প্রবাসে দৈবের বশে (দ্বিতীয় পর্ব)
প্রদীপ্ত কুমার সিংহ, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
BHEL, An Institution, The Temple of Learning
It was year 1982, I was deputed by my employer BHEL, Tiruchirappalli to M/S Combustion Engineering Inc. USA, our collaborator for high pressure boiler for training in manufacturing of 500 MW boilers. Earlier, during 1975-76, the Indian power scenario made a quantum leap by the formation of NTPC. Initially, they set up four super thermal power plants with a total generating capacity of 1200 MW each at Singarauli, Korba, Ramagundam and Farakka. By that time, BHEL had mastered the technology to commission 210 MW power plants and was on the verge of commissioning of it’s first 500 MW power plant for Tata Powers Co, Trombay, Maharashtra. Except the headers, the main boiler components for Tata Power were imported from M/S CE works, Chattanooga, USA. And BHEL, Trichy was in the process of expanding it’s installed production capacity from 2500 MW to 4000 MW with the major thrust on 500 MW boiler components. My training in CE, USA was also clubbed with the inspection of special purpose welding machineries mainly for Boiler Drums, Headers and Steam piping. The supplier was based in Buffalo. After spending a week in Buffalo, I went to Chattanooga in the state of Tennessee where CE had it’s own manufacturing set up. I was simply awed by seeing the vastness of the set up in comparison to ours at Trichy. The activities on the shop floors were moving with clockwise precisions following neatly planned operation process sheets for each and every work centre. I was amused to see their Production Managers wearing ties. I thought, at once, if I had a tie around my neck in India, what would have happened!! The basic difference in work culture between USA and India is…in USA, jobs move but production executives don’t move whereas in India, production executives move from pillar to post to keep the jobs moving.
Every year as a routine, the quality control team from Combustion Engineering, USA led by Dr. Bailey (Director, QA & QC) used to visit our BHEL, Trichy works for quality audit of our products specially pressure parts. If any of our wrong doings was noticed by Dr. Bailey, he immediately used to call me and say ‘Mr. Sinha! It’s a bad practice. Please avoid such practices in future.’
One day during my training in CE works at Chattanooga, USA, I met Dr. Bailey on the shop floor. He was with our Mr. M.K. Sridhar, the then Executive Director, BHEL, Trichy, who was on a visit. I didn’t want to miss the opportunity to draw his attention to the similar wrong doings practised on CE shop floor. I showed him the same to him and told him “Sir! every time you came to Trichy you used to warn me and advised me to avoid such bad practices in future. But here, I found you too had been following the same.” He smiled, kept his hand on my shoulder and told “Gentleman!! Don’t do what we do .. do what we say.” I felt numbed. His words till ring in my ears after 42 years. My respect to the great teacher.
********
ভেল , তিরুচিরাপল্লী। ১ লা এপ্রিল ১৯৮৬।
১৯৮৫ র জুন মাসে ডেপুটি ম্যানেজার পদে উন্নীত হয়ে প্রথম বছর @ ১৯৮৫-৮৬ র লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করে এই দিনটিতে সকাল থেকেই ধোপদুরস্ত ইউনিফর্ম পরে খোশ মেজাজে শপে শপে ঘুরছি। বছর দুই/তিন আগে থেকে তখনকার ইডি শ্রীধর সাহেব চালু করেছিলেন ১লা এপ্রিল পুরো ইউনিটে কোল্ড ড্রিঙ্কস বিতরণ। শপে প্রচলিত নাম ছিল Colour বিতরণ। সর্বত্র একটা উৎসবের আবহ। মনের আনন্দে নিচে থেকে উপর পর্যন্ত সবাই সবার সঙ্গে করমর্দনে ব্যস্ত।
এবার একটু গৌড়চন্দ্রিকা না করলে উৎসবের মেজাজটা উপভোগ্য হবে না। ১৯৮৫-৮৬ সালে আমার মাথার ওপর ২৫০০ টন production এর লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য করা হয়েছিল। জানুয়ারি পর্যন্ত উৎপাদন ২০০০ টন। অর্থাৎ বাকি দুই মাসে ৫০০ টন উৎপাদন করতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে ২০০ টন, আর মার্চে ৩০০ টন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের সবাইকে জানিয়ে দিলাম। দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। প্রতি মাসের ২৪ তাং, শুধু মার্চ মাসে ৩১ তাং এর মধ্যে Shipping এ FPISO @ Finished Product Inspection and Storage Order সাইন করিয়ে কমার্শিয়াল ডিপার্ট্মেন্টে পাঠাতে হতো। Man proposes but God disposes. ফেব্রুয়ারি ২৪ তাং ১৩০ টন / ২০০ টন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারলাম। কপালে কি আছে কে জানে? রামকৃষ্ণন সাহেব তখন ইডি হয়ে ইউনিট হেড। অপেক্ষায় আছি কখন তাঁর ডাক পড়ে? মার্চের ১ তাং, লোকমুখে খবর পেলাম যে অন্য এক শপে ইডি সাহেব ভিজিটে এসেছেন। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। সেখান থেকেই ডেকে পাঠালেন। গুটি গুটি পায়ে গেলাম। আমাকে দেখেই ‘Aren’t you ashamed to show your face?’ (it still rings in my ears) ..কি আর বলবো? মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি।
‘How much will you give in March?’
