সাহিত্যিকা

তাদোবার জঙ্গলে

তাদোবার জঙ্গলে
@ সুনন্দা গাঙ্গুলি (দেবাশীষ গাঙ্গুলির স্ত্রী), ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং)

আমার কর্তাটি, মানে তোমাদের বিই কলেজের ৭৭ সালের ইলেকট্রিক্যাল দেবাশীষ গাঙ্গুলি, এক পুরোদস্তুর জঙ্গলপাগল। গিয়েছিলাম বাঙ্গালোরে বড় মেয়ে-জামাই এর কাছে। হঠাৎ হুজুগ উঠল চলো তাদোবা। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হল বাঙ্গালোর থেকে ট্রেনে নাগপুর, সেখান থেকে গাড়ীতে তাদোবা – প্রায় ১৪৫ কি. মি. রাস্তা। রিসর্ট বুকিং, ট্রেনের টিকিট, গাড়ী, জঙ্গল সাফারির জন্য অনলাইন বুকিং – সবই আমার ভালোমানুষ জামাই শমীকের দৌলতে হয়ে গেল।

৭ই মে, ২০১৫, শুক্রবার:
আমরা চারমূর্তি, মানে আমি, আমার কর্তা, মেয়ে আর জামাই বাঙ্গালোর-দিল্লী রাজধানী এক্সপ্রেস ধরে রওনা হলাম। এক ঘন্টা লেটে নাগপুর পৌঁছান গেল। আমাদের ইনোভা স্টেশনেই অপেক্ষা করছিল। মালপত্র তুলে তাদোবার উদ্দেশ্য চললাম। প্রায় তিন ঘণ্টার রাস্তা। গাড়িতে চেপেছিলাম বিকেল সাড়ে চারটের সময়, তখন চারিদিকে রোদ ঝলমল করছে। বাতানুকুল গাড়িতে বসে বাইরের তাপমাত্রা বোঝার উপায় নেই। ন্যাশনাল হাইওয়ে ৭ দিয়ে গাড়ি ঘন্টায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার গতিবেগে  উড়ে চলছে। কিছু সময় পর সূর্যাস্ত হল, চারিদিকের আলো কমে এলো। আমরা বড় রাস্তা ছেড়ে তাদোবার রাস্তা ধরলাম। ততক্ষণে চারিদিক নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। তারই মধ্যে হেড লাইট জ্বালিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। পথের বাঁকে বাঁকে সাবধান বাণী “Beware of wild life crossing”। ভগ্যিস আমাদের ট্রেনটা ১ঘন্টা লেট ছিল, তাই জঙ্গলের রাতের গা ছম্ ছম্ করা রূপ উপভোগ করলাম। সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা এসে পৌঁছলাম ইরাই সাফারী রিট্রিটে। প্রায় ১৪ একর জায়গা নিয়ে জঙ্গলের পাশে এক বিশাল রিসর্ট। রিসর্টের প্রধান ফটকে  এক হনুমানের হাতজোড় করা মর্মর মুর্ত্তি আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে।

British colonial style এ পুরো রির্সটটা সাজানো। আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়াল গাড়ি বারান্দার নীচে। গাড়ি থেকে নেমে কয় ধাপ উঠে সামনে লাউঞ্জ, মাঝখানে পুরুষ চিতলের এক বিশাল শিংওয়ালা পিতলের মূর্তি, এক লহমায় পুরো পরিবেশটাই পাল্টে গেল। পাশে রিসেপশন, লাইব্রেরি, video show room ইত্যাদি।

আমাদের থাকার ব্যবস্থা এয়ার কন্ডিশনড্ তাঁবুতে। মালপত্র নিয়ে একটা টুক্ টুক্ নিয়ে গেল তাঁবুতে। কাঠের কয় ধাপ সিঁড়ি উঠে ছোট কাঠের বারান্দা। একটা ছোট টি-টেবল, দুটো চেয়ার আর একটা এয়ার-কুলার রাখা আছে। তাঁবুর চেনটানা দরজা। ভেতরে ঢুকে দেখি ইওরোপিয়ান কায়দায় সাজানো ঘর। কি নেই সেখানে কার্পেট, ফ্রিজ, টিভি, এসি, রুম হিটার লেখার টেবিল, সোফা কাম বেড, ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গে লাগোয়া প্রসাধন কক্ষ ও বাথরুম। বারন্দার নীচে একটা গার্ডেন আম্ব্রেলা আর সাজানো বার-বি-কিউ এর সরঞ্জাম। দেরি হয়েই গেছে। সন্ধ্যে সাড়ে আটটায় ডিনার। তাড়াতাড়ি ছুট লাগলাম সেই দিকে – সারি সারি তাঁবুর ও গাছের সারির পাশ দিয়ে চলে গেছে টালি বসানো পাকা সরু রাস্তা। পথের ধারে ধারে ছোট্ট ছোট্ট আলো এমন করে সাজানো যাতে শুধু পথটুকুই আলোকিত হয়, চারিদিকে জঙ্গলময় পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রেখে।

