ঝরাপাতার দিনগুলি ………. (প্রথম পর্ব)
প্রদীপ ভৌমিক, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
জীবন যত মোহনার কাছে এগিয়ে যায়, পুরানো স্মৃতি ততই মানুষের মনে ভীড় করে। স্মৃতির পাতা কিছু ঝরে গেলেও বিশেষ কিছু স্মৃতি মনের গহনে ছাপা হয়ে যায়। চাকরী জীবনের ব্যস্ততার মাঝে সেই পুরনো দিনের কথা যেন চাপা পড়ে থাকে। অবসরের পর থেকে আবার সেটাই মনের মধ্যে অঙ্কুরিত হতে শুরু করে। স্মৃতির সঙ্গে অজান্তে কিছু কল্পনাও যেন জুড়ে যায়। পুরানো স্মৃতির মধ্যে স্কুল ও কলেজের জীবন সব থেকে মধুর। আরো মধুর করে তোলে যখন হস্টেল জীবন পাওয়া যায়। পঞ্চান্ন বছর আগে ১৯৬৯ সালে বিই কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। আবাসিক কলেজ। হোস্টেলে থেকে পাঁচ বছর পড়াশোনা করতে হবে। জেলা ও মহকুমা শহরে আমার বড় হওয়া। আর এই প্রথম কলকাতায় আসা। ভর্তি হবার আগে কিছু কিছু বাধা এসেছিল। ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে আসার আগে পূর্ববর্তী সমস্ত কাজ আমাকেই করতে হয়েছিল, কারণ আমার পিতা সেইসময় চাকরীসূত্রে ভিন্ন শহরে থাকতেন। যেমন এপ্লিকেশন ফর্ম, কলকাতায় গিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়া, ইন্টারভিউ ইত্যাদি। আমরা ভাইবোনেরা মার অভিভাকত্বে জেলাশহরের এক প্রান্তে থাকতাম। বাবা আমার ইচ্ছের কথা কিছুই জানতেন না। মা জানতেন। যখন কলেজে ভর্তি হবার চিঠি এলো বাবাকে জানাতেই হলো। বাবার আপত্তি হস্টেলে থাকবার বিষয়টি নিয়ে। কারনটা ছিল অর্থনৈতিক। আমরা অনেক ভাইবোন। পূর্ববঙ্গ থেকে সবকিছু ছেড়ে আসাতে আমার পিতাকে আবার প্রথম থেকে ভবিষ্যত শুরু করতে হয়েছিল। বহু বছর ধরে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল মোটামুটিভাবে এক জায়গায় এসে দাঁড়াতে। আমাকে ছাড়া অন্যান্য ভাইবোনের পড়াশোনার চিন্তাও উনাকে করতে হয়েছিল। যাইহোক অনেক আলোচনার পর বাবা রাজী হলেন। সেই সময়কার সরকারী কলেজের কম খরচা বাবাকে কিছুটা আশ্বস্ত করেছিল। প্রথমে আমার ইচ্ছে ছিল যাদবপুরে পড়বার। প্রবেশিকা পরীক্ষায় আমার সীট পড়েছিল যাদবপুরে। যাদবপুর ইঞ্জিনীয়ারিংএ উত্তীর্ণ ছাত্রদের তালিকায় আমার নামও উঠেছিল। আসল ইচ্ছে ছিল কলকাতায় থেকে শহরটাকে ভালভাবে দেখা। আমার এক জ্যাঠামশাই বললেন, যাদবপুরে রাজনীতি হয় আর প্রায়ই গন্ডগোল লেগে থাকে। উনি উপদেশ দিলেন শিবপুর বিই কলেজে ভর্তি হতে। সেই মত বিই কলেজে ভর্তি হলাম। হায়রে! তখন কি আর কেউ জানতো যে সত্তর দশকের রাজনীতির আঁচ এখানেও এসে পরবে না!
যাইহোক টিনের স্যুটকেস ও বিছানাপত্তর নিয়ে ডাউনিং হস্টেলে হাজির হলাম। দোতলায় একটা ঘরে আরো তিন জন আমার রুমমেট। শশাঙ্ক, মনোজ ও সুশান্ত। প্রাথমিক আলাপে জানতে পারলাম শশাঙ্ক দমদমে থাকে, মনোজ বেহালার, সুশান্ত (মামা) বাঁকুড়ায় আর আমি বর্ধমানের। শুনলাম হস্টেলের সুপার কামদাবাবু পরিবার নিয়ে কোয়ার্টারে থাকেন আমাদেরই এই দোতলায়, আমাদেরই একটা ঘর ছাড়িয়ে। প্রথম কয়েকদিন ছিল আমাদের হানিমুন পিরিয়ড। অর্থাৎ র্যাগিং পিরিয়ড। এই নিয়ে পরে কিছু বিবরণ আছে। এই হনিমুন পিরিয়ডের মধ্যেই আমাদের ক্লাশ শুরু হলো। মনে আছে প্রথম গেটের দোকান থেকে ড্রয়ংবোর্ড কিনে ফেরার পথে বগলে বোর্ড নিয়ে হেঁটে আসতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। বেঁটে মানুষ। হাতের আঙ্গুল বোর্ডের অন্যপ্রান্তে পৌছাতে অসুবিধা হচ্ছিল। দেবু (ছিট) বোর্ডটা আমার কাছ থেকে নিয়ে হস্টেল পর্যন্ত পৌছে দিয়েছিল।
কলেজ, বা হস্টেল যাই বলি, সেখানে গিয়ে প্রথমেই আলাপ হলো মানসের সঙ্গে। একসঙ্গেই আমাদের দুজনকে র্যাগিং করা হয়েছিলো। র্যাগিংএর বাড়াবাড়িতে আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে নিজেদের দুঃখের কথাই আলোচনা করেছিলাম। আমার গোঁফের একটা দিক কাটা। র্যাগিং এর সময় রেজর দিয়ে কেটে দিয়েছে আমাদের সিনিয়ার এক দাদা। মানস একসময় বলল যে, জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে এই কলেজ ছেড়ে দেবে। এরপর ধীরে ধীরে ওকে self assertive হতে দেখেছি। পরে ও আমাদের CR (ক্লাশ রিপ্রেজেন্টেটিভ ) ও ফাইনাল ইয়ারে SME র (Society of Mechanical Engineers) General Secretary (GS) হয়েছিল। দিন কয়েকের মধ্যে অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গেও আলাপ হল, শশা (শশাঙ্ক), ছিট (দেবব্রত), মামা (সুশান্ত), মোল্লা মনোজ), হোড় (তরুন) ,মাতাল (স্বপন), টাটা (চন্দন ভৌমিক), প্রভাত, সঞ্জয়, অজয় (ভগা), আশীষ, ক্ষমাদাস, অজয় (বুড়ো), অমিত ও কিশলয়।
টাটানগর থেকে এসেছিল, তাই চন্দনের নাম ‘টাটা’। স্বপনের নাম ‘মাতাল’ কারন হাঁটার সময় মাথাটা দুলতো। আশিষ গাড়ী নিয়ে গল্প করতো। ওর এক কাকা আমেরিকা থেকে এসে আমাদের কলেজে প্রফেসর হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। আমেরিকা থেকে উনার গাড়ীটাও নাকি জাহাজে করে আমাদের দেশে নিয়ে এসেছিলেন। ক্ষমাদাস খুব ফিটফাট থাকতো। কোঁকরানো চুলের খুব যত্ন করতো। আর মাঝে মাঝে হাসি হাসি মুখে টুকটাক মজার কথা বলতো। কার্পেন্ট্রি শপের ইন-চার্জ বর্মন স্যার ছিলেন সম্ভবত ক্ষমাদাসের কাকা। সঞ্জয়ের বাড়ী ছিল কৃষ্ণনগরে। শুনেছিলাম ওর বাবা বয় চ্যাটার্জী হাফ প্যান্ট পড়ে ঘুরে বেড়াতেন। পাইকপাড়ার অজয় চক্রবর্তী (বুড়ো) গম্ভীর মুখে বাতেলা মারতে ওস্তাদ। এখন আমেরিকার বাসিন্দা। আর একজন মজার ছেলে ছিল – উৎপল মিত্র (পাগলা)। হয়তো গম্ভীর হয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে, পরক্ষণেই কারো পেছনে কাঠি করে হাসি-মজায় পরিবেশটা ভরিয়ে দিত। পাড়ার মাস্তানদের কথাবার্তার স্টাইল নকল করতো। মহম্মদ রফির গানের ভক্ত ছিল। কিশলয় সুধীন দাশগুপ্তর কাছে গান শিখতো আর হেমন্ত মুখার্জীর গান ভাল গাইতো। ওর বাড়ী ছিল হরিনাভিতে। আর আমাদের মামা ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। এই দুইজনই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। মামা আর টাটা। টাটার সঙ্গে শনিবার-রবিবার অনেক সময় কাটিয়েছি। শনিবার এলে কলকাতাবাসী বা কাছাকাছি যারা থাকতো, তারা বাড়ী চলে যেত। আর আমাদের হস্টেল দু’দিনের জন্য প্রায় খালি হয়ে যেতো।
কলেজ ছাড়ার পর পাগলার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। কয়েকবছর আগে ক্ষমাদাসের কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে পাগলাকে ফোন করছিলাম। কলকাতায় থাকে। ফোন পেয়ে ছাড়া ছাড়া ভাবে কিরকম যেন প্রশ্ন-উত্তর দিল বা করলো। কথায় কোন উচ্ছ্বাস আছে বলে মনেই হলো না। মনে হলো কোন কারনে ওর মানসিকতার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কথাবার্তা বেশিদূর আর এগোয়নি। ফেসবুকে একদিন সৌরভের ছবি দেখলাম। মনে হল পরিবারের সঙ্গে তোলা ছবি। চেহারা মোটামুটি একই আছে। উত্তেজিত হয়ে কমেন্ট লিখলাম আমাদের ডাউনিং হস্টেলের ঘটনা নিয়ে। ফোন নাম্বার চাইলাম। উত্তর পাইনি। এরপর ফেসবুকে ওর কোন পোস্ট দেখিনি। আমাদের জীবনের সঙ্গে নদীর অনেক কিছু সাদৃশ্য আছে। প্রকৃতির কারনে নদী পাড় ভেঙ্গে নতুন গতিপথ তৈরি করে। এক পাড় ভেঙ্গে অন্য পাড় তৈরি হয়। মানুষের জীবনেও এই ধরনের ঘটনা ঘটে।
হোস্টেলে আসবার পর আরও অনেকের, বলতে গেলে প্রায় প্রত্যেকেরই একটা করে নাম দেওয়া হয়েছিল। অথবা বড় নাম হলে নামটা ছোট করে দেওয়া হয়েছিল। এইসব নাম দেবার পিছনে মজার মজার ঘটনাও থাকত। যেমন মনোজ হস্টেলে চেক চেক লুঙ্গি পরে থাকত বলে ওর নাম ‘মোল্লা’। শশাঙ্ক হয়ে গেলো ‘শশা’। দেবুর ‘ছিট’ নাম দেবার ঘটনাটাও অকস্মা। আমরা ডাউনিং হোস্টেলে সবে এসেছি। আমি, সৌরভ, দেবু ও অন্য কয়েকজন ব্যাতাইতলা বাজারে ঘুরছি কিছু কেনাকেটার জন্য। সৌরভ শান্তভাবে হাসি হাসি মুখে মজার মজার কথা বলতে পারত। ওর চেহারাটাও সুন্দর ছিল। দেবু সৌরভের কাঁধে হাত রেখে হাটতে হাটতে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। আর মুখ দিয়েও সমানে স্প্রে করে যাচ্ছে। আমরা একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সাইনবোর্ডে লেখা ‘ছিট কাপড়ের দোকান’। সাইনবোর্ড দেখে সৌরভ হঠাৎ দেবুকে বলল – শোন আজ থেকে তোর নাম ‘ছিট’। সৌরভের নাম দেবার ভঙ্গিমা দেখে আমরা তো হেসেই কুপোকাত। আর এই নামটাই কলেজে বিখ্যাত হয়ে গেলো। এই খ্যাতি সুদূর মুম্বাইতেও ছড়িয়ে পরল যখন আমরা B.A.R.C মুম্বাইতে চাকরি নিয়ে গেলাম। তবে সবাই ওকে খুবই পছন্দ করত ওর খোলাখুলি সরল ব্যবহারের জন্য। চাকরি সূত্রে ও সিঙ্গাপুরে থাকতো। সিঙ্গাপুরে বেড়াতে গিয়ে দেখি এই নামেও সে ওখানে বেশ পরিচিত।
