সাহিত্যিকা

পুরানো দিনের কথা

পুরানো দিনের কথা
**** শেষার্ধের কিছু অংশ সংগৃহীত

আমাদের ব্যাচের সকলেরই বয়স এখন চুয়াত্তরের আশেপাশে।
আমরা এই চুয়াত্তরীরা ছোটবেলায় যা যা দেখেছি, সেগুলি আজ অবলুপ্ত, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বুঝিয়ে বলা যাবে না, তাঁরা জানতেও আগ্রহী নয়। এ শুধুমাত্রই নিজেদের স্মৃতিচারণ। আমরা অধিকাংশই বাঙালী ঘরের থেকে এসেছি, তাই আমাদের সেই শৈশবের দিনগুলিও অনেকটাই একরকম ছিল।

প্রথমেই যদি বলি, আমাদের অক্ষরজ্ঞান।
বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজ পাঠ’ আমাদের প্রত্যেকের পাঠ্যপুস্তক হলেও ‘হাসিখুশি’র ছড়াগুলোই যেন সবথেকে বেশি মনের মাঝে জায়গা করে নিয়েছে। ‘বর্ণপরিচয়’-এর ভাষায় আছে গাম্ভীর্য, সেখানে ছবিতে ও ছড়ায় ‘হাসিখুশি’ সত্যিই যেন অন্যরকম।

অ-য়ে অজগর আসছে তেড়ে
আমটি আমি খাবো পেড়ে
ইঁদুরছানা ভয়ে মরে
ঈগল পাখি পাছে ধরে’

ঈশ্বরচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ যেমন শুধু ‘বর্ণপরিচয়’ বা ‘সহজ পাঠে’র জন্যেই পরিচিত নন তেমনই ‘হাসিখুশি’র স্রষ্টা যোগীন্দ্রনাথ সরকারও শিশুসাহিত্যের জন্যই পরিচিত। বইয়ের জগতের গম্ভীর আকাশে তিনি সরলতা প্রয়োগ করেছিলেন। আজও আমাদের অনেকে হাতের সামনে ‘হাসিখুশি’ পেলেই একবার পড়ে নিই। শিশুসাহিত্যে শুধু নয়, শিশুশিক্ষার প্রথম পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ‘হাসিখুশি’ আমাদের কাছে ছিল সবথেকে প্রাঞ্জল। এরসাথে তারপরেই মনে আসে সুখলতা রাও।

আরেকটু যখন বয়স বেড়ে গেলো, সবে স্কুলে ক্লাস থ্রি ফোরে পড়ছি, হাতে এলো প্রতি মাসের শুকতারা, বাঁটুল, হাঁদা ভোঁদা। প্রতিদিনের আনন্দবাজারে পেলাম অরন্যদেব, আর রিপ কার্বি। রবিবারে জাদুকর ম্যান্ড্রেক, লোথার, নার্দা। আর সোমবারের বিশেষ পাতা আনন্দমেলা।
আমাদের কতিপয় কিছু ভাগ্যবান ইতিমধ্যেই ঠাকুরমার ঝুলি, সুকুমার রায় পড়ে নিয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ রাহা সেইসময় বিশ্ব সিরিজের বইগুলি একে একে বাংলায় অনুবাদ করে যাচ্ছেন। সেই আমাদের প্রথম পরিচয় বহির্বিশ্বের শেক্সপীয়র, ডিকেন্স, ডুমা, টলস্টয়ের সাথে। তবে অবশ্যই চাই দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাসংখ্যার বই। মহালয়ার সময় বাজারে এলো নীহারিকা, বেনুবীনা, উত্তরায়ন, রামধনু, …… আমাদের পরিচয় হলো বগলামামা, অমরেশ মামা, পটলডাঙার টেনিদার সাথে। আরও আছে; লরেল হার্ডির হাসির এটম ব্যোম, শিবরাম চক্রবর্তীর হাসির টেক্কা, হাসির ফোয়ারা। ভুত পেত্নি’র গল্পও ছিল। পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়ের মাসিক সন্দেশ, বা কিশোর ভারতী ছিল, তবে মাসিক শুকতারাই ছিল সবথেকে বড় আকর্ষন।
ওদিকে পূজোর ষষ্টীর দিন থেকেই পাড়ার মাইকে বাজছে পূজা সংখ্যার নতুন নতুন এইচ এম ভি গান। নতুন নতুন নাম শুনছি আরতি মুখোপাধ্যায়, বনশ্রী, পিন্টু, …… আর কে এক মিন্টু দাশগুপ্ত এক একটা বাংলা আর হিন্দী গানের প্যারডি গাইছে। মাইকের হিন্দী গানের আদ্দেক কথাই বুঝিনা। ‘তু জহাঁ জহাঁ চলেগা, মেরা সায়া সাথ হোগা’। এ আবার কি কথা? আমার সায়া তোমার সাথে সাথে কেন যাবে? কি কনফিউশন!!
মাইকের গানের কথায় মনে এলো, ১৯৬১ সাল, মানে আমরা সবাই স্কুলের একদম নীচের দিকের ক্লাসে, বাজারে এলো Come September মিউজিক। সেই জমানায় কেউ এই মিউজিক শোনেনি, এ অসম্ভব। আজ ৬০ বছর বাদেও সেই সুর পুরনো হলো না।

