অবস্থান, পরিস্থিতি ও পরিচিতি! (প্রথম পর্ব)
স্নেহাশীষ ঘোষ, ১৯৭৪ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
(সত্য ঘটনার স্মৃতিচারণে)
ভূমিকা।
বেশ মজার ব্যাপার, না? বাড়িতে থাকলে নিজেদের মধ্যে আমরা আমাদের নামেই পরিচিত, বড়জোর কোনও সম্বোধনে যেমন মা, বাবা, দাদা, দিদি, ইত্যাদি। কিন্তু বাড়ির বাইরে বেড়োলেই, সে কাজেই হোক বা বেড়াতে বেড়িয়ে, আমাদের অবস্থানের সাথে পরিস্থিতি আর আমাদের পরিচিতিও যায় বদলে। বাড়ির বাইরে, দেশে হোক বা বিদেশে, বেড়োলেই একটা পরিচিতি পর্ব্ব কোথাও না কোথাও এসেই যায়। কেউ জিজ্ঞেস করবে, “দাদা কোত্থেকে?”, নয়তো “আপলোগ কাঁহাসে আয়ে হো?” বা হয়তো “হোয়্যার ফ্রম আর ইউ কামিং, মাই ফ্রেন্ড?” উত্তর কিন্তু প্রতিবার আমাদের এক হয় না বরং আলাদাই হয়। আমাদের উত্তর নির্ভর করে সেই সময়ে আমাদের অবস্থান এবং পরিস্থিতির উপরে। তাই না?
যদি সিমলায় দেখা কোন বঙ্গ সন্তানের প্রশ্ন হয়, উত্তর এক রকম, যদি শ্রীনগরের কোনো স্থানীয় লোক জিজ্ঞেস করে, তা’হলে উত্তর অন্য রকম, আর বিদেশের কোনো শহরে কেউ জানতে চাইলে উত্তর হবে আর এক রকম। ব্যাপার’টা একটু আলোচনা করলে কেমন হয়?
“মা, আমি একটু স্বপন’দের বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি”।
“কোন্ স্বপন?” মা জিজ্ঞেস করলেন।
উত্তর দিলাম, “ভট্টাচার্য’দের বাড়ি”।
“ও আচ্ছা যাও।” মা বুঝে গেলেন।
একই পাড়া, দু’জন স্বপন, তাই ওনার বোঝার জন্যে পদবী’টার প্রয়োজন ছিল, আমি কোন্ বাড়িতে যাচ্ছি।
আবার যেমন, হয়তো পাড়ারই এক বন্ধুর বাড়ি গেছি, তাকে ডাকতে। বোধহয় তার ঠাকুমা বাইরে বেড়িয়ে এলেন। জানতে চাইলাম রবিন বাড়িতে আছে কিনা। উনি আমাকে আগে দেখেননি, চেনেন না আমাকে।
জিজ্ঞেস করলেন “কি নাম তোমার?”
বললাম নামটা।
“কোন্ বাড়ির?” আবার প্রশ্ন এলো।
“ঘোষেদের বাড়ি, বাবা অনাদি ঘোষ”। উত্তর দিলাম। উনি বুঝে গেলেন।
“আচ্ছা, দাঁড়াও। দেখছি রবিন কোথায় আছে, ডেকে দিচ্ছি”।
কথোপকথন কিছু’টা এরকমই হতো, যদি আমি আর আমার সেই বন্ধু একই পাড়ায় থাকতাম। পরিচয় শুধু নামে যখন বোঝা যায় না, তখন হয় পদবী, নয়তো বাবার নাম অথবা বাড়ির অবস্থান’টা বললেই যথেষ্ট হতো।
আবার যখন বাইরে থেকে বাড়ি ফিরছি, ছবি’টা অন্য রকম। বাসস্ট্যান্ডে বাস থেকে নেমে হয়তো একটা রিক্সার প্রয়োজন, বাড়ি যাবো।
চালক আমাকে চেনে না, জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাবেন”?
বললাম, “নতুন পাড়া, রেজিস্ট্রি অফিস”।
অর্থাৎ বাড়ির বাইরে থেকে এলে, আমাদের পরিচয় দিতে হয়, আমাদের পাড়ার নামে।
যেমন বাড়িতে কেউ হয়তো বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বাবাকে বললাম, “অমর কাকা এসেছেন”।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কে অমর”?
আমি বললাম, “দোহালিয়ার চাটুয্যে বাড়ির”। অর্থাৎ অন্য পাড়ার অচেনা কেউ এলে, তাদের পরিচয় হতো, কোন্ পাড়ার লোক হিসেবে।
একই পাড়ায় থাকলে, “কোন্ বাড়ির ছেলে”? আর অন্য পাড়ায় থাকলে, “কোন্ পাড়ার ছেলে”? তখন বাড়ির ছেলে নয়, পাড়ার ছেলে হয়ে গেলাম। পরিচয় গেলো পাল্টে।
এবার ধরা যাক্ আমাদের স্কুলের ফুটবল টীম একটা ম্যাচ খেলতে বহরমপুরে গেছে। হয়তো আমাদের কান্দী স্কুলের সাথে বহরমপুর স্কুলের খেলা হচ্ছে। বহরমপুরে তখন আমাদের পরিচিতি কান্দীর স্কুলের ছেলে বলে। একদিনের কথা মনে পড়ে গেল, ইন্দ্রজিৎ আর আমি জুনিয়র ডিস্ট্রিক্ট কম্পিটিশনে বহরমপুরে ব্যাডমিন্টন খেলতে গেছি। বহরমপুরেরই দুই ভাই এর সঙ্গে আমাদের খেলা ছিল। কানে আসছিল কোর্টের বাইরে দর্শকরা বলাবলি করছে “ছেলে দুটো কান্দী থেকে খেলতে এসেছে”। কান্দীর বাইরে বেড়িয়ে আমার সেদিন প্রথম অনুভূতি হলো, আমরা কান্দীর ছেলে। আগে কিন্তু এটা নিয়ে সে ভাবে কোনদিন মনে হয়নি। সত্যিই তো, যখন কান্দীর শীল্ডের ফুটবল ম্যাচ হতো, তখন মুর্শিদাবাদ জেলার নানান জায়গা থেকে ফুটবল ক্লাব কান্দীর মোহনবাগান মাঠে খেলতে আসতো। আমরা বলতাম জিয়াগঞ্জের ক্লাব, কয়তা’র টীম, বহরমপুরের কালেক্টারটের টীম বা জঙ্গিপুরের জয়হিন্দ ক্লাব। মহকুমা’র বা জায়গার নাম দিয়ে ক্লাবের পরিচয়। তাই তো?