পথ ধরে এলাম বিশাল সাজানো গোছানো ডাইনিং হলে এয়ার কুলার চলছে। সাহেবি কায়দায় সাজানো টেবিল। মাঝখানে মোমবাতি দান। আর আছে বিভিন্ন বন্য জন্তুর কাঠের মূর্তি। Buffet মেনুতে আছে – সুপ, বাসমতী চালের ভাত, চাপাতি, ডাল, অতি সুস্বাদু দুরকম নিরামিষ তরকারি, চিকেন কারি আর desert – এক এক দিন এক একরকম। ঠান্ডা জলের পাত্র নিয়ে waiter হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ভরপেট আহারাদি সেরে আমরা তাঁবুতে ফিরলাম। মাথার উপরে খোলা, দূষণহীণ আকাশ। উজ্জ্বল তারাগুলি পরিবেশকে আরও মোহময় করে তুলেছে। আমরা এখন সভ্য জগৎ থেকে অনেক দূরে – দিন, তারিখ ও সময়ের হিসেব হারিয়ে বসেছি। কাকভোরে উঠতে হবে – শুয়ে পড়া দরকার।

চন্দ্রপুর জেলায় অবস্থিত এই জঙ্গল মহারাষ্ট্রের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান – “তাদোবা – আন্ধারি” টাইগার রিজার্ভ নামেও পরিচিত। আন্ধারি বনের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ছোট নদী। তাদোবা নামের উৎপত্তি “তারু” নামের এক প্রাচীন রাজার নামে, যিনি বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন। স্থানীয় গোন্ড উপজাতির লোকেরা তাঁকে দেবতা জ্ঞানে পূজো করেন। তারুকে উৎসর্গ করে একটা মাজার তাদোবা হ্রদের তীরে একটা বড় গাছের নীচে এখনও বর্তমান। ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে দুরদুরান্ত থেকে আদিবাসীরা দল বেঁধে এখানে পূজো দিতে আসে।

১৯৫৫ সালে এই বনাঞ্চলের ১১৬.৫৪ স্কোয়ার কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে একটি জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষিত হয়। ১৯৮৬ সালে আন্ধারি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য তৈরী হয়। ১৯৯৫ সালে জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য মিলে বর্তমান ৬২৫.৪ স্কোয়ার কিলোমিটারের টাইগার রিজার্ভ গঠিত হয়। এর তিনটি প্রধান রেঞ্জ হলো তাদোবা নর্থ, মোহারলি এবং Kolsa South। মোট ছটি গেট বা প্রবেশ পথ আছে। আমাদের রিসর্টটি মোহারলি গেটের কাছেই – ইরাই হ্রদের তীরে।

এই বিস্তীর্ণ জঙ্গলে প্রায় ৪১ রকম স্তন্যপায়ী, ৩০ প্রকার সরীসৃপ, ৫ রকম উভচর, ৭৪ প্রজাতির প্রজাপতি, ২৬ রকম মাকড়সা, ২৩ রকম মাছ ও ১৮৫ প্রজাতির পাখী পাওয়া যায়। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও দেখা মেলে লেপার্ড, স্ট্রাইপড্ হায়না, ঢোল বা জংলী কুকুর, শ্লথ বিয়ার, বুনো বিড়াল, ভাম, বুনো শুয়োর, গাউর, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ ও আ্যান্টিলোপ যেমন চিতল, সম্বর, কোটরা হরিণ, নীলগাই, চৌশিঙ্গা, চিঙ্কারা ইত্যাদি। বাঘের খাদ্য তৃণভোজী প্রাণীর প্রাচুর্য্য চোখে পড়ার মতন। জঙ্গলটি মূলতঃ dry and moist deciduous forest এর মিশ্রণ। প্রধানত সেগুন ও বাঁশের জঙ্গল – তাছাড়াও বিভিন্ন রকম গাছ, ওষধি ও লতাগুল্ম আাছে।