পুরো আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম ‘370 tons ..Sir!’
সাহেবের এমনিতেই বড় বড় চোখ, আরও বড় হয়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে ‘Are you sure what you say?’
জবাবে ‘Yes Sir’ বলে সে যাত্রা রক্ষা পেলাম।
সেইদিনই দুপুরে ইডি’র সিনিয়র ম্যানেজার এবং উর্ধতনদের সাথে ফাইন্যাল প্রোডাকশন রিভিউ মিটিং এর মাঝে বেলা আড়াইটে নাগাদ ইডি অফিস থেকে ফোন পেলাম যে উনি আমাকে ডেকেছেন as a special invitee.. ফাইলপত্র নিয়ে দৌড়লাম। ঘর্মাক্ত কলেবরে সিনিয়র কনফারেন্স হলে ঢুকতেই একটা চাপা গুন্জন। তিলধারনের জায়গা নেই। শুধু ইডি র সামনের চেয়ারটা খালি। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন ‘this is your’s..’ সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছেন। আর আমি বসলাম হাসিমুখে। উনিও হাসিমুখে তামিলেই জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমাকে কেন ডেকেছি জানো?’
আমিও তামিল ভাষাতেই জানতে চাইলাম ‘কেন স্যার?’
‘শপে আমাকে সকালে মার্চের যে ফিগারটা বলে ছিলে আশাকরি মনে আছে তোমার? সবার সামনে একবার বলে দাও।’
আমিও সঙ্গে সঙ্গে ‘ হ্যাঁ স্যার ..মনে আছে ..৩৭০ টন‘ ..
আবার একটা চাপা গুন্জন। তখনও পর্যন্ত আমার রেকর্ড ২৫০ টন …’৮৫ মার্চ। টেবিলের তলা দিয়ে হাতে হাতে আমার কাছে একটা চিরকুট এসে পৌঁছলো। রমণ সাহেব AGM (Production), আমার বস্, এর লেখা ‘Sinha !! you are pitching too high.. commit 250 tons only.’
আমি ইশারায় আশ্বস্ত করলাম ৩৭০ টন।
ইডি সাহেব মনে করিয়ে দিলেন ‘মনে রেখো ৩১ মার্চ রাত্রি ১২ টা পর্যন্ত ৩১ মার্চ ..’
আমিও ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।
দিন এগোয়, আমিও এগোই।
अब आएगा मज़ा
রামকৃষ্ণন সাহেব তখন কমার্শিয়াল চিফ মিঃ জগদীশ্বরণকে (এক সময় উনি আমার বস ছিলেন) নির্দেশ দিলেন ‘Mr. Jagadeeswaran! Pl see that any header handed over beyond mid night has to be accounted for April only ..FY 1986-‘87.’
জগদীশ্বরণ সাহেবও বিশ্বস্ত সৈনিকের মত ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন।
৩১শে মার্চ, রাত তখন দশটা। ওজনের কাঁটা বলছে ৩৬৫.৫ টন। একটা ৪.৫ টনের Header তৈরি আছে, for handing over তবে তার আগে NTPC ক্লিয়ারেন্স দেবে। আমি শপে দাঁড়িয়ে আছি। Mr. Paranjyothi, SM, QC, NTPC এলেন আর অনুরোধ করলেন, ‘Sinha, I am too tired to clear this header now. I will come tomorrow morning and clear for FPISO. Please bear with me.’ What to do?