সময়ের সাথে কান্দী স্কুলের পাট চুকলো। নিজের বাড়ি ছেড়ে, পাড়া ছেড়ে, মহকুমা ছেড়ে, জেলা ছেড়ে অন্য এক জেলায় অন্য এক শহরে গেলাম, আমাদের বি ই কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। আমার মতোই নানান জায়গা থেকে ছাত্ররা পড়তে এসেছে এই কলেজে। হোস্টেলে থাকতে আলাপ হলো, বন্ধুত্ব হলো অনেকের সাথে। কোলকাতা ও শহরতলীর ছাত্রই বেশি। তারই মধ্যে আমাদের মতো মফস্বলের ছাত্রও কিছু কম ছিল না। আমাদের তখন পরিচয় কি? বাবার নামে নয়, পদবী’তে নয়, পাড়ার নামে নয়, মহকুমার নামে নয়, আমাদের পরিচয় তখন জেলার নামে। যেমন আমি মুর্শিদাবাদের ছেলে, সুপ্রিয় হাওড়ার, শুভঙ্কর হুগলীর, তরুণ মেদিনীপুরের। এই রকম সব এক এক জেলার আমরা যেন এক এক জন প্রতিনিধি। আমাদের পরিচয় তখন জেলার নামের হিসেবে। যেমন যেমন আমাদের অবস্থানের পরিবর্তন হলো, তেমন তেমন আমাদের পরিস্থিতি এবং পরিচয়ও। তার সাথে পরিচয়ের পরিধিরও হলো বার-বাড়ন্ত।
একদিন কলেজের পড়াশোনাও শেষ হলো। চাকরি খোঁজার সময় এলো। চাকরিও হলো। কোলকাতায় কিছুদিন কাটিয়ে বদলি হলাম বাংলার বাইরে রাজধানী দিল্লীতে। রাতারাতি আমার পরিচয় গেল বদলে। আমার নাম’টা এমনিতেই একটু লম্বা, অবাঙ্গালী’দের কাছে সেটা উচ্চারণে একটু মুস্কিল তো আছেই। তারা ঘোষ বলেই ডাকতে শুরু করলো। তবুও বললাম না, রাতারাতি আমার পরিচয় সত্যি করে পাল্টে, নামের সাথে যোগ হলো ঘোষ “বাবু” নয়তো ঘোষ “দাদা”। বাঙ্গালীর পরিচিতি পেলাম বাঙলা ছাড়ার পর। কেউ সেভাবে কোনদিন অনুভব করেছেন কি? সত্যি করে বলুন তো। ঠিক যেমন মায়ের পেটে থাকতে আমাদের কোনো পরিচিতি ছিল না, জন্ম নিতেই পরিচয় হলো মায়ের নামে, “মিষ্টিদির ছেলে” বলে। নিজেদের নাম’টা এসেছিল তার বেশ ক’দিন পরে।
এখানেই শেষ নয়। অন্নের সন্ধানে দেশ ছেড়ে গেলাম বিদেশে। সেখানে পা রাখতেই, এক ঝটকায় হয়ে গেলাম ভারতীয়। ফর্মে লিখতে হলো আমি ‘ইন্ডিয়ান’। আরব দেশ ছিল বলে, ওদের কথায় আমাদের পরিচিতি হলো ‘হিন্দী’ নামে। হিন্দী মানে হিন্দুস্থানী মানে ইন্ডিয়ান। বিদেশে এসে নিজের ‘ইন্ডিয়ান’ পরিচয়ে একটা যেন দায়িত্ব এসে গেলো বলে মনে হলো। আমার জন্যে আমার দেশের যেন কোনো বদনাম না হয়, এই কথা’টা মনের মধ্যে গেঁথে গেলো। সেই একই কথা আবারও বলতে হচ্ছে, ইন্ডিয়া ছাড়ার পরই কিন্তু নিজেকে ইন্ডিয়ান বলে পরিচিতি পেলাম। সেই প্রথম অনুভব করলাম, আমি ভারতীয়। অবাক লাগছে, না?
বাংলা ছেড়ে বাঙ্গালী হওয়ার অনুভুতি আর ভারত ছেড়ে ভারতীয় হওয়ার অনুভুতি, ভাবলে যেন কেমন লাগে, কিন্তু এটাই সত্যি। সেই রকম বেড়াতে বেড়িয়ে হোক বা কাজের সূত্রে, দেশে হোক বা বিদেশে, খুব ছোট ছোট কিছু ঘটনা মনে পড়ছে, যার সাথে আমার তখনকার অবস্থান এবং পরিস্থিতি ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে থাকতো। শুধু আমি কেন, সবাই নিজেরা যদি একটু পিছন ফিরে দেখেন, আমি নিশ্চিত এরকম ঘটনা আরও অনেকের সাথেই ঘটেছে, এই যেমন আমার ঘটেছে। এখানে বিদেশের কিছু শহরে আমার অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু পরিস্থিতির সাথে আমার পরিচিতির যোগাযোগের কথা লেখার চেষ্টা করলাম। দৈর্ঘ্য’টা বেড়ে গেলো, তাই ধৈর্যৈর একটু প্রয়োজন পড়বে।
*****
পরিস্থিতি এক! অবস্থান সিডনি।
হাইপার মার্কেট, সিডনি
এই সাম্প্রতিক কালেরই একদিনের এক ছোট্ট একটা ঘটনা। সিডনিতে ছেলের কাছে বেড়াতে গেছিলাম। প্রতি উইক-এন্ডের মতো, এক শনিবারে সারাদিন ‘ডে-আউট’ করার পরে সন্ধ্যে নাগাদ আমরা ব্ল্যাকটাউন নামে এক একটা টাউনের শপিং মলে এসেছি কোলস নামের একটা হাইপার-মার্কেট থেকে সাপ্তাহিক বাজার করার উদ্দেশ্যে। বাজার শুরু করার আগে, ছেলে আর ছেলের মা ওয়াশরুমে গেছে একটু ফ্রেশ হতে। আমি কাছেই বেশ বড়সড় একটা বুচারীর সামনে দাঁড়িয়ে ওদের কর্মকাণ্ড দেখছি। এর সামনে দুটো ইনডোর প্ল্যান্ট ঘিরে বানানো বসার বেঞ্চিতে জনা’কয়েক লোকজন বসে আছে। তার মধ্যে বেশ বয়স্ক এক ব্যক্তি হঠাৎই আমাকে সোজা জিজ্ঞেস করে বসলেন, “আপ পাকিস্তানী হ্যায়”? এই ধরণের প্রশ্নে আমি অভ্যস্থ, আমার কাছে নতুন নয়। আমার কর্মজীবনে আবুধাবিতে, কোয়েতে, কাতারে বেশ কয়েকবার আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে, তাই বলে এই সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়, যেখানে কাউকে অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে বিশেষ নাক গলাতে দেখিনি? একটু অবাক হয়েই তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, “নেহি, ম্যায় ইন্ডিয়াসে হুঁ”। ভদ্রলোক একটু নিরাশ তো হলেন বোঝা গেল। বললেন, “আপকো দেখকে লাগা কি আপ পাকিস্তান সে হো। ইন্ডিয়া’কা কৌনসি জাগা, পাঞ্জাব”? এ তো মহা মুস্কিল। কিন্তু ওঁকে দেখে একজন সাধাসিধে লোক বলেই মনে হলো। মাথায় পাগড়ি ছাড়া অনেক’টা কাবুলিওয়ালা মার্কা চেহারা ও পোশাক। ছোট করে উত্তর দিলাম, “নেহি, বঙ্গাল সে”। উনি বলে চললেন, “ম্যায় বালোচিস্তান সে হুঁ। বাহারই মেরা কার্পেট’কা দুকান হ্যায়। আব্ মেরা বেটা উয়ো বিজনেস সামহালতা হ্যায়। ম্যায় পিছলা চালিশ সালও’সে অস্ট্রেলিয়ামে রহতা হুঁ, লেকিন আবতক্ অংরেজী নেহি শিখা, নেহি বোল সকতা”। কি অকপট স্বীকারোক্তি!! ওনার কথা শুনে কয়েক সেকেন্ডে বুঝে গেলাম, উনি তাঁর নিজের ভাষায় কথা বলার জন্যে একজন সঙ্গী খুঁজছেন। তখনই কোলকাতায় পাড়ার ক্লাবের বা মাঠের কোনও বেঞ্চিতে বসে থাকা সেই বৃদ্ধদের চেহারা মনে পড়ে গেলো। মনে হলো ইনিও ঠিক যেন দলছুট হয়ে যাওয়া তাঁদেরই একজন। আমি একটু দুঃখিত হলাম। ওঁকে সজীব করতে বললাম, “কোই বাত নেহি, আপকা জিন্দেগি তো আরামসে চলতা হ্যায় না”? আমার কথায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপ ইধার কাম করতে হ্যায়”? আমাকে বলতেই হলো, “নেহি, হামারা কাম করনেকা উমর অভি নিকাল চুকি হ্যায়। মেরা বেটা ইধার কাম করতা হ্যায়। হামলোগ উসকে পাস ঘুমনে আয়ে হ্যায়”। ততক্ষণে দেখলাম আমাদের ছেলে ও তার মা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভদ্রতার খাতিরে আলাপ করিয়ে দিলাম, “মেরা বিবি অঔর হামারা বেটা। আভি জারা শপিং কে লিয়ে জানা হ্যায়”। এই বলে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলাম। উনিও বিদায় জানাতে হাত’টা একটু উপড়ে ওঠালেন ঠিকই, কিন্তু ওঁকে দেখে বেশ ম্রিয়মান মনে হলো।
