প্রবাসে দৈবের বশে (প্রথম পর্ব)
প্রদীপ্ত কুমার সিংহ, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
উপরের ছবিটি ১৯৮২ সালে কোদাইকানালে
জানুয়ারী ১৯৭৬। আমার কর্মজীবনের শুরু। সুদূর তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লীস্থিত BHEL কর্মশালায়। নির্ভেজাল এক বঙ্গসন্তান যে বাংলা ছাড়া আর অন্য কোন ভাষায় কিছুই বলতে জানে না তাকে কি না যেতে হবে এমন এক জায়গায় যেখানে এক বর্ণও বাংলা চলবে না। আর হিন্দি? নৈব নৈব চ। যদিও আমার হিন্দি জ্ঞান ‘মাসিমার রাষ্ট্রভাষা’ জ্ঞানের মতই সীমিত। অনেকটাই ‘চোখের মাথা খায়া হ্যায়?‘ গোছের আর ইংরেজি যদিও বুঝি ,ইংরেজিতে কথা বলাটা তখন শিক্ষানবিশ পর্যায়ে বলা যায়। ছোটবেলার বাংলা মিডিয়াম স্কুল ‘কান্দী রাজ উচ্চ বিদ্যালয়’ আর কলেজ ‘বঙ্গীয় কারিগরি মহাবিদ্যালয়, শিবপুর’। ইংরেজিতে কথা বলবো? সুযোগ কোথায়, বা দুঃসাহস?
দাক্ষিণাত্য যাত্রায় কপালগুনে মাদ্রাজ মেলের প্রথম শ্রেণীতে একই কূপে হাওড়া থেকে আমরা চার বঙ্গসন্তান একই সঙ্গে যাত্রা করি। জীবনে সেই প্রথম রেলের প্রথম শ্রেণীতে যাত্রা, তার আনন্দও আলাদা। সফর শেষে প্রথম ধাক্কাটা খেলাম মাদ্রাজ (তখনও চেন্নাই হয়নি) স্টেশনে নেমে। কুলি, ট্যাক্সি ড্রাইভার ঝরঝর করে তামিলে কথা বলছে। দেখেই বুঝেছে নতুন আমদানী। আকারে ইঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করছে কত লাগবে। আমাদের গন্তব্য ত্রিচি। মাদ্রাজ সেন্ট্রাল থেকে মাদ্রাজ এগমোর স্টেশন গিয়ে অন্য একটা ট্রেন ধরতে হবে। অনেক দরদস্তুর করে ট্যাক্সি রফা হলো পনেরো টাকায়। ট্যাক্সিতে উঠলাম, আর নামলাম। আসল ভাড়া দু’টাকা। ভাষা বিভ্রাটের প্রথম চোট। সেই ১৯৭৬ এর জমানায় ১৫ টাকা!!!
আবহাওয়া, সংস্কৃতি, পোষাক পরিচ্ছদ, আদব কায়দা, ভাষা, খাওয়াদাওয়া পুরো উত্তর থেকে দক্ষিণ। একদমই আলাদা। প্রথম বছরটা বহুভাষিক হোস্টেলে থাকার সুবাদে খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা অতটা বুঝতে পারিনি। সময়ের স্রোতে ইডলি, দোসা, সম্বর, রসমের স্বাদ রপ্ত করতে শিখে গেছি। আমাদের ব্যাচে জনা পঁয়ষট্টি উত্তর ভারতীয় (তার মধ্যে ন’জন বঙ্গসন্তান) থাকায় তামিল ভাষা শেখার তাগিদটাও অতটা উপলব্ধি করিনি। তবে সবাই বলতো আমার হিন্দি শুনে উত্তর ভারতীয় বন্ধুরা নাকি বাংলা ভাষাটা ভালো রপ্ত করে নিয়েছিল।
দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধুদের সঙ্গে আমার ইংরাজীতে কথা বলাটা ধীরে ধীরে বেশ সরগর হয়ে উঠেছিল। মেস কর্মচারী আর দোকানদারদের সঙ্গে কাজ চালানোর জন্য দু’একটা তামিল শব্দও শিখে নিয়েছিলাম। যেমন ‘আদে’ (ঐটা), ‘ইদে’ (এইটা), ‘আন্না’ (দাদা), ’তান্নি’ (জল), ‘উপ্পু ‘(নুন), ‘কুন্ডুয়া’ (নিয়ে এসো), ‘কুড়ু’ (দাও), ‘ভেন্ডা’ (চাই না), ‘ইরক্কু’ (আছে), ‘ইল্লা’ (নেই) ইত্যাদি। প্রথম পুরো বাক্য শিখেছিলাম ‘তামিল তেরিমা? (তামিল জানো?) তখন আমার উত্তর হবে ‘তামিল তেরিয়াদে’ (তামিল জানি না)।
আমাদের ট্রেনিং পর্ব শেষ হতে না হতেই ১৯৭৭ এর জানুয়ারিতে নতুন গ্র্যাজুয়েট ইন্জিনিয়ার ট্রেনীর দল এসে হাজির। ঐ দলে আবার ছ’জন বাঙালি। তার মধ্যে চারজন শিবপুরের। আমাকে আর পায় কে? মারো গোলি তামিল। হাটে বাজারে, রাস্তাঘাটে হৈ হৈ করে বাংলা বলছি। তামিলরা কি বলে আমরা বুঝি না, আমরা কি বলি ওরা বোঝে না। ওরাও হাসে, আমরাও হাসি।
Trichy 1976
আমরা ভারত সরকারের BHEL কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। সেই যুগে হাতে চার অঙ্কের মাইনে। স্বাভাবিকভাবেই বিয়ের বাজারে সবার বাজার দর চড়চড় করে উঠতে লাগলো। দক্ষিণে দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারটা একটু বেশি বলে Sensex সব সময়ই উপরের দিকে থাকতো। দক্ষিণ ভারতে মামা, ভাগ্নী, মামাতো, পিসতুতো, মাসতুতো ভাই বোনদের মধ্যে বিয়েটা কোনো ব্যাপারই ছিল না। পাত্র হিসাবে ‘মামা’ অগ্রগণ্য। নিজের দিদি তখন হয়ে যেত শাশুড়ী। প্রথম প্রথম আমাদের চোখে খুব আশ্চর্য্য লাগতো। মামা গররাজি হলে তবেই দ্বিতীয় পছন্দ। ইনটু মিনটু থাকলে অবশ্য অন্য কথা। এক অন্ধ্রের বন্ধু মার্চ মাসের মধ্যেই মাথা থেকে পা পর্যন্ত সোনা দিয়ে মুড়িয়ে নবপরিনীতা বৌ নিয়ে হাজির। তারপর থেকেই লাইন দিয়ে প্রতি মাসেই একজন দু’জন করে লজ্জাবনত নববধূর আগমন শুরু হয়ে গেলো। Owner’s pride, neighbour’s envy. বৌ তো আনবে, কিন্তু রাখবে কোথায়?