মেনে নিলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত কাছে এসেও মাত্র ৪.৫ টনের জন্য ৩৭০ টন হ’লো না? ইতিমধ্যে বসেদের অভিনন্দন বার্তা আসতে শুরু করে দিয়েছে।
রাত তখন ১১ টা। Mr. Subramanian, Senior Manager, Shipping হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে এসে ঐ header টার দিকে আঙুল দেখিয়ে ‘Sinha! when are you going to hand over that header?’
আমি তাৎক্ষণিক জবাবে বললাম, ‘24th April Sir ..’
স্যুব্রম্মনিয়াম অবাক, ‘Why? Why? ..The header seems to be ready..’
জবাবে ‘Sir! it doesn’t matter whether it is 1st or 24th ..the credit goes to April only i.e next year.’
আমি জানি যে আমার ওপর যেমন লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য হয়েছে, স্যুব্রম্মনিয়াম সাহেবের মাথার ওপরেও Despatch এর খাঁড়া ঝুলছে, যার ওপর নির্ভর করছে BHEL, ত্রিচির Commercial Invoicing in turn yearly@ 1985-‘86 turn over.
আসলে হয়েছে টা কি..আমি ইতিমধ্যেই একটা অনুরূপ header একই প্রজেক্টের জন্য hand over করে দিয়েছি। Shipping এ ৯টন লোডের একটা ট্রাকে লোডও হয়ে গেছে ..এই header টা লোড হলেই full truck লোড নিয়ে ট্রাকটা চলে যাবে।
স্যুব্রম্মনিয়াম সাহেব তখন মরিয়া ..’Please give me the papers ..I will sign with the date 31st March ..now, tell me ..when will you hand over the header ..?’
আমার উত্তর, ‘Tomorrow morning by 9 AM. Sir.’
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১২ টা ছুঁই ছুঁই করছে। ওজনের কাঁটা..৩৭০ টন ..
Win Win situation for both of us
৩১ মার্চ রাত ১২ টা। ওজনের কাঁটা ৩৭০ টন ছুঁলো।
আমার কলার উঁচু।
নিয়ম মাফিক ফি বছর ১লা এপ্রিল ইডি সাহেব শপ ফ্লোরে এসে সবার সঙ্গে করমর্দন করে সবাইকে অভিনন্দন জানান। পারিষদবর্গ পরিবেষ্টিত হয়ে সকাল ন’টা নাগাদ রামকৃষ্ণন সাহেব আমার শপে এলেন। সবাই ঘিরে ধরেছে। আমি ইচ্ছে করেই একটু দূরে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছিলাম।
‘Where is Sinha?’
আমি এগিয়ে গেলাম। বুকে জড়িয়ে ধরলেন ‘I must congratulate you first .. unbelievable performance.’
৩৮ বছর আগের ঘটনা। স্মৃতিতে অমলিন।
******
২৪ জুন, ..a D Day in BHEL..আমাদের সবার এই দিনটির দিকে তাকিয়ে ‘আশায় বাঁধিনু ঘর‘ এর চিন্তায় দিন কাটতো। সবাই অপেক্ষায় থাকতাম কখন বসের অফিস থেকে ডাক আসবে। আসলে ঐ দিনটিই BHEL এর নিচে থেকে উপর পর্যন্ত কর্মচারীদের পদোন্নতির দিন। কিছু কিছু পদোন্নতি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে যেখানে cadre এর পরিবর্তন হ’তো যেমন Worker Grade I থেকে Supervisor, বা Supervisor থেকে Executive, Executive from Units to Corporate (Senior Manager and above upto Executive Director). সকাল থেকেই সর্বত্রই একটা চাপা উত্তেজনা। শুধু পদোন্নতিই নয় ..সবার মনে আরও একটা সংশয় ..ডিপার্টমেন্ট, বা বস বদল হবে না তো?