আমাদের অবস্থান, পরিস্থিতি আর পরিচিতির সমন্বয়ের এটা আমার কাছে একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
******
পরিস্থিতি দুই! অবস্থান এথেন্স।
কর্মসূত্রে সেবার কোয়েত থেকে এথেন্সে এসেছি দিন তিনেকের জন্যে। কিন্তু কর্ম-বহির্ভূত সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো সেবার, বলা যায় এক সম্ভাব্য অবাঞ্ছিত বিপত্তি থেকে কোনক্রমে অব্যাহতি পেয়েছিলাম।
আমি সেদিন দুপুর নাগাদ হোটেলে পৌঁছে গেছি। সেই রাত্রের ফ্লাইটে আমার বসেরও আসার কথা। পরের দু’দিন আমাদের মিটিং। তাই সেদিনের বিকেলটায় আমি ফ্রী। কাজের জন্যে প্রাইভেট কোম্পানী যত্ন করে তাদের কর্মচারীদের বাইরে পাঠায় ঠিকই, তবে একটু যে আমরা ঘুরে ফিরে জায়গাটা দেখে নেবো, সেইটুকু সময়ও দেয় না। কাজ শেষ তো নেক্সট্ আ্যভেলেবেল ফ্লাইটেই ফেরৎ। কথায় বলে না, “কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরালে পাঁজী”।
যাই হোক্, বঙ্গ সন্তান বলে কথা। পায়ের তলায় সর্ষে। চেক্ ইন্ করে, ফ্রেশ হয়ে, লাইট লাঞ্চ সেরে, কাজের ফাইলপত্র গুছিয়ে রেখে, একটু জিড়িয়ে নিয়ে হোটেলের লবিতে নামলাম। ওখানেই সুভেনীর শপ্ থেকে শহরের একটা ম্যাপ কিনলাম। টার্গেট দু’টো দেখার জায়গা। প্রথমটা ঐতিহাসিক অলিম্পিয়ান জিউস এর মন্দির আর দ্বিতীয়’টা এ্যাক্রোপলি ও পার্থেননের ধ্বংসাবশেষ। অত সময় হবে কি? রিসেপশন ডেস্কে একজনের সাহায্য চাইলাম। বললাম আমার ইচ্ছার কথা। ভদ্রলোক ম্যাপে জায়গা দু’টো মার্ক করে কি ভাবে যাবো লাল কালি দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। মন্দির’টা বেশ কাছেই, তবে এ্যাক্রোপলি যেতে একটু হাঁটতে হবে আর একটু পাহাড়ী রাস্তায় উঠতেও হবে। আর বললেন মন্দির যাওয়ার পথে পার্লামেন্ট বা সেন্ট্রাল স্কোয়্যার’টাও ঘুরে নিতে। প্রতি ঘন্টায় গার্ড চেঞ্জ হয়, ভালো লাগবে।
ব্যাপার’টা বুঝে নিয়ে, নিজের মতো করে প্ল্যান করে নিলাম। ঠিক করলাম দু’দিন তো আছি, এ্যাক্রোপলি’টা পরের বিকেলের জন্যে তুলে রেখে বাকি দুটো দ্রষ্টব্য সেদিন সেরে নেব। গুগুল ম্যাপ তখনও আমাদের মোবাইলে আসেনি। বেড়িয়ে পড়লাম এথেন্সের ম্যাপ হাতে। সন্ধ্যে পর্য্যন্ত সময় কম। সেন্ট্রাল স্কোয়্যার’টা বেশ সড়সড় একটা চত্তর। একদিকে বেশ কয়েকটা সিঁড়ির উপরে বিশাল পুরোনো রাজপ্রাসাদ। খুব পুরোনো অবশ্য নয়, জানলাম উনিশ শতাব্দীরই (১৮৭৩) তৈরি। তার সামনে পাথরে বাঁধানো লম্বা-চওড়া উঠোনই বলা যাক্। ওই চত্তরে দর্শনার্থীদের বেশ আনাগোনা। অনেক’টা লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়্যারের মতো। ইউরোপে এরকম স্কোয়্যার অনেক জায়গায় দেখা যায়। ভালোই লাগলো।
প্রাসাদের সামনে চেঞ্জ অফ গার্ড ও দেখা হয়ে গেল। দেরী না করে ম্যাপ দেখে এগোলাম। গন্তব্য অলিম্পিয়ান জিউসের মন্দির। ডাউন-টাউন বলতে যা বোঝায়, সবটাই কমার্শিয়াল এলাকা। চারিদিকে দোকান পাট, বিশেষ করে খোলামেলা রেষ্টুরেন্টে ভরা। একটা জায়গায় এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে হলো জানার আগ্রহের তাগিদে। নজরে পড়লো, একটা ছোট চাতালের মতো জায়গায় বসে বেশ কয়েকজন লোক ভারতীয় জিনিষপত্র বিক্রী করছে। প্রদীপ, তেল, ধূপ, ধূপকাঠি, মোমবাতি, সলতে এইসব পুজার সামগ্রী, হাতের কাজ করা ছোট ছোট মাটির পুতুল, চটের ব্যাগ, চামড়ার ব্যাগ, বেতের ডেকরেশন পিস্ আরও এই ধরণের চলতি বা সস্তা জিনিস। কোলকাতায় সেই মেট্রো বা গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে যেমন সব চাইনিজ মালপত্র নিয়ে বসতো, অনেক’টা সেই রকম, তবে খোলা আকাশের নীচে। বোঝার চেষ্টা করছি, এই এতো দূরে এতো সস্তার ভারতীয় জিনিস নিয়ে এসে কারা আর কেনই’বা এসব বিক্রী করছে। স্থানীয় কিছু খদ্দের দেখতে পেলাম, টুরিস্ট ও হতে পারে।
কাউকে একটু জিজ্ঞেস করবো ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ পাশেই বেশ দরাজ গলায় একজন যেচে এসে বলে উঠলো, “হ্যালো ব্রাদার। গুড আফটারনুন। ফ্রম ইন্ডিয়া? টুরিস্ট অর কাম ফর ওয়ার্ক?” একটু অবাকই হলাম, কিন্তু বেশি কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না। একটু হাসিমুখে হ্যাঁ বলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই, আরও কাছে এসে বললো, “আই অ্যাম জ্যাকি, আই অ্যাম এ টুরিস্ট গাইড। জাস্ট ফিনিসড মাই ডিউটি। আই হ্যাভ এ ক্লোজ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। টু’ডে দেয়ার ইজ এ স্মল পার্টি অ্যাট দেয়ার প্লেস ফর দেয়ার ডটার’স এনগেজমেন্ট। আই আ্যম গোয়িং দেয়ার। প্লীজ কাম উইথ মি এন্ড জয়েন দ্য পার্টি। দে উইল বি ভেরি হ্যাপী টু গেট আ্যন ইন্ডিয়ান ফ্রেন্ড।” এটা আবার কি ধরণের আমন্ত্রণ? এবার আমি ঘুরে ওকে আপাদ মস্তক দেখে একটু বোঝার চেষ্টা করতে চাইলাম, এ কি ধরনের লোক, ভালো, মন্দ না কি পাগল? তখন আমি পঞ্চাশ হলে সেও কিছু কম হবে না। ছবিতে দেখা গ্রীক’দের মতো