ঝরাপাতার দিনগুলি ………. (দ্বিতীয় পর্ব)
প্রদীপ ভৌমিক, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
হাওড়া কোর্টের এই কেস আমাদের জীবনে আরো কয়েকবছর প্রভাব ফেলেছিল। ফাইন্যাল ইয়ারে পাশ করবার পর কলেজের মাধ্যমে চাকরি পেলাম BBJ (Braithwaite Burn Jessop) কোম্পানীর মেইনট্যানন্স ওয়ার্কশপে, কলকাতার তারাতলায়। শুনেছিলাম ব্যাচের আরেক বন্ধু সনৎ ভৌমিকও BBJ র manufacturing ওয়ার্কশপে চাকরি পেয়েছিল। দেখা হয়নি বলে ওর সঙ্গে এই ব্যাপারে আর কোন কথা হয়নি। চাকরিসূত্রে কলকাতায় থাকতে হবে বলে দমদমে এক ঘরের বাড়ি ভাড়া নিলাম। দমদম থেকে তারাতলার দুরত্ব বেশ ভালই ছিল। সময়ও বেশি লাগতো। প্রভাতও তখন আমার সঙ্গে একই ঘরে থাকতো। ও সম্ভবত সেই সময়ে DCPL এ চাকরি পেয়েছে। BBJ-তে আমার পদ ছিল Student Engineer। রিপিয়ার-মেইনট্যানন্সের জন্য এই ওয়ার্কশপে প্রজেক্ট সাইট থেকে নানা ধরনের মেশিন আসতো। যেমন ক্রেন, ডিজি সেট, গাড়ী ও প্রজেক্ট সাইটে ব্যবহৃত নানা ধরনের মেশিন। সেই ওয়ার্কশপের ম্যানেজার ছিলেন এক কাজপাগল মানুষ। মাঝে মাঝে দেখতাম বয়লার স্যুট পরে অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছেন। ম্যানেজারের চাপে আমিও ওয়ার্কশপের শ্রমিকদের কাজে সাহায্য করে কাজ শিখতাম। মনে আছে কোম্পানির দুপুরের লাঞ্চ বেশ ভাল ছিল। নানাবিধ সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা থাকতো। ম্যানেজার ও ইঞ্জিনীয়ারদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। পরবর্তিকালে বেশ কিছু বছর পর আশির দশকের শেষ ও নব্বুই দশকে মুম্বাই থেকে কলকাতায় আসতাম আমাদের কোম্পানীর কাজে। আমাদের ক্লায়েন্টের প্রজেক্ট অর্ডার ইন্সপেকশন ও ফলো আপ করবার জন্য। যেমন McNeil Magor, Flakt, Paharpur Cooling Tower, Flanders McNeill, হাওড়ায় কিছু কাস্ট আয়রন ফাউন্ড্রি শপ, ইত্যাদি। একটা জিনিষ লক্ষ্য করতাম যে কলকাতার প্রায় সমস্ত কোম্পানীতেই লাঞ্চে খাওয়ার ব্যবস্থা বেশ ভাল ছিল। মুম্বাই ও পুনা অঞ্চলে দেখে ছিলাম calorie হিসাব করে লাঞ্চের খাবার তৈরি হতে, যাতে অতিরিক্ত খাবার খেয়ে শ্রমিক ও কর্মচারিরা অলস না হয়ে যায়। McNeil Magor-র ম্যানেজার একদিন মজা করে বলেছিলেন এই খাওয়া-দাওয়ার জন্য আমাদের কোম্পানী লাটে উঠবে। সকালে শ্রমিকরা সকাল সাতটায় আসে, সাড়ে সাতটায় breakfast । মোটামুটিভাবে সকাল আটটার আগে কাজকর্ম শুরু হয়না। আবার দুপুর একটায় মধ্যাহ্ন ভোজন। মধ্যাহ্ন ভোজনের আগে ও পরে কিছুক্ষন কাজকর্ম বন্ধ থাকে। উনি হিসেব করে বলেছিলেন খুব বেশি হলে একটা শিফ্টে ছয় ঘন্টার বেশি কাজ হয়না। পরবর্তীকালে McNeil Magor কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায় কোন এক কারনে। ভাল কোয়ালিটির পাইপিং ভালভ এই কোম্পানী আমাদের বিভিন্ন প্রজেক্টে সাপ্লাই করেছিল। ততদিনে দক্ষিন ভারতে ভাল ভাল বড় কোম্পানী গড়ে উঠেছিল। তারা ভাল কোয়ালিটির হাই প্রেসার পাইপিং ভালভ তৈরি করতো। যেমন L&T, KSB , Tuflin, ইত্যাদি। এছাড়াও তৈরি হয়েছিল world class foundries।
পুরনো কথায় ফিরে যাই। BBJ তে কয়েকমাস চাকরি করেছিলাম। এরপর বেলঘরিয়া Texmaco তে যোগ দিলাম গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার ট্রেইনি হয়ে। ব্যাচেলরদের জন্য কোম্পানির মেইন বিল্ডিংয়ের উপরের তলায় ফার্নিশড একোমডেশনের ব্যাবস্থা ছিল। এখানেই আমার থাকবার ব্যবস্থা হলো। বেশ ভাল ব্যবস্থা। দমদমের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে এখানে চলে এলাম। প্রভাত এরপরে কি করেছিল তা ঠিক মনে নেই। এখানে একই ফ্লোরের মেসে আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। তবে ভেজিটেরিয়ান। ব্যাচেলর একোমডেশনে আমিই একমাত্র বাঙ্গালি ছিলাম। বাকিরা উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থানের বিভিন্ন কলেজ থেকে এসেছিল। মোটামুটি ভালই ছিলাম। মনে আছে দিল্লী থেকে একজন ট্রেইনি ইঞ্জিনীয়ার এসেছিল, নাম সাক্সেনা। প্রথম নামটা মনে নেই। মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছিল। প্রায়ই বলতো- ফোর ফিগার স্যালারি হলে তবেই আমি বিয়ে করবো। মেসে একটা গান খুব চলতো ‘কভি কভি মেরে দিলমে খেয়াল আতা …….’। অমিতাভ বচ্চনের “কভি কভি” সিনেমাটা ঐ সময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। GWM ( general works manager)র ছেলে আমার কাছে মাঝে মাঝে পড়তে আসতো। ও La Martiniere স্কুলে ক্লাশ সিক্সে পড়তো। GWM ই আমাকে বলেছিলেন ওকে একটু পড়াশোনার ব্যাপারে গাইড করতে। উনার বাড়ীতে অনেক গেছি। এর আগে উনি মুম্বাইয়ে কোন টেক্সটাইল মেশিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে চাকরি করতেন। বাড়ীতে উনার বউ, এক ছেলে (যে আমার কাছে পড়তে আসতো ) ও এক মেয়েও ছিল। মেয়েও লা মার্টেনিয়ার স্কুলে সম্ভবত ক্লাশ নাইনে পড়তো। অতিশয় ভদ্র পরিবার। তবে GWM অফিসে গেলে অন্যরকম ব্যাক্তিত্ব হয়ে উঠতেন। সবাই খুব ভয় পেতো।
আমি ছিলাম স্পিন্ডল মেশিন শপে। এই সেকশনের ইনচার্জ ছিলেন একজন সুপারইনডেন্ট ।
