সাহিত্যিকা

চটি

চটি
@ সঞ্জয় বসু, ১৯৮৪ আর্কিটেকচার ও প্ল্যানিং

সেবার চলেছি আর এক পাহাড়ের পথে। কোনো এক শিবের মন্দির তো বটেই। কিন্তু ঠিক কোনটা, সেটা স্মৃতির পাতা থেকে আবছা হয়ে গেছে।

বেরিয়েছিলাম অন্ধকার ভোরে, অনেকটা পথ। রাতের আগে ফেরত আসার আশা রাখতে হলে, ভোরে বেরোতেই হবে। সেদিন আমি, অন্য সময়ের মতোই, একেবারেই একা। না কোনো গ্রুপ, না কোনো আত্মীয় বন্ধু, না কিছু। সেই অমিতাভ বাবুর ডায়ালগ, ‘ম্যায় ঔর মেরি তনহাই’!

তবে একা হলেও, এই ধরনের যাত্রা শুরু করা খুব সোজা। পাহাড়ের গায়ে একটাই রাস্তা। তীর্থ যাত্রীরা সবাই এক জায়গাতেই জড়ো হয়, তারপর পুলিশ বা ফরেস্ট অফিসারের অনুমতিতে সকাল সাড়ে চারটেতে ফটক খোলে, যাত্রা শুরু হয়। তাই, নাইবা পথ চেনো, বাবার নামটাও যদি না জানো, নাইবা বোঝো ভাষা, বাবার থানে তুমি পৌঁছতেই পারো! আমি মনে করি, এইখানেই আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠত্ব!

প্রথম প্রথম রাস্তা হবে অতি মনোরম। বাঁধানো মসৃণ পথ, ঢালু কম, ধারে রেলিং থাকতেও পারে। মাঝে মাঝে বসবার বেঞ্চ পেলেও পেতে পারো। এগুবে যত, প্রথমে রেলিং আর তারপর বেঞ্চ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর একসময় দেখবে পড়ে আছে শুধু সরু, অসমতল একটা পাকদন্ডী, একদিকে খাড়া পাহাড় আর একদিকে গভীর খাদ। বুঝতে হবে, আসল যাত্রার এটাই শুরু।
আমি বলি, একটু দাঁড়াও এখানে। এতক্ষনে হয়ত সূর্যদেব পাহাড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছেন। একবার পেছন দিকে চাও, দেখবে হয়ত অনেক নিচে, দূরে, আবছা ভাবে পুলিশ নাকা বা ফটক হয়ত দেখা যাবে। ফিরে যাবার এই শেষ হাতছানি। যদি শরীর না দেয়, যদি প্রাণে ভয় হয়, বা একাকীত্বের ব্যথা বুকে বেজে ওঠে, ফিরে যাওয়ার এইটাই প্রশস্ত সময়। বেশ একটা প্রাতঃ ভ্রমণ হবে। সেলফি নাও খচাখচ। ফিরে এসে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দাও, “আমি, অমুক বাবার মন্দিরের পথে”! পৌঁছবার কি দরকার?

আর যদি বেপরোয়া হও, জীবন দর্শন যদি হয়, “জীতে হ্যাঁয় রোজ রোজ, মরেঙ্গে তো এক রোজ” তাহলেও, দাঁড়াও এক বার। প্রথমেই জুতোটা নিরীক্ষণ করো। পাহাড়ে জুতো ছিঁড়ে গেলে বিষম বিপদ! তারপর দেখ খাবার জল আছে কিনা। পাহাড়ের বরফ গলা ঠাণ্ডাজল খেতেই পারো, তবে শরীর জমে যাবার সম্ভাবনা। প্রবল পেটের গন্ডগোল হতে পারে। এরপর গরম জামা। শেষে দেখো কিছু খাবার আছে কিনা। খেজুর, আমসত্ত্ব টাইপের খাবার পাহাড়ের পথে ভালো, শক্তি দেয়। এক্কেবারে শেষে দেখো হাতের লাঠিটাকে। যখন আর কেউ নেই, এই লাঠিই সম্বল। আর কি, আর কিছু নয়। সূর্য্য এতক্ষনে পাহাড়ের আড়াল থেকে বেশ একটু বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে পড় এবার। সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে, আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে পথ চলতে থাকো।