আগের দিন অর্থাৎ ২৩শে জুন ১৯৮৬, লান্চের পর রমণ সাহেব, AGM (Production) আমাকে ডেকে পাঠালেন। উনার চেম্বারে ঢুকে দেখি Mr. Gopinath, DGM (Production), Mr. Krishna Rao, Sr. DGM (Production) এনারা সেখানে উপস্থিত। আমারে বসতে বললেন। বসলাম। রমণ সাহেবেই শুরু করলেন ‘Sinha!! Two of your High Pressure Welders are to be dropped from the promotion list to accommodate two other candidates due to Union pressure.’ Incidentally আমি সেবার Grade I to Chargeman selection committee তে ছিলাম। সেদিন সকাল পর্যন্ত এই দু’জনের নাম সর্বসম্মতিক্রমে প্রমোশনের তালিকায় ছিল। অনেক অনুনয় বিনয় করলাম। সবারই এক কথা ‘বুঝতেই পারছো union pressure, তাঁদের নিজেদের লোকদের ঢোকাতে হবে। কিছু করার নেই।’ আমার মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছে আগামীকাল এই দু’জনকে কি বলে সান্ত্বনা দেবো যখন ওরা দেখবে লিস্টে ওদের নাম নেই।
রমণ সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটা মারলাম Administrative Building এর দিকে Mr. Srinivasulu, GM (Operation) এর সঙ্গে দেখা করতে। I just barged into his chamber. আমাকে বসতে বলেই ‘What’s the matter Sinha ? You look disturbed.‘
আমি পুরো ঘটনাটা বললাম। উনি মন দিয়ে আমার কথা শুনলেন। বললেন ‘the list has already been cyclostyled and signed by the ED.. how can this be changed at this moment?’ আমিও নাছোড়বান্দা। সমানে বলেই চলেছি ‘Please do something Sir.’
‘O.K.. give me the names with serial nos.. But I can’t assure you.’
GM এর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এবার এসে ঢুকলাম Sr. DGM (Production) এর চেম্বারে। উনি ছিলেন আবার selection committee র Chairman
আবার আমার সেই একই কথা ‘Please do something Sir‘ এবং সেই এক উত্তর ‘Sinha! Nothing could be done at this stage. The list is signed by the ED.’
মনমরা হয়ে নিজের জায়গায় ফিরে গেলাম। মন মেজাজ ভালো নেই ..ভাবছি আজ তাড়াতাড়ি কেটে পড়বো। এমন সময় GM office থেকে GM এর PA র ফোন ‘Mr. Sinha! GM is on line’ এবং আমাকে GM ফোনে জানালেন ‘Mr. Sinha. I could include one name ..Sl no.1.‘
জবাবে ‘Thank you Sir..’ মনটা সামান্য একটু ভালো হ’লো।
ভাবছি আর একজনকে কি করে ঢোকানো যায়? ইডি ই একমাত্র ভরসা।
২৪শে জুন, সকাল ৮ টা। আমি শপ ফ্লোরে। খবর পেলাম ইডি রামকৃষ্ণন সাহেব আমার শপ ভিজিটে আসছেন। ৯ টা নাগাদ GM, AGM, Sr. DGM, DGM পরিবেষ্টিত হয়ে উনি আমার শপে পৌঁছলেন। এসেই আমাকে সঙ্গে নিয়ে NTPC প্রজেক্টের কতটা অগ্রগতি হয়েছে দেখতে শুরু করলেন। আমি মনে মনে ভাবছি এই মওকা ছাড়া উচিৎ হবে না। উনার গাড়িটা আমার শপের exit point এ দাঁড়িয়েছিল। Progress review শেষ হ’লে আমার সঙ্গে করমর্দন সেরে গাডিতে উঠলেন। আমি গাড়ির ভিতর মুখ ঢুকিয়ে আমার সমস্যা জানালাম।
রামকৃষ্ণন সাহেব গাড়ি থেকে নেমে হাত নেড়ে আমার AGM কে ডেকে নির্দেশ দিলেন ‘Mr. Raman! please take care of Sinha’s issue and see it’s done.’
সেই মুহুর্তে মনে হচ্ছিল উনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করি।
বেলা ১২ টা। AGM এর অফিস থেকে ডাক পেলাম। Cyclostyled promotion list আমার হাতে দিয়ে অভিনন্দন জানালেন ‘Sinha! you won.’
লিস্টে শেষ দু’টো নাম হাতে লেখা। ৩৮ বছর পরও লিস্টটা আমার চোখে ভাসছে।
AGM চেম্বার থেকে বেরিয়ে আমার কেন জানি না মনে হ’লো এটা কি আমার ৩৭০ টনের পুরস্কার??
