মুখোশের আড়ালে
@ সুকৃৎ বসু, ১৯৭৩ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
*** গল্পের চরিত্রগুলো নিছকই কাল্পনিক ***
সুনীথ ঘোষ আজ একজন স্টীল বা ইস্পাত শিল্পের ম্যানেজমেন্ট গুরু ও স্বনামধন্য টেকনোক্রাট। পৃথিবীর অনেক দেশে বিশেষ করে চীন, জাপান, ইংল্যান্ডের অনেকগুলি ইস্পাত শিল্পের আধুনিকীকরণ, বানিজ্য ও শ্রীবৃদ্ধি সুনীথ ঘোষের অবদানের ফসল। এবং ফলস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ প্রচুর অর্থের বিনিময়ে সুনীথ ঘোষকে বিশেষ পরামর্শদাতার আসনে নিয়োগ করেছে।
সম্প্রতি ভারত সরকার মি. সুনীথ ঘোষকে সম্মানিত করেছে পদ্মভূষণ উপাধি প্রদান করে।
উন্নতি ও পরিবর্তনের পাশাপাশি সুনীথ আজ পেশাদারিত্বের মুখোশে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। অন্যথায় সে কিন্তু অন্য মানুষ। মাটির কাছাকাছি, সহজ, সরল, নিষ্পাপ, ভগবান ভীরু মানুষ।
আজ থেকে বছর পনেরো আগে সুনীথ নিতান্তই এক সহজ, সরল, হাসিখুশি মানুষ। জীবনের জটিলতা তখনও সে জানে না। ছিল না কোন দায়িত্ব, বা কোন মুখোশ। তাই জীবনে বহু ধাক্কা খেতে খেতে অপমানিত হতে হতে একসময় সে ঘুরে দাঁড়ায়। তখন সে অন্য মানুষ। অন্য সুনীথ, একজন মুখোশের আড়ালে। ইস্পাত তীক্ষ্ম পৌরুষের মুখোশ। পরিণত বুদ্ধি যে হার মানতে জানে না। প্রতিহিংসার হিসেব মেটায় একে একে। ধরাছোঁয়ার বাইরে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। সমাজকে বুঝিয়ে দেয়, মানুষ শক্তেরই ভক্ত। সহজ-সরল মানুষের দাম কম। অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয় কায়দায় বা কৌশলে।
এখন অফিস থেকে ফিরে সে তাঁর পৌরুষত্বের আবরণ যদি কিছুক্ষণের জন্যও সরায়, কোমল হৃদয়টা একেক সময় কেঁপে ওঠে। পরক্ষণেই চেতনা হয়ে ওঠে সজাগ। অপমানের গ্লানি চিবুক শক্ত করে দেয়। চোখ দুটি চকচক করে ওঠে। মুখোশটা পরে নেয় আবার। তখন সবাই সমীহ করে, ধারে কাছে ঘেঁষতে ভয় পায়।
সুনীথ তাঁর পেশাদারি জীবন শুরু করে কোলকাতার কাছাকাছি এক ইস্পাত শিল্প নগরীতে। অপূর্ব সুন্দরী সেই শহর। সবুজে ঢাকা গাছপালায় সাজানো গোছানো এক শিল্পনগরী। থাকে প্রায় তিরিশ হাজার পরিবার। যখন সে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনী হিসেবে চাকরিতে যোগ দেয়, তখন থাকতে হতো সাজানো গোছানো অফিসার্স হোস্টেলে। সামনে খেলার বিরাট মাঠ। দূরে পাহাড়ের হাতছানি।