খেয়াল করেছি, হঠাৎ কিছু সুন্দর দৃশ্য দেখলে, একাকীত্বের পীড়া কলিক পেইনের মত মাথা চাড়া দিতে পারে। হাঁ করে দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় চলে যায় গড়গড়িয়ে। চিন্তাগুলো পায়ের গতি মন্থর করে। তাছাড়া, পা পিছলে সটাং নিচে চলে যাবার সম্ভবনা প্রবল। এইসব হচ্ছে একা থাকার বিড়ম্বনা আর কি!
আমি চোখ নামিয়ে পথ চলি। পথ ছাড়া বিশেষ কিছুর দিকে না তাকিয়ে। ছন্নছাড়া চিন্তাগুলোকে আটকে দিতে বিড়বিড় করতে থাকি বাবার নাম। ‘ওম নমঃ শিবায়!’ এক এক পা ফেলে এক একটা শব্দ – ওম, নমঃ, শিবায়। বাবার নামের দুই আবর্তনে দাদরার তাল।
‘ধা ধি না, ধা তু না ‘।
রাস্তার ঢাল নিচের দিকে থাকলে বড়ো বড় পা। উপর দিকে থাকলে, ছোট ছোট পা, কিন্তু চলার সময় দাদরা তালের লয় এক। অনেক হেঁটে দেখেছি, চলতে থাকলে দাঁড়াবার ইচ্ছেটাই চলে যায়। লয়, তাল কেটে যাবে যে! তবু দাঁড়াতেই হয় মাঝে মাঝে।

সেদিন বেশ রোদ উঠেছে ততক্ষনে। গরম জামা না খুললেই নয়। সাধারণত দাঁড়াই না। জপতে জপতে এগোই, এগুতে এগুতেই জ্যাকেট খুলে কোমরে জড়াই। ব্যাগ ছোট, জায়গা নেই। তবু দাঁড়াতে হলো। সামনে ধস নেমে রাস্তা ধুয়ে গেছে। এক বিশৃঙ্খল পাহাড়ি নদী গুড়গুড় হুশহুশ শব্দ করে ধুয়ে নিয়ে চলেছে পথের যেটুকু বাকি ছিল। প্রায় হাঁটু জল। দাঁড়াতেই হলো। তাল তো কাটবেই!

আগে পিছে চেয়ে দেখলাম, কেউ কোথাও নেই। বাঁ দিকে পাহাড়। ডান দিকে ধসের সাথে পাথর নেমে গেছে অনেক নিচে। এগিয়ে যেতে হলে একটাই পথ, সোজা জলের মধ্যে দিয়ে। বেশ খেয়াল করে দেখলাম, একটা দুটো পাথর একটু জলের ওপর চাগিয়ে আছে, সাবধানে পা ফেলে ফেলে টপকে যাওয়া যাবে। প্যান্টের পায়া গুটিয়ে জ্যাকেট সামলিয়ে লাঠি বাগিয়ে এগুলাম এক পা। তারপর আড়াআড়ি আরও এক পা। আবার তির্যকভাবে আরও এক পা। এমনি করেই আরও আগে। এখন চারিদিকে জল। বেদম স্রোতে নিচের দিকে চলেছে। জলের শব্দ এমন যে, কেউ চেঁচিয়ে কথা বললেও শোনা যাবে না।