আমরা উনাকে কুন্ডুবাবু বলে ডাকতাম। পুরনো আমলের মানুষ । নীচু তলা থেকে কাজ শিখে উপরে উঠেছেন। সমস্ত ডিপার্টমেন্টে দেখতাম প্রোডাকশন টারগেট এচিভ করা নিয়ে খুব চাপ। মাসে মাসে উঁচু লেভেলের মিটিং হতো। GWM ও Chief Executive মিটিং এ উপস্থিত থাকতেন। যারা টারগেট এচিভ করতে পারতো না তাদের ভীষনভাবে গালিগালাজ করা হতো। Time study ডিপার্টমেন্টের ইঞ্জিনীয়াররা এসে প্রত্যেক মেশিনের প্রত্যেকটা কাজের সময় বেঁধে দিয়েছিল। সেইভাবেই প্রোডাকশন টারগেট বেঁধে দেওয়া হতো। একবার monthly meeting এ দেখা গেল যে আমাদের সেকশনের প্রোডাকশন টারগেট এচিভ করা যায়নি। কুণ্ডুবাবু ম্যানেজমেন্টের কাছে থেকে গালাগাল খেতে থাকলেন। উনি বলেছিলেন কয়েকটা মেশিন খারাপ থাকায় প্রোডাকশনের ক্ষতি হয়েছে। মেইনটেনান্স ম্যানেজার ছিল খুব স্মার্ট শিক্ষিত ইঞ্জিনীয়ার। উনি খাতায় কলমে বুঝিয়ে দিলেন যে মাত্র কয়েকঘন্টা মেশিন খারাপ ছিল। ম্যানেজমেন্ট উনার কথাই শুনলো ও কুন্ডুবাবুর শাস্তি বলে দেওয়া হলো – আপনি কাল থেকে আর অফিসে আসবেন না। তিরিশ বছরের উপর এই কোম্পানিতে কাজ করেছেন। নীচু লেভেল থেকে কাজ শিখে নিজ যোগ্যতায় উনি এই পদে এসে পৌছেছেন। কুন্ডুবাবুকে দেখতাম বাইরে ফ্যাকট্রিতে ঢোকার গেটের কাছে চুপচাপ দাড়িয়ে খাকতে। এমনিভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর কুন্ডুবাবু ম্যানেজমেন্টের হাতেপায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে আবার চাকরিতে যোগ দিলেন। এই ছিল ওয়ার্ক কালচার। এই ঘটনা আমার মনকে ভীষন ভাবে আহত করে। মনে মনে ঠিক করলাম এই কোম্পানি ছাড়তে হবে। চাকরী খুঁজতে লাগলাম। সঙ্গে চলল পড়াশোনা। কলেজের কিছু বই ও নোট খাতা সঙ্গে রেখেছিলাম। BARC-তে ইন্টারভিউ ভাল হলো। ওখানকার নিয়ম ছিল ইন্টারভিউ বোর্ডেই সিলেকশনের কথা বলে দেওয়া। দুপুরে ওখানকার Moblab রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। ওখানেই দেবুর (ছিট ) সঙ্গে দেখা হলো। ও আমার একবছর আগে BARC তে যোগ দিয়েছে। আর আমি কলকাতায় একবছর অন্য কোম্পানিতে চাকরি করে তারপর এখানে যোগ দিয়েছিলাম। BARC (Trombay) র ভিতরকার অফিস রাস্তাঘাট দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ঠিক যেন ছবির মতো। তিনদিক পাহাড়ে ঘেরা আর একদিকে সমুদ্র। মনের আনন্দে এখানকার অফিস থেকে আসা-যাওয়ার ভাড়া কালেক্ট করে কলকাতায় ফিরে এলাম।
যথাসময়ে BARC থেকে নিয়োগপত্র হাতে পেলাম। আমার বড়বোনের বাড়ি ব্যারাকপুরের ঠিকানা দিয়েছিলাম। সেখানেই নিয়োগপত্র এসেছিল। চিন্তায় পড়ে গেলাম। টেক্সম্যাকোতে তো বন্ড আছে পাঁচ বছরের। নানারকম আশঙ্কায় ভুগছি। অফিসের বন্ধুদের সঙ্গেও কোন আলোচনা করিনি। কোম্পানিতে একজন ফাউন্ড্রি ম্যানেজার ছিলেন। বয়স্ক মানুষ। ওখানে স্টাফ কোয়াটার্সে থাকতেন, মেইন বিল্ডিংয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে। কুমারঢুবির ম্যাকনেলি-ভারত থেকে টেক্সম্যাকোতে এসেছিলেন। তাঁর ছেলে মেটালার্জিস্ট এই কোম্পানিতেই চাকরী করতো। ঠিক মনে করতে পারছি না ওর নাম, সম্ভবত দীপক। ওর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্বও হয়ে গেল। প্রায়ই আমরা সন্ধেবেলায় বাসে করে দক্ষিনেশ্বর মন্দিরে চলে যেতাম। খুব একটা দূরত্ব ছিল না, আমরা মন্দিরের চাতালে বসে কীর্তন শুনতাম। দীপকের বাড়ীতেও গল্প-গুজব করতে যেতাম। ওর বাড়ীতে শরৎ রচনাবলি ছিল। শরৎচন্দ্রের বইয়ের সঙ্গে ওখানেই আমার পরিচয়। এক একটা বই নিয়ে পড়তাম। এইভাবেই বেশ কিছু বই পড়া হয়েছিল। সেই দীপককেও আমি চাকরীর কথা বলতে পারিনি। অফিসের কিছু বন্ধু আমার কোম্পানীর একোমোডেশনে গল্প করতে আসতো। কোম্পানীর ওয়ার্ক কালচার নিয়ে আলোচনা হতো। প্রায় প্রত্যেকেই তখন চাকরী খুজছে। ঠিক করলাম কাউকে বলবো না। এমনকি GWM -কেও না। মুম্বাই যাবার ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে গেল। চিন্তায় পড়লাম এখন কোম্পানীর দেওয়া একোমোডেশন থেকে বেরবো কি ভাবে! ফারনিশড একোমোডেশন থাকায় জামাকাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। প্রয়োজনীয় জামাকাপড় ও কলেজের কাগজপত্র একটা হ্যান্ডব্যাগে প্যাক করলাম। স্যুটকেসটা আগেই রেখে এসেছিলাম আমার বোনের বাড়ি ব্যারাকপুরে। ঠিক করলাম খুব ভোরে উঠে চলে যাবো। উপর থেকে তাকিয়ে নীচে দেখি GWM মর্নিং ওয়াক করছেন। পাশেই উনার বাংলো। মর্নিং ওয়াক শেষ হবার পর আমি ঘর বন্ধ করে চাবিটা security তে জমা দিলাম। হাতের ব্যাগ দেখে যে কেউ ভাববে – আমি হয়তো দু একদিনের জন্য কোথায়ও যাচ্ছি। ছোট স্টাফ কলোনীতে প্রায় সবাই সবাইকে চিনতো। কলোনী থেকে সোজা বেলঘড়িয়া স্টেশনে চলে এলাম। সেখান থেকে আমার বড় বোনের বাড়ী। সেদিন রাত্রিতেই মুম্বাই যাবার ট্রেন। মুম্বাই যাবার ট্রেনের টিকিট ভায়া বর্ধমান হয়ে করেছিলাম। বর্ধমান স্টেশনে বাবা ও ভাইবোনেরা কম্পার্টমেন্টে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। মনে একটা কাঁটা খচখচ করছিল GWM কে না বলে আসবার জন্য। কোম্পানী থেকে ভাল ব্যাচেলার একোমোডেশন দিয়েছিল। উনি ও CEO আগরওয়াল সাহেব আমার ইন্টারভিউ নিয়ে ছিলেন। ইমপ্রেস করবার জন্য আমার প্রেমিকা ও তার দিদিকে আমার একোমোডেশন একদিন দেখিয়েও নিয়ে এসেছিলাম।