নতুন কলোনি তৈরী হলো। নামকরণ হলো Probationers’ Hostel, সংক্ষেপে PH. এক একটি স্টুডিও ইউনিটে ৬’x৩’ সাইজের দুটি খাট (সুটকেশ ইত্যাদি খাটের তলায়) রাখার মত একটি বেডরুম। তারই মধ্যে মুখ ধোয়া, দাড়ি কামানোর জন্য একটি আয়না (বৌয়ের ড্রেসিং টেবিল) সহ ছোট একটি বেসিন। সব কাজ সেরে আসার জন্য একটি বাথরুম। আমরা নাম দিয়েছিলাম Bathroom with attached Bedroom ..আর ছোট্ট একটি রান্নাঘর। অবিবাহিতদের জন্য একটি ইউনিটে দু’জন probationers. আমি PH49 1/2 আর জগত PH49 1/2 ( ঠিক এইরকমই লেখা ছিল) ..যদি একটি পুরো ইউনিট পেতে চাও তো বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র লাগিয়ে যথাযোগ্য স্থানে একটি দরখাস্ত ঠুকে দাও। আমি ’৭৭ ডিসেম্বরের প্রথমেই দিলাম ঠুকে একটি দরখাস্ত।
১৯৭৮ এর জানুয়ারির শেষাশেষি গুনে গুনে চৌদ্দটি লটবহর সঙ্গে তানপুরা রন্জিত গীতবিতান হস্তে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গিনী মৈত্রেয়ীকে নিয়ে নামলাম তিরুচিরাপল্লী জংশনে। প্রায় সব বন্ধুরাই @ জগত ঘোষ, প্রদীপ বর্ধন, বিজিত রায়, প্রতীক মহাজন (চিরতরে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে), দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় এঁরা স্টেশনে হাজির ছিল PH কলোনির প্রথমা বঙ্গবধূকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। শুরু হলো আমার (বা আমাদের দুজনের) নতুন অধ্যায়। না গ্যাস, না রেফ্রিজারেটর ..সম্বল বলতে ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানির দুটো কেরোসিন স্টোভ (বাজারে সদ্য বের হয়েছে, high flame low kerosene consumption .. IOCL এর marketing gimmick ..এক একটির দাম ৩৫ টাকা) আর বিয়েতে পাওয়া কিছু বাসনপত্র। তাই দিয়েই পাতা হলো নতুন সংসার।
এরই মধ্যে আমাদের পরের ব্যাচের আটজন trainee ট্রেনিং শেষে PH কলোনিতে নিজেদের কোয়ার্টার পেয়ে গেছে। তখনের PH কোয়ার্টারের এক একটি ব্লকে ছ’টা করে ইউনিট, মানে নিচে চারটে, উপরে মুখোমুখি দুটো। ওপরে দুটো ইউনিট হওয়ার দরুন বেডরুম সংলগ্ন ছাদটি পরিণত হতো আড্ডা মারার জন্য একটি আদর্শ মুক্তাঙ্গনে। তবে ওপরতলার ইউনিট পাবার জন্যও আলাদা দরখাস্ত, আলাদা লাইন। কপাল ভালো বলতে হবে। তাড়াতাড়ি পেয়েও গেলাম। বিকেল ৫ টার সময় অর্ডার কপি হাতে নিয়ে ফিরলাম। আধ ঘন্টার মধ্যেই বন্ধুদের হাতে হাতে লটবহর সমেত আমরা স্থানান্তরিত।
ইতিমধ্যে তামিল ভাষাটা সামান্য একটু রপ্ত হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা শুধু ভাষার নয়। কিছু কিছু উচ্চারণে সমস্যা দেখা দিলো যেমন ‘V’.. বাঙালির V আসে না, সব B। রোজকার মত প্রাতঃরাশ সেরে ডিউটি তে গিয়েছি। সেদিনের মেনু ছিল দুধ, চিড়ে। প্রায় প্রতিদিনই সবাই এমনকি আমার ঠিক ওপরের বস্ও জিজ্ঞেস করতেন কি খেয়ে এসেছি? আসলে নতুন বৌ কি খাওয়ালো সেটাই জানার উদ্দেশ্য; একটু মজা করা এই যা। যাই হোক, আমি নতুন শেখা তামিলে উত্তর দিলাম ‘আওল (চিড়ের তামিল AVAL) পাল (দুধ)।’ শুনে সবাই হেসেই অস্থির, আমার সঙ্গে সবাই করমর্দন করতে লাগলো। আমার মনে মনে বেশ গর্ববোধ হলো। হাসাহাসি থামলে বস্ এসে কানে কানে বললেন ‘সবই ঠিক আছে। তবে তোর উচ্চারণে V আসেনি, W এসেছিল মানে AWAL শুনিয়েছে। আর AWAL মানে মেয়ে ..বুঝেছিস্? ‘উচ্চারণের বিড়ম্বনা আর কাকে বলে। তামিল ভাষার এই মজা। একটু এদিক ওদিক হলেই পুরো মানেটাই বদলে যায়।