এমনি করে এগুতে এগুতেই একসময় আর বুঝে পেলাম না, যে শুরুতে কোন পাথরের ওপর পা রাখবো ভেবেছিলাম। দূর থেকে যে পাথরগুলো কাছাকাছি মনে হয়েছিল, সেগুলো আসলে অত কাছে নয়। ইংরেজিতে যাকে পারাল্যাক্স বলে আর কি। পরের পাথরগুলো দেখলাম পায়ের নাগালের বাইরে। কিংকর্ব্যবিমূঢ় হয়ে খানিকক্ষণ দুই পায়ে আর লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নড়বড়ে পুরনো তেপায়া টেবিলের মত যাকে বলে!
ফেরত যাবার প্রশ্নই ওঠেনা। তাই যে পাথরটাকে নাগালের মধ্যে কম গভীর জলে মনে হলো, তাতেই ডান পা তুলে রাখতে গেলাম। ব্যাস, পায়ের চাপে মুহূর্তেই পাথরটা গড়িয়ে গেল। জলের তোড়ে নিজে তো গেলই, সঙ্গে করে নিয়ে গেল সঙ্গের অন্য কিছু পাথর। কোনো মতে লাঠিতে ভর দিয়ে সামলে নিলেও শেষ রক্ষা হলো না। স্রোতের তেজে ঘুরে সরে গেলো বাঁ পায়ের তলায় পাথরটাও। চিৎ হয়ে পড়তে পড়তেও টাল সামলে লাঠিতে ভর রেখে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম বরফ গলা জলের মধ্যে। মুহূর্তে ঠান্ডায় যেন শ্বাস রোধ হয় এলো!

সম্বিত ফেরত পেতে যে কয়েক সেকেন্ড, তাতেই মনে হল ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। উরু অবধি ঠান্ডা জলে ভিজে গেছে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চিৎ হয়ে পড়িনি বলেই হয়ত জলের টানে নিচে নেমে যাই নি। গেলে, আজ আর গল্প লিখতে হতো না।

ভিজেই গেছি যখন, আর চিন্তা নেই। ছপাস ছপাস শব্দ তুলে বাকি জলটা পেরিয়ে গেলাম। ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরে গেছিলো। জ্যাকেটটা কোমরে জড়ানো বলে তার তলার দিকটা জলে ভেজা দেখলাম। পরা গেলো না। ব্যাগটার তলায় জল লেগে গেলেও ওয়াটার প্রুফ বলে ভেতরের জিনিস ভেজে নি। ব্যাগটার মধ্যে থেকে ফ্লাস্ক বার করে একটু গরম জল খেয়ে ধাতস্থ হলাম।

এইরকম মুহূর্তে কাজে লাগতে পারে ভেবেই ব্যাগে একটা ট্রাক প্যান্ট থাকে সবসময়। আশেপাশে কোথাও কেউ না থাকায় লজ্জার মাথা খেয়ে খোলা আকাশের নীচেই প্যান্ট জুতো ছেড়ে ফেললাম। দেখলাম আন্ডারওয়্যারও ভিজে গেছে মোক্ষম জায়গায়। বিন্দাস সেটাও খুলে রোদে পা শুকোলাম খানিক। সে এক অপূর্ব দৃশ্য!
পা শুকোতে শুকোতে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করলাম খানিক। দুই হাঁটুতে বেশ একটু ছড়ে গেছে। ব্যথা জানান দিচ্ছে বেশ। বাঁ পায়ের পাতাও ভালই মচকেছে। ঠান্ডায় আর উত্তেজনায় এতক্ষন বোঝা যাচ্ছিল না। এবার বুঝলাম হাঁটা কষ্টকর হবে। খুঁজে দেখলাম ওষুধের প্যাকেটটা বড়ো ব্যাগে রয়ে গেছে, সঙ্গে আসে নি।
ট্রাক প্যান্টটা পরে নিয়ে জুতোয় পা গলাতে গিয়ে দেখলাম সেটা এমন ঠান্ডা, যে কারেন্ট লাগছে মনে হচ্ছে। ধারালো পাথরের ওপর দিয়ে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব মনে করে জোর করে পা গলাবার চেষ্টা করলাম। আমার জুতো ওয়াটারপ্রুফ ট্রেকিং স্নিকার নয়, পাতি খাদিমের। ভেতরে কার্ডবোর্ড, আর পাশে কাপড়ের লাইনিং। সব জলে ফেঁপে এমন হয়েছে যে জুতোয় পা আর গলাতেই পারলাম না।
অগত্যা লাঠিতে বেশি ভর রেখেই জুতো জোড়া ব্যাগের সাথে ফিতে দিয়ে বেঁধে আবার হাঁটা শুরু করলাম। মুচকে যাওয়া জায়গাটা এমন ব্যথা করছিলো যে সাবলীল হাঁটা সম্ভব ছিল না। ধারালো পাথরে চলতে গিয়ে পায়ের পাতার চামড়া ছুলে যেতে লাগলো। বাঁ পায়ে বেশি ব্যথা বলে বেকায়দায় পড়ছিলই, এবার এমন লাগলো এক জায়গায়, যে আর্তনাদ করে বসে পড়তে হলো। এই যে বসলাম, বসেই রইলাম অনেকক্ষন। উঠতে গেলেই এমন ব্যথা লাগছিল, যে ওঠার ইচ্ছাটাই চলে গেলো।
কোথায় গেলো আমার দাদরা, কোথায় গেলো শিব মন্ত্র!