এরপর ১৯৬২ সালে সবার মুখে মুখে তখন ইংরেজি হাটারি সিনেমা। তার সাথে বিখ্যাত মিউজিক Baby Elephant Walk. তবে ইংরেজি সিনেমা ছিল আমাদের নাগালের অনেক বাইরে। ছোটবেলায় আমাদের সিলেবাসে ছিল শুধুই বাংলা, মানে বাদশা, লালুভুলু, রামের সুমতি, বীরেশ্বর বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র, …
শাম্মী কাপুরের ইভনিং ইন প্যারিসের গান যেমন এখনও আমাদের কানে বাজে, তেমনি আজও ভুলতে পারলাম না লাল ঝুটি কাকাতুয়া ধরেছে যে বায়না… । ক্লাস টেন ইলেভেনে উঠে হয়তো কয়েকজন স্কুল কেটে সিনেমায় গেছে, কিন্তু সংখ্যা ছিল নগন্য।

নিজেদের কথায় ফিরে আসি। দু বছর পরপর পা বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই চাই নতুন জুতো, সেও কেনা হতো পূজার সময়। আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপন ছিল ‘পুজোয় চাই নতুন জুতো’।

এরপর পূজোর পরেই বাড়িতে এলো একগাদা পোস্টকার্ড, এনভেলাপ। আত্মীয়দের বিজয়ার প্রণাম জানিয়ে চিঠি লিখতে হবে। আমরা তো সবার ছোট, সুতরাং সব্বাইকে প্রণাম জানিয়ে সব চিঠিতেই বাঁধাধরা কয়েক লাইন, ‘তোমরা আমার বিজয়ার প্রণাম নিও”। তাঁর সাথে আরও দু’এক লাইন, ‘আমার পূজো খুব ভালো কেটেছে, দশটা প্রতিমা দেখেছি’, ইত্যাদি। তখন পূজো মানে প্রথমেই তিনটে নাম – পার্ক সার্কাস, কলেজ স্কোয়ার, আর দমকল। রমেশ পালের প্রতিমা দেখেছি কিনা, সেই আলোচনা। তারপর ক্লাস সিক্স সেভেনে উঠে আমাদের লিস্টে এলো নতুন নাম ফাটাকেষ্ট’র কালীপূজা। সেই প্রথম দেখা আলোর খেলা, জেনেছিলাম চন্দননগরে সব তৈরি হয়। আমাদের যারা চন্দননগর, শ্রীরামপুর, রিষড়া অঞ্চলের তাঁদের বাড়তি পাওনা ছিল সেখানের জগদ্ধাত্রী পূজা।

ক্লাস সিক্স সেভেনে উঠে এক একজন মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার হয়ে গেলাম। ক্লাসে দুইদলে ভাগ হয়ে তুমুল তর্ক – অসীম মৌলিক’কে কেউ আটকাতে পারবে না। থঙ্গরাজকে গোল দেওয়া কঠিন। আরও একটু বড় হয়ে জেনেছিলাম যে তখন ময়দানে তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম শক্তিও ছিল, কিন্তু সেইসব দিনে এই ক্লাবগুলোকে আমরা পাত্তাই দিই নি। মহমেডান স্পোর্টিং এর মুস্তাফা, আলতাফ, জন, লতিফ, রামানা, পাপ্পানা, সারমদ খাঁ, সাদাতুল্লা, বিমান লাহিড়ী। ওদিকে বিএনআর টিমে দীপক দাস, অরুণ ঘোষ, শান্ত মিত্র, এন্টনি এম্বরোজ, বলরাম, আপ্পালারাজু, ভারালু, রাজেন্দ্রমোহন। আর ইস্টার্ন রেলওয়ে টিমে সঞ্জীব বসু, কাজল মুখার্জি, পিকে, উদয়শংকর চৌধুরী, মীরকাশিম। আরও কয়েকজন ছিলেন, যেমন বালী প্রতিভার নীলেশ সরকার, হাওড়া ইউনিয়নের দুলাল মন্ডল, রাজস্থানের ফেন, এরিয়ান্সের অসীম বসু, এরকম অনেকেই।

