সাহিত্যিকা

মন টানে ক্যান্টিনে

মন টানে ক্যান্টিনে
@ সুদীপ্ত চক্রবর্তী, স্থাপত্যের অপত্য ১৯৮২

নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না।
তাঁর সেই ঠোঁটটেপা দুষ্টুলাজুক মোহনহাসিটি একেবারে ঝকঝকাস ছবির মতন পয়পরিষ্কার মনপটে উজ্জ্বল, মায় তাঁর সেই খেঁটোগোটানো বিপজ্জনক লুঙ্গির সর্বদাই নীল জমিতে কালো চেকের মোটা দাগের দুই পাশের সরু সাদা দুই দাগ। এবং তাঁর বাধ্যতামূলক সব ঋতুতেই চোখ-সয়ে-যাওয়া আদুল গা, হাতের কালো কারে বাঁধা চৌকো তাবিজ, আর তার বার বার বার বার উশখুশ করে দরজার বাইরে গিয়ে পোড়াবিড়িতে আকুল বিফল টান।
নাকি নাম কখনো জানতেই চাইনি, জানতামই না।

মাননীয় সম্পাদক মশায়ের আদেশে এই লেখার প্রচেষ্টা শুরুর আগে আমার আগেপিছের বেশ কয়জন বিক্কলেজীকে শুধোলাম। নামটি কারোই মানসপটে প্রতিভাত নেই। তবে আশা বা জেদ ছাড়িনি, জেনেই ছাড়বো। তিনি ছিলেন, কী যে ছিলেন, ছিলেন কলেজ ক্যান্টিনের কর্মচারী। নাকি “ওয়েটার”, নাকি সেই অজানি দেশের নাজানি রান্নাঘরের রাঁধুনি? সে ধাঁধার জবাব খুঁজিই নি কোনোদিনো। আজ নামটা খুঁজছি।

তবে কি অন্যজনের নাম মনে আছে? না তাও নেই। তবু তাঁর একটা নাম ছিলো বটে, ম্যানেজার। আমি তো সর্বজনের সঙ্গে যথাসম্ভব ভাবসাব পাতিয়ে ফেলার নেশাখোর ছিলাম, তাও ভুলেছি ও দু’নাম, হা হতোস্মি! মনে আছে ম্যানেজারের খোঁচা দাড়ি নীল শার্ট ময়লা ধুতি আর ম্যাগ্‌নিফাইং গ্লাস পারা চশমাজোড়াও।

কথা হচ্ছে বিক্কলেজের পুরোনো ক্যান্টিন নিয়ে। সেই যে সেই ক্যান্টিন যার এক লম্বা দেয়াল ইন্সটিটিউট হলের পশ্চিম দেয়াল, এক খাটো দেয়াল জানাদার দোকানের ডান পাশের ছোট্টো ঘরটির দক্ষিণ দেয়াল, ঢোকার দরজার লম্বা দেয়াল আর আরেক খাটো দেয়াল আধফসলি গোলাপবাগানে। ভিতরে দিনে আঁধিয়ারা, রাতে ঝুলভরা বুকচাপা আধো আলো, রাতে মানে এমনকি সন্ধ্যের পরেও বেশির ভাগ দিনেই দরজা বন্ধ, আর কটি সরুপায়া চল্‌টা-ওঠা নড়ন্ত টেবিল আর রুজু রুজু কটি হেলানছাড়া বেঞ্চি।