হবে হয়তো।
******
ধর্মসংকট (পঞ্চম কিস্তি)
এপ্রিল ১৯৮৪। ত্রিচিতে বসেছে অষ্টম ফেডারেশন কাপের আসর। সেই প্রথম একটা সর্বভারতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতার আসর বসতে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই গোটা BHEL জুড়ে একটা উন্মাদনা। খেলা হবে আমাদের কৈলাশপুরম থেকে ১৩ কিমি দূরে বিশপ হেবার কলেজের মাঠে। সপ্তাহের দিনগুলোতে রোজ তো আর যাওয়া সম্ভবপর হবে না। তবে মোহনবাগান ইষ্টবেঙ্গলের খেলা থাকলে সেদিন অবশ্যগন্তব্য। বছরের শুরু, তাই কাজের চাপও কম। ইষ্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা থাকলে রামকৃষ্ণণ সাহেবকে (তখন Unit Head as GM In Charge) মাঠে সাইড লাইনের ধারে ভি আই পি আসনে দেখা যাবেই যাবে। আসলে দূর্গাপুর স্টীল প্ল্যান্টে দীর্ঘদিন কাটানোর সুবাদে কলকাতা ফুটবল সম্বন্ধে উনার একটা ধারণা তৈরী হয়েছিল মনে হয়। আর আমার কপাল আমি ঠিক পিছনের গ্যালারীতেই। আমার চিৎকার তাঁর নজর এড়াতো না।
পয়লা মে ..শ্রমিক দিবস ..ছুটি ..
বছরের চারটি দিন ..২৬শে জানুয়ারি, ১লা মে , ১৫ই আগষ্ট, ২রা অক্টোবর..নিস্তব্দ্ধ ভেল, ত্রিচি। ‘৮৪-‘৮৫ র আমার শিয়রে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছিল ২০০০ টন। প্রথম মাস @এপ্রিলে ফেডারেশন কাপের দৌলতে হলো মাত্র ৪ টন।বাকি এগারে মাসে বলতে গেলে প্রায় ২০০০ টন @১৮০ টন+ প্রতিমাসে।
২রা মে.. রামকৃষ্ণণ সাহেব আমার শপ পরিদর্শনে এসে ‘Sinha! Federation cup is over. Your Mohan Bagan could not win. Why don’t you concentrate on production now?‘
আমি নতমস্তকে ‘Yes Sir‘.
নড়েচড়ে বসলাম। সামনের বছর আবার DM promotion due .
ঐ দিনই সব ক’টি ইউনিয়ন নেতাদের ডেকে মে দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে সবাইকে লক্ষ্যমাত্রা @২০০০ টন পূর্ণ করার তাগিদে একজোট হ’য়ে কাজ করতে আবেদন রাখলাম। উপস্থিত সকলের কাছ থেকেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের অঙ্গীকার পেলাম। BHEL ত্রিচিতে ছোট বড় মিলিয়ে এক ডজন ইউনিয়ন ছিল। DMK, AIADMK, CITU, INTUC, AITUC, BMS ছাড়াও ছিল High Pressure Welders’ Association, Pressure Welders’ Association, Fitters’ Association ইত্যাদি। আমার অধীনে প্রায় সব ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাই ছিল। তাতে যেমন সুবিধা ছিল, সমস্যাও ছিল অনেক। ইউনিয়ন থাকলেই থাকবে Inter Union Rivalry।
৩রা মে ..সকাল ৮ টা নাগাদ শপ ফ্লোরে দাঁড়িয়ে আছি। Worker রা আস্তে আস্তে নিজের জায়গায় জমায়েত হচ্ছে। তারই মধ্যে ছোটখাটো এক নেতা আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে আস্তে করে তামিলে জানিয়ে গেল ‘স্যার। আজ সুব্বু কাজে আসেনি কিন্তু ওর attendance card punch হয়েছে।’ সত্যিই সেদিন সুব্বু অনুপস্থিত। কিন্তু attendance card punched..সুব্বুর অভিন্নহৃদয় বন্ধু চন্দ্রু। কেন জানিনা মনে হ’লো এটা চন্দ্রুরই কাজ। কিন্তু হাতেনাতে প্রমাণ চাই। আমি ব্যাপারটা Production Engineer এর নজরে এনে সতর্ক করে দিলাম আর Out punch এর সময় (বিকাল ৪.৩০ মি) ঘড়ির দিকে নজর রাখতে বললাম।
বিকাল ৫টা নাগাদ শপ ফ্লোরে এসে দেখি Production Engineer এর ঘরের সামনে বিরাট জটলা। আমি যেন কিছুই জানি না ভান করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে দেখি চন্দ্রু নতমস্তকে দাঁড়িয়ে। আমার অনুমান ঠিক। চন্দ্রুর কাছ থেকে লিখিত স্বীকারোক্তি নিয়ে ওকে ছেড়ে দিতে বলে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাইরে তখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে জটলা। সবার চোখে একটা ঔৎসুক্যপূর্ণ দৃষ্টি। আমি কোনও কথা না বলে বাড়ির পথে রওনা দিলাম।
