সাহিত্যিকা

অবস্থান, পরিস্থিতি ও পরিচিতি! (দ্বিতীয় পর্ব)

অবস্থান, পরিস্থিতি ও পরিচিতি! (দ্বিতীয় পর্ব)
স্নেহাশীষ ঘোষ, ১৯৭৪ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
(সত্য ঘটনার স্মৃতিচারণে)

পরিস্থিতি ছয়! অবস্থান সিওল।
আমাদের অবস্থান যখন পরিবর্তনশীল, তখন আমাদের পরিচিতির পরিসরও অনেকটা প্রশস্ত। প্রাসঙ্গিক আলোচনার এই ঘটনায় ঘুরে আসা যাক্ দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল (অথবা সোওল) শহরে।

আমি তখনও সেই কুয়েতেই কর্মরত। সময়’টা হবে ২০০৬ এর আশে-পাশের। সাদাম হুসেনের ভয় কাটিয়ে আমেরিকার সংরক্ষণে কুয়েত তখন নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলছে। আমরা যখন স্থানীয় কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর হয়ে কাজ করছি, তখন সারা দুনিয়ার নানা রকমের নামী দামী কোম্পানীরাও কুয়েতে তাদের নিজেদের ক্ষেত্রেও বেশ ব্যাস্ত। তবে বাইরে থেকে আসা এইসব কোম্পানীদের স্থানীয় লোকবল না থাকায় স্থানীয় কোম্পানীর সাহায্য নিয়েই তাদের কাজ করতে হতো। সেই সূত্রেই আমাদের মতো অনেক স্থানীয় কোম্পানীরাও অনেক রকম কাজে সেই সময় বেশ ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিল। আমাদের কোম্পানী নিজেদের কাজ ছাড়াও, কয়েকটা বিদেশী কোম্পানীর সিভিল কনস্ট্রাকশনের কাজও করতো। যেমন পাওয়ার প্ল্যান্ট, সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট অথবা আমেরিকার ডিফেন্স বেস এর কোনো কাজের সাথে যুক্ত বিদেশের বিশেষজ্ঞ কোম্পানীর প্রজেক্টের কিছু সিভিল কন্সট্রাকশন। হুন্ডাই কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর সাথে একটা পাওয়ার প্ল্যান্টের সিভিল ওয়ার্কের নিগোসিয়েশনের জন্যই আমার দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল এ যাওয়া। আমার সঙ্গী ছিলেন আমাদের কোম্পানীরই এক বিজনেস ডেভলপমেন্ট অফিসার মিঃ কি ওন ইউ (Ki Own Yoo), আমরা তাকে ‘কিউ’ বলে ডাকতাম, একজন দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক। আমাদের দেশে যেমন তিনটে দক্ষিণ ভারতীয় এক জায়গায় হলে স্থান, কাল, পাত্র ভুলে নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতে শুরু করে দেয়, ঠিক তেমনই কোরিয়া, চায়না, জাপান এইসব দেশের লোকেরাও নিজেদের ভাষায় বেশী সাচ্ছন্দ বোধ করে। তাই সেবার আমার সঙ্গী ছিলেন কোরিয়ারই এই সহকর্মী, সেই ভাষার বেড়াটা পার করার জন্যে। অবশ্য আমিও ব্যক্তিগত ভাবেও কিছু লাভবান হয়েছিলাম, সে কথায় পরে আসছি।

এবারেও সেই এমিরেটস এয়ারলাইনস। এবারেও আবার এক নতুন অভিজ্ঞতা। কোম্পানী যদি বেসরকারী হয়, তা’হলে জেনে রাখবে, কোম্পানীর কাজে বাইরে যেতে হলে, সেদিনের পুরো ডিউটি করার পরের কোনো ফ্লাইটের টিকিট কেটে তোমাকে পাঠানো হবে। পরের সারাটা দিন সেখানে কাজ করে, সেই রাত্রের ফ্লাইটেই ফিরে এসে পরের দিন সকালে আবার যথারীতি অফিস করতে হবে। একটু যে শহর’টা ঘুরে দেখে আসবো, সে সুযোগও দেবে না। এবারের সিওল যাত্রায় হলো সে গুড়ে বালি। কেন বলছি। কারণ সিওল তো আর দিল্লী নয় – কোয়েত থেকে এক রাত্রে গেলাম, পরের দিনে কাজ সারলাম আর সেই রাত্রেই ফিরে এলাম।

সেই বিকেলে অফিস সেরে বাড়িতে একটু ফ্রেশ হয়ে কুয়েত থেকে দুবাই এর ফ্লাইট ধরলাম। আমার কোরিয়ান সহকর্মী দু’দিন আগেই চলে গেছে। ওর বাড়ি তো সিওলেই। বেশ রাত্রি করেই দোহা-সিওলের ডায়রেক্ট ফ্লাইটে উঠে বসলাম। আমাদের কোম্পানী কৃপণতা করতো না। লং-হল হলে বিজনেস অথবা ফার্স্ট ক্লাসেই সিনিয়র স্টাফদের পাঠাতো। আমার উইন্ডো-সীট ছিল। যথারীতি টেক-অফ হলো, একটু স্থিরতায় এলে বিমানকর্মীরা যাত্রীদের নিজের নিজের পছন্দের পানীয় আর স্ন্যাক্স পরিবেশন করা দিলো। একটা ছেলে আবার খাতির করে একটা ভাল ওয়াইনের বোতল খুলে কিছুটা গ্লাসে ঢেলে দিয়ে বোতল’টা রেখে “এনজয় ইওর ড্রিংক” বলে একটা মিক্সড ড্রাই ফ্রুটের কৌটো রেখে চলে গেল। ছেলেটা ইন্ডিয়ানই ছিল। আকাশে নিয়ম নাস্তি। একটু পরেই ডিনার এলো। চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় সহকারে সেটাও শেষ হলো। কেউ একজন একটা কিট্ দিয়ে গেলো, স্লিপিং স্যুট, মোজা, চপ্পল, ব্লাইন্ড, টুথব্রাশ, পেস্ট, ইত্যাদির। সুযোগ নিলাম। ব্লেজার’টা খুলে একজন ক্রু’কে দিলাম হ্যাঙ্গারে রেখে দেওয়ার জন্য। জামা-প্যান্ট বদলে, স্লিপিংস্যুট পড়ে, সীট’টা কে লম্বা করে শোওয়ার অবস্থায় এনে, কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমের দেশে চলে গেলাম। ততক্ষণে কেবিনের সব লাইটও নিভে গেছে।

এত কথা কেন লিখছি পরে বোঝা যাবে। নির্বিঘ্নে বেশ একটা ঘুম দিলাম, চার-পাঁচ ঘন্টার মতো হবে। এদিক ওদিক থেকে কিছু গুঞ্জন ও টুকটাক আওয়াজে ঘুম’টা ভেঙ্গে গেল। সুযোগ বুঝে ভীড় শুরু হওয়ার আগে প্রথম চোটেই প্রাতকৃত্য’টা সেরে নিলাম। পোষাক বদলে, সীট সোজা করে আবার ভদ্রলোক সেজে বসলাম। পাশের সহযাত্রী, এক ইংরেজ ছোকরা, তখনও গভীর নিদ্রায় মগ্ন। মর্নিং টি, ট্রলি’তে নয়, যে যেমন চাইছে, তাকে আলাদা করে সার্ভ করছে। আমার মন’টা ও চা-চা করছিল। একটা নিয়ে বসলাম। সূর্য্যদয় দেখার ইচ্ছায় জানালার শাটার’টা একটু তুলে ধরলাম। দেখি সারা আকাশ আলোয় ভরা। এতক্ষণ ভাবছিলাম, এই সকাল হলো, কিন্ত দেখলাম তখন প্রায় বিকেল, কারণ আমরা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাচ্ছিলাম। দুবাই এর সময় থেকে সিওল পাঁচ ঘন্টা আগে আর ফ্লাইং টাইম প্রায় সাড়ে আট ঘন্টা। আমাদের ব্রেকফাস্ট টাইমে যেটা পরিবেশন করা হয়েছিল সেটা তখন সিওলের স্থানীয় সময়ের হিসাবে দেখলে বিকেলের টিফিনের মতো। ঘন্টাখানেক পরেই সিওলে ল্যান্ড করবে সেই ঘোষণাও হয়ে গেল। ঠিক সময়েই সিওলে নামলাম। বাইরে বেড়িয়ে কথামত সহকর্মী কিউ এর দেখা পেলাম। সে তো ওখানে তার বাড়িতেই থাকে। ওর সঙ্গ পেতেই আমাকে এরপরে আর কিছুই ভাবতে হয়নি।