মুম্বাইয়ে দাদার স্টেশনে এসে পৌছালাম। স্টেশনেই BARC র ছাই রংয়ের বাস দাঁড়িয়েছিল। অন্যান্যরাও ছিল যারা এখানে যোগ দেবে। BARC তে যোগ দিলাম। Training hostel এ থাকবার ব্যবস্থা হলো। প্রত্যেক ঘরে এক একজনের থাকার ব্যবস্থা। ১৪ তলা বিশাল বিল্ডিং, একদিকে পাহাড়। ছবির মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, পরিস্কার রাস্তাঘাট, চারিদিক সবুজ ও প্রচুর গাছপালা। BARC ও পাহাড় দিয়ে ঘেরা ও একদিকে সমুদ্র। সম্ভবত: সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই এই ব্যবস্থা। একবছরের ট্রেনিং হোস্টেলের জীবন ছিল extended কলেজ লাইফ। বাড়তি সুবিধা মাসিক স্টাইপেন্ড। খাওয়া দাওয়াও ভাল ছিল। খেলাধূলার ভাল ব্যবস্থা ছিল, যেমন ফুটবল, ক্রিকেট, টেবিল টেনিস, ইত্যাদি। আমাদের এক বছরের ট্রেনিংয়ের সময় আমাদের প্রায় দশ কেজি ওজন বেড়ে গেছিলো। প্রত্যেক সোমবার রাত্রিবেলায় ওয়েস্টার্ন ডিনার থাকতো। রাত্রে ডিনারের পর আমরা চেম্বুরে সিনেমা দেখতে যেতাম। তবে পড়াশোনার চাপও ছিল। প্রত্যেক সপ্তাহে সোমবার করে পরীক্ষা হতো। সোম থেকে শুক্রবার ৫ দিন ক্লাশ, শনি-রবিবার ছুটিতে ছিল পরীক্ষার জন্য অধ্যয়ন। এক বছরে প্রায় ৩৫টা সাবজেক্ট পড়া ও তার পরীক্ষা দিতে হতো। সিনিয়ার অফিসাররা ক্লাশ নিতেন। ইঞ্জিনীয়ারিং সাবজেক্ট ছাড়াও ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, কমপিউটার পোগ্রামিং, ইত্যাদি ছিল। একটা বিশাল রাশিয়ান কম্পিউটার ছিল BESM 6 বিশাল জায়গা জুড়ে। সেই সময় রাশিয়ান ভাষারও ক্লাশ হতো। একবছর রাশিয়ান পড়ে পাশ করতে হতো। সিলেবাস তৈরী হয়েছিল নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের কথা ভেবে। এখন ট্রেনিং স্কুলকে Deemed Homi Bhabha University তে পরিনত করা হয়েছে। এখন এই একবছর ট্রেইনিংয়ের পর ইঞ্জিনীয়ারদের Diploma in Nuclear Engineering সার্টিফিকেট দেওয়া হয় আর সায়েন্টিস্টদের দেওয়া হয় post graduation in nuclear science। তখন Govt of India প্রজেক্ট নিয়েছিল নিউক্লিয়ার সাবমেরিন তৈরী করবার। পরবর্তিকালে Mazagon Dock এ সাবমেরিন তৈরি হয়। নিউক্লিয়ার ইঞ্জিন দিয়ে এই সাবমেরিন চালনা করা হয়। BARC তে তখন একটা রিসার্চ রিয়েকটার ছিল। নাম CIRUS । পোখরানে নিউক্লিয়ার বম্বের যে টেস্ট হয় তার প্লুটোনিয়াম এই রিসার্চ রিয়েকটারে তৈরি হয়।
আমাদের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং গ্রুপে দেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে প্রায় ৩০ জন যোগ দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর , শিবপুর ও খড়গপুর থেকেও। আমাদের গ্রুপে মুম্বাই আইআইটি থেকে আসা একটি মেয়েও ছিল। এছাড়া ৪ জন Commissioned Naval officer যারা নিউক্লিয়ার সাবমেরিন প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আমাদের কলেজের ব্যাচমেটদের মধ্যে ছিল বাগু (দেবব্রত মিত্র), পুটু (সমীর চৌধুরী)। এছাড়া কলেজে আমাদের পরের ব্যাচ থেকে যোগ দিয়েছিল গৌতম চ্যাটার্জী (প্রফেসর পি এন চ্যাটার্জীর ছেলে), রঞ্জন রায় ও পার্থ সরকার। রঞ্জন বন্ড পিরিয়ডের পর কলকাতায় এম এন দস্তুর কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিল। দক্ষিন ভারত থেকে বেশ কিছু মেয়ে বিভিন্ন বিভাগে যোগ দিয়েছিল। এছাড়া কয়েকজন প্রবাসী বাঙ্গালী ছিল যারা পরীক্ষায় ভাল ফল করেছিল।
মুম্বাইয়ে এসে প্রথম ধাক্কাটা লাগলো BEST বাস চড়বার সময়। বাস স্ট্যান্ড থেকে আমরা প্রথম গেট দিয়ে বাসে উঠলাম। কন্ডাকটার আমাদের গালাগাল দিয়ে নীচে নামিয়ে দিল। এরা যাত্রীদের সঙ্গে তু তু বলে কথা বলে যেটা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না। যাইহোক এরপর থেকে আমরা পিছনের দরজা দিয়ে উঠে প্রথম দরজা দিয়ে বাস থেকে নামতাম।
আমাদের welcome ceremony হলো central complex র অডিটোরিয়ামে। আমাদের ১৯৭৬ সালের 20th ব্যাচে প্রায় ২০০ জনের মত ট্রেইনি BARC এর বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে জয়েন করলো। welcome ceremony তে Atomic Energy Commission র Chairman Dr. Sethna, BARC র Director Dr. Raja Ramanna ও অন্যান্য গ্রুপ ডাইরেক্টরা উপস্থিত ছিলেন। মনে আছে উনারা ট্রেইনিদের উদ্দেশ্যে Cream of our Society বলে সম্বোধন করেছিলেন। দেশের বিভিন্ন কলেজ বা ইউনিভার্সিটি থেকে মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, ইন্স্টুমেনট্রেশন, মেটালার্জি, কেমিক্যাল, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, ইত্যাদিতে গ্রাজুয়েশন বা পোষ্ট গ্রাজুয়েশন করে তাঁরা এসেছিল। ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে প্রেসিডেন্সী , যাদবপুর, কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও ছিল। ট্রেইনিদের মধ্যে দক্ষিন ভারতীয় ও পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যা শতকরা হিসাবে বেশী ছিল। কয়েকজন ট্রেইনি জম্মু-কাশ্মীর থেকেও এসেছিল।