এরই মধ্যে আমাদের পরের ব্যাচের আটজন ট্রেনিং শেষে PH কলোনিতে কোয়ার্টার পেয়ে গেছে। প্রতি রবিবার দুপুরে আমাদের আস্তানাতে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া হতো। দশটার মধ্যেই গান্ধী মার্কেট থেকে কম করে দু’রকম মাছ চলে আসতো (টাউনশিপ থেকে ১৩ কিমি দূর, বাসে যাওয়া আসা)। তখন ত্রিচিতে ভাগে মাছ বিক্রী হতো। আমার মনে আছে ৫ টাকায় ২৬ টা পাবদা মাছ আর ৮/৯ টাকায় আড়াই তিন কেজি সাইজের রুই মাছ। ১০ টাকা কেজি পাঁঠার মাংস। আমাদের কেউ তরকারী কাটছে, কেউ মশলা বাঁটছে। তারই মধ্যে হাসি ঠাট্টা গল্প গুজব। ১৮/১৯ টা কলাপাতা পড়তো। আর বিকেল বেলায় দলবেঁধে টাউনে সিনেমা যাওয়া। রাতে Aristo hotel @ তখন ত্রিচির একমাত্র multi cuisine restaurant এ খেয়ে ফেরা।
ঐ বছরেই BHEL ‘৭৭ ব্যাচের আরও দু’জন বঙ্গসন্তান অন্য ইউনিট থেকে ত্রিচিতে এক বছরের ট্রেনিং এ এসেছিল। দিল্লী প্রবাসী শক্তিশরন রায়, আর অন্যজন অমিত চ্যাটার্জি। (অমিতও আমাদের মধ্যে আর নেই)। দুজনেই গায়ক। শক্তি ভালো তবলাও বাজাতো। সন্ধে হলেই আমাদের ছাদে গানের আসর শুরু হতো। নিচে বিজিতদের কোয়ার্টারে বসতো ক্যারমের আসর, যেখানে উদ্দীপক’দা (উদ্দীপক চক্রবর্তী, আমাদের কলেজের ‘৭১ সিভিল) Mecon, রাঁচি থেকে BHEL এর Seamless Steel Tube প্রজেক্টে Sr. Resident Consultant হয়ে এসেছিলেন। জমাটি দাদা। বৌদিকে ওপরে গানের আসরে পাঠিয়ে দিয়ে নিচে ক্যারমের আসরে বসে পড়তেন আর প্রতীকের দ্বৈরথ জমে যেত। বেশির ভাগ দিনই রাত্রের খাওয়া সারা হতো বিজিতদের মেসে। প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগের কথা। মনে হয় এই তো সেদিন। চোখের সামনে সব ভাসে।
মনের আনন্দে ভালোই কাটছিল দিন গুলি। ‘খাও দাও জিও পিও টেক ইট ইজি ইয়ার’। আমাদের কাছে ‘BHEL’ তখন ‘Be Happy and Enjoy Life.’ মনের স্বাধীন আনন্দে সুখেই ছিলাম। হঠাৎ ১৯৭৮ এর প্রথম দিকে আমার উত্তর ভারতীয় বড় সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, ‘তোমাকে শপ্ ফ্লোরে ট্রান্সফার করে দিলাম’.. আমার মাথায় তো বজ্রপাত। আমতা আমতা করে বললাম ‘স্যার! ভাষা জানিনা। অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে কি করে কথা বলবো?’ গম্ভীর উত্তর ‘ডরো মাত্। সব কুছ শিখ যাওগে।’ সমস্যাটা শুধু ভাষার নয়। তার থেকেও বড়ো সমস্যা আমি তখন সদ্য বিবাহিত। শপ ফ্লোরের ডিউটিতে কোনো সময় অসময় নেই। একবার ঢুকলে নাকি বেড়োনো যায় না। কি আর করা যাবে? যাচ্ছি, আসছি আর কিছু কিছু ভাষা শিখছি..