১৯৬৪ মোহনবাগানের প্লাটিনাম জুবিলিতে হাঙ্গেরি থেকে এলো তাতাবানিয়া। ফ্রেন্ডলি ম্যাচ, তাই বেশি নাচালো না, আমাদেরকে কয়েক গোলে হারিয়ে চলে গেলো। এরপর ১৯৬৬ সালে লন্ডনে বসলো জুলে রিমে কাপের আসর। তখন রোজের আনন্দবাজারে প্রথমেই চলে যেতাম খেলার পাতায়। শুধু পেলে নামটা কানে এসেছিল। সেই পেলেকে কিছু লোক মেরে মাঠের বাইরে বার করে দিলো। কে একজন ইউসোবিও, কোনোদিন নামও শুনিনি, সে হ্যাটট্রিক করে পর্তুগালের হারা ম্যাচটা জিতিয়ে দিলো। পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে স্কুলে আমাদের মুখে মুখে তোতাপাখির মতন আরও কয়েকটি নাম – ববি মুর, চার্লটন, জর্জ বেস্ট, বেকেনবাওয়ার, মুল্যার, লুইগি রিভা। কে একজন লেভ ইয়াসিন নাকি উড়ন্ত পাখি। তখন টিভি ছিল না। খবরের কাগজ পড়ে সামান্য যেটুকু বুঝতাম (বা কিছুই হয়তো বুঝতাম না) সেগুলোই নিজের মতন কল্পনা করে নিতাম, আর সেই নিয়েই ক্লাসে তর্ক।

১৯৬৬ সালে ইস্টবেঙ্গলে এলো এক ঝাঁক নতুন প্লেয়ার – নইম, হাবিব, গুরুকৃপাল, শ্যাম থাপা, আফজল। বাংলাদেশ থেকে এলো বলাই দে। মোহনবাগান নিয়ে এলো পুঙ্গব কান্ননকে। তখনও আমাদের অধিকাংশই কলকাতা ময়দানের ঘাসই চোখে দেখিনি। সেই অতি সামান্য জ্ঞান নিয়েই পাড়ায় বা স্কুলে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যেতো। গুরুকৃপাল যা খেলবে না!!! দেখিস, … নেট ফাটিয়ে দেবে। অথচ গুরুকৃপালের সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না।
তখনের ময়দানে ছিল মিনি পত্রিকা ‘গ্যালারী’, ;স্টেডিয়াম’, ‘গড়ের মাঠ’, … লিখতেন মতি নন্দী, …… সব আজ হারিয়ে গেছে।
খবরের কাগজ কেটে প্লেয়ারদের ছবি জমাতাম।

স্কুলের ল্যাবে গিয়ে কি উত্তেজনা। মাইক্রোস্কোপ নামটা আগে শুনেছি, আর সেদিন সেই প্রথম চোখে লাগিয়ে দেখছি। কি দেখছি জানি না। স্যার বা দিদিমনি বলে দিচ্ছেন, যেটা বড় দেখছি, সেটা আসলে খুবই ছোট। আমার দেখার আর শেষ হয় না, এদিকে পিছনে লাইনে তখন অনেকেই দাঁড়িয়ে।
ক্লাসে আরও একটা ব্যাপারে রেষারেষি ছিলো, কে মনিটর হবে?
পরীক্ষার সময় পাশে সিনিয়র দাদা থাকলে ভরসা হতো, যে প্রশ্নে আটকে যাবো, সে নিশ্চয়ই উত্তরটা বলে দেবে। পরে অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে, আমিও যেমন জানিনা, সেও জানেনা। আর ঘন্টা বেজে গেলে, “স্যার, দু মিনিট প্লিজ……… দু মিনিট।“ বলছি দু মিনিট, কিন্তু চাই পাঁচ মিনিট।

