বাংলাদেশে রবিঠাকুরের কুঠীবাড়ী
প্রদীপ ভৌমিক, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
ঢাকা থেকে সড়কপথে Inova গাড়ীতে চড়ে আমরা সবাই মিলে হৈ চৈ করতে করতে রাজশাহী, খুলনা ও কুষ্ঠিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের সঙ্গে আছে তোতন, তোতনের বউ সুদেবী ও ওদের সাত বছরের ছেলে। সম্পর্কে আমি তোতনের পিসেমশাই। আর তোতন বাংলাদেশে ভারতীয় পার্লে কোম্পানীর মার্কেটিং হেড। থাকে ঢাকা শহরের গুলশান অঞ্চলে কোম্পানীর দেওয়া এপার্টমেন্টে। আর সহযাত্রী আছেণ তোতনের সহকর্মী আলমগীর ও রেজাউল।
অসাধারণ সুন্দর গ্রামবাংলার মধ্য দিয়ে আমাদের রাস্তা। দুধারে মাইলের পর মাইল সবুজ খেত ও মাঝে মাঝে হলুদ সর্ষে ফুল। বিধাতা যেন পরম মমতায় গ্রামবাংলাকে সবুজ গালিচা দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন।
মাঝে মাঝে নদী-গাঙ। নদী-গাঙে নৌকা চলেছে মালপত্র নিয়ে। কোথাও জেলেরা জাল দিয়ে মাছ ধরছে। লোকজন বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে এপার ওপার করছে।
যেতে যেতে রেজা বলল – পিসেমশাই আপনাদের কথাবার্তা কি সুন্দর পরিষ্কার। আমি তোতনের পিসেমশাই, সেই সম্পর্কে তাঁর বন্ধুরাও আমাকে এই নামেই সম্বোধন করে। আমি একটু অবাকই হলাম। যে মাটির টানে যে কথার টানে সারাজীবনের সঞ্চিত আবেগ নিয়ে পূর্বপুরুষের ভিটে দেখতে এসেছি, সেই দেশের একজন মানুষের আমাদের কথার টান শুনে ভাল লাগছে! শুনে মনে মনে খুশিই হলাম।
বাংলাদেশে সাধারন মানুষ খুব সরল ও আবেগময়। আমি বললাম আমরা তো তোমাদের কথা শোনার টানে এদেশ দেখতে এসেছি। আমাদের মা বাবা যে ভাষায় কথা বলতেন সেই ভাষা শুনতে এসেছি। বললাম ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দিন আমরা রাত্রিবেলায় কলেজ হোস্টেলের ছাদে আনন্দে উত্তেজনায় খবরের কাগজ জোগার করে আগুন জ্বালিয়ে তোমাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছি। মনে হল আমার কথা শুনে ওরা একটু অবাকই হলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সময় হয়তো ওদের জন্মই হয়নি। শুধু বলল পিসেমশাই আপনারা হচ্ছেন খাঁটি বাঙালি।
মধ্যাহ্নে আমরা গ্রামের এক গাঙের ধারে গাড়ী থামিয়ে হোটেলে দুপুরের খাবার খেলাম। অবশ্যই মাছ ভাত। কাতলা মাছের পেটি লম্বায় প্লেট প্রায় ছাড়িয়ে যায়। তেমনই সুস্বাদু।
আবার আমরা চলতে শুরু করলাম। সন্ধ্যার পর রাজশাহী শহরে গিয়ে হোটেলে উঠলাম। পরের দিন সকালে গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। অনেকটা জায়গা জুড়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখান থেকেই আমরা কুষ্ঠিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। প্রধান আকর্ষন শিলাইদহর কুঠিবাড়ী দেখা।
শিলাইদহের এই কুঠিবাড়ীতে রবীন্দ্রনাথ একনাগাড়ে প্রায় দশবছর পরিবার নিয়ে ছিলেন। ১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত। এখানেই তাঁর পরিচয় হয় পূর্ববাংলার নিবিড় প্রকৃতির সঙ্গে, নদীমাতৃক বাংলার নদনদীর সাথে। প্রকৃতির নানাণ ঋতুর সাথে। বিশেষ করে ওনার প্রিয় বর্ষা ঋতুর সাথে। কুঠীবাড়ীর অনতি দূরেই প্রবাহিত পদ্মানদী। গাইড আমাদের বললেন কুঠীবাড়ী তৈরী হয়েছিল প্রায় ৬ বিঘা জমির উপর। ঠাকুরবাড়ীর সেই জমিদারী ছিল প্রায় ৬ হাজার বিঘের।
