বিক্কলেজের কাসুন্দি
@ সৌমিত্র সিংহ, ১৯৮১ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আগে আপনাদের বি ই কলেজের অম্লানের ব্যাগের গল্প বলেছি, এবার আসি চশমার গল্পে ۔۔۔ ব্যাগের গল্পটা না পড়ে থাকলে মাননীয় পাঠকগণ পরে পড়ে নেবেন।
আমি কর্মসূত্রে বিদেশে থাকি, গতবার দেশে গেছি ۔۔ অম্লান USA থেকে ফোন করে খুব মিহি গলায় বললো, “তুই কি আমার একটা উপকার করতে পারবি?” আমি ততোধিক জোরালো ভাষায় বললাম, “কি করতে হবে?” আগে থেকেই ক্লিয়ার না হলে একটার কথা বলে পরে পাঁচটা উপকার চাইবে।
শুনলাম অম্লানের ভাগ্নে আমায় একটা থলি দিয়ে যাবে তাতে অম্লানের চশমা এবং মেয়ের জন্যে কেনা আরো কিছু জিনিস আছে – সেটা হুলোর কাছে পৌঁছে দিতে হবে। হুলো আছে ঢাকুরিয়া লেকের কাছের একটি হোটেলে, specifically দেশপ্রিয় পার্কের কাছে। আর আমি গড়িয়া থেকে এসে সেগুলি হুলোর হাতে সমর্পণ করবো। নিমরাজি হয়ে গেলাম, আমার গার্লফ্রেন্ডের জন্যে একটা শাড়ি কিনতে গড়িয়াহাট আসতেই হতো। শেষ অবধি অবশ্য হুলো ও তার গিন্নি এসে আমার বাড়ি থেকে চশমা নিয়ে গেলো, আমারও পরিশ্রম বাঁচলো।
মনে মনে খুশি হলাম অম্লান চশমা পেয়ে বৃদ্ধবয়সে নারীসঙ্গিনীদের অন্ততঃ ঠিকঠাক দেখতে পাবে, কানাকে অন্ততঃ ঝাপসা দেখবে না। হুলো সেই চশমা নিউ জার্সিতে নিয়ে আসবে। সেখানে অম্লান জুলাই মাসের বঙ্গ সম্মেলনে যখন আসবে তখন নিয়ে নেবে। ۔আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করলেন কি সুচারু সমন্বয়, চশমার আমেরিকা যেতে কোনো পয়সাই লাগবে না।
কিন্তু বাদ সাধলো হুলো। ও নিউ জার্সিতে চশমা এনেই হারিয়ে ফেললো ۔۔বাড়িতে রং হবে তাই ইধার কাল মাল উধার – চশমা গায়েব ۔۔শোনা যায় প্লেনে হুলো আর শমীর মধ্যে চশমা কোথায় রাখা হবে নিয়ে এতো মতবিরোধ হয়েছিল যে বাঙালী flight attendant ওদের পারিবারিক কলহ থামাতে দু’তিনবার চোখের ইশারা করেছিল। যাক সে কথা۔۔ আমি তখনও কলকাতায় আছি, আমাকে অম্লানের ফোন, তুই কি হোটেলে যেতে পারবি? হুলো ছস্মার ব্যাগ খুঁজে পাচ্ছে না। আমি আবার হোটেলের reception এ গিয়ে জিগেস করলাম একটা হলদে থলি পাওয়া গেছে? বেশ কড়া উত্তর এলো, না পাইনি কিছু, আপনার থলি আমরা রাখবোই বা কেন? পেলে জানতাম। বিনা কারণে ধুলিঝড়ের মতো থলিঝাড় খেয়ে চলে এলাম ۔۔۔
এর মধ্যে হুলো আবার দেশে গেলো, শ্বশুরবাড়িতে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও চশমা পাওয়া গেলো না ۔۔আসলে হলদে রঙের থলিটাই মিসিং।
বঙ্গ সম্মেলন চলে গেলো ۔۔তারপর হুলোর গিন্নি শমী একদিন মেয়ের ঘর থেকে সেই থলি উদ্ধার করলো। অম্লান, সিনহা ও হুলোর হুল্লোড় শুরু হয়ে গেলো, অম্লানের আরাধ্য থলি পাওয়া গেছে। হুলো আর কালবিলম্ব না করে সেই থলি সঙ্গে সঙ্গে অম্লানকে মেইল করে দিলো কিন্তু পোস্টাল চার্জ আর লজ্জায় চাইতে পারলো না। অম্লানও দেখলো থলিটার সাত সমুদ্র পেরিয়ে আসার পর পোস্টাল চার্জ দিতে হয় তাহলে থলির রাহাখরচে একটু চোনা পড়ে যায়। তাই হুলোর সামনে পওহারি বাবার মতোই মৌনী হয়ে রইল।
এতো কিছুই বললাম যখন শেষটা বলি আমার গার্লফ্রেন্ডের জন্য কেনা শাড়িটা আমার গিন্নি একবার দেখেই বাতিল করে দিলো ۔۔বললো আমায় বাজে শাড়ি দিয়ে এমন অভ্যেস করে ফেলেছো যে কমদামী শাড়ি গার্লফ্রেন্ডকেও দিচ্ছো?
মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো, কে জানে ভাল শাড়ি দিলে হয়তো উলটো বিপত্তি হতো।
*******
গল্পটা অনেকবার বলেছি, কলেজের গল্প, আপনারা হয়তো না শুনে থাকতে পারেন, তাই আবার বলছি।
একবার আমাদের পরীক্ষিৎ সাহা (ইলেক্ট্রিক্যাল) ১৩ নম্বর হস্টেলের বাথরুমে স্নান করতে গেছে। আপনারা হয়তো জানেন না বাথরুমে অনেকগুলোর দরজাই থাকতো না, তবে ওরটায় দরজা ছিল। সেখানে গামছাটা ঝুলিয়ে গান গাইতে গাইতে চান করছে।
ইতিমধ্যে কেউ এসে গামছাটা নিয়ে চলে গেছে। সাবান টাবান ধুয়ে যখন গা মুছতে গেলো তখন চক্ষু চড়কগাছ। গামছা নেই। অনেক চিৎকার, চেঁচামেচি করেও কিছু হলো না। যে গামছা নিয়ে গেছে সে কি আর গামছা ফেরত দেয়? তবে ভালো যে ওর ঘরেই রেখে দিয়েছে। পরীক্ষিৎ তখন জন্মপোশাকে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে গট গট করে ঘরে এসে ঢুকলো। আসার পথে কথ্য ভাষার ওপর কোনো আগল না রেখেই সারা করিডোর জুড়ে অনুরণন ফেলে গেলো।
আমাদের হুলো ব্যাপারটা নজরে রাখছিলো। যদিও ও গামছাটা সরায়নি। ও করলো কি, কলেজ গেলো আর মামীমাকে ধরলো, আর বললো তুই শুধু পরীক্ষিৎকে বলবি তোদের হোস্টেলের ৪ তলা থেকে দুপুর ১২ টা নাগাদ ওঁকে ১৩ নম্বর হোস্টেলের করিডোর দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছিস। হুলো আর কিছু ভাঙলো না। মামীমা ছিল আমাদের এক প্রমীলা সহপাঠিনী। খুব সরল মানুষ, জানেও না কিছু মাঝের ঘটনা। ও সটান গিয়ে পরীক্ষিৎকে সেই কথা বললো। পরীক্ষিৎও আতংকিত হয়ে জিগেস করলো কি দেখেছিস? কি দেখেছিস?
মামীমা হুলোর পরামর্শ মতো হাসি হাসি মুখে বললো তোকেই দেখেছি। আমার কিছুই ভুল হয়নি। বারান্দা দিয়ে তুই হেঁটে হেঁটে আসছিস। পরীক্ষিৎ ভাবলোও না এতদূর থেকে ওকে দেখা যাবে কিনা, আর দেখলেও চিনতে পারবে কিনা?