৮ মে, ২০১৫, শনিবার:
সাড়ে চারটের সময় চোখ খুলেই তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলাম। চারিদিক শান্ত, ঠান্ডা, অন্ধকার, চাঁদ অস্তপ্রায়, দূরে দু একটা রাতজাগা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।

তাড়াতাড়ি তৈরী হতে হবে। আজ জঙ্গলে প্রথম সাফারি। ভোর ৫-২০ মিনিটে আমরা রিসেপশনে এসে উপস্থিত হলাম। মারুতি জিপসি এসে গেছে, প্যাকড ব্রেকফাস্ট সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আমরা তাদোবা আন্ধেরি টাইগার রিজার্ভের মোহারলি গেটের সামনে এসে সাফারি পারমিট দেখিয়ে লাইন দিলাম। প্রতিদিন প্রায় ২৬ টা জিপ জঙ্গলে প্রবেশ করে। ঠিক ৬ টায় একজন ফরেস্ট অফিসার এসে আমাদের পারমিট চেক করে জঙ্গলে ঢোকার অনুমতি দিলেন। গাড়িতে আমরা চারজন, একজন ড্রাইভার ও একজন গাইড, যার নাম “ভাগ্যবান”।

জঙ্গল আর জঙ্গল মনোরম দৃশ্য! “এ যে বন্য, এ অরণ্য! হেথা দিনেতে অন্ধকার, হেথা নিঝুম চারিধার, হেথা উর্ধে ওঠায়ে মাথা দিল ঘুম যত আদিম মহাদ্রুম!!!” জঙ্গলের পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তা ধরে জিপ ছুটছে, চারিদিকে এখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। কি ঠান্ডা!

প্রথমেই চোখে পড়ল একটা Jungle Night Jar পাখী রাস্তার ধারে শুয়ে ঘুমচ্ছে যেন মনে হচ্ছে ওখানে কিছু খড়কুটো পড়ে আছে। রাতে এই পাখির চোখ উজ্জ্বল লাল দেখায় অন্ধকারে। গাড়ি এগিয়ে চলেছে, আস্তে আস্তে আলো বেশ পরিষ্কার হয়েছে। হঠাৎ দূরে চোখে পড়ল ময়ূরের দল, তারমধ্যে একটা পেখম তুলে ঘুরছে। আহা কি শোভা …… চারিদিকে পাখির কলরব। আশীষ (মানে আমার পতিদেব দেবাশীষ) ও কন্যা রাই পাখি নিয়ে ব্যস্ত কেমন দেখতে, কেমন ডাক, আর কেমনি বা তার গতিবিধি। এক জায়গায় দেখলাম Tree shrew দেখতে অনেকটা কাঠ বেড়ালির মতো কিন্ত আসলে ওরা বানর প্রজাতির অন্তর্গত। জঙ্গলটা মূলত বাঁশঝাড়ে ভরা, কোথাও কোথাও বুনোফুলের গন্ধে চারিদিক ম ম করছে। অনেক গাছে বোলতার চাক্, মৌচাক, বিন বিন … শব্দে যেন নেশা ধরিয়ে দেয়।

এক ফাঁকে চিজ স্যান্ডউইচ আর অমলেট স্যান্ডউইচ’ আর চা দিয়ে, জঙ্গলে জিপের ওপর বসেই প্রাতরাশ সেরে নিলাম। জিপ চলেছে কখনও পাকা রাস্তা, কখনও কাঁচা রাস্তা দিয়ে, কখনও কখনও রাস্তা এত সরু হয়ে যায় যে রাস্তার ধারের গাছপালা গায়ে এসে লাগে আর তার জন্য গাটা ছম্ ছম্ করে।

