খেয়ালী বাড়িতে ভরা আমাদের শান্তিনিকেতন ও তার বৈচিত্র সম্ভার
বিজিত কুমার রায়, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
শান্তিনিকেতনের গোড়ার কথা
১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য যাচ্ছিলেন। পথে ভুবনডাঙা গ্রামের কাছে একটি দিগন্তপ্রসারিত মাঠের ভিতর দুটি মাত্র ছাতিম গাছ দেখতে পান। সেই ধূসর প্রান্তরের ভিতর এই ছাতিম গাছ দুটি দেখে তিনি এক ধরনের আত্মিক আকর্ষণ অনুভব করেন। এখানে থেমে ছাতিম গাছের ছায়ায় তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। এই স্থানের আকর্ষণ থেকেই তিনি ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ তারিখে [রবিবার ১৮ ফাল্গুন, ১২৬৯ বঙ্গাব্দ] রায়পুরের জমিদার প্রতাপ নারায়ণ সিংহের কাছ থেকে ভুবনডাঙা গ্রামের বাঁধ সংলগ্ন এই ছাতিমতলাসহ বিশ বিঘা জমি বার্ষিক পাঁচ টাকা খাজনায় মৌরসী-স্বত্ব গ্রহণ করেন। পরে এখানে একটি আশ্রম গড়ে তুলেন। এই স্থানে খুব ডাকাতের ভয় ছিল, ডাকাত-সর্দারের নাম ছিল দ্বারী সর্দার। দেবেন্দ্রনাথ এই ডাকাত-সর্দারকে এই স্থানের রক্ষাকর্তা হিসাবে নিয়োগ করেন। ফলে ক্রমে ক্রমে এই স্থানে ডাকাতি কমে যায়। ১৮৮৮ সালের ৮ই মার্চ দেবেন্দ্রনাথ ট্রাস্টি চুক্তির মাধ্যমে শান্তিনিকেতনকে সবার জন্য উন্মুক্ত করেন।
ছাতিমতলা
শান্তিনিকেতন ভবন
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এখানে একটি দালান বাড়ি তৈরি করেন। প্রথমে এটি ছিল একতলা, পরে দোতলা করা হয়। বাড়ির উপরিভাগে খোদাই করা আছে – “সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং” মহর্ষির প্রিয়, উপনিষদের এই উক্তিটি। তিনি নিজে বাড়ির একতলায় ধ্যানে বসতেন। তাঁর অনুগামীরাও এখানে এসে থেকেছেন। কৈশোরে বাবার সঙ্গে হিমালয়ে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে কিছুদিন বাস করেন। ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের সময়ও রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল সপরিবারে এই বাড়িতে বাস করেন। পরে আর কখনও তিনি এটিকে বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন নি। এখন বাড়িটির সামনে রামকিঙ্কর বেইজ নির্মিত একটি বিমূর্ত ভাস্কর্য রয়েছে। শান্তিনিকেতন ভবনের অদূরে একটি টিলার আকারের মাটির ঢিবি আছে। মহর্ষি এখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতেন। একসময় এই টিলার নিচে একটি পুকুরও ছিল। ১৮৯২ বঙ্গাব্দে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মমন্দির।
১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ এখানে একটি বিদ্যালয় (ব্রহ্মাশ্রম) স্থাপন করেন। এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় আর ছাত্র ছিলেন গৌরগোবিন্দ গুপ্ত, প্রেমকুমার গুপ্ত, অশোককুমার গুপ্ত, সুধীরচন্দ্র, গিরিন ভট্টাচার্য, যোগানন্দ মিত্র, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীকালে এই বিদ্যালয়টি বিশ্বভারতী বিশ্বদ্যালয়ে পরিণত হয়।
শান্তিনিকেতনের উদাত্ত প্রকৃতি তাঁর মনের দুয়ার খুলে দিয়েছিল। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে কবি। তাই তাঁর মন কোনও দিনই গতানুগতিকতার নাগপাশে বন্দি হয় নি। কাব্যসৃষ্টির তাগিদে তিনি সদাই অনুসন্ধান করতেন নিত্য নতুনকে – যা তাঁকে দিত প্রেরণা, অনুপ্রাণিত করত নব নব কাব্যসৃষ্টিতে।
শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণ চত্বর রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য। কোনার্ক-শ্যামলী-পুনশ্চ-উদয়ন-উদিচী এই পাঁচটি বাড়ি মিলিয়েই উত্তরায়ণ। একঘেয়েমির থেকে মুক্তির আশায় কবিগুরুর ইচ্ছেয় একের পর এক নির্মিত হয়েছিল বাড়িগুলি। অবশ্যই এই নির্মাণের পশ্চাতে যে নিপুণ কিছু পরিকল্পনা ছিল তা নয়, – মনের দুয়ার খোলা রাখার তাগিদই এ ক্ষেত্রে অধিক হয়ে উঠেছিল। শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র শিল্পী-ভাস্কর-লেখক অলোকেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘শান্তিনিকেতন চেনা অচেনা’ বইটির থেকে এই সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
কোনার্ক
১৯২৯ সালে শিলং থেকে শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্রনাথ বাস করতে শুরু করেন উত্তরায়ণ চত্বরে এবং সেই হেতু মনে করা হয় উত্তরায়ণের প্রথম নির্মিত বাড়ি কোনার্কের ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯১৮ সালেই। প্রথম দিকে এটি কিন্তু সম্পূর্ণ বাড়ি বলতে যা বোঝায় তা ছিল না মোটে। গুরুদেব চেয়েছিলেন চার দিক খোলা একটি ঘর, যে ঘরে বসে তিনি শান্তিনিকেতনের খোলা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করবেন এবং প্রাকৃতিক দৈনন্দিন রহস্যকে উপলব্ধি করবেন নীল আকাশের অনন্তলোকে বা সুদূর দিকচক্রবালে। তাই কোনার্ক গড়তে গিয়ে প্রথমে তৈরি হল বেশ উঁচু প্লিন্থের ওপর চারটি থামের ওপর খড়ে ছাওয়া চার দিক খোলা একটি চৌতারা। এই চৌতারায় বসে লিখতে লিখতে তিনি প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন। চৌতারার পশ্চিমে বেশ কয়েকটি সিঁড়ি দিয়ে নীচে একটি ছোট্ট শোওয়ার ঘর ও তার পাশে একটি ছোট্ট খাওয়ার ঘর ছিল। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সাল থেকে কোনার্কে বসবাস করতে শুরু করলেও এর নানা পরিবর্তনের কাজ আরম্ভ হয় ১৯২২ সাল থেকে। এর পর ধীরে ধীরে খড়, মাটির দেওয়ালের বদলে উঠেছে ইঁটের মোটা গাঁথনি, সিমেন্টের ঢালাই ছাদ, লাল আট থামের বারান্দা এবং আরও কত কিছু। ১৯২৮ সালে শেষ হয় কোনার্কের সম্পূর্ণ কাজ।