ও ক্যান্টিনের কাহিনী অনেক।
সবার প্রথমেই বলা যাক, ওখানে কখনো কেনাকাটা খাওয়াদাওয়ার মত বাজে ব্যাপারের ধুম একেবারেই দেখিনি অন্তত আমাদের কালে। খাবারদাবার বানানো আনানো সাজিয়ে রাখার মত পাপ কম্মে কখনোই ওখানকার ম্যানেজারকে ব্যাপৃত হতে দেখা যায়নিকো। উনি এমনকি কথাও ব্যয় না করে শুধু মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিতেন যে কিছুই নেই। ডানদিকে এক প্রায়-পুরো-খালি কাঁচের বাস্‌কে গুটিচার হিমশীতল আঁকাবাঁকা বেক্কুরে শিঙ্গাড়া ছাড়া বা বেশির ভাগ সময়েই খালি বাস্‌কো ছাড়া অন্য কিছু দেখেছি বলে শত্তুরেও অপবাদ দিতে পারবেনা। এটাও পরিষ্কার মনে আছে, প্রথম প্রথম “অমুক জিনিস আছে?” তারপর “কী আছে?” ইত্যাদি অর্বাচীন প্রশ্ন করার পর যখন শিখে গেলাম, চা দিতে বলে অনায়াসে ঘন্টাদুই বসে গপ্পোগ্যাঁজা করে চা না পেয়েই না খেয়েই দিব্যি বেরিয়ে আসা যায়, তারপর থেকে ঢুকেই “চা দিন” কথাটি হাওয়ায় ভাসিয়ে সিধে টেবিল মুখো হতেম। হাল্‌কা বেগুণে রঙের তিন গজ কবোষ্ণ চা ক্কচিত কদাচিৎ ফাটা কাপে ঠকাঠক টেবিলে বসিয়ে যেতেন যেদিন ওই মধুরাস্য মানুষ, সে এক দুর্লভ কান্ড। এ সবি আমাদের কালের কাহিনী, জানিনা আমাদের আগেপিছে ও ক্যান্টিনে কদাপি দাপাদাপি করেছে কিনা কোনো ভব্য ভোজের ভান্ডার।

ওখানকার বেওসা মন্দার কারণ হিসেবে ভাবা যায়, ছেলেপুলেরা একেই আসতো টাকাপয়সার চাপওয়ালা বাড়ির থেকে, তারপর সকালে বিকেলের জলখাবার খেতো ফ্লোর ব্যারাকে, দুপুর আর রাতের খাওয়া বাঁধা ছিলো মেসে, কাজেই এমন কোনো খাদ্যাভাব বা খিদেরচাপ সেভাবে থাকতো না। শৌখীন খাওয়ার আর নেশাপন্থীদের প্রিয় আড়তগুলি ছিল দুই মূল গেটে। আর বিক্রি নেই বলে মাল নেই, মাল নেই বলে বিক্রি নেই, এই চক্রাকার আবর্তে পড়ে ওই ক্যান্টিন নামক স্থানটি বনেছিল কেনাবেচার ঝঞ্ঝাট-ঝামেলি থেকে মুক্ত এক অনায়াস খোলাবাজার, যেখানে প্রায় কখনোই ভীড়ের চাপেরও বালাই ছিলো নাকো। ওই স্যাঁতসেঁতে লম্বা হলের মধ্যে টেবিল-বেঞ্চির সংখ্যা কম ছিলো না, ফলে জায়গা পেতাম সদাই, তা একাই যাই আর দলেবলে।

তাহলে যেতাম কেন আর কখন?
যেতাম কখনো অসীম মূর্খতার বশে ভুল ফান্ডার পাকেচক্রে ক্লাস কেটে, ক্কচিত কোন ক্লাস ফাঁকা থাকলে, আর পরের দিকে অল্প কটি সুন্দরীর পিছনে লাইন দেয়া প্রচুর সংখ্যক নিষ্ফলের হতাশের দলে, বা মরিয়া হয়ে “আমরা ছেলেরাই নিজেরাই যথেষ্ট” এই না-বলা স্লোগানের আওতায়, আর শেষের দিকে কিমাশ্চর্যম দুয়েকটি দুর্লভ রমণীরত্নের আলোকিত প্রাদুর্ভাবের সাক্ষী থাকতে। এটা হলো ওই সাতেপাঁচে-না-থাকা আমাদের কথা। তারপরে পরের দিকটায় যখন রাজনীতিতে জোয়ার এলো, নানা দলের নানা মতের ছেলেরা এবং বেশ কিছু বিভিন্ন দলের সমর্থক মেয়েরা ক্যান্টিন গমগমে জমজমাট করে নানাবিধ তত্ব আর কৌশলের সোচ্চার আলোচনা বিশেষত সন্ধের দিকে করে চলতেন। আমরা ভেদো ছেলেরা ও সময়ে ওমুখো নৈব নৈব চ। আমরা বরং ছাগলের তৃতীয় সন্তানের মত বা বুরা ধান্দা ওয়ালা ভিলেনের মত সন্ধেটা লাভার্স লেন বৃথাই চষে বেড়াতাম। তবে আমাদের সদাই সন্দেহ, ছেলেদের ক্যান্টিনে হাজিরা দেয়াটায় সর্বদাই মেয়েদের একটা ভূমিকা থাকতো, যথা তাদের আদৌ না থাকা, তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা, তাদের অল্প সংখ্যায় কলেজে প্রাদুর্ভাব, জানালা দিয়ে সুদুর্লভ রাস্তাচলারূপিনীদের এক ঝলক দেখার আশা, তাদের অন্য টেবিলে দেখার আশা, তাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসার দুর্লভ সৌভাগ্যের আশা, রাজনীতি করে এক্টু সহজে আর রাজনীতি না করে একটু মুশকিলে তাদের কয়েকজনের সংগ পাওয়া, বা ছপ্পর ফেড়ে ভাগ্য বরষালে কোনো এক এককিনীর সাথে এক টেবিলে ক্কচিত বসা, অর্থাৎ মেয়েদের এক প্রচ্ছন্ন বা সরাসরি ভূমিকা ছিলোই, তাদের অভাব বা প্রাদুর্ভাব আমাদের ক্যান্টিনমুখীনতাকে প্রবল প্রভাবিত করত।