আমাদের সব কিছুই ব্যাচ ধরে। ‘৭৬ এ চাকরী, ‘৭৭/‘৭৮ এ বিয়ে। ’৭৮/‘৭৯ তে প্রথম কিস্তি। আমাদের ব্যাচে একজন বন্ধু ছিল মনপ্রীত লাকড়া (দুর্ভাগ্য, ২০২২ সালে সে চিরতরে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে)। রাউরকেল্লার ছেলে। ভালো হকি খেলতো। একবছরের মধ্যেই BHEL হকি টিমে জায়গা করে নিয়েছিল। প্রখর দৃষ্টিশক্তি। ওর কাছেই PH Colony র সব খবর পাওয়া যেত। মাঝে মাঝেই আমাকে জিজ্ঞেস করতো ‘আরে সিনহা। উসকা বিবি কো লাগতা তো হ্যায় ..না?’ ওর নাম দিয়েছিলাম ‘লাগতা তো হ্যায়।’
জানিনা আমার বেলায় কাকে জিজ্ঞেস করেছিল।
৩১ মার্চ।
এই দিনটির চাপে পড়েন নি এমন কি কেউ আছেন? আমাদের কর্মজীবনে নাওয়া খাওয়া ভুলে লক্ষ্যে পৌঁছনোর তাগিদে কমবেশি সকলকেই দৌড়তে হ’তো এই তারিখটির পিছনে। ১৯৮২ সাল। আমি তখন BHEL, ত্রিচি কর্মশালায়, সদ্য Senior Production Engineer / Boiler Production পদে উন্নীত হয়ে প্রথম বছর @১৯৮১-‘৮২ র লক্ষ্যে পৌঁছনোর তাগিদ। মাথার ওপর চেপে বসলো Tata Power Co র Trombay Unit V @ 1X500 MW unit ..BHEL ত্রিচির প্রথম 500MW Boiler order in collaboration with Combustion Engineering Inc, USA …স্বভাবতঃই প্রচন্ড কাজের চাপ। নাওয়া খাওয়া ভুলে বিশেষ করে জানুয়ারি থেকে মার্চ রাতদিন শপফ্লোরেই কাটতো। দেখতে দেখতে ৩১ মার্চ এগিয়ে এলো। অবশেষে তৈরি হ’লো the then India’s heaviest Steam Header @ 40 T …officially flagged off by Mr. M.K. Sridhar, the then Executive Director, BHEL, Trichy. আমার পিঠ চাপড়ে বললেন ‘Sinha!! Congratulations. I know you have spent sleepless nights for this project. I have recommended your name for training in 500 mw boilers at Combustion Engineering, USA.’
I stood dumbstruck.
ঠিক হ’লো এক সপ্তাহ Cayuga Works , Buffalo তে Inspection of welding machines for 500 mw Drums and headers আর তিন সপ্তাহ CE, Chattanooga (Tennessee) works এ ট্রেনিং.. সব মিলিয়ে এক মাস।
স্বপ্নের উড়ান
“There are only two rules for being successful. One, figure out exactly what you want to do, and two, do it.” ~ Mario Cuomo
এরপর ৬ ই জুন ১৯৮২ ..আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। জীবনের প্রথম উড়ান। আমার স্বপ্নের উড়ান। পাড়ি দিলাম এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজা ‘আকবরে’ চড়ে মুম্বাই থেকে নিউইয়র্ক ভায়া দুবাই, লন্ডন।
ফিরে আসি আমাদের ত্রিচির প্রথম দুর্গাপূজার কথায়।
বাংলা নববর্ষের ক্যালেন্ডার বাজারে বেরুলেই সারা ভারতবর্ষ জুড়ে বাঙালিদের প্রথম কাজ ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে দেখা ‘এবার দূর্গা পুজো কবে?’ এখন মাঝে মাঝে ভাবি ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত ১০ টা বছর সুদূর তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লীতে আমরা বাঙালিরা দূর্গাপুজো ছাড়া কি করে বেঁচে ছিলাম? প্রথম দিকে নবাগত বাঙালিদের অনেকেই পুজোর ক’টা দিন ছুটি নিয়ে নিজেদের বাড়ি চলে যেত। ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলে সেটা আর সম্ভবপর হতো না। কেননা তামিলনাড়ুর স্কুলে পুজোর ছুটি বলে কিছু ছিল না। মনে পড়ে দেবীপক্ষের শুরু হতেই রেডিওতে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে পুজোর ক’দিন ঢাকের বাজনা বাজানো হতো অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে? ঢাকের বাজনা আর পুজোর ক’দিন নতুন জামাকাপড় পরে পালা করে সন্ধে থেকে কারুর বাড়িতে আড্ডা আর খাওয়াদাওয়ার মধ্যেই আমাদের পুজোর আনন্দ সীমিত থাকতো। নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করতাম ‘আজ মহাষ্টমী‘, ‘আজ মহানবমী‘ ..