একে একে চোখে পড়তে লাগল চিতল, সম্বর, Barking deer, প্রভৃতি হরিণের দল। ঝাঁকে ঝাঁকে দলে দলে। তাদের চাহনি, চলনভঙ্গি আর অভিব্যক্তি আমরা দুচোখ ভরে দেখেছি। দেখতে দেখতে বেলা বেশ বেড়ে উঠল। রোদের তাপ ও বাড়ল। এখন ফেরার পালা। গাইড আমাদের নিয়ে এল একটা লেক এ নাম “পন্ডারপানী”। বেশ বড় লেক। লেকের ধারে ধারে কত পাখি, বক, হরিণ জল খাচ্ছে; হঠাৎই চোখে পড়ল জলের মধ্যে একটা হলুদ মাথা এবং তার কানটা নড়ছে। দূরবীনে চোখ রাখলাম দেখি একটা বাঘ – গাইড বলল ও বাঘিনী “মায়া” – রোদের তাপে জলে কাদায় ঢুকে বসেছিল। আস্তে আস্তে সে উঠে দাঁড়াল, জল থেকে হেঁটে উঠল পাড়ে। চারিদিক তাকিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিমায় হেঁটে লেকের ধারের মাঠ অতিক্রম করল এবং জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হল – এতক্ষণ আমরা যেন কোন সিনেমার অংশ বিশেষ দেখলাম। আর সময় নেই – এবার জঙ্গল থেকে বেরোনোর পালা।

বিকেলে রিসর্টের এর ম্যানেজার মিস্টার নাইডু আমাদের জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থার আয়োজন করেছিলেন। ইরাই লেকের ধারে চা পানের ব্যবস্থা। ইরাই এর ধারে যখন পৌঁছালাম তখন সূর্য অস্ত প্রায়। কি সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া। দিনের শেষে পাখিরা জল পান করছে। মাটিতে ছোট ছোট লতাগুল্ম হয়ে আছে। ম্যানেজার ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে দুতিন জন লোক দিয়েছিলেন। তাদের কাছেই শুনলাম বর্ষায় লেকের জল এত বেড়ে যায় যে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির শোভা দেখছি সে সব জায়গা ডুবিয়ে জল একেবারে রেসর্টের দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছে যায়। লেকের জলে কুমির (Marsh Crocodile) আছে। তারই মধ্যে কিছু স্থানীয় অধিবাসী ছিপ নৌকা নিয়ে মাছ ধরছে। নৌকা থেকে নেমে জলে স্নান ও করছে – ধন্যি সাহস তাদের। চারিদিকের আলো ক্রমশ কমে আসছে। এরমধ্যে গার্ডেন চেয়ার, টেবিল পেতে আলু পকোড়া, চা, দুতিন রকমের বিস্কুট সহযোগে বিশেষ চা পান সমাপ্ত হল। ততক্ষণে আকাশে সন্ধাতারা জ্বলজ্বল করছে, দু’একটা রাতজাগা পাখির ডাক কানে আসছে। মাথার ওপর দিয়ে একটা পেঁচা উড়ে গেল। আমরা সম্মোহিতের মত তখনও উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে বসে আছি।

আমাদের সঙ্গে যে দুতিন জন এসেছিল তারাও বসেছিল মাটিতে। তাদের মধ্যেই একজন হঠাৎ চাপা গলায় বলে উঠল ‘ভালু…ভালু’। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি অন্ধকারের মধ্যে এক জমাট বাঁধা অন্ধকার আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তড়িৎপৃষ্টের মতন লাফিয়ে উঠে সবাই টর্চ জ্বেলে ওই দিকেই তাড়া করলাম। অন্ধকারে হুড়মুড় করে ছুটছি। সামনে লক্ষ্য করলাম তাড়া খেয়ে ওই জমাট বাঁধা অন্ধকারটিও ছুটে চলেছে, তারপর একসময় ঝোপে ঢুকে পড়ল। আর বসে থাকা সমীচীন নয়। অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে রেসর্টে ফিরে এলাম।