লম্বা-চওড়া চেহারা নয়। আমাদেরই মতো, কিন্তু বেশ হাট্টা-গাট্টা। আমি বললাম, “থ্যাংক ইউ ভেরী মাচ্, বাট্ আই অ্যাম সরি, আই ক্যান নট্ জয়েন ইউ। আই অ্যাম বিট বিজি, গোয়িং টু অলিম্পিয়ান জিউস টেম্পল।” তবুও পিছন ছাড়ার নাম নেই। বলে কিনা, ”দ্য পার্টি হল ইজ ক্লোজ বাই। জাস্ট কাম ফর ফিউ মিনিটস, মাই ফ্রেন্ড উইল বি হ্যাপী। ইউ আর ফ্রম দেয়ার প্লেস। দ্য টেম্পল ইজ অলসো নট ফার আ্যন্ড শ্যাল রিমেইন ওপেন টিল এইট। প্লিজ কাম”। এ’তো মহা বিপদ। আমি চট্ করে কাউকে ‘না’ বলতে পারি না। তবুও মনে জোর এনে, “প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড, এক্সকিউজ মি” বলে, ওর কথার অপেক্ষা না করে হন্ হন্ করে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলাম। গ্রীসে এটা আবার কি ধরনের আতিথেয়তা? বুঝতে সময় লাগলো একটু। ভালো কি মন্দ বুঝতে পারলাম না। ওর কথা ভেবে মন’টা একটু খারাপও লাগলো। লোকটা কি ভাবলো কে জানে। যাইহোক্ অলিম্পিয়ান জিউস মন্দির’টা দেখলাম। কয়েক’টা ছবি তুললাম। ততক্ষণে সূর্য্যদেব সেদিনের মতো বিদায় নিতে চলেছেন।
আবার সেই অবস্থান, পরিস্থিতি আর আমার পরিচিতি, বিদেশে এক ভারতীয় হিসাবে। কোথায় কুয়েত, কোথায় গ্রীস আর কোথায় আমার ভারতবর্ষ। তবে ব্যাপার’টা ভাবলে কেমন অবাক লাগে না? পরের দিন সুযোগ মতো ঘটনা’টা আমার বস্’কে বললাম। বেশ সিনিয়র লোক। জাতি হিসেবে ব্রিটিশ, কিন্তু পাশেরই সাইপ্রাসে বাস। মনে আছে, উনি ফেরার সময় তাঁর বাড়ি হয়ে কুয়েতে ফিরেছিলেন। শুনে হেসে বললেন, “ভালোই করেছো যাওনি। কে জানে কোথায় নিয়ে যেত। জনপ্রিয় সব টুরিস্ট-স্পটে এই ধরণের অনেক লোক থাকে, কে কেমন চেনা যায় না। ওদের এড়িয়ে চলাই ভালো”।
পরের দিন কাজের শেষে বিকেলে আমরা দু’জনে অ্যাক্রোপলি দেখে এলাম। প্রায় সবই ভেঙ্গে পরেছে। রিনোভেশন চলছিল। কিছু সুভেনীর কিনলাম, স্বেতপাথরের একটা ছোট্ট আ্যক্রোপলিও নিলাম আমার বস্ এর পরামর্শে। বেশ ভালো করে একটা কাঠের বাক্সে ওরা প্যাক করে দিল। গ্রীসের ইতিহাস ও বেশ আকর্ষনীয়। তবে সে সব আমার আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। ফেরার পথে সাহেব-সঙ্গ-দোষ’এ সেই ভর-সন্ধ্যেয় বস্ এর সঙ্গে একসাথে ডিনার সারতে হলো। অবশ্য তার জন্যে অনুতপ্ত হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। উন্মুক্ত আকাশের নিচে, স্ব-পাণীয় বেশ সুস্বাদু কাবাব ও টিক্কা সহযোগে আরলি-ডিনার বেশ উপভোগ করেছিলাম।
********
পরিস্থিতি তিন! অবস্থান ফ্র্যাঙ্কফুর্ট।
আর একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল, আমাদের এই পরিস্থিতি, অবস্থান আর পরিচিতি নিয়ে। সেই কুয়েতের কোম্পানীর কাজেই বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়া এয়ারপোর্টের নতুন রানওয়ের সিগন্যালিং সিস্টেমের ব্যাপারে মিটিং ছিল সিমেন্স কোম্পানীর সাথে ফ্র্যাঙ্কফুর্টে। এখানে পরিস্থিতির কারণে “আইডেনটিটি ক্রাইসিস” এর ছোট্ট একটা ঘটনার কথা লিখবো। তার আগে সেদিনের একটা মজার কথা এখানে লিখতে ইচ্ছা করছে।
জার্মানীতে সেই প্রথম আসা। ইউরোপের কিছু দেশে ভাষা’টা কখনও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, এটা তার একটা উদাহরণ। ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টের বাইরে বেড়িয়ে আমারও তাই হলো। ট্যাক্সির লাইনে দাঁড়িয়ে একটা ট্যাক্সিতে লাগেজ রেখে উঠে বসলাম। বললাম, “শেরাটন হোটেল”। ড্রাইভার শুনে কিছুটা নিজের ভাষায় আর বাকিটা ট্যাক্সির বাইরে বেড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করে ঠিক পিছনের একটা ফুটব্রীজ দেখিয়ে আমাকে কিছু বোঝাতে চাইলো আর আমার স্যুটকেস’টা ডিকি থেকে নামিয়ে দিলো। আমার মাথায় হাত। ড্রাইভার দেখলাম এয়ারপোর্টের এক কর্মচারীকে ডেকে কিছু বললো আর আমাকে ইশারায় তার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে সামনে তার ট্যাক্সিটাকে আবার লাইনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো। এয়ারপোর্টের ওই স্টাফ ভাঙ্গা ইংরাজীতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যেতে চাই, শেরাটন হোটেল? আমি বললাম “ইয়েস”। ও আমাকে বুঝিয়ে দিলো, হোটেল’টা ঠিক রাস্তার ওপারে টার্মিনালের ঠিক উল্টো দিকে। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখলাম রাস্তা’টার ওপারে বড় সাইনবোর্ডে লেখা শেরাটন। এক নিমেষে পরিমাপ করে নিলাম সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারের সততা’টা। তাঁকে প্রণাম। যাইহোক্, ওই ভদ্রলোক একটা লিফট দেখিয়ে বললেন, “উপরে উঠে ফুটব্রীজ দিয়ে রাস্তা ক্রশ করলেই একদম শেরাটনের লবিতে পৌঁছে যাবেন”। সত্যিই পৌঁছে গেলাম তিন মিনিটে। ভাবলাম যদি এই ঘটনা আমাদের নিজের দেশে ঘটতো, ট্যক্সিওয়ালা আমাকে এয়ারপোর্টের পুরো একটা চক্কর দিয়ে আমার কাছ থেকে শ’দুয়েক টাকা আদায় করে নিতো। মাফ করবেন।