জীবনে অনেকবার ফিরে যাবো ভেবেও শেষমেষ এগিয়ে গেছি। এই দিন মনে হলো আর গতি নেই! ফিরতেই হবে। কিন্তু ফিরি কি প্রকারে? প্রথমেই তো হাঁটতে হবে, যেটা এই ক্ষণে দুষ্কর। তারপর ওই অবাধ্য দুর্দান্ত জলধারা আবার পার হতে হবে! উফ! দুঃসাধ্য! সুতরাং বসেই রইলাম। আগে ব্যথাটা কমুক। খাবার বার করে একটু খেলাম, আর একটু জল।
তারপর বসেই ছিলাম। সূর্য্য তখন প্রায় মাথার উপর। আমার কাছে ঘড়ি থাকে না। মোবাইল ভরসা। মোবাইল এ চার্জ না থাকলে, সূর্য্য ভরসা। রাতে চার্জ দিতে পারি নি, গ্রামে কারেন্ট নেই। বা থাকার কথা হলেও, ছিল না।

একটু পরে ফিরতি পথের যাত্রীরা, ছোকরা ছেলেরা সব লাফাতে লাফাতে আসতে লাগলো। তারা যাবে অনেক দূর। তাড়াতাড়ি গ্রামে পৌঁছে নিজের গ্রামের বাস ধরবে। কয়েকজন তো ‘বোম ভোলে’ বলেই দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল। শেষে তিনজনের একটা ছোট্ট দল আমাকে দেখে দাঁড়ালো। দুটো বেশ মুশকো মতন, হাসি হাসি মুখ, আগে আগে আসছে তারা। একটা একটু লম্বা রোগাটে, বসা চোখ, গম্ভীর, একটু পেছনে। হাসিমুখওয়ালা একজন বললে, “বোম ভোলে আঙ্কল! এয়সে বৈঠে হ্যাঁয়! সব ঠিক তো হ্যায় না?”
বুঝিয়ে বললাম আমার বৃত্তান্ত। বললাম ফেরত তো যেতেই হবে। অনেকক্ষন বাদে কথা বলার সুযোগ পেয়ে অনেকটা বেশিই বলে ফেললাম বোধ হয়। চুপ করে শুনলো তারা। হাসলো না। দুঃখ প্রকাশ করলো না। শেষে অন্য হাসিমুখ বললো, “বাবা কে নাম লেকর নিকলে হেঁ, রুকিয়ে মত! আইয়ে হম উঠা দেতে হেঁ! শাম তক পহুঁচ জাইয়ে গা বাবা কে ধাম।“

এতক্ষন যে আমি তাদের কত কথা বললাম, শোনেই নি মনে হলো। ফেরত যেতে সাহায্য করার কথাই তুলল না। শহুরে মানুষ আমি। ভাবলাম তাদের ফেরবার তাড়া আছে, তাই আমাকে সঙ্গে নিতে চাইছে না। ভুল ভাঙলো রোগাটের কথায়, “আঙ্কল সোচ রহে হেঁ কি হম উনকো সাথমে ওয়াপস লেনে নহি চাহতে!”
অবাক কান্ড! ব্যাটা মাইন্ড রিডিং জানে নাকি!
শুনে আমি অধোবদন হলাম। হাসি মুখ দ্বিতীয় জন তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, “আরে আঙ্কল, বাবা আপকো বুলায়ে হেঁ, হম আপকো কইসে লওটনেকা সালাহ দেঙ্গে!? পর, আপ ওহী চাহতে হেঁ তো হম জরুর লে যায়েঙ্গে!”
প্রথম হাসিমুখ হেসে উঠে বললে, “হম কনধে পর বিঠাকে লে যায়েঙ্গে! একদম!”
এই কথা বলতেই দুজন খুব হাসতে লাগলো! রোগাটা তেমনি গম্ভীর, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মন পড়ছে!
বুঝলাম, বাবার পথে কাউকে ফেরত যাবার উপদেশ দেওয়া নিষেধ!
করুণ মুখে চেয়ে থাকলাম রোগাটার দিকে। অনেক বাদে কথা বললে সে, ধীরে ধীরে, “ইন দোনোকো ঘর যানা জরুরী হ্যায়। ম্যায় আপকে সাথ চল সকতা হুঁ। বাবা দর্শন করাকে ওয়াপস লে আউনগা!”