৯ মে, ২০১৫, রবিবার – সকাল
গতকালের মত আজও আমরা সকাল ৫-৩০ এ তৈরি হয়ে জঙ্গল গেটে এসে ৬ টায় জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলাম। গেটেই খবর পেলাম কোলসা রেন্জে এক বাঘিনী গত রাত্রে গাউর মেরেছে। চার শাবক নিয়ে ভোজে ব্যাস্ত। অতএব চলো কোলসা। পিছনের সব জিপ ফেলে আমরা সামনে এগিয়ে চলেছি পিচ রাস্তা ধরে। আজ আকাশ মেঘলা, রোদের তেমন তেজ নেই। ইন্ডিয়ান পিট্টার ডাকে জঙ্গল সরগরম। পথের দুধারে বাঁশ ঝাড়ের নীচে ঝোপঝাড় নেই, তাই দৃষ্টি বহুদূর পর্যন্ত ভিতরে চলে যায়। দূর থেকে মনেহয় একটা হাল্কা সবুজ জর্জেটের ওড়না দিয়ে যেন জঙ্গলটা মোড়া। আমি এমনটি কোথাও দেখিনি। চলতে চলতে এক জায়গায় ইশারায় গাড়ি দাঁড় করানো হল। দেখলাম গাছের গুঁড়ির আড়ালে এক “শ্লথ বিয়ার” দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দাঁড়িয়ে পড়তেই ভাল্লুক বাবাজী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এবং ধীর গতিতে রাস্তা পেরিয়ে আবার জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। গতকাল রাতে যাকে ঠিক করে দেখতে পাইনি, আজ তাকে দিনের আলোয় চাক্ষুস করলাম। দিনের শুরুতেই এক বিশাল পাওনা হল – “Morning shows the day” দিনটা বোধহয় ভালই যাবে।

আবার চলতে শুরু করলাম। পথের দুপাশে চোখে পড়ছে কত চিতল, সম্বর ও অন্যান্য হরিণের দল, কত রঙবেরঙের পাখি। উচু নিচু ঢেউ খেলানো রাস্তা দিয়ে চলেছি। বেশ কিছুটা গিয়ে পথের বাঁকে চোখে পড়ল বহু জিপ পথের ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই টের পেলাম দুর্গন্ধ। ভোজনান্তে তারা যদি জল খেতে বেরোয়; সেই আশায় এত জনসমাগম। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। আমার কর্তা বললেন আহার সমাধা না করে এই ভীড়ের মধ্যে ওরা কখনোই বাইরে আসবে না। অতএব সময় নষ্ট না করে আমরা দুর্গন্ধময় এলাকা ছেড়ে চললাম। এইবার চলে এলাম “ঘন্টিনালা” – গাইড বললেন বাঘিনীটি সপরিবারে এই water hole এর ধারেই কদিন ধরে বাস করছিল। তাই একবার এইখানটা ঘুরেই যাওয়া যাক্। দেখলাম water hole এর কাছে রাস্তা শেষ হয়ে গেছে। Water hole এর পাশে এক বাঁশ ঝাড়ের নীচে এক পাল বুনো শুয়োর। Water hole এ জল কম, স্বভাবোচিত ভাবেই তারা জল কেলি করছে, কাদা মাখছে, নিজেদের মধ্যে আনন্দ করছে। আমরা একমনে তাদের লক্ষ্য করছিলাম। হঠাৎই গাইড বলে উঠল “লেপার্ড লেপার্ড ডাহিনে তরফ”!! চকিতে ঘুরে দেখি ডানদিকে একটা শুকনো নালা, তারই মধ্যে থেকে উঠে দাঁড়াল এক পুর্ণাঙ্গ পুরুষ চিতাবাঘ। আমাদের দিকে ফিরে তাকাল, একবার ডাকল – ঠিক যেন করাত দিয়ে কাঠ কাটার আওয়াজ। তারপর নেমে গেল উন্মুক্ত তৃণভূমিতে। চিতাবাঘের গায়ে রোদ পড়েছে, আহাঃ গায়ে হলুদ কালো রঙের কি কারুকার্য। ঈশ্বরের কি অপূর্ব সৃষ্টি। সে ততক্ষণে তৃণভূমির মধ্যে দিয়ে হাঁটছে। বাতাসে সবুজ লম্বা লম্বা ঘাস দুলছে, তারি মধ্যে দিয়ে দুলকি চালে সে এগিয়ে চলেছে। দূরে ময়ূর পেখম তুলে নাচছে, চোখ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। চিতাটি দুবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকাল, ডাকলো আস্তে আস্তে অতঃপর তৃণভূমির মধ্যে অদৃশ্য হল। আমরা স্থানুবৎ বসে রইলাম। সম্বিত ফিরতেই গাইড বললেন সময় শেষ, সাড়ে দশটা বাজে, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