ইতিমধ্যে ১৯৬৬ সালে, মানে আমরা তখন ক্লাস নাইনে। রিতা ফারিয়া বিশ্বসুন্দরী হয়ে গেলেন। কে রিতা ফারিয়া? বিশ্বসুন্দরী মানে কি? কিছুই জানি না। তবু আমাদের কি আলোচনা সেই নিয়েই!!! বাড়িতে গিয়ে যে এই বিষয়ে বাবা মা’ কে প্রশ্ন করবো, সেই সাহসই ছিল না। তবুও আমাদের আলোচনা চলতো।
সেইসময় সিনেমার পোস্টারে সবার আগে নজর চলে যেতো হেলেনের দিকে। সেই কৈশোরের দিনগুলোতে হেলেন মানেই ধমনীতে এক শীতল স্রোত………

আরও একটি উত্তেজনা, স্কুলের লাস্ট বেঞ্চে বসে লুকিয়ে স্বপনকুমার। স্যার কি পড়িয়ে যাচ্ছেন সে খেয়াল নেই। আমরা স্বপনকুমার পড়েই চলেছি। অদৃশ্য সংকেত, দুরাত্মার ছল, ভ্রান্তপথের শেষে, চলন্তছায়া, ……… স্যারের ক্লাস শেষ, আমাদের পড়াও শেষ। তখনও বাজারে ফেলুদা অতটা আসেনি। আমাদের মন কেড়ে নিয়েছে দীপক চ্যাটার্জি, আর কিছুটা কিরিটী রায়। স্কুলের একটু উঁচু ক্লাসে গিয়ে ব্যোমকেশের সাথে পরিচয় হলো।
আর বাড়িতে নবকল্লোল এলে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করতাম।
পাশাপাশি হেমেন্দ্র কুমার রায়ের দেড়শ’ খোকার কান্ড, আবার যকের ধন, সূর্যনগরীর গুপ্তধন, জয়ন্তের কীর্তি, মেঘদূতের মর্ত্যে আগমন, ……… তবে সেগুলি লুকিয়ে পড়তে হতো না।
আরও ছিলো, ময়ূখ চৌধুরীর রোমাঞ্চকর এডভেঞ্চার কমিকস।

আমাদের বাবা মা’রা অত সহজে আমাদের হাতে পয়সা দিতেন না। তবুও কোনরকমে দু’পয়সা বাঁচিয়ে স্কুলের টিফিন টাইমে গেটের বাইরে গিয়ে খেতাম ঘুগনি, ছোলামটর। খাওয়ার আগেই জিভে জল চলে এলো।

পরীক্ষা শেষ।

শীতকালে ডিসেম্বরের শেষের দিকে পাড়ায় পাড়ায় চলত সারারাতব্যাপী জলসা। অরিজিনাল গায়ক গায়িকাদের সাথে ডুপ্লিকেট শিল্পীরাও যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। লতা মঙ্গেশকরকে আনার ক্ষমতা নেই তাই  কৃষ্ণা রায়, চন্দ্রানী মুখার্জী, …… রফি সাহেবের জায়গায় পি রাজ, আর কিশোরকুমারের বদলে অমৃক সিং অরোরা, বা মাস্টার তিলক।  তবে যত বড় বা নামী গায়ক গায়িকাই হোক, অন্যতম আকর্ষন ছিল অর্কেস্ট্রা, আর সবথেকে বড় কয়েকটি নাম ছিল ভি বালসারা, হিমাংশু বিশ্বাস, বটুক নন্দী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ……
শীতকালের আরও একটি আকর্ষন ছিল সার্কাস।
আর ছিল পাড়ায় পাড়ায় রাস্তার উপর ইটের উইকেট দিয়ে ক্রিকেট ম্যাচ। হয়তো বা ফুটবল টুর্নামেন্ট।

এরপর তো বিই কলেজে এলাম, জীবনের সংজ্ঞাটাই বদলে গেলো।
তবে একটি কথা, আমরা বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন নামী অনামী স্কুল থেকে এসেছিলাম। আমাদের মাস্টারমশাইরা ছিলেন অতি সাধারণ। কিন্তু বহু যত্নে (এবং বেত্রাঘাতসহ) আমাদের যা শিখিয়েছিলেন, সেটাই আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার ভিত গড়ে দিয়েছিল। সেইসব মাস্টারমশাইদের আমরা কেউই ভুলতে পারবো না।

আজ কলকাতার বা মফস্বলের কত জায়গায় যাই, সব যেন কেমন হারিয়ে গেলো। টিনের বাক্সের প্যারী কোম্পানির টফি, জয়নগরের মোয়া, বর্ধমানের সীতাভোগ মিহিদানা, …… এমনকি গাঙ্গুরাম, ভীম নাগের সন্দেশ, এগুলিও আজকের প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে পারলো না।

*******

আরও কিছু আছে, যা দেখতাম, বিস্ময়ে মজা পেতাম, সেগুলিও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলো।

প্রথম: বিলুপ্ত…!!!