হোস্টেলে আমাদের কোন বিতর্কের সময় সত্যেশ অনুঘটকের কাজ করে বিতর্ককে ঝগড়ায় পরিনত করে দিত। ওর নাম হয়ে গেল ‘পলতে’। জানিনা ওর নামটা কে দিয়েছিল। হোড়ের (তরুন) বাবা আর্মির মেজর ছিলেন। তাই অনেক সময় ওকে মেজর বলেও ডাকতাম। কথাবার্তায় বেশ শক্ত সামর্থ বলেই মনে হতো। প্রথম বছরে আমরা কারপেন্ট্রি শপে প্র্যাক্টিকাল ক্লাশে হ্যামার, চিজেল ইত্যাদি দিয়ে কাঠের কাজ করছি। কাজ করতে করতে হোড়ের হাত কেটে রক্ত বেরোতে লাগল। রক্ত দেখেই ও অজ্ঞান। এম্বুল্যান্স ডেকে ওকে কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হল। কয়েক ঘন্টা পর হাসতে হাসতে উনি হোস্টেলে ঢুকলেন। হাতে ব্যান্ডেজ।
ডাউনিং হস্টেল বিই কলেজের প্রথম ছাত্রাবাস। তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকে। নামকরণ হয়েছিল প্রথম প্রিন্সিপাল এস এফ ডাউনিং র নামে। এই হস্টেলে থাকবার সময় মজার মজার কিছু ঘটনা ঘটেছিল। লোডশেডিং এর একরাতে প্রভাতের কাঁধে একজন চাপলো। প্রভাত এমনিতেই ৬ ফুটের উপর লম্বা। তার কাঁধের উপর একজন উঠে জনতার মুখে টর্চ লাইট ফোকাস করে ঘুরে ঘুরে ভয় দেখাবার চেষ্টা করেছিল। এমনিতেই গল্প আছে ডাউনিং সাহেবের ভূত নাকি রাত্রিবেলায় ডাউনিং হস্টেলের প্যাসেজে ঘুরে বেড়ায়! ব্যাপারটা বেশ জমেছিল – দশফুট লম্বা ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরেকটা ঘটনা কয়েকবার ঘটেছিল যেটা নিয়ে বিষদভাবে লিখে বর্ণনা না করাই ভালো। ভদ্রভাষায় বলতে গেলে আমাদের দোতলার ফ্লোরের (পশ্চিম) সঙ্গে নীচের তলার ফ্লোরের মধ্যে গালাগালি কম্পিটিশন। সিঁড়ির মুখে উপরে তলায় একটা দল আর সিঁড়ির অপর মুখে নীচের তলায় আরেকটা দল। এটা সাধারনত হতো রাত্রিবেলায় ডিনারের পর। দুই দলের মধ্যে কিছুক্ষন গালাগাল চলতো। তারপরই যে যার ঘরে। এই সমস্ত ঘটনা এখন মনে এলে হাসিও পায়। সতেরো বছর বয়সে কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষনে উজ্জীবিত ঘরছাড়া অপার স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ছেলেদের পাগলামি সত্তরোঊর্ধ বয়সে স্থির জীবনে কিছুক্ষন হলেও মনকে দোলা দেয়।
ব্যারাকের রাম’দাকে খুব মনে পড়ে। চেহারাটা রসগোল্লার মত গোলগাল শান্তশিষ্ট। মুখে সদাই হাসি। পড়নে খাটো ধুতি ও হাফ শার্ট। বাড়ী ছিল বিহারের মজঃফরপুরে। আমরা সবাই ওকে পছন্দ করতাম। ডাউনিং-এ আমাদের ব্লকে (দোতলায় বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিক) সকালের ব্রেকফাস্ট ও বিকেলের জলখাবারের ব্যবস্থা করত। বিকেলে নানারকমের চপ, সিঙ্গাড়া, মিষ্টি নিয়ে আসতো, আর রবিবার বা ছুটির দিনে ব্রেকফাস্টে আসতো সিঙ্গারা-জিলিপি। একদিন বিকেলে তিন রুমমেট (শশা, মোল্লা ও আমি) কলেজ থেকে ফিরে ঘরে বসে গল্প করছি। শশা ছিল খাদ্যরসিক। খুঁজে খুঁজে দেখতো কি কি মিষ্টি আনা হয়েছে। তারপর একে একে ওর প্লেট ভরে নিত। শশা’র দেখাদেখি আমিও একটা দুটো মিষ্টি খেয়ে নিতাম। মাথায় রামদার মাসিক বিলের কথাও ঘুর ঘুর করতো। যাইহোক, বিকেলের খাবার পর রাম’দা আমাদের ঘরে চা নিয়ে এসেছে। আমাদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলছে। এই সময় হঠাৎ কাপ ডিশ ভাঙ্গার শব্দ। রাম’দা প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল – এই রে, ছিট বাবু এসে গেছে! রাম’দা কাপ ডিশ মেঝের একধারে রেখে ছিল। ছিট তখন রামদা রামদা বলে চিৎকার আর গান গাইতে গাইতে কলেজ থেকে ফিরছে, মানে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। আমরা কাঠের সিড়িতে ওঠার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এমন সময় ছিটের পায়ে লেগে রাম’দার কাপ ডিশগুলো ভেঙ্গে গেলো। ছিটেরও দোষ ছিল না। ও হাই পাওয়ারের চশমা পরত। চশমার ফোকাসে হয়ত সেটা আসেনি। এই ছিট’কে নিয়েও অনেক মজার মজার ঘটনা ঘটেছিল আমাদের কলেজ জীবনে। তবে ছিটের অনেক ভালো গুনও ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং ভালো বুঝতো ও আমাদের এই ব্যাপারে সাহায্যও করতো। ভাল সাঁতারু ছিলো। কলেজে সাঁতার প্রতিযোগিতায় মেডেলও পেয়েছিল। দশ নম্বর হস্টেলে যখন এলাম একই ঘরে তিন বছর ছিলাম শশা, মোল্লা, ছিট আর আমি। দশ নম্বর হস্টেলে ছিল আশু’দা। আমাদের ফ্লোরে ব্রেকফাস্ট ও বিকেলে টিফিনের ব্যবস্থা করতো। সেই আশু’দা ছিল মজার লোক। মেদিনীপুরে বাড়ী। একটা লুঙ্গি ও হাতওয়ালা গেঞ্জি পরেই থাকতো। চোখে চশমা। রোগা মত কালো চেহারা। তার মুখটা এখনও মনে পড়ে। মাঝে মাঝে আশুদা গম্ভীর ভাবে বলতো – দাদাবাবু তোমরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে যেওনি। ওখানে ডাকিনী-যোগিনীরা ঘোরাফেরা করে। ধরা পড়লে ওরা তোমাদের চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। আমরা সবাই আশুদার কথা শুনে উপভোগ করতাম আর হাসতাম।
আবার ডাউনিং হস্টেলে ফিরে যাই। সেবার ১৯৬৯ সালে ইডেন গার্ডেনে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ। আমরা প্রায় দশ বারো জন বন্ধু ঠিক করলাম খেলা দেখতে যাবো। রাতে খাবার পর ৫৫ নং বাস ডিপোর দিকে যাচ্ছি, বেশ হই চই করে স্লোগান দিতে দিতে – যাচ্ছে কারা? বি ই কলেজ। দেখলাম কামদাবাবু তাঁর দোতলার কোয়ার্টারের জানলা থেকে উঁকি মেরে আমাদের দেখছেন। উনাকে দেখে স্লোগানের আওয়াজটা বেশ বেড়ে গেল। এসপ্লানেডে এসে ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দিলাম। স্টেডিয়ামের টিকিট কাউন্টারে আমরা লাইনে দাড়ালাম। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইন লম্বা হতে লাগলো। ডিসেম্বর মাসের ঠান্ডায় সারারাত আমরা লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। গল্প করছি আর মাঝে মাঝে চা সিগারেট খাচ্ছি।
বিই কলেজের ক্যাম্পাসের সবথেকে পুরনো স্থাপত্য ১৮২০ সালের, এখনের নাম মধুসূদন ভবন।
ইডেন গার্ডেনে টিকিটের জন্য সারারাত্রি লাইন দিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। খেলা দেখার অদম্য ইচ্ছা খোলা আকাশের নীচে সেই ডিসেম্বর মাসের শীত আমাদের কাবু করতে পারেনি। কাবু করলো পরবর্তি ঘটনা। ভোরবেলায় কিছু লোক জোর করে লাইনে ঢোকার চেষ্টা করছে। ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেল। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। লাইনের কিছু লোক মাটিতে পড়ে গেল। ওদের উপর দিয়েই বাইরের লোকজন লাইনে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগলো। অবস্থা সামাল দিতে ঘোড়াপুলিশ এলো। পুলিশের লাঠির ব্যবহার শুরু হলো। পরিস্থিতি এত খারাপ হল যে আমরা লাইন থেকে ছিটকে গেলাম। পায়ের জুতো খুলে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। সাইড ব্যাগে কিছু ডিম সেদ্ধ, পাউরুটি, মাখন এনেছিলাম, মাঠে বসে খেলা দেখার সময় খাবো। সেই ব্যাগও হাত থেকে ছিটকে গেল। ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে আমরা হোস্টেলে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনেকের পায়ের জুতো নেই। আমার গায়ে কোট অথচ পায়ে জুতো নেই। হস্টেলের আর যে সব বন্ধুরা সঙ্গে এসেছিল তাদের নাম এখন আর এখন মনে করতে পারি না। পঞ্চান্ন বছর আগেকার ঘটনা স্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে গেছে। তবে আবছা ভাবে মনে আছে প্রভাত লাইনে দাড়িয়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। জানিনা স্মৃতি ঠিকমত কাজ করছে কি না! প্রভাত হয়তো এবিষয়ে আলোকপাত করতে পারবে। আমরা এসপ্ল্যানেডে ৫৫ নং বাস টার্মিনাসের দিকে হাটতে শুরু করলাম। বিধানসভা ভবন ও আকাশবাণী ভবনের পাশে দেখলাম শয়ে শয়ে জুতো বিক্ষিপ্ত ভাবে রাস্তায় ছড়িয়ে আছে। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এই ছবি পরের দিন ছাপা হয়েছিল। চারিদিকে পুলিশ। আমরা এসপ্ল্যানেডে ৫৫ নং বাস ধরে বোটানিক্যাল গার্ডেনের বাস টার্মিনাসে নামলাম। খালি পায়ে হেঁটে হস্টেলের দিকে আসছি। যেটা ভয় পাচ্ছিলাম সেটাই হলো। সামনাসামনি কামদাবাবু। আপাদমস্তক আমাদের উদ্ভ্রান্ত চেহারাগুলো দেখলেন। হয়ত গতরাত্রের শ্লোগানের সঙ্গে আমাদের চেহারা মিলিয়ে দেখছেন। দেখা হতেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন এবার বলো-‘আসছে কারা’? আমরা চুপচাপ মাথা নীচু করে হস্টেলে ফিরে এলাম।