তাহলে করতামটা কী আমরা ক্যান্টিনে?
ছেলেজঙ্গল মেয়েমরুভূমি সেই আদি আমলে আমরা জানালা দিয়ে কড়া নজর রাখতাম, কোনো নওল কিশোরী জানাদার দোকানে আসতে বাধ্য হলেই লাফিয়ে অকারণেই ও দোকানে হানা দিতাম। বাকি সময়টা কাটাবার জন্যে ছিল তুমুল আড্ডা আর গায়ক থাকলে টেবিল বাজিয়ে বিপুল গানবাজনা। সে সব গানের মধ্যে ছিল কিছু অতুল্য অসাধারণ অনির্বচনীয় প্যারোডি যা যেকোনো বয়েসের যে কোনো রামগরুড়ের ছানার মুখেই গ্যারান্টি দিয়ে অন্তত মুচকি হাসি আনতে বাধ্য। কিন্তু বিক্কলেজী মানদন্ড অনুযায়ী যথারীতি সে সব মনভোলানো প্রাণমাতানো গানে ঝালমশল্লা বেশ চেপে ঠেসে দেয়ার কারণে, সেসব, সব পরিষ্কার কথাবার্তা সুরতাল-সহ মনে থাকা সত্বেও, আজ আর এ সুধীসমাজে ছেপে বার করার উপায় নেইকো। যাঁরা জানে, মুচকি হাসছে, যারা জানে না, জানে না কী হারাইলো। সেসব গানের মধ্যেও আবার দুই থাক ছিলো, এক হোলো ভেজ প্যারোডি যেগুলো গলা ছেড়ে ক্যান্টিনে গাওয়া যেত, আর হোলো নন-ভেজ প্যারোডি যেগুলো গভীর রাতের হোস্টেলেই গাওয়া হত। হস্টেলের আসরে সেসব গান গাওয়ার জন্যে তবলা হারমোনিয়াম আমদানি হয়েছিল, যে গভীর নিষ্ঠায় চোখ বুঁজে প্রাণ ঢেলে সেসব গাওয়া হত, আসল কবি গীতিকার সুরকারেরাও হয়ত সেলাম দিতেন হেসেকেঁদে। হায় সেসব উচ্চ সাহিত্যের ভান্ডার আজ কোথায়। তাও যদ্দুর পারা গেছে রাখা আছে। তখন ভিডিও দূরস্থান অডিও রেকর্ডও খুব কঠিন ছিলো, তবু কিছু ক্যাসেট আজো আছো যখের ধনের মত সঙ্গোপনে সযত্নে রাখা।
এর পর ছিলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কিছু কোরাস গান যা নানান বিখ্যাত গানের সুরে বসানো। উদাহরণ দেয়া যায় ক্যান্টিন-কাঁপানো সেই সব জনপ্রিয় গানেরঃ
“শোনো আমাদেরি গান, চাই না প্রতিদান, মোরা হাসিমুখে গান গেয়ে যাই
শুধু হাসি আর খুশী, এই নিয়ে বেশ আছি, স্মৃতিটুকু থাক এই শুধু চাই…”
এটা ছিল হিন্দি গানের বঙ্গীয়করণ – “উঠে সবকে কদম তা-রা রম পম পম আজ এ্যাইসে গীত গায়া করো”
বা
“যত বাচ্চু বাছারা, মায়ের আঁচল-ছাড়া,
কেউ বা ছাড়ে গন্ধ দুধের, কেউ তারো বাড়া…”
বা,
“এই মরশুম রঙ্গিন জামা, বাক্সে যতো আছে সবই নামা…”
(ये मौसम रंगीन समा ठहर ज़रा ओ जान-ए-जां
तेरा मेरा मेरा तेरा प्यार है तो फिर कैसा शरमाना
रुक तो मैं जाऊँ जान-ए-जां मुझको है इनकार कहाँ
तेरा मेरा मेरा तेरा प्यार सनम न बन जाए अफ़साना)
এই সব গানগুলি ছিলো আর্কির প্রোডাক্ট কিন্তু সবাই গাইতো সবাই রস নিতো।