বাড়ি ফিরে সন্ধেবেলায় সপরিবারে এক বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা মেরে রাত ৯ টা নাগাদ ফিরে দেথি আমার কোয়ার্টারের সামনে জনা ত্রিশেক worker দাঁড়িয়ে আছে।
‘কি ব্যাপার? তোমরা ?’
সবাই মিলে আমাকে ঘিরে আকুল মিনতি ‘স্যার ! দয়া করে দেখবেন চন্দ্রুর চাকরিটা যেন থাকে। সংসারটা ভেসে যাবে স্যার।’
PSU তে proxy punching এ ধরা পড়লে one and only punishment …termination..এটা সবার জানা। যারা এসেছে তারা সবাই আমার বিশ্বস্ত অনুগামী।
‘দেখছি কি করা যায় ..আমাকে ভাবতে দাও। তোমরা এখন ফিরে যাও।’
সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। চন্দ্রুর করুণ মুখটা বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে যেন বলছে ‘স্যার! আমাকে বাঁচান‘ আমাকে যদি আমার শপের Fitter Grade. I দের rating করতে বলা হয় চন্দ্রু অবশ্যই প্রথম পাঁচজনের একজন। সব দিক দিয়ে। আমি পড়লাম মহা ধর্মসংকটে। এমন একটা বিষয় যে চেপেও রাখা যাবে না। চেপে গেলে ফ্যাকট্রির প্রতিটি গেটে ইউনিয়নের thatti (billboard) গুলোতে আমার নামে নোটিশ পড়ে যাবে proxy punching এর পিছনে আমার হাত আছে।
পরদিন সকালে শপে ঢুকতেই বিভিন্ন ইউনিয়নের ছোট বড় নেতাদের বিভিন্ন রকম প্রশ্ন ..কেউ ‘কিছু ভাবলেন স্যার?’..আবার কেউ কেউ ‘দেখবেন স্যার কিছু যেন না হয়’ ইতিমধ্যে আমার কাছে চন্দ্রুর হস্তলিখিত স্বীকারোক্তি পৌঁছে গিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম চন্দ্রু ও সুব্বু দু’জনেই কাজে অনুপস্থিত। কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা চলে গেলাম Mr. Ethiraj, GM( Personnel) এর কাছে। স্যারকে পুরো ঘটনাটি খুলে বললাম। এও বললাম চন্দ্রু আমার একজন বিশ্বস্ত অনুগামী ও কর্মদক্ষ fitter যার ওপর আমি ভরসা রাখতে পারি। আমি ওর termination চাই না। উনি সব মন দিয়ে শুনলেন ..’Mr. Sinha! you will have to issue him a charge sheet ..let him reply. There will be an enquiry ..Committee will decide.‘
‘O.K Sir’ বলে ফিরে এলাম। Charge sheet তৈরি হ’লো কিন্তু দোবো কাকে? চন্দ্রু তো কাজেই আসছে না। Shop notice board এ সাঁটতেই হৈ হৈ পড়ে গেল। ‘Charge sheet দিয়ে দিলেন স্যার ..আর তো ওঁকে বাঁচানো যাবে না।’
আমার দু’জন অনুগামীকে চন্দ্রুর বাড়িতে পাঠালাম ..বলে দিলাম চন্দ্রুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার কাছে নিয়ে আসতে। চন্দ্রু এলো। রাত তখন ৯ টা। চোখে জল। Charge sheet হাতে নিতে অনিহা। মুখোমুখি বসিয়ে Coaxed him to accept the Charge sheet.পরের দিন General Shift Duty ( 8 AM-4.30PM)তে আসতে বললাম। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল।
চন্দ্রু কথা রেখেছিল। যথারীতি ওকে নিজের কাজের জায়গায় দেখা গেল। শপ ফ্লোরে একটা চাপা উত্তেজনা। কারুর মুখে এও শোনা গেল ‘চার্জশীট withdraw করতে হ’বে।’ ..যা খুশি ওরা বলে বলুক, ওদের কথায় কি এসে যায়? দিনের শেষে Production Engineer কে চন্দ্রুকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে বললাম। চার্জশীটের শো’কজের জবাবে অকপট স্বীকারোক্তি লিখে আমার হাতে দিয়ে করুণ এক অভিব্যক্তি যেন বলছে ‘কিছু হবে না তো স্যার?’