তারপর যে কি হলো সহজেই অনুমেয়। মামীমার T square টা ওভাল এর মাঝখানে ছুঁড়ে ফেলে দিলো, বেচারা জানলোই না কি ঘটেছে! পরীক্ষিৎ আগুন ঝরাতে ঝরাতে হোস্টেলে ফেরত এলো আর ব্যাকরণ বহির্ভূত ভাষার যা বন্যা ছোটালো তা শুনলে যে কোনো বস্তির ছেলেও ওকে তখন ঈর্ষা করতো।
******
কলেজ গল্পের অনেক ভাগ আছে। এটা হলো আমাদের কলেজের এক সিনিয়র দাদার গল্প। এই মুহূর্তে গল্পটা কে বলেছিলো মনে নেই বা দাদার নামটা কি ছিল? যাক বাহুল্য বর্জিত করে গল্পটাই বলি। বেশি কিছু লিখলে পাঠকরা ভাববেন সৌমিত্রর ধানাইপানাই বেশি, গল্প কম। হয়তো অলরেডি ভাবতে শুরু করেছেন ।
ঘটনাটায় আসি। সবার নিশ্চয়ই মনে আছে আমরা রাতের বেলা খাবারটা রাখতে বলে সিনেমা দেখতে যেতাম, তারপর ফেরত এসে খেতাম। সেটাই আমাদের রীতি ছিল।
একবার ওই দাদা ঐরকম রাতের শোতে সিনেমা দেখতে গেছে। যথারীতি বটঠাকুরকে খাবার রাখার কথা বলেই গিয়েছে। দাদা সিনেমার খুব রোমান্টিক সিন ও গুন্ডা দমনের সিন্ দেখে চার্জড হয়ে ফিরছে। এসে দেখে টেবিলে কোন খাবার নেই। তখন যে ব্যারাক সারভেন্ট ছিল, তাকে ডেকেছে। সে তখন পরের দিনের জন্যে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলো। সে তখন বললো আমি তো জানি না বাবু, বটঠাকুর যা রেখে গেছে। এই শুনে রাগে দাদার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেলো। অগ্নিশর্মা হয়ে বললো বটঠাকুরকে ডাক। ছেলেটি বললো বটঠাকুর তো বাড়ি চলে গেছে। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়লো। দাদা বললেন এক্ষুনি কোয়ার্টার থেকে ডেকে নিয়ে আয়। আমি খাইনি আর আমি বলার পর খাবার না রেখে চলে গেছে। সেই শুনে জুনিয়র ব্যারাক সার্ভেন্ট তো পাঁই পাঁই করে দৌড়ে গিয়ে বটঠাকুরকে ডেকে নিয়ে এলো। আসতে আসতে সংক্ষেপে বিপদের গুরুত্বটা বোঝালো।
যাক এসে পৌঁছনোর পর প্রশ্নোত্তর পালা। শেষমেশ জানা গেলো যে বটঠাকুর খাবার রাখতে ভুলে গেছে। তৎক্ষণাৎ ওই দাদা জুনিয়র ব্যারাক সারভেন্টকে বললো রান্না ঘর থেকে একটা বঁটি নিয়ে আয়। সে প্রাণের ভয়ে দৌড়ে গিয়ে একটা বঁটি নিয়ে এলো। বঁটিটা দাদার হাতে দিয়ে দুজনেই ঠক ঠক করে কাঁপছে। দাদা বটঠাকুর এর দিয়ে চেয়ে বললেন, লুঙ্গিটা খোল। বলতেই বাবা গো, মা গো বলে দুজনেই পাঁই পাঁই করে দৌড়। শোনা যায় ওই দাদা ওই হোস্টেলে যতদিন ছিলেন বটঠাকুর ওনাকে দুহাত জোড় করে প্রণাম করতো ۔۔۔۔আরো শোনা যায় রাতে কেউ সিনেমা দেখতে গেলে একটা বদলে দুটো প্লেট রাখতো যাতে আর প্রাণহানির বা অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গহানির চান্স না থাকে।