BARC র জীবন প্রথম বছর বেশ উদ্দীপনায় ও ব্যাস্ততায় কেটেছিল। সুন্দর পরিবেশ। বিশাল জায়গা নিয়ে ছবির মতন সাজানো চারিদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এই প্রতিষ্ঠান। বিশাল বিস্তৃত জায়গা বলে establishment র ভিতরেই BARC র বাস সার্ভিস ছিল। ভিতরেই ছিল dome shape CIRUS research রিয়েকটার। পঞ্চাশের দশকে এই 40 MW রিয়েকটর কানাডার টেকনোলজি সাহায্যে তৈরি হয়। এরপর আশির দশকে আমাদের দেশীয় টেকনোলজিতে 100 MW Dhruva রিসার্চ রিয়েকটার তৈরি হয়। এই রিসার্চ রিয়াকটারগুলিতে মিলিটারি গ্রেড প্লুটোনিয়াম তৈরি করা যায়। এই রিসার্চ রিয়েকটরগুলি IAEA র (International Atomic Energy Agency) regulation র আওতায় আসে না। তবে CIRUS research রিয়েকটর এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে এখন ২২ টি Nuclear plant আছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যারা ইলেকট্রিসিটি উৎপাদন করে। এই নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টগুলি control ও manage করে NPCIL, এদের মধ্যে ১৮ টা heavy water নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ও ৪ টা light water নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট।
BARC ক্যাম্পাসের ভিতরেই বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট ছিল। আমরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ চা কফি স্ন্যাক্স খেতে যেতাম। আর বাইরে ছিল residential colony, নাম অনুশক্তি নগর। খুব সুন্দর, সাজানো ও পরিষ্কার। অনেকগুলো বহুতলা বাড়ি ছিল। সুন্দর সুন্দর নামের অজন্তা, ইলোরা, নালন্দা, এভারেষ্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, ধবলগিরি, নীলগিরি, শান্তিনিকেতন, ইত্যাদি। আমাদের ট্রেনিদের হস্টেল ছিল অনুশক্তি নগরে। BARC র বাসে করে আমরা ক্লাশ করতে বা ট্রেনিং করতে যেতাম আসতাম। BARC র গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকার বা গেট দিয়ে বাইরে বেরোবার সময় Security check খুব কড়াকড়ি ছিল। CRPF security কন্ট্রোল করতো।
সপ্তাহের ৫ দিন ক্লাশ থাকতো, শনিবার ও রবিবার ছুটি। সোমবার করে পরীক্ষা থাকতো। তাই শনি রবি এই দুদিন দেখতাম সবাইকে কমবেশি পড়াশোনা করতে। একটা চাপ তো থাকতোই – মানে পাশ করবার তাগিদ। সোমবার সন্ধ্যায় ওয়েস্টার্ন ডিনার, ডিনার খেয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া বা লনে বসে আড্ডা দেওয়া হতো। আমাদের কাছাকাছিই চেম্বুরে কয়েকটা সিনেমা হল ছিল। অথবা আরো একটু দূরে ঘাটকোপারেও মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে যেতাম। চেম্বুরে আমরা গীতাভবন নামে একটা ভেজিটেরিয়েন রেস্টুরেন্টেও মাঝে মাঝে খেতে যেতাম। বেশ নাম ছিল। এখনও এই গীতাভবন রেস্টুরেন্ট আছে। শুনেছিলাম রাজকাপুর এই রেস্টুরেন্টে খেতে আসতেন। রাজকাপুরের বিখ্যাত R.K. Studio এই চেম্বুরেই, তাঁর থাকবার বাংলোও ছিল চেম্বুরে। ২০২২ সালে Godrej properties এই স্টুডিয়ো কিনে নিয়েছে। এখন এখানে Luxury apartment তৈরি হচ্ছে।
মুম্বাইয়ে আমরা এসেছিলাম জুলাই মাসে। বর্ষাকাল। এসে দেখি অনবরত বৃষ্টি, থামার লক্ষনই নেই। আমাদের ট্রেনিং স্কুল হস্টেলের সামনে উঁচু উঁচু পাহাড় ছিল। মনে হতো পাহাড়গুলি যেন মেঘকে আটকে রেখে দিয়েছে! আমাদের প্রত্যেকের হাতে থাকতো হয় ছাতা বা রেনকোট। বৃষ্টির সঙ্গে সেরকমই হাওয়ার তীব্র গতি। ছাতা ধরে রাখা যায়না। দিনের পর দিন সপ্তাহের পর সপ্তাহ সূর্যের দেখা নেই। মুম্বাইয়ের আশেপাশে কোন নদী নেই। সাতটা বড় বড় লেকের মাধ্যমে বর্ষাকালে জল ধরে রাখা হয়। সারাবছর এই লেকে বৃষ্টির ধরা জলই পরিশ্রুত করে নাগরিকদের সাপ্লাই করা হয়। বৃষ্টি ঠিকমত না হলেই জলের কষ্ট হয়। একবার বৃষ্টি কম হওয়ার আর্টিফিসিয়াল বৃষ্টি করানো হয়েছিল লেকগুলোর কাছাকাছি জায়গায়। Climate change র কারনে BMC একটা পাইলট প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে – De-salination plant। সমুদ্রের জল থেকে নুন বার করে ও purify করে নাগরিকদের সাপ্লাই করা। যেমন মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে করা হয়। তবে এই প্রসেসে সাপ্লাই করা জলের দাম অনেক বেশি।
বাঙ্গালীদের একটা আড্ডার গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। আমরা ডিনারের পর হস্টেলের সামনে লনে বসে আড্ডা দিতাম। আমাদের মধ্যে বান্দ্রার একজন বাঙ্গালি ছেলে ছিল। বান্দ্রায় বাড়ী শুনে আমরা ভেবেই নিলাম যে ওর বাবা নিশ্চয় বড়লোক হবেন। সে খুব সাধারনভাবেই থাকতো। প্যান্টের উপর ঝোলানো হাফ শার্ট। পায়ে চটি। ওর সাবজেক্ট ছিল ইলেক্ট্রোনিক্স। কলকাতা সায়েন্স কলেজ থেকে B. Tech পাশ করে ট্রেনিং স্কুলে এসেছিল। শনি রবিবার বাড়ী চলে যেত ও সোমবার এসে পরীক্ষা দিত। পরীক্ষার আগে ওর ডিপার্টমেন্টের ছেলেরা ওর কাছে যেত কোন কঠিন জিনিষ বুঝতে। আস্তে আস্তে ওর সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হতে লাগলো। বাড়ীর কথা বলতে গেলে এড়িয়ে যেতো। একজন ওকে জিজ্ঞেস করলো – তোমার বাবা কি করেন ! ও বলল – ব্যবসা করে। এইভাবে কয়েক মাস যাবার পর ও আস্তে আস্তে নিজেকে খুলতে শুরু করলো। একদিন বাড়ী থেকে এসে আড্ডায় কথা বলতে বলতে বলল – বাবার চাপে পরে একটা সিনেমা দেখতে হলো। তখন প্রত্যেক রবিবার করে সন্ধেবেলায় দূরদর্শনে সিনেমা দেখানো হতো। আমরা জিজ্ঞেস করলাম কি সিনেমা! ও বলল – ‘আনন্দ’। বাবা এই সিনেমাটার জন্য ‘প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল’ পেয়েছেন। আমরা উচ্ছসিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম – তোমার বাবা হৃষিকেশ মুখার্জী!