হস্টেলে ফিরে দেখি আর এক চমক। বর্ধমান থেকে বাবা এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে আমার ভাই। বাবা আমার সেই বিধ্বস্থ চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। আমি সব বুঝিয়ে বললাম। রাম’দা বাবা-ভাইকে বসিয়ে যত্নআত্তি করেছিল। সকালের চা-জলখাবার দিয়েছিল। বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাসে উঠিয়ে দিয়ে এলাম। ইতিমধ্যে রেডিওর খবরে জানতে পারলাম – ছয়জন ছেলে ভীড়ের চাপে ইডেন গার্ডেনে মারা গেছে। খুব দুঃখ হলো ভেবে যে, খেলা পাগল তরতাজা কয়েকটি ছেলের অন্তিম পরিনতি শুনে। মৃতদের মধ্যে আমাদের কলেজের কেউ ছিল না। পরে খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারলাম যে একদিন বাদ দিয়ে খেলা যথারীতি শুরু হয়েছিল। খেলা শুরু হবার আগে দুই পক্ষের খেলোয়াড়রাই কয়েক মিনিটের নীরবতা পালন করেছিলেন মৃত ছেলেদের প্রতি শোকপালনের উদ্দেশ্যে। এই বেদনাদায়ক দিনটা ছিল সম্ভবতঃ ১৯৬৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। শর্মিলা ঠাকুর খেলা দেখতে মাঠে এসেছিলেন। নবাব পতৌদি তখন ভারতীয় দলের অধিনায়ক। এই টেস্ট ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া জয়লাভ করে।
Players wait in the middle for order to be restored at the end of the Test between India and Australia in Calcutta •Dec 16, 1969• (Source ESPNcricinfo Ltd.)
Interest in the fourth Test, at Eden Gardens, was high but Australia took a 123-run first-innings lead and then dismissed India for 161, winning by ten wickets. Huge crowds flocked to the ground every day, but on the fourth (and as it happened final) day, tragedy struck, when around 25,000 people who had been queuing patiently all night tried to rush the ticket counters shortly before they opened. Riot police fired teargas and in return were met with a hail of bottles and stones. Six people died and another 30 were injured. As had been the case three years earlier when there were similar scenes during a West Indies Test, it was widely blamed on the mass of black-market tickets in circulation.
Although play started on time, there was further trouble when spectators in the top tier of a stand started pelting stones at those in the lower tier, forcing them onto the pitch in a bid to escape. After a 15-minute delay police persuaded them to stay on the boundary edge so the match could be concluded. After Stackpole hit the winning runs, the Australian batsmen flanked the Nawab of Pataudi, India’s out-of-form captain, as he left the field, to try to protect him from missiles being aimed at him by the members.
আমাদের পাঁচ বছরের কলেজ জীবনে ডাউনিং হস্টেলের সেই একবছর ছিল নানা ঘটনায় বৈচিত্রপূর্ন। নানা মজার ঘটনা আমাদের জীবনকে আনন্দময় করে তুলেছিল। আগেই লিখেছি ডাউনিং আবাসিক হলের অধিকর্তা ছিলেন কামদাবাবু। দ্বিতলে উনার আবাসনের সামনে লাইন দিয়ে পর পর ছাত্রদের থাকবার ঘর। আমারা যে ঘরে ছিলাম সেটা উনার আবাসন থেকে প্রথম বা দ্বিতীয় ঘর। ঠিক মনে নেই। উনি ছিলেন অত্যন্ত ছাত্রবৎসল, ফিজিক্স পড়াতেন। তবে আমাদের ক্লাশে অন্য একজন পড়িয়েছিলেন। ভালমানুষ ছিলেন, কিন্তু হস্টেলের ছেলেদের উত্যক্তায় মাঝে মাঝেই উনি মেজাজ হারিয়ে ফেলতেন। কাছাকাছি থাকতাম বলে আমরা কিছু কিছু ঘটনার সাক্ষী ছিলাম। অনেক ঘটনাই স্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেছে। একটা ঘটনার কথা কিছুটা মনে আছে। উনার মেয়ে কলেজে পড়াশোনা করতো। কামদা বাবুর ছোট মেয়ে চটি জোড়া বাইরে ফেলে দেয় ছিঁড়ে যাওয়া বা পুরনো হয়ে যাবার জন্য। ডাউনিং হস্টেলে তুষার ঘোষ (দাদা) আমদের ব্যাচে ছিল। শুনেছিলাম সে বিএসসি পাশ করে এসেছিল। কিছুটা বয়সে বড় বলে হস্টেলের অন্যান্য ছেলেদের উপর দাদাগিরি ফলাবার চেষ্টা করতো। মাঝেমাঝে গালাগালিও। তবে সে গালাগালি ছিলো ভালবাসার খিস্তি। সবাই ওকে দাদা বলেই ডাকতো। সাহস ছিল। কাউকে খুব একটা তোয়াক্কা করতো না। সেই দাদা কারো সঙ্গে বেট লড়ে কামদা বাবুর ছোটমেয়ের ছেঁড়া চটিটা মুচির কাছ থেকে সারিয়ে নিয়ে উনার বাড়ীর সামনে এসে দরজায় আওয়াজ করল। কামদাবাবু দরজা খুললেন। দাদা কামদাবাবুকে বলল – স্যার আপনার মেয়ের চটিটা নিচে পড়ে গিয়েছিল! আমি নিয়ে এসেছি। আমরা দূর থেকেই ব্যাপারটা উপভোগ করছি। কামদাবাবু প্রথমে হতভম্ব হয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর বাড়ীর ভিতরে গিয়ে ব্যাপারটা অনুধাবন করবার চেষ্টা করলেন। ফিরে এসে ভীষনভাবে রেগে চীৎকার করে দাদাকে কিছু বললেন। কি বলেছিলেন এখন আর মনে নেই। তবে দাদার সামনে দরজাটা শব্দ করে বন্ধ করে দিয়ে ছিলেন। সেই দাদা ইহলোক ছেড়ে গেছে কয়েকবছর আগে। তবে দাদাকে সবাই মনে রেখেছে তার সোজাসাপটা কথা বলার জন্য আর মজার মজার ঘটনা ঘটানোর জন্য।
আমাদের সেই অলকা, ঝর্ণা সব আজ বন্ধ হয়ে গেছে।
হিন্দী সিনেমা আরজু দেখতে গেছি। সম্ভবতঃ মায়াপুরী বা অলকা সিনেমা হলে। সেই সময়ের বেশ হিট সিনেমা। নায়ক নায়িকা রাজেন্দ্রকুমার ও সাধনা। ভাল ভাল গান ছিল। সন্ধেবেলায় হস্টেলে ফিরে আমরা রাম’দার কাছে বিকালের চা-জলখাবার খেয়ে ছিটের ঘরে আড্ডা মারতে বসলাম। ছিটের অন্যান্য রুমমেটরা ছিল পাগলা, অমিত ও কিশলয়। আড্ডা হচ্ছে আরজু সিনেমা নিয়ে। পাগলা আর অমিত তখন সিনেমার একটা গানের দৃশ্য recreate করবার চেষ্টা করছে। পাগলা (উৎপল) সাধনার রোলে আর অমিত রাজেন্দ্রকুমার। নায়িকা পাগলার পরনে একটা গামছা, আরেকটা গামছা ঘোমটার মত করে পড়া। অন্যদিকে অমিত একটা গামছা পরে নায়কের ভূমিকায়। আমরা দর্শক। কারো পরনে জাঙ্গিয়া, কারো পরনে গামছা। সিনেমায় একটা গান ছিল ‘ছলকে তেরি আঁখো সে শরাব ………..’। অমিত নায়কের ভূমিকায় লিপ দিয়ে অভিনয় করে গানটা গাইছে আর পাগলা নায়িকার ভূমিকায়। সিনেমায় নায়কের হাতে একটা ছড়ি ছিল। অমিত একটা ছাতা নিয়ে হাত পা নাড়িয়ে গানটা গাইতে গাইতে রোমান্টিক ভঙ্গিমায় পাগলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর পাগলা লজ্জা লজ্জা ভাব করে অমিতের দিকে তাকিয়ে ঘোমটার আড়ালে অভিনয় করছে। রাম’দাকে দেখলাম লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খুব মজা করছি আর হাসাহাসি করছি। দুইজনকে বাহবা দিচ্ছি। এইভাবে কতক্ষণ চলেছিল ঠিক মনে নেই। হঠাৎ মনে হল দরজার কাছে একজন দাড়িয়ে আছে। আলো ছায়াতে মুখটা ভাল দেখা যাচ্ছে না। গান সাময়িক ভাবে থেমে গেল। দেখি ছিট গামছা ঠিক করতে করতে দৌড়ে গেল দরজার দিকে। বাবাকে নিয়ে দরজার বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষন পরে গম্ভীর মুখে ছিট ফিরে এল। ফিরে এসে চুপচাপ, কথাই বলছে না। পরের সপ্তাহে বাড়ী থেকে ফিরে বাবার প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছিল। কলেজের পরিবেশ ও ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিটের মায়ের কাছে উনি নাকি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
ডাউনিং এ একদিন শঙ্কর T- Square হাতে নিয়ে গীটার বাজাবার ভঙ্গিতে সিনেমার নায়কের মত করে গাইছে ‘নি সুলতানা রে প্যার কা মৌসম আয়া ….’। উনি ‘প্যার কা মৌসম’ সিনেমাটা দেখে এসেছেন! সিনেমার নায়ক শশীকাপুরের স্টাইলে গান গাইতে গাইতে অভিনয় করে চলেছেন! তবে ওর চেহারাটা অবশ্যই নায়কচিত ছিল।