যাইহোক এয়ারপোর্ট থেকে পূর্ব-নির্ধারিত হোটেলে নিয়ে যাওয়া, চেক-ইন করানো, ঘরে পৌঁছে দেওয়া, এমন কি বেল-বয় কে একটু টিপস দেওয়া পর্য্যন্ত সেই আমাকে সঙ্গ দিয়েছিল। ভাষার অসুবিধা একটু হতে পারে, সেটা বলে, আগামীকাল সকাল সাড়ে আটটায় দেখা হবে জানিয়ে বিদায় নিল। মিটিং ছিল দশটায়। কিম্ আতিথেয়তা এমন করছিলো, যেন ওর নিজের বাড়িতে গেছি। ও চলে যেতেই, সব আন্-প্যাক্ করে বেশ ভাল ভাবে উষ্ণ গরম জলে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে জানালা দিয়ে জায়গা’টা দেখার চেষ্টা করলাম। এয়ারপোর্ট থেকে এখানে আসতে আর এখন হোটেলের বেশ উপরের ঘর থেকে পাখির চোখে দেখে বুঝলাম এরা আমাদের থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে। হোটেলের নাম তো এখন মনে নেই, তবে এটা ছিল দুটো বড় রাস্তার ক্রসিং এ, একটা প্রাইম লোকেশনে।

কফি খেতে খেতে আগামীকালের মিটিং এর কাগজপত্র, ড্রইং, ল্যাপটপ, পেন-ড্রাইভ এইসব এক জায়গায় ঠিক্ করে রাখলাম। আসল মজা’টা (অথবা আমার দূর্দশা’টা) শুরু হলো ঠিক এর পরেই। আমার শরীর তখন কুয়েতের সময়ে চলছে। প্লেনে ডিনারের পরে রাত্রের ভালো ঘুম, আর সেই ঘুম থেকে উঠে বেশ জমিয়ে ব্রেকফাস্ট আর হোটেলে স্নান সেরে এই সবে মিড-মর্নিং এর কফি’টা যেন শেষ করেছি। অভ্যাস বশতঃ দেওয়ালে ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই বাস্তবে ফিরে এলাম। দেখি তখন স্থানীয় সময়ে রাত্রি প্রায় দশ’টা বাজে। অর্থাৎ এখন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার সময়। আবার খাওয়া, আবার ঘুম? কিন্ত আমি তো তখন একদমই চাঙ্গা – না পেটে ক্ষিদে, না চোখে ঘুম। চিন্তায় পড়ে গেলাম, কি করা যায়?

একটু সময় কাটিয়ে, রুম-সার্ভিসের মেনু’টা নিয়ে বসলাম, ছোট কিছু অর্ডার দেব বলে। হঠাৎই চোখে পড়লো, “ইন্ডিয়ান চিকেন-কারি উইথ্ স্টীমড্ রাইস”। ক্ষিদে নেই, তাই শুধু একটা চিকেন স্যুপ্ আর গ্রীক স্যালাড এর অর্ডার দিলাম। কিছু একটা খেতে তো হবে। দেরী করতে করতে রাত্রি বারোটার পরে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে শুতে গেলাম। একটু হয়তো চোখ’টা জড়িয়ে এসেছিল কিছুক্ষণের জন্যে। সেই যে ঘুম চলে গেল একটা-দেড়টা নাগাদ, আর তার পাত্তাই নেই। উঠছি, বসছি, শুচ্ছি, জানালা দিয়ে রাতের সিওল দেখছি, পায়চারি করছি, ঘুমের নাম ও নিষাণ নেই। দুটো, তিনটে, চারটে, পাঁচ’টার পরে যেন ঘুম’টা একটু এলো। সাত’টায় বলে রাখা ‘ওয়েক-আপ কলে’ কাঁচা ঘুম ভাঙলো। ওহ্, সে এক রাত্রি গেছে। জেট-ল্যাগের সেটাই ছিল আমার হাতেখড়ি। সকালে আবার সেই দৈনিক রুটিন। ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেলের লবি’তে আমি তৈরী। এখন অপেক্ষা কিউ এর। প্রায় সময় মতই ও এসে গেল।

এবার সেই অবস্থান ও পরিচিতির পালা। মিটিং হলো দক্ষিণ কোরিয়ার একটা কোম্পানীর সাথে কুয়েতের একটা কোম্পানীর। আমি ভারতীয়, কিন্ত তার কোনো জায়গা নেই। স্থানীয় সহকর্মী থাকার ফলে সমস্ত প্রক্রিয়া’টা সব প্রোটকল মেনেও বেশ ঘরোয়া পরিবেশের মধ্যেই চলেছিল। দুই কোম্পানীই তাদের আলোচ্যসূচী অনুযায়ী তৈরী ছিলাম। আমার টেকনিক্যাল বিষয়ের স্পষ্টীকরনে বেশী সময় লাগলো না। আমার পরে কিউ তার বক্তব্য রাখলো, আমাদের কোম্পানীর নির্মাণ কার্য্যের দক্ষতা ও ক্ষমতার কথা বলে। মাঝে কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজারের সাথে মিনিট পাঁচেকের জন্যে সৌজন্য সাক্ষাৎকার করে একটা “এম ও ইউ” এর খসরায় সই সাবুদ সেরে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই মিটিং শেষ। জেনারেল ম্যানেজার তাঁর অধঃস্তনদের বলে দিলেন, আমাদের জন্যে যেন লাঞ্চের ব্যাবস্থা করা হয়। বুঝলাম তাঁরাও বোধহয় খুশী হলেন।

এর আগে এতো সুন্দর বিজনেস ট্রিপ হয়নি। এইবারই প্রথম অফিসের কাজ কম, অন্য কাজ বেশী হলো। সেদিন ওদেরই অফিসের একটা ঘরে, ওদেরই স্টাইলে ঘরের মেঝেতে আসনে বসে, সামনে ছোট ডেস্কের উপড়ে রেখে কোরিয়ার খাবার খেলাম। ওদের কোনো একটা স্পেশালিটি ডিস্ ছিল। এখন তার নাম তো মনে নেই। একটা সিরামিকের বড় বাটিতে নুডলস্ স্যুপের মধ্যে গোটা একটা ছোট সাইজের চিকেন। ডিস্’টা পুরোটাই হার্বস্ দিয়ে তৈরী। সাথে আর কিছু নেই, শুধু পাশে রাখা নানা রকমের শস্ এর বোতল। স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। লিখতে গিয়ে জিভে জল এসে গেল। খাবার শুরু করার আগে টাকিলা স্টাইলে ওদেরই কোনো কান্ট্রী-লিকার খেতে দিয়ে বললো এটা এপিটাইজার। ওদের অনুসরন করে এক ঢোকে গিলে ফেললাম। হয়তো তারই কল্যাণে পুরো ডিশ্’টাই সাবার করে দিয়েছিলাম। লাঞ্চ শেষ তো মিটিং ও শেষ। ফেরার পথে কিউ তার একটা কাজ সেরে নিল। দু’জনে দাইয়ু (দেয়ু) অফিসের বিজনেস ডেভলপমেন্ট অফিসারের সঙ্গে দেখা করে আমাদের কোম্পানীর একটা ব্রোসার দিয়ে একটু তদ্বির করে এলো। কুয়েতে ওরাও তখন কয়েকটা বড়সড় কাজ করছিল।