সেই প্রতীপ মুখার্জীর সঙ্গে আলাপ হবার পর আমরা দুই তিনজন বন্ধু ওদের বান্দ্রার বাংলোতে গিয়েছিলাম। বান্দ্রা সমুদ্রের ধারে দোতলা বাংলো। একটা ঘরে ঋষিকেশ মুখার্জীর পাওয়া মেডেল সারি সারি সাজানো। ‘আনন্দ’ সিনেমার জন্য প্রেসিডেন্ট মেডেলও দেখলাম। বাড়িতে ওর বাবা ছিলেন না। কয়েকজন কাজের লোক ও কয়েকটা পোষা কুকুর ছিল। প্রতীপের কাছেই জানলাম যে ঋষিকেশ মুখার্জী পরিচালিত প্রযোজিত অনেক ছবির ইনডোর শুটিং ওদের বাড়িতেই হয়েছিল। যেমন ‘গোলমাল’, ‘আনন্দ’ ইত্যাদি। প্রতীপ আমাদেরকে ওঁদের খান্ডালার বাংলোতেও নিয়ে গিয়েছিল। মুম্বাই থেকে পুনা যাবার রাস্তায় পরে খান্ডালা ও লোনাভলা। পাহাড়ী জায়গা। মুম্বাইয়ের ধনী লোকেরা এখানে বাংলো কিনে রাখে সপ্তাহান্তে ছুটি কাটাবার জন্য। বর্ষাকালে পর্যটকদের খুব ভিড় হয়। এনারা বৃষ্টিতে ভিজে বর্ষা উপভোগ করতে আসেন। ছেলে-মেয়ে-পুরুষরা দলে দলে রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটতে হাঁটতে নাচতে নাচতে গান গাইতে গাইতে বর্ষা উপভোগ করেন সেই লাগাম ছাড়া বৃষ্টিতে। কাছাকাছি একটা ড্যাম আছে নাম – ভুসি ড্যাম। সেখানে গিয়েও অনেকে স্নান করে, সাঁতার কাটে। বর্ষাকালে এই সমস্ত অঞ্চলের দৃশ্য খুব সুন্দর। চারিধারে পাহাড় সবুজ রং ধারন করে।অজস্র ঝর্ণা পাহাড়ের কোল থেকে নিচে আসে।
আমরা বাসে করে এসে খান্ডালায় নামলাম। মুস্কিল হলো প্রতীপ ওদের বাংলোর অবস্থান ভুলে গেছে। খুব বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা রেইনকোট পরে বাড়ি খোঁজাখুঁজি করছি। প্রতীপের হঠাৎ মনে হলো যে ওদের বাংলো রাজেশ খান্নার বাংলোর পাশেই। ও গিয়ে পাশের বাংলোর একজন সিকিউরিটি গার্ডকে রাজেশ খান্নার বাংলোর অবস্থান জিজ্ঞেস করলো। সেইমত সেখানে গিয়েই ও নিজেদের বাংলো চিনতে পারলো। আমরা দুইদিন এখানে থেকে খান্ডালা-লোনাভলার বৃষ্টি উপভোগ করেছিলাম।
এদিকে ট্রেনিং স্কুলে ক্লাশ ও পরীক্ষার চাপ যথারীতি বাড়ছে। ট্রেনিং স্কুল হস্টেলে খেলাধূলারও ভাল ব্যাবস্থা ছিল। আমরা ফুটবল, ক্রিকেট, টেবিল টেনিস ইত্যাদি খেলতাম। মহারাষ্ট্রে অনেক আখের চাষ হয়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আখ পিষাইয়ের মেসিন নিয়ে বিক্রেতারা দাড়িয়ে থাকতো। ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার পর পরিশ্রান্ত হয়ে বরফ দেওয়া ঠান্ডা আখের রস খেয়ে আমরা দলবেঁধে হোস্টেলে ফিরতাম। একবার একটা মজার ঘটনা ঘটলো। আমাদের ব্যাচের (২০ ব্যাচ) সঙ্গে আগের ব্যাচের (১৯ ব্যাচ) ফুটবল ম্যাচ। দেবু (ছিট) ১৯ ব্যাচের গোলকিপার। খেলা শুরু হল। বেশ উত্তেজনাপূর্ন খেলা। কেউ কাউকে গোল দিতে পারছে না। খেলা শেষ হবার কিছুক্ষন আগে আমাদের সেন্টার ফরওয়ার্ড (তুষার- BHU থেকে এসেছিল) ডিফেন্সকে ড্রিবল করে তীব্রগতিতে গোলপোস্টের দিকে ছুটে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেবু একা গোলরক্ষক। আর কোন উপায় না দেখে দেবুও তুষারের দিকে দৌড়ে গিয়ে ওকে আটকানোর চেষ্টা করলো। ওর লক্ষ্য বল ছেড়ে তুষারের দিকে। এর ফলে মুখোমুখি সংঘর্ষ। দুজন দু’দিকে ছিটকে পড়লো। তার আগেই তুষার বলটা গোলপোস্টের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তুষারের চেহারা ছিল লম্বা গাট্টাগোট্টা। আমরা দৌড়ে দুজনের দিকে ছুটে গেলাম। দুজনেই অল্পবিস্তর চোট পেয়েছিল। দেবুর চশমা ছিটকে কিছুটা দূরে পড়েছিল। দুজনকেই অল্পবিস্তর ম্যাসাজ করে সুস্থ করা হলো।
ডিসেম্বর মাসে আমাদের দু’সপ্তাহের ছুটি হলো। আমরা প্রায় সব ট্রেইনিরা বাড়ী এলাম। বাড়ী এসে ঠিক করলাম আমার পুরনো কোম্পানি টেক্সম্যকোতে GWM র সঙ্গে দেখা করবো। কোম্পানি থেকে প্রায় পালিয়েই কাউকে না জানিয়ে মুম্বই চলে গিয়েছিলাম। মুম্বাইয়ে যাওয়ার পর অবশ্য উনাকে সবকিছু জানিয়ে ব্যক্তিগত চিঠি দিয়েছিলাম। কোম্পানিতে উনার ঘরে ঢোকার পর উনি সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। হাতের জরুরি কাজ শেষ করবার পর উনি আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। ভটচাজবাবু জিজ্ঞেস করলেন – এখন কোথায় আছো! আমি সব খুলে বললাম। শোনার শেষে উনি বললেন – ওখানেতো বুড়া বয়েসে লোকেরা চাকরি করতে যায়! এখানকার মতো কোন চ্যালেঞ্জ নাই! আমি চুপচাপ উনার কথা শুনে গেলাম। কোন উত্তর দিলাম না। মনে শান্তি পেলাম উনার সঙ্গে দেখা করতে পেরে। ইন্টারভিউুতে উনিই আমাকে টেক্সম্যকোতে নির্বাচন করেছিলেন।