চার-পাঁচ রকমের গান ক্যান্টিনে গাওয়া হত, প্রথমত ওই সব প্যারোডি, আমরা গোদা লেভেলের ছেলেরাই গাইতাম। পরের স্তরে মূলত “মান্না-কিস্যোর”, সঙ্গে “মুকেস” বা “জেসসুদাস”। একটু চাপা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব থাকতো, আর ওঁদের বিখ্যাত সব হিন্দি বাংলা গান দুইই গাওয়া হত। হিন্দি ভাষা তখনো নানা কায়দায় এমন জেঁকে বসেনি তাই হিন্দি গানে কথা বিভ্রাট ছিলো অনন্ত, এমনকি বাংলা গানেও ভুল এসে যেত। এক বিখ্যাত ক্যান্টিন-গায়ক তো হেমন্তের গানটি গাইতেন “খিড়কি থেকে সিন্ধুদুয়ার“ বলে, আমাদের কারোই মনে হয়নি ওটা ‘সিংহদুয়ার’ হবে। “চুনরি সা মালগাড়ি” “সাবুদানা ঝুলতা হ্যায়” ইত্যাদি কথা সহযোগে ওসব গান অনেকেই খুব ভালো গাইতো, আজও সেসব কানে লেগে আছে, আজো রিইউনিয়নে গাইতে বললে ঘ্যাষঘেষে ক্লান্ত চেরা গলায় তারা একই উদ্যমে সেসব গান শোনায়, এখন এই গোধূলি আভায় ভরা ঢলে-পড়া দিনে শুনতে যেন আরো মধুময় লাগে।

এর পর ছিলো একটু পরিশীলিত ছেলেদের গাওয়া কিছু গান, যেখানে আমরা মোটামুটি ভ্যাবলা দর্শকের ভূমিকায়, না পারি সঙ্গে চিল্লিয়ে গাইতে, না দেয় টেবিল বাজাতে। আর্কির অরুণেন্দু’দার (১৯৬১, অরুণেন্দু দাস, আর্কি) কালজয়ী অসাধারণ গান “কেন কাঁদি…” এই স্তরের গান, চুপ করে থম্‌ মেরে বিভোর হয়ে শোনার গান।

যেই না দেখা যেত কোনো সুদুর্লভ কোমল উপস্থিতি, না জেনে বা বাধ্য হয়ে বা খুব সাহসী হয়ে কোনো ললনা যদি এসে কোনো টেবিলে বসেছেন, ব্যস শুরু হয়ে যেত বিশুদ্ধ পবিত্র অনাবিল “রোবীনদ্রো” সোঙ্গীত। কিস্যোরকুমারে নিবেদিত গায়কপুঙ্গব তখন তার ষাঁড়কন্ঠে ওই সকালে রোবীনদ্রোনাথের “জাগরনে যায় বিভাবরী” বা ভর দুপুরে “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু” বা “আয় তবে সহচরী” এমনকি “পুরানো সেই দিনের কথা” গাইতে লেগে যেতেন। সুরুচির ভাপে ওই আঁধার ক্যান্টিন তখন ঝলমলিয়ে উঠত। তবে চিঁড়ে কোনোদিনো ভেজেনি।

আর মাঝেমধ্যে হত গণসংগীত। সেটা মোটামুটি ওই পার্টিঘেঁষা ছেলেমেয়েরাই গাইত। বেশিরভাগ সন্ধের পরই গাইত। দিব্যি গাইত, গমগমিয়ে ঝমঝমিয়ে। প্রাচীন দেয়াল কাঁপিয়ে, ঘরের ঘেরা ছাড়িয়ে, সে গানের ওজনদার উচ্চরোল তারাভরা আকাশের পানে উঠে যেত আর ছড়িয়ে যেত সব বনস্পতির ডালে ডালে লর্ডস ওভালের ঘাসে ঘাসে।