আমি হতবাক! বলে কি ছোকরা! পুরো রাস্তা এক অজানা লোককে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে, আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে? নিম্নগামী মন আমার, টাকার কথা মাথায় এল..অনেক টাকা চাইবে হয়ত! মাইন্ড রিডার বলে ওঠে, “হম প্যায়সা নহি মাংয়েঙ্গে!”
আবার লজ্জা পেলাম। বাবার সাথী এরা। এদের প্রতি এইসব ভাবনা পোষণ করা অতি ঘৃণ্য অপরাধ। তবে সঙ্গে করে তাকে আবার নিয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। গেলে একাই যাবো আমি।

ভাবলাম চটির কথা। আমার জুতো ভিজে কিনা, তাই। তা ভিজে জুতো এতক্ষনে কিছুটা শুকিয়ে থাকবে। তাই পরেই যাবো নাহয়! মাইন্ড রিডার আমার থেকে চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞেস করলো, আপনার জুতো কই? ঘুরে দেখলাম আমার ব্যাগে বাঁধা জুতো নেই। কখন ফিতে খুলে পড়ে গেছে হয়তো। এদিক ওদিক তাকালাম অসহায় ভাবে। মাইন্ড রিডার বললে, “হামারা চপ্পল হ্যায় হি নহি। নঙ্গে প্যর হম বাবাকে দর্শন করতে হেঁ! হোনে সে, দে দেতে আপকো!”

অবাক কান্ড! আমার খালি পায়ে এই কয়েক কিলোমিটার আসতেই হালত খারাপ, ওরা পুরো রাস্তা চলেছে হাসতে হাসতে? আবার চটি থাকলে দিয়ে দিত বলছে! নাহ, কোন বাবার তাকতে এরা এত জোর পায়, আমাকে দেখতেই হবে! যাবো আমি, আজই, যে করেই হোক। যা থাকে কপালে!
রোগাটে লোকটা সে ভাবনাটাও বুঝলো হয়ত! হেসে বললে, “নিকল পড়িয়ে। পহুচতে পহুচতে রাত হোগা। ওহি রুক যানা!”

তাই তো, এই কথাটা মাথায় আসেনি? রাত হলে কি করবো? এই বিষম ঠান্ডায় তো জমে মরে যাবো! ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা না হয় বাদই দিলাম!
রোগা জন বলে উঠলো, “নাটমন্দির মে রাতকো ঠহর যাইয়েগা। পন্ডিতজি মাত্র গর্ভগৃহ মে তালা লাগাতে হেঁ। নাটমন্দির কে দরয়াজা খুলাই রেহতা হ্যায়। পিনেকা পানি ঔর প্রসাদ ভী রখা রহতা হ্যায়। ঔর তিন কমবল ভী।“