প্রথম বছরেই আমাদের বিয়ার পান করবার অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। চার-পাঁচ জন বন্ধু মিলে কলকাতার সাহেবপাড়ায় ‘নিউ এম্পায়ার’ সিনেমা হলে ইংরাজী ছবি দেখতে গেছি। সিনেমা শুরু হবার দেরী ছিল। অজয় (বুড়ো) বলল, চল বিয়ার খাওয়া যাক। সিনেমা complex র চারতলায় একটা বার ছিল। অজয় একটা বিয়ার কিনল। আমরা কয়েকজন ভাগ করে খেলাম। একটু তেতো তেতো লেগেছিল। নিজেদেরকে একটু নেশাগ্রস্থও মনে হচ্ছিল। একে অপরকে প্রতিক্রিয়ার কথা জিজ্ঞেস করছি। প্রথম অভিজ্ঞতা বলে কথা, তাও আবার সাহেবপাড়ায় বসে খাওয়া! হোস্টেলে ফিরে এসে নিজেদেরকে নায়কের মত মনে হচ্ছিল! অজয় (বুড়ো) ছাড়া সেদিনের মদ্যপানের অন্যান্য সাথীদের নাম অতল স্মৃতির আঁধারে হারিয়ে গেছে। অজয় বুড়োর বাড়ি ছিল নর্থ কলকাতার পাইকপাড়ায়। প্রতি সপ্তাহে শনিবার রবিবার বাড়ী যেত। বেশ বাতেলাবাজও ছিল। একদিন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, হেমা মালিনী নাকি ওদের আত্মীয়! অবাক হয়ে শুনছি। ও গম্ভীর ভাবে বলে চলেছে – আমাদের সারনেম চক্রবর্তী, আর হেমা মালিনীর সারনেমও চক্রবর্তী! তখন কি আমরা জানতাম যে তামিলদের মধ্যেও চক্রবর্তী সারনেম আছে! মাঝেমাঝেই ও অনেক ঢপ আমাদের মাঝখানে ছেড়ে দিত। এখন ও আমেরিকার বাসিন্দা। এতদিন বাদে ২০২৩ সালের জানুয়ারী মাসে আমাদের ‘৭৪ ব্যাচের বাৎসরিক পিকনিকে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
এরপর দশ নম্বর হস্টেলে এসেও আমাদের জীবন বেশ আমোদে-আনন্দেই কাটছিল। একদিন তিন-চার জনের দল বটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে গেছি। ওখানেই হাওড়া গার্লস কলেজের সমসংখ্যক মেয়েদের একটা দলের সঙ্গে পরিচয় হলো। হোড়কে (তরুন) দেখলাম বেশ সপ্রতিভ হয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে। বাকি আমরা ছিলাম দোহার। মাঝে মাঝে কথাবার্তার মাঝখানে ঠেকা দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেদিনের আমাদের দলের অন্যান্য বন্ধুদের নাম মনে করতে পারছি না। হোড় (তরুন) যদি এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে! এইভাবে আরো দুই একবার আমাদের বটানিক্যাল গার্ডেনে দেখা হয়েছিল। বিশাল বটবৃক্ষের নীচে গল্পগুজব ও চা-ঠান্ডা পানীয় খাওয়া হলো। একদিন ঠিক হলো আমরা সিনেমা দেখতে যাবো। মেয়েরা বললো ‘আরাধনা’ দেখবে বঙ্গবাসী সিনেমা হলে। হাওড়া ময়দানের কাছে এই সিনেমা হল। সেই সময়কার সিনেমায় তখন রাজেশ খান্নার যুগ। মেয়েদের কাছে দেখলাম যে রাজেশ খান্নার ছবি সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। সিনেমা দেখার পর সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে চা-জলখাবার খেলাম। এরপর কোন অজানা কারনে আমাদের আর দেখা হয়নি। জানিনা হোড় (তরুন) এবিষয়ে আলোকপাত করতে পারবে কি না !
আমাদের মেসের সারা মাস প্রতিরাত্রে বোকা পাঁঠার দুই-এক টুকরো মাংস বা ডিম আর দিনের বেলায় ছোট এক টুকরো মাছ খেয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে যেতাম। তাই মাসের একদিন রাতের গ্র্যান্ড ফিস্ট ছিলো একটা হৈ চৈ করার দিন (রাত)। এই দিনটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম। ডাইনিং হল সেজে উঠতো। বেশি লাইট দিয়ে ডাইনিং হলকে আরো বেশি আলোকজ্বল করা হতো। হস্টেল জুড়ে একটা উৎসব উৎসব ভাব। এই হস্টেলেই থাকতে আমার এক পিসতুতো ভাই, সে বাড়ী থেকে (বালিগঞ্জ) রেকর্ড প্লেয়ার ও রেকর্ড নিয়ে আসতো। গান বাজতো আর সঙ্গে নাচ। সেই সময়কার বাংলা সিনেমা ‘নিমন্ত্রন’ ছবির একটা লোকগীতি ‘চ্যাং ধরে ব্যাং আর ব্যাং ধরে চ্যাং ………..’ আমাদের নাচের জন্য বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
দেবাশিস (লাল) খেতে খুবই ভালবাসত। চেহারাটা ছিল একটু মোটার দিকে। প্রত্যেক মাসে হোস্টেলে গ্র্যান্ডফিস্ট ডিনারে ভাল ভাল খাবার থাকত। ও খাওয়ার মাঝখানেই খাওয়া বন্ধ করে চিকেনের ঠ্যাং হাতে নিয়ে ডাইনিং হলের চারিদিকে দৌড়াত খিদে হবার জন্য। কিছুক্ষন দৌড়ে এসে আবার খেতে বসত। সেই দেবাশিস আর নেই। কয়েক বছর আগে সেও অনন্তলোকে যাত্রা করেছে। কলেজ ছাড়ার পর ওর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। শুনেছিলাম ও কলেজের পর BHEL এ চাকরি করতো।
১০ নম্বর হস্টেলে আসবার পর আমাদের হটাৎ জার্মান ভাষা শেখার ইচ্ছে হল। আমি আর হরিপদ (অলোক) বিকালে কলেজের ক্লাশের পর ম্যাক্সমূলার ভবনে জার্মান শিখতে যেতাম। ফেরার পথে ভবানীপুরে শ্রীহরির দোকানে কচুরি খেতে যেতাম। ধীরে ধীরে কচুরি খাওয়াটাই যেন মূল উদ্দেশ্য হয়ে উঠলো। এভাবে প্রায় মাস দুই ম্যাক্সমূলার ভবনে ক্লাশ করতে গেলাম। আস্তে আস্তে উৎসাহে ভাটা পড়তে শুরু করল। এরপর জার্মান ভাষা আর শেখা হয়ে ওঠেনি।
হস্টেলে কয়েকজন গিটার বাজিয়ে গান গাইত। যেমন পচা (প্রশান্ত), নাটু (সরোজ)। অন্যদের নাম মনে নেই। ওদের দেখে আমারও খুব শখ হল গিটার শেখার। এসপ্ল্যানেডে গিয়ে স্প্যানিশ গিটার কেনা হল। প্রথম প্রথম খুব উৎসাহ। পচা ও নাটুর কাছে গিটার বাজানো শিখতে যেতাম। নিজেদের ঘরে এসে প্র্যাকটিসও করতাম। ওদের কাছে একটা গান তোলারও চেষ্টা করেছিলাম – ‘উঠ গো ভারত লক্ষ্মী ……..’। কয়েক মাসের মধ্যেই উৎসাহ কমতে শুরু করল। গিটারটা কলেজের এক জুনিয়ার ছাত্রকে বিক্রি করে দিলাম। সেই জমানায় পচার ছিল বীটলস টাইপের চুল। আর একটা গান খুব গাইতো ‘কেন কাঁদি? ভালোবাসি যে কান্নার সুর……’ এটা লিখেছিলেন আর সুর দিয়েছিলেন ১৯৬১ সালের আমাদেরই প্রাক্তনী অরুনেন্দু দাস (আর্কিটেকচার)। বিই কলেজে এই গানটি তখন খুব জনপ্রিয় ছিল।
পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লা খান নিয়াজি’র আত্মসমর্পন স্বীকারোক্তি। ভারতীয় সময় ১৬-৫৫ IST
আমাদের ছিলেন ইস্টার্ন কম্যান্ডের জেনারেল অফিসার ইন কম্যান্ড (GOC-In-C) লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলা দেশ স্বাধীন হল। সারা দেশের সঙ্গে আমরাও আবেগ ও উত্তেজনার ঢেউয়ে ভাসলাম। রাত্রি বেলায় আমরা ১০ নং হোস্টেলের ছাদে খবরের কাগজ জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে সদ্যপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালন করলাম। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অলকা সিনেমা হলে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, ‘জীবন থেকে নেওয়া’। পরিচালক ওপার বাংলার জাইহার রহমান। এই সিনেমায় ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবসকে কেন্দ্র করে একটা গান ছিল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গা একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি ………’। সিনেমাটা দেখে খুবই আবেগপ্রবন হয়ে গিয়েছিলাম। আমার পূর্বপুরুষদের জন্ম ও কর্মস্থান এই পূর্ববঙ্গেই। একদিন শোনা গেল জাইহার রহমানকে বাংলাদেশে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক পরে জানা গেল যে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে জাইহারকেও পাক সেনারা হত্যা করেছে। গানটা এত বেশি আমাকে প্রভাবিত করেছিল যে অনেক বছর পর যখন পিতৃপুরুষের ভিটে দেখতে যাই, তখন ঢাকায় ভাষা শহীদ স্মারক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বাংলাদেশের মানুষের বাংলাভাষার প্রতি ভালবাসা দেখে অবাক হয়েছিলাম। এখন তো UNESCO ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পঞ্চাশ দশকে পাকিস্থান সরকার পূর্ববঙ্গে উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল। এমনকি রবিঠাকুরের গানও রেডিয়োতে প্রচার নিষিদ্ধ হয়েছিল। সেই সময় পূর্ববঙ্গে একটা সাংস্কৃতিক গ্রুপ গঠন করা হয়। নাম ছায়ানট। এরা বাংলা নববর্ষের দিন রমনা ময়দানে রবিঠাকুর ও অন্যান্য কবিদের গানের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতো। ভোর থেকেই দলে দলে ছেলেমেয়েরা রমনা ময়দানে মিছিল করে যোগদান করতো। মেয়েদের পরনে সবুজ বর্ডার দেওয়া সাদা শাড়ী ও ছেলেদের পরনে সাদা পায়জামার সাথে সবুজ পাঞ্জাবি। এই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। আমার জানা নেই পৃথিবীর আর অন্য কোন দেশ ভাষার ভিত্তিতে স্বাধীনতা পেয়েছিল কি না !
