সাহিত্যিকা

এক যোগ দুইয়ে তিন নম্বর মিক্সচার

এক যোগ দুইয়ে তিন নম্বর মিক্সচার
@ দীপক চক্রবর্তী, ১৯৭৬ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

সেইদিন সকাল থেকেই ঝাঁটা’র শরীর খারাপ। ঋতু পরিবর্তনের সময় এখন। ঠাণ্ডা গরমে সর্দ্দিকাশি হয়ে গেছে, সাথে গায়ে-হাতে-পা’য় ব্যাথা। আজ আর কলেজে যায় নি। সারাদিন বিছানায় শুয়েই ল্যাদ খেয়েছে। ও’র রুমমেটরা হচ্ছে ঢ্যাঙা, বোতল আর সমীরণ। রাতে ওঁদের সাথেই ডাইনিং হলে গিয়ে খেয়ে এসেছে। খাওয়ার পরেই ওঁর বুকটা ভারভার মত লাগছে। বোতলকে সেই কথা বলায় ও একটু সাহস দিয়ে বলল যে সকাল অবধি দেখে নিতে। তারপরেও যদি একই অবস্থা থাকে তাহলে কাল সকালেই কলেজের ইনফার্মারিতে নিয়ে যাবে।

কলেজের ছেলেদের এই নামকরণগুলো বড়ই অদ্ভূত। কে যে দেয়, আর কেনই যে দেয়, আর কি করেই বা হয়ে যায়, সেটা কেউই ঠিকঠাক বলতে পারে না। আর যাঁদের এই নামকরণগুলো হয়, পাঁচ বছর পর এবং তারপরে কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও তাঁদের পিতৃদত্ত নামটা তাঁরা ছাড়া বাকীরা কেউই আর মনে করতে পারে না।

তবে অনেকসময়ই এই নামকরণের মধ্যে নামদাতাদের বেশ একটা সৃজনশীল মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যেত। যেমন শ্যামল নামের অনেকগুলো ছেলে হঠাৎ করেই একটা ব্যাচে এসে গিয়েছিল। তখন স্পেসিফিক আইডেন্টিফিকেশনের জন্যই তাঁদের বাসস্থানের নামে তাঁদের সহজ নামকরণগুলো হয়েছিল, যেমন বম্বে, দিল্লি, বেলে ইত্যাদি। বেলের বাড়ী বেলেঘাটায় তাই সে বেলে, কেউ যেন না ভাবেন যে সেই শ্যামল বেলে মাছ খেতে ভালোবাসতো সেইজন্য এই নাম। আর হোস্টেলে তো ৩৬৫ দিনই পোনা মাছ হয়, অন্য মাছ সেখানে আসবেই বা কোথা থেকে। তবে সব থেকে আশ্চর্যজনক নাম পেয়েছিল লেডিজ হোস্টেলের সায়ন্তী ব্যানার্জী। তাঁর নামের ইংরেজি আদ্যাক্ষর এস এবং বি নিয়ে সে হয়েছিল এন্টিমনি।

ঝাঁটা যে কি কুক্ষণে হোস্টেলে প্রথম দিনই ঝাঁটা বের করে বিছানা ঝাঁট দিতে গিয়ে নিজের নামটা নিয়ে ফেলেছে, সেটা সে জেনেছিল সাতদিন পরে যখন ইস্ট উইং থেকে তাপস এসেছিল ওঁর কাছে ঝাঁটা চাইতে। ঝাঁটা’র সাথে করে তাপস ঝাঁটা’র পিতৃদত্ত নামটাও নিয়ে চলে গিয়েছিল। সেই ঝাঁটা’র মতন তাঁর পিতৃদত্ত নামটাও কলেজে থাকাকালীন পাঁচ বছরে আর ফেরত আসে নি। এমনকি কলেজ থেকে পাশ করে বেড়িয়ে যাওয়ার পরেও কলেজের বন্ধুবান্ধব, দাদা আর ভাইয়েরা ঝাঁটা নামেই তাঁকে এখনও ডেকে চলেছে।