সাইকেলে চেপেই তখন সুনীথরা কারখানা যেত। কলেজের হোস্টেল লাইফ কাটিয়ে এসে এখানকার হস্টেল লাইফ বেশ ভালই লাগতো। জমজমাট হস্টেল। খাওয়া-দাওয়া, গল্প-গুজব, ক্লাবে যাওয়া সব মিলিয়ে দুর্দান্ত। অরিন্দম, বরুণ, সুগত, তরুণদা, রবীন, মান্না সবাইকে নিয়ে আনন্দে দিনগুলি কেটে যেতো। সকালে হরি এসে দরজা নক্ করে বেড-টি দিয়ে যেতো, জুতো পালিশ করে দিতো। পরে এসে ঘর পরিষ্কার করে দিতো। রাজসিকভাবে চলতো জীবন। ধাপে ধাপে সুনীথ যত উন্নতি করে বাহনও পরিবর্তিত হয়ে সাইকেল থেকে স্কুটার, স্কুটার থেকে গাড়ীতে এসে দাঁড়ায়।
সুনীথের মনে পড়ে কারখানায় ওপরের E.O.T Crane থেকে তেলের ফোঁটা পড়ে পড়ে জামা ভরে যেত। ঘরে ফিরতো জামা ভরা তেলের ফোঁটা ফোঁটা দাগ নিয়ে। আর মাথায় হেলমেট ছিল বাধ্যতামূলক। ক্রেন থেকে নাটবল্টু পড়া, বা কারখানায় অন্যভাবে মাথার আঘাত থেকে বাঁচার জন্য হেলমেট পড়া বিশেষ জরুরী।
কারাখানায় দুর্ঘটনা প্রায় লেগেই থাকতো। কখনও ইঞ্জিন/লোকোতে ধাক্কা খেয়ে, কখনও রোলিং মিলের সোকিং পিট-এর ধারে গ্যাস খেয়ে, কখনও স্টীল ইনগট-এ ধাক্কা খেয়ে। একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই হইচই, হাঙ্গামা – কাজ বন্ধ। সুনীথ সেইসময় সহজ সাধাসিধে তরুণ। কারখানার রাজনীতি সে বোঝে না।
সুনীথ শীট মিলস্ এর ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে পোস্টেড ছিল। শীট মিলস্-এ তখন রমরমা। শেড নিয়ে শীট মিলসের টাইগার ব্রান্ড শীট তখন সারা ভারতবর্ষে বিখ্যাত। সতেরো শো লোক কাজ করে। একদিন মাঝরাতে ফোন। অপর প্রান্তের প্ল্যান্ট-ইন-চার্জ-এর কথা শুনে সে হতবাক। বিরাট বড় দুর্ঘটনা এবং শানিচার ওঁরাও। নামের একজন কর্মী মারা গেছেন। সে অত্যন্ত পরিশ্রমী, সুন্দর স্বভাবের Head Mill Wright কর্মী। নামটা শুনেই আঁতকে উঠেছিল সুনীথ। গাড়ী এসে সুনীথকে প্ল্যান্টে নিয়ে গেলো। সেখানে প্রচুর লোকের ভীড়। দু’নম্বর Roughing Mills-এর Feeding Table-এর ধারে শানিচার ওঁরাও-এর নিথর দেহ পড়ে আছে। ক্রেন ড্রাইভার ওপর থেকে নেমে এসেছে। তাকে ধরে নানা জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সুনীথ এসে পড়ায় ওকে নিয়েও চললো নানা প্রশ্ন। জানা গেলো Roughing Mills-এর Housing Base Bolt টাইট করার সময় ক্রেন দিয়ে Spanner slip করে প্রায় তিন কেজি ওজনের ভারী জিনিসটা সজোরে বুকে ধাক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গেই সব শেষ। এখন নানা প্রশ্ন উঠে আসছে Spanner-এর ঘাট রাউণ্ড হয়ে আসাতে ফুট বোল্টের উপর দিয়ে স্লিপ করে গেছে। কেন সেটা পালটানো হয়নি? ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেন্টের গাফিলতি কি? প্রচুর চাপান-উতোর চলতে থাকলো। ডেডবডি সরানো হল না। কাজ বন্ধ। যতক্ষণ না কর্তৃপক্ষ মৃত কর্মীর ছেলেকে চাকরি দেবার প্রতিশ্রুতি দেবে ততক্ষণ এই অশান্তি চলতে থাকবে।
