সাহিত্যিকা

বড়ই সুন্দর আজকের সকাল!

বড়ই সুন্দর আজকের সকাল!
স্মরজিৎ ব্যানার্জী, ১৯৭৪ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
(ভূমিকা – এটা আমার শরৎকালীন লেখা, কিন্তু সাহিত্যিকা ’৭৪ প্রাক্তনীদের বিশেষ সংখ্যার জন্য এটাই দিলাম।)

এবার পুজো কলকাতায় ফ্ল্যাটে থেকেই উপভোগ করবো, চিরন্তন সনাতনী সংস্কৃতির ধারক বাহক আর প্রাণের এই দুর্গাপূজা। তাই ভাবলাম এই প্রভাতী শিশিরভেজা মিষ্টি সকালে শিউলি ফুলের আগমনে ও প্রকৃতি লব্ধ কল্পনায় বাস্তব-সুপ্রভাত এক হাইরাইজ ফ্লাটের বারান্দায় বসে।

আজ রবিবার। বিছানা ত্যাগ করে ব্যাস্ত হবার কোন মানেই নেই। কিন্তু সকাল সকাল ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। শরতের নীল আকাশে পেঁজা তুলো ছড়িয়ে পড়েছে পুরো আকাশ জুড়ে। পুজো তো এসে গেল, মাঝে আর তো ক’টাই বা দিন। তারপর ঢাকের কাঠি পড়বে। একটু একটু শিশির পরছে সকালেই। সকালটা বড়ই সুন্দর- ভোরের অস্তমিত সুন্দরী চাঁদ তার ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে উদিয়মান সদ্যস্নাত সুর্যের রক্তিম শোভায় লজ্জাবনত। মনে কবিতার সুর –

সকালবেলায়, ঘুম ভেঙ্গে দেখি, আকাশ হয়েছে লাল।
সূর্যিমামা তখনও দেয়নি দেখা,
তবু, মেঘের কোলে রোদ হেসেছে,
শীতল হাওয়ায় উঠেছে হিল্লোল,
বৃক্ষ পাতার রস সঞ্চারে,
ফুল ফোটে ওই, তাহারই আঁধারে,
বলাকারা সব ডানা মেলে চলে,
তীর ভাঙ্গা ঢেউ নদীর জলে,
মল্লিকা চলে পদগরিমায় মধু অন্বেষনে ,
ফুলসম্ভার আনন্দে খুশী তাহারই গুনগুনে,
লজ্জাবতীর অবগুণ্ঠনে হে নবীন তপন,
এই বেশেই তুমি থাকো আরও ক্ষণকাল।

গতকাল এমনি কুমারটুলি গিয়েছিলাম, নেহাতই শখে। দেখে এলাম কিভাবে প্রতিমা শিল্পীরা মায়ের মূর্তিতে ফাইন্যাল টাচ দিচ্ছেন।

মৃদু মৃদু ঠান্ডা হাওয়ায় বারান্দায় বসে এক কাপ গরম চা ও তথসহ দুটি থিন এরারুট বিস্কুটে এক মনোরম উপভোগ। নীল আকাশের রঙটা একটু বেশিই নীল। সাদা মেঘের ভেলা তার বন্দনায় অবিন্যস্ত। সামনে বড় বড় অনেকগুলো ফ্লাট চারিদিক ঘিরে আছে। কিন্তু কোথাও সেইরকম কোন কর্মব্যস্তাতাই নজরে পড়ছে না। ১০ তলার আমার ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে দেখলাম সামনের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে পেপারওয়ালা ছেলেটা চলে গেল পেপার দিতে দিতে, সঠিক নিক্ষেপে নিপুন নিশানায়। কাজের মেয়েরা এক এক করে আসছে সিকিউরিটি গার্ডের অনুমতি নিয়ে। পাশের ফ্লাটের কাজের মেয়েটা ঐ তো দুর থেকে আসছে। গার্ড রাকেশ সিং মেন রোডের রাস্তাটা সকাল সকাল জল দিয়ে ধুয়ে লাইট গুলো নিভাতে নিভাতে চলে যাচ্ছে। দুধওয়ালা মন্ডল এসে গেছে সকাল বেলায়ই। বড় বড় ক্যানে দুধ নিয়ে তার মোটরসাইকেলে করে দুধ দিতে শুরু করবে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে। একটু গল্প রাকেশ সিং এর সাথে। প্রফেসার বিমল ঘোষের বড় ছেলেটাই তো মনে হচ্ছে! ও খুব ভালো স্পোর্টসম্যান, ভালো ফুটবল খেলে। শুনেছি ফুটবল খেলে অনেক প্রাইজও পেয়েছে। সকাল সকাল দৌড় প্র্যাকটিস করছে। আরে ঐ তো দুরে অমল, সুনীল, কাঞ্চন, রথীন, বাপ্পার বাবারা একসাথে এই সকালেই বেড়িয়েছে মর্নিং ওয়াক করতে।