মাঝে মাঝে মনে হয়, হায় যদি সম্ভব হতো কোনো এক পুনর্মিলন উৎসবে ঘুমপাড়ানিয়া আলোচনা বাদ দিয়ে বিক্কলেজের সেরা সেরা পুরোনো গানগুলি ভালো করে বাজনাবাদ্যি দিয়ে গেয়ে শোনানো! কিন্তুনা, চারিদিকে থাকে খালি সব্বোগ্রাসী হোয়াটসএ্যাপের সব্বোনাশী কুটুর কুটুর কুটুর কুটুর কুট কুট কুট আর হুম হাম খানাপিনার বহর।

আহরণের বাতাবরণ
ধীরে ধীরে একটু থিতু হয়ে সেকেন্ড ইয়ারের দিকে গেলে, আবিষ্কার করা গেল ক্যান্টিনের সোনার খনি। দাদা দিদিরা ক্রমে অনুমতি দিল তাদের দলে একসাথে বসবার, আর আমার চিরকালই চেষ্টা থাকত নিজের ডিপার্টমেন্টের বাইরের সিনিয়ার আর জুনিয়ারদের সঙ্গেও সেতু বানানোর। সেই সব আড্ডার চক্রে পাওনা হয়েছিল অনেক সোনা হীরা মুক্তা। গরিবানা নিষ্প্রভ ওই লম্বা ঘরখানি আলো হয়ে উঠতো নানান অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন, ইচ্ছে আর সক্ষমতার আভায়। কতো কী যে পেয়েছি তা সব বলার জায়গা এখানে হবেনা। দেখলাম আমার চেয়ে গরীব বা না-গরীব গ্রামের ছেলেমেয়েদের হালচাল কথাবার্তা, তাদের গভীর সংস্কৃতি, আলাদা খাদ্যাভ্যাস, অন্যরকম জীবনচর্যা জীবনবোধ। আবার এক অহিন্দু ভায়ার অকল্পনীয় বিশদ পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান দেখলাম রামায়ণ মহাভারতে। দেখলাম আমার চেয়ে অনেক বড়োলোক ছেলেমেয়েদের সম্পূর্ণ অন্য ধরণের মনগঠন, উদারতা, ভদ্রতা, সবার সঙ্গে সমান ভাবে মেশার ক্ষমতা। দেখলাম ইংরেজী ইশকুলের ছেলেদের (বার বার ছেলেদের লিখে ফেলছি কারণ আমাদের জগতটা ছিল ছেলেময় এবং আমাদের ৮২ ব্যাচ মনেহয় একমাত্র আর্কি ব্যাচ যাতে কোনোই মেয়ে ছিল না) চোখা ইংরেজী কিভাবে তারা জনসমাজে গুটিয়ে নিয়ে খালি নিজেদের মধ্যে বলত। দেখেছি কুইজমাস্টার, ডিবেটার আর স্বপ্নিলচোখো দুচার কবিও।

ক্যান্টিনেই জানলাম কেউ স্টেট লেভেলের খেলোয়াড় কেউ সেতার শেখে কেউ বিখ্যাত লোকের পুত্র কেউ নামকরা কারো ভাই-ভাগ্নে ইত্যাদি। আবার কারো বাবা মাথায় করে ছেলের জন্য মুড়ির বস্তা আনে হস্টেলে। মানুষের বাড়ীতে যে টেলিফোন বা গাড়ি থাকতে পারে, কারো কাকা স্কুটার চালায় তাও যেমন জানলাম, বহু ছেলের বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই বাথরুম নেই তাও জানলাম এখানেই। নিজের আর্থসামাজিক অবস্থানের দুই দিকেই দুই বিপুল জগতের সন্ধান পাওয়া গেল, মনে হতে লাগল, ওই সব কিছু শিখে নিতে হবে গিলে নিতে হবে করে নিতে হবে পেরে যেতে হবে জেনে নিতে হবে। সব কি আর সম্ভব, তবু যা হয়েছে।