তখন পার্সোনাল ডিপার্টমেন্ট ছিল ঝানু ম্যানেজারে ভর্তি। কিভাবে কি চাল খেলতে হবে সবই জানা। হঠাৎ-ই লক্ষ্য করা গেল, মোটর সাইকেলে কুখ্যাত গজার আবির্ভাব। সঙ্গে তার তিন-চারজন সাকরেদ। গজা এই ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেল। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় সবাইকে হুঁশিয়ারি দিতেই ভীত লোকজন সরে দাঁড়ালো। মুহূর্তে ডেড বডি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে গজা ও তার সাকরেদ হাওয়া। এটা পার্সোনাল ডিপান্টমেন্টের চাল। গজাকে মদ খাওয়ানো, টাকাপয়সা দিয়ে মাথায় চড়ানো – সবই নিখুঁত পেশাদারিত্ব। সুনীথ দেখল, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। সব স্বাভাবিক, গজার আবির্ভাব সব ঠাণ্ডা করে দিল। প্ল্যান্টের কাজ আবার শুরু হয়ে গেল। সব স্বাভাবিক।
সুনীথকে বানানো হল Scape goat। নরম মাটি পেয়ে লোক দেখানোর জন্য সুনীথকেই দোষী সাব্যস্ত করে ওয়ার্নিং লেটার দেওয়া হলো। সুনীথ প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেল, যেখানে প্রকৃত অর্থে ওর কোনো দোষই নেই। বসের ওপর সুনীথের ক্ষোভ জমে উঠলো। প্রণবদা বলেছিল, স্পষ্টবাদী হতে শেখো। চুপচাপ থেকো না। প্রণবদা সিনিয়র দাদা, সুনীথের কলেজের। সুনীথ ওঁকেই আইডল মানতো। ডাকাবুকো, সাহসী, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী প্রণবদা। তাই উন্নতিও করেছিল জীবনে।
সহজ-সরল সুনীথ এবার পেশাদারি জীবনের শুরুতে ধাক্কা খেতে থাকলো। কারখানা থেকে ফিরে স্নান সেরে সন্ধ্যায় চায়ের টেবিলে সবাই জমায়েত হয়। চা ও স্ন্যাক্স খেতে খেতে চলে নানান আলোচনা। সিনিয়র দাদাদের মধ্যে স্বপনদা ছিল মিটমিটে শয়তান। এমনিতে মিষ্টি মিষ্টি কথা কিন্তু বাস্তবে প্রচণ্ড বদমায়েশ।
সেবার সুনীথ খোঁজ করছিলো কোথায় নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়া যায়। একটা ঘর নিয়ে অফিসার্স হস্টেল ছেড়ে দেবে। আর বাবা-মাকেও নিয়ে আসবে। তখনও কোম্পানির কোয়ার্টারের এলিজিবিলিটি হয়নি। স্বপনদাও বিয়ে করবে বলে নিজের জন্য বাড়ী খুঁজছে। সুনীথ একটা বাড়ী পছন্দ করে ভাড়া ঠিক করে এসেছিল। সুনীথের থেকে সেই তথ্য নিয়ে স্বপনদা বাড়ীর মালিকের সঙ্গে বেশী ভাড়ায় রফা করে নিলো। সুনীথ জানতে পেরেছিল, আর তারপর স্বপনদার এই বেইমানি সুনীথ মনে রেখেছিল। স্বপনদার এই ব্যাবহারের জন্য অরিন্দম, বরুণ, তাঁকে অনেক কথা শুনিয়েছিল, কিন্তু তাতে স্বপনদার কিছু আসে যায়নি। ওদিকে শীট মিলের চিফ সুপারিনটেনডেন্ট অসিতদা সুনীথকে খুবই ভালবাসতো, দুটি কারণে পরিশ্রমী ও সততার জন্য। কোম্পানির পাক্ষিক পত্রিকা ‘Roughing Mills’-র সম্পাদককে ডেকে সুনীতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। পরে সেই পাক্ষিক পত্রিকায় বিরাট ফটো ছেপে সুনীথের সম্পর্কে বিশাল আর্টিকেল ছেপে ছিল। “Work is their first love” নাম দিয়ে। এতে সুনীথের মনোবল বেড়েছিল। কিন্তু এতে সুনীথের Direct Boss কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছিল।