আমাদের কাজ শেষ। হাতে অনেক সময়। সেদিনের বিকেল এবং পরের দিনের সাড়াটা দিন। কিউ কে আব্দার করলাম কয়েকটা দ্রষ্টব্য দেখানোর জন্য। রাজি হয়ে গেল। বাড়ি থেকে ফ্রেশ হয়ে আসতে দেরী হবে বলে, আমার সাথে হোটেলেই চেঞ্জ করে নিল আমারই একটা টী-সার্ট পড়ে। সেদিন আমাকে নিয়ে গেল একটা পাহাড়ের উপরে ওদের ল্যান্ডমার্ক নামসান সিওল (টেলিকমিউনিকেশন) টাওয়ারে।

বেশ উঁচু, অনেক দূর থেকে দেখা যায়। রোপওয়ে থাকা সত্বেও আমরা ট্রেকিং করেই সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিলাম। ওদের ফিজিক্যাল স্ট্যামিনা আমাদের থেকে অনেক বেশী। ঘন্টা খানেকের চড়াই আমাকে বেশ বেগ দিয়েছিল। সন্ধ্যেটা টাওয়ারের উপড়ে ভালোই কেটেছিল। উত্তর কোরিয়ার বর্ডারের আলো দেখা যাচ্ছিল, সেটা দেখলাম। ভিউইং গ্যালারিতে পৃথিবীর বেশ কিছু বড় শহরের ডায়রেকশন এবং সব থেকে উঁচু এই ধরনের কিছু টাওয়ারের উচ্চতা দেখানো আছে। এটার উচ্চতা তখন বোধহয় দশ এর মধ্যেই ছিল, ঠিক মনে পড়ছে না। এখন আর সেই লিস্টে বোধহয় এর নাম নেই। পায়ে পায়েই আবার নীচে নামলাম। আমার শরীরের উপর দিয়ে বেশ ধকল গেলেও নতুন জায়গা দেখার আনন্দে সেটা তখন বোঝা গেল না।

জাপানী’দের মতো কোরিয়ার লোকেরাও পাণীয়ের বেশ ভক্ত, সেটা বিয়ার হোক বা সিগারেট। তখন অফিস বা পাবলিক বিল্ডিংএ সিগারেট স্মোকিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বহুতল অফিসের একদম নীচে বাইরে অ্যাশট্রে রাখা থাকতো। ধুম্রপায়ীরা সেখানেই ফুঁকতে আসতো। আবার ওদের একটা খুব ভালো দিকও আছে, জাপানী’দের মতই ওরা বেশ কাজ-ভক্ত।

যাই হোক, পাহাড় থেকে নেমে আসতে আসতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছিল। একটু তৃষ্ণার ও ক্ষুধার ঊদ্রেক হচ্ছিল। আমার সতীর্থ সোজা আমাকে নিয়ে চলে এলো বেশ একটা রমরমা বাজার এলাকায়। ঠিক পশ্ বলবো না, তবে বেশ প্রাণবন্ত। চারিদিকে রঙ-বে-রঙের আলো-ঝলমল করছে। আবার বেশ চওড়া রাস্তার মাঝখানে লাইন করে হকারদের অস্থায়ী দোকান-পাট। হৈ হৈ করে সব রকমের জিনিষ বিক্রী হচ্ছে। আমরা ছোট কিন্তু পরিস্কার একটা রেস্টুরেন্টের দো’তলার খোলা ছাদে বসলাম। বন্ধুবর দু’টো বিয়ার আর ফিস্ ফিঙ্গার অর্ডার দিলে, আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলে বসলাম। হঠাৎ এরকম একটা লম্বা ট্রেকিং করে এসে ক্লান্তির মধ্যে সেদিনের সন্ধ্যে’টা বেশ উপভোগ করেছিলাম। ফেরার সময় হঠাৎই লক্ষ্য করলাম, এই একটু আগেই যেখানে রাস্তার মাঝে হৈ হৈ করে বাজার চলছিল, সেই রাস্তাটা একদম পরিষ্কার। দেখে মনেই হলো না যে সেখানে এই একটু আগে অবধি লোকেদের কেনাকাটা চলছিল। শৃঙ্খলা এবং নিয়মাবর্তিতা এদের কাছে শিখতে হয়। সেদিনের এই ছোট্ট ঘটনা আমার মনে একটা প্রভাব ফেলেছিল। একটু স্বচ্ছন্দ হয়ে হোটেলে ফিরলাম। কিম্ আমার টিশার্ট বদলে নিজের জামাটা পড়ে সেদিনের মত তার বাড়ি ফিরে গেল। বলে গেল কাল ব্রেকফাস্ট করে তৈরী থাকতে। আমাকে সাইট-সিইং এ নিয়ে যাবে।

Gyeongbokgung Palace
Gyeongbokgung Palace was completed in 1395 at the beginning of the Joseon Dynasty during the reign of King Taejo. Gyeongbokgung, which means “palace greatly blessed by Heaven,” was built in the heart of Seoul surrounded by Mount Bugaksan and Mount Namsan.

অনেক আগে রাজতন্ত্র তো অনেক দেশেই ছিল। এই কোরিয়াতেও ছিল। রাজা গোজন, জোসন ডাইনাস্টি, এই রকমই ছিল নামটা। গত শতাব্দীর শুরুতেই বোধহয় সেই রাজত্ব শেষ হয়েছিল। ব্রেকফাস্ট সারা হলে, দশটা নাগাদ কিউ আমাকে নিয়ে এলো সেই রাজপ্রাসাদে। কয়েক একর জুড়ে, সুন্দর একটা বাগানের মাঝে সেই প্রাসাদ, সাথে তার আনুসঙ্গিক সব রকমের সাপোর্ট সিস্টেম, যেমন সব ধরণের রাজপ্রাসাদে হয়ে থাকে, ছোটো-খাটো একটা শহর। আর তার সবেতেই বৌদ্ধ ধর্মের স্থাপত্যের প্রভাব। কিছু নির্দিষ্ট প্রাসাদ, মন্দির, অফিস, বাগান, এসব ঘুরতেই বেশ সময় লেগেছিল। বাইরের একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে, সেটা আবার নিজের ইচ্ছেতেই যত রাজ্যের শামুক, গুগলি, ঝিনুক, ইত্যাদির স্যুপের সাথে, বেড়িয়ে পরলাম সিওলের অপর প্রান্তে ওদের হ্যান নদী পেরিয়ে। মেট্রোতে গেলাম, বেশী সময় লাগেনি। আমাদের তখন সবে ধন নীলমনি, কোলকাতার মেট্রো। ওদের গুণমান কোলকাতার’টার থেকে অনেক ভালো সেটা বলাই বাহুল্য, তবে শহরের মধ্যে শুধু জমির নীচে, শহরের বাইরে কিন্তু জমির উপরে।