******
আমাদের কলেজ থেকে অনেকেই শান্তিনিকেতনে দোল খেলতে যেতো। সেটা নিশ্চয় অনেকেরই মনে আছে। কারণটা আর বলতে হবে না নিশ্চয়। তাও যাদের ন্যূনতম সন্দেহ আছে যে কেন যেতো তাদের পরিষ্কার করে বলি যে তারা ভবিষ্যৎ গৃহিণীর সন্ধানে যেত। কারো কারো উদ্দেশ্য খানিকটা খারাপ ছিল সেটা পাঠকরা জানেন তাই আর বুঝিয়ে বলছি না ।
১৯৭৯ সাল্ হবে সম্ভবতঃ। সেবার আমাদের বন্ধু আগুন গিয়েছিলো। আগুন রবীন্দ্রসংগীত এর খুব ভক্ত, তাই প্রতিবারই যেতো। তার সঙ্গে আমাদের ব্যাচের বেশ কয়েকজন যেতো। তেমনি দিনে অগ্নির সাথী হয়েছে আমাদের এই হোয়াটস্যাপ গ্রুপ এর এক বন্ধু। ওই দোলের বাজারে সে এক বান্ধবী জুটিয়েছে। এবং তাকে রং দেওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছে। কিন্তু মেয়েটি আমাদের বন্ধুটিকে খানিকটা পছন্দ করলেও রং দেয়াতে সঘন আপত্তি জানিয়েছে। একটা অচেনা ছেলেকে স্বাভাবিকভাবেই কেন তার গায়ে বা মুখে হাত দিতে সম্মতি দেবে?
আগুন সহ আরও কয়েকজন বন্ধু ওদের অনুসরণ করছে একটু দূরে থেকে, যদিও ওদের কথাও শোনা যাচ্ছে, আর মজাও নিচ্ছে। যাই হোক মেয়েটি শেষ অবধি বলে উঠেছে প্লিজ আমায় রং দেবেন না, আমার রঙে এলার্জি আছে। আমাদের নাছোড়বান্দা প্রিয় বন্ধুটির সংক্ষিপ্ত উত্তর আমারও তো মেটালারজি অর্থাৎ মেটালে এলার্জি আছে। মেয়েটি শুনে পুরো হাঁ। বলে কি? আর সঙ্গের বন্ধুরা অনুসরণ করবে কি, হেসে কুটিবাটি ۔۔۔۔
বন্ধুটির নামটা না হয় উহ্যই থাক।
******
আমার বেশ কয়েক বছর জুনিয়র একটা ছেলে – নাম সুমিত, এখন থাকে আমেরিকার কানসাসে। সে আবার আমার বৌয়ের বন্ধুর স্বামী। তাঁর মুখেই গল্পটা শোনা। সে তখন থার্ড ইয়ারে পড়ে। কিছু বন্ধু মিলে লাভার্স লেন এর কাছে বসে গল্প করছে। সময়টা একটু অদ্ভুত। প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। মশার কামড় খানিকটা অগ্রাহ্য করেই বসে গল্প করছে।
কাছেই ঘোড়ার আস্তাবল মতো একটা ছোট ঘর। সম্ভবতঃ ঘোড়ার খাবার জায়গা। গল্প করতে করতে হঠাৎ দেখে তিন চারটে সেকেন্ড ইয়ারের ছেলে এসে হাজির। সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেগুলো এঁদের দেখতে পায়নি। ওরা লক্ষ্য রাখছে ছেলেগুলো কি করছে, ওরা ঘোড়ার আস্তাবলের মধ্যে ঢুকলো। একটা আলো জ্বাললো যেটা খুব বেশি উজ্জ্বল নয়। ওরা বুঝতে পারছে না কি মতলবটা কি ওদের? ড্রাগ খাওয়া না মাল খাওয়া? এতো কষ্ট করেই বা খাবে কেন? হোস্টেলে বা বাইরে খেলে কে আটকাচ্ছে?