এরপর ইউ.কে-তে দু’মাসের জন্য বিশেষ ট্রেনিং নেবার জন্য সুনীথ মনোনীত হয়েছিল। কিন্তু সেবারও সেই একই বস সুনীথকে বাদ দিয়ে নিজেই ইউ.কে ঘুরে আসে। প্রচণ্ড ক্ষোভ হয় সুনীথের। বস-কে আর সহ্য করে উঠতে পারছিল না। এত পরিশ্রম করেও বস-এর মন জয় করতে না পারার জন্য নিজেকে বিশ্লেষণ করে সুনীথ। প্রণবদা পরে বুঝিয়েছিল ট্যাক্টফুল হয়ে চলতে শেখো। শুধু কাজ করলেই চলবে না।
সদ্য বিয়ে করে আসার পর যখন কালিঝুলি মেখে সুনীথ রাত্রে বাড়ী ফিরতো তখন গিন্নী অনেকদিনই আক্ষেপ করেছিল, তুমি ইঞ্জিনীয়ার না কুলি-মজুর? এত কালি লাগে কি করে? কে কাকে বোঝায়? মনটা সুনীথের ভেঙে পড়ে। একদিকে পরিশ্রম অন্যদিকে বস ও তার সঙ্গে ঘরের লোকজনও অখুশী।
একদিকে পেশাদারি জীবনে ধাক্কা খাওয়া, আর অন্যদিকে ইস্পাত শহরের সৌন্দর্য, সবুজ গাছপালা, অফিসার্স ক্লাব, সুন্দর সাজানো-গোছানো বাংলো, বিরাট বিরাট ফ্ল্যাট নিয়ে অন্য সুন্দর জীবন। ছবির মতো পার্ক ছিল – নেহেরু, পার্ক। দামোদর নদীর ধারে কৃত্রিমভাবে তৈরী, উঁচুনীচু পাহাড়ি ঝর্ণা, লেক, ছোট ছোট বোটিং-এর ব্যবস্থা বড়ই মনোরমছিল। সন্ধ্যায় মিউজিক্যাল ফাউন্টেন- অপূর্ব। প্রায় তিরিশ মিনিটের প্রোগ্রাম দেখার মতো ছিল। সংস্কৃতি ভবনও ছিল বিনোদনের আর এক পীঠস্থান। বঙ্গ সংস্কৃতি থেকে মেলা- কী না ছিল? সুনীথের এসব বড় ভাল লাগতো। অফিস থেকে ফিরে স্নান সেরে স্ত্রী অনিতা ও পুত্র অর্ককে নিয়ে ক্লাবে যাওয়া। ক্লাবের কুক মহাদেবের হাতের মটন চাপ, চিকেন ফ্রাই, ফিস ফ্রাই জমিয়ে খাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা অদ্ভুত সে আনন্দ! ক্লাবে অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। সিনেমা দেখানো, নাচ-গানের অনুষ্ঠান, কালীপুজোয় আতশবাজি, এক্সমাসের অনুষ্ঠান – সবই উপভোগ্য। অরিন্দম, বরুণ ও ওদের পরিবারের সঙ্গে হৃদ্যতা বেড়ে উঠেছিল।
সুনীথের মতে মহিলা সমাজ ছিল অন্য মেজাজে। পি.এন.পি.সি. (পরনিন্দ পরচর্চা) হতো প্রাণ খুলে। পি.এন.পি.সি. র আসর বসতো বাসস্ট্যান্ডে, ক্লাবে, ফ্ল্যাটে। কার বর উন্নতি করলো, কে করলো না, জীবনের ইঁদুর দৌড়ে কে কোথায় দাঁড়িয়ে, কার ছেলে ‘কার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে এগুলিই আলোচনার মশলা, মহিলা সমাজের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