আমাদের কৈলাসপুরম টাউনশিপে নিয়মিত সরস্বতী পুজো উদযাপন হতো। কিন্তু দুর্গাপুজো ব্যাপারটা চিন্তার বাইরে ছিল। ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাস। নতুন আর্থিক বছরের শুরু। বছরের শুরুতে কাজের চাপ সাধারণত থাকে না। এক উইকএন্ডে পাঁচবন্ধু মিলে সপরিবারে আড্ডা মারছি। কথায় কথায় কথা উঠলো ‘এবার দূর্গাপুজো করলে কেমন হয়?’ গিন্নীরাও নেচে উঠলেন। দুর্গাপুজোর ভাবনায় প্রথম উপকরণগুলি হলো তিনটে ‘প’। পুজো মন্ডপ, প্রতিমা, পুরোহিত। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রথমেই চতুর্থী থেকে একাদশী আর লক্ষ্মীপুজো সব মিলিয়ে ন’দিনের জন্য আমাদের টাউনশিপের কমিউনিটি হল বুক করে দিলাম। খবর পেলাম প্রতিবছর ব্যাঙ্গালোরের Bengalee Association এ কুমারটুলি থেকে একজন প্রতিমা শিল্পী আসেন আর association complex এ ব্যাঙ্গালোর, মাইশোর ও আশপাশের জায়গার দূর্গাপুজোর জন্য গোটা সাত আটেক প্রতিমা তৈরী করেন। ওখানেই আমাদের প্রতিমারও বায়না দিয়ে দিলাম। প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি।
এবার মিশন পুরোহিত। গরমের ছুটিতে সপরিবার কান্দি যাবার পরিকল্পনা করলাম। কান্দি গিয়ে আমার মেজকাকাকে (বাবু’দা নামেই অধিক পরিচিত) পুরোহিতের ব্যাপারটা বিহিত করতেই উনি এক কথায় জানালেন, ‘শঙ্করকে নিয়ে যা। আমার SDO অফিসের সহকর্মী। কথা বলে নোবো।’ একদিন অফিস ফেরত কাকার সঙ্গে শঙ্কর কাকা @ কুমারেশ রায় এলেন। ত্রিচি যেতে রাজীও হলেন। সঙ্গে ভাগ্নে @ রাধামাধব চট্টোপাধ্যায় কাকাও যাবেন। রাধামাধবকাকা আমাদের জীবধরপাড়ার পুরোনো বাসিন্দা ছিলেন। আমার কাকা আশ্বাস দিলেন যে পুজোর যাবতীয় উপকরণ কুমারেশ কাকাদের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। শুধুমাত্র নবপত্রিকা বাঁধার জন্য যেসব গাছগাছরা লাগে সেগুলি আমাদের ত্রিচি থেকেই যোগাড় করতে হবে। মিশন পুরোহিত সম্পন্ন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্বের পরিসমাপ্তি। নবপত্রিকা ব্যাপারটা ঝুলে রইলো।
লিস্ট এলো যথাসময়ে। ‘নবপত্রিকা‘ বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ। কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু, ধান ও শ্বেত অপরাজিতার লতা। বোঝো ঠ্যালা। তামিল দেশে লোকজনকে অশোক, মানকচু, জয়ন্তী, শ্বেত অপরাজিতার লতা এসব বস্তু বোঝাই কি করে? কথিত আছে মায়ের পুজো মা নিজেই করিয়ে নেন। একদিন The Hindu পত্রিকায় নজরে পড়লো ‘Miss Aruna Basu IFS, is posted as District Forest Officer, Tiruchirappalli, নিজ দায়িত্বে ফোন করলাম। সুদূর ত্রিচিতে ফোনের অন্য প্রান্তে সদ্য আসা এক বঙ্গসন্তান ফোনে বাংলা কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত ও আনন্দিত। একদিন চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এলেন। বাচ্চা মেয়ে। Botany Hons নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের স্নাতক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এস সি। চা বিস্কুট খাইয়ে নবপত্রিকার লিস্টটা ধরিয়ে দিলাম। যথা সময়ে উনি সব কিছু বস্তাবন্দি করে পৌঁছে দিলেন। এরপর থেকে প্রতিবছর নিয়ম করে সেগুলি যথাসময়ে পাঠিয়ে দিতেন।