৯ মে, ২০১৫, রবিবার, বিকাল
কোনরকমে মধ্যাহ্ন ভোজন সমাধা করে আবার যখন জঙ্গলে প্রবেশ করলাম তখন ঘড়িতে ৩টে বাজে। এইসময় বাইরের তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রির কাছাকাছি – কিন্ত জঙ্গলের মধ্যেকার আবহাওয়া ঠান্ডা ও আরামদায়ক। কখনও পিচ রাস্তা কখনও কাঁচা লাল রাস্তার মধ্যে দিয়ে জিপ চলেছে। দিনের শেষে সব বন্য প্রাণীদের জল পানের তাড়না। তাই জলাশয়ের কাছে গেলেই তাদের সাক্ষাত মিলতে পারে। পথ চলতে চলতে রাস্তার একধারে জিপ দাঁড়ালে দেখলাম একটি পরিত্যক্ত গ্রামের ক্ষেতে মনের আনন্দে ঘাস খাচ্ছে একদল বাইসন বা গাউর, পায়ে তাদের লম্বা সাদা মোজা পরা। গাড়ি এগিয়ে চলল, পৌঁছলাম তাদোবা লেকের ধারে। কি বিশাল সরোবর, চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা। জলের মধ্যে কতরকম বক, সারস জাতীয় পাখী, জলের ধারে মাটিতে বসে শিকারি পাখীর দল, হরিণের পাল একমনে কচি ঘাস খেয়ে চলেছে আর মাঝে মাঝে চমকে উঠে কান খাড়া করে তাকিয়ে থাকছে আর পা ঠুকছে। সরোবরের এক তৃতীয়াংশ পদ্মবনে ঢাকা। আকাশের ঘন নীল, জলে প্রতিফলিত হয়ে অপরূপ হয়ে আছে। মৃদু ঠান্ডা বাতাসে লেকের জল তিরতির করে কাঁপছে। সব মিলিয়ে এক অনির্বচনীয় মনোরম পরিবেশ। দূরে চোখে পড়ল একটা ওয়াচটাওয়ার। পড়ন্ত আলোয় লেকের কি রূপ, শয়ে শয়ে হরিণের পাল পদ্মবন পেরিয়ে জল খেতে এসেছে। ওয়াচটাওয়ার দেখে মনে বড় লোভ হচ্ছিল – যদি একরাত্রি এখানে কাটাতাম, আরও কত কিছুই মনক্যামেরায় বন্দি করে নিয়ে আসতাম। লেক পেরিয়ে বাঁদিকে বাঁক ঘুরতেই গাছের তলায় ঝোপঝাড়ের ভেতরে চোখে পড়ল একদল বুনো কুকুর – wild dog। দেখতে অনেকটা শেয়ালের মতো। খুব হিংস্র, দল বেঁধে এরা শিকার করে। জঙ্গলের অন্য সদস্যরা এদের সমীহ করে চলে। অনেকক্ষণ ধরে তাদের খেলা, হুটোপাটি, mating আর তাদের বাচ্চাদের লক্ষ্য করলাম।

দিনের আলো ক্রমশ কমে আসছে। নির্দিষ্ট সময়ে গেটে পৌঁছতে হবে। তাই ফিরে চললাম। আগেও কয়েকবার জঙ্গলে এসেছি; সেটা সকালে; বিকেলে কখনও আসিনি তাই জঙ্গলের প্রাক্ সন্ধ্যাকালীন যে রূপ সেটা মনপ্রাণ ভরে উপভোগ করছিলাম। সবুজ ওড়নার ফাঁকে ফাঁকে জমাট অন্ধকার ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে। নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ জায়গায় জায়গায় বনভূমি মাতিয়ে দিচ্ছে। একটানা ঝিঁঝিঁ ডাক, গোধূলি আলো, প্রাণ কেড়ে নেওয়া বাতাস বহুদিন আমার মনকে মাতিয়ে রাখবে। আজ সকালে বনভূমিতে পা রেখে মনে হয়েছিল দিনটা বোধহয় ভাল যাবে। দিনান্তে সেই প্রবাদ বাক্য “Morning shows the day” এর যথার্থতা প্রত্যক্ষ করলাম।