খানিকটা পরে ওদের অস্ফুট কথার মাধ্যমে বুঝতে পারলো যে ওরা র্যাগিং এর অঙ্গ হিসবে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের ভূতের ভয় পাওয়াতে চায়। ওরা করলো কি, ওই নিবু নিবু আলোতে একটা সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেকে দাঁড় করিয়ে রাখলো দেয়ালের দিকে মুখ করে। সে দেয়ালে দুটো হাত রেখে চোখ বুজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার ছায়াটা যাতে দেয়ালে বীভৎস ভাবে পড়ে ওঁরা সেভাবে
আলোটা রাখলো। এবার ছেলেটাকে রেখে সবাই চলে গেলো।
অমিতরা বুঝলো এবার এই সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেগুলো ফ্রেসারদের ডেকে এনে ভূতের ভয় দেখাবে। তখনই ওদের মাথায় এক দুর্বুদ্ধি খেললো। সুমিত বাকিদের বললো তোরা দাঁড়া, দেখ আমি কি করি। সুমিত খুব আস্তে আস্তে ছেলেটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ওই দাঁড়ানোতে ঘাসে যে শব্দ হলো তাতে সুমিত লক্ষ্য করলো ছেলেটা বেশ সিঁটিয়ে গেছে। সুমিত ঠিক ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বেশ বড়ো একটা নিঃস্বাস ফেললো। সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেটি চোখ বুজেই আছে। সুমিত বুঝতে পারছে ওর সাহস তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এবার সুমিত শেষ শয়তানিটা করলো। পেছন থেকে হালকা করে ওর হাতটা ছুঁলো। ছেলেটি পোকা ভেবে ফুঁ দিয়ে সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু আগেই সুমিত হাত সরিয়ে নিয়েছে। সুমিত পেছন থেকে দেখছে ও রীতিমতো কাঁপছে। এবার সুমিত আস্তে করে ওর হাতের ওপর হাতটা রাখলো কিন্তু এবার আর সরালো না। ছেলেটা আধো অন্ধকারে অমিতের হাতটা অনুভব করেই ‘বাবা গো’ বলেই উল্টোদিকে দৌড়। কিন্তু ওর দুর্ভাগ্য একটা গাছের গুঁড়িতে হোঁচট খেয়ে অজ্ঞান। গোঁ গোঁ করে আওয়াজ করছে। ওরাও ভয় পেয়ে তখন দৌড়ে গিয়ে জল এনে ছেটাচ্ছে।
এর মধ্যে সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেগুলো এক দঙ্গল ফ্রেসার নিয়ে হাজির। তারা বুঝতেই পারছে না ছেলেটা যাকে রেখে গেলো তার এই অবস্থা হলো কি করে? ফ্রেসার ছেলেরাও অবাক, ভূত দেখাবে বলে এনে এটা কি হচ্ছে? এবার থার্ড ইয়ারের ছেলেগুলো আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছে দেখে সটকে পড়লো ۔۔۔۔কেউই জানলো না ভূত দেখাতে এনে কি ঘটলো আসলে।
******
প্রেমের গল্পে আসি – আমাদের ইয়ার এর এক বন্ধু কলেজ পাস্ আগে থেকেই প্রেম করতো। আবার কলেজের মেয়ের সঙ্গে। আমার অবশ্য ওই বয়সে প্রেম করার সাহস হয়নি।