শ্যামলী গৃহ
কবিগুরুর যখন ছেষট্টি বছর বয়স তখন তিনি ‘শ্যামলী’ গৃহনির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তাঁর চিন্তায় আসে এমন একটি বাড়ি যা হবে পুরোপুরি মাটির এমনকী তার ছাদও। এমন অভিনব পরিকল্পনাটি রূপায়ণের দায়িত্ব পড়ল শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ করের ওপর। মৃত্যুর পর মানুষ বিলীন হয়ে যায় এই ধরণীর ধূলিতে। তাই ধুলোমাটি দিয়েই তৈরি হোক একতলা বাড়ি যার নাম হবে ‘শ্যামলী’। চন্দননগরের মোরান সাহেবের বাড়িতে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ এক অদ্ভূত মাটির বাড়ি দেখেন। সেই বাড়িটির কথা মাথায় রেখে এবং তার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় আশ্রয় নিয়ে শ্যামলীর নির্মাণ শুরু হয়। শ্যামলী কোনার্ক-এর ডান দিকে। বাড়িটি তৈরি হয়েছিল মাটির কলসি এক একটা গায়ে গায়ে সাজিয়ে। শ্যামলীর দেওয়াল ছিল খুব মোটা এই কারণে যে কলসিগুলি ছিল গায়ে গায়ে শোওয়ানো এবং তাদের মুখগুলি ঘরের ভিতরের দিকে। সুমিতেন্দ্রনাথের বর্ণনায় আমরা পাই, ‘কলসির ওপর কলসি সাজিয়ে তার ওপর মোটা মাটি লেপে দেওয়ালের ওপর খাড়াখাড়ি কলসির মাথাগুলি নীচের দিক করে বসিয়ে সারগাছ ও কাশফুলের ডাঁটি গায়ে গায়ে বেঁধে ঘরগুলোর মাথার ফাঁকা অংশ ওপর ও ভিতর মাটির পলেস্তারায় বন্ধ করে ঘরের আকার দেওয়া হল’। গৃহনির্মাণের পর নন্দলাল বসু ও তাঁর কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বাড়ির বাইরে মাটির দেওয়ালে নানা মূর্তি ও শান্তিনিকেতনের জীবনযাত্রার নানা ছবি এঁকে তাকে অপরূপ করে তুললেন। এই বাড়িটির গায়ে শিল্পী রামকিঙ্কর ফুটিয়ে তোলেন কয়েক জন সাঁওতাল রমণীর চেহারা, এই শিল্পকর্মটিও অপূর্ব। ১৯৩৫ সালে কবি তাঁর পঁচাত্তরতম জন্মদিন পালনের পর এই ঘরে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। মাটির ঘরের জানলার পাশে লেখার টেবিলে বসে তাঁর মন উড়ে যেত সেই কোন সুদূরে আলপথের পাখির ডাকে সাড়া দিয়ে। ১৯৩৬-এ প্রবল বৃষ্টিতে ‘শ্যামলী’র ছাদ ধসে পড়ে এবং শ্যামলীর মাথায় ত্রিপল বিছিয়ে আলকাতরা লেপন করে তার সংস্কার করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ আপন মনে বসে শেষ সপ্তকের গদ্যছন্দের রচনা গুলো লিখছেন এবং তার ফাঁকে ফাঁকে রং তুলি নিয়ে বসছেন। এদিকে সুরেন্দ্রনাথ আর নন্দলালের মাথায় এসেছে নূতন ছন্দে বাড়ি করবার আইডিয়া! রবীন্দ্রনাথ নিজে থেকেই তাঁদের দুজনকে ডেকে একটা মাটির বাড়ি নির্মান করার ফরমাশ করে বললেন – “এবারের যে বাড়ি হবে তাতে মেঝে থাকবে সব সমান, ঘরে চৌকাঠ বলেও কিছু থাকবে না, সিঁড়িও নয়, পথ আর ঘরের তফাতই বোঝা যাবে না – পথ যেন আপনি এসে ঘরে ঢোকে! “মাটির বাড়ি নির্মানের যুক্তি হিসাবে বলছেন – “তোদের সকলেরই বাড়ি আছে, ঘর আছে, থাকবার একটা আলাদা স্থায়ী বাসস্থান আছে। আর আমার? নিজের বাড়ি বলে কিছুই নেই, আমি তো বেশি কিছু চাই নে; একখানা শুধু মাটির ঘর – এমন আর কি? তোমাদের মতো বড়লোকি চাল তো আমার নেই। দালানকোঠা তোমাদেরই মানায়। আমি গরিব মানুষ; মাটির কুড়েঘরই আমার ভালো। আর দুদিন পরে তো মাটিতেই মিশব । সম্বন্ধটা এখন থেকেই ঘনিষ্ঠ করে রাখি।”
এই সকল উক্তি পড়বার সাথে সাথে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথের কাছে কিন্তু সরল জীবনযাপন ও সৌন্দর্যহীনতা একার্থক নয়। তখন দেশের মধ্যে গান্ধীজির সরল জীবনাদর্শের অনুকরণে এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে কৃত্রিম গরিবানার ঢং দেখা দিয়েছিল; সৌন্দর্যকে অবজ্ঞা করা যেন তাদের আধ্যাত্মিকতার একটা অঙ্গ।
রবীন্দ্রনাথ বরাবরই ছোট ঘর ভালোবাসতেন – বেশ ছোট ছোট ঘর হবে, এক জায়গায় বসে হাত বাড়িয়ে এদিককার ওদিককার জিনিস নাগাল পাবে। তিনি বলছেন, “ঘরের জিনিসপত্র কাছে কাছে থাকলে মনে হয় যেন ঘরটি আমার আপন ঘর। নিচু ছাদ কাছে নেমে আসে, চারদিকের দেয়াল কাছে কাছে ঘিরে থাকে, বড়ো আরাম লাগে মনে। নয় তো কি সব বড় বড় ঘর, উঁচু উঁচু ছাদ, জিনিসপত্র ঐ কোণে সেই কোণে, একটি বই দরকার তো উঠে গিয়ে শেলফ থেকে পেড়ে আনো – সে যেন নিজেরঘরেই পর হয়ে থাকা।” এই জন্যেই মাটির ঘর – যার ছোট ছোট ঘর হবে সব!