রাজনৈতিক অশান্তির জন্য ১৯৭০ সালে কলেজ প্রায় আটমাস বন্ধ ছিল। বাড়ীতে কিছুতেই মন বসছিল না। যেদিন কলেজ খুলল আমাদের আনন্দ যেন আর ধরে না। বন্ধুদের দীর্ঘ দিন দেখার পর আমরা সবাই আনন্দে আত্মহারা। দেবু (ছিট) মাতালকে (স্বপন) দেখে এত উত্তেজিত হয়ে গেল যে মাতাল মাতাল বলতে বলতে ছুটে ওকে জড়িয়ে ধরলো। মাতালের তো অস্বস্থি! কারণ পাশেই মাতালের বাবা। বার বার ইশারা করে দেখাচ্ছে বা বলার চেষ্টা করছে যে বাবা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কে কার ইশারা দেখে আর কথা শোনে! মাতাল নামটা কে দিয়েছিল জানিনা। তবে হস্টেলে থাকতে ওকে কোনদিন মদ খেতে দেখিনি।
১০নং হস্টেলে থাকবার সময় আমরা ৭-৮ জন মিলে একবার দিল্লী, হরিদ্বার, দেরাদুন , মুসৌরি বেড়াতে গেছি। শশা ও আশীষ ব্রম্মর নামটা মনে করতে পারছি। অন্যদের নাম স্মৃতির পট থেকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার এক পিসতুতো ভাইও লেজুড় হয়ে আমাদের সঙ্গে গেছিল। মুসৌরি পাহাড়ে লাল টিব্বা দেখতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলাম। ওখানে মোটর বাহনের রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে গেছে। যেমনটা পাহাড়ে থাকে। উচ্চতায় দেখতে গেলে একটা রাস্তা থেকে উপরের রাস্তা প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু। ঝোঁক চাপলো যে এক রাস্তা থেকে উপরের রাস্তা ট্রেক করে যাবো। কিছুটা উপরে ওঠার পর মনে হলো যে কাজটা ঠিক হয়নি। পাহাড়ের গায়ে দেখলাম ঘাস-গাছ-লতাপাতা খুব বেশি নেই। নুড়ি পাথর আছে। আমরা যে কোন সময় স্লিপ করে নীচে চলে যেতে পারি। নীচে নেমে যাবার তখন আর উপায় নেই। উপরের যাওয়ার থেকে নীচে নামা আরও শক্ত। উপরের রাস্তায় দেখি দুই তিনটি গাড়ী দাঁড়িয়ে গেল। গাড়ী থেকে নেমে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। আমাদের মধ্যে একজন কোনরকমে উপরের রাস্তার কাছে এলো। এখানে এসে দেখা গেল প্রায় দুই ফুটের খাড়া ইটের দেওয়াল। দুই তিনজন লোক দেওয়ালে কাছে এসে একটু ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে প্রথম জনকে উপরে টেনে নিল। এই ভাবে একজন একজন করে আমরা উপরে উঠে এলাম। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। সেদিন যে কোন একটা অঘটন হতে পারতো। মোটর বাহিত রাস্তা ধরে পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। এরপর আমরা আর কোন এডভেঞ্চার করতে যাই নি।
দিল্লীতে সফদরজং এলাকায় আমরা আশিষের মামার বাড়ীতে এসে উঠলাম। দুপুর বেলায় আশিষের মামীমা চামচে করে সবার প্লেটে একে একে খাবার তুলে দিচ্ছেন। আমাদের মধ্যে একজন বলল –মামীমা আপনাকে কষ্ট করে আর দিতে হবে না, আমরা নিজেরাই নিয়ে নিতে পারবো। ট্রেন থেকে নেমে আমরা এমনই ক্ষুধার্ত ছিলাম যে মামীমা ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবামাত্র আমরা খাবারের উপর হামলে পরে সবটা খাবার ঢেলে নিজেদের প্লেটে নিয়ে নিলাম। সেই যাত্রায় ট্রেনে এক সাধুর সঙ্গে দেখা। আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে উনি খুশি হয়ে হরিদ্বারে উনার আশ্রমে আমাদের থাকতে বললেন। পকেটে টাকার অঙ্ক হিসেব করে আমরাও খুশি। আমরা কয়েকদিন উনার আশ্রমেই থেকেছিলাম। খাওয়া দাওয়া করেছিলাম। ক্যামেরা দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে দিতেই সাধুবাবা খুশি। হরিদ্বারে মনসা পাহাড়ে বেড়াতে গেছি। এখনকার মতন তখন রোপওয়ের ব্যবস্থা ছিল না। হেঁটে হেঁটেই মনসা পাহাড়ে উঠলাম। এক জায়গায় বসে পাহাড়ের চারিদিকের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছি। হঠাৎ দেখলাম আশিষ ব্রম্ম আমাদের মধ্যে নেই। খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেল উনি একটি মেয়ের সাথে দিব্যি গল্প করছেন। কখন যে ওদের মধ্যে আলাপ হল জানিই না। এই আলাপ ক্রমে প্রণয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল। কলেজ থেকে পাশ করবার পর আশীষ এই মেয়েকেই বিয়ে করেছিল। প্রায় ৫০ বছর পর আশীষের নাতির অন্নপ্রাশনে আশিষ ও বউয়ের সঙ্গে আবার দেখা হলো।
আমাদের আরেক নায়ক সঞ্জয় চ্যাটার্জী। কৃষ্ণনগরে বাড়ী। নিজেকে বয় চ্যাটার্জীর ছেলে বলে গর্ব করত। ওর বাবা নাকি হাফ প্যান্ট পড়ে সেই যুগে বাইরে ঘুরে বেড়াতেন। সঞ্জয় প্রতি শনিবার দুপুরে লাঞ্চের পর বেড়িয়ে যেত। বেশ সেজেগুজে। শীতকালে কোট টাই। জিজ্ঞেস করলে বলতো মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। ওর প্রেমিকার নাম দিয়েছিল – মেম সাহেব। শুনেছি সেই মেমসাহেবকেই ও বিয়ে করেছে। সঞ্জয় এখন অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা ।
একদিন ছিটের সঙ্গে বেহালার সরসুনা অঞ্চলে ওদের বাড়ীতে গেলাম। বিকেলে চা খাবার পর উপরের তলায় ছিটের ঘরে বসে সিগারেট খাচ্ছি। এইসময় মাসীমা দেবুর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলছেন – কই রে কই গেলি! সঙ্গে সঙ্গে ছিট বলল, খাটের তলায় ঢুকে যা। আমরা তাড়াতাড়ি খাটের তলায় ঢুকে গেলাম। সিগারেট নিভিয়ে দিলাম। মাসীমা পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে দেবু’কে কয়েকবার ডাকাডাকি করে চলে গেলেন। এরপরেও ছিটের বাড়ি কয়েকবার গেছি। এই যোগাযোগের সূত্রে দেবুর বাবার সঙ্গে আমার বাবারও যোগাযোগা হলো। দেবুর বাবা কলকাতা থেকে পুরুলিয়া জেলার আদ্রা শহরে অফিসের কাজে বদলি হলেন। কিছুদিন পর আমার বাবাও আদ্রা শহরে বদলি হন। তাস খেলার সূত্রে দুজনের যোগাযোগ হৃদ্যতায় পরিনত হলো। ছুটির দিনে উনারা ঘন্টার পর ঘন্টা ব্রীজ খেলতেন। একদিন শশাঙ্কর দমদমের বাড়ি গেলাম। মাসীমা যত্ন করে দুপুরের খাবার খাইয়েছিলেন।
আবার হস্টেল জীবনে ফিরে আসি। একবার ঠিক হলো চার রুমমেট মিলে গাঁজা খাব। পরিমান মত গাঁজা এনে সিগারেটের তামাক বার করে গাঁজা ভরা হলো। শশা, আমি আর মোল্লা সাবধানে আস্তে আস্তে দুই একটা টান দিলাম। মাথা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। ছিট এদিকে ছটফট করছে গাঁজার টান দেবার জন্য। শশা ইচ্ছে করেই ওকে আমাদের পেছনে রেখেছে। ওর টার্ন আসতেই ছিট গাঁজা ভরা চারমিনার সিগারেটে লম্বা একটা টান দিল। অভ্যাসমতো ও লম্বা টান দিয়েই সিগারেট খায়। দেখলাম, প্রথম টান দেবার পর দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সে বসে পড়লো। দ্বিতীয় বার লম্বা টান দেবার পর বসা অবস্থা থেকে শুয়ে পড়লো। বেশ নেশা হয়ে গেছে। চীৎকার করে বলছে – আমি উড়ে যাচ্ছি, আমাকে জোর করে ধর। শশা, আমি আর মোল্লা তিনজনে ওর হাত পা ধরে আছি। কিছুক্ষন এইভাবে চলার পর ও শান্ত হলো।
একদিন রাত্রে মোল্লা মশারির ভেতর দুই হাতে মশা মারছে। আওয়াজে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মোল্লা আলো জ্বালিয়ে দেখে মশারির কোনে একটা ছোট ফুটো আছে। সেটা দিয়ে মশা ঢুকছে। ওকে দেখলাম একটা কাগজ রোল করে পাইপ বানালো। মশারির ফুটোর কাছাকাছি জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে আর একটা ফুটো করে, এরপর কাগজের পাইপটা দুটো ফুটোর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। মশা পাইপের এক মুখ দিয়ে ঢুকে অন্যমুখ দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। মশারির ভিতর আর ঢুকতে পারছে না। মোল্লা নিশ্চিন্ত হয়ে মশারির ভিতর ঘুমোতে চলে গেলো। আমরা চার রুমমেট বেশ আনন্দেই আছি। তবে ছিট আর শশার মধ্যে টুকটাক লেগেই থাকতো। শশাই ছিটের পিছনে বেশি লাগতো। তবে সেটা ছিল হাসি মজার মধ্যেই আবদ্ধ।
এরপর আমরা যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, ১৯৭০ সালে, কলেজের তখন রাজনৈতিক পরিবেশ অশান্ত। রাজনৈতিক বিভেদ শুরু হয়ে গিয়েছিল। সাহেবপাড়াকে বলা হত বামপন্থীদের আস্তানা আর মুচিপাড়াকে বলা হত অতি বামপন্থীদের ঘাঁটি। আমাদের ১০নং হোস্টেল মুচিপাড়ার মধ্যে পড়ে। দেখতাম বাইরের কিছু অচেনা ছেলে আমাদের হোস্টেলে এসে থাকতে শুরু করেছে। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় জানতে পারলাম ওরা অতিবামপন্থী দলের ছেলে। হস্টেলে একটা চাপা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। বাইরের ছেলেরা অবাধে হোস্টেলে যাওয়া আসা করছে। মেসে খাওয়া দাওয়া করছে। সম্ভবত ওরা আমাদের স্টাডিতে থাকতে শুরু করেছিল। জানতে পারিনি কার অনুমতি নিয়ে তারা থাকতো। একদিন স্নান করে এসে দেখলাম আমার বিছানায় ভাজ করা লেপের তলায় একটা পিস্তল। লেপের তলায় সেই পিস্তল দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পড়ে নীচে ডাইনিং হলে দুপুরের খাবার খেতে চলে গেলাম। এব্যাপারে কারো সঙ্গে আলোচনা করতেই ভয় পাচ্ছি। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কোনরকমে লাঞ্চ সেরে ফিরে এসে লেপটা তুলে দেখলাম যে পিস্তলটা আর নেই। যাক, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অজানা এক ভয়ে ঘটনাটা বন্ধুদের কাছেও বলতে পারিনি। জীবন যেমন চলছিল সেইভাবেই চলতে থাকলো। কিছুদিনের মধ্যে ঘটনাটা ভুলেও গেলাম। এটাই বোধ হয় প্রথম যৌবনের ধর্ম। কোন seious ঘটনাও বেশি দিনের জন্য মনে দাগ কাটেনা।