বছর ঘুরতেই আমাদের একবছরের ট্রেনং শেষ হলো। পরীক্ষার ফল প্রতি সপ্তাহে পরীক্ষার পর জানিয়ে দেওয়া হতো। দেখলাম সমস্ত ডিপার্টমেন্ট মিলে ভূপালের একজন বাঙ্গালি ছেলে প্রথম হয়েছে – নাম জয় দাশগুপ্ত। খেলাধূলাতেও ভাল ছিল। পরবর্তি একবছরের মধ্যেই ওর অকাল মৃত্যু হয়। আমরা সবাই শ্মশানে গিয়ে দেখলাম ছেলের মৃতদেহের সামনে বসে বাবা বেদ পাঠ করছেন।
আমাদের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে প্লেসমেন্ট হলো। অনেকের প্লেসমেন্ট হলো বিভিন্ন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে। যেমন তারাপুর, রাজস্থান, মাদ্রাজ, নরোরা, ইত্যাদি জায়গায়। আমাদের বাগুর (দেবব্রত মিত্র) হলো রাজস্থান নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে। সেইসময় অনেকেই প্লেসমেন্ট নিত মুম্বাইয়ের বাইরে। কারণ মুম্বাইয়ে ভয়ানক বাড়ীর সমস্যা। আমার জায়গা হলো BARC তে সেন্ট্রাল ওয়ার্কসপে আমার পছন্দমতো। এর আগে একবছর কলকাতার কোম্পানি ওয়ার্কশপে চাকরি করেছিলাম। চার বছরের বেশি সেন্ট্রাল ওয়ার্কশপে ছিলাম। অনেকে গেল ডিজাইন ডিপার্টমেন্টে। এই সময়ে দেশের প্রথম রিসার্চ রিয়েকটার তৈরি হয় R5 প্রোজেক্টের জন্য। প্রোজেক্ট শেষ হবার পর যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ধ্রুব’। দেশীয় ডিজাইনে এই রিয়েকটরের ক্যালেন্ড্রিয়া তৈরি হয়েছিল এই সেন্ট্রাল ওয়ার্কশপেই। ইউরোপিয়ান দেশ থেকে মডার্ন মেশিন আনা হয়েছিল এই ক্যালেন্ড্রিয়া তৈরি করবার জন্য। যেমন computer controlled precision machine tools, electron beam welding m/c, ইত্যাদি।
ট্রেনিং পিরিয়ড শেষ হবার পর নিজেদের বাসস্থান নিজেকেই খুঁজে নিতে হতো। পর্যাপ্ত কোয়াটার্স কলোনীতে ছিল না। ১০-১৫ বছর অপেক্ষা করবার পরই কোয়াটার্স পাওয়া যেতো। এখন অনেকেই লোন নিয়ে কোয়াটার্সের বাইরে ফ্ল্যাট কিনে নেয়, তাই এখন কোয়াটার্স খালি থাকে। আমাদের সময়ে বাড়ী পাওয়া ভয়ানক সমস্যা ছিল। একবছর ট্রেনিং হসেটেলে খাকার পর কোম্পানি অনেককে একঘরের ছোট ফ্ল্যাট দিল। ভাসীতে (নবি মুম্বই) দুজনকে একটা ঘরে জায়গা দেওয়া হলো। এতেই আমরা খুশি। আমার রুমমেট হলো মিলন। ফিজিক্সের ছেলে। পরবর্তিকালে ও কলকাতার Saha Institute of Nuclear physics র ডিরেক্টর হয়েছিল। দেবুও (ছিট) কাছাকাছি থাকতো। ও আমার থেকে একবছর আগে BARC তে যোগ দিয়েছিল। বেশ আনন্দে দিন কাটছিল। অফিসের পর ব্যাডমিন্টন খেলা, ছুটির দিন ক্রিকেট খেলা বা সিনেমা দেখা।
এরই মধ্যে ঘটলো বজ্রাঘাত। দেশে তখন এমারজেন্সি। দেবুর চাকরির probation period extend হলো। এর মধ্যে ও বিয়ে করেছে মুম্বাইয়ের এক মেয়েকে। শশা (শশাঙ্ক) এই বিয়েতে মুম্বাইয়ে এসেছিল। আমি এয়ারপোর্টে গেছিলাম শশাকে রিসিভ করতে। আমাদের এক সিনিয়ার দাদারও চাকরী চলে গেল। আমরা সবাই কলেজে থাকাকালিন পুলিশ কেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কলেজের গন্ডগোলের সময়ের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও কোর্ট থেকে আমাদের কেসটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু BARC তে যোগ দেবার সময় কিছু undertaking দিতে হয়েছিল। সেখানে আমাদের পুলিশ কেস সম্বন্ধে যথাযথ ভাবে জানিয়েছিলাম। মনে নানারকম শঙ্কা। দেবুর যা হচ্ছে আমারও তাই হবে। সরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের ক্লাশ ওয়ান গেজেটেড পদ বলে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়ত বিশদভাবে করে। চাকরি চলে যাওয়ার ঘটনা তখন দেশে বেশ কিছু হয়েছিল। সম্ভবত এমারজেন্সি চলছে বলেই নিয়মের আরো কড়াকড়ি। দেবু প্রায় রোজই বউকে নিয়ে ভাসীতে আমাদের ফ্ল্যাটে আসতো। আমরা নানারকম আশঙ্কার কথা আলোচনা করতাম। আমরা দুজনে একই পথের পথিক। শুনেছিলাম আমাদের সিনিয়ার দাদা একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিল গ্রুপ ডাইরেক্টের ফরমাসে। এরমধ্যে এমারজেন্সী পিরিয়ড শেষ হয়ে ভোটের পরে ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টির নতুন সরকার তৈরী হলো। নতুন গভর্নমেন্ট এসে সম্ভবত কিছু নিয়ম কানুনের পরিবর্তন করেছিল। এরপর সিনিয়ার দাদা অবশ্য চাকরি ফেরত পায়। দেবুর চাকরিরও confirmation হলো। আমারও পরে আর কোন অসুবিধা হয়নি। আমাদের জীবনে যে এত ঝড় ঝাপটা গেল তার জন্য দায়ি করবো কাকে? আমরা কি সত্যিই কিছু করেছিলাম! রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছাড়া আর কাউকেই বা দায়ী করা যায়!