“অ্যাই ঘুঁটেএএএএ, … ঘুঁটিয়া ..
বিকেল তিনটের পর বিহারী ঘুঁটেওয়ালা, আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায়, টেনে টেনে হাঁক দিয়ে যেত। আমার বয়স তখন কত হবে? বড় জোর সাত আট। স্কুল থেকে ফিরে সবে খেয়েদেয়ে মাঠে খেলতে যাব বলে তৈরি হচ্ছি। মা আটকে দিতেন। ঘুঁটেওয়ালা গুনে গুনে ঘুঁটে দেবে, তা গুনে নিতে হবে। অবশ্য গুনতি দেখতে ভালই লাগত আমার। প্রতিবারে চারটি করে ঘুঁটে গুনত সে। শুরু করত ‘রাম’ দিয়ে। অর্থাৎ এক- দুই না বলে বলত, “রাম- দো-তিন ….।”
পরীক্ষার ইনভিজিলেটরের মত চোখ খুলে বসে থাকতাম সামনে।

তখনকার দিনে সব বাঙালি গৃহস্থ বাড়িতেই জ্বালানি বলতে কয়লা-ঘুঁটে- কেরোসিন। গ্যাসের চলন ছিলনা তেমন। বাঙলায় বসবাসকারী বহু বিহারী মানুষের সংসার চলে যেত গোমাতার পেছন পেছন ঘুরে আর ‘রাম-দো-তিন’ গুনে।

কখনও আসত কাঁসারি। নবদ্বীপের কাঁসার বাসন, বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করত। কাঁসারি থাকত সামনে। আর মালগাড়ির কন্টেইনারের মত পেছন পেছন চলত এক মুটে, মাথায় তার বিশাল ঝাঁকা। ঝাঁকা বোঝাই থাকত থালা-বাটি-গামলা-গেলাস। সবই কাঁসার তৈরি।

তবে আমায় সবচেয়ে আকর্ষণ করত কাঁসারির একহাতে কাঁসার বাটি বাজানো। বাটি বাজানোটাই ছিল কাঁসারীদের ‘সিগনেচার টিউন’। মোটামুটি ৬” ব্যাসের, নীচু কাদের একটা কাঁসার বাটি। আর একটা একটু ছোট শক্ত কাঠি। ট্যাং-ট্যাট্যাং। দিব্যি একহাতে, ধাতব ধ্বনিতে, দুপুরের নীরবতা মুখরিত করে দিতে দিতে চলত বাসন বিক্রেতা। ওর বাটি পেটানো আমাকে এত টানতো যে আমি নিজে বাড়ির একটা বাটি নিয়ে, ছোট একটা লাঠি দিয়ে কত বাজানোর চেষ্টা করতাম। হ্যাঁ, আওয়াজ একটা হত ঠিকই। সেটা-বাটিটার মাটিতে পড়ার শব্দ।
মার্মোওয়ের আর স্টীলের যৌথ আক্রমণে কবেই বিদায় নিয়েছে কাঁসারি। শোনা যায় না আর তার ট্যাং-ট্যাট্যাং-ট্যাং।

বই বিক্রি? তা-ও বাড়িতে ঘুরে ঘুরে?
নব্বুইয়ের দশক বা তার পরে যারা জন্মেছেন, তারা আশ্চর্য হবেন এ-কথা শুনে। বই বিক্রেতার বাঁধা গৎ ছিল:
“লক্ষ্মীর পাঁচালী পাবেন,
শনিদেবের পাঁচালী পাবেন,
মেয়েদের ব্রতকথা পাবেন,
ভাল ভাল গল্পের বই পাবেন…. ”
আজকাল কেউ গল্পের বই পড়েনা। স্কুল-কলেজের পাঠ্য বই বাদ দিলে বাঙালির সঙ্গী হল মুঠোফোন আর বোকাবাক্স। তাই দুপুররোদে ঘাম ঝরাতে বই-বিক্রেতারা আর আসেনা ।
সেই সুরেলা গৎ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে যা আর ফিরবে না।