ঢ্যাঙা’র নামটা স্বাভাবিকভাবেই হয়ে গেছে। প্রথম দিনেই, তাঁর ছয় ফুট দুই ইঞ্চি চেহারার জন্য। তবে এই কারণে সে যে খুব একটা মনঃক্ষুণ্ণ তা নয়। বরঞ্চ কলেজের বাস্কেটবল দলে সে তাঁর নিজের জায়গাটা স্থায়ী করার সাথে সাথে দলের অধিনায়ক হিসাবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আর বোতল! কলেজের ফ্রেশার্স ওয়েলকামের দিন মঞ্চে উঠে সেই সময়কার প্রচণ্ড হিট গান ‘বোতল হ্যায় বগল মেঁ’ গানটা নিজের সুরে গেয়ে, প্রচুর জনসমর্থন পেয়ে, নিজের নামকরণ সে নিজেই করে নিয়েছিল। অস্বস্তি বোধ করে তখন, যখন কলেজের জুনিয়ার ছেলেরা ওঁকে ‘বোতলদা’ বলে সম্বোধন করে।

পরের দিন ভোরবেলায় ঝাঁটা বোতলকে ডেকে তুলল। ওঁর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ওঁর রুমমেটরাও সকলেই উঠে পড়ল। আর একটু পরে কলেজে যেতে হবে। ঝাঁটাকে নিয়ে সবাই ইনফার্মারিতে গিয়ে জানতে পারল যে এই সময়টায় ডাক্তারবাবু, যাঁকে কলেজের ছেলেমেয়েরা ‘বুলডগ’ বলে ডাকে, তিনি কলেজের ওভাল মাঠে দৌড়াতে আসেন। ওঁরা সকলে মিলে ঝাঁটাকে সঙ্গে নিয়ে ওভালের দিকে রওয়ানা হ’ল।

চারিদিকে কুয়াশা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ওঁরা ঝাঁটাকে গ্যালারিতে বসিয়ে মাঠের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। কুয়াশায় দশ ফুটের বেশী দূরে দেখা যাচ্ছে না। তারই মধ্যে দেখা গেল বুলডগের মতন চেহারা’র একজন দৌড়িয়ে আসছেন। কাছে আসতে বোঝা গেল ডাক্তারবাবুই বটে। ওঁনার মুখটা অনেকটা বুলডগের মতন দেখতে বলেই ওঁনার এই নামকরণ। এছাড়াও ওঁনাকে নিয়ে অনেক গল্পও চালু আছে ছাত্রমহলে। একবার রিইউনিয়নের সময় অসীম যখন লর্ডস মাঠের ধারে কোনও একটা ঝোপে জলবিয়োগ করতে গিয়েছিল তখন ওঁর পায়ে সাপে কামড়েছিল। ছাত্রেরা যখন তাঁকে ধরাধরি করে ইনফার্মারির পাশে ওঁনার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল, তখন তিনি না কি সব শুনে “কি সর্বনাশ! সাপে কেটেছে! ডাক্তার ডাকো, ডাক্তার ডাকো” বলে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিলেন। যাঁরা অসীমকে নিয়ে গিয়েছিল এবং অসীম নিজেও তখন ডাক্তারবাবুকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়েছিল যে উনিই ডাক্তার। তারপরেই উনি চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। পরে জানা গিয়েছিল ওটা একটা নির্বিষ সাপ ছিল।