এর পরে আর দেরি করা চলে না, আগের বছর নন্দলাল অনেক মাথা খাটিয়ে ভোজনশালার সম্মুখে রাস্তার মোড়ে একটি মঞ্চ তৈরি করেছিল – সুরেন্দ্রনাথের সেটি বিশেষ পছন্দ হয়। সুরেন্দ্রনাথ নন্দলালকে নিয়ে সেই মঞ্চ তৈরির অনুরূপ উপাদানে মাটির বাড়ি তৈরি করবে বলে বিস্তর ভাবনা চিন্তা শুরু করে দিল, অনেক পরামর্শ চলল রবীন্দ্রনাথের সাথে। ঠিক হল, পনেরো বছর আগে যে পর্ণকুটির মাঠের ভিতর নির্মত হয় তাকে কেন্দ্র করে উত্তরায়ণের প্রাসদোপম বাড়ির পাশেই নূতন বাড়ি তৈরি হবে। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা অনুসারে বাড়ির ছাদও হবে মাটির এবং তাকে আলকাতরা মিশিয়ে শক্ত করা হবে – ঘরের মেঝেও একই ভাবে তৈরি হবে। সেই মতো সাঁওতালী মাঝি – মেঝেন লেগে গেল একদল মাটি কাটতে, মাটি মাখতে।
রবীন্দ্রনাথ সকাল বিকেল শিমুলতলায় বসে বসে দেখেন, আর খুশিতে বলেন – “মাটির দেওয়াল কি কম শক্ত হয় ভেবেছিস? কত ঝড় – ঝাপটা বৃষ্টির ধারা এর উপর দিয়ে যায়, ভাঙে কি? তবে ছাদই বা মাটির হতে পারে না কেন? একটু ঢালু করলেই তো হল, জলটা গড়িয়ে যাবে, ভয়ের কিছু থাকবে না। সুরেন বলেছে সেই রকমটিই হবে। এ যদি সাকসেসফুল হয়, তবে কত লোকের উপকার হবে। গ্রামের লোকেরা কত সহজে বাড়ি তুলতে পারবে, বাঁশ খড়ের জন্য ভাবতে হবে না।”
মাটির বাড়ির কথা মুখে মুখে রটে যায়। হাটের পথে যেতে আসতে গাঁয়ের লোক এসে থামে সেখানে – দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটির বাড়ি তৈরি হওয়া দেখে – কত জিজ্ঞাসা তাদের, নন্দলাল সুরেন্দ্রনাথরা উত্তর দেন – সকালেরই কৌতূহল মাটির ছাদ কেমন হয় তা দেখার। আর ওরা যে এই আসা যাওয়ার পথে আগ্রহ ভরে ক্ষণিকের জন্য হলেও দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির সামনে, তা দেখে মনে মনে ভীষণ আনন্দ পান রবীন্দ্রনাথ – বলেন, “কত উৎসুক ওরা, বাড়িটা কতক্ষণে শেষ হবে – মাটির ছাদ উঠবে। একটা যেন কি আশা ওদের মনে।” তারপর নব নব উৎসাহে সুরেনকে ডেকে নির্দেশ দেন, “যেমন করে হোক মাটির ছাদ টেকসই করে তুলতেই হবে।” আবার কখনো বা পরামর্শও দেন, “মাটিতে গোবর মেশালে, কাঁকর মেশালে, তুষ মেশালে – চাই কি আলকাতরাও মেশালে চলে; উই ধরবে না তবে। এই সব মেশানো মাটিতে ছাদ মজবুত হবেই।” রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই বহুজনকে বহুবার বুঝিয়েছেন, “গ্রীষ্মকালে ঘর গরম হয়ে যায় বল তোমরা, একটা কাজ করলেই তো পারো; অতি সহজ উপায়। ঘরের চারদিকে মাটির হাঁড়ি সাজিয়ে তার উপরে চুনবালির পলস্তারা দিয়ে দাও। দেওয়ালের মাঝখানে হাওয়া থাকার দরুন ঘরের ভিতরটা আর গরম হতে পারবে না। তোমরা একজন কেউ প্রথমে করে দেখো, পরে অনেকেই করতে পারবে।” কিন্তু সেই প্রথম একজন আর কাউকেই পাওয়া যায় নি – অবশেষে রবীন্দ্রনাথই হলেন সেই প্রথম একজন।
সুরেন বাবু তো সে ইচ্ছের কথা শুনে প্রথমটায় বেশ আপত্তি করলেন! তারপর রবীন্দ্রনাথ যখন খুব করে ধরে বললেন, “বেশ তো সুরেন সাহেব, সব ঘর যদি না-ই করতে চাও তবে একটি ঘর অন্তত আমার মাটির হাঁড়ি সাজিয়ে করে দাও। আমি বলছি ভালো হবে।” তখন, মাটির বাড়ির উত্তর – পশ্চিম কোণের একটি ঘর হল মাটির হাঁড়ি দিয়ে। সারি সারি হাঁড়ির উপর হাঁড়ি সাজিয়ে দেয়াল উঠল। ছাদের উপরেও মাটির হাঁড়ি সারি সারি উপুড় করা হল। গাছতলায় বসে বসে নন্দলাল জাফরির নকশা কাটেন; কখনো বা কলাভবনের দল নিয়ে মাটির দেওয়ালে মূর্তি গড়েন। বাড়ির সামনে তৈরি হল দক্ষিণমুখী অর্ধচন্দ্রাকার খোলা আঙিনা। পথ হতে মাটি উঁচু হতে হতে উঠে এসেছে আঙিনায়, আঙিনা গেছে ঘরের ভিতরে ঢুকে – ঠিক যেমনটা রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, “পথ আর ঘরের তফাতই বোঝা যাবে না – পথ যেন আপনি এসে ঘরে ঢোকে”। বাড়িতে উঠতে সিঁড়ি ভাঙতে হয় না মোটে। ঘর হতে বেরিয়ে আঙিনা বেয়ে এসেই পথ, সেই পথই উত্তরায়ণের ফটক পেরিয়ে সোজা চলে গেছে আশ্রমে।
সময় গড়াতে থাকে, সুরেন্দ্রনাথ আর নন্দলালের কোন দিকে তাকানোর সময় নেই, দিন রাত এক করে মাটির বাড়ি নির্মানের কাজে নিজদের সঁপে দিয়েছে তারা।কবিরও ভারী উৎসাহ – মনে আনন্দ নিয়ে লিখে ফেললেন –
আমার শেষ বেলাকার ঘরখানি
বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে
তার নাম দেব শ্যামলী।
ও যখন পড়বে ভেঙে
সে হবে ঘুমিয়ে পড়ার মতো,
মাটির কোলে মিশবে মাটি;
ভাঙা থামে নালিশ উঁচু করে
বিরোধ করবে না ধরণীর সঙ্গে;
ফাটি দেয়ালের পাঁজর বের করে
তার মধ্যে বাঁধতে দেবে না
মৃত দিনের প্রেতের বাসা।
অবশেষে ২৫ – শে বৈশাখের তিন দিন আগে বাড়ির কাজ মোটামুটি ভাবে সম্পূর্ণ হয় – স্থির হয় কবির জন্মদিনেই গৃহপ্রবেশ হবে। কবির ৭৪ তম জন্মোৎসব যথারীতি পালন করা হল। এই দিন স্মরণে অমিয়চন্দ্রকে গদ্য কবিতায় একটি পত্র দেন – যেটা আমরা পাই শেষ সপ্তকের মধ্যে (৪৩ – সংখ্যক) – ” পঁচিশে বৈশাখ চলেছে / জন্মদিনের ধারাকে বহন করে / মৃত্যু দিনের দিকে।” এই দীর্ঘ কবিতায় জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা, বেদনা, ক্ষয়, আঘাত, আশা আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ পেয়েছে। উৎসবের শেষে গৃহ-প্রবেশ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল – কবি আনুষ্ঠানিক ভাবে নাম দিলেন শ্যামলী। প্রভাতকুমার যথার্থই বলেছেন, মাটির ঘর করার ফরমাশ কবির, স্থাপত্য – পরিকল্পনা সুরেন্দ্রনাথের, ভাস্কর্য নন্দলালের। কবি, স্থপতি ও ভাস্করের মিলিত প্রয়াস আছে এই গৃহ রচনায়। তবে আসলে এই কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করার কৃতিত্ব সুরেন্দ্রনাথ করের। এই গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানের মধ্যে কবি সে কথা স্বীকার করে সুরেন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে – ” ধরণী বিদায়বেলা আজ মোরে ডাক দিল পিছু- কহিল, / একটু থাম, ‘ তোরে আমি দিতে চাই কিছু’, ” কবিতাটি পাঠ করেন।
পরদিন ভোরেই কবি কলকাতার উদ্দেশ্য রওনা দিলেন। জোড়াসাঁকোতে বসে তিনি ইংল্যাণ্ডে প্রতিমা দেবী ও রথীন্দ্রনাথকে লিখলেন – মাটির বাড়িটা খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে। নন্দলালের দল দেয়ালে মূর্তি করবার জন্য কিছুকাল ধরে দিনরাত পরিশ্রম করেছে …। গ্রামের লোকদের ঔৎসুক্য সব চেয়ে বেশি। মাটির ছাদ হতে পারে এইটাতেই ওদের উৎসাহ। পাড়াগাঁড়ে খড়ের চাল উঠে গেলে সব দিক থেকেই ওদের সুবিধা।”
শ্যামলী গৃহ নির্মানে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু কখনই আর্টিস্টের বিলাসিতা আনতে দেননি, অনেক ক্ষেত্রে তিনি দুজনকে শাসনও করেছেন – তাঁর একমাত্র দৃষ্টি ছিল ব্যবহারিক সাফল্যের দিকে। প্রসঙ্গত আমারা যদি এই সময়টার রবীন্দ্র মনন বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাবো, তিনি শ্রেণীগত সাহিত্য, কলা, আনন্দ – সৃষ্টির বিরোধীতা করছেন ভীষণ ভাবে। গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান হয়ে গেলেও, শ্যামলীর টুকিটাকি কাজ আরও কিছু বাকি – সে গুলো সারা হলেই সম্পূর্ণরূপে বাসোপযোগী বাড়ি হয়, কিন্তু সে টুকিটাকি কাজ যেন আর ফুরাতেই চায় না। রবীন্দ্রনাথ অধৈর্য্য হয়ে বললেন, “এখানে থাকলে কেবলই মনে হতে থাকবে কাজ আর এগচ্ছে না। তার চেয়ে গরমের সময়, বোট আছে ঘাটে বাঁধা, দু মাস স্বচ্ছন্দে কাটানো যাবে। ফিরে এসে নিশ্চিন্তে শ্যামলীতে থাকতে পারবো!”