যাইহোক্ আজকের বিষয়ে আসা যাক্। খুবই ছোট্ট ঘটনা, কিন্তু পারিপার্শিক অবস্থাগুলো বোঝাতে অনেক কিছু এসে যায়। সেই অবস্থান আর পরিস্থিতির পরিপ্রক্ষিতে একজনের পরিচিতির ‘আইডেনটিটি ক্রাইসিস’ সম্বন্ধীয় ঘটনা’টা লিখছি। স্থানীয় সময়’টা তখন সন্ধ্যার দেখালেও, আমার কাছে সেটা কার্য্যত অপরাহ্ন। হোটেল’টা বেশ বড়সড়। এয়ারপোর্ট সংলগ্ন বলে মনে হলো ট্রানসিট প্যাসেঞ্জারই বেশি। চেক-ইন ও চেক-আউটের চক্করে রিসেপশন ডেস্কে বেশ ভীড়। একটু বেশি সময় লাগলো হোটেলের ঘরে পৌঁছাতে। ঘরও তেমন পছন্দসই মনে হলো না। ট্র্যানজিট নেচারের হোটেলের এটাই সমস্যা, সে যত বড়ই হোটেল হোক। যাই হোক্ শুধু দু’রাত্রির ব্যাপার। সেই গত মধ্যরাতে কুয়েত থেকে বেড়িয়ে অ্যামস্টার্ডাম হয়ে এখানে পৌঁছাতে বেশ সময় লেগেছিল। স্থানীয় সময়ে দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। স্নান করে, ঘরেই এক কাপ চা বানিয়ে কুকিজ সহকারে খেলাম। এবার আমার সাথে ছিল কোম্পানির বিজনেস ডেভলপমেন্ট কলিগ ব্রজিলের রিচার্ড। দু’দিন আগেই সে এসে গেছে সেখানে। তার স্ত্রী এই জার্মানিরই মহিলা। বেশ মজাদার চরিত্র এই রিচার্ড। কয়েক বছর আগে ওর সঙ্গে প্রথম আলাপ’টা মনে পড়ে গেল। ব্রাজিলের লোক শুনে সেদিন খুব উৎসাহ দেখিয়েছিলাম। মনে আছে বলেছিল, “ইয়েস আই অ্যাম ফ্রম ব্রাজিল, বাট্ প্লিজ ডোন্ট আস্ক মি অ্যাবাউট পেলে। আই নেভার প্লেইড ফুটবল।” তাকে একটা ফোন করলাম। মজা করে বললো, “তোমার হোটেলের ব্রেকফাস্ট শুনেছি খুব লোভনীয়। কাল সকালে আমরা দু’জনে তোমার গেস্ট হয়ে তোমার হোটেলে একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো। তারপরে মিটিং এর জন্যে তোমাকে নিয়ে বেড়িয়ে যাবো”। কোম্পানীর কাজে এসে, এরা জানে কি ভাবে সেই সুযোগ নিজেদের কল্যাণের জন্য লাগানো যায়। সে আমাকে একটা উপদেশও দিল, “রাত্রের ডিনার’টা হোটেলে না করে রাস্তার উল্টো দিকে এয়ারপোর্টের টার্মিন্যাল বিল্ডিংয়ে চলে যেও। সেখানে পছন্দের খাবারের অনেক বিকল্প পাবে”। তাই করেছিলাম, সত্যিই তাই, ও একদম সঠিক উপদেশই দিয়েছিল।
আসল কথা থেকেই পিছলে পিছলে যাচ্ছি। রিচার্ডের সঙ্গে কথা বলে বেড়িয়ে পড়লাম হোটেল থেকে। বঙ্গ সন্তান বিদেশে গিয়ে খামোকা হোটেলে বসে থাকবে? অসম্ভব। পশ্চিমের সাহেব’রা অফিস ছুটির পরই বলে, “লেটস গো ফর ডিনার”। অথচ সূর্য্য তখনও আকাশে সমহিমায় বিদ্যমান। তাই ডিনারে যাওয়ার আগে একটু উইন্ডো-শপিং করে নিলাম। এয়ারপোর্ট সংলগ্ন কমার্সিয়াল এলাকা। ঝাঁ চকচকে সব দোকান-পাট। তবে দুবাইয়ে থাকার সুবাদে এসব আর আমাকে খুব একটা আকর্ষণ করে না। চলে গেলাম এয়ারপোর্টের টার্মিন্যাল বিল্ডিংএ। সেখানে পৌঁছেই খেয়াল করলাম, চারিদিকে টিভি লাগানো, ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের প্রথম রাউন্ডের খেলা চলছে। ২০০২ সালের কথা। কপাল ভালো ব্রাজিল আর কোস্টারিকা’র খেলা চলছিলো। হয়তো লাইভ ছিলো না, তবে আমার না দেখা খেলা। চারিদিকেই সব রেস্টুরেন্ট আর বড় বড় টিভি লাগানো। একটু কম ভীড় দেখে একটা টিভির কাছাকাছি বসলাম। বাইরে তখনও বেশ আলো, যদিও ৮টা বেজে গেছে। খিদে তেমন পায়নি। সময় কাটানোর জন্যে একটা বীয়ার নিয়ে বসলাম। তখনও আমরা স্মার্টফোনে নেশাগ্রস্থ হইনি। মন দিয়ে খেলা দেখছি। সেবারে কোস্টারিকা বেশ ভালো টীম ছিল। রেজাল্ট তখন ২-২ চলছে। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে। অর্ডার নিতে একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো, কাগজ কলম হাতে। ঘুরে দেখতেই বুঝলাম ছেলেটা আরবী, ইজিপ্টের ছেলে। একটু বাড়তি সুযোগ পেতেই হোক বা মজা করার জন্যেই হোক, বলে ফেললাম, “অ্যাহলেন, কিফ্ হালক?” (হ্যালো, কেমন আছো?) ছেলেটা একটু থতমত খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটা দায়সারা গোছের উত্তর দিল, “ফাইন”। মেনু কার্ড’টা এগিয়ে দিয়ে ভাঙ্গা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, “হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু হ্যাভ ইন ডিনার”? আমি খাবার তালিকা দেখতে দেখতে ভাঙ্গা আরবীতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় বাড়ি, মিশর?” আমার কথার উত্তর না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। শুধু তাই নয়, আমার কাছে ওই ছেলেটা আর অর্ডারই নিতে এলো না। অথচ দেখলাম এদিক ওদিক সে তার কাজ করে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আর একজনকে ডেকে আমার খাবারের অর্ডার’টা দিলাম। ছেলেটার ব্যাপার’টা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলাম না। অন্যরা কেউ হলে খুশী হয়ে একটু গল্প করে নিত, নিজের ভাষায়। ও কি খেজুরে আলাপ করতে চায় না? না কি কাজে খুব ব্যাস্ত? পরে বুঝেছিলাম, ছেলেটা বেআইনিভাবে এখানে কাজ করছে। কারও সঙ্গে বেশি কথা বলে এক্সপোজড হতে চায় না, বিশেষ করে কোনো আরব দেশের লোকেদের সাথে। বুঝলাম ওর আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আছে। আমার মতো নয় যে ভারতীয় বলে পরিচয় দিয়ে আমি নিজেকে গর্বিত বোধ করবো। তার অবস্থান ও পরিস্থিতি অনুযায়ী তার পরিচয় সে সময় প্রকাশ করার মতো হয়তো ছিল না।
যাইহোক, ওদিকে ব্রাজিল-কোস্টারিকার ম্যাচ’টা ৫-৩ এ শেষ হলো। আমার ফেভারিট টিম ব্রাজিল জেতায়, ডিনার সেরে আমিও খুশী মনে গুটি গুটি হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।
এখানেও কেমন সেই অবস্থান, পরিস্থিতি আর পরিচয়ের সহাবস্থান দেখলাম। তাই না?
*******
পরিস্থিতি চার! অবস্থান কুয়েত।
কুয়েতের কিছু ঘটনার কথা মনে পড়ছে। হবে ২০০২-০৩ সালের ঘটনা। আমাদেরও কুয়েতে তখন ২-৩ বছর হয়ে গেছে। আরব আমিরাতের সারজা, দুবাই, আবুধাবী, ইত্যাদির মতো জায়গায় দীর্ঘ দিন কাটিয়ে যখন নতুন কর্মস্থান কুয়েতে পা রাখলাম, আমার বৌ এর মুখ’টা ছিল দেখার মতো। এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসতেই বলেও ফেললো, “এ বাবা! কোথায় এলাম, এতো গ্রামের মতো, কিছুই তো নেই”। তার কথার প্রতিবাদ করলেও তখন সেটা তেমন জোরালো ছিল না। কারণ ২০০০ সালের নির্ণীয়মান নতুন দুবাই তখন পুরোনো কুয়েতের থেকে অনেকটাই ঝাঁ-চকচকে ছিল। আমাদের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার’দের এটাই জীবন। সেই সত্তর দশকে যখন আরব আমীরাতের ‘রাস আল খেইমা’তে পৌঁছেছিলাম, আমার মনেও তখন সেই একই চিন্তার উদ্রেক হয়েছিল, “এ কোথায় এলাম”। আজকের দুবাই আর সে দিনের দুবাই’এর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ।