এত অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা যে কি বলবো! এই গেঁয়ো ছোকরা মন্দিরের সব অংশ গুলোর নাম জানে, সেখানে রাতে কি থাকে না থাকে সব জানে?
ছেলেটা একটু হাসলো। বললে, “আপকে জইসে ঔর ভী লোগ হোতে হেঁ। সোচিয়ে নহি। নিকল পড়িয়ে। বাবা কে ধাম দূর নহি! মন্দির সুবহ খুলনেসে পহেলা দর্শন কিজিয়েগা! সুরজ কে পহেলা কিরণ বাবা কে উপর গিরতা হ্যায়, বহুত আচ্ছা দিখতা হ্যায়!”
যাবো আমি! সত্যি দরজা খোলা নাটমন্দির আছে কিনা দেখবো! জল, প্রসাদ বা কম্বল আছে কিনা দেখব। সুর্যের প্রথম আলো বাবার ওপর কেমন পড়ে সেটাও দেখবো। দেখতেই হবে বলেই বেঁচে থাকবো। ঠান্ডায় মরবো না! রোগাটা আমার মনের সবটাই বুঝলো বোধ হয়!
ছেলেটার চোখের ইশারায় মুশকো দুটো আমার দুই হাত ধরে তুলে দিলে। ব্যাগ পিঠে বেঁধে দিলে। বাবার প্রসাদি ফুল গুঁজে দিলো বুক পকেটে। দুটো নকুলদানা মুখে পুরে দিল। তাঁদের বোতল থেকে জল এগিয়ে দিল। খেলাম। দুই জনে আমার পিঠ চাপড়ে এগিয়ে দিল বাবার পথে, উচ্চস্বরে ‘বোম ভোলে’ ডাক দিয়ে।
মাইন্ড রিডার এর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখন আমার পিঠে, বেশ অনুভব করছি। সে কিন্তু একটিবারও বোম ভোলে বললো না! মনে হলো, স্থির দৃষ্টি দিয়েই সে বোধহয় আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছে।

খোঁড়াতে খোঁড়াতে, ঠোকর খেতে খেতে এগিয়ে চললাম। না হলো শিব নাম জপ, না তাল মেলানো পদক্ষেপ। মাথার মধ্যে তখন ঘুরছে শুধু কোনো এক স্বল্পকল্পিত ছোট্ট মন্দিরের শিবলিঙ্গ আর তাতে একফালি ভোরের আলো।
কতক্ষন এগিয়েছি মনে নেই। সূর্য্য বেশ হেলে পড়েছে। একবার ভাবলাম, ভুল হলো নাকি! এত কথা বললো রোগা ছেলেটা, একবারও তো বাবার নাম নিল না অন্যদের মতন? তাকিয়ে দেখলাম, যারা দর্শন করেছে তারা সব ঊর্ধ্বশ্বাসে পাশ কাটিয়ে ‘বোম ভোলে ‘ বলে চলে যাচ্ছে। নাহ, আর ফেরার অবকাশ নেই। মন্দিরেই রাত কাটাতে হবে। এগিয়ে যাবো!

কুয়াশা করে এলো। ভালো দেখা যায় না। আরো একটু এগোতেই রাস্তার ডান ধারে একটা ছেঁড়া চটি দেখতে পেলাম। রবারের স্লিপার। কটকটে হলুদ রঙের, ডানপায়ের। পরার অযোগ্য। অন্য কোনো রং হলে চোখেই পড়ত না। কারো চটি ছিঁড়ে যাওয়ায় ফেলে গেছে। পরিবেশ দূষণ! পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এরকম প্রাকৃতিক পরিবেশে বেশ বেমামানই মনে হলো।
এগিয়ে চললাম। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, উঁচু থেকে আরো উঁচু রাস্তা। উচ্চতা বাড়লে মাথায় কেমন একটা ধোঁয়াশা হয়, চিন্তাগুলো গোলমেলে হয়ে যায়। বেশ একটু এগিয়ে এক জায়গায় কুয়াশা একটু কম। দেখলাম, পথের বাঁ পাশে পড়ে আছে সেই ছেঁড়া চটিটার অন্য পাটিটা। যার চটি, সে এতটা এক পায়ে চটি পরে এসে শেষে অসুবিধে বলে এটাও ফেলে দিয়েছে! পরিবেশ দূষণ! আমি খালি পায়ে এগিয়ে চললাম । রাতের আগে পৌঁছতেই হবে! তবে নোংরা কিছু আরো চোখে পড়লো। একটা খালি জলের বোতল, আর দুটো বিস্কুটের মোড়ক।
এতক্ষন কিছু চোখে পড়ে নি। এবার নজর একটু তীক্ষ্ণ হলো। জনগন পরিবেশ সম্মন্ধে আরো একটু সজাগ হলে ভালো হতো। ফেরার পথে এগুলো কুড়িয়ে নিয়ে নিচে গ্রামে ডাস্টবিনে ফেলে দেব ভাবলাম। আরও একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটু দূরে ঢালের মধ্যে লাল কিছু উঁকি দিচ্ছে। ঠাহর করে দেখলাম এক জোড়া চটি। কেউ ফেলে গেছে। নিশ্চই ছেঁড়া।