প্রফেশনে সুনীথ চতুর্থ ধাপ অর্থাৎ ম্যানেজার পদ পর্যন্ত ঠিকঠাক এগিয়ে ছিল। কিন্তু পরের ধাপে অর্থাৎ সিনিয়র ম্যানেজার হতে এক বছর দেরীতে হয়েছিল। সেজন্য মনে বড় ধাক্কা খেয়েছিল। বস অর্থাৎ টি. এস. ভট্টাচার্যের এই মনোভাবে সুনীথ ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে। সোজাসুজি বস-এর ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, প্রমোশন দেওয়া হল না কেন তাকে? কিসের অভাব দেখেছেন তিনি সুনীথের মধ্যে? কোনো সদুত্তর দেয়নি সেই টি. এস. ভট্টাচার্য। শুধু বলেছিল, কোন কৈফিয়ৎ দিতে তিনি বাধা নন, নীরবে বেরিয়ে এসেছিল সুনীথ। প্রণবদা তখন বুঝিয়েছিল, মন খারাপ করিস না, শুধু পেশাদার হতে শেখো।
পেশাদার, পেশাদার, পেশাদার। ভাল লাগে না। সুনীথ এবার বস-এর ওপরেই শুধু ক্ষুব্ধ হল না, নিজের ভাগ্যের দোষ দিতে দিতে নিজেকেও বিশ্লেষণ করলো। না ভাগ্যকে দোষ দেবে না সে। এবার সে ভাগ্যকে নিজেই তৈরী করবে। একদিন নিজের চরিত্রকে পাশে সরিয়ে রেখে পেশাদারিত্বের মুখোশ পরে নিল। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর যোগ্য জবাব দেওয়া, প্রয়োজনে বসকেও। শুরু হল নতুন জীবন। প্রতিজ্ঞা করলো, বস-এর ব্যবহারের যোগ্য জবাব সে দেবেই। পেশাদারিত্বের চরম পর্যায়ে পৌঁছে তবেই সে মুখোশ খুলবে। সুনীথকে অন্য চেহারায় এবার দেখা গেছে। সুনীথ সাংসারিক জীবনেও লক্ষ্য করেছে, মানুষ শক্তেরই ভক্ত। প্রণবদার প্রবচন শিরোধার্য করে নতুনভাবে মুখোশ পড়ে এগিয়ে চলে সুনীথ।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বস টি. এস. ভট্টাচার্যের সঙ্গে সুনীথের বিবাদ বাঁধে এবং এবার চাঁচাছোলায় তীব্র ভাষায় জবাব দিয়ে রেজিগনেশন লেটার জমা দিয়ে আসে। নিজের মেধায় ESSAR Steel-এ A.G.M হয়ে যোগ দেয়। ছ’মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে Management Philosophy ও Leadership Style নিয়ে পড়তে আমেরিকায় চলে যায়। পরে চীন, জাপান, ইংল্যান্ডে ইস্পাত শিল্পে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ দেখিয়ে পৃথিবীর নানান দেশের স্বীকৃতি অর্জন। এবং আমেরিকা সরকারের আমন্ত্রণে উপদেষ্টা হিসেবে সেখানেই পাকাপাকিভাবে থাকা।
আজ সুনীথের ডাক পড়েছে তারই পুরোনো কারখানার উন্নতিকল্পে, রুগ্ন কারখানার মুনাফার মুখ দেখাতে। দু’বছরের বিশেষ কনট্যাক্ট। পুরোপুরি ক্ষমতা দিয়েছে।