আমাদের গন্তব্য ছিল ১৯৮৮’র কোরিয়ার অলিম্পিক স্টেডিয়াম এবং ২০০২ সালের ফিফা ওয়ার্লড কাপের মেন স্টেডিয়াম। বেশ দূর থেকেই বুঝতে পারছিলাম আমরা স্টেডিয়ামের দিকে এগোচ্ছি। অলিম্পিক স্টেডিয়াম মানে শুধু একটা খেলার মাঠ নয়, সব মিলিয়ে যেন একটা ছোট শহর। বলা যায় একটা শহরের মধ্যে আর একটা শহর। মেন স্টেডিয়ামের আশেপাশে আরও অনেক ধরনের খেলার মাঠ, ইন-ডোর ও আউট-ডোর, সুইমিং পুল, জিমনেসিয়াম, হাসপাতাল ও ল্যাবরেটরি, নানা ধরনের কিচেন ও ডাইনিং হল, হোটেল, হোস্টেল, গেমস ভিলেজ, হেলিপ্যাড, দমকল, সাইকেল ট্রাক, গার্ডেন, পার্কিং কি যে নেই সেখানে, এমন কি শপিং সেন্টারও। কাছের স্টপেজে নেমে, হাঁটা শুরু করে প্রায় এক কিলোমিটার পর স্টেডিয়ামের মেন গেট’টা পেলাম। কিন্তু কপাল খারাপ, গেট বন্ধ। অবশ্য বাইরে থেকেই লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে পুরো স্টেডিয়ামের ভিতর’টা দেখলাম। স্বচক্ষে সেই আমার প্রথম অলিম্পিক স্টেডিয়াম দেখা। আশেপাশে একটু ঘুরে, কয়েক’টা ছবি তুললাম। একটা কফিশপে বসে একটু সময় কাটিয়ে, সেই মেট্রো ধরে হোটেলে ফেরা। তখনও সন্ধ্যে হয়নি।

সেই রাত্রেই বেশ দেরী করে আমার ফেরার ফ্লাইট। আমি একাই ফিরবো। কিউ বাড়ি ফিরলো। আমার সহকর্মীর বাড়ি এখানে, তাই ও ক’টা দিন পরে ফিরবে। আমার সাথে নগণ্য মালপত্র। কিউ বলেছিল আমার হাতে তাদের কিছু দেশী খাবার আমার সাথে কুয়েতে পাঠাবে, পরে আমার থেকে নিয়ে যাবে। যদিও ব্যাপারটা সমীচীন নয়, তবুও বন্ধুত্বের খাতিরে আমি রাজী হয়েছিলাম। বলাই বাহুল্য সেটা আমার কোন রকম বিপত্তির কারণ ঘটায়নি। যাইহোক আমি আমার সব জিনিষপত্র প্যাক করে, স্নান সেরে তৈরী হয়ে একটু তাড়াতাড়ি হাল্কা ডিনার করে নিলাম। কথামত ঠিক্ সময়ে কিউ তার খাবারের কার্টন নিয়ে হাজির হলো। বললো, সব প্যাকট্ এবং শুকনো খাবার, দশ কেজি মতো ওজন হবে। আমাকে এয়ারপোর্টে ছাড়তেও যাবে। আমি ঘর ছাড়ার আগে হাউসকিপিং স্টাফদের কিছু টিপস্ দেওয়ার ইচ্ছা জানালে, কিম্ বললো “যা দিতে চাও বালিশের নীচে রেখে দাও”। একটা নতুন কায়দা শিখলাম সেদিন। লেট চেক-আউটের জন্যে বলাই ছিল। পেমেন্ট তো কোম্পানী করেছে। আমি বিল’টা নিয়ে কিউ এর সাথে হোটেল ছাড়লাম। এয়ারপোর্টে চেক-ইন করা অবধি কিউ সেদিন আমার সাথেই ছিল।

এখানে বলে রাখি, এই বিজনেস ট্রিপ’টা আমার জন্যে খুব ভাল ছিল। এক তো কোরিয়ারই একজন নাগরিক ছিল আমার সাথে, যেখানে ভাষার সাথে সংস্কৃতিও একটু হলেও একটা অন্তরায়, কাজের শেষে বেড়ানোর জন্যে পুরো দেড়টা দিন পেয়েছিলাম, যা অন্য কোন ট্যুরে পাইনি, আর যে কাজের জন্যে আসা, হুন্ডাই কনস্ট্রাকশন কোম্পানী তাদের সেই প্রজেক্টের সিভিল কাজের কনট্রাক্ট আমাদেরই দিয়েছিল, কুয়েতে ফেরার মাস খানেকের মধ্যেই। বলাই বাহুল্য, আমার কোম্পানীর সাথে আমিও সেদিন খুব খুশী হয়েছিলাম, তবে সে ভারতের আমি নই, কুয়েতের আমি। সেই সময়ে আমার অবস্থান তখন আমার পরিস্থিতি ও জন্মগত পরিচিতি বদলে দিয়েছিল।

*******

পরিস্থিতি সাত! অবস্থান ভিয়েনা।
অবস্থান ও পরিচিতির স্মৃতিচারণে দেখতে দেখতে আধা ডজন পেরিয়ে গেলাম। এই কথোপকথন খুব বেশি দিনের পুরানো নয়, এই ২০১৪ সালেরই। সেবার বেড়াতে বেড়িয়ে আমরা দু’জনে সুইটজারল্যান্ড ঘুরে, লুজার্ণ-জুরিখ হয়ে সেদিন বেশ লম্বা কিন্তু সুন্দর একটা ট্রেন-জার্নি করে ভিয়েনা পৌঁছেছিলাম। সাড়া দিনের সফর বলা যায়। সকালের ট্রেন ধরে বিকেলে পৌঁছানো। ইচ্ছা ছিল ইউরোপের কান্ট্রী-সাইড দেখা আর একটা লম্বা ট্রেন-জার্নি করা। আল্পস এর উপত্যকা বরাবর সুইটজারল্যান্ড আর অস্ট্রিয়ার প্রাকৃতিক ভূচিত্র দেখে চোখ, মন, প্রাণ সব যেন জুড়িয়ে গেল। আর সেই ট্রান্স-ইউরোপের রেল-সফর করার ইচ্ছে পূরণ হলো, ভোলা যায় না।

ভিয়েনা’র জন্যে তোলা ছিল শুধু দু’টো দিন। তার মাঝে ওই ট্রেন সফরে একটা দিনের সিংহ ভাগ তো চলেই গেছিলো। তাই হোটেলে চেক-ইন করে, তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে দু’জনে বেড়িয়ে পড়লাম হাঁটি হাঁটি করে ডাউন-টাউনের দিকে। হাতে ম্যাপ, তাই কোনো অসুবিধা ছিল না। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সুন্দর করে সাজনো গোছানো শহর। অস্ট্রিয়ার ইতিহাসে যাচ্ছি না, তবে বলে রাখি, এর চারিদিকে ছিল ছড়ানো ছেটানো যাদুঘর আর রাজপ্রাসাদ – শহরের মধ্যেই হোক বা বেশ কিছু দূরে দূরে। ঐতিহাসিক দানিউব নদীও এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। ইউরোপীয় শহর, তাই এদিক ওদিক নানা রকমের স্থাপত্যের অভাব নেই, তেমনি আবার চারিদিকে বাড়ির মাঝে ছোট ছোট সব বাঁধানো উঠোন, এক চিলতে করে বাগান, সেখানে বসার জায়গা আর নানান ধরনের রেস্তোরা। স্থানীয় লোকেদের সাথে দর্শনার্থীর ভীড়ও কিছু কম যায় না। সন্ধ্যের মুখে সে যেন একটা উৎসবের অনুভূতি। সামনেই ছোট একটা মিউজিয়াম ঘুরে নিলাম, চৌমাথার একটা দো-তলা চাতালের ওপরে উঠে কিছু ছবি তুললাম। কাতার এয়ারওয়েজ ও এমিরেটস এয়ারলাইন্সের অফিস নজরে পড়লো, দেখে যেন নিজেদেরই মনে হলো। আমরা দোহা থেকেই সেবার ওখানে গেছিলাম। পরের দিন সকালে যেখান থেকে বিগ-বাসে উঠে শহর পরিক্রমায় বেড়োবো, সে জায়গা’টাও চিনে রাখলাম। এক এক করে সন্ধ্যের আলো জ্বলে উঠতেই এলাকা’টা যেন স্বপ্নপুরী হয়ে উঠলো। হোটেলে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। যতক্ষণ শরীর সঙ্গ দিয়েছিল, ততক্ষণ আমরা সেখানে ঘুরে ফিরে সেদিনের মতো হোটেলে ফিরে এলাম। তবে একটা কথা এখানে না লিখে পারছি না, সেদিন আমাদের দু’জনকে কেন জানিনা একটু বেমানান লাগছিল। আমাদের মতো কোন ভারতীয় সেদিন নজরেই পড়লো না। নয়তো যেখানেই গেছি অন্তত দু-এক জন বঙ্গ সন্তান নজরে পরেছে।