আমি চন্দ্রুকে বলে দিয়েছিলাম Enquiry Commission এর সামনে যেন নিজের দোষ স্বীকার করে নেয়। নির্দিষ্ট দিনে দুই সদস্যের Enquiry Commission বসলো ..একজন Personnel Officer আর একজন EII & above level Executive ..Commission এর সামনে চন্দ্রু নিজের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। Commission এর সুপারিশের ভিত্তিতে Personnel Department থেকে চন্দ্রুর নামে notice issue করা হ’লো ..এক বছরের increment @ Rs.30/- per month # Rs.360/- hold করে। BHEL, ত্রিচির ইতিহাসে এক নজির বিহীন ঘটনা যার সাক্ষী আমি নিজে। অভিনন্দনের স্রোতে ভেসে গেলাম আমি।
সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর আজকের এই দিনে @ ১মে শ্রমিক দিবস..আমার শ্রমিকময় জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
মে দিবস জিন্দাবাদ
********
আমি, রামানুজম আর গোরুর পাঁচ পা
১৯৮৮ সাল। আমি তখন ভেলের তিরুচিরাপল্লীস্থিত কর্মশালায় কর্মরত। হঠাৎ ইডি সাহেবের অফিস থেকে জরুরী তলব। হন্তদন্ত হয়ে ছুটলাম। সিনিয়র কনফারেন্স হলে ঢুকে দেখি আমার সব বসেরাই সেখানে হাজির। তাঁদের চোখের ইশারায় একটি আসন গ্রহণ করে বসলাম। কি ব্যাপার? আই এন টি ইউ সির সর্বভারতীয় সভাপতি ও ভেল বোর্ডের সদস্য মি: রামানুজম কাল বাদ পরশু ভেল ত্রিচি পরিভ্রমণে আসছেন এবং পুরো কর্মশালা পরিদর্শন করবেন। উনি ১ নং বিল্ডিং এর ১ নং পরিসর দিয়ে ঢুকে ২,৩,৪ ইত্যাদি দেখতে দেখতে মাঝের রাস্তা ধরে ১১ নং পরিসর দিয়ে বেড়িয়ে যাবেন। ১ থেকে ৪ ও ১০, ১১ নং পরিসর আমার এলাকার মধ্যে পড়ে বলে রামানুজম সাহেবের পুরো ভ্রমণসূচী সামলানোর দায়িত্ব আমার ওপরেই পড়লো। হ্যাঁ ,উনি হুড খোলা জীপে চড়ে আসবেন ঠিক হয়েছে।
যাই হোক পড়িমড়ি লেগে পড়লাম। রাস্তা পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে প্রতিটা শপ ঝকঝকে তকতকে করার কাজ শুরু হলো। আসল কাজ দু’দিন শিকেয়। হাতে মাত্র একদিন সময়। তারই মধ্যে সবকিছু শেষ করতে হবে। ১ থেকে ১১ পুরো রাস্তার দুদিকে হলুদ রঙের বর্ডার টানতে হবে। নির্দিষ্ট দিনের আগের দিন সন্ধে বেলায় ইডি রামকৃষ্ণণ সাহেব নিজে জীপে চড়ে পুরো রাস্তা টহল দিয়ে চাক্ষুস পরীক্ষা করলেন সব কিছু পরিকল্পনা মতো হযেছে কি না। পিঠ চাপড়ে সাবাসি দিলেন। নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরলাম। আগামীকাল সকাল ৯ টায় রামানুজম সাহেব প্রবেশ করবেন ১ নং বিল্ডিং এ পারিষদবর্গ নিয়ে। আমার ওপরেই বর্তালো প্রবেশ পথে ওঁকে অভ্যর্থনা জানানোর দায়িত্ব। রাতে ভালো করে ঘুম হলো না। সকাল সকাল পৌঁছতে হবে।