দমদম এয়ারপোর্টে মি. সুনীথকে নিতে এসেছেন চিফ পার্সোনাল ম্যানেজার মি. তিওয়ারি ও কারখানার নিজস্ব ছোট প্লেনের পাইলট মি. গুহ রায়। দীর্ঘ পনেরো বছর পর আজ সুনীথ ঘোষ মাঝরাতে কারখানা পরিদর্শনে আসছেন। ম্যানেজমেন্ট গুরুর প্রথম চমক। মাঝরাতে ছোট প্লেনে শহরে অবতরণ করেই কারখানা ঘুরে দেখা। মাঝরাতে কারখানা পরিদর্শন? সাজো সাজো রব! হই চই বেঁধে গেল।
প্লেনে কফি খেতে খেতেই সুনীথ তাঁর স্মৃতির পাতাগুলো খুলে দেখছিলো। ভাবতে ভালই লাগছে। কত স্মৃতি বিজড়িত এই তিলোত্তমা ইস্পাত নগরী। এই শহর তাঁকে ভালো মন্দ অনেক কিছুই দিয়েছিল। এখানেই বিরাট বাংলোয় তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। এখানেই সুন্দর পরিচ্ছন্ন হাসপাতালে অর্কের জন্ম। বাবা-মার কাছ থেকে পাওয়ার বিরাট ঋণ সামান্য শোধ করেছিল মায়ের চোখের অপারেশন কারখানারই নার্সিংহোমে করিয়ে দিয়ে। ছোট বোন এষা ও বিজিতের বিয়ের বন্দোবস্তো এখানকার বাংলোয় করিয়ে। ছোট ভাই অংশু ও স্বাতীরও বিয়ের ব্যবস্থা করিয়ে। সেখানেই কিছুটা পরিতৃপ্তি ও শান্তি।
Hill View Park-এর বন্ধু শীট মিলস্-এর শিফট্ ইনচার্জ সুব্রত ঘোষের কথা মনে পড়ে। অত্যন্ত সাধাসিধে ভালমানুষ ছিল সুব্রত। মনে পড়ে বরুণ ঘোষ ও অরিন্দমের কথা। কত মজাই না করেছে সবাই মিলে। আর বস- টি. এস. ভট্টাচার্য, স্বপনদার কথাও মনে পড়ে। ওদের যোগ্য জবাব দিতে পারলে তবেই শান্তি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শিল্পনগরীর উজ্জ্বল ঝলমলে আলোয় ছোট প্লেন মাটি স্পর্শ করল। প্লেন থেকে নেমে আত্মবিশ্বাসের স্তম্ভে পা ফেলে এগিয়ে চললো সুনীথ। প্রথমেই গলায় মালা পরিয়ে দিল সুনীথেরই এক সময়ের আইডল প্রণবদা, যিনি বর্তমানে এই কারখানার কর্ণধারও। সুনীথের খুব ইচ্ছে করছিল প্রণবদার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। কারণ, প্রণবদাই সুনীথকে অনুপ্রাণিত করেছিল। কিন্তু না, আজ সুনীথ পেশাদারিত্বের মুখোশে ঢাকা, কোনোরকম দুর্বলতার সেখানে কোন ঠাঁই নেই। বুকে জড়িয়ে ধরে শুধু প্রণবদাকে। সুনীথের বদলে যাওয়া চেহারার চাকচিক্য, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, কাঁচা পাকা চুলের জন্য প্রণবদা প্রথমে চিনতে পারেনি। সুনীথ দেখলো অভ্যর্থনা কমিটিতে তার পুরোনো বস টি. এস. ভট্টাচার্য দাঁড়িয়ে। বিশেষ পাত্তা না দিয়ে অনিচ্ছায় শুধু পেশাদারিত্বের ছোঁয়ায় হাত মিলিয়ে এগিয়ে গেল। গাড়ীর কনভয় এগিয়ে চললো কারখানার উদ্দেশ্যে। কারখানা পরিদর্শন করে সুনীথ ভোরে গেস্ট হাউসে ফিরে এলো। এর আগে অনেক রুগ্ন কোম্পানিকে সে সুস্থ করেছে। এখানেও ভাবনার ছক সে আগেই করে রেখেছে। শিল্প শহর সারা রাত নানা উন্মাদনায় নানা জল্পনায় জেগে রইলো।