তবে একটা কথা এখানে বলে রাখি, কুয়েত শহরের পরিকাঠামো কিন্তু দুবাইয়ের বেশ আগে থেকেই উন্নত ছিল। কিন্তু ইরাকের ইনভেশন ও পরে ওদের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে কুয়েত বেশ মৃয়মান হয়ে পড়েছিল। মনে হচ্ছিল সব থেকেও যেন কিছু নেই। আমরা যুদ্ধের পরে গেছি। কুয়েতের রক্ষণাবেক্ষণ তখনও পুরোপুরিই আমেরিকার হাতে।। তাদেরই ছত্রছায়ায় কুয়েত আবার নতুন করে নিজেকে গড়ার চেষ্টা করছে। আমরাও তার অংশীদার ছিলাম। এখানে আরও একটা কথা বলে রাখি, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও আমার কর্মজীবনের সব থেকে ভালো সময়’টা কিন্তু কুয়েতেই কেটেছিল আর বিশেষ কিছু না থাকার মধ্যেও এই ছোট্ট আরব দেশে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনও ছিল বেশ আনন্দময়।
আমার কর্মজীবনের দায়ীত্বপূর্ণ ভূমিকা, কর্মসূত্রে বেশ কিছু বিদেশ ভ্রমণ, নতুন করে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলা, সন্তানদের পড়াশোনা, সহধর্মিনীর নতুন বন্ধুমহলে সক্রিয়তা, বঙ্গীয় পরিষদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দূর্গাপূজা, বি ই কলেজের মুষ্ঠিমেয় প্রাক্তনীদের আড্ডা, সমুদ্র-সৈকতে বার-বি-কিউ, এই সব মিলিয়ে জীবন’টা কুয়েতে ৭-৮ বছর বেশ কেটেছিল। শুনেছিলাম, কুয়েতে আগে বাংলার দূর্গাপুজো, মহারাষ্ট্রের গণেশপুজো, দক্ষিণের ওনাম, এই ধরনের অনুষ্ঠান ইন্ডিয়ান এমব্যাসী’র হলে হতো। কিন্তু ৯/১১র পরে সে সব বন্ধ হয়ে যায়। আমরা যতদিন কুয়েতে ছিলাম, বঙ্গীয় পরিষদের দূর্গাপুজো’টা ইন্ডিয়ান কমিউনিটি স্কুলের অডিটোরিয়ামে হতে দেখেছি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর ব্যাপক খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত থাকতো। স্কুল থাকলে, আমরা শুধু রাত্রেই পুজো মন্ডপে যেতাম। এই পুজো কিন্তু সেই আমাদের অবস্থান ও পরিস্থিতির জন্যই অনুষ্ঠিত হতো, সেটা বলাই বাহুল্য। ভারতীয় ছাড়াও এই দূর্গা পূজোয় বাঙালীত্বেরও যে একটা নিবিড় সংযোগ ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
যাই হোক্, কুয়েতে থাকা কালীন এই পূজো উপলক্ষে, আমরা ভারতীয় বাঙালীর সাথে সাথে বাংলাদেশী বাঙালী সম্প্রদায়েরও যে একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল, ওই পরিচিতির কারণেই, সেটা’ই আজকে আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য। ওদিকে বাংলাদেশী’রা জানিনা কেন আমাদের পশ্চিম বাংলার বাঙালীদের “দেশী” বলে সম্বোধন করতো। বাংলাদেশী দোকানে মাছ কিনতে গেলে, কাউন্টারে বসে থাকা ভদ্রলোক বলতেন, “সফিক, এদিকে আয়। দেশী’কে দ্যাখ”। আমরাও খুশী হতাম, কোলকাতার বাঙালী হিসেবে তারা যেন আমাদের একটু বেশীই খাতির করতো। মাছ তো কোনো সময় খারাপ দিতই না।
কুয়েতে থাকা কালীন সেই দূর্গাপূজোর একদিনের কথা আজ এখানে লিখছি। আমাদের বি ই কলেজেরই এক বন্ধু, আমাদের থেকে দু’বছরের জুনিয়ার, কুয়েতে অনেকদিন ধরে আছে, পূজোর সময় বললো, “চলো কাল সকালে আব্বাসিয়ায় (একটা এলাকার নাম) যাই, বাংলাদেশীরা কয়েক’টা দূর্গাপূজো করে, দেখে আসি”। আমরা চারটে পরিবার সেখানে গেলাম সেদিন, সকাল পার করে। গোটা তিনেক পূজো হয় শুনেছিলাম। ঠাকুর দেখে ফিরে এসে সকলে মিলে দুপুরে কারও একজনের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে নেব, সেই রকম ইচ্ছে ছিল। সে দিন ছিল নবমী, শুক্রবার ছুটির দিন। সে বছর সেই সময় আবার রামাদানও চলছিল। এলাকা’টা তাই একটু শান্ত-শিষ্ট মনে হচ্ছিলো। এমনিতে অন্য সময়ে শুক্রবারে এই সব জায়গায় বেশ হৈচৈ থাকে। এই এলাকা’টায় বেশিরভাগই বাংলাদেশীরা আর তার সাথে অবশ্যই ভারতীয় ও পাকিস্তানী’রাও থাকতো। প্রবাসী আরব’রা যে থাকতো না, তাও নয়।
প্রথম প্রতিমা’টা দেখতে আমাদের এক সঙ্গীর চেনা-জানা একটা বাড়িতে ঢুকলাম। সাধারণ একটা তিনতলা ফ্ল্যাট বাড়ি। প্রতি তলায় চারটে করে ফ্ল্যাট। সব বাংলাদেশী ব্যচেলার ছেলেরা শেয়ারিং সিস্টেমে থাকে। সকলে মোটামুটি ফোরম্যান, টেকনিসিয়ান বা বাজারের সেলসম্যান জাতীয় কাজকর্ম করে। সকলেই দেখলাম পূজোরই কাজ-কর্ম্মে ব্যাস্ত। দো’তলায় পূজো। হঠাৎ পূজোর সাজে, বিশেষ করে আমাদের বৌ’দের দেখে, ওরা সকলে বুঝে উঠতে পারছিলো না, কি ভাবে আমাদের আপ্যায়ন করবে। ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা বলে, চট্ করে একটা ঘরের গোটা দুয়েক বিছানা একটু পরিস্কার করে আমাদের বসতে বললো। মনে হলো আমরা যেমন ওদের কে অস্বস্তিতে ফেললাম, আমরা নিজেরাও যেন একটু অস্বস্তিতে পরে গেলাম। কিন্তু কয়েট’টা মিনিট কাটতে না কাটতেই আমরা যেন ওদের আতিথেয়তায় বন্দী হয়ে গেলাম।
ফ্ল্যাটের ড্রইংরুমে এই পূজো হচ্ছিলো। এক দিকের প্রায় পুরোটা দেওয়াল জুড়ে বেশ বড় একটা প্রতিমা। দেখলাম রঙিন সব কাঁচের টুকরো দিয়ে প্রতিমা’টা বানানো। ছোট সেকসনের ব্রোঞ্জ রঙের অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমে পাতলা থার্মোকোলের বেস বানিয়ে তার ওপরে বাতিল করা রঙিন কাঁচের টুকরো সেট করে এক একটা চরিত্র বানানো। কি সুন্দর ভাবনা আর তার বাস্তবায়ন। শুনলাম এই বাড়িতেই থাকে, দু’জন ছেলে কোন কাঁচের দোকানে কাজ করে যারা বাড়ির ইন্টিরিয়ারের কাজের সঙ্গে যুক্ত। সেই দু’জন বেশ কয়েক মাস ধরে একটু একটু করে এই মহিষাসুরমর্দিনীর চালা’টা বানিয়েছে। তাদের সাথে আলাপও হলো। দু’জনেই ঢাকার ছেলে। ব্যবহারও অমায়িক, শিল্পীর মন বলে কথা!