দেখতে দেখতেই মাথায় চিন্তা এলো। যদি ছেঁড়া না হয়? যদি আমার জুতোর মত ভালো হয়, ভুলে ফেলে গেছে, তবে তো আমি পরতেই পারি!? লাঠিতে ভর করে সাবধানে ঢাল বেয়ে নিচে নেমে দেখলাম, নাহ, ভালো না। বাঁ পায়ের স্ট্র্যাপটা ছেঁড়া। ইচ্ছে করেই ফেলে গেছে। একটা ছিঁড়ে যেতে দুটোই ফেলে গেছে। হলুদ চটিটার মালিকের মত নয়।
মাথার ধোঁয়াশা হটাৎ পরিষ্কার হয়ে গেল যেন। হলুদ চটি! আরে, ওইটার বাঁ পাটা ঠিক ছিল না? তাড়াতাড়ি ভালো লাল চটিটা ডান পায়ে গলালাম। আট নম্বর। ক্ষয়ে যায় নি বেশি। আমার পায়ের থেকে একটু বড়! তাহলে হলুদ চটিটাই বা নয় কেন?

খোঁড়াতে খোঁড়াতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভালো হলুদ চটিটার কাছে ফেরত এলাম। দিব্যি পায়ে গলে গেল। সাত নম্বর। আমারই মাপের। ক্ষয়ে গিয়ে একটু ঢিলে হয়ে গেছে। নতুন লাল আট নম্বর ডান পায়ে, আর ঢিলে হলুদ সাত নম্বর বাঁ পায়ে দিয়ে বেশ আরাম হলো। চটির জন্য পাথরে লাগার ব্যাথাটা বেশ কমে গেল। কি মনে হলো, রুমাল বার করে বাঁ পায়ের মচকানো জায়গাটা বাঁধলাম। ভালো আরাম হলো। বেশ চট চট আওয়াজ করে চলতে লাগলাম। পৌঁছে যে যাবই, সে সন্দেহ আর রইলো না।

আস্তে আস্তে চলার লয় ফেরত এলো। একসময় অজান্তেই আবার ‘ওম নমঃ শিবায়’ জপ শুরু হলো। লয় স্থির হলো। দাদরা তালও একসময় ফেরত পেলাম। মন্দিরে পৌঁছবার খানিক আগেই দূর থেকে পুজোর ঘন্টি শোনা যায়। পাহাড়ের গায়ে ঠোকর খেয়ে খেয়ে আওয়াজ অনেক দূর অবদি যায়। আমি পৌঁছলাম যখন, পুজো শেষ, সব বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ কোথাও নেই।

মন্দিরের নিচে লাল হলুদ চটিজোড়া অতি যত্নে পাশাপাশি রেখে দেব দর্শনে গেলাম। নাটমন্দির খোলা ছিল, তবে মূল মন্দির বন্ধ ছিল। গরাদের মধ্য দিয়ে একটা মাত্র প্রদীপের আলোতেই দেব দর্শন হলো। শিবলিঙ্গের মাথায় একটা হলুদ গাঁদার ফুল। আর কিছুই বিশেষ নেই। নাটমন্দিরের এক ধারে পাতায় ঢাকা খাবার ছিল। ভিজে চাল, ভিজে গোটা মুগডাল আর ছোলা, নকুল দানা, এই সব। পেট না ভরলেও, ক্ষিদে মিটলো। এমন কিছুই না, সাধারণ জিনিস। দরজা দিয়ে চাঁদের আলো আসছিল একটু, তাই অন্ধকার অতটা জমাট ছিল না। প্রদীপের আলোয় কম্বল পেলাম দুইখানা। একটা পাতলাম, একটা গায়ে দিলাম। কুটকুটে পুরনো কম্বলের গন্ধ জানান দিলেও, কষ্ট দিল না। ঘুমিয়ে পড়লাম একসময়ে।

সকালে পুরোহিত এলেন। মন্দির খুলে কিছু ফুল, বাতাসা, নকুল দানা দিয়ে পুজো করলেন। ভোরের সূর্যের লালচে হলুদ আলো সোজা এসে পড়লো শিবলিঙ্গের ওপর। কি আশ্চর্য ডিজাইন এত হাজার বছর আগে! অদ্ভুত ভালো লাগছিল!