রাত্রে ডাইনিং হলে এসে দেখি সেখানে বসেছে এক গানের আসর। দুই স্থানীয় গায়ক মাথায় বড় বড় পাগড়ী লাগিয়ে ঢোল আর সারেঙ্গী বাজিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় গান গাইছে। বড় মিঠে সে সুর। রাত্রে নৈশাহারে পোলাও, জিরা আলু, ডাল মাখানি, নবরতন কোর্মা, পালক পনীর, ছোট ছোট বেগুনের কোর্মা, চিকেন এবং দুধের তৈরি স্থানীয় একরকমের ক্ষীর নাম “বাসুলি”। ভরপেট খেয়ে আরামের ঘুম।

১০ মে, ২০১৫, সোমবার

আজ তাদোবা সংরক্ষিত জঙ্গলে আমাদের শেষ সাফারী। যথাসময়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলাম, বেশ কিছুটা এগুতেই দেবাশীষ ইসারায় জীপ থামাতে বলল। বিশাল ব্রেক কষে দাঁড়ানো হল। বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি এক বিরাট ইঁদারা এবং তার মুখে একটা লোহার ঢাকনার ওপর একটি চিতাবাঘ শুয়ে আছে। গাড়ির ব্রেক এর আওয়াজে তার ঘুম ভেঙ্গেছে। ঘাড় ঘুড়িয়ে আমাদের দেখল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গল। কি সুন্দর তার দেহ সৌষ্ঠব।

ইঁদারার পাশেই সোলার ইলেকট্রিকের একটা প্যানেল আছে, সেটাকে চাটলো কয়েকবার, তারপর আস্তে আস্তে খুব সতর্ক পায়ে নেমে পড়ল মাটিতে। এগিয়ে চলল ধীর পায়ে, আমরা তখনও স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে। কিছুদূর পর্যন্ত তার চলে যাওয়া দেখতে পেলাম, তারপর যথারীতি হারিয়ে গেল সবুজ ওড়নার আড়ালে। এ অরণ্য যেন উদার হাতে তার সমস্ত রত্নসম্ভার আমাদের সামনে সাজিয়ে রেখেছে উপভোগের জন্য। ধন্য সৃষ্টিকর্তা। জিপ এগিয়ে চলল – কারো মুখে কোনো কথা নেই – না জানি সামনে কি অপেক্ষা করে আছে।

পন্ডারপানীর জলের ধারে দেখলাম একপাল বাইসন, তারা আপন মনে ঘাস খাচ্ছে, জল খাচ্ছে। অনেকক্ষণ তাদের দেখে এগিয়ে চললাম। এবার এলাম জামুন ঝোরা, জঙ্গলের আর একটি দিকে – রোদ ঝলমলে সকালে ঝোরাতে কি বন্য জন্তুর সমাহার, নীলগাই – এই প্রথম দেখলাম, শুয়োর এক পাল ও বুনো কুকুর সপরিবারে – আপন মনে কাদা মাখছে ও জলকেলি করছে নির্ভয়ে – দেখে বড় আনন্দ হল। বেলা বেড়ে চলেছে সঙ্গে সঙ্গে রোদের তাপ বাড়ছে। ফিরতি পথে আবার একটা water hole চোখে পড়ল। দাঁড়িয়ে গেলাম নানান পাখি, হরিণ, সম্বর ঘুরে বেড়াচ্ছে, দূরবীন এ চোখ রেখে এদিক ওদিক দেখছি – এমন সময় হঠাৎ চোখে পড়ল জলের মধ্যে দুটি হলুদ কান, তাতে সাদা দুটো স্পট। ভাল করে ফোকাস করতেই বুঝলাম তিনি স্বয়ং বাঘমামা। জলের মধ্যে বসে বসেই তিনি আমাদের পর্যবেক্ষণ করছেন। নিশ্চয় পেট ভরা। গায়ের ডোরা কাটা দাগ গুলো কি সুন্দর। রোদ্দুরে রঙ যেন ঝলকাচ্ছে। অরণ্যদেবী শেষকালে আমাদের জন্য এই চমকটা বাকি রেখেছিলেন। সাফারি র সময় শেষ। এবার ফিরতে হবে।

এই শ্যামল স্নিগ্ধ অরণ্যভূমি ছেড়ে এবার কংক্রিটের জনারণ্যের দিকে পা বাড়ালাম।
বিদায় অরণ্য বিদায়!

 

Sahityika Admin

Add comment