সে দিন ওই ছেলেদের আন্তরিকতায় আমরা ওদের ফ্যান হয়ে গেলাম। মেয়েরা লেগে গেলো পুজোর কাজে। ফল কাটা দিয়ে শুরু হলো। একটু পরে পুরোহিত মহাশয় এলেন। তিনি ও কোনো একটা কোম্পানীর অ্যাকাউন্টেট। তার পরে একে একে গোটা কয়েক পরিবার এলো। পুজোর সামগ্রী সাজিয়ে পুরোহিত মহাশয় পুজো শুরু করলেন। একে একে পুজো, অঞ্জলী, ভোগ দেওয়া, নবমীর হোম শেষ হলো। সকলে মিলে প্রসাদ খেলাম। ওদিকে, দেখি দুপুরের খাওয়ার ব্যাবস্থা হচ্ছে। বারান্দায় সব্জী, তরি-তরকারী নিয়ে দু’জন বসে গেছে কাটাকুটি করতে। আমাদের বৌ’রাও দেখলাম তাদের সাথে হাত বাড়ালো। গল্প-গুজবের মধ্যে, ওই ছোট রান্নাঘরেই বেশ রান্নার সেশন চলছিল। গোটা চারেক ছেলে মিলে দেখলাম একে একে নামিয়ে ফেললো খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, একটা সব্জী, রুই মাছের কালিয়া, চাটনি আর পাঁপড় ভাজা। একটু দেরি করে হলেও সকলে মিলে পাত পেরে দুপুরের আহার সম্পন্ন করলাম। খেতে খেতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কৌতূহল বশে, কথায় কথায় ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমাদের এই দুর্গাপুজো নিয়ে তোমাদের বাড়ির আরবাব (আরবীতে বাড়ির মালিক) তোমাদের কিছু বলে না”? একজন বললো, “প্রতি বছর আমরা ওঁকে জানাই, আমরা এরকম একটা পুজো করবো। শুনে বলেন, যা খুশী করো, আমার বাড়ি নষ্ট কোরো না আর পাড়ার প্রতিবেশী’দের কাউকে বিরক্ত কোরো না”। আর একজন বললো, “এই তো, উনি গতকাল এসে আমাদের প্রতিমা দেখে গেলেন। বললেন খুব সুন্দর হয়েছে। উনি খুবই ভদ্রলোক”। কেউ আবার বললো, “এ বছর পুজোর সময় রামাদান পরে গেছে, নইলে আমাদের অনেক মুসলমান বন্ধুরাও আমাদের সঙ্গে সারাদিন থাকে”। শুনে খুব ভালো লাগলো, একটু গর্বও হলো। এর মধ্যে আবার কাগজের কাপে সকলের জন্যে চা’ও এসে গেলো। অতিথিপরায়ণতা এদের কাছে শেখার মতো। ভাবলাম, আমরা ভারতীয় বাঙালীরা কি আমাদের পুজো মণ্ডপে ওখানে এভাবে এদের’কে আপ্যায়ন করতাম? একদমই না।
এবার মনে হলো, আমাদের ফেরা উচিৎ। এখন কেউ আর আপত্তি করলো না। শুধু বললো, “সম্ভব হলে কাল আবার আসবেন”। কাল শনিবার তো ওখানে সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন, সুতরাং আসা সম্ভব নয়, ওরাও জানে। নিচে নামার মুখে একজন জানালো, “পাশের দুটো ব্লকে আরও দুটো পুজো হচ্ছে। বাড়ি ফেরার আগে ও দুটো ঠাকুরও দেখে যাবেন”। আমাদের সাথে দু’জন ছেলে নীচে নেমে রাস্তাটা দেখিয়ে দিল।
আমরা হেঁটেই চলে গেলাম পাশের ব্লকে। তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। রামাদানের মাস, ইফতারও হয়ে গেছে। পাড়া জুড়ে তখন বেশ ভীড়, রামাদানের সন্ধ্যের একটা আনন্দের আমেজ। পুজোর জন্যে সেটা যেন একটু বেশীই মনে হলো। ছেলেদেরই সংখ্যা বেশী। ভীড় কাটিয়ে আমরা একটু সামনে গিয়ে দেখলাম একতলার পার্কিংএ প্রতিমা রেখে পুজো করছে। মুর্তির আকার বেশ বড়ই। এটা পুরোটাই সাদা, শোলার বদলে ‘থার্মোকোল’ দিয়ে তৈরী। কি সুক্ষ আর পরিস্কার কারুকার্য। মন্ডপের কাছে এগিয়ে যেতেই, সকলে পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের যাওয়ার রাস্তা করে দিলো, যেন আমরা তাদের বিশেষ অতিথি। অথচ আমরা কেউই তাদের পরিচিত নই, বাকিদের মতো শুধুই কিছু দর্শনার্থী। প্রতিমা দর্শন করে, সকলে কিছু প্রণামী দিয়ে ফিরতে যাব, সেই সময়েই আয়োজকদের কেউ একজন সামনে এসে আমাদের এক সঙ্গীর হাত ধরে অনুরোধ করলেন, “আপনারা এখন চলে যাবেন না। এখনই আরতি শুরু হবে। তারপরে একেবারে প্রসাদ খেয়ে যাবেন”। বুঝলাম, আবার আমরা আটকে যেতে বসেছি। যে বন্ধু আমাদের এখানে নিয়ে এসেছিলো, তাকে একটু ইশারা করতেই হলো। সারাদিন এক পুজো বাড়িতে কাটিয়ে তখন নিজেদের বাড়ি ফেরার খুব প্রয়োজন ছিল। অনেক অনুরোধ করে কিছুটা জোর করেই আমাদের সেদিন ফিরতে হলো। বুঝলাম ওই ছেলেরা বেশ অসন্তুষ্ট হলো, কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিল না।
কথায় কথায় কত কথাই এসে যাচ্ছে। ঘটনা সব সত্যি, তাই শেষ করতে ঘটনাক্রমে লিখতেও হচ্ছে। কিন্তু কেন? শুধু এটাই বোঝাতে, যে দুই বাংলার বাঙ্গালীদের মধ্যের এই হৃদ্যতা, এতটা আকর্ষণ, এতটা খাতির সবটাই কিন্তু বিদেশে আমাদের অবস্থানগত পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল ছিল। এই যদি কোলকাতার কোন বাঙালীর সাথে ঢাকায় কোন বাংলাদেশের বাঙালীর আলাপ হতো, তা’হলে তাদের কথপোকথন অন্য রকম হতো, সেটা অস্বীকার করার কোন কারণই থাকতো না। আমাদের পরিচিতির সবটাই আমাদের অবস্থান ও পরিস্থিতির উপরে নির্ভরশীল। এটাই আমার বক্তব্য ছিল।
******
পরিস্থিতি পাঁচ! অবস্থান সোফিয়া।
এবার মনে পড়ছে এমন একটা সমীকরণ যেখানে আমার পরিচিতি বাঙালী বা ভারতীয় নয়, বরং যে দেশের হয়ে তখন কাজ করছিলাম, আমার পরিচয় তখন হয়ে গেছিল সেই দেশের প্রতিনিধি হিসেবে।
ব্যাপার’টা বোঝানোর জন্যে এখানে আমাকে একটু বিস্তারিত লিখতে হবে। আমি তখন কুয়েতে কর্মরত, ওখানকারই একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানীতে। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় ইসলামী দেশগুলির একটা বিশেষ ধর্মীয় চরিত্র তখন আমার নজরে পড়েছিল এবং সেটা হলো “জাকাত তহবিল”। জাকাত হলো মুসলমান সম্প্রদায়ের আয়ের দান করা একটা অংশ যেটা ব্যবহৃত হয় দরিদ্র অথবা অভাবি মানুষের কল্যানে। এমনকি এই ধনী ইসলামী দেশগুলিও তাদের জাতীয় আয়ের কিছু অংশ এই জাকাত তহবিলে সঞ্চয় করে থাকে, কোন দরিদ্র ইসলামী দেশের কল্যাণের বা উন্নতির কাজে দান করার জন্য। জাকাত ছাড়াও নিজের নিজের দেশে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী আরও আর্থিক তহবিল থাকে, ওই একই প্রয়োজনে ব্যাবহারের জন্যে। সেই রকমই কোন এক অবস্থায় যখন কুয়েতের আর্থিক সহায়তায় পূর্ব ইউরোপের পিছিয়ে থাকা ইসলামী দেশ বুলগেরিয়ায় একটা কাজের সূচনা হলো, আমাদের কোম্পানীর প্রতিনিধি হয়ে আমি গেছিলাম তার রাজধানী সোফিয়ায়। কাজ’টা ছিল, সোফিয়া বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ। বিমানবন্দরের কথায় ওখানে সেবারের এক মজার ঘটনার কথাও মনে পড়ে গেল। সে কথায় একটু পরে আসছি। আপাতত কাজের কথায় ফেরা যাক।