আজ মনে হয়, সবরকম পটভূমি থেকে উঠে আসা নানারঙ্গের ছেলেপুলেরা কি সুন্দরভাবে একাকার হয়ে নিজেদের জাহির না করে বা হীনমন্যতায় না ভুগে সবাই কেমন বিক্কলেজের সমান সন্তান হয়ে গেল, তা এক মধুর উপলব্ধি। ওই ক্যান্টিনেই দেখেছি মহা রসিক, হাড় কেপ্পন, উদ্ভূতুড়ে, পাগলাটে, প্রতিভাবান, সুপার পড়ুয়া, আস্ত ভেড়ুয়া, নেশাখোর, গায়ক, বাদক, খেলোয়াড়, দানবীর, চিরহোমসিক, স্যার-ত্যালানো, মনভোলানো, রাগী, মিনমিনে, ফুলবাবু, শীতকাবু, প্রেমিক, দেবদাস, আরো কতো কতো “টাইপ” চরিত্র। এক ছেলে দেখলাম এনসিসির রাইফেল ক্যাডেট, টেনিস আর ব্যাডমিন্টনের ওস্তাদ, সাঁতারে ডলফিন, তবলায় আল্লারাখা। কোনো অহংকার নেই। এক মেয়ে দেখলাম, রূপলাবণীর অরূপবাণী যেন, গুণে সরস্বতী মুখে সরস অতি। অল্প অহংকার রাখতে হয়েছিল তাকে, তা ছিল রক্ষাকবচ। কি তার চারুতা কি শীলন। প্রত্যেকে দাগ রেখে গেছে, প্রত্যেকে কিছু দিয়ে গেছে। হোস্টেল হোস্টেল ঘুরে তো আর এ সম্পদ জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। প্রায় ফোকোটেই এক বিশাল ঋদ্ধকারী এক্সপোজার একাধারে ওই ক্যান্টিনে। ওখানেই এত পেয়েছি, তাহলে কফি হাউসের আড্ডাধারীরা না জানি কী পেয়েছে।

ক্যান্টিনে পাওয়া ‘ডিপো’র দাদারা অনন্ত জ্ঞানের ভান্ডার, কোথায় সস্তায় রোট্রিং পেনের সেট কোথায় ট্রেসিং পেপার, ‘পল-টোন’ পেপার কী বস্তু, প্ল্যান এলিভেশান পারস্পেক্টিভের রেন্ডারিং কার থেকে শেখা উচিত, ভালো সরেস গাঁজা কোথায়, আখতার এর দোকানে ধারে বিড়ি পাবি, দেবুদা জ্যাম কিনলে একটা ব্লেড দেয় এইসব প্রাণবাঁচানো তথ্যমালা। জানলাম অনেকে আশেপাশে টিউশানি করে নিজের খরচ চালায়। জানলাম কারো-বা হাতখরচ আসে সেই জমানায় তিনশো টাকা। আবার নানান সিনিয়রের কাছে জানলাম শুনলাম পল রোবসনের আর ভূপেন হাজারিকার গান। জানলাম গীটার মানুষেই বাজায়, চেনা মানুষেই। তাজ্জব হলাম জেনে যে কেউ নাকি চারচাকা চালাতেও জানে। জেনে রাখা গেল মদ তাস তিনপাত্তি খৈনি গাঁজা নাকি অতীব উপাদেয় ব্যাপার। শুনলাম দানেশ শেখ লেন, বট্‌স আর হাওড়া গার্লসে ঠ্যাঙ্গানি খাওয়ার আর সফল হবার বিয়োগান্ত-মিলনান্ত কাহিনী। ক্যান্টিনেই পাঁচমিশেলী দলের লিপি বা মায়াপুরী যাবার চাঁদা তোলা হত। ক্যান্টিনেই স্বপ্ন দেখে আমাদের সিনে ক্লাব হোলো, নাম তার দিল ‘চিত্রাঙ্গিক’। জানাদার দোকান থেকে মালমশলা কিনে ওই ক্যান্টিনের টেবিলে ঝটপট বানিয়ে ফেলতাম ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ ‘রজনীগন্ধা’ ‘বাইসাইকেল থিফ’ এর পোস্টার।