ত্রিচিতে BHEL, আর Ordnance Factory মিলে বাঙালি কর্মীসংখ্যা জনা পঞ্চাশ আর NIT ত্রিচির জনা চল্লিশ বাঙালি ছাত্র। সবাইকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এলাম। স্ত্রী পুত্র কন্যা সব মিলিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়ালো শ’দেড়েক। দুর্গাপুজো একবার শুরু করলে পরপর তিনবছর করতেই হয়। তার ফলস্বরূপ আমাকে ‘৮৬-‘৮৮ তিন বছর তিরুচিরাপল্লী সর্বজনীন পুজো কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল।
দক্ষিণ ভারতে খুব ধূমধামের সঙ্গে ‘নবরাত্রি‘ পালিত হয়। একটা উৎসবের বাতাবরণ থাকে। মহানবমীর দিন আমাদের plant এ প্রত্যেক shop floor এ ‘আয়ূধা পুজো‘ (চারহাতের সরস্বতী, বাহন ময়ূর, দক্ষিণের বিশ্বকর্মা) পুজো হতো। ঐদিন সকল জনসাধারণের জন্য অবারিত দ্বার। টাউনশিপে প্রথম দূর্গাপুজোয় সবার কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেলাম। স্থানীয় তামিল, তেলেগু, মালয়ালম সমাজগুলোর জন্য মহাসপ্তমী, মহাষ্টমীর দু’টি সন্ধে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ করা হলো। আর বাঙালিদের জন্য রইলো মহাষষ্ঠীতে আগমনী আর মহানবমীতে বিবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সে কি উন্মাদনা। বিশেষকরে বৌ বাচ্চাদের। পূজোর আগে মাস দেড়েক প্রত্যেক দিন কারুর না কারুর বাড়িতে নাচগানের রিহার্সাল আর আমাদের ছেলেদের মিটিং। সেইসঙ্গে চা তারসঙ্গে টা বলতে ঘুগনি। শেষকালে আমি গান বাঁধলাম ‘ দুরন্ত ঘুগনির এই লেগেছে পাক ..’।
দেখতে দেখতে আমাদের বহু আকাঙ্খিত দূর্গাপূজো এগিয়ে এলো। এখনও মনে পড়ে যেদিন ব্যাঙ্গালোর থেকে প্রতিমা নিয়ে ফিরলাম। ২ রা অক্টোবর। ছুটি থাকার জন্য সবাই বাড়িতে। কি ভীড় যে হয়েছিল প্রতিমা দর্শনের জন্য। এখন ভাবি মা’কে ব্যাঙ্গালোর থেকে একা কি করে নিয়ে এসেছিলাম? সবই মায়ের আশীর্বাদ। কুমারেশ কাকারাও নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেলেন। শুরু হলো মায়ের পুজো। সেই পুজো এখনও চলছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেকগুণ বড় হয়ে।
প্রথম দুর্গাপুজো। ভেল ত্রিচি ১৯৮৬। স্মৃতিতে অমলিন
I read comments from different persons. But none of them possibly know, the real story before the stage was set for this photo. How many sleepless nights Pradipta Sinha, the founder Secretary (1st Secretary of the Durga Puja at BHEL Trichy) had to pass through, what odds he had to endure. Some of us who stood behind him in those turbulent days are the witness, – but as I wrote “stood