সে যাই হোক। ডাক্তারবাবু কাছাকাছি হ’তেই বোতল বলতে শুরু করল, “ডাক্তারবাবু গায়ে-হাতে-পায়ে ব্যাথা, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে”, ডাক্তারবাবু দৌড়াতে দৌড়াতেই জিজ্ঞাসা করলেন, “কবে থেকে?” বলেই দৌড়ে এগিয়ে গেলেন। ওঁনার সাথে দৌড়াতে গিয়ে বোতলের হাওয়াই চটি’র স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল। একচক্কর পাক খেয়ে ডাক্তারবাবু কাছে আসার আগেই বোতল তাঁর দুই হাতে দুই হাওয়াই চটি গলিয়ে নিয়ে দৌড় শুরু করে জানাল, “গতকাল থেকে”।
ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “জ্বর আছে?” বলেই এগিয়ে গেলেন।
বোতল ওঁনার দৌড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে ফিরে এল। এইরকমভাবে কয়েক পাক মারার পরে জানা গেল ঝাঁটাকে গরম জলে স্নান করতে হবে। আর ইনফার্মারি থেকে তিন নম্বর মিক্সচার নিয়ে গিয়ে দিনে তিনবার করে তিনদিন খাওয়াতে হবে, আর সাথে একটা করে ক্রোসিন, দিনে তিনবার। অবস্থার কোনও পরিবর্তন নাহ’লে ইনফার্মারিতে এনে রাখতে হবে অথবা বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে।

ঝাঁটাকে নিয়ে সমীরন আর ঢ্যাঙা হোস্টেলে চলে গেল, আর বোতল চলল ইনফার্মারিতে। সেখানে গিয়ে বিস্তারিতভাবে কিছু বলার আগেই নার্স জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন ইয়ার?” থার্ড ইয়ার জেনে আর কিছু না শুনেই ভিতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে দাগমারা কাগজ আটকানো একটা শিশিতে করে মিক্সচার আর ক্রোসিন ট্যাবলেট দিয়ে বললেন, “নিয়ে যাও। চিন্তার কিছু নেই”। তারপর নাম আর হোস্টেলের নাম জেনে নিয়ে রেজিস্টারে লিখে রাখলেন।

বোতল এর আগেও বেশ কয়েকবার ইনফার্মারিতে এসেছে, কিন্তু এই রঙের মিক্সচার ও দেখেনি। ওখানে ওষুধের তাকে পাঁচটা বড় বড় বোতলে পাঁচরকম রঙের মিক্সচার দেখেছে, সেখান থেকেই রোগীদের দেওয়া হয়, কিন্তু এই বিকট রঙটা ও দেখেনি। বোতল তাই জানতে চাইল মিক্সচারটার রঙ এইরকম কেন?

নার্স বোতলের দিকে তাকিয়ে একটু মিচ্‌কি হেসে জানাল যে ফার্স্ট ইয়ার থেকে ফিফ্‌থ ইয়ার অবধি পাঁচটা বোতলে মিক্সচার রাখা আছে ১, ২, ৩, ৪, ৫ নম্বর দিয়ে। যাঁর যখন অসুখ করে, সে যেই অসুখই হোক না কেন, রোগী যেই ইয়ারে পড়ে, সেই ইয়ারের বোতল থেকে ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু থার্ড ইয়ারের ৩ নম্বর বোতলের মিক্সচারটা শেষ হয়ে গেছে। তাই ফার্স্ট ইয়ার আর সেকেণ্ড ইয়ারের ১ আর ২ মিলিয়ে থার্ড ইয়ারের ৩ নম্বর মিক্সচারটা উনি বানিয়ে দিয়েছেন। তাই রঙটা ঐরকম লাগছে।

বোতল আর কথা না বাড়িয়ে ওষুধগুলো নিয়ে হোস্টেলের দিকে রওয়ানা দিল।

ঝাঁটা সেইদিন বিকালেই ক্রোসিন খেয়ে, ইন্টার ডিপার্টমেন্টাল ফুটবল ম্যাচ খেলেছিল আর দু’টো গোলও করেছিল। তবে মিক্সচারটা খাওয়ার সাহস হয় নি। ওঁদের হোস্টেলের সামনে কালু নামের যেই কুকুরটা রাত্রি বেলায় চেঁচামেচি করে, সেইদিন রাত্রেও চেঁচামেচি করায় ওঁরা সবাই মিলে ওকে ধরে পুরো মিক্সচারটা খাইয়ে দিয়েছিল।

তার পরেরদিন থেকে কালু আর রাত্রিবেলায় চেঁচামেচি করে নি।

Sahityika Admin

2 comments

  • বি ই কলেজ, হস্টেল, হাসপাতাল, পোষা কুকুর সব মিলিয়ে এক নরক গুলজার।