সেবার তিনি গিয়েছিলেন চন্দননগরে। গরমের শেষে যখন শান্তিনিকেতনে ফিরলেন, শ্যামলীর কাজ তখন শেষ হয়েছে। শ্যামলীকে দেখে তাঁর আনন্দ যেন আর ধরে না, অবিরাম খালি চেয়েই থাকে সে দিকে। বসবার ঘরে যে বেদী তৈরি হয়েছিল, তার উপর পাতা হল খেজুর পাতার তালাই। বাঁশের মোড়া, সরকাঠির চেয়ার দিয়ে হল গৃহসজ্জা। কোনার্কের বারান্দায় রাখা বেলফুল গাছ-সমেত মাটির কলসী গুলোকে আনা হল শ্যামলীর সামনে। রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ে গেল প্রিয় বাতাবিলেবু গাছটিকে – তৎক্ষণাৎ আদেশ, তাকেও আমার সঙ্গে চাই, আমার কাছাকাছি থাকবে সে। আদেশ মাত্রই আড়াই হাত মাটি খুঁড়ে অতি যত্নে কচি গাছটি তুলে এনে লাগানো হল শ্যামলীর পাশে। এই গাছ একদিন ঘন সবুজ মোটা পাতায় ভরা তার কয়েকটি ডালের ঝিরঝিরে ছায়া মাটিতে ফেলল। কত সকালে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির অমালিন উপহার তাঁর সেই বাতাবিলেবু গাছটার ঝিরঝিরে ছায়ায় চেয়ার টেবিল আনিয়ে খাতা খুলে খুশি মনে লিখতেন। একসময় ছোট্ট গাছটুকু ডিঙিয়ে নক্ষত্র-লোকের রবির আলো এসে পড়ত মাটির সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া রবির কপালে, তখন উনি গ্রাহ্যই করতেন না, বলতেন “সকালের এই রোদের তাপটুকু বরং ভালো শরীরের পক্ষে। বড়ো বড়ো গাছের নীচে বসলে এ সুবিধেটুকু পাই নে।” বাতাবিলেবু গাছটি রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল ছোট্ট একটি মেয়ে, উঠে চলে গেলে পাছে যদি সে মনে ব্যথা পায় – তাই কত সহজে রোদের তাপ মেনে নিতেন মনে।
বর্ষা এল, সাথে সাথে তরল সবুজ রঙের পতাকা উড়িয়ে মাথা উঁচু করে শ্যামলীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল কত কি গাছের চারা। মালী ত্রস্ত হাতে সে গুলো সরাতে যাবে, এমন সময় কবির ভিতর থেকে বলাই বলে উঠল – “ওরা ঠিক জায়গা বেছেই উঠেছে, ওদের কেউ নাড়াবে না।” এমন ছাড়াপত্রে মনের আনন্দে যে যার মতো উঠতে লাগল – একপাশে উঠল জাম, বেল, মাদার, কুরচি ;আর এক পাশে তেঁতুল, আতা, শিরিষ, ইউক্যালিপটাস। পিছনের আঙিনায় আম, কাঁঠাল, সামনের আঙিনায় রইল ফুলে ভরা গোলঞ্চের বাহার। আঙিনা গোবর মাটি দিয়ে নিকানো থাকে – রবীন্দ্রনাথ কখনো আমগাছের ছায়ায় বসে লেখেন, মাদার কুরচি-তলায় বসে চা খান, কখনো গোলঞ্চের তলায় ছড়িয়ে পড়া সাদা ফুলের মাঝে আসনখানি পেতে বই পড়েন। শ্যামলীর রবীন্দ্রনাথ সেই জোড়াসাঁকোর বালক রবীন্দ্রনাথ, মাঝের বয়সটুকু যেনে একেবারেই ভেসে গেছে খোয়াই-কোপাইতে। শ্যামলীকে ঘিরে ঘিরে জোড়াসাঁকোর ছোট ছেলেটার খেলা যেন আর ধরে না – আজ সকালে চনবনে রোদ মাথায় নিয়ে হয়ত এখানে বসে লিখেই চলেছেন, কাল হয়তো জামের ছায়ায় ছুট্টে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, জাম গাছটাও বুঝি খেলার একজন সাথী পেত তাই তো অমনি করে কচি পাতা গুলো দিয়ে তাঁর মুখে গালে হাত বুলিয়ে দিত – আবার কখনো বা দুষ্ট আমগাছটা ইচ্ছে করেই আমের বোল ঝুরঝুর করে ফেলতো ওঁর মাথার উপর, জোড়াসাঁকোর ছেলেটি কিন্তু এতটুকুও রাগ করতো না বরং দুষ্ট আম গাছটার সাথে বেশি বেশি করে ভাব দিত – এমন সময় সে তল্লাটে কোথা হতে এসে মেলা জমাতো হাজার মৌমাছি, ওদের সাথে গান জুড়তো আমাদের জোড়াসাঁকোর বালক।
খেলা কি শুধু বাইরে? ঘরের ভিতরেরও চলতো সমান তালে দুষ্ট ছেলের খেলা। দুপুরে এই কোণায় আছে তো বিকালে ঐ কোণে – ছবি আঁকতে ইচ্ছে করলে আরেক কোণে – দিন ভর এমনই চলে। একটা সময় মেঘের গায়ে রাঙা আলপনা সাজিয়ে সন্ধ্যা নামে, সারাদিনের কত খেলায় ক্লান্ত জোড়াসাঁকোর বালক এসে বসে শ্যামলীর সামনে খোলা অঙ্গনে – পথ যেথা আপনি এসে মেশে। কত রাত অবধি একাকী বসে থাকেন স্তব্ধ হয়ে দুচোখ বুজে। তখন সে আর বালক নয়, বৃদ্ধও নয় – সমস্ত পার্থিব বন্ধন মুক্ত অমৃতলোকের পুরুষ – নক্ষত্রবিথী তলে বসে থাকা, শত শত মানুষের নিভৃত লোকের দেবতা। গেয়ে ওঠেন-
“এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে।
তার হৃদয়বাঁশি আপনি কেড়ে বাজাও গভীরে।।
নিশীথরাতে নিবিড় সুরে বাঁশিতে তান দাও হে পুরে,
যে তান দিয়ে অবাক্ কর গ্রহশশীরে।।
যা-কিছু মোর ছড়িয়ে আছে জীবন-মরণে
গানের টানে মিলুক এসে তোমার চরণে।
বহুদিনের বাক্যরাশি এক নিমেষে যাবে ভাসি-
একলা বসে শুনব বাঁশি অকূল তিমিরে।। “
পুনশ্চ বাড়ি
শ্যামলীর পর ‘পুনশ্চ’। রবিঠাকুরের মন এক পরিবেশে, এক ঘরের দেওয়ালের মধ্যে বেশি দিন আবদ্ধ থাকতে পারত না। নতুন লেখার তাগিদে প্রয়োজন হল পরিবর্তন। তাই শ্যামলীর পূর্ব দিকে পুনশ্চর আবির্ভাব। ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে সুরেন করের তত্ত্বাবধানে চার দিকে চাতালবেষ্টিত একটি বেশ বড় ঘর তৈরি হল। পুনরায় গৃহনির্মাণ, তাই ঘরটির নাম হল বোধহয় ‘পুনশ্চ’। তাঁর জিনিসপত্র থাকত শ্যামলীতে। সকালবেলা লেখা ও ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে তিনি পুনশ্চর ঘরটিতে প্রবেশ করতেন। সারা দিন ধরে চলত তাঁর লেখা ও ছবি আঁকা। এখানে তিনি বেশির ভাগ সময় ছবি আঁকায় মগ্ন থাকতেন। আবার অনেক সময় কাঠের বাক্স জোড়া লাগিয়ে তার ওপর বিছানা করে রাতও কাটিয়েছেন তিনি এখানে। ‘পুনশ্চ’য় বসবাসকালে সুবিধা মতো ঘরটির রূপও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়।