ঘন্টি বাজিয়ে প্রদীপ নাড়িয়ে আরতি হলো। পুরোহিত আমায় বড়ো ঘণ্টা বাজাতে বললেন। বাজালাম। আমি না থাকলে অন্য কে বাজাতো? কে জানে?
পুজো শেষে পুরোহিত আমার কথা জিজ্ঞেস করলেন। ওনার ঘর নিচে কোথাও গ্রামে। ভোরে উঠে আসেন ওপরে রোজ, শর্টকাট রাস্তায় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। ভাবলাম, লংকাট টাই প্রাণান্তকর, শর্টকাটটা কেমন হবে?

জানলাম, আমি যে গ্রামের থেকে আসছি, এটা সেটা নয়। জঙ্গলের মধ্যে কয়েক ঘর আদিবাসী থাকে, সেখানে পুরোহিত থাকেন তাদেরই একজন হয়ে। ওনার পরিবার থাকে আমার লজের গ্রামে।

মন্দিরটা ঘুরে দেখলাম, পুরনো আর ছোট্ট। এমন কিছুই নয়। বড়ো হবেই বা কেন? দেব তো থাকেন ওই রোগা, মুশকো, বা ওদের মতোই, মানুষের বুকে! ভক্তের হৃদয়ে যাঁর পীঠ, মন্দিরের আড়ম্বরে তাঁর কাজ কি?

নমস্কার জানিয়ে, নাটমন্দির ঝাঁট দিয়ে, প্রসাদ পেয়ে, ফিরতি পথে রওয়ানা দিলাম। লজে একদিনেরই টাকা দিয়েছি। তারা চিন্তা করবে। সেদিনের যাত্রীরা তখন মন্দিরের পথে যাচ্ছে। কেউ আমার পায়ের লাল হলুদ চটি পরা দেখে কেউ হাসলো না। ‘বোম ভোলে’ বলে এগিয়ে গেলো তারা। পথে একজায়গায় দেখলাম আমার একটা পাটি জুতো পড়ে আছে। তুলে ব্যাগে বাঁধলাম। একপাটি পেলাম যখন, অন্যটাও হয়ত পাবো। একপায়ে চটি আর একপায়ে জুতো পরে হাঁটাও সম্ভব নয়। আরো একটু এগিয়ে দেখি আমার জুতোর অন্য পাটিটাও পড়ে আছে। কেই বা নেবে? ইতিমধ্যে দুটো জুতোই দেখি শুকিয়ে গেছে। দারুন খুশি হয়ে পায়ের রুমাল ব্যান্ডেজ খুলে এবার জুতোয় পা গলালাম। চটি দুটো বেঁধে নিলাম ব্যাগের সঙ্গে। নদীটা পার হতে কাজে লাগবে। জুতোটা ভিজলে চলবে না।

নদীটার কাছে পৌঁছলাম যখন, তার স্রোত আর নেই। তিরতির করে বয়ে চলেছে বাধ্য কিশোরীর মত। ওপরের ভাঙ্গা বাঁধে জল বোধ হয় আর নেই। জুতো পরেই অনায়াসে পেরিয়ে গেলাম তাকে। একটু পরে ব্যাগ থেকে চটি জোড়া নামিয়ে একটা বড় পাথরের ওপর তাদের অনেক যত্নে রাখলাম। প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলাম তাদের।
– অনেক উপকার করলে! সুখে থাকো, ভালো থাকো, দুজনে দুজনের খেয়াল রেখো, এমনি করেই সবার সাহায্য কোরো, মঙ্গল হোক তোমাদের!

তারপর, চটিদের আর একবার দেখে, নিজের জুতো পরে মসমস করে লজের দিকে এগিয়ে চললাম আমি, শহরের বাবু।

@SunJoy

 

Sahityika Admin

1 comment

  • সামান্য এক চটি নিয়ে এমন লেখা যায়? সত্যি দারুণ হয়েছে।