তু বন্ধু সঙ্গ ত্যাগ করাও বড় দূরুহ কাজ। ভেবে ভেবে উপায় বেরোল। আমার তো ফি বর্ষায় একটাই জালে কাজ চালানোর দরকার নেই। এই বর্ষায় কাজ চলে গেলেই হল। তাই মায়ের কাঁথা সেলাই এর সুতো মানে পুরানো কাপড়ের পাড় থেকে তোলা সুতো দিয়েই জাল বোনা শুরু হয়ে গেল। ধরা পড়ে মার বকুনি হজম করে বললাম ‘পাড় তো অনেক আছে আমি না হয় তুলে দেব”। মারস্নেহ সে যাত্রায় খবরটা বাবার কান অবধি পৌঁছাতে দিল না। আমি নতুন উদ্যমে জালবোনা শুরু করে দিলাম। সারাদিন হাতে পেঁত্যা আর জালকাঁটা হাতে একদল বালক গাছে বসে সুতোর পেছনে মেপে মেপে ফাঁস লাগিয়েই চলেছে। জালের বহর দুহাত মানে তিনফুট। একটা ফাঁসের মাপ আধইঞ্চি, মানে পেঁত্যার মাপ। তাই আধইঞ্চি লম্বায় এগোতে বাহাত্তরটা গিঁট লাগাতে হচ্ছে। প্রতি গিঁটে দুবার ফাঁস লাগিয়ে টান মেরে গিঁট বসাতে হচ্ছে। কইগাঁতি বোনা হচ্ছে যে। যত সহজ ভেবে শুরু করেছিলাম তত সহজ নয়। তার ওপর আমার পাড়ের পচা সুতো আর বন্ধুদের নাইলনের শক্ত সাদা সুতো। ওরা দিনে চারহাত লম্বায় বাড়ে তো আমি বড়জোর দুহাত। এই করে যখন ওরা আঠাশহাতি বানিয়ে ফেলল, আমি দশহাতে পৌঁছালাম। তবুও কম কী? এইবার জায়গা খোঁজার পালা। এখানে বন্ধুদের কোনো মায়াদয়া নেই। সেরা জায়গাটা সবার চাই। সে লড়াইএ আমি হেরে গিয়ে খুঁজতে থাকি পড়ে পাওয়া চোদ্দোআনার মতো যদি কোন পছন্দমত জায়গা পাই। না সে সুযোগ বন্ধুরা রাখেনি। অগত্যা পুকুরের কোণে যেখানে মাঠের জল নামে তার গা ধরে আড়াআড়ি দশহাত মতো জায়গা শালুক শাপলা ঠেলে পরিষ্কার করে জাল পেতে দিলাম। এখন হয়তো ফল নাও পেতে পারি কিন্তু গড়েনের সময় মানে কার্তিক মাসে যখন মাঠের জল নামা শুরু হবে তখন এ জায়গা সোনারখনি।

@তাপস সামন্ত 23/06/2017

*******

Waiting For The Rain
The dark greens scribble over the blue;
The gentle wind lazily passes through;
The soft little branches sway in delight-
The flock of birds on their scattered flight,
Look down to earth in nervously wonder;
Strains of dirt scattered here and there,
All dark and ill; the selfish lives run aimless,
Like the droplets fallen on a flat hard surface;
The livings that are stationed by Nature,
That even can not resist the axe of torture,
Pray in pain to have the strength to forgive
Those running lives and to happily survive,
In the scorching summer; everyone in vain-
awaits for a brighter day – a little drop of rain.
The unhappy cloud flies away to the unknown;
Keeping everyone beneath awaiting for the rain.

16 June 2012

©Tapas Samanta

Sahityika Admin

Add comment