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে শ্যামলী তৈরি হওয়ার পর, রবীন্দ্রনাথ একটি নতুন ধরনের ছোটো বাড়ি তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, এই বাড়িতে আসার জন্য কাউকে যেনো কোনো বাধার সম্মুখীন হতে না হয়। চারিদক থেকে এই বাড়িতে অবাধে প্রবেশ করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এই রকম বাড়িতে অবাধে মানুষ ছাড়াও কুকুর, ছাগল ইত্যাদি প্রবেশ করছে। ফলে তিনি একটি বড় ঘরবিশিষ্ট বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করেন। যে বাড়িতে আসবাব পত্র হিসাবে বাক্স ব্যবহার করবেন। যাতে রাতে ঘুমানো যায় এবং দিনে লেখালেখির কাজও করা যায়। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এইরকম একটি বাড়ি করালেন এবং এর নাম দিলেন পুনশ্চ। এই বৎসরেই তিনি এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল শ্যামলীর পুবদিকে।
কিছুদিন পর দেখা গেল, পূব দিকের বারান্দা দিয়ে বৃষ্টির জল ঘরে ঢুকে পড়ে। এই কারণে পূব দিকের বারান্দা কাঁচ দিয়ে ঘেরা হলো। শীতকালে উত্তরের ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকে, তাই সেদিকও ঘেরা হলো। অতিথিদের অপ্যায়নের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঘর তৈরি করা হলো। সামনের বারান্দায় বসে রবীন্দ্রনাথ লিখতেন। পূর্ব-দিক থেকে রৌদ্র এসে পড়তো। রৌদ্রে রবীন্দ্রনাথ কষ্ট পেতেন বলে সেদিকে একটি পাঁচিল তুলে দেওয়া হলো। একই কারণে পশ্চিম দিকেও পাঁচিল তোলা হয়েছিল। সব মিলিয়ে পুনশ্চ আর খোলামেলা বাড়ি রইলো না। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ নতুন বাড়ির কথা ভাবা শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িটি ত্যাগ করার পর, এখানে কিছুদিন অ্যান্ড্রুজ ছিলেন। পরে ইন্দিরা দেব চৌধুরানী ও তাঁর স্বামী প্রমথ চৌধুরী বেশ কিছুদিন এখানে ছিলেন।
উদয়ন
উত্তরায়ণের এই তিনটি বাড়ির পরিকল্পনা রূপ পরিগ্রহ করে সুরেন করের মাধ্যমে। কিন্তু ‘উদয়ন’ বাড়িটির স্থাপত্য পরিকল্পনা সম্পূর্ণ রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের। রথীন্দ্রনাথ তাঁর সৌন্দর্যচেতনা, শিল্পবোধ উজাড় করে দিয়েছিলেন এই গৃহের নির্মাণকাব্যে। ১৯২০ সালের পর থেকে রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী প্রতিমাদেবী শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। তখন থেকেই উয়দনের পরিকল্পনার সূত্রপাত। ১৯২১ সালে উদয়নের কাজ শুরু হয়। যখন যেমন অর্থ পাওয়া গেছে সে ভাবেই এগিয়েছে নির্মাণকাজ। তাই ঘর, ছাদ বা বারান্দায় সঙ্গতি এখানে পাওয়া দুষ্কর। এই অসঙ্গতিই যেন উদয়ন-এর সৌন্দর্য। রথীন্দ্রনাথ উদয়ন-এর একতলার বসবার ঘর সাজিয়েছিলেন জাপানি রীতিতে। উদয়ন-এর স্থাপত্যে চোখে পড়ে দেশি ও বিদেশি শিল্পশৈলির সংমিশ্রণ। বরবুদুর, বালিদ্বীপ, রাজস্থান ও গুজরাতের নানা স্থাপত্য শিল্প এই বাড়ির বারান্দা, অলিন্দ বা গবাক্ষে প্রতিফলিত। সতেরো বছর ধরে উদয়ন-এর কাজ চলে, শেষ হয় ১৯৩৮ সালে। উদয়ন-এ রাত কাটিয়েছেন মহাত্মা গাঁধী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন, জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গাঁধী, জাকির হোসেন প্রমুখ এবং অনেক বিখ্যাত বিদেশি ব্যক্তিত্ব।
উদিচী
এ বার উত্তরায়ণের শেষ নির্মাণ ‘উদিচী’। যথারীতি ‘পুনশ্চ’য় কয়েক মাস বাস করার পর আর সেখানে ভাল লাগল না কবির। প্রতিবারের মতো এ বারেও প্রয়োজন অনুভূত হল নতুন পরিবেশে চার দিক খোলা একখানি ঘরের যা তাঁর কাব্যশিল্পচর্চার অনুকূল হবে। এ বারে ডাক পড়ল রথীর। পুনশ্চ-র দক্ষিণ পূর্ব কোণে গোলাপ বাগানের গায়ে কয়েকটি ঢালাই করা থামের ওপর একটি চারদিক খোলা ঘর তৈরি হল। সেই ঘরটিতে কাঠ বা কাচের চিরাচরিত জানালা ছিল না ছিল রাজস্থানী স্থাপত্যের অনুকরণে অলংকৃত খোলা গবাক্ষ। সুমিতেন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘এই ঘরে ওঠার জন্যে বাগানের রাস্তার ধার থেকে একটা খোলা সিঁড়ি ঘরটির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই সিঁড়ির পাশে ছিল একটা পলাশ গাছ যা বসন্তের আগমনে উদিচী-র পরিবেশ লালে লাল করে এক রকম আগুন জ্বালিয়ে দিত।’ পরবর্তী কালে কবির মৃত্যুর পর এই বাড়িটির উপর নীচে কয়েকটি নতুন ঘর যোগ হয়। রাজস্থানী জানালাকেও ঘরের চেহারায় ফিরিয়ে আনা হয়। আটাত্তর বছর বয়সে অর্থাৎ চিরতরে চলে যাওয়ার কিছু সময় আগে থেকে কবি এই ঘরে বসবাস শুরু করেন। এই তাঁর শেষ গৃহবদল। কবিগুরুর শেষ জীবনের আঁকা বহু ছবি এবং কবিতার মধ্যে হৃদয়ের যে ব্যাকুলতা ও গভীর অনুভূতির প্রকাশ— তা এই উদিচী-র মুক্ত ঘরেই সৃষ্ট।
উদয়ন এলাকার পশ্চিমে একটি সরোবর ও উদ্যান আছে, নাম ‘পম্পা’। এই উদ্যানেই ছিল প্রতিমা দেবীর ছবি আঁকার চিত্রভানু নামক ‘স্টুডিও’। এর উপরের তলায় রয়েছে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুহাঘর’ নামক কারখানা। কোণার্কের পাশে ইংরেজি এল বর্ণের আকারে অনেকগুলো বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। এই বাড়িগুলো ‘রান্নাবাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপ থেকে ফিরে এই বাড়িগুলোর একটিতে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতিমা দেবী কিছুদিন বসবাস করেন। রবীন্দ্রনাথ-এর কন্যা মীরা দেবীও পুত্রকন্যা-সহ এই বাড়িতে কিছুদিন বসবাস করেছিলেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকীর সময় রবীন্দ্রচর্চার কেন্দ্র হিসেবে ‘বিচিত্রা’ নামে একটি বাড়ি তৈরি করা হয়। পরে এই বাড়িটির বিস্তার ঘটিয়ে ‘মাল্টিমিডিয়া’ নামক বৈদ্যুতিন কর্মশালা গড়ে তোলা হয়েছে।