সবচেয়ে সুরেলা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হাঁক দিত শাঁখারীরা। ওদের হাতে থাকত ছোট একটা টিন বা কাঠের বাক্স। তাতে সারি সারি সাজানো থাকত শাঁখা-পলা। বাড়ি বাড়ি ঘুরে, সধবা গৃহিণীদের হাতে, পরম যত্নে পরিয়ে দিত শাঁখাপলা। শাঁখারীদের আর থাকত শাঁখার আংটি। এই আংটি ছেলেরাই বেশি পরত। কিন্তু ফ্যাশন হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ শাঁখার আংটিগুলোর দাম ছিল বেশি, আয়ু ছিল কম।
সেই বিগত দিনের ছবি এখন ইন্টারনেটেও পাওয়া মুস্কিল

বৃষ্টির দিনে দলবেঁধে রাস্তায় নেমে ভেজা।

শাঁখারীর হাঁকের পাল্লা দিতে পারত শিলকাটাইওয়ালা। কতরকম সুর যে ছিল ওদের গলায়!
যখন আমাদের বাড়িতে শিল-নোড়া কাটাতে আসত, কাটাইওয়ালার পাশে বসে তন্ময় হয়ে দেখতাম, ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে শিলের গায়ে ফুটে উঠছে মাছ, ফুল বা কোন নকশার অবয়ব। আজকাল শিলকাটাইওয়ালারা বিদায় নিয়েছে। কেননা, মিক্সার-গ্রাইন্ডার এসে গেছে শিলনোড়ার বদলে।

সাঁপুড়ের বাঁশী শুনলে কি আর ঘরে থাকা যায়। বিশেষত গরমের ছুটির সময়, এই সাঁপুড়েরা আসত। কাঁধে থাকত কম্বলের মত কাপড় দিয়ে তৈরি ঢাউস একখানা ঝোলা। তার ভেতরে গোল গোল, মাটিলেপা, বেতের বাক্স। বাক্সগুলোর ভেতরে থাকত যত রহস্য। কোনদিন অবশ্য নিজের পয়সা খরচ করে দেখতে হয়নি সাপ খেলা। কোন এক ‘সহৃদয়’ কাকু জুটে যেতই, যার উৎসাহে ও খরচায় সাঁপুড়ে তার ঝোলা খুলত। একে একে বেরোতো সাপ। সাঁপুড়ে তার বাঁশী বাজাত, আর তার ডানহাত মুঠো করে দোলাতো। সাথে সাথে সামনে, ফণা তুলে দুলত নানা ধরনের সাপেরা। উপরি পাওনা হিসেবে ছিল, সাঁপুড়ের আবোলতাবোল সর্পবিষয়ক তথ্যের ধারাবিবরণী। প্রত্যেকবারেই ছোটখাট একটা ভিড় জমে উঠত।

ডমরুর শব্দ শুনলেই বুঝে যেতাম নয় একজোড়া বাঁদর, আর নয়তো একটি মুখবাঁধা ভালুক হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে একটি লোক। বাকিটুকু ওই সাপখেলার মতনই।

পুরোহিত মন্দিরে যেরকম ঘন্টা বাজিয়ে আরতি করেন, সেই ধরণের ঘন্টা বাজাতে বাজাতে আসত এক বিশেষ দ্রব্যের বিক্রেতা। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন- ‘বুড়ির চুল’। গোলাপি বা সাদা রঙের। মিষ্টি খেতে, জিভে লাগালে ঠাণ্ডা, মুহূর্তে ভ্যানিশ!

ছুরিকাঁচির শান দেওয়ার খুব চল ছিল আগেকার দিনে। আমার মা খুব সেলাইটেলাই করতেন। তাঁর একটা খুব সুন্দর সাইজের কাঁচি ছিল। কাঁচির গায়ে খুব ছোট্ট করে খোদাই করা ছিল ‘মেড ইন ইটালি’। মাঝেমাঝে শানওয়ালা ডেকে, মা শান দেওয়াতেন কাঁচিটিতে।
শানওয়ালার যন্ত্রটা আমার মনে হত অনেকটা ওল্টানো সাইকেল রিক্সা। একটা ছোট চাকা পেডল করে ঘোরানো হত, আর তার সাথে একটা বড় চাকা ঘুরত। ওই বড় চাকাটার সাথে জোড়া থাকত শান দেওয়ার গোল পাথরটা। যখন শান দেওয়া হত, আগুনের ফুলকি ছিটকে ছিটকে বেরোতো। শানওয়ালারা খুব তারিফ করত আমার মায়ের কাঁচিটার। বলত ‘বহুত বঢ়িয়াঁ ইস্টিল’। শুনে বেশ একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করতাম।