কুয়েত সরকারের আর্থিক সহায়তায় বিদেশে কোন কাজ হলে আমাদের এই কুয়েতি কোম্পানির সেই কাজে অংশ গ্রহণের যোগ্যতা ছিল। অবশ্য কুয়েতের আরও গোটা চার-পাঁচ কোম্পানীরও এরকম যোগ্যতা ছিল। এধরনের আর্থিক সহায়তা দেওয়া কাজে, বোধহয় নিয়ম ছিল যে, সহায়ক দেশের কোন কনস্ট্রাকশন কোম্পানী যেন সেই কাজের নির্মাণের সাথে যুক্ত থাকে। সেই সূত্রেই ছিল আমার সোফিয়া যাওয়া। কারণ’টা হলো প্রি-টেন্ডার মিটিং ও সাইট ভিজিটে যোগদান করা এবং নিজেদের স্বার্থে সেই দেশের একটা সার্ভে করা। অবশ্য এই কাজের জন্যে আমরা চারটে কোম্পানী মিলে একটা কনসোর্টিয়াম তৈরী করেছিলাম। বুলগেরিয়ার একটা আধা-সরকারি হোস্ট কোম্পানী, জার্মানীর সিমেন্স, তুর্কির একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানী এবং আমরা কুয়েতের কোম্পানী। আমরা প্রত্যেকের একজন করে প্রতিনিধিরা একজোট হয়েছিলাম সোফিয়াতে, প্রথমে নিজেদের মধ্যে মিটিং, পরে সোফিয়ার এয়ারপোর্ট অথোরিটির সাথে প্রি-টেন্ডার মিটিং ও সাইট ভিজিটের জন্যে। এখানে আবার আমাদের সেই অবস্থান ও পরিচিতির কথা এসে যাচ্ছে। মিটিং এর পরিচয় পর্বে আমাকে বলতে হলো, “আই অ্যাম সো এন্ড সো, রিপ্রেজেন্টিং সো এন্ড সো কোম্পানী ফ্রম কুয়েত”। আমি তখন কুয়েতের লোক, সেখানে আমার পরিচয়ে ইন্ডিয়ার নাম-গন্ধও ছিল না। আমার অবস্থান ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তখন আমি ইন্ডিয়ান নই, একজন কুয়েতি। কি অদ্ভুত না? এই একই ধরনের কাজে একবার আমাদেরই প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপ এ আসতে হয়েছিল। সেখানেও সেই কুয়েতের প্রতিনিধি হয়ে।
আজকের এই পর্ব শেষ করার আগে একটা মজার ঘটনা বরং একটা উপলব্ধির কথা না লিখে পারছি না। এ ধরনের ট্রিপে কোম্পানীই আমাদের ফ্লাইট এবং হোটেল বুক করে। সেবার আমার ফ্লাইটগুলো ছিল কুয়েত-দুবাই-ইস্তানবুল-সোফিয়া। বেশ গোলমেলে রুট, বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে। তবুও ইস্তানবুল পর্যন্ত্য তো ঠিকই এলাম। শেষ পর্যায়ে বুলগেরিয়ার বিমান। অপেক্ষা করছি বিমানবন্দরের ট্রানসিট লাউঞ্জে, বিমানের দেখা নেই, আসেই না। বেশ দেরী করে শেষ-মেষ এলো। কিছুক্ষণ পরে বোর্ডিং এর ঘোষণা হলো। একে একে আমরা উঠে বসলাম। বেশ ছোট একটা প্লেন। হাতে-গোণা যাত্রীদের সংখ্যা। জানিনা, হয়তো একটা ইঞ্জিনেরই প্লেন ছিল। এসি চলছে বলে মনে হলো না। সীটে বসতেই ঘামতে শুরু করলাম। প্লেন’টা চালু করে ট্যাক্সিং করতেই একটা বিশ্রী আওয়াজ শুরু হলো, মাথার উপরের লাগেজ ডেকের একটা-দুটো দড়জা খুলে গেল। শুধু তাই নয়, এসি ভেন্ট দিয়ে যাত্রীদের শরীরে জলের ছিটে এসে পড়ল। চারিদিক থেকে যাত্রীদের গুঞ্জন শোনা গেল। বিমানের গতি যত বাড়তে শুরু করলো, তার সাথে বাড়লো তার ইঞ্জিন আর তার সারা শরীরের আওয়াজ। সেটা চললো যতক্ষণ না পক্ষীরাজ হাওয়ায় তার গা ভাসালেন। শরীরের আওয়াজ একটু কমলেও ইঞ্জিনের আওয়াজ আরও তীক্ষ্ণ হলো। যেন মনে হলো, আমরা ফিরে গেলাম সেই পঞ্চাশ দশকের ডাকোডার যুগে। চারিদিক থেকে সহযাত্রী’দের ভীত সন্ত্রস্ত আওয়াজে, হাসাহাসিতে ও নানা ভাষার কটূক্তিতে বিমানের মধ্যে বেশ একটা মজার বাতাবরণ তৈরী হয়ে গেল। ইস্তানবুল আর সোফিয়ার দূরত্ব খুব বেশী নয়, ঘন্টা দেড়েকের সফর। সবাই কিন্ত বেশ চিন্তিত ছিলাম, ভালোয় ভালোয় পৌঁছে গেলে হয়। যাত্রীদের সেই চিন্তার অবসান করতে হাসিমুখে জলখাবার দিতে এলেন বিমান সেবক সেবিকার দল। আমার সফর তো চলছিল আগের রাত্রি থেকে। এমনিতেই বেশ ক্লান্ত ছিলাম। ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকলেও, এই সফরের দূরবস্থায় সেটা প্রায় উবে যেতে বসেছিল। দৃশ্যমান জলের বোতল আর খাবারের সুগন্ধ সেটাকে আবার উদ্দীপ্ত করে তুললো। সকলের সাথে আমিও সময় নষ্ট না করে উদরপুর্তি করে নিলাম কফি সহযোগে। জলযোগ পর্বের ব্যাস্ততা শেষ হলো, আবার শুরু হলো সেই কলরবের বাতাবরণ আর সেই নিরাপদ অবতরণের চিন্তা। কিছুক্ষণ পরেই বিমান চালকের ঘোষণা হলো অবতরণের। মিনিট কুড়ির মধ্যেই সোফিয়ায় আমরা নামবো। সকলে নিজের নিজের ব্যাক-রেষ্ট সোজা করলাম, সীট-বেল্ট বাঁধলাম। এখন কেবল অপেক্ষা। দেখতে দেখতে সেই ক্ষণের অবসান হলো। চাকাগুলো খোলার আওয়াজ পেলাম। তার একটু পরেই মনে হলো কিছুটা যেন তড়িঘড়ি করেই আমাদের বিমান রানওয়েতে হুমরি খেয়ে পড়লো। আমরা যাত্রীরা তখন নিজেদের আসনে পিঠ ঠেকিয়ে টান্-টান্ হয়ে বসে আছি। কারও মুখে কোন আওয়াজ নেই। বিমানের চাকার সাথে রানওয়ের সংযোগ হতেই মনে হলো রানওয়ে নয়, বিমান’টা যেন কোনও ধানক্ষেতের উপরে নেমে দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করেছে। সে এক অনুভূতি। বিমানের কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বোধহয় সেদিন বাকি ছিল না যেটা আওয়াজ করছিল না। রকমারী সেই আওয়াজের মাঝে মাঝেই ব্রেক। তারই জেরে সামনের মাথার ওপরের একটা লকারের দরজা খুলে গিয়ে দুটো হ্যান্ড ব্যাগ ধপ্ ধপ্ করে মাঝের আইলে এসে পড়লো। ভাগ্য ভালো, কারও মাথার উপরে পড়েনি। মনে হচ্ছিল ব্রেক যেন কাজ করছে না, এই বোধহয় রানওয়ে থেকে বেড়িয়ে গেল। সকলের উদ্বিগ্ন মনকে শান্ত করে অবশেষে আমাদের বিমান রানওয়ের এক প্রান্তে এসে থামলো। আর বিমান থামতেই যাত্রীদের কি উল্লাস। প্রায় সকলেই একসাথে হাততালি দিয়ে উঠলো আর সাথে উচ্চস্বরে বিভিন্ন ভাষায় সাধুবাদ এবং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। সে এক দৃশ্য, সে এক উপলব্ধি। এই ধরণের সফরের অভিজ্ঞতা সেই প্রথম আর এখন পর্য্যন্ত সেটাই শেষ। তবে সে দিনের সেই অভিজ্ঞতার তাৎপর্য্য এটাই বুঝিয়েছিল যে কুয়েত একটা যথার্থ প্রয়োজনে বুলগেরিয়ার সরকার’কে তাদের সেই সময়ের বিমানবন্দরের উন্নতির জন্য অর্থিক সহায়তা করেছিলো। জানতে ইচ্ছা করে আজকের দিনে সোফিয়া বিমানবন্দরের কি অবস্থা।
আমরা গিয়েছিলাম এর প্রি-টেন্ডার আর সাইট ভিজিটে
সব শেষে বলতে ইচ্ছা করছে, সেদিন বিকেলে আমাদের কনসোর্টিয়ামের সংক্ষিপ্ত মিটিং এর পরে সোফিয়া কেম্পেস্কি হোটেলের ডাইনিং হলে সেই প্রথম কেভিয়ার খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এখানে একটু বলে রাখি, কেভিয়ার হলো কাস্পিয়ান সী ও ব্ল্যাক সী’র এক ধরনের মাছের ডিম যেটা ইরানে খুব পাওয়া যায়। ওই দিকের একটা ডেলিকেসি। সাধারণত স্টার্টারের স্প্রেড হিসেবে সার্ভ করা হয়, খেতে খুব সুস্বাদু। নাম তো এখন মনে পড়ছেনা, তবে তুর্কির কোম্পানির কন্সট্রাক্শন ম্যানেজারের সাথে সেই সন্ধ্যায় বেশ জমিয়ে ডিনার করলেও,
দুঃখের বিষয় হলো, ওই কাজ’টা আমাদের কনসোর্টিয়াম শেষ পর্য্যন্ত জিততে পারেনি।
*******
(ধারাবাহিক)
Add comment