আজকাল তো অনেক শহরেই আছে, তবে বিগ বাসের সাথে আমার প্রথম সখ্যতা হয়েছিল লন্ডনে। তার সাথে তার এক অপারেটরের সাথেও। সে কথাও পরে একদিন লিখবো। বেশ মজার এই বিগ বাস। পরে তো দেখলাম ইউরোপের প্রায় সব শহরেই, কম-বেশি এই বিগ বাসের সার্ভিস রয়েছে। এই বিগ বাসের মজা’টা হলো, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এতে শুধু বসে বসেই একটা চক্কর শেষ করলে সেই শহরের মোটামুটি সব দ্রষ্টব্যই বাইরে থেকে দেখে নেওয়া যায়। তা’ছাড়া কোনো বিশেষ দ্রষ্টব্য দেখতে চাইলে, বাস থেকে নেমে পড়ো, দেখে নাও আবার অন্য আরেকটা বাসে উঠে পড়ো পরের কিছু দেখার জন্যে। সেই কবে চাকা আবিস্কার হয়েছিল, আর সেই চাকার ওপরে এই বিগ বাসও। হাঃ-হাঃ। এইরকম কোনো বড় শহর পরিক্রমায়, এই “হপ্-অন্ হপ্-অফ্” – ট্যুরিষ্ট’দের জন্যে এক আদর্শ বাহন, ‘হো-হো’।

Schonbrunn Palace, Vienna

পরের দিন সকালে ব্রেকফাষ্ট করে আমরা সেই বিগ বাসে উঠে বসলাম। বিস্তারিত বিবরণে যাচ্ছি না। ঘন্টা চার-পাঁচ ধরে ঘুরে শহরের মধ্যের একটা মিউজিয়াম, একটা গীর্জা আর একটু দূরে বেশ বড়সড় শোনব্রুন রাজপ্রাসাদ দেখে দুপুর পার করে হোটেলে ফিরে এলাম। হাল্কা লাঞ্চ সেরে, শরীর’টা একটু টান-টান করে আবার বেড়িয়ে পড়লাম, হাঁটি হাঁটি পা পা। কারণ’টা ছিল ‘অদ্যই শেষ রজনী’।

আজকের শিডিউলে অপেরা দেখা নয়, তবে ছিল অপেরা হাউস আর কনসার্ট-হল গুলো বাইরে থেকে দেখে নেওয়ার। ওর জন্যে বিশেষ কিছু এলাকা নির্দিষ্ট আছে। ভিয়েনার মিউজিকের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই – মোজার্ট আর বিটোফেন এই দুটো নামই যথেষ্ট। ম্যাপ দেখে পৌঁছে গেলাম সেই অপেরা চত্তরে। সেইখানের একটা ছোট্ট ঘটনা অথবা বলা যায় একটা ছোট্ট কথোপকথন এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয়। অপেরা চত্তরের মধ্যে ঢুকতেই বুঝলাম ওখানে গাড়ি-ঘোড়ার প্রবেশ নিষেধ, হ্যাপিজোন এর মতো।

এখানে বলে রাখি ভিয়েনা শহরে কিন্তু ঘোড়ায় টানা গাড়ি এখনও আছে। চত্তর’টা দেখেই মনেপড়ে গেল গ্লোব, মিনার্ভা বা লাইট হাউসের সামনের সেই ছোট্ট জায়গা গুলো। এখানে দেখলাম এক দিকে দোকান-পাট আর অন্যদিকে লাইন করে অপেরা হাউস। মাঝখানে বেশ চওড়া একটা চত্তর যেখানে বেশ একটা বনেদিয়ানার ছাপ। সবথেকে মজা লাগলো, যাত্রা বা থিয়েটারের অভিনেতার বেশে বেশ কিছু লোক, তাদের হাতে একটা করে পাতলা অ্যালবাম গোছের কিছু নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে পর্য্যটকদের কাছে অপেরার টিকিট বিক্রী করার চেষ্টা করছে। একজনকে কাটিয়ে যাই তো আর একজন এসে হাজির। আমরা তো শুধু ওই অপেরা হাউসগুলো দেখতে এসেছি, অপেরা দেখতে নয়। আমি বুঝি না তো কিছু, শুধু ব্যাঙ্গ করি ওই গান শুনে। “না, আমরা ইন্টারেস্টেড নই”, বলছি আর এগোচ্ছি। এ তো মহা মুস্কিলে পড়া গেলো। একজন বোধহয় একটু বেশি স্মার্ট ছিল। কথা শুরু করলো, “হ্যালো মাই ইন্ডিয়ান ফ্রেন্ড, হাও ডু ইউ এনজয় ভিয়েনা”? কথা না বলে একটা ‘থাম্বস্ আপ’ দেখিয়ে আমরা দু’জনে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। সহজে ছাড়তে চাইলো না। বললো, “ইওর ভিজিট টু ভিয়েনা উইল রিমেইন ইনকমপ্লিট, ইফ ইউ ডোন্ট ওয়াচ্ অ্যান ওপেরা”। বোঝাতে চেষ্টা করলো ওই হলে কোন থিমের ওপরে অপেরা’টা হবে, কে সিঙ্গার, ব্যালে’তে কোন্ গ্রুপ থাকবে, এই সব। আরও সামনে এসে বললো, “ডোন্ট মিস্ ইট। বাই দ্য ওয়ে, হুইচ পার্ট অফ ইন্ডিয়া আর ইউ কামিং ফ্রম? বুঝলাম আমাদের সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। বললাম, “ফ্রম ক্যালকাটা”। আমার উত্তর শুনে ছেলেটি একদম যেন স্প্রিং এর মত লাফিয়ে উঠলো। খুশীর একটা আতিশয্য দেখিয়ে একটু উঁচু স্বরে বলে উঠলো, “ওহ্ মাই গড। ইউ আর ফ্রম ক্যালকাটা, ফ্রম দ্য হোলি প্লেস অফ মাদার টিরিজা”! ওর সাথে এবার খুশী তো আমাদেরও হতে হলো। ওই যে, আমাদের সেই ক্ষণের অবস্থান ও পরিচিতি আমাদের একটা গর্বের কারণ হয়ে উঠেছিল।

ছেলেটা কিন্তু আলোচনা বন্ধ করলো না। জিজ্ঞেস করে বসলো, “ডু ইউ নো হোয়্যার মাদার টিরিজা ওয়াজ বর্ন”? ওকে খুশী করার জন্যে বললাম, “এই তো তোমাদের দেশেই”। একটু থেমে ছেলে’টা বললো, “নো, শী ওয়াজ বর্ন ইন মেসিডোনিয়া। বাট, ইউ আর রাইট। উই বোথ আর ফ্রম সেম কান্ট্রী ইওগোস্লোভিয়া আরলিয়ার”। বুঝলাম ওর কোনো পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। ওকে সোজা বুঝিয়ে বললাম, “দেখ ভাই, কাল সকালেই আমরা লন্ডন চলে যাবো। ম্যাপে দু-তিনটে জায়গা দেখিয়ে বললাম, এগুলো দেখা এখনও বাকি আছে। তা’ছাড়া আমাদের মেয়ের জন্যে তোমাদের বিখ্যাত সোরস্কি (swarovski) থেকে একটা নেকলেস কিনতে সামনের ওই শপে যেতে হবে। আমাদের এখন শান্ত হয়ে অপেরা দেখার মুড বা সময় কোনোটাই নেই। কিছু মনে করোনা ভাই”। হয়তো আমার কথায় চিঁড়ে ভিজলো। বললো, “ওকে, ক্যারি অন্। নাইস মিটিং ইউ। টেক কেয়ার আ্যন্ড ভিজিট এগেইন”। একটু খারাপ লাগলেও আমরা ওকে বিদায় জানিয়ে আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশে পা বাড়ালাম। সত্যিই সোরস্কিতে যাওয়ার ছিল।
দেখো, কোথায় কোলকাতা, কোথায় ভিয়েনার অপেরা আর কোথায় আমরা ও মাদার টেরেসা। সকলেরই কিন্তু তাদের নিজেদের অবস্থান দিয়েই নিজের নিজের পরিচিতি।