খুব মনখারাপ লাগে, তখন তো আর হাতে হাতে মোবাইল এমনকি ক্যামেরাও ছিল না, নইলে কয়েকটা পোস্টার বানিয়েছিলাম মন্দ না লোকে বলেছিল। ভাবি দুখান পোস্টার আবার বানাই, তা কি আর হয়। অমল দত্ত এসেছিলেন তাঁর ফুটবল প্রেমের ডালি নিয়ে, তার পোস্টারও ক্যান্টিনেই বানানো হয়েছিল। আর হোত নানান রকম অবিশ্বাস্য বদমায়েশির প্ল্যানিং আর সব করে-ফেলা কেলেঙ্কারির বলিহারি রিপোর্ট। মুচি পাড়ার অঙ্ক-জাদুকর সায়েব পাড়ার খানদানি ফেলুয়াকে প্রাণপণে ক্যালকুলাস গেলাচ্ছে, তাও দেখেছি এই ক্যান্টিনে। নববয়েসে দুনিয়ার তিনশোষাট ডিগ্রী ভিউ ও ক্যান্টিনেই পেয়েছিনু, সে সব মহাভারত ভাগ্যে থাকলে ক্রমশ প্রকাশ্য।

প্রেমের উপক্রম
আগেই বলা হয়েছে, ক্যান্টিনটা ঠিক প্রেম করার জায়গা ছিলো না অন্তত আমাদের আমলে। ওই বড় দলের মধ্যে একটি-দুটি নারী, ওইরকম। তা একটিমাত্র ঘটনা বলা যাক, আমাদের এক দলে এক সুন্দরী মাঝে মাঝে বসতেন, আর সে দলের পাকা সদস্য ছিল এক, ধরা যাক নাম তার লেন্টু। সে ওই সুন্দরীকে তাক করেছিল। প্রেম তখন একেবারেই ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের জীবজগতের নিয়মে হত, অনেক পুরুষ, এক বা অল্প নারীর জন্যে লড়াই। তো সেই লেন্টু ওই ললনার জন্যে প্রায় ক্যান্টিননিবাসী হবার দশায় এসেছিল। আমরা বলতাম বেডটা এখেনেই নিয়ে আয়না। যাই হোক কিছুতেই একলা না পেয়ে পেয়ে না পেয়ে পেয়ে একদিন আমাদের পাঁচমিশেলি তুমুল আলোচনার মধ্যেই টেবিলের এধার থেকে ওধারে ঝুঁকে “গেন্টি আই লাভ ইউ” সজোরে বলে ফেলেছিল। হঠাত যেন টেবিলে টাইম থমকে গেল, সবাই থ, সবার চোখ গোল গোল। মনে পড়েছিল বিষ্ণু দে’র সেই মহান কবিতা “…একটি কথার দ্বিধা-থরোথরো চূড়ে / ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী // একটি নিমেষ দাঁড়ালো সরণী জুড়ে/ থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি …”। সে মেয়ে কিন্তু রাগে লাল লজ্জায় গোলাপী কিছুই হলো না, কারণ সে একদঙ্গল ছেলের সাথে ক্যান্টিনে বসার মতন সাহসী মেয়ে। ‘একটি নিমেষ’ কাটার পরেই সে শুধু বললো, “তোকে আমি ভাইয়ের মত দেখি।“ ব্যস আবার তুমুল ভাবে চালু আলোচনার খেই ধরে ফেলা হল। বলা দরকার, আখেরে সেই গেন্টি কিন্তু সেই লেন্টুকেই বিয়ে করে মহানন্দে আছে।

এই হল ক্যান্টিনের জাদু। আজ নাকি ক্যাম্পাসের নানান্‌ খানে বেশ কয়টি আধুনিক চকমকিলা ফুড জয়েন্ট রেস্ত্রঁ গজিয়েছে, কিন্তু আমাদের সেই ঝুঁঝকো আঁধার ঝুলে ফাটলে ভরা ম্যাসোনাইট বোর্ডের ঝোলাফোলা ফলস্‌ সিলিংওলা টলমলে টেবিল ঢরঢরে বেঞ্চি সাজানো ক্যান্টিন আমাদের স্মৃতির হীরা আমাদের গড়ে বেড়ে ওঠার বৃন্দাবন আর এই বার্ধক্যের রত্নাকর।