যাইহোক ভাসীতে আমাদের বেশ হইচই করেই কাটছিল। অফিস থেকে ফিরে এসে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। বাড়ির সামনে ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য কোর্ট বানানো হলো, সঙ্গে লাইটের ব্যবস্থা। রান্নাবান্না নিজেদের করতে হতো। আমি আর মিলন রুমমেট। সাধারনত রান্না আমিই করতাম। এটাও কলেজ হস্টেলে থাকবার সময় দেখে দেখে শেখা। ৭৩ সালের ডিসেম্বরে আমাদের ব্যারাক সারভেন্টদের স্ট্রাইকের সময় হস্টেলের ছাত্রদের গ্রুপ করে রান্না করা, তরকারি কাটা ও বাসনপত্র ধোওয়া, ইত্যাদি কাজ করতে হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে কাজে লেগেছিল। অসুবিধা হয়েছিল প্রথম প্রথম মাছ ভাজা নিয়ে। মাছ ভাজার সময় ফুটন্ত তেল ছিটকে আসতো। আমি রেইনকোট পড়ে চোখে গগলস লাগিয়ে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম। বাইরে থেকে এসে ঘরের ভিতরে ঢুকে আমার রুমমেট আমাকে দেখে তো হতবাক! পরে জানা গেল তেল ভাল করে গরম করবার পর কড়াইয়ে মাছটা ফেলে ভাজতে হয়। এরপর থেকে মাছ ভাজতে আর অসুবিধা হয়নি।
নবী মুম্বাই তখন ডেভেলপ হতে শুরু করেছে। ভাসী থেকেই ডেভেলপমেন্টের শুরু। গ্রামের জমি অধিগ্রহণ করে নতুন শহর তৈরি হতে শুরু করেছে। আমরা শীতকালে ছুটির দিনে সামনের একটা মাঠে ক্রিকেট খেলতাম। গ্রামের ছেলেদের সেটা পছন্দ ছিল না। একদিন আমরা ক্রিকেট খেলছি। দেখলাম গ্রামের ছেলেরা আমাদের ঘিরে দাঁড়ালো। একজন একটা উইকেট তুলে গৌতমের (পি এন চ্যাটার্জীর ছেলে) পিঠে মারলো এক বারি। সেই দেখে আমরা যে যার মত দৌড়ে পালালাম নিজেদের বাঁচানোর জন্য। দেখলাম আমার পাশে ভাস্করদাও (আমাদের সিনিয়ার, বিহার থেকে এসেছিল) দৌড়চ্ছে। আমরা রো’ হাউসের পাশ দিয়ে ছুটছি। দেখলাম একটা বাড়ির দরজা খোলা। দুজনে সেই বাড়িতে ঢুকে দরজা ভিতর দিক থেকে বন্ধ করে সোজা উপরে উঠে গেলাম। দেখলাম ছুতোর মিস্ত্রি কাজ করছে। আমরা ঢুকে উপরের ঘরের দরজাটাও বন্ধ করে দিলাম। দেখলাম ছুতোর মিস্ত্রি আমাদের দেখে ভয় পেয়েছে। ভাস্কর’দা ইশারা করে চুপ থাকতে বললো। বাড়ির নীচে দুইজন মহিলাকে দেখলাম চেঁচামেচি শুরু করেছে। ভাস্করদাকে দেখলাম হাত জোর করে উনাদের চুপ থাকতে বললো। এই ভাবে কিছু সময় পর আমরা এই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নিজের নিজের বাড়িতে চলে গেলাম। এদিকে দেবু (ছিট) দর্শকের আসনে বসে খেলা দেখছিল। গ্রামের ছেলেরা ওর পেছনেও তাড়া করলো। দৌড়তে দৌড়তে হোচট খেয়ে দেবু একটা ড্রেনে পড়ে গেল। গ্রামের ছেলেরা ওকে মারতে শুরু করলো। পরে শুনেছি নিজেকে বাঁচাবার জন্য দেবু নাকি হিন্দী ও মারাঠী ভাষা মিলিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেছিল – ম্যায় খেলোয়াড় নেহি। যাই হোক পাশের দোকানের লোকজন এসে ওকে রক্ষা করে।
আমরা একবার বাদল সরকারের নাটক দেখতে গেলাম। প্রায় একসপ্তাহ ধরে চলেছিল এই নাট্য উৎসব। অমল পালেকরের নাটকের গ্রুপ ‘অনিকেত’ এই নাট্য উৎসবের আয়োজন করেছিল। বাদল সরকারের ৪-৫ টা নাটক দেখেছিলাম। যেমন ভোমা, হট্টমেলার ওপারে, ইত্যাদি। নাটকগুলো হয়েছিল দাদর অঞ্চলে ছবিলদাস স্কুলের একটা হলে। দেখলাম বাদল সরকারের নাটকে স্টেজ থাকে না। হলের মেঝেতে দর্শকরা বসে, ওদের মাঝখানে গোল জায়গায় নাটক প্রদর্শন হয়। দর্শকদের মাঝেই শিল্পীরা বসে থাকে। যখন সময় হয় উঠে গিয়ে শিল্পীরা গোল জায়গাটায় গিয়ে অভিনয় করে। শিল্পীরাই দৈহিক কুশলতায় গাছ, বাড়ি, ইত্যাদি হয়ে যাচ্ছে। শিল্পীদের কোন বিশেষ সাজ পোষাকও ছিল না। হলে গিয়ে দেখতাম কাউন্টারে বসে অমল পালেকার টিকিট বিক্রি করছে। মাঝে মাঝে দেখতাম ওর বউ চিত্রা পালেকার অবসর সময়ে কাউন্টারের বাইরে সিগারেট খাচ্ছে। মহারাষ্ট্রে দেখেছি নাটকের উপর জনসাধারণের একটা বিশেষ আকর্ষন আছে। মুম্বাই, থানে, পুনে, নাগপুর, ইত্যাদি শহরে রীতিমত নাটকের প্রদর্শন হয়। নাটকের হলগুলি বেশ ব্যস্ত থাকে। পি সি সরকারের (জুনিয়ার) ম্যাজিক শোয়ের আয়োজন করতে গিয়ে একটানা হল পাবার জন্য আমাদের বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। একবার উৎপল দত্তকে আমন্ত্রন করে নাটকে অবদানের জন্য তাঁকে বিশেষ সম্বর্ধনা দেওয়া হলো সরকারী ব্যবস্থাপনায়। সেই সম্বর্ধনায় উপস্থিত ছিলেন মারাঠী নাটকের মহীরুহু পিএল দেশপান্ডে, বিজয় তেন্ডুলকর, শ্রীরাম লাগু। একটা মারাঠী নাটক ছিল ‘শান্ততা কোর্ট চালু আহে’ যার বাংলা অনুবাদ হয়েছিল ‘চুপ আদালত চলছে’। অনেক বাংলা নাটকও মারাঠীতে অনুবাদ হয়েছে।
এরপর BARC তে একবছরের হোস্টেল জীবনও কেটেছিল আনন্দে। যাই হোক নানা বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে আমার চাকরীর confirmation হলো। ১৯৭৭ সালে জনতা সরকার আসবার পর যাদের এমারজেন্সির সময় চাকরী চলে গেছিল তারাও চাকরী ফেরত পেলো। আমারও চাকরীর confirmation হতে অসুবিধা হয়নি। এরপর আমার বিয়ে হলো কলকাতায়। কলেজের বন্ধুদের মধ্যে শশাঙ্কই আমার বিয়েতে এসেছিল। ছুটি কম ছিল বলে বিয়ের কয়েকদিন পর একাই মুম্বাই ফিরলাম। তাছাড়া আমার বউয়ের ফাইনাল ইয়ারের কিছুদিনের ক্লাশ বাকী ছিল।