*******

পরিস্থিতি আট! অবস্থান লন্ডন।

যে ঘটনার কথা এখানে লিখতে বসেছি, সেই ঘটনাস্থল হলো লন্ডনের লিসেস্টার স্কোয়্যার। যে বিষয়টি নিয়ে ক’দিন ধরে আমি একটু চেষ্টা করে যাচ্ছি, এখানে সেই অবস্থান ও পরিচিতি’র ঘটনা’টা সব মিলিয়ে হয়তো এক ঘন্টারও নয়, তবে আমাদের অবস্থান’টা যে হেতু লন্ডনের মতো একটা শহরে, কথা প্রসঙ্গে বেশ কিছু বাড়তি কথা এখানে এসেই যাবে, এড়ানো যাবে না, মাফ করবেন।

আমি খুব যে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছি তা’ কিন্তু নয়। তবুও দেশের মধ্যে মুম্বাই, দিল্লি, কোলকাতা, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, গোয়া আদি থেকে বিদেশের এই লন্ডন, প্যারিস, ফ্র্যাঙ্কফুর্ট, আমস্টার্ডাম, ইস্তাম্বুল, দুবাই, সিঙ্গাপুর, সিডনি, মেলবোর্ন আর এদিকের ঢাকা, কলম্বো এমন কি করাচিও একটু ঘুরে এসেছি। আমার দেশপ্রেম’কে মাথায় রেখেই বলছি, এইসব শহরের মধ্যে লন্ডনের মতো প্রানবন্ত শহর আমি কোথাও খুঁজে পাইনি। লন্ডন আমার খুব প্রিয় শহর, এই শহরে একটা ভায়াব্রেশন আছে, আমার খুবই ভালো লেগেছিল। সুযোগ হলেই আবার যেতে চাইবো।

তার কারণ’টা ঠিক কি, আমি বিশেষভাবে বলতে পারবো না, বোঝাতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে, তবে সব মিলিয়ে ‘আই লাভ লন্ডন’। অবশ্য একটা কারণ, যেটা হতে পারে, সেটা হলো, আমাকে কর্মসূত্রে বেশ কয়েকবার সেখানে যেতে হয়েছিল। সেই কুয়েতে থাকাকালীন আমাদের কোম্পানি একটা জাপানি কোম্পানির সাথে জয়েন্ট-ভেঞ্চারে দুটো সূয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কাজ করেছিল দোহায়, কাতারে। দুটো কাজেই এমনই কন্ট্র্যাকচূয়াল ডিসপিউট হলো যে দুই পক্ষকে কন্ট্র্যাক্ট অনুযায়ী আরবিট্রেশনে যেতে হলো লন্ডনের ইন্টারন্যাশান্যাল কোর্ট অব আরবিট্রেশনে। আমি ছিলাম তারমধ্যে একজন উইটনেস, কারণ আমি দুটো কাজেরই ‘টেন্ডার ও প্রপোজ্যাল’ এর দায়িত্বে ছিলাম। সে এক নতুন উপলব্ধি হয়েছিল। ডকুমেন্ট তৈরি থেকে শুরু করে, মিটিং, ট্রেনিং, মক-কেসের ইন্টারোগেশন, কোর্টে লাইভ কেস দেখতে যাওয়া, আমাদের ল’ইয়ারের উপদেশ শোনা আর সব শেষে উইটনেস বক্সে বসে বিবাদী পক্ষের উকিলের জেরার উত্তর দেওয়া। লিখতে বসলে আর একটা অধ্যায় হয়ে যাবে।

তবুও এখানে একটা অভিজ্ঞতার কথা না লিখে পারছি না। সেদিন আমাদের ট্রেনিং এর প্রথম ক্লাশ। অফিসের একটা ঘরে আমরা প্রায় জনা’দশেক বসে অপেক্ষা করছি। নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের ট্রেনার এক মহিলা এসে সকলকে ওয়েলকাম করে নিজের পরিচয় দিলেন এবং আমাদের সকলের পরিচয় নিলেন। তারপরে একটা ব্রিফিং দিলেন, কি ভাবে কোর্টে আরবিট্রেশনের কাজ চলে আর আগামী তিন দিনে কি ভাবে উনি আমাদের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তৈরি করবেন। সেই সময় সকলের চোখ মুখের চেহারা দেখে বুঝেছিলাম, শুধু আমার নয়, সবটাই আমাদের সকলের সিলেবাসের বাইরে। তারপর শুরু করলেন, “টুডে আই উইল টেল ইউ এবাউট ডু’জ এন্ড ডোন্টস ডিউরিং লিগ্যাল ইন্টারোগেশন। দ্য ফার্স্ট আ্যন্ড দ্য ফোরমোষ্ট ইজ ‘নেভার টেল এ লাই, ইভন্ ইওর রেসপন্স গোজ এগেনস্ট ইউ’। লাইজ আর অলওয়েজ কট এন্ড ইট গোজ এগেনস্ট ইওর উইটনেস আ্যট দ্য এন্ড”। নতুন কিছু কথা নয়, দেখেছি সাক্ষী ধর্মগ্রন্থে হাত রেখে সত্যি বলবার শপথ নেয়, তবুও তারা মিথ্যে কথা বলে। কোনও এক পক্ষের সাক্ষী তো মিথ্যা সাক্ষ্য দেবেই। কিন্তু ইনি তো দেখছি সিরিয়াসলি সত্যি কথাই বলতে বলছেন। একটা জানা কথা নতুন ভাবে শুনলাম, শুধু তাই নয়, অনুধাবনও করে নিলাম যেন কোনো ভাবে এই ভুলটা আমার না হয়। আরও একটা উপদেশের কথা মনেপড়ে গেল। বলেছিল, “প্রশ্ন যেই করুন না কেন, উইটনেস বক্সে বসে, সবসময় উত্তর’টা কিন্তু দেবে প্রশ্নকর্তাকে নয়, জাজ এর চোখের দিকে তাকিয়ে”। কথাটা শুনে খুব সোজা মনে হলেও, আসলে বেশ কঠিন। প্রশ্ন শুনছি একজনের কাছ থেকে অথচ উত্তর দিচ্ছি আর একজনকে।

যাই হোক, দু’টো কেসের জন্যে প্রায় বছরখানেক ধরে বেশ কয়েকবার লন্ডনে যেতে হয়েছিল। দশ-বারো জন কলিগদের সাথে, একটা আন্তর্জাতিক ল’ইয়ার ফার্মের বড়সর অফিসে বসে কাজ করে, বেশ কিছু ভালো হোটেলে রাত্রিবাস করে আর প্রতিদিন নিত্য নতুন সাহেবী খাবার টেষ্ট করে, তখন সন্ধ্যার অবসরের এবং সপ্তাহান্তের সময়গুলো বেশ ভালোই কেটেছিল। এইসবের জন্যেই হয়তো লন্ডন’কে আমার একটু বেশিই পছন্দ হয়।