তখন কলেজের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ভাবে অশান্ত হয়ে পড়ছে। প্রিন্সিপ্যাল দুর্গা দাস ব্যানার্জী উগ্রপন্থীদের ভয়ে কলেজের কোয়াটার্স ছেড়ে কলকাতায় অন্য জায়গায় থাকেন। কলেজের administration ভেঙ্গে পড়েছিল। প্রফেসর পি এন চ্যাটার্জী তখন কলেজের একটিং প্রিন্সিপ্যাল। মাঝে মাঝেই আমাদের হস্টেলের ফ্লোরের একটা ঘরে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হতো। বাইরের ছেলেরাই এসে নেতৃত্ব দিত। আমাদের প্রায়ই বলত আলোচনায় যোগ দিতে। আমরা যেতাম না। একদিন বাধ্য হয়ে ওদের পীড়াপিড়িতে আলোচনায় যোগ দিলাম। বসে ওদের আলোচনা চুপচাপ শুনছিলাম। কথায় কথায় মণীষিদের মূর্তি ভাঙ্গার প্রসঙ্গ এলো। মনোজ (মোল্লা) মূর্তি ভাঙ্গার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললো। কয়েকদিন আগে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গা হয়েছে। এই নিয়ে প্রশ্ন উত্তর চললো। সদুত্তর দিতে না পেরে সেই নেতা একটু রেগেই গিয়েছিল। এরপর আমরা আর আলোচনায় যোগ দেইনি। তখন থেকেই রাজনৈতিক পরিবেশ বেশ গরম হতে শুরু করেছে।
একদিন বিকেলের শো’তে অলকা সিনেমায় সাগিনা মাহাতো দেখে হষ্টেলে ফিরেছি। রাজনৈতিক খুনখুনির কারনে সেদিন ৫৫ নং বাস বন্ধ ছিল। হেঁটেই হোষ্টেলে ফিরেছিলাম। ডাইনিং রুমে রাত্রির খাবার খেয়ে ঘরে ফিরেছি। সেই সময় ট্রানজিস্টর রেডিও বানাবার একটা হুজুগ এসেছিল। সম্ভবত মেজর (তরুন) ও অলোকের (হরিপদ) এই hobbyটা অনেকের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল। আমিও একদিন হরিপদর সঙ্গে ম্যাডান স্ট্রীটে গিয়ে ট্রানজিস্টর রেডিয়োর components কিনে নিয়ে এলাম। কাগজে ছাপা electronic circuit দেখে component গুলো soldering করছিলাম। তখন রাত প্রায় দশটা। নীচ থেকে শুনলাম একদল ছেলের শ্লোগানের আওয়াজ। কয়েকটা ছেলে দৌড়ে এসে বলল – ওদের গ্রুপের একটা ছেলেকে ম্যাকডোনাল্ড হোস্টেলে ধরে রেখেছে। ওকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। যারা না যাবে তাদের চিনে রাখা হবে। ম্যাকডোনাল্ড হোস্টেল সাহেবপাড়াতে। আমরা বেশ কয়েকজন দৌড়ে ১০ নং হোস্টেলের ছাদে চলে গেলাম। ছাদে আমরা লুকিয়ে আছি। কিছুক্ষন পর দেখলাম একটা বড় গ্রুপ ছাদে আমাদের খুঁজতে এসেছে। তারা একরকম জোর করে আমাদের নিচে নিয়ে এলো। নেমে দেখলাম প্রায় ২০০ ছেলের জমায়েত। ব্যারাক সার্ভেন্টরাও বাদ পরেনি। জোর করে তাদেরও ধরে নিয়ে এসেছে। সেই বিভীষিকাময় রাত্রির কথা আমরা ভুলতে পারব না। যদিও ৫০ বছরেরও বেশি আগে এই ঘটনাটা ঘটে ছিল।
মিছিল প্রথমে গেল অধ্যাপকদের আবাসনের দিকে। মিছিলে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিল তাদের অনেকের হাতে পিস্তল, পাইপ গান, গুপ্তি ইত্যাদি। ভয় দেখিয়ে অধ্যাপকদের মিছিলে সামিল করা হল। কলেজের প্রিন্সিপাল দূর্গাদাস ব্যানার্জী বাড়িতে ছিলেন না। এক্টিং প্রিন্সিপাল পি এন চ্যাটার্জী ও কেমিস্ট্রির হেড ডঃ বসাককে মিছিলে সামিল করা হল। আরও অধ্যাপকরা ছিলেন তাঁদের নাম মনে করতে পারছি না। এরপর শুরু হল শ্লোগান ও অধ্যাপকদের উপর অকথ্য গালাগাল। একটা শ্লোগান এখনও মনে আছে – ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’। মিছিল চলল ওভাল স্টেডিয়াম ও ক্লক টাওয়ারের পাশ দিয়ে কলেজ বিল্ডিংয়ের দিকে। রাস্তার বাঁ পাশে রেজিস্ট্রারের সুন্দর একটা বাংলো ছিল। তার কাঁচের দরজা জানলা ভেঙ্গে দেওয়া হল। রেজিস্ট্রারকে পাওয়া গেল না। মিছিল চলল কলেজ মেইন বিল্ডিংয়ের দিকে। কলেজ বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে যখন মিছিল যাচ্ছে, শুরু হল বোমাবর্ষন। অপর পক্ষ কলেজ বিল্ডিং থেকে বোমা ফেলতে শুরু করেছে। সৌভাগ্যক্রমে বোমাতে splinter ছিলনা। এছাড়া বোমা মিছিলের আশেপাশে ফেলা হচ্ছিলো। বোমার আঘাতে কেউ আহত হয়নি। তবে প্রচন্ড শব্দে মিছিল ছত্রাখান হয়ে গেল। যে যেখানে পারলো দৌড়তে লাগলো। বোমার শব্দ এত বেশি ছিল যে আমি একটা গাছকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে লাগলাম। পায়ের চটি ছিটকে গেছে। দেবু (ছিট) আমার পাশেই ছিল। বলল – চল পালিয়ে যাই। আমি বললাম – সেটা ঠিক কাজ হবেনা। কেও ভুল ভেবে স্ট্যাব বা শুট করতে পারে। এর থেকে ভাল হবে অধ্যাপকদের সঙ্গে যোগ দেওয়া। আমি ও দেবু খালি পায়ে অধ্যাপকদের সঙ্গে যোগ দিলাম। মিছিলে তখন প্রায় ৮০ জন ছিল। মিছিলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল পার্টির কয়েকজন নেতা। সেই নেতাদের আগে কখনও কলেজে দেখিনি। মিছিল ঘুরতে ঘুরতে ম্যাকডোনাল্ড হোস্টেলের দিকে এগিয়ে চলল। বাঁ দিকে পুকুর, কলেজের ফার্স্ট গেটের কাছে।
মধ্যরাত্রির কাছাকাছি আমাদের মিছিল কলেজ বিল্ডিং থেকে ম্যাকডোনাল্ড হোস্টেলের দিকে এগিয়ে চলেছে। শ্লোগান দেওয়াটাও যেন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। সবাই যেন কিছুটা ক্লান্ত। প্রথম গেটের কাছে একটা পুকুর ছিল। আমরা পুকুরটাকে বাঁ দিকে রেখে এগিয়ে চলেছি। কলেজের ফার্স্টগেটে ল্যাম্পের উজ্বল আলোয় চারিদিকটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দেখা গেল সারি সারি পুলিশভ্যান কলেজের প্রথম গেট দিয়ে ঢুকছে। ভ্যানে ই.ফ.আর ও সি.আর.পি.এফ বাহিনীর সঙ্গে লোকাল থানার পুলিশ। চারিদিক নীরব ও নিস্তব্দ। বাইরে থেকে আসা নেতারা আমাদের পালাতে বারন করলো। একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। আরো বলল আমাদের সঙ্গে কলেজের অধ্যাপকরা আছেন, ভয় পাবার কারন নেই। পুলিশ আমাদের কিছু করবে না। এরপর ই.ফ.আর ও সি.আর .পি.এফ বাহিনী ভ্যান থেকে নেমে রাইফেল উুঁচিয়ে আমাদের ধীরে ধীরে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলল এবং আমাদের দিকে এগুতে লাগল। আমাদের একদিকে পুকুর। পালাবার কোন রাস্তা নেই। এইরকম সময়ে হঠাৎ দেখলাম অধ্যাপকরা দুই হাত উঁচু করে পুলিশ বাহিনীর দিকে দৌড়ে এসে জোরে জোরে বলছেন ‘We are the professors ! Don’t shoot us!’। পুলিশ উনাদের নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে গেল। মিছিলে রয়ে গেলাম আমরা ছাত্ররা, মেসের কর্মচারীরা ও কিছু নেতা যাদের চিনতামই না। এইবার আমরা ভীষনভাবে ভয় পেয়ে গেলাম। পুলিশবাহিনী রাইফেল উঁচিয়ে চারিদিক থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা গোল হয়ে ছোট হতে হতে মানুষের এক ঢিবির মত হয়ে গেলাম। আর আমি মানুষের ঢিবির একেবারে তলায়। প্রচন্ড চাপে যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এরপর ই.ফ.আর ও সি.আর.পি.এফ বাহিনী বেয়নেট ও রাইফেলের বাট দিয়ে খোঁচাতে ও মারতে শুরু করল। যারা ঢিবির উপরের দিকে ছিল তাঁদের কয়েকজন আহত হলো। আহতদের এম্বুল্যান্স করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বাকিদের একে একে পুলিশ ভ্যানে তুলতে শুরু করলো। আমার ছোটখাট রোগা চেহারা দেখে একজন ই.এফ.আর জওয়ান একটু অবাকই হলো। বললো – তুম ভি নক্সাল হ্যায়! বলে আমার পিছনে এমন এক লাথি মারলো যে আমি যেন হাওয়ায় উড়ে পুলিশ ভ্যানে উঠে গেলাম। আমাদের শিবপুর পুলিশ লকআপে আনা হল। আন্দাজ ১৫০ বর্গফুট ঘরে তখন আমরা প্রায় ৮০ জন। ভালভাবে বসতেও পারছিলাম না। অনেকেই দাঁড়িয়ে রইল। এরই মধ্যে লক্ষ্য করলাম তিন-চার জন চোর পকেটমারও আমাদের লকআপে চুপচাপ বসে আছে। কয়েকজন ছেলেকে দেখলাম চোর পকেটমারদের গালাগাল ও চড়-চাপাটি মারতে শুরু করেছে। বেগতিক দেখে পুলিশ অফিসার ওদের অন্য জায়গায় নিয়ে গেল। প্রভাতের শরীর একটু খারাপ হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে পুলিশ অফিসার প্রভাতকে কোল্ড-ড্রিঙ্ক খাইয়েছিল। এ ব্যাপারে প্রভাতই ভাল বলতে পারবে। কোনরকমে বসবার জায়গা করে সারা রাত কাটিয়ে দিলাম। দেখলাম কেউ হতাশা বা দুঃখে নেই। দিব্যি মজার মজার কথা হচ্ছে আর হাসাহাসি হচ্ছে। এখন এই বৃদ্ধ বয়েসে এসে মনে হয় সেদিনের সেই ১৭ -১৮ বছরের তরুনদের কত না জীবনীশক্তি ছিল! এত বড় একটা ঘটনাও তাদের কাবু করতে পারেনি। মনেও আসেনি ভবিষ্যত জীবনে এই ঘটনা তাদের কতটা প্রভাব ফেলতে পারে!