আজ আর থাক, যদিও কাহিনী অফুরান।
সব ইয়ারের সব ধরণের প্রাণীদের মিলনবিন্দু ওই মলিন ক্যান্টিন প্রোজ্জ্বল হয়েছিল অনেক মনের মিলনমেলায়, বিচিত্র সব স্যাম্পেলের জমায়েতে, মনের প্রসার গুণের প্রচার নানান দিকের আচারবিচার দিন দুনিয়ার হালচাল খোঁজ খবরে মালামাল ওই ‘ক্যান্টিনের ঠেক’-এ খাওয়াদাওয়াটা ছাড়া বাকি অনেক তৃপ্তির খোঁজ মিলেছিল। কে বেঁটে কে কালো কে রোগা আর কে বা রাজকুমারপানা, সেসব এক মুহূর্তের তরেও মনে আসেনি, যৌবনের জোশই রাজত্ব করেছে, মায়াচশমার চোখ আর কাঁচাসবুজ মন তার সমস্ত প্রীতিকামনা খবরতৃষা আর জ্ঞানবুভুক্ষা নিয়ে সবকিছুই শুষে নিয়েছে। ক্লাসে পাওয়া জ্ঞানের জীবনব্যাপী স্পন্দন, হোস্টেলে পাওয়া আমরণের বন্ধন আর ক্যান্টিনে পাওয়া দশ দিশার ইন্ধন, এতেই তো তৈরি আমরা বিক্কলেজীরা।

 

 

 

 

Sahityika Admin

12 comments

  • এক্কেরে হ্যাভক। কী লিখলি !
    আজ চান না করে ছেঁড়া চটি পরে কলেজ যেতে ইচ্ছে করছে।

  • আমি শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী। স্থান কাল পাত্র পাত্রী ভিন্ন, কিন্তু ইতিহাস একই। প্রেম, ব্যর্থ প্রেম, গ্যাস খাওয়ানো, হতাশা, লাইন করিয়ে দেবো এই প্রতিশ্রুতিতে জক মেরে চা সিগারেট, সব মিলে যাচ্ছে।

    • বেয়াড়া বিক্কলেজ থেকে শীলিত শান্তিনিকেতন – সবুজ মনের অবুঝ লীলা একই রকম, তা জেনে ভারি আমোদ হোল, নিশ্চিন্তিও লাগলো। অনেক ধন্যবাদ।

  • আমার গর্ব – থুড়ি আমাদের ব্যাচের গর্ব।
    সুদীপ্ত তো এমনই। সেই প্রথম দিন থেকে দেখে আসছি – ওর কথা, ওর লেখা, ওর রসিক মন, সকলের জন্য ওর অকাতরে বিলোনো প্রেম – এমন ‘ছেলে’কে ভাল না বেসে উপায় নেই। কেন জানিনা, রিটায়ার্ড বুড়োর হাত দিয়ে আজও “ছেলে” শব্দটিই বের হয়😊
    ওর লেখা তো ভালো লাগবেই। চোখ আটকে গেল, “পারা” শব্দের কি দারুণ প্রয়োগে।
    মনে পড়ে গেল – তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা—-
    – অরুণ ভট্টাচার্য, ‘৮২ ই ই

    • অযোগ্যের অযথা শংসা, কর্তার মহানতা। লেখার গুণ নেই, গুণ কুশীলবদের।

  • কি দুর্ধর্ষ লেখ।পুরো পিছিয়ে গেলাম ৪৬ বছর। পুনর্জীবিত হবার অপেক্ষায় রইলাম।জানিনা আর কবে ফিরে পাবো সেই দিনগুলো।reunion টা একমাত্র সম্বল। আহা রে,কি মধুর সেই হারানো দিনগুলো….

    • লেখা এমন কিছু নয়, আসল হোল বিচিত্র চরিত্রগুলো আর সেই চিরস্মরণীয় সময়পর্বটুকু, যা দিয়ে গিয়েছে জীবনভরের সুখপুঁজি। বারে বারেই ফিরে পাওয়া যাবে হৃদয়মন্থনে, স্মৃতিসিন্দুকে সে মোহররাশি অবিনশ্বর…………

  • কলেজ ক্যান্টিন মানেই অনেক ইতিহাস, সে বি ই কলেজ হোক, বা হাওড়া গার্লস। কত প্রেমের আশা নিরাশা, কত গায়কের গান গাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা, কতজনের look at me syndrome,
    সেই যা আমার নানা রঙের দিনগুলি

    • সবার প্রাণেই সেসব কাহিনী আধোঘুমে উজাগর………………