আজকাল সেলাই ফোঁড়াইয়ের চল উঠে গেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে। কাঁচি হয়তো একটা পাওয়া যাবে খুঁজলে, তবে তা চীন বা তাইওয়ানে প্রস্তুত – ‘ব্যবহার কর, বিতাড়ন কর’। স্মৃতি বয়ে বেড়ানোর দায় নেই।

সেই চেনা হাঁকগুলো, চেনা দিনগুলো আমাদের শহুরে জীবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে…!!!

সত্যি, স্মৃতি বয়ে বেড়ানোয় লাভ কী? তবু, ‘জীবন’ নামক উপন্যাসের শেষ অধ্যায়টা যত এগিয়ে আসতে থাকে, ততই পড়ে ফেলা পৃষ্ঠাগুলো যেন আরেকবার উল্টে দেখতে ইচ্ছে করে। ফেলে আসা ছোট্টতুচ্ছ অভিজ্ঞতাগুলো কেমন বিশাল গুরুত্ব নিয়ে আসে।

তখন তত্ত্ব-তথ্য-নীতিকথা ভাল লাগেনা আর। মন ছুটে চলে সেই শিশু বা কিশোরটি হয়ে। যে ব্যস্ত, শহরে আসা নতুন সার্কাসের সস্তা রঙবেরঙের ম্যানিফোল্ড কাগজে ছাপা বিজ্ঞাপনের লিফলেট সংগ্রহ করতে। যে ব্যস্ত সিনেমাওয়ালার ‘সিনেমাবাক্সের’ কৌটোর ঢাকনা খুলে ভেতরের অসংলগ্ন ছবির ধারাপ্রদর্শনী দেখতে। যে শিশুর কানে ঘটিগরমওয়ালার ঘন্টাধ্বনি, মন্দির বা চার্চের ঘন্টার আওয়াজের চেয়েও পবিত্র।

দ্বিতীয়: আকাশবাণী
আকাশবাণী –, খবর পড়ছি নীলিমা সান্যাল। আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল …..।

১৯৬০-৭০ বা ৮০র দশকে আকাশবাণী’র সংবাদ পাঠকদের মধ্যে কয়েকজনের নাম মনে গেঁথে গিয়েছিল। দেশবিদেশের সংবাদ পাঠকদের মধ্যে নীলিমা সান্যাল ছাড়াও ছিলেন ইভা নাগ, অসিত ভুষন দাশ, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন মিত্র, অনিল চট্টোপাধ্যায়, প্রমুখ।
আর স্থানীয় সংবাদ পাঠকদের মধ্যে যেসব নাম মনে আসছে তার মধ্যে দেবাংশু বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ, তরুণ চক্রবর্তী এবং …… দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
বা উপেন তরফদার ॥

ইংরাজি সংবাদে শুনতাম কিছু নামকরা নিউজ রিডার: This is All India Radio; The news, read by Surajit Sen. It was an age of legendary newsreaders, who were all household names: Barun Haldar, Pamela Singh, Sushil Jhaveri, Lotika Ratnam (Surajit’s sister), to name just a few.

কলকাতার হিন্দি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন – দীপচাঁদ মিঠোলিয়া।

রবিবারের সকালগুলো আমাদের ছোটোদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন “তোমাদের ইন্দিরাদি”। ওনার পরিচালনায় “শিশুমহল” অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। “ছোট্ট সোনা বন্ধুরা সব, কেমন আছো সকলে? ভালো তো?”
তার কিছুক্ষন আগেই পঙ্কজ মল্লিক -এর পরিচালনায় ” সঙ্গীত শিক্ষার আসর” শেষ হতো। বা সুপ্রভা সরকারের।