কুঠীবাড়ী যখন পৌছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। এই সময়ের পর পর্যটকদের ভিতরে যাবার নিয়ম নেই। আমাদের ভিতরে যাবার টিকিট পেলাম না, অনেক বলা সত্ত্বেও কাউন্টার টিকিট দিলো না । আমরা হতাশই হলাম। এতদূর এসেও এত অনুরোধেও রবিঠাকুরের বাড়ী না দেখে ফিরে যেতে হবে! তোতনের সহকর্মী রেজাউল বলল আমি একটু চেষ্টা করে দেখি। সে ওখানকার অফিসে গিয়ে বলল ‘ঢাকার থিইক্যা কর্নেল সাহেব আইছেন কুঠীবাড়ী দেখবার লাইগ্যা ‘। তোতনকে দেখলাম মিলিটারী কায়দার স্টাইল মেরে চোখে কালো চশমা পরে দাঁড়িয়ে আছে। তোতনকো দেখে অবশ্য কর্নেল বলেই মনে হয়। প্রায় ছ ফুট লম্বা ছিপ ছিপে গড়ন। মাথার চুল ছোট ছোট করে কাটা। তখন অফিসের লোকেরা তোতনকে দেখে অনুমতি দিল। আমরা ভিতরে গিয়ে কুঠীবাড়ী দেখলাম। বিশাল দোতলা বাড়ী। বাড়ীর ভিতর রবিঠাকুরের লেখার টেবিল, শোবার ঘর, পিয়ানো ইত্যাদি সযত্নে রক্ষত আছে। দেখলাম বাথরুমে কমোডের ব্যবহার তখনও ছিল। বাথরুম পরিষ্কার করবার জন্য বাড়ীর বাইরে থেকে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি। আছে লন টেনিস খেলার কোর্ট, বিরাট পুকুর, তাঁর বাঁধানো ঘাট। আর ঘাটের পাশেই সেই বিখ্যাত বকুল গাছ, যার নীচে বসে রবিঠাকুর লিখতেন।
আমরা পুকুরের ঘাটে বসে আছি। এমন সময় এক অন্ধ বৃদ্ধ তার ১৪-১৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে আমাদের কাছে এলো। হাতে একতারা। কাছে এসে বলল – গান শুনবেন বাবু!
সেই সুন্দর পরিবেশ, গোধূলি লগ্নে যেন কনে দেখার আলো, রবিঠাকুরের কুঠিবাড়ী, পুকুরের ঘাট, বকুল গাছ আমাদের এক স্বপ্নময় জগতে নিয়ে গেল। আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলাম।
ছেলেটা একতারা বাজিয়ে গান শুরু করলো। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’, ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে’, ‘গ্রাম ছাড়া এই রাঙা মাটির পথ’ , ইত্যাদি। সেই পরিবেশের কারণেই হয়তো মনে হল যে এমনভাবে দরদ মাখানো গান আগে বুঝি কখনও শুনিনি। হৃদয় আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল, মেঘ থেকে বৃষ্টি, বৃষ্টির জল হৃদয়ের দুকূল ছাপিয়ে চোখ ভরে গেল। সময়ের জ্ঞান নেই। একটার পর একটা গান শুনে যাচ্ছি। শুনলাম অন্ধ বৃদ্ধ ছেলেটাকে ছোটবেলা থেকে বড় করেছে গান শিখিয়েছে। সম্পর্কে কেউ হয়না। এই ভাবেই তাঁরা কুঠিবাড়ীর পর্যটকদের গান শুনিয়ে জীবিকা অর্জন করে। আমি বৃদ্ধের হাতে কিছু টাকা দিলাম। বৃদ্ধ হাত জোড় করে অনুরোধ করল আমরা যেন ছেলেটার জন্য আল্লার কাছে দোয়া করি ! চির জীবন মনে থাকবে গোধূলি লগ্নে ছেলেটার গাওয়া গান । রবিঠাকুরের শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে বকুল গাছের নীচে।
লেখা ও ছবির সুন্দর সংমিশ্রণ।