আমাদের সময় প্রেম করার জায়গার বেশ অভাব ছিল। সিনেমাতে গেলে টিকেট কাটার সময় বন্ধু বান্ধবরা হাত দিয়ে ইশারায় বলতো আমাদেরটাও কাট নইলে তোর বাড়িতে ফাঁস করে দেবো। পার্কে গেলে বা ভিক্টোরিয়া গেলে বাদামওয়ালা চাওয়ালারা জোর করে বিক্রি করবে তাদের সওদা। তাহলে কোথায় যাওয়া যায়? আমার সেই কলেজ বন্ধু ঠিক করলো কলেজের কাছে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে প্রেম করবে। কিন্তু এতো লোকের মাঝে প্রেম করা যায়? কখনোই না ۔۔তাই ঠিক করলো তৃতীয় শ্রেণীর ওয়েটিং রুমে গিয়ে প্রেম করবে। কিন্তু সেখানে গিয়েও দেখে ভয়ঙ্কর ভিড়, বসা তো দূরের কথা দাঁড়ানোরই জায়গা নেই। জায়গা খুঁজতে খুঁজতে হটাৎ একদিন আবিষ্কার করলো যে হাওড়া স্টেশনেরই দোতলায় প্রথম শ্রেণীর ওয়েটিং রুম আছে, কিন্তু বেশ ফাঁকা। প্রেমের আদর্শস্থল। তাই তাদের প্রেমের জায়গা স্থির হলো ওয়েটিং রুম।
সেখানে প্রেম চলছিল বেশ গড় গড়িয়ে। কিন্তু বিপদ বাঁধলো একদিন। সব ভালো জিনিসেরই খুঁত থাকে একটা না একটা। দুই মক্কেল এক বিকেলে প্রেমের জোয়ারে যখন মশগুল তখন বলা নেই কওয়া দুই রেলের পুলিশ উপস্থিত এক টিকেট চেকার সহ। যেন সাক্ষাৎ যমরাজ নন্দী ভৃঙ্গী সহ। আর দুটি পুলিশ দরজার কাছে, চেকার টিকেট চেক করছে যে বিশ্রামরত বা প্রেমরতো যাত্রীদের প্রথম শ্রেণীর টিকেট আছে কিনা?
নাঃ, তাদের তো কিছুই নেই, প্লাটফর্ম টিকেটও নেই। চেকার মশাই আরো অনেক মুরগির সঙ্গে এই দুজনকে রেলওয়ে পুলিশ অফিসে নিয়ে এলেন। অনেক অনুনয় বিনয়ে কোনো কাজই হলো না। ফাইন দেয়ার মতোও টাকা নেই। মানে, একদিনের জেল হাজত হবেই। তার ওপর দুজনেরই ফাইন। প্রায় কান্নাকাটি অবস্থা। জেলে থাকলে ছাড়াবে কে? বাবা মা তো জানতে পারবেই। টিকেট না কেটে জেল তার ওপর না বলে প্রেমের শাস্তি। সব জানাজানি, মহা ঝঞ্ঝাট। পাত্রী তো প্রায় কেঁদে ফেলে, পাত্র কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ফাইন হয়েছে ১৯৮১ সালের হিসেবে প্রায় ১৩৭ টাকা। কিন্তু দুজনের মিলে পকেটে আছে কুল্যে ২২ টাকা।
এবার পুলিশ তাহলে এই দুটো প্রাণীকে নিয়ে কি করবে? কিছু পয়সা নিয়ে বিদায় করতে চায়। এদের কাছে তো পয়সাও নেই, তাই বলে বিনা কারণে ছাড়া যায় না যখন জেনেছে এক নামকরা কলেজের এক সুপুত্র ও এক সুপুত্ৰী। শেষমেশ রফা হলো ওই ২২ টাকা, একটা হাত ঘড়ি ও গলার একটা সোনার চেন। ঠিক হলো পরদিন এসে টাকা দিয়ে সব ছাড়াবে। যাই হোক পুলিশ আইন মাফিক কাগজপত্র লিখে দিলো। পরদিন গুণাগার দিয়ে সেই পুত্রের ঘড়ি ও কন্যার চেন মুক্ত হলো। তাদেরকে সেই শিক্ষা এমন দিলো যে ট্রেন কোম্পানির আর তাদের টিকেট নিয়ে জীবনে ভাবতে হয়নি ۔۔۔۔
এই গল্পে অবশ্য একটা টুইস্ট আছে সেটা আগে বলিনি।