পরের দিন সকালে আমাদের পুলিশ ভ্যানে পাঠানো হল দমদম সেন্ট্রাল জেলে। প্রায় সমস্ত পত্রিকার প্রথম পাতায় গত রাত্রির বিই কলেজের ঘটনা ছাপা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে এই নিয়ে খুব হৈ চৈ হয়েছিল। আমাদের বেল তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। কলকাতায় যাদের বাড়ী ছিল তাঁরা দু তিন দিনের মধ্যেই বেল পেয়ে জেল থেকে ছাড়া পেল। তখনকার সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা এত ভাল ছিল না। বাড়িতে খবর পেতে দেরি হয়েছিল। তাই যাদের গ্রামে বা মহকুমা-জেলা শহরে বাড়ী তাদের জেল থেকে ছাড়া পেতে খানিক দেরি হলো। আমার বাড়ী জেলা শহরে। বাড়ীতে টেলিফোন ছিল না। জেল থেকে ছাড়া পেতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগেছিল।
জেলে কটা দিন মোটামুটি ভালই কেটেছিল। হয়ত সবাই একসঙ্গে ছিলাম বলে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়িনি। যদিও জেলের খাবার খেতে ভাল লাগছিল না। তাস খেলে ও বিকেলে ভলিবল খেলে মোটামুটি ভালই দিন কাটছিল। অন্যান্য জেল বন্দিদের সঙ্গে ভলিভলের দুই একটা ম্যাচ খেলাও হয়ে গেল। তারুন্যের অশেষ জীবনীশক্তি আমাদের খারাপ থাকতে দেয় নি। অবশেষে আমার জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার দিন এসে গেল। মুস্কিল হল আমার পায়ে চটি বা জুতো নেই। সেই বিভীষিকার রাতেই সেটা খোয়া গেছে। খালি পায়ে জেল থেকে বেরোতে কিছুতেই মন চাইছিল না। নিজেকে চোর চোর মনে হচ্ছিল। আমাদের ব্যারাক সার্ভেন্টরা তথনও জেল থেকে ছাড়া পায়নি। দেখলাম ওরা গোল হয়ে বসে তাস খেলছে। তাঁদের পেছনের দিকে চটিজোড়া রাখা আছে। আমি একজনের পিছন দিকে দাড়িয়ে তাস খেলা দেখার ভান করলাম। তারপর চটি দুটো পায়ে গলিয়ে নিঃশব্দে ওখান থেকে বেরিয়ে জেল গেটের দিকে এগোতে লাগলাম।
দমদম জেল থেকে বেড়িয়ে এলাম কোন এক ব্যারাক সার্ভেন্টের চটি পরে। বাইরে এসে দেখি আমার এক জ্যাঠামশাই ও পিসীমা আমাকে নিতে এসেছেন। জ্যাঠামশাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত ঘটনা জিজ্ঞেস করলেন। উনিই আমাকে যাদবপুরে না পড়ে শিবপুরে ভর্তি হতে বলেছিলেন। যাই হোক কলকাতায় একদিন থেকে বর্ধমানে নিজে বাড়ী চলে এলাম। বেলের নিয়ম অনুযায়ি আমাকে বর্ধমান শহরের পুলিশ থানায় রোজ হাজিরা দিতে হতো। পুলিশ থানা থেকে একটা নোটবুক দিয়েছিল। প্রতিদিন হাজিরা দেবার পর পুলিশ সাব-ইন্সপেকটরের সই নিতে হতো। উনার কথামতো মাঝেমাঝেই সিগারেটের প্যাকেট কিনে নিয়ে যেতাম। চারিদিকের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে শুরু করেছিলো। ভয়ে ভয়ে থাকতাম। এইভাবে প্রায় মাসখানেক চলল। এরপর আমাকে সপ্তাহে একদিন করে, এর পরে মাসে একদিন পুলিশ থানায় হাজিরা দিতে হতো। এরমধ্যে খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পারলাম আমাদের কলেজের বামপন্থী ছাত্রদলের নেতা অসীম গাঙ্গুলী আততায়ীদের হাতে খুন হয়েছে। চারিদিকে হত্যালীলা শুরু হয়ে গেছে। স্কুলের মাস্টারমশাই থেকে শুরু করে পুলিশ কনস্টেবল, ছাত্র, যুবক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী কেউ বাদ নেই। আমাদের কিছু আত্মীয় স্বজনরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতো আমি নাকি অতিবামপন্থী দলে নাম লিখিয়েছি। ধরা যখন পরেছি তখন একটা কারন নিশ্চয় থাকবে! চাহনিতে যেন একটু সন্দেহের ভাব। আমার স্কুলের এক বন্ধু, তাঁর বাড়ীতে যেতাম। কয়েকদিন পরে দেখলাম সেও আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। হয়তো বাড়ী থেকেই বারন করেছিল।
দীর্ঘদিন কলেজ বন্ধের কালে, সময় যেন আর কাটতেই চাইতো না। এর মধ্য আমাদের শহরে এক CRPF স্টাফের সঙ্গে আলাপ হলো। সে ছিল administrative dept থেকে। বাঙ্গালী, বাড়ী আসামে। আমার থেকে কয়েক বছরের বড়ই হবে। মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে বসে রাম খেতাম। সেই আমার প্রথম রাম খাওয়া শুরু। পরবর্তীকালে মুম্বাইয়ের Mazagon Dock এ কিছুকাল চাকরী করবার সূত্রে সপ্তাহান্তের পার্টিতে রাম খেতে শুরু করেছিলাম। বেশ কিছু Ex-Naval officer এখানের Mazagon Dock এ চাকরী করতো। প্রত্যেক শনিবার হাফ ছুটির পর অফিস প্রিমাইসে কোন অফিসারের কোয়ার্টারে পার্টি হতো। সেখানে Naval অফিসারদের স্টাইল করে ড্রিংকস করা দেখতাম। নানা রকমের খাবার থাকতো যেমন cheese cube, boiled eggs, fruits ও আরও অনেক কিছু। পরিবেশটা ভাল লাগতো। চুপ চাপ আস্তে আস্তে কথা বলা। খুব একটা হৈ চৈ নয়। সবাই যে যার মত ড্রিংকস নিচ্ছে। দেখলাম অনেকেই রাম নিচ্ছে। দেখাদেখি আমিও রাম নিতাম।
যাইহোক পুরনো কথায় ফিরে যাই।
দীর্ঘ ৮ মাস পর কলেজ খুলল। হোষ্টেলে এসে বন্ধুদের পেয়ে পুরনো জীবনে ফিরে গেলাম। নিয়মিত ক্লাশ শুরু হলো। তবে হোস্টেলে নানা বাধানিষেধও প্রনয়ন করা হলো। প্রত্যেককে আইডিন্টি কার্ড দেওয়া হলো। প্রতিটি গেটে সি.আর.পি.এফ মোতায়ন করা হলো। গেটে আইডিন্টি কার্ড দেখিয়ে কলেজে ও হোস্টেলে ঢুকতে হতো। বহিরাগতদের হোস্টেলে ঢোকা বন্ধ হলো। নিয়ম হলো রাত্রি ১০টার পর বাইরে থেকে কলেজ ক্যাম্পাস বা হস্টেলে ঢোকা যাবেনা। নিজস্ব ছন্দে কলেজ ও হস্টেল জীবন চলতে থাকলো।
এবার আমাদের কলেজ জীবনের কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। একটা ঘটনার কথা মনে আছে। তখন ফোর্থ ইয়ার পরীক্ষার ফাইনাল দেবো। পরীক্ষার আগে কয়েকদিনের ছুটি। আমি আর শশাঙ্ক হোস্টেলে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটা সাবজেক্ট নিয়ে গ্রুপ স্টাডি করছি। বোঝার চেষ্টা করছি, সম্ভবত effect of electromagnetic force on induction motor। ব্যাপারটা কিছুতেই conceptualise করতে পারছিলাম না। ঠিক করলাম ডিপার্টমেন্টে মাষ্টারমশাইয়ের কাছে গিয়ে বোঝবার চেষ্টা করবো। গিয়ে দেখলাম ডিপার্টমেন্টে কোন মাষ্টারমশাই নেই। একমাত্র প্রফেসর শঙ্কর সেন উনার ঘরে বসে কাজ করছেন। আমরা ঘরের বাইরে দরজার কাছে দাড়িয়ে আছি। ঘরের ভিতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছি না। কিছুক্ষন পরে উনার চোখ আমাদের দিকে পড়লো। উনি আমাদের ভিতরে ডাকলেন। শশাঙ্ক আমাদের অসুবিধার কথা উনাকে জানালো। একটু ভেবে উনি বললেন চল ওয়ার্কশপে যাই। ওয়ার্কশপে একটা মোটর খোলা অবস্থায় ছিল। উনি প্রায় আধঘন্টা ধরে খুটিনাটি আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন। এই রকম মাষ্টারমশাই ছিলেন শঙ্কর সেন। শুধু উনিই নন , অন্যান্য মাষ্টার মশাইদের কাছেও এই ধরনের সাহায্য পেয়েছি। উনাদের কাছে গেলে তাঁরা খুব খুশি হতেন ও সাগ্রহে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। অন্য প্রফেসর যারা আমাদের ক্লাশ নিতেন, যেমন দীপক সেনগুপ্ত ও সুকোমল তলাপাত্রর কাছে কতবার করে গেছি strength of material ও fluid mechanics বুঝতে!