শান্তিনিকেতনের আশ্রম চত্তরে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপনা রয়েছে যা এই সাংস্কৃতিক আশ্রয়স্থলের প্রতিষ্ঠার প্রমাণ বহন করে। আসুন আমরা এই স্থাপত্যের বিস্ময়গুলির মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করি:
শান্তিনিকেতন গৃহ ও মন্দির: আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের উপাখ্যান
উপাসনা গৃহ
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক নির্মিত শান্তিনিকেতন গৃহ (ঘর) এবং মন্দির (মন্দির) ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ। মন্দির, একটি জাঁকজমকপূর্ণ দাগযুক্ত কাঁচের মন্দির, একটি অ-সাম্প্রদায়িক উপাসনার স্থান হিসাবে কাজ করে, সর্বজনীন চেতনাকে মূর্ত করে যা শান্তিনিকেতনের পুনরুজ্জীবন এবং বাংলা ও ভারতে ধর্মীয় আদর্শের পুনর্ব্যাখ্যাকে ভিত্তি করে। মন্দিরের সংলগ্ন, শান্তিনিকেতন গৃহের চারপাশে একটি সূক্ষ্মভাবে নকশা করা বাগান রয়েছে, যা মাটির উপরের স্তরটি বাইরে থেকে সমৃদ্ধ মাটি দিয়ে প্রতিস্থাপন করে তৈরি করা হয়েছে। সারি সারি ফলের গাছ এবং লতাপাতা এই পবিত্র স্থানটির নির্মলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পথ, সাল গাছের পথ ধরে হাঁটলে চারপাশের শান্ত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া যায় না।
নতুন-বাড়ি: উদারতার জন্য একটি টেস্টামেন্ট
নতুন-বাড়ি, একটি সাধারণ খড়ের কুটির যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিবারের জন্য তৈরি করেছিলেন, শান্তিনিকেতনের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। ১৯১৫ সালে, রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধীর ফিনিক্স স্কুলের ছাত্রদের এই নম্র আবাসের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বাড়িটির নামকরণ করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের প্রয়াত স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সম্মানে, এবং আজ, এটি করুণা ও জ্ঞানের সাধনার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সংলগ্ন মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা, একটি নার্সারি স্কুল, তার নামকে আরও অমর করে রেখেছে।
দেহলি, সন্তোষলয় এবং সিংহ-সদন:
ইতিহাসের প্রশংসাপত্র
দেহলী, একদা রবীন্দ্রনাথের আবাসস্থল, এর দেয়ালে কবির উপস্থিতির প্রতিধ্বনি রয়েছে। এই ঐতিহাসিক ভবনটি রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের মধ্যে গভীর সংযোগের স্মারক হিসেবে কাজ করে।
সন্তোষলয়, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রদের একজন সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের নামে একটি টালিযুক্ত ছাদ সহ একটি একতলা বাড়ি, তরুণ ছাত্রদের জন্য হোস্টেল হিসাবে কাজ করে৷ এর দেয়াল, বিশের দশকের ফ্রেস্কো দিয়ে সজ্জিত, পরিবেশে একটি শৈল্পিক ফ্লেয়ার যোগ করে।
সিংহ-সদন, একটি ঘড়ির টাওয়ার এবং ঘণ্টার গর্ব করে যা আশ্রমের দৈনন্দিন রুটিনগুলি নিয়ন্ত্রণ করে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট সহ রবীন্দ্রনাথকে প্রদত্ত প্রশংসার প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়েছে। পূর্বতোরণ এবং পশ্চিমতোরণ, সিংহ-সদনের পাশের দুটি ভবন, শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের বৌদ্ধিক বৃদ্ধিকে লালন করে, ক্লাসের স্থান হিসেবে কাজ করে।
রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রাক্তন বাসভবন দ্বিজভিরাম, এর দেয়ালের মধ্যে বিশিষ্ট দর্শনার্থীদের প্রতিধ্বনি বহন করে যারা মহাত্মা গান্ধী নিজে সহ এই আবাসটি উপভোগ করেছিলেন।
দিনান্তিকা, চা চক্র, এবং ঘন্টতলা:
দিনান্তিকা, একটি অষ্টভুজাকার দ্বিতল কাঠামো, এর স্রষ্টা কমলাদেবীর শৈল্পিক দক্ষতার প্রমাণ হিসাবে কাজ করে। মূলত একটি চা-ঘরটি চক্র নামে পরিচিত, এটি কমলাদেবীর প্রয়াত স্বামী দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। নন্দলাল বোসের প্রাণবন্ত ফ্রেস্কো দিয়ে সজ্জিত, এই বাড়িটি শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক প্রাণবন্ততার একটি প্রাণবন্ত উপস্থাপনা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ঘন্টতালা, একটি বৌদ্ধ স্তূপের প্রবেশদ্বারের স্মরণ করিয়ে দেয়, সালভিথিকার চৌরাস্তায় এবং চেনা ভবনের দিকে যাওয়ার রাস্তাতে দর্শকদের স্বাগত জানায়। এর ব্রোঞ্জ ঘণ্টা একবার আশ্রমের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত করেছিল, শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি জাগিয়েছিল। গৌর-প্রাঙ্গন, স্কুল ভবনের সামনের খোলা মাঠ, স্বাধীনতা দিবস এবং প্রজাতন্ত্র দিবসে পতাকা উত্তোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে কাজ করে। 23শে জানুয়ারী, নেতাজির জন্মবার্ষিকীতে, সারি সারি আলোকিত প্রদীপগুলি মাটিকে আলোকিত করে, এই অনুষ্ঠানটিকে স্মরণ করে।