পরের দিন ঠিক সময়েই অর্থাৎ সকাল ন’টাতে হট লাইনে কারখানার পরিস্থিতি অর্থাৎ কোথায় কত উৎপাদন হলো, কেন কম হলো তার হিসেব নিতে এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টরকে নির্দেশ দিল সুনীথ। সব Head of Dep.-এর নিজের নিজের চেম্বারে বসে জবাবদিহি চললো। সুনীথ নেপথ্যে মাঝে মাঝে তাঁর মতামত জানাচ্ছিলো পেশাদারি কায়দায়। প্রথম দিনই বুঝিয়ে দিল, প্রত্যেককে শ্রম দিতে হবে। ফাঁকি বাজি চলবে না। অন্যথায় ছাঁটাই করা হবে। নির্দিষ্ট কাজ শেষ হলেই তবে বাড়ী যাওয়া যাবে, নতুবা নয়। খরচের অপব্যবহার করা চলবে না। Cost Control আর Modernisation-এর এটাই মূলমন্ত্র। চারদিকে হই-চই বেঁধে গেল।
সাতদিনের মাথায় স্বপনদাকে, দশদিনের মাথায় টি. এস. ভট্টাচার্যকে রেজিগনেশন লেটার জমা দিতে বলা হল। দু’জনেই সুনীথের সঙ্গে দেখা করতে চাইলো। কিন্তু অনুমতি মিললো না। প্রণবদা সব বুঝতে পেরে সুনীথকে শুধু বলেছিল, একেই বলে পেশাদারি চাল। কারখানার লোক স্তম্ভিত। টি. এস. ভট্টাচার্যের মতো শক্ত মানুষকে এত সহজে উপড়ে নেওয়া? সকলে কোমরের বেল্ট শক্ত করা শুরু করে দিল। টি. এস. ভটাচার্য কিন্তু মর্মে মর্মে টের পেলেন তাঁর পতনের কারণ। অনেক কষ্ট দিয়েছিল একসময় সে সুনীথকে। অপমান করা, প্রমোশন না দেওয়া। এখন মেনে নেয় সত্যিই সে অপমান করেছিল। স্বপনদাও বুঝতে পেরেছিল তার অতি চালাকির কথা। সুনীথের প্রাপ্য ঘর কেড়ে নিয়েছিল বেশী ভাড়া দিয়ে চালাকি করে।
সুব্রত একদিন ফোন করেছিল সুনীথকে – একদিন গিন্নীকে নিয়ে এসো। ছোট্ট জবাব দিয়েছিল, নিশ্চয়ই যাবো। ইচ্ছে থাকলেও কঠোর পেশাদারিত্বে সেটা করেনি। কারণ, পেশাদারি দর্শন বলে – নিজের দর বাড়াও। সহজে ধরা দিও না। নরম মাটি চলবে না। মানুষ শক্তেরই ভক্ত। বিশেষ বন্ধুরা বরুণ ঘোষ, অরিন্দম চৌধুরীরা সপরিবারে দেখা করে গেলেও সুনীথের যাওয়া হয়নি। অনিতা, অর্কর বড় ইচ্ছা ছিল আগেকার ফ্ল্যাটটা একবার ঘুরে দেখে আসে। কত স্মৃতির সাক্ষী সেই ফ্ল্যাট। বিশাল সুন্দর ফ্ল্যাট। তাতে বাথটব, গিজার, আউট হাউজ, গ্যারেজ সবই ছিল। ব্লাস্ট ফার্ণেসের মতো বাড়িতেও সারাক্ষণ জ্বলতো সরকারী চুল্লী। কারখানার থেকে তখন মাসে তিনশো কেজি করে কোক দেওয়া হতো বিনা পয়সায়। লোডশেডিং কখনও দেখেনি।
সুনীথের ফর্মুলায় কারখানা প্রথম বছরে Break-even- point-এ পৌঁছালো। পরের বছরে পনেরো কোটি মুনাফা। সকলের পে-স্কেল প্রায় দ্বিগুণ করা হলো।
আস্তে আস্তে সুনীথের ফিরে যাবার সময়, যাওয়ার দু’দিন আগে পেশাদারিত্বের মুখোশ খুলে প্রণবদাকে প্রণাম করে এসেছিল। সুব্রত ঘোষ, বরুণ ঘোষ, অরিন্দম চৌধুরী সবার বাড়ী বাড়ী গেয়ে দেখা করেছিল।
আর প্রণবদার বিশেষ অনুরোধে টি. এস. ভট্টাচার্য ও স্বপনদাকে পুনর্বহাল করে ফিরে গেল আমেরিকায়।
Add comment