এরপর প্রফেসর শঙ্কর সেনের সঙ্গে দেখা হয় মুম্বাইয়ে BECCA- Maharashtra র বাৎসরিক পিকনিকের সময়। সালটা সম্ভবত নব্বুই দশকের প্রথম দিকে। সম্ভবত উনি সেই সময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের VC বা পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ মন্ত্রী। দেখলাম উনি বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করছেন। বাচ্চারাও খুশি হয়ে উনার সঙ্গ উপভোগ করছে। দেখলাম উনি প্রত্যেক বাচ্চার নাম জেনে সেই নাম দিয়ে ছোট ছোট কবিতা লিখে দিচ্ছেন তাঁর ভিসিটিং কার্ডের পেছনে। আমার মেয়ের নাম তিতাস। তাকে নিয়েও একটা ছোট কবিতা লিখে দিয়েছিলেন। কবিতাটা মনে নেই। কার্ডটাও হারিয়ে ফেলেছি। এই রকম কত সুখ স্মৃতি হৃদয়ের গহিন অতলে হারিয়ে গেছে। অনেক বন্ধুদের কলেজ ছাড়ার পর আর দেখা হয়নি। অনেকের মুখ মনে করতে পারি । তাদের নাম মনে নেই।
আমাদের সময়ে mass cut কথাটা খুব চালু ছিল। কোন ক্লাশ বা সাবজেক্ট বোরিং মনে হলে ছাত্ররা অনেকেই ক্লাশে যেতে চাইতো না। এ ব্যাপারে ছাত্রদের মধ্যে ছিল সাংঘাতিক ঐক্য। একবার যখন ঠিক হতো তখন কেউ ক্লাশে যেতো না। কেউ ক্লাসে যাবার চেষ্টা করলে তাকে আওয়াজ দিয়ে হোস্টেলে ফিরিয়ে আনা হতো। তবে ভাল মাষ্টারমশাই বা ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট হলে মাস কাট হতো না। একবার এক মজার ঘটনা হলো। প্রথম বা দ্বিতীয় বছরে আমাদের Humanities, Civics ইত্যাদি সাবজেক্ট পড়তে হতো। যিনি পড়াতেন তাঁকে একেবারেই ইন্টারেস্টিং মনে হলো না। এই ক্লাশে প্রায়ই মাস কাট হতো। বছরের শেষে জানলাম যে আমাদের attendance percentage নেই। সুতরাং এই পরীক্ষায় বসা যাবে না। সকলেই চিন্তায় পড়ে গেলাম। ঠিক হলো সবাই মিলে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে মাষ্টারমশাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে অনুরোধ করে পরীক্ষায় বসতে দিতে রাজী করানো হবে। অনেকে মিলে গিয়ে মাষ্টারমশাইকে অনুরোধ করা হলো। উনি রাজী হচ্ছেন না। আমরা সবাই মাষ্টারমশাইকে ঘিরে দাড়িয়ে অনুনয় অনুরোধ করছি। দেখলাম শশাঙ্ক attendance register র খাতাটা চুপচাপ পাশের টেবিল থেকে নিয়ে জামার ভিতরে ঢুকিয়ে গম্ভীর মুখে বেড়িয়ে গেল। আমরা সবাই ধীরে ধীরে হোস্টেলে ফিরে এলাম। পরে ডিপার্টমেন্টে ক্লারিকেল স্টাফের কাছে শুনেছিলাম খাতাটা নিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি হয়েছিল। কোন অজানা কারনে দেখলাম পরীক্ষায় বসতে আমাদের আর অসুবিধা হলো না।
কত ঘটনাই যে ঘটেছে পাঁচবছরের কলেজ ও হোস্টেল জীবনে! বেশির ভাগই মজার, কিছু ঘটনা দুঃখের। ১০ নং হস্টেলে ল্যাংটা (ভাল নাম জানিনা) একদিন আমার কাছে একটা জামা ধার করলো। ওকে নাকি কোথায় যেতে হবে! এরপর ল্যাংটাকে আর দেখিনি। আমাদের সামনের ৯ নং হোস্টেলে মৌসুমি বলে একটা ছেলে থাকতো। চেহারাটা এখনও চোখে ভাসে। ফর্সা ও সুন্দর চেহারা। সে এবং আরো কয়েকজন (নাম মনে নেই) হোস্টেল থেকে বেপাত্তা। কয়েকদিন পরে শোনা গেল যে তাঁদের মৃতদেহ নাকি বালির এক sewege ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার হয়েছে। সেই সময় কেউ কোন অপরিচিত জায়গায় যেতে ভয় পেতো। রাজনৈতিক কারনে মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস, হিংসা ও প্রতিহিংসার ঘটনা প্রায়ই লেগে থাকতো। আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কলেজ জীবনে প্রথম দুই বছর রাজনৈতিক আঁচ কম বেশি প্রায় প্রত্যেককেই প্রভাবিত হয়েছিল। এরপরই কলেজ কতৃপক্ষ শান্তি ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করে। গেটে CRPF পাহারার ব্যবস্থা করে। তবে সব মিলিয়ে বলতে গেলে আমাদের কলেজ ও হোস্টেল জীবন বেশ আনন্দেই কেটে ছিল।
১৯৭৩ সালে কলেজের দ্বিতীয় গেটের কাছে ‘লিপি’ সিনেমা হলের উদ্বোধন হলো ‘ববি’ সিনেমা দিয়ে (সঠিক মনে নেই, উত্তমকুমারের রৌদ্রছায়াও হতে পারে)। ১০ নং হস্টেল থেকে ঠিক হলো সবাই মিলে সিনেমাটা দেখা হবে। ব্যারাক স্টাফেদেরও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে। সেই বুঝে চাঁদা তোলা হলো। টিকিট কাটা হলো। সম্ভবত একটা লিস্ট সি.আর.পি.এফ সিকিউরিটি গেটে জমা দিতে হয়েছিল। এই লিস্টে সবার নাম ও রুম নং দেওয়া হয়েছিল যারা যারা সিনেমা দেখতে যাবে। খুব হই চই করে ‘ববি’ সিনেমা দেখা হলো। সঙ্গে কিছু স্ন্যাক্সের ব্যবস্থাও হয়েছিল। আমাদের সকলেই তখন ডিম্পল কাপাডিয়ার রূপমুগ্ধ। বিভিন্ন সিনে নায়িকাকে দেখে সিটি মারা চলছে। কয়েকজন সিনেমার পর্দার সামনে গানের সঙ্গে উদ্বাহু নাচানাচিও করলো।
এদিকে আমাদের যে ৮০জন ধরা পড়েছিলাম হাওড়া কোর্টে তাঁদের কেস চালু হলো। নির্ধারিত দিনে আমাদের সকলকেই কোর্টে হাজিরা দিতে হতো। সবাই মিলে চাঁদা করে উকিলের ফিস দিতাম। এইভাবে প্রায় দুবছর এই কেস চলেছিল। কোর্টে হাজিরা দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন কাজ ছিলনা। তারপর ১৯৭২ সালে নতুন সরকার এলে সিদ্ধার্থ শংকর রায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন। সরকার পক্ষ থেকে কেসটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যতদূর জানি এর পেছনে প্রভাতের কিছু অবদান ছিল। গ্রামের M.L.A র সঙ্গে দেখা করে ও সমস্ত কিছু জানায়। সেইসময় মন্ত্রীসভায় সুব্রত মুখার্জী অন্যতম কনিষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন। M.L.A সমস্ত ঘটনাটা সুব্রত মুখার্জীকে জানান। সুব্রত মুখার্জী তদ্বির করে কেসটা বন্ধ করে দেবার ব্যবস্থা করেন। প্রভাতের কাছে শুনেছিলাম – আমাদের এ্যারেস্ট হবার খবর শুনে প্রভাতের বাবা খুব রেগে গিয়েছিলেন। প্রভাতকে বলেছিলেন – ভবিষ্যতে প্রভাত যেন উনার নামটা কোনোদিন ব্যবহার না করে!
কেসটা বন্ধ হয়ে যাবার খবরটা আমরা আগেই জেনে গেছিলাম। সেদিন আমরা বেশ ফুরফুরে মেজাজেই হাওড়া কোর্টে এসেছি। আমাদের সঙ্গে কলেজের অন্যান্য বন্ধুরাও ছিল। আমরা প্রায় ৮০ জন জজ সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালাম। একে একে আমাদের নাম জিজ্ঞাসা করা হলো। এরপর জজ সাহেব কেসটা বন্ধ করবার কথা ঘোষনা করলেন। কোর্টের বাইরে এসে দেখি কলেজের বন্ধুরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আনন্দে খুব হুল্লোর হৈ হৈ হলো। আমরা চা সিগারেট খাচ্ছি। এমন সময় দেখি আমাদের উকিল আমাদের খোজাখুজি করছেন উনার ফিসের টাকার জন্য। দেখলাম জনতার মাঝে একজন (ঋত্বিক?) গম্ভীর মুখে উকিলের দিকে এগিয়ে গেল। কিছু কথাবার্তা হবার পর সে গম্ভীর ভাবে পকেট থেকে সামান্য কিছু টাকা উকিলের হাতে ধরিয়ে দিল। টাকার অঙ্ক দেখার পর উকিলের মুখের প্রতিক্রিয়া দেখে দেবুকে (ছিট) দেখলাম হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পড়লো।
*******
Add comment