এই ঘটনা সেই সময়ের কোনও একদিন ঘটেছিল। আমি আর আমার এক ভারতীয় সতীর্থ, সেদিন ফ্রী ছিলাম। একটা কেসের শুনানিতে আগের দিন আমাদের দুজনেরই সাক্ষ্য দেওয়া শেষ হয়ে গেছিলো। হাতে আর কোনও কাজ নেই। দু’দিন পরেই দোহায় ফিরবো। হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে, অফিসে না গিয়ে দু’জনে মিলে একটা লন্ডন-ট্যাক্সি’ ডেকে বেরিয়ে পরলাম। লন্ডনের ‘আন্ডার-গ্রাউন্ড’ (মেট্রো রেল) নেটওয়ার্কের সুবিধা বলাই বাহুল্য। তবুও সময় আর চিন্তা বাঁচাতে আমরা ট্যাক্সিই নিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো লন্ডনের বিখ্যাত ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম’টা দেখে, লিসেস্টার স্কোয়্যার যাবো। এর আগে অনেক সন্ধ্যেয় আমরা দলবেঁধে এখানে এসে ডিনার করে গেছি। বেশ মজার জায়গা এই লিসেস্টার স্কোয়্যার। এখানকার ওডিয়ন সিনেমা তো বিশ্ব বিখ্যাত। অস্কারজয়ী এমন কোনো সিনেমা বোধহয় নেই যার প্রিমিয়ার শো, এখানে হয়নি। লন্ডনের মোটামুটি মধ্যিখানের এই স্কোয়্যারের আসেপাশে বিখ্যাত কুখ্যাত কি যে নেই, বলা মুশকিল। এটা লন্ডনের পর্য্যটকদের জন্যে খুবই জনপ্রিয় একটা জায়গা, ডিটেলে যাচ্ছি না। ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম’টা দেখে এসে, এখানে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দিনের বেলায় এই জায়গাটা একটু ঘুরে দেখা, একটু শপিং করা, বিশেষতঃ কিছু সুভেনিয়ার আর স্বভাবতই লাঞ্চ করা। আমাদের জনা’কয়েকের আলোচ্য অবস্থানের সঙ্গম এইখানেই আমাদের আলোচনার মাধ্যমেই ঘটেছিল। সেই প্রসঙ্গেই এখন আসবো।

কি বলে এদের’কে, ‘স্ট্রীট-আর্টিস্ট’? না কি এদের অন্য কোনও বিশেষ নাম আছে? আমাদের নজরে পড়লো, এই স্কোয়্যারের ক’য়েক পা দূরে অপেক্ষাকৃত একটু ফাঁকা, ঠিক ফুটপাত বলবো না, উঠোনে (courtyard) একটা টুলে বসে, হাতে একটা ছোট ড্রইংবোর্ড নিয়ে একজন ছবি আঁকছে তার সামনে আর একটা টুলের ওপর বসে থাকা এক পর্য্যটকের। খুব যে একটা নতুন কিছু, তা’ কিন্তু নয়। আমরা এরকম তো আমাদের দেশের টুরিস্ট স্পটে কখনো দেখেছি। কেউ ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে টুরিস্টদের ছবি তুলে দেওয়ার জন্যে। এখন না হয় মোবাইলের দৌলতে সেটা অনেক কমে গেছে। কেউ একা, এমন কি কোনও আর্ট কলেজের ছাত্রদেরও এদিকে ওদিকে বসে ছবি আঁকতে দেখেছি। দু’এক জন এরকমও দেখা গেছে, যারা এই রকম টুরিস্টদের সামনে বসিয়ে তাদের পোট্রেট এঁকে দিচ্ছে, বিনিময়ে কিছু পারিশ্রমিক। শুধু ইচ্ছা আর সময় থাকতে হবে।

আমাদের তখন দুটোই ছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমরা ওর আঁকার হাত কেমন বোঝার চেষ্টা করছিলাম। দেখলাম ওই মডেল পর্য্যটকের মুখ আর তার ছবি বেশ মিলে যাচ্ছে। আমার বন্ধুর আগ্রহ একটু বেশিই ছিল। বোধহয় বিদেশে বলে, একটা স্মৃতি সাথে করে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। আমারও যে সেরকম ইচ্ছে একটু হচ্ছিলো না তেমনও নয়। এই তো আজ লিখতে বসে এতদিন পরেও আমি ভাবছি তার স্কেচ্ করা আমার সেই পোট্রেট’টা কোথায় রেখেছি। যাই হোক পাশেই রাখা তার একটা ড্রইংবোর্ডে দেখলাম টাঙ্গানো আছে নানা ধরণের স্কেচের রেট আর তার চারিদিকে স্বল্প পরিসরে বিভিন্ন সাইজের, সাদা-কালো, রঙ্গিন, পেন্সিলের, রং-তুলির নানা ধরনের স্কেচ্ রাখা আছে, স্যাম্পল হিসেবে। কয়েকটা ছবি আবার ব্যাকগ্র্যাউন্ডের সাথে, যার রেট আবার একটু বেশি। আগের ভদ্রলোক তার ছবি নিয়ে, দাম মিটিয়ে চলে গেলেন। এবার আমাদের পালা।

“হ্যালো, আই আ্যম ড্যানিয়েল। প্লীজ কাম এন্ড সীট হিয়ার টেন মিনিট, আই ড্র এ নাইস পিকচার ফর ইউ”। কথা শুনে বুঝলাম ও এখানকার ইংরেজ নয়। আমার সহকর্মী সুশীল, কেরালার ছেলে, পেশায় আ্যকাউনটেন্ট আর পারিবারিক ব্যবসা হলো মাছের রপ্তানি। তাই টাকার মূল্য ভালোই বোঝে, বিশেষ করে যখন পাউন্ড বলে কথা। বললো, “উই ওয়ান্ট টু সীট ফর এ স্কেচ্, বাট্ ইয়োর রেট ইজ ভেরি হাই”। “নো নো, নট হাই। হোয়াট সাইজ, ইউ ওয়ান্ট”? বন্ধু বললো, “উই নোটিশড্, ইউ আর এ ভেরি গুড আর্টিস্ট। উই নিড সিম্পল স্কেচেস ড্রওন উইদাউট এনি ব্যাকগ্রাউন্ড ইন এ-থ্রী সাইজ”। ও সময় নষ্ট না করে বললো, “ওকে, কাম। পে মি টেন পাউন্ড ফর টু পেন্সিল স্কেচেস আপ টু ইওর চেষ্ট”। জিজ্ঞেস করলো, “নর্ম্যাল অর কার্টুন? হোয়াট ইউ লাইক”? আমরা বললাম, “বোথ কার্টুন টাইপ”। প্রথমে সুশীল নিজেই বসে পড়লো। শিল্পী ওকে একটু নির্দেশ দিলো, কি ভাবে বসতে হবে। সুশীল কে ওই ভাবে দেখে, আমি মনে মনে ভাবলাম, এই চাতালে এত লোকের আনাগোনার মধ্যে ওই ভাবে বসলে আমাকে তো এমনিতেই কার্টুন মনে হবে। নিজের দেশ হলে এভাবে ফুটপাতে বসে কাউকে আমার ছবি আঁকতে বলতাম? মনে তো হয় না। এখানে এই অবস্থানে আমার পরিচিতি শূণ্য। তাই কে কি ভাবলো সেই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, লোকটা কি ভাবে স্কেচ’টা বানাচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বন্ধুর মুখটা ড্যানিয়েলের বোর্ডের উপর একটা কার্টুন চরিত্রে রূপান্তরিত হলো। মাঝেমধ্যে পর্য্যটকরাও দাঁড়িয়ে পড়ে এইসব কান্ড দেখছিল। ফিনিশিং টাচ্ শেষ হলে দেখলাম সুশীলের কার্টুন ভালোই বানিয়েছে, বেশ ফানি। এবার আমার টার্ন, খুশি মনে আমি বসলাম যেভাবে আমাকে বলা হলো। বললো, “জাষ্ট টেন মিনিট”। তবে দশ নয়, মিনিট পনেরো তো লেগেছিল। আছে কোথাও সেই ছবিটা, খুঁজে পেলে নিশ্চয়ই শেয়ার করবো।