ঘটনাটা ঘটলো ১৯৮২ সালে, অর্থাৎ আমাদের পাস করার ঠিক এক বছর পর। আমাদের আরো দুই বন্ধু অম্লান ও প্রকাশ এর ওই প্রণয়ীযুগলের সঙ্গে কথা হয় যে পরদিন ওই একই জায়গায় চারজন দেখা সাক্ষাৎ করবে এবং কলেজ পরবর্তী ঘটনার আলাপচারীতা হবে।
পরদিন ওরা ওখানে গিয়ে দেখে ভোঁ ভাঁ অর্থাৎ কেউই নেই। খুব চোটে মোটে ওয়েটিং রুম থেকে বেরোচ্ছে। আবার সেই চেকার এর পাল্লায়। ফল হলো শ্রীঘর। সেদিনই প্রকাশের আবার এলয় স্টীল প্ল্যান্টের নাইটশিফট। ব্যস, প্রকাশের মুখ শুখিয়ে আমসি। চেকার সাহেব বলছেন টাকা দিয়ে বাড়ি যাও। অম্লান -প্রকাশের কাছেও এতো টাকা ছিল না। তখন উনি বললেন ঠিক আছে দুজনের ঘড়ি জমা দিয়ে যাও, কাল এসে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। ভদ্রলোক তখন স্বগতোক্তি করছেন যদিও বেশ জোরে জোরে – দিনকাল কি যে পড়লো কালকেও এক প্রণয়ীযুগলকে ধরেছিলাম তারাও ঘড়ি দিয়ে জামিন পেলো, আজ এসে টাকা দিয়ে ঘড়ি ও হার ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। কেন রে বাবা বৈধ টিকেট ছাড়া প্রথম শ্রেণীর ওয়েটিং রুম এ ঢোকা কেন? ততক্ষণে অম্লান ও প্রকাশের মাথায় বিদ্যুতের ঝিলিক ছড়িয়ে পড়েছে, কারণটা পরে বলছি।
প্রকাশের বাবা রেলওয়েতে কাজ করতেন। বাবার বদনাম হবে ভেবে সাহস করে বাবার নাম বলতেই পারছে না। বাবার নাম বললেই ওদেরকে ছেড়ে দিতো। অবস্থা বেগতিকের দিকে যাচ্ছে দেখে অম্লান বুঝলো আর উপায় নেই, পিতৃপরিচয় দিতেই হবে। তাতে যদি বাঁচা যায়। অম্লান কায়দা করে বললো যে বাবা যা কাজ করেন উনি জানলে তো বেজায় গন্ডগোল হয়ে যাবে। ওরা স্বাভাবিকভাবেই জিগেস করলো, বাবা কি করেন? অম্লান একটু কিন্তু কিন্তু করে বললো বাবা লিলুয়াতে পুলিশের এনফর্স ডিপার্টমেন্টের অফিসার। মন্ত্রের মতো কাজ হলো। ওরা সমস্বরে বলে উঠলো আরে আগে বলবে তো, যাও যাও বাড়ি যাও, আর এরকম করো না যেন পুলিশরাই ওদেরকে ধরে এনে মহাদোষ করে ফেলেছে। প্রকাশ তো ট্রেন ধরার তাড়ায় দৌড়োবে বলে ভাবছে তার আগেই অম্লান ও প্রকাশের আবার চোখাচুখি হলো, নিমেষে বুঝে গেলো কালকের প্রণয়ীযুগল কারা এবং আজ তারা অনুপস্থিত কেন? অর্থাৎ রেল পুলিশ কালকে কাদের ধরেছিল!
পরদিন তাদেরকে অর্থাৎ প্রণয়ীযুগলকে চেপে ধরতেই পুরো ঘটনার বিবরণ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো ۔۔ এই ঘটনার পাত্রপাত্রীর মধ্যে আমি নেই, তবে আমি এই ঘটনার বিবরণে খামতি রাখবো না সেটাই ঠিক করেছিলাম, তাই আজ নতুন করে শেষ অংশটা পাঠকগণের কাছে মেলে ধরলাম।
আবারও বলি এগুলো গল্প নয়, সবই সত্যি ঘটনা।
মাইরি
দারুণ হয়েছে , আর ফটোগুলো দুর্দান্ত
ফাইনাল ইয়ারে উলফে ছিলাম
সেই দিনগুলি আর ফিরে আসবে না রে, কত যে ইতিহাসে পিছনে ফেলে এসেছি।