ভোর ছটা নাগাদ ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। ফোন তুলে বিস্ফারিত খবর। কে বা কারা মি: রামানুজমকে কালো পতাকা দেখাবে বলে পুরো রাস্তায় হলুদের ওপর কালো রং করে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়লাম। বুঝেছিলাম কার বা কাদের কাজ। কিন্তু কারুর মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারলাম না। একেই বলে শ্রমিক ঐক্য। যাই হোক আই এন টি ইউ সি সমর্থিত শ্রমিকদের সাহায্যে দু’ঘন্টার মধ্যে কেরোসিন তেল দিয়ে কালো রং তুলে আবার নতুন করে হলুদ রং লাগানো হলো। প্রভুজী এলেন, দেখলেন, চলে গেলেন। এর সাথে আমার তামিল ভাষায় বাগ্মীতার প্রশংসা করে, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করে বিদায় নিলেন। আমি ও আমার উর্ধতন কতৃপক্ষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম / বাঁচলেন।
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা করছি। বসের ফোন। বিকেল ৫ টায় MD auditorium এ মি: রামানুজমের ভাষণ সিনিয়র অফিসারদের উদ্দেশ্যে। যেতেই হবে ইচ্ছে থাক্ বা না থাক্। সর্বভারতীয় শ্রমিক নেতা সুতরাং বাগ্মীতা ও বাচনভঙ্গি নিয়ে কোনো কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। হাস্যরস মিশ্রিত ঘন্টা খানেকের সংক্ষিপ্ত ভাষণ। বলতে দ্বিধা নেই ‘নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা..অন্তরে অতৃপ্তির আবেশ, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।’
শুরু করেছিলেন এই ভাবে
“আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। আমাকে বলা হলো আপনাদের উদ্দ্যেশে কিছু বলতে। আমি বলেছিলাম আপনাদের ইডি সাহেবকে বরং আপনারা কিছু বলুন আমি শুনি। উনি আমার কথা রাখলেন না। আমার ছোট বেলার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আমি তখন প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডী পার হতে পারিনি। পিতৃদেব মোটামুটি বুঝে গিয়েছিলেন এই ছেলেটির ভবিষ্যত অন্ধকার। কিস্যু হবে না। শুধু সময়ের অপেক্ষা কখন ইস্কুল থেকে তাড়াবে। ইতিমধ্যে হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলাম হাতে একটি প্রাইজ নিয়ে। বাড়িশুদ্ধ সকলের চক্ষু চড়কগাছ আমার হাতে প্রাইজ দেখে। বাবার জিজ্ঞাস্য কে আমাকে প্রাইজ দিল আর কেনই বা দিল? আমি জানালাম আমাদের স্কুল পরিদর্শক আমাকে এই প্রাইজটি দিয়েছেন ওঁর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য। তৎক্ষণাৎ বাবার প্রশ্ন ‘পরিদর্শক মশাই কি জিজ্ঞেস করেছিলেন?‘
আমি বললাম ‘গোরুর কয়টা পা?‘
আমি উত্তর দিলাম ‘পাঁচটা।’
পরিদর্শক মশাই খুব খুশি হয়ে আমাকে এই প্রাইজটা দিলেন। বাবা বিস্ফারিত চোখে বললেন ‘তুই পাঁচটা বললি আর প্রাইজ পেলি?‘
আমি বললাম ‘কেন? ভুল কি বলেছি ? বাকিরা তো কেউ ছয়, কেউ সাত উত্তর দিয়েছিল।‘
আমার দীর্ঘ কর্মজীবনের অনেক ভুল এই গল্পটিকে ভড় করে উতরে গেছি।
BHEL Trichy ET 1976 ET batch
Mysuru Meet, February 20-22, 2024
Add comment