ভদ্রলোক একটু শান্ত প্রকৃতির মনে হলো। দুটো খামে ভরে স্কেচ্’দুটো আমাদের দিয়ে দিলেন। আমরা পাঁচ পাউন্ড করে ভদ্রলোক’কে দিয়ে বললাম, “থ্যাংক ইউ”। জিজ্ঞেস করলো,”ইউ লাইক দেম? গুড্”? সম্মতি জানালাম, “ইয়েস ভেরি মাচ্”। মজা করে বললাম, “আই শ্যাল শো ইট টু মাই ওয়াইফ। শী উইল বি হ্যাপি টু সী মি ইন দিস কার্টুন ক্যারেক্টার”। তখনও তার কাছে নতুন খদ্দের আসেনি। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি রোজ এখানে বসে টুরিস্টদের স্কেচ বানাও?” বললো, “হ্যাঁ, তবে খুব বেশী টুরিস্ট ছবির জন্যে বসে না”। জিজ্ঞেস করলাম, “চারিদিকে এই যে স্কেচ, পেন্টিং রেখেছো, এগুলো কি তোমার আঁকা”? বললো, ‘হ্যাঁ, যখন কাস্টমার থাকে না, তখন এসব বানাই”। দেখলাম ভালই হাত, সব ছবিই বেশ লাইভ। যেখানে বসে কাজ করছিল, তারই আশেপাশের বেশ কিছু ছবিও ছিল। রেখেছিলও সেই ভাবে দিক মিলিয়ে, যাতে আসল জায়গার সাথে তার আঁকা ছবিগুলো রিলেট করা যায়। সুযোগ বুঝে সে আমাদের জিজ্ঞেস করলো, “দু-একটা ছবি নাও না, আমার একটু সাহায্য হবে”। কথাটা আমাদের কানে বেমানান লাগলো, সাহায্য কেন বলছে? সুশীল বললো, “সাহায্য কেন বলছো? এটা তোমার কষ্টার্জিত আয়। তোমার ট্যালেন্ট আছে। কিন্তু আমরা এখানে কোম্পানির কাজে এসেছিলাম, তোমার পেন্টিং কেনার মত তৈরী নই। কিছু মনে করো না”। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটাই কি তোমার প্রফেশন? তুমি এমনিতে কি করো”?

আমি বোধহয় ওর কোনো নরম জায়গায় আঘাত করে ফেলেছিলাম। একটু সময় নিয়ে নিজের ছবিগুলো একটু রি-শাফল্ করলো। তারই মধ্যে থেকে, ওর নিজেরই আঁকা একটা ছোট ফ্রেম-বন্দী এক তরুণীর ছবি বের করে আমাদের দেখিয়ে বললো, “মাই ফিঁওসে, এমিলি”। এবার সময় আমাদের নেওয়ার পালা। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, ব্যাপার’টা কি? ও নিজেই যা বললো, সেটা এইরকম। “আমি একজন রুমানিয়ান, একটা আর্ট-স্কুলের পাশ-আউট, ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট, আমার বাড়ি বুখারেস্টে। আমি ওখানে পার্টটাইম ট্যুরিস্ট-গাইডেরও কাজ করি। এক সামারে, স্কুলের এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে এমিলি লন্ডন থেকে বুখারেস্টে আমাদের স্কুলে এসেছিল এক মাসের জন্যে। আউটডোর ল্যান্ডস্কেপিং এর ট্রেনিং এ আমরা একই গ্রুপে এক্সকারশনে যেতাম। আমার সঙ্গে তখন ওর আলাপ হয়েছিল। দেন উই ফেল ইন লাভ। বাট শী ইজ এ বৃটিশ গার্ল। প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা। একমাস পরে ও লন্ডনে ফিরে এসেছিল, কিন্তু আমরা সুযোগ পেলেই দেখা করতাম, একসাথে থাকতাম। কখনো আমি এখানে চলে আসতাম আর কখনো এমিলি বুখারেস্টে যেত। শী ইজ এন আর্ট টিচার ইন এ প্রাইমারি স্কুল হেয়ার। এমিলি হ্যাজ হার হোম হেয়ার ইন লন্ডন আ্যন্ড মাইন ইন বুখারেস্ট। কস্ট অফ লিভিং ইন লন্ডন ইজ ভেরি হাই। আই হ্যাভ নো সিকিওরড জব হেয়ার। এমিলি জাস্ট ক্যান নট লিভ হার জব টু স্টে উইথ মি ইন বুখারেস্ট আইদার, আ্যন্ড সেম ফর মাই সিচ্যুয়েশন অলসো। সেই জন্যে লন্ডনে থাকলে আমি এইভাবে কাজ করে কিছু ইনকাম করে নিই, টু মিট দ্য এন্ডস। এ ভাবেই চলছে আমাদের জীবন। জানিনা কবে আমরা পারমানেন্টলি একসাথে থাকতে পারবো, টু সেটল ডাউন”।

এক নাগাড়ে ড্যানিয়েল কথাগুলো বলে গেল আর আমরা অবাক হয়ে শুনে গেলাম। নিজের মুখে তারই একটা সুন্দর প্রেমের সত্যি গল্প। ওর মুখে একটা হাসির ছোঁয়া থাকলেও ওর গলায় কোথায় যেন একটা বিষাদের সুর শুনতে পেলাম। বুঝলাম এবং শিখলাম, জীবন সুখের বানাতে হলে পরিস্থিতি ও অবস্থানের সঙ্গেও কিছু আপষ খুশি মনে মেনে নিতে হয়। জানিনা হঠাৎ কেন ড্যানিয়েল এভাবে স্বতস্ফু্র্ত হয়ে আমাদের কাছে তার প্রেমিকা এমিলির সাথে তাদের সাম্প্রতিক জীবনের ছবি তুলে ধরলো। কাজের পরেও আমরা তার পার্সোন্যাল দৈনন্দিন রুটিনের কিছু কথা জানতে চেয়েছিলাম, যা হয়তো কেউ কোনও দিনও চায়নি, তাই হয়তো আমাদের ওপরে তার কনফিডেন্স লেভেল’টা একটু বেড়ে গেছিলো! ঠিক বলতে পারবো না, তবে সেই সুদূর লন্ডনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনও এক অচেনা রুমানিয়ার শিল্পীর সাথে আমাদের মতো দোহায় কর্মরত ভারতীয়দের সাথে এরকম একটা আন্তরিক কথপোকথন হবে সেটা আশা করিনি। দেখলাম জনা’চারেক মহিলার একটা দল এসে তার স্কেচ্ গুলো দেখতে লাগলো। আমরা তাই ড্যানিয়েল’কে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানিয়ে সুভেনিয়ার শপের দিকে এগিয়ে গেলাম।
মনে গেঁথে গেছে সেদিনের এই ছোট্ট ঘটনা’টা।

********

অবস্থানের সাথে পরিস্থিতি এবং পরিচিতি নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। আপাতত এখানেই শেষ করা যাক্। পরে কোনোদিন এই রকম আরও কোন ঘটনা বা কথোপকথনের সম্মুখীন হলে, আবার লিখে জানাবো। পাঠকদের মধ্যে অনেকেরই এইরকম নানা ধরণের অভিজ্ঞতা আছে। আমি আশা করবো তাঁরাও যেন সেই সব ঘটনা আমাদের সাথে ভাগ করে নেন।

সমাপ্তি।

Sahityika Admin

Add comment