কালো বাড়ি এবং পান্থশালা: সৃজনশীলতা এবং সম্প্রদায়ের অভিপ্রায়
কালো বাড়ি, কাদা এবং কয়লা-আলকা থেকে তৈরি একটি অনন্য কাঠামো, শান্তিনিকেতনের মধ্যে সৃজনশীল চেতনার প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়েছে। ত্রাণ কাজের দ্বারা সজ্জিত, শিল্প ছাত্রদের দ্বারা বছরের পর বছর ধরে তৈরি করা, এটি শৈল্পিক প্রচেষ্টার প্রতিফলন করে যা শহরের পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। পান্থশালা, হীরাবাইয়ের উদার অনুদানের মাধ্যমে 1925 সালে নির্মিত, একটি বইয়ের দোকান এবং রেলওয়ে রিজার্ভেশন কাউন্টার সহ একাধিক উদ্দেশ্যে কাজ করে। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই ভবনটি ভ্রমণকারীদের জন্য একটি বিশ্রামের স্থান, একটি কূপ এবং একটি জলের ঘাট প্রদান করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা দিয়ে যাতায়াতকারীদের শান্তিনিকেতনের উষ্ণ আতিথেয়তা প্রসারিত করা হয়েছিল।
রতন কুঠি এবং মালঞ্চা: পণ্ডিতদের শ্রদ্ধা এবং সান্ত্বনা
রতন কুঠি, শান্তিনিকেতনে কর্মরত পণ্ডিতদের আবাস হিসাবে 1924 সালে নির্মিত, তাতারা রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার প্রতীক। এই ভবনটি সম্মানিত কবির প্রভাব এবং বিশ্বে তার প্রভাবের একটি প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। 1926 সালে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক নির্মিত মালঞ্চ, তার কনিষ্ঠ কন্যা মীরাকে তার ব্যর্থ বিবাহের পরে সান্ত্বনা প্রদানের উদ্দেশ্যে ছিল। বাবা এবং মেয়ে বাড়ির চারপাশে সুরম্য বাগানের পরিকল্পনা করতে সহযোগিতা করেছিলেন, এটিকে ভালবাসা এবং প্রশান্তি দিয়ে মিশ্রিত করেছিলেন।
শান্তিনিকেতন উপাসনাগৃহের পাশেই দেখা যায়, গোল একটা কুঁড়েঘরের খড়ের চাল চিরে সোজা উঠে গেছে একটা তালগাছ। এক সময় শান্তিনিকেতনের শিক্ষক তেজেশ্চন্দ্র সেনের বাড়ি। ‘তালধ্বজ’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট মেয়ে মীরার জন্য করে দিয়েছিলেন একটা বাড়ি। উত্তরায়ণের পাশেই। মীরা গাছপালা আর বাগান ভালবাসতেন। বাড়িটার নাম তাই ‘মালঞ্চ’। নাম লেখা ফলক এখন ঝাপসা। এক সময় বৈকালিক চা-চক্রের প্রয়োজনে একটা বাড়ি তৈরি হয়। আশ্রম মাঠের লাগোয়া সেই দ্বিতল চা-গৃহের নাম ‘দিনান্তিকা’। আশ্রমের পুরনো বাড়িগুলোর প্রায় কোথাও নাম-ফলক বসানো নেই। কেন নেই কে জানে! পুরনো শান্তিনিকেতনের বেশ কিছু বাড়ি অবলুপ্ত, শুধু তাদের নামগুলো জানা যায়। জাপানের দারুশিল্পী কিন্তারো কাসাহারা শ্রীনিকেতনে তিনটে গাছের উপর রবীন্দ্রনাথের জন্য বানিয়েছিলেন এক অভিনব বাড়ি। লম্বা সিঁড়ি বেয়ে রবীন্দ্রনাথ উঠতেন সেখানে। ওই কাঠের গাছ-বাড়ির নাম পাওয়া যায় না।
বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতে একবার শান্তিনিকেতনের তল্লাট ঘুরে আসি চলুন। মনে দাগ কাটার মতো কয়েকটা নাম। শ্রীপল্লীতে আশুতোষ আর অমিতা সেনের বাড়ি ‘প্রতীচী’। এখন চেনা অমর্ত্য সেনের বাড়ি হিসেবেই। ফলকের ‘টাইপোগ্রাফি’ চমৎকার। অবনীন্দ্রনাথের আঁকা এই বাড়ির একটা স্কেচ পাওয়া যায়। একটু এগিয়ে পিয়ারসন পল্লীতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ‘আনন্দধারা’। কাছেই চিদানন্দ দাশগুপ্তের বাসভবন। এখন কন্যা অপর্ণা সেন বাবার চলচ্চিত্রের স্মৃতিতে সেই বাড়ির নাম রেখেছেন ‘আমোদিনী’। শিল্প নির্দেশক হিসেবে তাঁর মা সুপ্রিয়াও কাজ করেছিলেন সেই ছবিতে। ফলকের ক্যালিগ্রাফি অপূর্ব। ঢেকে আছে আইভি লতায়।
শান্তিনিকেতনের উত্তরে, লালবাঁধের ধারে রবীন্দ্রনাথের সচিব অনিল চন্দ আর তাঁর স্ত্রী রানীর বাড়ি ‘জিৎভূম’। রবীন্দ্রনাথের ‘উদীচী’ বাড়ির পাশেই একটা পাকা রাস্তা। তার গা ঘেঁষে তাঁর একসময়ের সচিব, কবি অমিয় চক্রবর্তীর বাড়ি ‘রাস্কা’। সাঁওতালি ভাষায় কথাটার মানে ‘আনন্দ’। আমৃত্যু অমিয় এই বাড়িতেই ছিলেন ড্যানিশ স্ত্রী হৈমন্তীকে নিয়ে। রতনপল্লীতে রথীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা নন্দিনী আর জামাতা গিরিধারী লালার জন্য বানিয়ে দিয়েছিলেন ‘ছায়া নীড়’। এই নামের ভিতর কোথাও যেন একটা ব্রাহ্ম ছায়া। বহু অপমানের ভিতর, চোখের জল ফেলতে ফেলতে শেষবার তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে যান এই বাড়ি থেকেই। এই বাড়ির অদূরেই ক্ষিতীশ রায়ের মেয়েদের বাড়ি ‘ছায়া বীথি’।
আশ্রমের পূর্ব প্রান্তে বিশ্বভারতীর ধার দেওয়া জমিতে বহু বাড়ি রয়েছে। বেশির ভাগই দুই-বিঘা জমির উপর তৈরি। উপাচার্যের বাসভবন ‘পূর্বিতা’। তার পাশেই রেললাইন। ওই এলাকায় নজর-কাড়া নামের বাড়িগুলোর কয়েকটা— ‘ডেরা’, ‘ফেরা’, ‘আস্তানা’, ‘আকন্দ’, ‘লাবণ্য’, ‘পাখি’, ‘ঢাকা দক্ষিণ’, অথবা ‘কোরক’। বঙ্কিম বিশেষজ্ঞ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের বাসভবন ‘আনন্দমঠ’-এর পাশেই এক সময় ছিল পদার্থবিদ্যার এক অধ্যাপকের বাড়ি ‘পরমাণু’। খুঁজতে গিয়ে দেখলাম হাত-বদল হবার পর পুরনো সব কিছু ভেঙে সেখানে নতুন বাড়ি উঠছে। পূর্বপল্লীতে ‘রবি তীর্থ’ বলে একটা বাড়ির উল্টোদিকে শিল্পী কে জি সুব্রহ্মণ্যনের বাড়ি ‘কৈলাস’। ইংরেজিতে লেখা নাম, শিল্পীর প্রিয় এক রং, কালোর উপর সাদা হাতের লেখায়। এই ধাঁচেই কলাভবনে আস্ত একটা বাড়ি নিজের হাতে আঁকা ছবি দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। পূর্বপল্লীর দক্ষিণ প্রান্তে যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক শিবনারায়ণ রায়ের বাড়ি ‘রুদ্র পলাশ’। আর শিল্পী সুধীর খাস্তগীর এবং তাঁর কন্যা থাকতেন যে বাড়িটায়, তার নাম ‘পলাশ’। গায়িকা নীলিমা সেনের আবাস ‘সোনাঝুরি’। গায়েই বুদ্ধদেব বসুর বাড়ি। নাম তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামে। ‘স্বাগত বিদায়’। আসা আর যাওয়া। একেবারে জীবনের মতো। বাড়িটা মৃত্যুর পথে, হাত-বদল হয়ে হয়তো নতুন কোনও বাড়ির অপেক্ষায়। ফলকটা এখনও অক্ষত, ইতিহাসের পাহারাদারের মতো। ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন এক সংস্কৃত ছন্দের নামে তাঁর বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘রুচিরা’।
আশ্রম মাঠের গা ঘেঁষে স্থপতি সুরেন্দ্রনাথ করের বাড়ি ‘সুরমা’, তাঁর আর তাঁর স্ত্রী রমার নামের অক্ষর জুড়ে। শান্তিনিকেতনের বহু ঐতিহাসিক বাড়িতে রয়েছে সুরেন্দ্রনাথ করের ভাবনার পরশ। এই একই ভাবনা দেখা যায় শিল্পী সুশোভন অধিকারীর বাড়ির নামকরণে। স্ত্রী, পুত্র এবং নিজের নামের অক্ষর ব্যবহার করে বাড়ির নাম রেখেছেন শুধু ‘সু’। হাতিপুকুরের পাশেই শিল্পী-দম্পতি মিমি এবং কে এস রাধাকৃষ্ণণদের চমৎকার দুটো বাড়ি। একটা ‘মিমির বাড়ি’, পাশেই পরে কিনে মেরামত করে নেওয়া দ্বিতীয়টার নাম, ‘পাশের বাড়ি’। কী সহজ আর সাদামাটা! নন্দলাল বসু, রীতেন্দ্রনাথ মজুমদার, সনৎ কর, যোগেন চৌধুরী, দিনকর কৌশিক, সোমনাথ হোরের মতো শান্তিনিকেতনের শিল্পাচার্যদের বাড়িগুলো রহস্যময় ভাবে নামহীন! তবে অবনপল্লীতে অবনীন্দ্রনাথের নাতি অমিতেন্দ্রনাথের বাড়ি ‘আবাস’-এর নাম-ফলকে এক সময় দেখা যেত জাপানি কায়দায় অবন ঠাকুরের হাতের লেখায় বাড়িটার নাম। এখন সেটার আদলে একটা বেশ খারাপ, কালো গ্রানাইটের ফলক বসেছে বাড়িটায়। রতনপল্লীতে ভাস্কর কিরণ সিংহের বাড়ির নাম ছিল ‘বুলবুল বাড়ি’। তার অদূরেই কলকাতা থেকে এসে একটা পেল্লায় বাড়ি করেছিলেন শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য। মাঝেমধ্যে এসে থাকতেন। বাড়ির নাম রেখেছিলেন পুত্রকন্যার নামে। ‘বলাকা-বিভাস’। ওই চত্বরেই বাংলার অধ্যাপক ভবতোষ দত্তের বাড়ি ‘কুন্দকলি’। পাশেই বাবা-মায়ের স্মৃতিবিজড়িত ‘করতোয়া’য় থাকেন সঙ্গীতশিল্পী সাহানা বাজপেয়ী। ডিয়ারপার্ক এলাকায় শিল্পী মোহন সিংহ খাঙ্গুরার বাড়ি ‘শাহানা’। তার কাছেই ভাস্কর শর্বরী রায়ের বাড়ির নাম, তাঁর প্রয়াণের পর, ‘শর্বরী’। রতনপল্লীর পিছনে যে বাড়িটায় এক সময় শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ থাকতেন, সেটা ভেঙে নতুন বাড়ি হয়েছে। ইতিহাসের চিহ্ন মুছে ফেলে, সম্ভবত দয়া করে নতুন বাড়ির নাম রাখা হয়েছে ‘কিঙ্কর’। ওই বাড়ির কাছাকাছি একেবারে মুখোমুখি দুটো বাড়ির নামে চোখ আটকে যায়। ‘এলাপর্ণী’, আর রায়দের, সম্ভবত আবার একটা নতুন বাড়ি, ‘পুনরায়’। সুপ্রিয় আর শুভ্রা ঠাকুর হই-হুল্লোড়ে থাকতে না পেরে রতনপল্লীর বহুদিনের পুরনো আস্তানা ‘শোহিনী’ ছেড়ে অন্যত্র নতুন বাড়ি করে উঠে যান। বাড়ি বিক্রির শর্ত অনুযায়ী নিয়ে যান সেই নাম-ফলকও, নতুন বাড়ির জন্য।
রবীন্দ্রনাথের ছায়া শান্তিনিকেতনের অসংখ্য বাড়ির নামকরণে। রতনপল্লীতে অরূপ সরকারের বাড়ি ‘নৈবেদ্য’, পূর্বপল্লীতে জিৎ আর মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ‘খেয়া-তরী’, মৃদুচ্ছন্দা আর দেবব্রত পালিতের বাড়ি ‘ছুটি’র মতোই ‘শেষের কবিতা’, ‘তবু মনে রেখো’, ‘লিখন’, ‘লাবণ্য’ তারই কয়েকটা।
পূর্বপল্লীর একেবারে উত্তরে জাপানি স্থপতির নকশায় একটা ছোট্ট বাড়ি আছে। এলাকায় বাড়িটা পরিচিত ‘জাপানি বাড়ি’ বলেই। তার একটা পোশাকি নামও আছে, ‘কোকোরো’। বাংলায় যার মানে ‘হৃদয়’। বাড়িটা একবারে চিনে কেউ আসতে পারে না। বারবার বলে দিতে হয়। ‘জোড়া বাড়ির সামনে একটা ট্রান্সফর্মার। তার সামনে ভূগোল শিক্ষকের বাড়ি ‘সহ্যাদ্রি’।’ ডানদিকের পাঁচিল বরাবর রাস্তা ধরে সোজা এসে ধাক্কা খাবেন একটা বাড়িতে, যার নাম ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’। সেখান থেকে বাঁদিকের মাটির রাস্তায় নেমে এগোবেন। বাঁদিকে ‘ময়ূরাক্ষী’। সামনে কয়েকটা স্তম্ভ পোঁতা। উল্টোদিকের সরু গলিটার শেষ বাড়ি ‘পূর্বাহ্ণিক’। তার পাশ দিয়ে বেঁকে প্রথম ডানদিক। একসময় অর্থনীতিবিদ অশোক রুদ্রের বাড়ি ‘অশোক কানন’-এর একেবারে উল্টোদিকের কালো-বাঁশওয়ালা বাড়িটাই ‘কোকোরো’।
তথ্য ঋণ স্বীকার
১) বঙ্গ দর্শন
২) মুর্শেদ আলম তুহিন
৩) আনন্দবাজার পত্রিকা
৪) শান্তিনিকেতন ডায়েরী নীলাঞ্জন বন্দোপাধ্যায়
৫) পান্থশালা
৬) উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন ব্লগ
********
মনে হয় অনেক পড়াশোনা ও পরিশ্রম করে এই লেখা। শান্তিনিকেতন আশ্রমে রবিঠাকুরের বাড়ি সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ভাল লাগলো।
রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয় বিষয়।
সাহিত্যিকায় রবীন্দ্রনাথের উপর এই রচনাটি বেশ ভালো লাগলো
বিজিতের এই লেখাটা অনেক পরিশ্রমের ফসল। খুব ভালো লাগলো, অনেক কিছু অজানাকে জানতে পারলাম