প্রতি সন্ধ্যায় “ঠক-ঠক-ঠক ক্রুঊঊউ, ঠক-ঠক-ঠক … উমমমম” এই ধরণের আওয়াজ দিয়ে শুরু হতো “মজদুর মন্ডলির আসর”; তার পরেই আসরে নামতেন — “মোড়ল-নিশীকান্ত-মঙ্গলময়” প্রভৃতি চরিত্ররা “পল্লিমঙ্গল আসর” জমিয়ে দিতে। সব পরিচালকদের নাম মনে নেই। তাহলেও সুধীন সরকারের নাম মনে রয়েছে। বুধবার বিকেলে “গল্পদাদুর আসর” নিয়ে বসতেন জয়ন্ত চৌধুরী। একবার ওনাকে দেখেছিলাম – “দাদু” বলে মোটেই মনে হয়নি। পরে পার্থ ঘোষও এই দায়িত্ব সামলেছেন।

প্রায়দিনই দুপুরবেলায় “— কেটে কুচি কুচি করে নুন-ঝাল মাখিয়ে কড়া’তে তেল দিয়ে উনুনে ফুটিয়ে তাতে ছেড়ে দিয়ে …” বেলা দে আসতেন তাঁর “মহিলামহল”এ।

প্রতি শুক্রবার রাত ৮ -টা থেকে রাট ৯ -টা: নাটক!
কত যে ভালো নাটক শুনেছি তার লিস্ট বিশাল।

শনি-রবি দুপুরের ‘অনুরোধের আসর’, রবিবার রাত সাড়ে ন’টায় ‘ছায়াছবির গান”, দুপুরে নাটক।

“বিরূপাক্ষের আসর” নিয়ে বসতেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র ।

“সংবাদ সমীক্ষা”, “সংবাদ বিচিত্রা” ছাড়াও আরোও অনেক বিচিত্র অনুষ্ঠান ছিল। ১৯৬৮’র সম্ভবত ১৬ই অক্টোবর থেকে ‘বিবিধ ভারতী’ তে টুং-টুং শব্দ দিয়ে শুরু হলো বিজ্ঞাপন । সেগুলোও লোকের মুখে মুখে ফিরতো। যেমন *সুরভিত এন্টিস্যাপ্টিক ক্রিম বোরোলিন*

যেমন ভোলা যায় না “নমস্কার, ইডেন উদ্যান থেকে বলছি পুষ্পেন সরকার” …….
ভোলা যায় না সেই কন্ঠস্বর…….
নমস্কার। ইডেন উদ্যান থেকে মোহনবাগান এবং ইষ্টবেঙ্গল ম্যাচের ধারাবিবরণী দিচ্ছি আমি অজয় বসু। আমার সঙ্গে আছে সুকুমার সমাজপতি।
টেস্ট ক্রিকেটের ধারাবিবরণী পুষ্পেন সরকার, অজয় বসু এবং কমল ভট্টাচার্য্য।
পাড়ায় মাত্র দু’একজনের বাড়িতেই রেডিও ছিল। ফুটবল ক্রিকেটের ধারাবিবরণী সেখানে গিয়ে শুনতে হতো।

শনিবার ও রবিবার•••••আরব্য রজনী, ডেনড্রাইটের শনিবারের বারবেলা, শ্রাবন্তী মজুমদারের বোরোলীনের সংসার, কেয়ো কার্পিন নাটকের দিন●●●● এই সব অনুষ্ঠানের জন্য সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করতাম।

তখন জীবন এত দ্রুতগতির ছিল না। কিন্তু অনেক বেশী বর্ণময় ছিল। অনেক বেশী তৃপ্তি ছিল।
••• হয়তো অনেক বেশী মনুষ্যত্ত্বও ছিল।।।
সময়ের দূরবীন দিয়ে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকালে চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিছু ফেলে আসা স্মৃতির কোলাজ।

*******

কৃতজ্ঞতা স্বীকার
**** শেষার্ধের কিছু অংশ সংগৃহীত

Sahityika Admin

1 comment

  • শরদিন্দু চৌধুরী, প্রেসিডেন্সি কলেজ says:

    আমি যদিও বিই কলেজের প্রাক্তনী নই, তবে সাহিত্যিকার নিয়মিত পাঠক।
    প্রতিটি লেখাই রুচিসম্মত, ভালো, সকলেই পড়তে পারে।
    তবে যেটি সবথেকে ভালো লাগলো, কত সহজ করে আমাদের ছোটবেলার বিশেষ করে স্কুলের সময়ের ছবি সুন্দর ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

    সাহিত্যিকা আরও এগিয়ে চলুক