behind” literally means just stood behind – making it “Plural number” only. It was the single-handed effort and determination of Pradipta Sinha which made the above photo possible. Look at Pradipta’s face in the photo – it will tell you about the sleepless nights he suffered. Here, I must record the contributions and sacrifice made by Papan (Maitrei Sinha) who stood – not behind – but by the side of Pradipta like the real “Sahadharmini”. I was expecting to see some comments from BHEL Trichy guys of those days. Unfortunately, we have lost some senior people – Pranata Chakraborty – the 2nd Secretary and S K Guha – the decoration incharge. Me – the 3rd Secretary, is still ticking. I possibly got overwhelmed in sentiment seeing the photo. Excuse me.
– Tapan Mitra
ত্রিচি ১৯৮৭ দুর্গাপুজো
দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক মজুমদার’দা। পুরোনো বাঙালি। আমার ১৯৮৬ র প্রথম দুর্গাপুজোর শেষে বিজয়ার কোলাকুলিতে জড়িয়ে ধরে ‘প্রদীপ্ত, তুমি লিডার। আমি মানছি।’ এখনও কানে বাজে কথাগুলো।
আমাদের সময় সকল দন্ডমুন্ডের কর্তা ছিলেন রামকৃষ্ণণ সাহেব। দীর্ঘদিন দুর্গাপুর স্টীলে কর্মজীবনের সুবাদে ত্রিচির দুর্গাপুজোকে সাফল্যমন্ডিত করার পিছনে উনার অবদান অনস্বীকার্য্য।
১৯৯২ সাল, ১৬ বছর থাকার পর বিদায় ত্রিচি
মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে।
(ধারাবাহিক)
বেশ ভাল লেখা । পড়ে ভাল লাগলো। অনেক কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৮৫ -১৯৯০ সালে আমি প্রজেক্টের কাজে ( Jacobs / H&G) মুম্বাই থেকে দক্ষিন ভারতে মাসে দুবার করে যেতাম। মাদ্রাজ এগমোর স্টেশন থেকে রকফোর্ট এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে ত্রিচি যেতাম। ট্রেনের টিকিট না পেলে বাসে যেতাম। AC বাসে সারারাত তামিল সিনেমা দেখতে দেখতে ভোরে ত্রিচি এসে পৌছাতাম। এখানে Kaveri Engg, Moorco & Tuflin valves কোম্পানীতে visit করতাম। কয়েকবার BHEL এ high pressure valve section ও visit করেছি। সেই সময় BHEL থেকে কয়েকজন engineer কোম্পানী ছেড়ে দিয়ে ত্রিচিতে fabrication shop শুরু করে – Cether Vessel । Registration জন্য আমি এই কোম্পানীতে audit করতে যাই। একবার হলো কি Kaveri Engg থেকে বেশ কিছু equipment র delivery করতে দেরি হলো। Urgency ছিল বলে আমাকে একমাসের জন্য ত্রিচিতে stationed হতে হল। সম্ভবত Anand hotel এ ছিলাম। Non- veg খাবার পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। মাঝে মাঝে Trichy স্টেশনে চলে যেতাম ওখানকার canteen এ non-veg খাবার জন্য। দুর্গাপূজোর সময় ত্রিচিতে আটকে পড়েছিলাম। Kaveri Engg র contract manager Mr Balan উনার বাড়িতে দশেরার দিন আমন্ত্রন করেছিলেন উনার বাড়িতে।