12 July 2015
মাস দুয়েক পর শুনলাম প্রতীপ কলকাতায় যাচ্ছে। ওকে বললাম ফেরার সময় আমার বউ তার সঙ্গে মুম্বাইয়ে ফিরবে। আমার বউয়ের বড়দা এদের দুজনের ট্রেনের টিকিট কাটলেন। সেই সময়ে মধ্যবিত্ত পরিবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে বম্বের সিনেমা সম্বন্ধে একটা ভীতি ছিল। উনি প্রতীপের কলকাতার বাড়ী গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে এলেন। ট্রেন ছাড়ার আগে শোনা গেল প্রতীপের বাবা হৃষিকেশ মুখার্জীও ওদের সঙ্গে আসছেন। উনার ফ্লাইটে টিকিট কাটা ছিল। টিকিট cancel করে উনি গীতাজ্ঞলি ট্রেনে টিকিট কাটালেন। সেই সময় ১৯৭৮ সালে এই ট্রেনের উদ্বোধন হয়েছে। মধু দন্ডাবতে তখন রেলওয়ে মন্ত্রী। গীতাজ্ঞলি তখন classless ট্রেন। সেই ট্রেন দেখার জন্য উনি গীতাজ্ঞলিতে মুম্বাই যাওয়া মনস্থ করলেন। সেইময় এই ট্রেন ছিল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, শোবার জন্য পরিষ্কার ধোয়া চাদর- বালিশ দেওয়া হতো, সঙ্গে ছিল বইয়ের লাইব্রেরী। উনার সঙ্গে বিখ্যাত সেতার শিল্পী উস্তাদ রইস খানও ছিলেন। উনি ১৯৮৬ সালে পাকিস্থানে চলে যান। আমার বউয়ের টিকিট মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত জায়গায় কাটা হয়েছিল। সেখানে সেই ছিল একমাত্র মহিলা যাত্রী। ঋষিকেশ মুখার্জী আমার বউকে উনাদের কাছে নিয়ে আসেন। আমার বউকে উনি সারা ট্রেনে মা বলে সম্বোধন করে গেছেন। বেশি সাজগোজ করেনি বলে খুশি হয়েছিলেন। ব্যবহারে খুবই ভদ্র ও সাধারন। পরের দিন রাত দশটায় গীতাজ্ঞলি ট্রেন দাদর ষ্টেশনে এসে পৌছালো। ষ্টেশনে এসে উনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন – প্রদীপ, এতরাতে ভাসীতে না গিয়ে আমাদের বাড়ী চলো। সেই সময় নবীমুম্বই সবেমাত্র ডেভেলাপ হতে শুরু করেছে। আমি বললাম – মেসোমশাই আমার সঙ্গে দুজন বন্ধু আছে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে। কোন অসুবিধা হবে না। অল্প পরিচয়ের মধ্যে মনে হয়েছে উনারমত স্নেহময় মানুষ আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। এরপর উনি একদিন আমাদের ভাসীর বাড়ীতে এসেছিলেন। উনি তখন পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ডাইরেক্টর। পুনা থেকে ফেরার পথে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
কলেজের পড়াশোনা শেষে যখন মুম্বাইয়ে এসেছিলাম, তখন এত ফোন, ফেসবুক, ইন্টারনেট ছিল না। ফলে প্রায় চল্লিশ বছর কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগই ছিল না। শুধু দুই একজনের সঙ্গে যাদের চাকুরিস্থল ছিল মুম্বাই। দেবু (ছিট) আর আমি BARC তে চাকরী করতাম। এছাড়া ছিল বাগু (দেবব্রত মিত্র)। ও আমার সঙ্গে ট্রেনিং স্কুলেই ছিল। এক বছর training period র পর ওর RAPP-তে ( Rajasthan atomic power plant) পোস্টিং হয়। এরপর আর ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। ওর একটা কথা খুব মনে হয় – ১০০ টা গাধা মরলে একটা বাড়ীর বড় ছেলে হয়। কয়েকবছর আগে রিটায়ারের পরে কলকাতার এক হাসপাতালে ও মারা যায়। এছাড়া শশাঙ্ক আমার বিয়েতে বর্ধমানের বাড়িতে ও দেবুর( ছিট ) বিয়েতে মুম্বাইয়ে এসেছিল। কলেজ থেকে পাশ করবার পঞ্চাশ বছরের গোল্ডেন জুবিলির সময় পুরনো দিনের কিছু কিছু স্মৃতি আবছাভাবে মনে পড়তে লাগল।
Picnic by 1974 college batch, Shibpur at Diamond Harbour on 7th Jan’18. A get together for me after 44 years.
অনেক বছর পর নব্বুই দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবছরের মত আমরা কলকাতায় গেছি। ইচ্ছে হলো বউ আর মেয়েকে আমাদের কলেজ দেখিয়ে নিয়ে আসি। আমরা ৫৫ নং বাস ধরলাম এসপ্ল্যানেড থেকে। নামলাম কলেজের এক নম্বর গেটের কাছে। এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে হাটতে হাটতে কলেজ বিল্ডিং দেখে ওভালের পাশ দিয়ে দশ নম্বর হস্টেল দেখে ডাউনিং হস্টেলের পাশ দিয়ে গেট থেকে বেরোলাম। এরপর ঢুকলাম বটানিক্যাল গার্ডেনে। বটানিক্যাল গার্ডেন ছাড়া বিই কলেজ সম্পুর্নই হয়না। কলেজের ছেলেরা কোন না কোন সময়ে নিজেদের রোমিও ভেবে জুলিয়েটের সন্ধানে কত না ব্যোটানিকেল গার্ডেনে ঘুরে বেরিয়েছে! মন খারাপ হলে এই বিশাল সবুজ বাগান ঘুরে মনকে শান্ত করেছি। হাটতে হাটতে great banyan গাছের কাছে এলাম। অগুন্তি শাখাপ্রশাখা নিয়ে দাড়িয়ে আছে আমাদের বিশাল iconic বটগাছ। ঠিক যেন আমাদের মাতৃসমা বিই কলেজ। সহস্র সহস্র ছাত্র ছাত্রী শত বছর ধরে দেশে বিদেশে শাখা প্রশাখার মত ছড়িয়ে আছে।
Add comment