কয়েকদিন আগেই বাপ্পার বাবা এসেছেন ছেলের কাছে থাকবেন বলে। খুব মিশুকে লোক, জমিয়ে গল্প করতে ভালোবাসেন। এর মধ্যেই উনি অনেক সমবয়স্ক বন্ধু পেয়ে গেছেন। বিকাল হলেই সবাই মিলে বসে যাবে সাজানো বাগানের কংক্রিট চেয়ারে বা মাটিতেই চলবে নানান বিষয়ে গল্প, আলোচনা, দাবা খেলা। প্রতিদিন নিয়ম মেনে।

রাস্তার দুপাশের বসার কংক্রিট টেবিলগুলো ফাঁকা, এখনো কেউ বসেনি। রাস্তার দুই পাশের সারিবদ্ধভাবে সোজা উঠে যাওয়া গাছগুলো যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে – সবুজ পাতায় ছেয়ে আছে ডালপালা মেলে। মেইন গেটের ঠিক পাশেই সাজানো পার্ক, সেখানের দোলনা, স্লিপ ও বাচ্চাদের আরো অনেক খেলার উপকরণ আছে। কিন্তু এখন সব সুনসান। একটু পরেই ঝাড়ুদার এসে পরিষ্কার করে যাবে। আজ রোববার জল দিয়ে ধুয়ে দেবে সলিড প্লাস্টিকের স্লিপ, দোলনা, মাকরসার জাল। বিকালবেলা কচি কাঁচাদের কলরবে মুখরিত হয়ে উঠবে কল কোলাহলে – মায়েরা ব্যাস্ত থাকবে ওদের নিয়ে গল্প গুজবে।

ঐ যে রতনবাবু সাইকেল চালিয়ে বাজারে বেড়োলেন – শুনেছি ভোরের সকালে বাজার করা উনার বহুদিনের অভ্যাস – আড্ডাবাজ ভালো লোক – চায়ের দোকানে বসে পেপার পড়ে চা খেয়ে দু ঘন্টা পরে ফিরবেন, আবার বেরোবেন না-কিনে আনা, ভুলে যাওয়া কিছু নিত্য ফরমাইসি প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য – উনার আসা যাওয়া পেন্ডুলাম ঘড়ির কাটার মত। এটি উনার বরাবরের অভ্যাস।

গতকাল রাতেই আমাদের প্যান্ডেলে প্রতিমা এসে গেছে। আর আজ সকালেই আমাদের মন্ডপে পুজোর ফাইন্যাল আয়োজন শুরু হয়ে গেছে – ডেকরেটার তার উপকরণ নিয়ে হাজির – শেষ টাচিং আপের কাজগুলো করছে। ধুতি আর নীল পাঞ্জাবী গায়ে চারজন ঢাকী বাজনা শুরু করে দিয়েছে। বিকালবেলা গাড়ি বারান্দায় আজ বিশেষ সভার আয়োজন করা হয়েছে পুজো উপলক্ষে। ডেকরেটার সেই নিয়ে ব্যাস্ত। সকাল সকাল চেয়ার টেবিল নিয়ে উপস্থিত।

পাশের বহুতল টাওয়ারের ১২ তলায় অমিয়বাবুর ফ্লাটের বারান্দায় সাজানো ফুলের টব গুলো খুবই সুন্দর লাগছে আজ – জবা ফুল ফুটেছে অনেক। আরো অনেক রকম ফুল ফুটেছে উনার সাজানো বারান্দার টবে। টবে ফুলের বাগান করা উনার অনেক দিনের অভ্যেস। উদিত সূর্যের আলোয় আলোকিত সদ্যফোটা ফুলগুলো শীতল বাতাসে বন্দিত কুর্নিশ “জবাকুশুমঃ সংকাশঃ কাস্বপেয়ঃ মহাদুতিমঃ, ধনতারিঃ সর্বপাপঘ্নঃ প্রনত্যস্মিঃ দিবাকরনমঃ”।

আমার ফ্ল্যাটের নীচের তলায় ডাঃ শীতল চক্রবর্তীর ছোট মেয়েটি খুব সুন্দর গান গায়। সকাল সকাল হারমোনিয়াম বাজিয়ে রেওয়াজের আওয়াজ আসছে, “চরন ধরিতে দিও গো আমারে, নিও না নিও না সরায়ে…………”। আমাদের এবার পূজোয় ও গান গাইবে, তারই প্রস্তুতি চলছে। কি চমৎকার গলা ওর। কতই বা বয়স, হয়তো ১১ কি ১২। চোখ বুজে ওর গান শুনতে ইচ্ছে করছে।
আরে চা’টা তো শেষ হয়ে গেল! যাই আরেক কাপ নিয়ে এসে এই বারান্দায় বসি – সদ্য ওঠা সূর্যের আলোয় বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে চা খেতে খেতে আরো

অনেক কিছু দেখার, উপলব্ধি করার আছে, ফিরে পাওয়া – ফেলে আসা আনন্দঘন অতীত।

বড়ই সুন্দর আজকের সকাল।

Sahityika Admin

1 comment

  • ভাল লাগলো তোমার লেখাটা পড়ে। কত ছোটখাটো অথচ সুন্দর ঘটনা আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যায়।